ভূমিকা : ইহজাগতিকতা বিষয়ে ভাবনা


তালাল আসাদ
Wednesday 21 October 09

নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ বাংলাদেশে কমবেশি পরিচিত। পেশায় শিক্ষক, মার্কিন দেশের ন্যূ ইয়র্কের সিটি য়ুনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। ঔপনিবেশিক উৎস ও প্রকরণজাত শাস্ত্র হিসেবে সাম্রাজ্যিক প্রকল্প থেকে পরিচালিত অ-পশ্চিমী জগতকে ‘বিষয়’ বানিয়ে বিদ্যা উৎপাদন ব্যবসা তার হাতে পড়ে বড়সড় একটা ঝাকুনি খায়। তিনি একেবারে আরম্ভেই মোকাবেলার সূচনা করেন, এই শাস্ত্রের অনুমান, পাটাতন আর উদ্দেশ্যকে। এরই আদি নিদর্শন তার সম্পাদিত ‘এনথ্রপলজি এন্ড কলনিয়াল এনকাউন্টার’(১৯৭৩) বইটি।

নৃবিজ্ঞানের অভ্যাসের আওতায় ফেলে পশ্চিমকে সাব্যস্ত করার কাজ শুরু করেন সেই থেকে। ঔপনিবেশিক ‘কর্তা’কে ঔপনিবেশিতের অজ্ঞান উদ্ধারের জন্য বাছাই করে তিনি আধুনিকতার ইতি-আদি—আকার ও বিকার প্রদর্শনে নিরত হন। গোড়ায় গিয়ে গাথুনির তলা এবং মালমশলার স্বরূপ সংক্ষেপ করেছেন জেনিয়ালজি অব রিলিজিন বইটাতে(১৯৯৩)। ধর্মাধর্মের অর্গলমুক্ত নিখাদ দুনিয়াদারিতে অগ্রগামিতার অভাব হেতু প্রাচ্য বিশেষ, মুসলমানদের দুর্দশার যে অন্ত নাই সেই বয়ানের চাকচিক্যময় বাহিরানা আর অন্দরের ঐতিহাসিক বাসনার বসন খুলে তিনি আসল মুখখানা হাজির-নাজির দেখাতে কোশেশ পেয়েছেন ফরমেশনস অব সেক্যুলার(২০০৩) বইটাতে। সদাপ্রভুর খেদমতে নিয়োজিত খ্রিস্টসাম্রাজ্য রাষ্ট্র ও রাজনীতির নিরন্তর দাওয়াইপত্রে ইসলামকে যেভাবে আদিভৌতিক বিভীষিকা বানানোর তালে মজেছে তার চলন ও চরিত বিশ্লেষণে তিনি তাদেরই ইতিহাসকে সাক্ষী মেনেছেন সর্বশেষ অন সুইসাইড বম্বিং(২০০৭) বইতে।

বাংলাদেশে এসবের কিছু খরব কিছু, জাবর কাটা হয়েছে। তবু ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্তের মনোবৃত্তি আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে ইসলাম বিদ্বেষের আয়োজনে ভাটা পড়েনি। অতি সম্প্রতি আরো জোরদার হয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রায়োগিক কৌশল বাস্তবায়নে ব্যস্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির লোক-লশকর মিলে। রাষ্ট্র ও সংবিধানকে ‘সেক্যুলার’ করার উপায় অথবা নিরুপায় রাস্তা ধরে আওয়ামী লীগ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখেছে। অন্যদিকে কোনো মৌলিক পর্যালোচনার আভাস নেই গতানুগতিক বিরোধিতাকারীদের। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চাইতেও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় কেন এত অধিক আগ্রহ জমে ওঠে বাংলাদেশে সেই প্রশ্নটি করা দরকার।

সেই অভাববোধ ঘুচিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনের সারির প্রশ্নগুলোর মোকাবেলায় প্রস্তুতির সহায়ক হবে এই বিবেচনায় আমরা আসাদের ফরমেশন অব সেক্যুলার বইটির তরজমা ধারাবাহিকভাবে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে সেই প্রেক্ষিত তৈরি এবং আলোচনায় সবার সরব অংশগ্রহণ কামনা করছি। তরজমার কষ্টসাধ্য কাজটি করছেন মোহাম্ম্দ আরজু

প্রথম কিস্তি:

১.

জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকরণ হিসেবে জাগতিক(সেকুলার) এবং রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ইহজাগতিকতার (সেকুলারিজম) মধ্যে যোগসূত্র কি? উভয়ে কি নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে? ইহজাগতিকতার একটি নৃতত্ত্ব দেখতে ঠিক কেমন হতে পারে? বইটি প্রাথমিকভাবে এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করতে চেয়েছে।

সমসাময়িক দুনিয়াজুড়ে ধর্মীয় আন্দোলনের জোয়ার এবং সে বিষয়ে পন্ডিত ও সাংবাদিকদের ভাষ্য ঝড়ে এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট যে আধুনিক দুনিয়া থেকে ধর্ম কোনোভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে না। ধর্মের এই পুনর্জাগরণ, অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন জাগতিক রাজনীতি ও পরিবেশগত উদ্বেগের প্রতি প্রয়োজনীয় নৈতিক মাত্রা সরবরাহের উপায় জ্ঞানে। আর অন্যদের কাছে এটা নিত্যকার জীবনে ক্রমবর্ধমান যুক্তিহীনতা ও অসহিষ্ণুতার আশঙ্কাজনক উপদ্রব বলে বিবেচিত। ইহজাগতিকতার প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে তাত্ত্বিক যুক্তি ও দুনিয়াদারির বিবাদ ঘুচানোর বিষয় হিসেবে। এইসব বিতর্কের ইতি-আদির মধ্যে যদি কোনো-একটা ঐকমত্য থাকে তবে তা হলো; ধর্মীয় থেকে জাগতিক বানাতে ব্যস্ত সোজাসাপ্টা প্রগতিশীলতার বয়ান আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই ঐকমত্য কি প্রমাণ করে যে ইহজাগতিকতার সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য কোনো সারবত্তা নাই?

রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ইহজাগতিকতবাদ উদ্ভূত হয়েছে আধুনিক ইওরো-আমেরিকায়। সরলভাবে এই চিন্তা করা সহজ কাজ যে, নিছক সরকারের দরবারি (সেকুলার) প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে ধর্মীয় বিষয়াবলীর পৃথকীকরণের জন্য এটা দরকারি ছিল, কিন্তু এটুকুই সব নয়, এটাতেই শেষ নয় । আবছা করে বলা যায় এ ধরনের পৃথকীকরণের উদাহরণ মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চিয়ানরাজ্যসমূহে এবং ইসলামী সালতানাতে—এবং সন্দেহ নেই, অনত্রও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ইহজাগতিকতার স্বাতন্ত্র্য এই যে, এটা ধর্ম (রিলিজিয়ন), নীতিবিদ্যা(এথিকস) ও রাজনীতি(পলিটিকস) এর নতুন ধারনা এবং ধারনার সহযোগী নতুন কর্তব্যও ধার্য করে। অনেকে এই নতুনত্ব উপলদ্ধি করেছে এবং নানাভাবে সাড়া দিয়েছে। এভাবে যখন এর সমর্থকরা জোর দিয়ে বলছে যে এর বিশেষ উৎপত্তিস্থান এটিকে সমসাময়িক দুনিয়ার প্রাসঙ্গিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় না তখন মধ্যপ্রাচ্যে ও অন্যত্র ইহজাগতিকতাবাদের বিরোধীরা পাশ্চাত্যের সাথে নাড়িরযোগ থাকার দায়ে এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রখ্যাত দার্শনিক চার্লস টেলর হচ্ছেন তাদের একজন যারা জোর গলায় বলেন যে যদিও ইহজাগতিকতা হাজির হয়েছে আধুনিকতার আদিপর্বে পশ্চিমের খ্রিস্ট সমাজের সমস্যার জবাবে—ধর্মের (খ্রিস্ট ধর্মের নানা ফেরকার মধ্যকার) বিধ্বংসী লড়াইয়ের মাধ্যমে যার যাত্রা শুরু—তবুও এটা আধুনিক হয়ে উঠেছে এমন অ-খ্রিস্ট সমাজ সমূহের জন্য প্রযোজ্য, সর্বত্রই। অনেকানেক প্রভাবশালী একজন সমাজ দার্শনিকের এই চমৎকার ও আকর্ষণীয় যুক্তি এই প্রশ্নে আগ্রহী প্রত্যেকের মনোযোগ দাবি করে।

টেলর এটা মেনে নিয়েছিলেন যে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের সাথে ইহজাগতিকতাবাদের আবির্ভাব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং তিনি দুটি উপায় চিহ্নিত করেছেন যে উপায়ে ইহজাগতিকতা নিজেকে বৈধতা দেয়। প্রথমত, ইহজাগতিকতার প্রচেষ্টা ছিলো বিবদমান ধর্মীয় ফেরকাসমূহের মধ্যে নূন্যতম সাধারণ অভিধাগুলো খুঁজে পাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক নীতি দাড় করানোর প্রচেষ্টা ছিলো। যে আদলটি আজকের দুনিয়াজুড়ে প্রয়োগযোগ্য তা হচ্ছে শেষেরটি, কিন্তু এটা কেবল তখনই উপযোগী হবে যখন আমরা এই মডেলটিকে (জন) রলসীয় ওভারল্যাপিং কনসেনসাস(ঐক্যমত্যের জড়াজড়ি) ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে নেবো। যে ধারণা এই পূর্বানুমান ভর করে এগোয় যে, একটি আধুনিক ও বৈচিত্রপূর্ণ সমাজে গৃহীত রাজনৈতিক নীতি’র কোনো সর্বজনীনভাবে গ্রাহ্য ভিত্তি থাকতে পারে না, সেই ভিত্তি জাগতিক হোক কিংবা ধর্মীয়। টেলর এ বিষয়ে রলসের সাথে একমত যে রাজনৈতিক নৈতিকতা অন্য কোনো মঙ্গলবোধের বোঝাপড়ার সাথে একই সূত্রে গাথা হতে পারে, কিন্তু রলসের বিপরীতে টেলরের তর্ক এই যে; মূলগত বোঝাপড়া এবং সামনে থাকা রাজনৈতিক নীতিসমূহ দৃঢ়ভাবে একসাথে গাথা থাকার দরকার নেই। টেলর কথিত ইহজাগতিকতার এই আদল শুধু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই আবেদনময় নয় বরং টেলর বিশ্বাস করেন যে এটা ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (মডার্ন ডেমক্রেটিক স্টেট) হতেই পারে না। টেলর এ বিষয়ে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের চিন্তা পসন্দ করেন। অ্যান্ডারসন এর চিন্তা এই যে, আধুনিক জাতি হচ্ছে একটি কল্পিত সম্প্রদায় কারণ এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অংশ আধুনিক কল্পলোকের দুটি দিকের ওপর জোর দেয়। এ দুটি হচ্ছে; প্রথমত, আধুনিক সমাজের আনুভূমিক ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক চরিত্র এবং দ্বিতীয়ত, জাগতিক সমরূপ সময়ে এর বসবাস। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রতিফলন বিভিন্ন অগ্রসরতার মধ্যে দেখা যায় যেমন: জনপরিসর এর উত্থান (জাতীয় বিতর্কে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবার সমানাধিকার), বাজার-নীতি’র বিস্তার (চুক্তির সব পক্ষই সমান আইনি সত্ত্বা), এবং (ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নীতির ওপর ভিত্তিতে) নাগরিকত্বের আবির্ভাব। ব্যক্তিবর্গের জীবনের সামগ্রিকতা যা একটি (জাতীয়) সম্প্রদায় গঠন করে যেখানে কোনো বিশেষাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি বা ঘটনা নেই এবং অতএব কোনো মধ্যস্থতার ব্যাপারও নেই; এমন ধরনের ব্যক্তি-সামষ্টিকতা কল্পনা করার জন্য প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক সমাজ ধারণা ছাড়াও আরো একটি পূর্বশর্ত হলো সমরূপ সময়। এরুপ সমরূপ সময় আধুনিক প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক সমাজের রাজনৈতিক বৈধতার উৎস তৈরি করে যা একটি বৈষয়িক সমঘন রাষ্ট্র হিসেবে প্রথাগতভাবে বৈষয়িক এবং রাজনৈতিক মধ্যস্থতামূলক রাষ্ট্রের চেয়ে মৌলিকভাবেই আলাদা। টেলর লিখছেন, ‘প্রথাগত স্বৈরতন্ত্র জনগণকে শুধু অনুগত থাকতে ও আইন মেনে চলতে বলতে পারে।’ কিন্তু ‘গণতন্ত্র; তা প্রাচীন হোক কিংবা আধুনিক, তার আরো বেশি বলার আছে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্র চায় যে এর সদস্যরা প্রয়োজনীয় অবদান রাখতে উদ্ধুদ্ধ হবে; সেটা হতে পারে সম্পদের ক্ষেত্রে (করসমূহ প্রদান করে), কখনো রক্ত ঝরিয়ে (যুদ্ধ) এবং সবসময়ই কিছু মাত্রায় শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। একটি মুক্ত সমাজ অবশ্যই নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নিয়মের দ্বারা স্বৈরতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতাকে প্রতিস্থাপন করবে। যেখানে এটা ব্যর্থ হয়, সেখানে পুরো পদ্ধতিই বিপদাপন্ন।’

এই ব্যাখ্যা কি আকৃষ্ট করার মতো? এখানে এসে কিছু সন্দেহ দেখা দেয়। কর পরিশোধ কিংবা সেনাদলে অর্ন্তভূক্তকরণ নিশ্চিতভাবেই স্বেচ্ছাকৃত-প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে না, বরং তা নির্ভর করে রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্য করার ওপর। ‘কিছু মাত্রায়’ শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ (যার দ্বারা টেলর বুঝিয়েছেন প্রতি চার কি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে অংশ নেয়া) প্রতক্ষ্যভাবে পুরো জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানগত পরিমাপকে নির্দেশ করে, এবং এই পরিসংখ্যানগত পরিমাপ কখনোই ব্যক্তিগত প্রণোদনা কতটা শক্তিশালী তার নির্ণায়ক নয়। অতএব, ব্যক্তিগত নৈতিকতার ওপর নয় বরং এটা নির্ভর করে নির্বাচনী প্রচারণার সংগঠন ও অর্থায়ন সহ রাজনৈতিক দক্ষতার ওপর যার দ্বারা বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যাকে সামলানো হয়। আমি বলবো—আধুনিক উদার শাসনব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য বাধ্যকরণ (বলপ্রয়োগ) কিংবা সংলাপ (সম্মতি) কোনোটিই নয়, বরং এটা হলো রাষ্ট্রযন্ত্র যা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে স্বেচ্ছাশৃঙ্খলা ও অংশগ্রহণ, আইন ও অর্থনীতি ইত্যকার উপাদানকে কাজে লাগায়। প্রাচীন অথবা আধুনিক গণতন্ত্রের বরাত, যার কারণ রাজনৈতিক বিপদের তুলনা উপস্থাপন, তা সত্ত্বেও বলা যায়—আধুনিক সমাজের সমস্যা ও সম্পদ প্রাচীন গ্রীক নগরীর চেয়ে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। অংশগ্রহণ বিষয়ে টেলরের বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে আধুনিক রাষ্ট্রশাসিত জনসংখ্যার অধিকাংশ ব্যক্তি যেভাবে শাসনব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দেয় তার সাথে মেলে না। তার বক্তব্য বরং এমন যে একজন আদর্শিক মুখপাত্র রাজনৈতিক বৈধতার তত্ত্ব দিচ্ছেন। যদি ব্যবস্থা বিপদাপন্ন হয় তার কারণ এই নয় যে নাগরিকদের স্বেচ্ছাশৃঙ্খলা অনুপস্থিত। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ জানেন যে ব্যবস্থা বিপদাপন্ন তখনই যখন সাধারণ জনগণ কোনো সমৃদ্ধির অনুভূতি উপভোগ করে না, যখন বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা শাসিতদের প্রতি সাড়া দিতে সম্পূর্ণরূপে অনুপযুক্ত হয়, এবং যখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসংস্থা ভীষণ অদক্ষ হয়ে পরে। জনসাধারনের বিপুল অংশকে অসন্তুষ্ট করা থেকে বিরত থাকে এমন নীতি নির্ধারনী কৌশল এবং অর্থনীতি স্বেচ্ছাশৃঙ্খলা (একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নিয়ামক) থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আজকালের উদার গণতন্ত্রের ধাঁচ থেকেই প্রস্তাবনার পক্ষে একটি শক্তিশালী নজির দেখানো যায় যে, নির্বাচক জনগণ ও তার সংসদীয় প্রতিনিধিদের মাঝে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর সরাসরি সংযোগসূত্র বিদ্যমান। সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক নির্বাচক জনসংখ্যার আর্থ-সামাজিক স্বার্থ, পরিচয় ও আকাঙ্ক্ষার অনেক এবং অনেক কম প্রতিনিধিত্ব করে প্রতিনিধিরা। শাসনব্যবস্থার সাথে যুক্ত সংসদ বর্হিভূত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে নাগরিকের প্রত্যক্ষ প্রতিফলনের অনুপস্থিতি’র ক্ষতিপূরণ হয়না। অন্যদিকে, সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর চাপ-প্রয়োগকারী গোষ্ঠী সমুহের প্রভাব, যেই নির্বাচক জনগোষ্ঠী সরাসরি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কর্তৃত্ব অর্পণ করে তাদের প্রভাবের চেয়ে বেশি না হলে অনেক প্রকাশ্য। (উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের ফার্মার্স ইউনিয়িন; এবং যুক্তরাষ্ট্রের এইপ্যাক ও অয়েল লবি)। মতামত জরিপ, নাগরিকদের নড়বড়ে সামষ্টিক মতামতের ওপর অবিরামভাবে নজরদারি করে, সরকারকে নির্বাচন মধ্যবর্তী জন-মনোভাবের বিষয়ে ওয়াকেবহাল রাখে, এবং নির্বাচনে ভোটদান সংক্রান্ত মতামত আঁচ ও প্রভাবিত করতে সরকারকে সক্ষম করে। চুড়ান্তভাবে গণমাধ্যম, যা ক্রমবর্ধমানহারে বাণিজ্যিক গোষ্ঠীসমূহের মালিকানায় চলে আসছে এবং প্রায়ই রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করছে; তারা জনগণের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং এর নিশ্চয়তা ও আশংকার মনোভাবের মাঝখানে থেকে মধ্যস্থতা করে। এভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে এই সমাজ (উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজ) কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ-অংশগ্রহণমূলক সমাজ নয়। এখানে এমন কোনো পরিসর নেই যেখানে সব নাগরিক মুক্ত ও সমানভাবে একজন আরেকজনের সাথে আলাপালোচনা চালাতে পারে। জনজীবনে আলাপালোচনার অস্তিত্ব কেবল দল নেতা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসক, সংসদীয় আইন প্রণেতা ও ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই অভিজাতদের মতো সাধারন নাগরিকরা নীতি নির্ধারনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না—নির্দিষ্ট সময় পর পর নাগরিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এমনকি যে নীতির সপক্ষে নাগরিক ভোট দিলো সেটা তা মেনে চলার নিশ্চয়তাও দেয় না।

talal asad.....................................

ফরমেশন অব সেক্যুলার বইয়ের প্রচ্ছদপট।

................................

কল্পিত সম্প্রদায় হিসেবে আধুনিক জাতি সবসময়ই বেশ কিছু নির্মিত ভাবমূর্তির দ্বারা চালিত। টেলর যখন বলেন যে আধুনিক গণতন্ত্রকে অবশ্যই জাতীয়তাবাদী ভাবানুভূতির একটি স্বাস্থ্যকর মাত্রা অর্জন করতে হবে তখন তিনি মূলত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সহ জাতীয় গণমাধ্যমের কথা বলেন—যার দায়িত্ব হচ্ছে ওই ভাবানুভূতির আবাদ করা। গণমাধ্যম স্রেফ সেই উপায় নয় যার মাধ্যমে ব্যক্তি একই সাথে তার জাতীয় সম্প্রদায়ের কল্পনা করে; গণমাধ্যম এই কল্পনায় মধ্যস্থতা করে, যে সংবেদনশীলতার ওপর ভর করে কল্পনা দাঁড়ায় সেই ভিত্তি নির্মাণ করে। টেলর যখন বলেন যে আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিকত্বকে পরিচয়ের প্রাথমিক নীতি করবে তখন তিনি মূলত বলেন শ্রেণী, লিঙ্গ ও ধর্মের ওপর নির্মিত ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়গুলোকে সে অবশ্যই ছাড়িয়ে যাবে, অভিজ্ঞতার একত্রীকরণ করে পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গীগুলোকে প্রতিস্থাপন করবে। তাৎপর্য বিচারে, (নাগরিকতা আশ্রয়ী) এই অতিক্রমনই হচ্ছে ইহজাগতিকতা(সেকুলারিজম)। ইহজাগতিকতা স্রেফ সামাজিক শান্তি ও সহিষ্ণুতা টেকসই করা বিষয়ক প্রশ্নের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব নয়। ইহজাগতিকতা হচ্ছে এমন এক কার্যকর প্রক্রিয়া যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক মাধ্যম (নাগরিকত্বের প্রতিনিধিত্ব) শ্রেণী, লিঙ্গ এবং ধর্মের হাত ধরে গাথা আচরণসমূহের পুন:সংজ্ঞায়ন করে এবং এগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে প্রাক-আধুনিক সমাজসমূহে কার্যকর মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র স্থানীয় পরিচয়সমূহের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে এগুলোকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ছাড়াই।

আধুনিক জাগতিক সমাজে (মুক্ত) পরিসর নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে—ক্রমপরম্পরা’র অনুপস্থিতির অভিযোগ এবং আনুভূমিক সংহতির ওপর প্রত্যাশিত নির্ভরতার প্রশ্ন আছে। তাছাড়া সময় এর ব্যাপারটাই বা কি? এখানেও বাস্তবতা টেলরের আদল যেরকমটি বলে তার চেয়ে জটিল। আধুনিক রাজনৈতিক অর্থনীতির হিসাবে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও বাজার ব্যবস্থার সমরূপ সময় অবশ্যই কেন্দ্রীয়। এটা (সময়ের) গতি এবং অভিমুখকে যথাযথ পরিকল্পনার সাথে যুক্ত করে। কিন্তু আরো সময়গত ব্যাপার আছে—তাৎক্ষণিক ও মধ্যস্থতামূলক—পরস্পরবিরোধী ও পরস্পরবিরোধী নয় এমন—যার মধ্যে অ-সমজাতীয় সমাজের মানুষ বাস করে অতএব এর মধ্যেই তাদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আকার পায়।

সংক্ষেপে, উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক সমাজের সূচনা করে; এই পূর্বানুমান আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়। আধুনিক সমাজে মধ্যস্থতার চরিত্রের নানা ধরনধারন নিশ্চিতভাবেই মধ্যযুগের খ্রিস্টান এবং ইসলামি কোনো একটি সমাজের চেয়ে ভিন্ন রকম, কিন্তু এই ফারাক শুধু আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের জনজীবনে নিছক ধর্মের গরহাজির থাকার মতো মামুলি ব্যাপার নয়। এমনকি আধুনিক ইহজাগতিকতাবাদী দেশসমূহেও দেশভেদে ধর্মের জায়গা আলাদা আলাদা। এভাবে ফ্রান্সের চরমভাবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ই জাগতিক, ব্রিটেনে রাষ্ট্রের সাথে প্রতিষ্ঠিত চার্চের যোগসূত্র রয়েছে এবং এর অধিবাসীরা ব্যাপক মাত্রায় অধার্মিক, আমেরিকায় জনসংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় ধার্মিক কিন্তু রাষ্ট্র ইহজাগতিক। ব্রিটেন ও আমেরিকা উভয় রাষ্ট্রেই ধর্ম সবসময় প্রকাশ্যে হাজির ছিল। যার ফলে, যদিও এইসব দেশগুলোর ইহজাগতিকতায় অনেক সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু আধুনিক কল্পনার মধ্যস্থতামূলক চরিত্রের দিক দিয়ে এগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক আছে। প্রত্যেকটি সমাজে ধর্মীয়ভাবে সংজ্ঞায়িত দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতার ভাব নানা দিক থেকে আলাদা। তিনটি দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জাতি ও রাষ্ট্রে অংশগ্রহণ বিষয়ে সাধারন মনোভাব ভিন্নতর।

