রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা খাতের বাণিজ্যিকীকরণ


রোকেয়া বেগম
Sunday 26 September 10

সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি আরোপ করে চিকিৎসা সেবার সুযোগ কেড়ে নেয়া হচ্ছে

 চিকিৎসা সেবার মত মানবিক মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুনভাবে ধার্য করা ইউজার ফির নামে চিকিৎসা সেবার সুযোগ সংকুচিত করছে। ফলে দেশের গরিব মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার যে ন্যূনতম সুযোগ ছিল তা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। ১৯৯৪ সাল থেকে সরকারি হাসপাতালের স্ব স্ব বিভাগ থেকে আদায় করা ইউজার ফি’র ৫০ ভাগ সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন হয়ে আসছে।

২০০৯ সাল থেকে আবার নতুন করে সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি (সেবার বিনিময়ে আদায়যোগ্য অর্থ) আদায়ের কথাটি শোনা যায়। রোগীর কাছ থেকে আদায় করা টাকা (ইউজার ফি) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলার সব বিভাগের চিকিৎসক নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে কর্মচারীদের কাজের প্রতি উৎসাহ দেখা দেয়। ৬০ ভাগ ইউজার ফি পাবেন উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। কিন্তু এই বণ্টনের হার নিয়ে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতদিন সরকারি হাসপাতালে ঝুঁকি ভাতা হিশাবে ডায়াগনস্টিক টেস্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ইউজার ফি’র ৫০ ভাগ পেতেন।

২০০৯ সালে ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় ইউজার ফি বণ্টন অবৈধ আখ্যায়িত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বণ্টন কার্যক্রম বন্ধ করে সব টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। অভিযোগ ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ইউজার ফি বণ্টন হয়ে আসছে। স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত এক সভায় স্বাস্থ্য অধিকার কর্মীরা এ ধরনের বাণিজ্য বন্ধের বিরুদ্ধে জনআন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় মানববন্ধন করার। ইউজার ফির নামে অর্থ আদায়ের প্রতিবাদে স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১০ জুলাই, ২০১০ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সকাল ৯.৩০-এ এক মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।

মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন, স্বাস্থ্য আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক ফরিদা আখতার, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) থেকে শামসুজ্জোহা, উদয় চট্টোপাধ্যায়, ডাব্লিউ বিবি ট্রাস্ট এর নাজমুল করিম, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে লিপিকা আক্তার, খাদিজা বেগম, টিটু বড়–য়া, উবিনীগ থেকে সীমা দাস সীমু, আনোয়ার হোসেন, রজব আলী, মুন্নী খানম, নবপ্রাণ আন্দোলন থেকে রোকেয়া বেগম, শ্রমবিকাশ কেন্দ্র থেকে শাহীনুর বেগম, বাঁচতে শেখ নারী থেকে ফিরোজা বেগম, গার্মেন্ট শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন থেকে শবনম হাফিজ, মুক্ত শিশু ও নারী সংঘ ফোরাম থেকে লাভলী ইয়াসমিন।

মানববন্ধনে স্বাস্থ্য আন্দোলনের সদস্যরা ছাড়াও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কর্মীরা মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন এবং বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বলেন জনগণের টাকায় হাসপাতালগুলো পরিচালিত হয়--চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান, নার্স ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদান করা হয়। এ সকল ব্যক্তিদের শিক্ষার খরচও জনগণের অর্থ হতে যোগান দেয়া হয়। জনগণের সেবার জন্য এসকল ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় হাসপাতালে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু জনগণ হতে সুবিধা ভোগ করে প্রজাতন্ত্রের সেবকগণকে জনগণের সাথে অনৈতিক বাণিজ্যে নিয়োজিত করা উচিত না।

জনগণের টাকায় পরিচালিত হাসপাতালগুলো ইউজার ফি নামে এ ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ অসাংবিধানিক। এ প্রক্রিয়া মানুষকে জিম্মি করে ফেলবে। একদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য বাণিজ্য এবং অপর দিকে রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি’র ব্যবস্থা মানুষের চিকিৎসা সেবার অধিকার হরন করবে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের অর্থে পরিচালিত সেবা প্রতিষ্ঠানে এধরনের বাণিজ্যিক ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। দেশের সংবিধান ও মানুষের অধিকার রক্ষার স্বার্থে সরকার, সচেতন রাজনৈতিক মহলসহ প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ প্রক্রিয়া বন্ধে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিকার কর্মীরা হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি’র নামে বাণিজিকীকরণ বন্ধে সারা দেশে অব্যাহত আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের বক্তব্য

ছালমা বেগম তার স্বামীর চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার স্বামীর চিকিৎসার জন্য তিনি একটি গরু, একটি ছাগল বিক্রি করেও সুস্থ করে তুলতে পারছেন না। ছালমার মেয়ে তার বাবার চিকিৎসার খরচ যোগাতে তার ২ সেট জামা কাপড় ছিল সেই জামা কাপড় বিক্রি করে বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করছে। ছালমা বলেন, হাসপাতালে রোগীর জন্য বালিশ পর্যন্ত নাই। মরা রোগীর বালিশ এনে দেয় রোগীকে। ভাত তরকারি ঠিক মত দেয়া হয় না। তরকারি চাইলে বলে ২০ টাকা দেন তরকারি এনে দেব। এক প্লেট ভাত ২০ টাকা নেয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখে দেয় বাহিরে থেকে করার জন্য। বাহির থেকে পরীক্ষা করলে অনেক টাকা লাগে। সরকারি হাসপাতাল কেন বাহির থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি সরকারি হাসপাতালেই বিনে পয়সায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হোক।

পারভীন আখতার ফতুল্লা থেকে এসেছেন তার ছেলের চিকিৎসার জন্য। তিনি বলেন, আমার ছেলের কানের অপারেশন করেছে তারা। এক জায়গার টিকেট অন্য জায়গায় দেখে না। টিকিটের দাম ২০ টাকা। ডাক্তারদের ব্যবহার খুব খারাপ, কিছু জানতে চাইলে ডাক্তাররা কথায় কথায় ঝাড়ি মারে।

আমিনুল ইসলাম বলেন হাসপাতালের পরিবেশ খুব খারাপ; রোগীরা যে পায়খানা ব্যবহার করে সেটা খুব নোংরা। টাইলস দিয়ে করা হয়েছে ঠিকই--কিছুদিন আগেই করা হয়েছে। এখানেও দুর্নীতি হয়েছে কারণ কিছুদিনের মধ্যেই সব ভেঙ্গে গেছে। পরিস্কার পায়খানা ব্যবহার করাও তো স্বাস্থ্যের একটি অংশ।

বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য এসেছেন মানিক। তিনি বলেন, আগে বহির্বিভাগের টিকিটের মূল্য ছিল ১০ টাকা এখন ২০ করা হয়েছে; কিন্তু দিনে দিনে টিকিটের সাইজ ছোট হয়ে গেছে। এই টিকিটে মাত্র তিনটি ওষুধের নাম লিখলেই শেষ হয়ে যায়। আবার নতুন করে টিকিট কাটতে হয়। যতবার আসব ততবার টিকিট কাটতে হয়। এটাও একটা ব্যবসা।

View: 3311 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD