প্রশাসনে দলবাজি এবং সুশীল তৎপরতা


শাহাদাৎ তৈয়ব ও সাইফ শিশির
Sunday 31 October 10

সুশীল সমাজের ‘অভ্যুত্থান’ ক্ষেত্র তৈরি করছে আওয়ামী লীগ

জনপ্রশাসন আর দলীয় বাহিনীর মধ্যে কোনও ফারাক রাখতে চাইছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বর্তমান সরকারে নির্বাহি দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা আর মন্ত্রীরা পরিস্কার ঘোষণা করছেন যে, শুধু দলীয় বিবেচনায় ভিত্তি করে নির্বাহি প্রশাসন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ করা হবে। ফলে পরিস্থিতি এমন নৈরাজ্যকর হয়ে উঠছে যে তাতে পুরা প্রশাসনিক কাঠামো অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় প্রশাসন চলবে সেটাই গণতান্ত্রিক রেওয়াজ এবং আমরাও তা-ই চাই। কিন্তু এখন একদিকে ক্ষমতাসীন দলের হামলা ও অন্যদিকে উল্টা নির্বাহি প্রশাসনকেই সরকারিভাবে দোষারোপ করার ফলে কর্মকর্তারা কোনঠাসা হয়ে বেছে নিচ্ছে ‘সুশাসন’ পন্থীদের। ‘সুশাসন’পন্থী সুশীল সমাজও নতুন করে তৎপর হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলার--বিশেষত মূল দুইটা রাজনৈতিক দলের দৃশ্যমান ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে এর আগে দুই হাজার ছয়ে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতা দখল করেছিল বিদেশী স্বার্থের প্রতিনিধি এই সুশীল সমাজ। সুশীল-সামরিক অভ্যুত্থানে পছন্দসই উপদেষ্টাদের দিয়ে দুবছর ধরে বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চালু রেখেছিল তারা। বর্তমানে নির্বাচিত সংসদীয় শাসনের নামে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রশাসন বানানোর নৈরাজ্য আবার পরিস্থিতি তৈরি করছে আরেকটা সুশীলঅভ্যুত্থানের।

যোগ্য জনবল সমৃদ্ধ প্রশাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে

স্থানীয় নির্বাহি প্রশাসনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সাম্প্রতিক হামলার প্রথম যে খবরটি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পায় সেটা ঘটেছিল নাটোরে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুর ওয়ালিয়া হাকিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে আহত করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। ওই ঘটনায় পূর্বনির্ধারিত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার সাক্ষাৎকার স্থগিত করা হয়।

পাবনার জেলা প্রশাসকের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার ঘটনার মধ্য দিয়ে এধরনের দুর্নীতির ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় চলে আসে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটা নিয়োগ পরীক্ষা চলার সময় পাবনার জেলা স্কুল ও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হামলা চালায়। এতে পরীক্ষা ভেস্তে যায়। পরে ক্ষমতাসীন দলে নেতাকর্মীদের অব্যাহত মহড়া এবং চাপের মুখে স্থানীয় নির্বাহি প্রশাসন অচল হয়ে যায়। তাছাড়া চাপের মুখে একযোগে বদলি আবেদনেরও সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সুশীল সমাজের সাথে এক বৈঠকে জেলা প্রশাসন তাদের প্রতি সরকার দলীয় নেতাদের আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের দেয়া তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় এ হামলা চালানো হয়।

পাবনার ঘটনার দুইদিনের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে পঞ্চগড় সিভিল সার্জন কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগে নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র ও ফলাফলের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এই মৌখিক পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীদের নাম না থাকায় এ হামলা চালায় তারা।

পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধায় ৬৮ টি কনস্টেবল পদে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের আবেদন জানায় জেলা আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ আবেদন জানানো হয়। একই দাবিতে গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘেরাও করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এসময় তারা নিয়োগ কমিটির প্রধান বগুড়ার পুলিশ সুপারকে অবরুদ্ধ করে রেখে বাইরে বিক্ষোভ করে।

২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপালকে লাঞ্ছিত করে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসা

 সরাসরি ঘোষণা দিয়ে নিয়োগ দেয়ার পদ্ধতি এই প্রথমকার ঘটনা। তবে এটা শুধু নিয়োগ দুর্নীতির ব্যাপারেই সত্য না, সমস্ত খাতেই এখন প্রায়ই সরাসরি এই অবস্থা জোরদার হয়েছে। পাবনার ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি শুধু দেশব্যাপী আলোচনায় আসতে সুযোগ তৈরি হল। এই ঘটনার বেশ আগেই পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্রসেনের এক বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি তার নিজ এলাকার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রশাসনে দলীয় লোকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেককেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের প্রক্রিয়া যেভাবে জারি রাখা ছিল সেটা আরও শক্তিশালীভাবে প্রকাশ্য হয়ে উঠছে দিনে দিনে। সরকারের উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীদের এধরনের নীতি-নির্ধারণী বক্তব্যের জোর প্রভাব পড়ে প্রশাসনের পুরা ব্যবস্থার ওপর। এতে সরকারের দলীয় নেতাকর্মী সহ তাদের পুরা জনশক্তি সেই মানসে প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। পাবনা, পঞ্চগড় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তার দৃশ্যমান পরিণতি।

সর্বশেষ সরকারের এমন অবস্থানের কথা জানালেন আরও একজন; ‘দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা যাতে চাকরি পায় সেজন্য মোটামুটি একটি সিস্টেম করা হয়েছে। আমি তো আমার অফিসারদের বলে দেব- আমার লোককে চাকরি দিতে হবে।’--কথাগুলা বলেছিলেন প্রধান মন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী। গত ২০ সেপ্টেম্বর এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেছিলেন। তিনি সে বৈঠকে আরও বলেছেন, সারা দেশের আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের থেকে সাড়ে তের হাজার কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার নিয়োগ দেয়া হবে। এসব বক্তব্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনকে তার ইচ্ছামত তৈরি করছে। এদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের পর দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগে সাড়ে পঁচিশ হাজার লোক নিয়োগ দেয়া হবে।

যোগ্য জনবল সমৃদ্ধ প্রশাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে

স্থানীয় নির্বাহি প্রশাসনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সাম্প্রতিক হামলার প্রথম যে খবরটি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পায় সেটা ঘটেছিল নাটোরে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুর ওয়ালিয়া হাকিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে আহত করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। ওই ঘটনায় পূর্বনির্ধারিত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার সাক্ষাৎকার স্থগিত করা হয়।

পাবনার জেলা প্রশাসকের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার ঘটনার মধ্য দিয়ে এধরনের দুর্নীতির ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় চলে আসে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটা নিয়োগ পরীক্ষা চলার সময় পাবনার জেলা স্কুল ও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হামলা চালায়। এতে পরীক্ষা ভেস্তে যায়। পরে ক্ষমতাসীন দলে নেতাকর্মীদের অব্যাহত মহড়া এবং চাপের মুখে স্থানীয় নির্বাহি প্রশাসন অচল হয়ে যায়। তাছাড়া চাপের মুখে একযোগে বদলি আবেদনেরও সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সুশীল সমাজের সাথে এক বৈঠকে জেলা প্রশাসন তাদের প্রতি সরকার দলীয় নেতাদের আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের দেয়া তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় এ হামলা চালানো হয়।

পাবনার ঘটনার দুইদিনের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে পঞ্চগড় সিভিল সার্জন কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগে নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র ও ফলাফলের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এই মৌখিক পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীদের নাম না থাকায় এ হামলা চালায় তারা।

পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধায় ৬৮ টি কনস্টেবল পদে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের আবেদন জানায় জেলা আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ আবেদন জানানো হয়। একই দাবিতে গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘেরাও করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এসময় তারা নিয়োগ কমিটির প্রধান বগুড়ার পুলিশ সুপারকে অবরুদ্ধ করে রেখে বাইরে বিক্ষোভ করে।

২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপালকে লাঞ্ছিত করে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসা কর্মকর্তা পদের নিয়োগ পরীক্ষায় দলীয় প্রার্থী পাস না করায় এ হামলা চালায় তারা। চিকিৎসা কর্মকর্তার সত্তরটি পদের বিপরীতে ছয়শ পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্য থেকে দুইশ সাতজনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়। অপরদিকে সত্তরটি পদের বিপরীতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বাচিপের পক্ষ থেকে চারশ জনের সুপারিশ করে তালিকা পাঠানো হয়। পরে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত পরীক্ষার্থীদের তালিকায় তাদের নাম না থাকায় তারা উপাচার্যের ওপর হামলা করে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণ করতে আমেরিকায় অবস্থানের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার ঘটনার জন্য প্রশাসনকে দায়ী করে বলেন, এক হাতে তালি বাজে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেন, কিছু ব্যক্তির অপরাধের দায় দল নেবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নয়। তিনি পাবনার ঘটনায় আওয়ামী লীগকে দায়ী না করার আহ্বান জানিয়ে ওই ঘটনায় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ করেন। ইমাম বলেন, সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জনগণ তার কাছে চাকরির আবদার করতে পারে এবং চাকরির আবদার নিয়ে তিনি প্রশাসনের কাছে যেতে পারেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম নিয়োগ-দুর্নীতির ঘটনায় দলের ‘অতি উৎসাহী’ কিছু নেতা-কর্মী জড়িত মন্তব্য করে বলেন, আওয়ামী লীগ এর দায় নেবে না। জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, ‘নিয়োগ নিয়ে কি হচ্ছে- আল্লাহই ভাল জানে। গণমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ-দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। অপরদিকে তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন। নিয়োগ-দুর্নীতির খবর কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল আল্লাহই ভাল জানে। ’

সব দেখে শুনে এটাই স্পষ্ট যে সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের নির্বাহি প্রশাসন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এমন জনবল দিয়ে গড়ে তোলা যাদের একমাত্র যোগ্যতা হবে নিখাদ দলীয় আনুগত্য। দক্ষতা ও যোগ্যতার কোনও বালাই নাই।

হামলার শিকার নির্বাহি প্রশাসনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

সরকার কেবল পাবনায় নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে ওই হামলার ঘটনার দায় অস্বীকারই করে নাই। উল্টা এর দায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। পাবনা সহ সারাদেশে নিয়োগ সংক্রান্ত হামলার ঘটনায় সরকার বিশেষ কোন নিরপেক্ষ তদন্ত করে নাই। যারা হামলা করেছে সরকার দলের সমর্থক সেই যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই এই শাস্তিতে নাই। মোটকথা তাদেরকে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পুরা আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। আর প্রশাসনকে শাস্তি দেয়ার অংশ হিশাবে জেলার পাঁচ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার ও বদলি করা হয়েছে। পাবনার ঘটনায় ২৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক ড. এএফএম মনজুর কাদিরের চাকরি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করা হয়। পুলিশ সুপার জামিল আহমেদকে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া সদর উপজেলার নির্বাহি কর্মকর্তা (টিএনও) আবদুল আলীমকে ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় বদলি করা হয়েছে। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিজয় ভূষণ পাল ও ইমামউদ্দিন কবিরকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। যদিও ২৯ সেপ্টেম্বর তাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। এ প্রসঙ্গে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে পাবনা জেলার অধিকাংশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কৌশলগত কারণে এক সাথে সবাইকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলার প্রায় দশ দিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু পাবনায় সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে আলাদা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে এইচটি ইমাম ওই ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসনকে দায়ী করে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন বৈঠকে বসে সমঝোতা করতে পারত।’ প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আঁচ করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় গণবদলি ও প্রত্যাহার শুরু হয়।

পরাশক্তি ও বিদেশী স্বার্থের প্রতিনিধি সুশীল সমাজকে জনস্বার্থবিরোধী নয়া তৎপরতা চালানোর পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়া হচ্ছে

তবে সরকারের দলীয়করণের মাত্রা এমন অবস্থায় চলে গেছে যাতে এখন খোদ তার গড়া প্রশাসনই এখন তার উল্টা দিকে ছুটছে। একদিকে যুবলীগ-ছাত্রলীগ আরদিকে প্রশাসন। রাষ্ট্রের নির্বাহি ক্ষমতায় থাকা দল হিশাবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের নির্বাহি প্রশাসনকে যেহেতু একশভাগ দলীয় প্রশাসন হিশাবে গড়ে তুলতে চাইছে, কাজেই প্রশাসনের চেয়ে সরকারের কাছে এখন দল বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে একদিকে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নাগরিকরা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিযুক্ত হতে পারছেন না, অন্যদিকে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায়--অযোগ্য দলীয় প্রশাসন রাষ্ট্রচালনায় ব্যর্থ হচ্ছে--সাধারণ নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না। এত গেল আপাত দুই বিপদের কথা। কিন্তু‘ এর মাধ্যমে এই দুই বিপদ ছাড়া আরও বিপদ ঘটাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের এমনতর ব্যাপক দলীয়করণ-দলবাজি ও দুর্নীতির জনক হিশাবে খোদ গণতন্ত্রকে আসামী করে গণতন্ত্রবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে একটা গোষ্ঠী, গত এক এগার’র মত আরেকটা অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারি শাসনের পরিস্থিতি তৈরি করতে এই গোষ্ঠী--মানে সুশীল সমাজ ইতিমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের বেশ কিছু সাম্প্রতিক সক্রিয়তার আলামতও ইতিমধ্যে দেখা গেছে। যেমন পাবনার ঘটনায় পর দেখা গেল একপর্যায়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় সুশীল সমাজের কাছে ‘সহযোগিতা’ নেয়ার চেষ্টা করে। সুশীলরাও তাদের পাশে দাঁড়ায়। কারণ এই পাশে আসার সুযোগ রাজনৈতিক শক্তির দুর্নীতি ও দুর্বলতা থেকেই তারা পায়। এই দুর্বলতাটা কি? সেটা সুশীলদের মুখেই শোনা যাক। ‘যেখানে নাগরিকদের কোনও পাওনা বা প্রাপ্য রয়েছে সেখানেই বাজিকরেরা একটা উৎকট ব্যস্ততায় উন্মুক্ত। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি--এত ধরনের বাজির রকমফের দেখে দেশের লোক দিশেহারা। যেখানে একটা চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য তিন লাখ টাকা গুনতে হয়, সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন কেমন করে আমরা গড়ব। বাংলাদেশে এখন দেবী লক্ষ্মী নতুন নন্দীভৃঙ্গীদের কবজায়। দেবী সরস্বতী অধোবদনে চিন্তান্বিতা।’ এই কথাগুলা এমন একজনের যিনি কি না বাংলাদেশে পরাশক্তি ও করপোরেট পুঁজি’র স্বার্থের প্রতিনিধি গোষ্ঠী--সুশীল সমাজের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি জনাব হাবিবুর রহমান ১৯৯৬ সালে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও প্রধান ছিলেন। গত ছয় অক্টোবর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গবেষণার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি সুশীল সমাজের মুখপাত্র আকারে এসব বলেন। তিনি বাংলাদেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। যেসব সাবেক বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা-আমলা-বিচারক-এনজিও মালিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের দিয়ে গত প্রায় দেড় দশক ধরে পরাশক্তি ও আন্তর্জাতিক করপোরেট পুঁজি বাংলাদেশে সুশীল সমাজ গড়ে তুলেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছেন জনাব রহমান। সুশীল সমাজ বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে গত ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের এগারতে। জাতিসংঘ সহ পরাশক্তির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমর্থন ও সহযোগিতায় এবং সামরিক বাহিনীকে পাহারাদার হিশাবে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করে এরা। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলাকে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তাদের অগণতন্ত্রী ও নৈরাজ্যকর আচরণের ফলেই এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল যে ক্রমশ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়া মধ্যবিত্তের সমর্থন পেয়েছিল ওই অনির্বাচিত এবং অগণতান্ত্রিক শাসকেরা। অবশ্য সবকিছুকে আড়াল করে সুশীল সমাজ রাজনৈতিক দলগুলার বিরুদ্ধে এক ধরনের দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা চালিয়েই ক্ষমতা দখলের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। দুর্নীতির অভিযোগ কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু সুশীলদের কাছে এটা নিছকই রাষ্ট্রক্ষমতায় সওয়ার হওয়ার জন্য একটা উছিলা মাত্র। রাজনৈতিক দলগুলার দুর্নীতির মত এই অপকর্মকে একটা উছিলা বানিয়ে তারা পরাশক্তি নিয়ন্ত্রিত সুশীল-সামরিক সরকার কায়েমের একটা আয়োজন সম্পন্ন করেছিল।

এই যেমন তাদের অন্যতম মুখপাত্র জনাব হাবিবুর রহমানের ওপর ভর করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অপকর্মের চিত্র তুলে ধরে এখন মেধাভিত্তিক প্রশাসন গড়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করছে তারা। এই অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ মোটেই অযৌক্তিক না। কিন্তু মেধাভিত্তিক কিম্বা যোগ্য প্রশাসন গড়ে তোলার ব্যাপারে সন্দেহ বা শঙ্কা প্রকাশের দোহাই দিয়ে তিনি আসলে অন্যকথা বলতে চেয়েছেন। নাগরিকদের পুরাপুরি রাজনীতিবিমুখ করে তোলা যার আসল উদ্দেশ্য। তার বক্তব্যের উপরি কথা হল, প্রশাসনকে সুশৃঙ্খল এবং দক্ষভাবে গড়ে তোলা দরকার। প্রশাসন সহ সবক্ষেত্রে দক্ষ এবং সৎ নেতৃত্ব ও সৎ শাসন কায়েম হলে পরে দেশ আগায়ে যাবে ইত্যাদি তার কথা। কিন্তু এখানে এসে তিনি আর গণতন্ত্র ও রাজনীতির কথা বলেন না। অথচ তার এসব বক্তব্যের পটভূমি শুরু হয়েছে রাজনীতি এবং গণতন্ত্র দিয়ে। উপরি কথা ওরফে বাইরের রাখঢাক শেষে তিনি তার আসল কথা--সুশীল প্রকল্পের বয়ানে চলে যান। সেই জায়গায় গণতন্ত্র আর সুশাসনকে (গুড গর্ভনেন্স) তিনি একাকার করে ফেলেন। যেখানে আর তিনি মানে সুশীল সমাজ গণতন্ত্র চান না আসলে। চান সুশাসন। যেমন তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের প্রশাসনে নাগরিকদের শরিকানা বৃদ্ধি করতে পারিনি। দেশের অভ্যুদয়ের কাল থেকে আমরা সংবিধানে প্রদত্ত স্থানীয় শাসনের বিধান লঙ্ঘন করে আসছি।’ দেখা যাচ্ছে, এখানে তারা স্থানীয় শাসনের কথা বলছেন। এবং প্রশাসনে জনগণের শরিকের কথা বলছেন। এতে দৃশ্যত মনে হবে তারা গণতন্ত্রের কথা বলছেন। অর্থাৎ জনগণকে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে সুশাসন করছেন। জনগণকে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা না। তাদের পুরা প্রক্রিয়া হল রাজনীতিহীন করার প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক পরিচয় কাঠামোর বাইরে গিয়ে যেহেতু স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। ফলে তারা এই রাজনৈতিক পরিচয়মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে সপৃক্ত করার কথা বলছে। কাজেই মনে রাখতে হবে সুশাসন মানেই গণতন্ত্র না। কিম্বা সুশাসন মানে একটা জাতিকে রাজনৈতিক সত্তায় জীবন্ত করে তোলা না। সুশাসন প্রধান হয়ে ওঠলে সেখানে গণতন্ত্র থাকবে এমন কোন কথা নাই। কিন্তু গণতন্ত্র হলে নির্দলীয়-যোগ্য-দক্ষ ফলে গণতান্ত্রিক প্রশাসন কায়েমের মাধ্যমে এক অর্থে ‘সুশাসন’ও হয়ে যায়। এরজন্য আলাদা করে সুশাসনের কথা বলতে হয় না। কিন্তু সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সরকারের কায়েম করা প্রশাসন আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘সুশাসন’ প্রকল্প আলাদা জিনিস। কিন্তু যখন গণতন্ত্র আর রাজনীতির কথা না বলে শুধু সুশাসনের কথা বলা হয় তার মানে এর উদ্দেশ্য আসলে গণতন্ত্র আর স্বয়ং রাজনীতিকেই অস্তিত্বহীন করে তোলার চেষ্টা চালানো। এমনকি সুশাসন মানে দুর্নীতিমুক্ত কোন দেশ না।

মজার কথা হল, সুশাসন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র কথা বলা হয় না সাধারণত। দেশ কথাটা বলা হয়। রাষ্ট্র কথার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক দেহ আত্মার মত অভিন্ন। কিন্তু দেশ অন্য জিনিস। ভূগোল মাত্র। কিন্তু আজকের দিনে সুশাসন আর দুর্নীতিমুক্ত সৎ ও দক্ষ শাসন ব্যবস্থার মানে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল শক্তির কাছে জনগণের ক্ষমতাকে আমানত রাখা না। বরং রাজনীতিমুক্ত এবং জনগণ দ্বারা নির্বাচিত না এমন শক্তির কাছে বিদ্যমান রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড ন্যাস্ত করা। মানে রাষ্ট্রের নিজ ক্ষমতার আওতাভুক্ত সকল প্রক্রিয়া, কাঠামো-খাত ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতামুক্ত ও অনির্বাচিত ব্যক্তি পর্যায়ে বা কোন সংস্থা ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর কাছে ন্যাস্ত করা। যার ওপর রাষ্ট্রের কোন তদারকি থাকে না। বরং এদের নিয়ন্ত্রক এবং তদারককারী হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মত আন্তর্জাতিক নানা নীতি নির্ধারণী সংস্থা। তারা আন্তর্জাতিক পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এসব শক্তিশালী সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ।

এর সবচেয়ে বড় নজির হল, জ্বালানি খাতে সাম্প্রতিক উদ্যোগ। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে রাষ্ট্রীয় খাতের বাইরে ব্যক্তিখাতে নিয়ে যাওয়া হল রেন্টাল পাওয়ার বা ভাড়া বিদ্যুৎ হিশাবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবা খাত হল বিদ্যুৎ। আরও বড় কথা হল শিল্পায়িত ও যন্ত্রায়িত এই সময়ে জ্বালানি নিঃসন্দেহে জাতীয় নিরাপত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় হবে বেসরকারি খাতের ভাড়া বিদ্যুৎ-এ। ফলে বেসরকারি খাতে জ্বালানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকির পাশাপাশি জ্বালানির দামও বাড়বে--রাষ্ট্রীয় খাতে উৎপাদনের চেয়ে দুইগুণ থেকে শুরু করে চারগুণেরও বেশি দামে এই ভাড়া বিদ্যুৎ কিনতে হবে সরকারকে। ফলে দাম এতই বাড়বে যে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি দিয়ে এই খাতকে রাষ্ট্রীয় সেবা খাত হিশাবে চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের এই পুরা নীতিগত অদল-বদলই ‘সুশাসন’-এর অন্তর্ভুক্ত।

আর সুশাসনের প্রকল্প হিশাবে সুশীলরা এর সমর্থনে নানা ধরনের তৎপর আছে। যেমন সেদিনকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গবেষণাপত্রের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সাবেক ওই প্রধান বিচারপতি বক্তৃতা করেছিলেন, সেই গবেষণাপত্রের প্রধান বিষয় ছিল বিদ্যুৎ খাতের এই বিপজ্জনক বেসরকারিকরণ। জনাব রহমানের বক্তৃতা জুড়েও একক বিষয় হিশাবে সবচেয়ে বেশি অংশ জুড়ে ছিল এই ভাড়া বিদ্যুতের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রস্তাব। এখন থেকে প্রায় দেড় দশক আগে ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘পাওয়ার সেল’ বলে একটা বিভাগ গঠন করেছিল সুশীলদের মালিক বিশ্বব্যাংক। তখন বলা হয়েছিল, যে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ওই সেল কাজ করবে। কিন্তু দেখা গেল যে, বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণ ছাড়া ওই পাওয়ার সেলকে দিয়ে কিছুই করানো হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় খাতের সমস্যা সমাধানে কিছুই করা হয় নাই। সেলের শুরুতে পরিচালক হিশাবে যোগ দিয়েছিলেন প্রকৌশলী বি ডি রহমত উল্লাহ এবং পরে দীর্ঘদিন মহাপরিচালক হিশাবেও দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সম্প্রতি চিন্তা’র সাথে এক আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘পরবর্তীতে আমরা বুঝতে পেরেছি, এর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ খাতকে ভেঙ্গে একে বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করা। . . . সরকার হয়ত ভেবেছিল পাওয়ার সেল গঠিত হলে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার হবে, সিস্টেম লস কমে যাবে এবং সবখানে স্বচ্ছতা আসবে। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হয় নাই।’ অবশ্য সরকারের মাথায় থাকা এই উদ্দেশ্য যে বিশ্বব্যাংক ও সুশীল সমাজের ছিল না তা স্পষ্ট। কিন্তু সেই সময় বিশ্বব্যাংক ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি সুশীল সমাজ তখন রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যামন অদক্ষতা ও অনিয়মকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ‘দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা’য় নেমেছিল এবং ওই দুর্নীতির উছিলা দিয়ে বিদ্যুতকে বেসরকারি খাতে তুলে দেয়ার আয়োজন তখনই শুরু হয়।