সুতরাং মতবাদ হিসেবে ইহজাগতিকতাবাদের সাথে ঐক্যমত্যের জড়াজড়ি ধারনার কোনো কাজের সম্পর্ক আছে কি? ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্রপূর্ণ সমাজে, টেলরের দাবী অনুযায়ি, সেই সমাজ জনগণকে ইহজাগতিক নৈতিকতায় একমত হওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন (এমনকি পারস্পরিকভাবে বিরোধী-স্বভাবের) কান্ডজ্ঞান পোষণ করাকে স্বীকৃতি দেয়। যেমন; জীবনধারনের অধিকার জাগতিক অথবা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা ন্যায্যতা পেতে পারে—এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যের অনেক রকমফেরে আসতে পারে। তার মানে এই যে কর্তৃপক্ষীয় সমাধানের অসমর্থতায় রাজনৈতিক মতভেদ চলবে এবং অস্থায়ী সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে আলাপালোচনা ভিত্তিক আপসের ওপর। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মূল রাজনৈতিক নীতি এবং মৌলিক ন্যায্যতা হিসেবে কি বিবেচনা করা হবে তা নিয়ে ঝগড়া-ফ্যসাদ থাকতে পারে, সেগুলো কিভাবে ফায়সালা হবে? টেলর জবাব দিচ্ছেন: প্ররোচনা ও আলাপালোচনা দ্বারা। এই জবাবের পেছনে নিশ্চিতভাবেই সহৃদয় আকুতি আছে, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র কোনো সহৃদয় সংস্থা নয় এবং এর আইন প্ররোচনার কারবার করে না। একবার ভাবুন যখন বিবদমান (রাজনৈতিক) দলসমূহ নীতিগত বিষয়ে আপস করতে নারাজি তখন কি ঘটে ? (সেই নীতি যা কোনো সক্রিয়তা বা কিছু হয়ে ওঠা’কে গ্রথিত করে, যা কেবল বিশ্বাসের বিবৃতি সেই নীতি নয়)। যদি সরকার এবং সরকার সমর্থক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কর্তৃক জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়া কোনো বিষয়ে নাগরিকদের কোনো অংশ বাধা দেয় তবে আইনি ব্যবস্থা’র (যা বলপ্রয়োগকে অর্ন্তভূক্ত করে) হুমকি ব্যবহৃত হতে পারে। সেই অবস্থায় আলাপালোচনা কেবল অসম সম্মতির বিনিময় হতে পারে, যেখানে দুর্বলতর দলের কোনো পছন্দের সুযোগ নেই। কি ঘটে যখন আইনের প্রয়োজনীয়তার শিকার হয়ে যখন আধুনিক ইহজাগতিক কল্পলোকে সাম্য ও স্বাধীনতা’র দাবি করে? তখন এই সত্য বেরিয়ে আসে যে, যদিও সে তার জন্য ভালো পছন্দ করতে পারে কিন্তু সে তার জন্য মন্দ চিহ্ণিত করতে পারে না।

অথবা বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখা যাক; রাষ্ট্র যখন বলপ্রয়োগ করে মূল রাজনৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা করতে প্রচেষ্টা চালায়, যখন রাষ্ট্রের আদালত মূল নীতিমালা ও মৌলিক ন্যায্যতা’র মাঝখানে বিশেষ ফারাক আরোপ করে (আইন সবসময়ই ‘সহিংসতা’র মাধ্যমে কাজ করে), তখন তা ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। তাহলে কি ধর্মীয় যুদ্ধের সহিংসতাকে জাতীয় ও ঔপনিবেশিক যুদ্ধের সহিংসতায় বদল করে শান্তির নিশ্চয়তা ইহজাগতিকতাবাদ দিতে পারে—যেমনটি ইওরোপ-আমেরিকার আগেকার জামানায় নজির আছে বলে বলা হয়? যুদ্ধ ও শান্তির মতবাদ হিসেবে ইহজাগতিকতা নিয়ে মুশকিলটা ঠিক এটা ইওরোপিয়ান বলে নয় (এবং, অতএব অ-পশ্চিমীয়দের কাছে আগন্তুক) বরং মুশকিলটা হচ্ছে এই যে এটা পূঁজিতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত—উভয়ে পারস্পরিকভাবে অবিশ্বস্ত এবং ক্ষমতা ও সম্পদের দিক থেকে সবমিলিয়ে অসম, উভয়ই একটি সামগ্রিক সত্ত্বা ধারণ করে যা ভিন্ন ভিন্নভাবে সমন্বিত সুতরাং ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্ভাবনাময় ও সমস্যা আক্রান্ত।

এই জায়গা থেকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক আমেরিকান জাতির মুখপাত্রদের প্রবণতা উল্লেখ করেছেন, এমন এক প্রবণতা যা সেপ্টেম্বর এগারোর ট্রাজেডির পর নাটকীয়ভাবে নতুন করে হাজির হয়েছে, আমেরিকান জাতিকে ‘শুভ’ নাম দিয়ে বিপরীতে এর ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের ‘শয়তান’(অশুভ) নাম দেয়া। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ঐতিহাসিক এরিক ফনার বলছেন, ‘এই দৃষ্টিভঙ্গির শেকড় আমেরিকার দুটি আলাদা ঐতিহ্যে, দেশটির ধর্মীয় মূলগত অবস্থান এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের উচ্চমাত্রার ধারাবাহিকতা শত্রুদের কেবল বিরোধী হিসেবে না দেখে শয়তান হিসেবে দেখতে আমেরিকানরা বেশি পসন্দ করে। দেশটির ধর্মীয় শেকড় এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের চলমান উচ্চমাত্রা আমেরিকানদের নিজেদের প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে না দেখে শয়তান হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত করেছে। তাদের এই বিশ্বাস তৈরি করেছে যে দুনিয়ায় উদারনৈতিকতার সর্বশেষ আশা হলো আমেরিকা সুতরাং যারা আমেরিকার প্রতিপক্ষ হয় তারা উদারনৈতিকতার প্রতিপক্ষ হয়।’ এই ঐতিহাসিকরা আমাদের বলছেন, এই ধরনধারনের ভেতরের প্রবণতা হচ্ছে জনগণের ভিন্নমতকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা হিসেবে ভৎর্সনা করা এবং বিভিন্ন অভিবাসী গোষ্ঠীর ওপর দমন চালানোকে আইনসিদ্ধ করা। ঐতিহাসিকেরা আঠারোশ’ শতাব্দির শেষের দিক থেকে অর্থাৎ রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমেরিকান জাতীয়তাবাদের (যেখানে অভ্যন্তরীণ মতভিন্নতা অসহিষ্ণুতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে বিশেষত যখন মতের ওই ভিন্নতাকে ‘বিদেশি’ বলে চিহ্ণিত করা হয়) পুনরাবৃত্তিমূলক খাসলতের তালাশ পেয়েছেন। এই খাসলতকে কি তার ধর্মীয় উৎপত্তির সম্পর্কের জায়গা থেকে বুঝতে হবে? কিন্তু বিংশ শতাব্দিতে তো রাজনৈতিক আক্রমণ এবং দমনমূলক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে সত্যিকার এবং কল্পিত সেকুলার বিরোধীদের লক্ষ্য করে। এই খাসলতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা আমেরিকার ধর্মীয় ভিত্তিমূল ও সমসাময়িক ধর্মচারণ বিবেচনার বাইরে রেখে আমেরিকার একটা আদর্শ সেকুলার গঠনতন্ত্র (কনস্টিটিউশন) থাকার কথা বলছেন, টেলরও যে বিষয়টি সঠিকভাবে নজরে আনছেন। কিন্তু আমার কথা বলার জায়গা হচ্ছে; আমেরিকার ইতিহাসে অসহিষ্ণুতার বিস্ফোরণ বারবার যে কারণেই ঘটুক না কেন—এগুলোকে যেভাবেই বোঝা যাক না কেন—এগুলো চরমভাবে আধুনিক সমাজের ইহজাগতিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ (প্রকৃতপক্ষে পরস্পরগ্রথিত)। এভাবে আমার কাছে মনে হয়, পরাশক্তি নিয়ন্ত্রিত দুনিয়ায় সেপ্টেম্বর এগারোর ট্রাজেডির তাৎপর্য নিয়ে কোনো টেকসই জন-বিতর্ক হয়নি। সবমিলিয়ে সংবাদমাধ্যম দুটো প্রশ্নের মধ্যে নিজেদের আটকে রেখেছে: একদিকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং ওয়ার অন টেররের ক্ষেত্রে নাগরিক স্বাধীনতা’র বিপদ, অন্যদিকে ধর্ম হিসেবে ইসলামের ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য আরবদের দায়িত্ব। (সেপ্টেম্বর ট্রাজেডির ওপর চিন্তাশীল অনেক রচনা এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এগুলো প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক বাহাসে প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না।) একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজে জন-বিতর্কের এই অনুপস্থিতি অবশ্যই সেই মধ্যস্থতাকারী প্রতিনিধিত্বের পরিভাষায় ব্যাখ্যা করার দরকার আছে যেই পরিভাষা ওই সমাজের জাতীয় চরিত্র নির্ধারন করে এবং যে ডিসকোর্স তাকে হুমকিতে ফেলে তা চিহ্ণিত করে।

আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো ইনডিয়া, একটি জাগতিক গঠনতন্ত্র সহ দেশটিতে সচল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যতিক্রমি রেকর্ড রয়েছে—সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার। এবং ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায়ই ইনডিয়াতে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (হিন্দু এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের মধ্যে, যেমন মুসলিম, খ্রিস্টান ও অস্পৃশ্য) হয়। পার্থ চ্যাটার্জি এবং অন্যান্যরা যেরকমটি বলছেন, ইনডিয়ার জনপ্রিয় জাতীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় পুর্নগঠিত উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদ প্রতিনিধিত্ব থেকে, এবং যারা ব্যক্তিত্বের এই ধরনের সাথে খাপ খায় না তারা অনিবার্যভাবে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। এটা প্রায়ই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের’ আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে পৌছে দেয়। একটি ইহজাগতিক রাষ্ট্র সহিষ্ণুতার নিশ্চয়তা দেয় না: এটা বরং আকাঙ্ক্ষা ও ভয়ের ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো। যেহেতু সবসময়ই আইনের লক্ষ্য হচ্ছে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা সুতরাং আইন কখনোই সহিংসতা নির্মুল করতে চায় না।

 

View: 7300 Posts: 5 Post comments

অনুবাদ আরো সহজ হওয়া দরকার।

পড়লাম। অনুবাদ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজ, তারপর আবার এইসব বই অনুবাদতো আরো কঠিন। তবে আমার মনে হয় অনুবাদ আরো সরল হওয়া দরকার। পড়তে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদ করা প্লেটোর রিপাবলিক, রুশোর দি কনফেশানস পড়েছি। একদম স্বচ্ছ পানির মত টলটলে অনুবাদ। সহজ অনুবাদ হলে অনেক পাঠক বইটি শেষ পর্যন্ত পড়তে আগ্রহ পাবে। অনুবাদক আরজুর কষ্ট আরো স্বার্থক হবে। আরজুর প্রচেষ্টা স্বার্থক হোক। গ্রেট জব।

তরজমার মুশকিল টুশকিল

স্বীকার করি- মুশকিল তো আছেই। ''সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার মতো শব্দের বাংলা ভাষায় প্রচুর অভাব।'' মানে ফোর্ট উইলিয়াম পরবর্তী বাংলাভাষা। সুতরাং সমস্যা আমার নিসন্দেহে আছে। সরদার সাহেবের রিপাবলিক কিংবা সংলাপ পইড়া আমারো আপনার মতো অনুভুতি হইছে। একেবারে ঝরঝরে অনুবাদ, মনে হয় না যে এইটা আগে অন্য কোনো ভাষায় লেখা হইছিল। চমৎকার! কিন্তু পেশাদার হিশাবে আমি যখন অনুবাদ করতে শুরু করি- আজ থেকে তিন বছর আগে। তখন থেকেই একটা বিষয় কাজ করতো যে, যে ভাষা থেকে আমি অনুবাদ করছি সেই ভাষার স্বতন্ত্র ব্যকরন-স্টাইল ইত্যাদির স্বাদ যদি কিছুটা হইলেও পাঠকরে না দেওন যায় তাইলে কেমন হইলো! তো সেইটা করতে গিয়া আমরা দৈনিক পত্রিকার পাঠকের কাছে যেসব বিদেশি শব্দের অর্থ কিংবা ব্যঞ্জনা পরিচিত সেইগুলান ওই ভাষায়ই রাইখা দিতাম। আর বাকি গুলান যথাসম্ভব বাংলা ভাষার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আদলের সাথে পরিচিত শব্দাবলি ব্যবহার করতাম। কিন্তু জ্ঞানচর্চার নানা শাখা- যেগুলো ফোর্ট উইলিয়াম পরবর্তী সময়ে বাংলাভাষার বিচরন নাই সেগুলাতে পরিভাষা ইত্যাদি নিয়া কিছুটা ঝামেলা তো আছেই। সাইজির ইচ্ছায় কাটায়া উঠবো।

জরুরি কাজ

তালাল আসাদের বইটির অনুবাদ হওয়াটা খুবই জরুরী ছিল। আরজু ভাইকে ধন্যবাদ যে তিনি কাজটিতে হাত দিয়েছেন। আন্তরিকভাবে তার সফলতা কামনা করছি।

mahadi ভাই এর জরুরি মন্তব্যেলোচনা চাই

দোয়া তো চাই-ই। যাতে দোজাহানে অশেষ কামিয়াবি হাছেল করতে পারি। সেই সাথে মন্তব্য চাই। আলোচনা চাই। জরুরি ভিত্তিতে।

I made an attempt to go through this section, but found it very exhausting. Being a translator I understand translating something like this is a difficult task. I think, avoiding dictionary words would have been a good idea. Translator may also consider style of phrasing/rephrasing the santences as well.
Home
EMAIL
PASSWORD