আগেও জলাধার সংরক্ষণে আইন ছিল, এবং ছিল ড্যাপের মতই অকার্যকর


চিন্তা প্রতিবেদক
Monday 23 August 10

প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকারেই উল্টা সুর, জলাধার সংরক্ষণ হবে কিভাবে?

পরিকল্পনাটার প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় দুই হাজার চাল সালে, আর তারও চার বছর আগে জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ বলে পরিচিত আইনটা পাশ হয় জাতীয় সংসদে। ওই আইনে বলা হয়েছে, মাস্টার প্লানে ও ভূমি জরিপ নকশায় যেটাকে উদ্যান বা পার্ক হিশাবে চিহ্নিত করা হয়েছে কিংবা সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা যেটাকে উদ্যান বা পার্ক হিশাবে ঘোষণা করা হয়েছে সে স্থানই হবে উদ্যান। খোলা জায়গা হল, মাস্টার প্লানে উন্মুক্ত স্থান হিশাবে শনাক্ত বা সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উন্মুক্ত স্থান হিশাবে ঘোষিত এমন স্থান যা দীর্ঘদিন হতে ঈদগাহ বা অন্য কোনভাবে জনসাধারণ কর্তৃক ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘প্রাকৃতিক জলাধার’ বলতে নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝর্না বা জলাশয় হিসাবে মাস্টার প্লানে শনাক্ত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোন সংস্থা কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যা প্রবাহ এলাকা হিশাবে ঘোষিত কোন জায়গা, পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আইনটি পাশ হওয়ার সময় ঢাকা মহানগরীর একটা ‘মাস্টার প্লান’ ছিল। উনিশশ পঁচানব্বই সালে নেয়া ওই মাস্টার প্লানের নাম ছিল, ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি)। কিন্তু কোন আইন-কানুনই আবাসন ব্যবসায়ীদের দখলদারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ--আইন পাশ হচ্ছে--কিন্তু সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। এবং আইন করার যে আসল উদ্দেশ্য--জলাধার সংরক্ষণ করা, পরিবেশ রক্ষা করা এবং বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলা--এর ফলে সেটাই পুরা ভেস্তে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কোন নাগরিকই আইনের উর্ধ্বে হতে পারে না। কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীরা কোন আইনেরই তোয়াক্কা করছে না।

জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০

আইনটার পুরা নাম হল ‘মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলা খবরে উদ্ধৃতি দেয়ার সময় এই নামটাকে সংক্ষেপে ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ লেখে। ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আইনটা প্রাকৃতিক জলাধার, খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, উদ্যান সংরক্ষণ করতে পাশ করেছে সরকার। কোন কোম্পানি বা ব্যক্তি এ আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান জারি করা যাবে এ আইনের বিধান অনুসারে। দুই হাজার সালে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ করে। পরিবেশ বাঁচানো এবং বাসযোগ্য হিসাবে মহানগর, বিভাগীয় শহর ও পৌর এলাকা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আইনটি তৈয়ার করা হয়।

বেআইনি দখল

আইনের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে ‘এই আইনের বিধান অনুযায়ী খেলার মাঠ, খোলা জায়গা, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে শনাক্ত জায়গার ‘শ্রেণী পরিবর্তন’ করা যাবে না।’ এখানে ‘শ্রেণী পরিবর্তন’ বলতে বুঝায়, এ আইন অনুযায়ী চিহ্নিত করা জায়গাগুলা কেউ জনস্বার্থ বিরোধী হয় এমন ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। ভাড়া, ইজারা তো না-ই, হস্তান্তর করাও নিষেধ করা হয়েছে আইনটিতে। অথচ এরকম জমি বেআইনিভাবে দখল করে আবাসন ব্যবসায়ীরা প্লট ব্যবসা সহ বাড়ি বানিয়ে ফ্ল্যাট বাণিজ্য করে যাচ্ছে দেদারছে। এর সাথে ‘জনস্বার্থ’ কথাটার বিন্দু মাত্র কোন আইনি সম্পর্ক নাই। অথচ আবাসন ব্যবসায়ীদের দখল করা জমি কোন অজুহাতেই জায়েয করার সুযোগ নাই। তারা এখন দাবি করছে, নব্বই সালের দিকে জাপানি সংস্থা ‘জাইকা’ একটা জরিপ করে। সেই পুরানা জরিপের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ পর্ষদ সংশোধন এনেছে। গত দশ-বারো বছরে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার ভেতরে যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, পর্যবেক্ষণ পর্ষদ তা বেমালুম ভুলে গেছে। তারা এসব আমলে না নিয়েই ইচ্ছামত সংশোধন করেছে। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করে আবাসন ব্যবসায়ীরা যে বসতবাড়ি বানিয়েছে, সংশোধনগুলাতে তার কোন উল্লেখ নাই।