হালের সুশাসনের মুখপাত্র জনাব হাবিবুর রহমান ছিয়ানব্বইতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থাকার সময় বিশ্বব্যাংকের হয়ে এই পাওয়ার সেল গঠন ও আনুষঙ্গিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ খাতকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য। আর যেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে জনাব রহমান সর্বশেষ সুশীল খুতবা দিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ড.জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তার সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা। আর এখন সুশীল সমাজ বিদ্যুৎ খাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কথা বলছে। কিন্তু সুশীল সমাজ সমর্থিত বেসরকারিকরণের মাধ্যমেই এই ব্যাপক দুর্নীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, তারাই দুর্নীতির কারণ ও ক্ষেত্র তৈরি করছে। আবার দলগুলার এই দুর্নীতিতে গণতন্ত্রবিরোধী প্রচারণায় কাজে লাগাচ্ছে। অন্যদিকে সুশাসনের অংশ হিশাবে এখন তারা শুধু বেসরকারিকরণের কথাই বলছেন না। বলছেন এই বেসরকারিকরণ রাষ্ট্র নিজে অংশ নিয়ে নিজের খরচে করবে। জাতীয় নিরাপত্তার অংশ জ্বালানি খাতকে দেশী ও বিদেশী করপোরেট পুঁজি মালিকদের হাতে ছেড়ে দেয়াই শুধু না, বরং রাষ্ট্রকে এখনও পুঁজিকে রীতমত প্রণোদনা অর্থাৎ উৎসাহ জাগানিয়া সমর্থন এবং নগদে ও হাতে কলমে সহযোগিতা করতে হবে। এখন ওই শুধু উৎসাহিত করলেই চলবে না, রাষ্ট্রকে এখন বিদ্যুতকে ব্যবসায়িক খাতে দেয়ার পর বিনিয়োগেও থাকতে হবে। এই হল সুশীল সমাজের কথিত ‘প্রণোদনা’ আর সুশাসনের ফর্মুলা।

সুশীল সমাজের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র জনাব হাবিবুর রহমানের আরেকটি বরাত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলছেন, ‘হুজ্জতে বাঙালের দেশে গণতন্ত্র যে কী ভঙ্গুর হতে পারে, তার নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। ব্যাংকে আগুন জ্বালিয়ে, রিকশাওয়ালাকে জীবন্ত দগ্ধ করে, যত্রতত্র বোমা ফাটিয়ে, পটকাবাজি করে এবং বাসে বারুদ ছড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দলীয় নন্দীভৃঙ্গীরা গণতন্ত্র উদ্ধার করতে পারে নি, অত্যন্ত স্বল্পকালের জন্য ক্ষমতায় আরোহণ করে দ্রুত তাদের পদস্খলন ঘটেছে মাত্র।’ সুশীল সমাজের এই পদ্ধতি এখন পরিচিত। রাষ্ট্রকে রাজনীতিশূন্য করে পুঁজি মালিকদের দয়ার ওপর নাগরিকদের ছেড়ে দেয়ার যেকোনও সুশাসনীয় ফর্মুলা উপস্থাপনের আগে বরাবরই সুশীলরা রাজনৈতিক দলগুলার ব্যর্থতা ও স্বেচ্ছাচারিতার উদাহরণকে কাজে লাগায়। বিদ্যমান দুরাবস্থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মায়াকান্না করে নাগরিকের চোখে জল আনার চেষ্টা করে। তারপর বলে--এ জল তোমার চোখে আনল বল কে? জবাব প্রস্তুত থাকে--রাজনীতি, এবং অবশ্যই রাজনীতি।

ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকদের কোলে বেড়ে ওঠা কলকাতার বাবু ‘নাগরিক সমাজ’ এককালে পূর্ব বাংলার মানুষদের যে তাচ্ছিল্যসূচক পরিচয়ে ডাকত--সেই ‘বাঙাল’ সম্বোধন করে জনাব রহমান বলছেন যে এই দেশে গণতন্ত্র মাত্রই ভঙ্গুর। সুশীলদের বরেণ্য মুখপাত্র বলছেন, ‘মানুষ নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতা চায়। গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে না।’ কাজেই নাজাত লাভ করতে হলে সুশাসন দরকার! সুশীলরা পরাধীনতার বিপরীতে, পরাশক্তির বিপরীতে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বিপরীতে স্বাধীনতার কথা বলছে না। তারা স্রেফ দলীয় রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার কথা বলছে। এটুকু বললেই রেহাই ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে সুশীল স্বাধীনতার মানে হল বিপজ্জনক আমলাতান্ত্রিক ‘সুশাসন’। স্বাধীনতা মানে যে জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের বিষয়--তাকে আড়াল করে রাজনীতিহীন করে তোলার জন্য বলছে, ‘গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে না।’ তাদের দাবি, এই নিশ্চয়তা প্রদান করে সুশাসন। জনগণের রাজ নৈতিকতার চর্চার মধ্য দিয়ে এই নিশ্চয়তা গড়ে উঠবে না--এটা হবে সুশাসনের মাধ্যমে! ফলে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা হল জনগণের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্বশীল এবং জবাবদিহিতার জায়গাগুলাকে ক্রমান্বয়ে জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সত্যিকার মুসিবত হচ্ছে; সুশীল সমাজের এই প্রকল্পের বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলা সচেতন বলে মনে হচ্ছে না। রাজনীতির নামে দলবাজির মাধ্যমে, ক্রমাগত নিপীড়কের ভূমিকায় হাজির হওয়ার মাধ্যমে তারা সুশীলদের প্রকল্পের উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করছে। দলীয়করণ-রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও নিপীড়নের ফলে যে দূরবস্থা তৈরি হচ্ছে পুরা দেশে, তার ফলে সুশীলরা সুযোগ পাচ্ছে বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্তের চোখে আঙুল দিয়ে প্রশ্ন করার--এ জল তোমার চোখে আনল বল কে? কিন্তু বিপদ হচ্ছে সেই ‘কে’র জবাব হিশাবে শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে হাজির করা হচ্ছে না। বরং পুরা রাজনীতি-নাগরিকের রাজ নৈতিকতা ও গণতন্ত্রকে আসামী বানাচ্ছে এরা। সেই সাথে নাজাতের উপায় হিশাবে হাজির করছে বিপজ্জনক সুশাসনকে। এভাবেই এক এগার’র মত একটা চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনের পক্ষে এরা বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্তকে দলে ভেড়াতে পেরেছিল। এখন আবার আওয়ামী লীগের ভূমিকার কারণে সেই পরিস্থিতি তৈরিতে সুশীলদের চেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ যদি দলবাজির প্রক্রিয়াগুলা ত্যাগ না করে তবে আবারও সুশীল-সামরিক অভুত্থ্যান হতে পারে। পাশাপাশি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও অঙ্গগুলা অনির্বাচিত ও রাষ্ট্রের বাইরের শক্তি নির্দেশিত বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া বন্ধ করা জরুরি। সেই সাথে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায় গণতন্ত্রকামী নাগরিকদের এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে যে, ‘জনগণের নির্ভরশীলতা হতে হবে রাজনৈতিক শক্তির কাছে। . . . নাগরিকদের অসহায়ত্বের প্রকাশই প্রশাসনের অসহায়ত্ব। তাই এসবের নিরাপত্তার জন্য রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত করতে হবে। না হয় আবার একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে, আবার তথাকথিত নির্বাচন হবে, এ বৃত্তের মধ্যেই চলতে থাকবে। এ বৃত্তটা ভাঙা দরকার। এ জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন।’

 

View: 3732 Posts: 0 Post comments

Home
EMAIL
PASSWORD