অবৈধ দখলে শাস্তির বিধান

পাঁচ নম্বর ধারার এই আইন কোন ব্যক্তি বা কোম্পানি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করা হয় আট নম্বর ধারায়। কোন ব্যক্তি এই আইন লঙ্ঘন করলে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত করা হবে। আটের দুই উপ-ধারায় বলা হয়েছে, পাঁচ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করলে কর্তৃপক্ষ নোটিশ দ্বারা জমির মালিককে, অথবা বিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে বাধা দিতে পারবে। বেআইনি নির্মাণকাজ ভেঙে ফেলতে পারবে। ভেঙে ফেলার পর কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না। আটের তিন নম্বর উপ-ধারা অনুসারে এই রকমের যেকোন নির্মাণকাজ ও অবকাঠামো তৈরি হলে আদালতের আদেশে তা বাজেয়াপ্ত হবে। এইসব আইন অনুযায়ীই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) সকল প্রাকৃতিক জলাধার, খোলা জায়গা ও বন্যা প্রবাহ অঞ্চল বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু সেসব এলাকায় আবাসন কারবারিরা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে জমি দখল করে নেয়। এখন দখলকারীদের শায়েস্তা করতে অন্য কোন উপায়ের দরকার হয় না। প্রজ্ঞাপন জারি করার পর সাত মন্ত্রণালয়ের পর্ষদ গঠন করে নতুন করে পর্যালোচনার দরকার পড়ে না। এই আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিলেই যথেষ্ট। অথচ আবাসন ব্যবসায়ীরা এভাবে অবৈধ নির্মাণ ও জমি দখল করার পরও সরকারের তরফে ব্যবস্থা নেয়ার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। উল্টা মন্ত্রীশুদ্ধ তাদের দ্বারা নাজেহাল হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

কোন কোম্পানি এই আইন লঙ্ঘন করলে

এ আইনের এগারো নম্বর ধারাটি হল কোন কোম্পানি আইন লঙ্ঘনকারী হলে কাদের দায়ী করা হবে সে ব্যাপারে। কোম্পানি বলতে কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সমিতি ও সংগঠনকে বুঝাবে। ধারাটিতে বলা হয়েছে--কোম্পানির মালিক, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব বা অন্য কোন কর্মকর্তা অথবা এজেন্ট বিধান লঙ্ঘন করেছে বলে ধরে নেয়া হবে। এই কর্মকর্তারা তখন অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হবেন। এবং তাদের বিরুদ্ধে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তারা যদি প্রমাণ করতে পারেন এ লঙ্ঘন তাদের অজ্ঞাতসারে হয়েছে। অথবা তারা লঙ্ঘন ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, তাহলে তারা অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে, আইনটির এই সুযোগটুকু তারা তাদের বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে পার পাওয়ার উপায় হিসাবে ব্যবহার করছে।

‘পৃথিবীতে চূড়ান্ত বলে কিছু নাই’

ঢাকায় বসবাসকারী সবার সহযোগিতা, মতামত, জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ, আপত্তি-অনাপত্তি নিয়েই তারপর ড্যাপ বাস্তবায়ন করা হবে--কথাটি বললেন বর্তমান সরকারের গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী। আবাসন ব্যবসায়ীরা তাকে যারপরনাই অপদস্ত করে। এ ঘটনার পর বাইশ জুন মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদন দিয়ে সরকার ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করেন। যা ছিল সত্যিকার অর্থে একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সবার মনে হয়েছিল এতদিনে বোধহয় অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মের কাছে পরাস্ত না হয়ে সরকার আত্মমর্যাদা রাক্ষা ও জনস্বার্থর প্রতি অনড় অবস্থান নেবার সূচনা করল। কিন্তু সে আশা অল্পতেই মিলিয়ে গেল। কি এক রহস্যময় কারণে উল্টা সুর ধরলেন! সাতাশ জুন প্রধানমন্ত্রী ড্যাপ চূড়ান্ত করতে সাত মন্ত্রণালয়ের একটা পর্ষদ গঠন করেন। গত চার জুন গণপূর্তমন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই পর্ষদের প্রথম বৈঠক হয়। সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বাইশ জুন প্রজ্ঞাপনে প্রকাশিত ড্যাপ চূড়ান্ত থাকবে কি-না সাংবাদিকদের এরকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীতে চূড়ান্ত বলে কিছু নাই। অর্থাৎ আবাসন ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের মত-অমত ও স্বার্থের খেলাপ বা বেখাপ্পা যা কিছু আছে সেটা পরিবর্তন করেই আবার ড্যাপ তৈরি করা হবে।এই হল চির পরিবর্তনশীলতার আসল মাজেজা।

View: 6968 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD