চিনুয়া আচেবের থিংস ফল এপার্ট : উত্তর-ঔপনিবেশিক বিবেচনা


মোকাররম হোসাইন
Friday 23 October 09

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে যে সম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে কারাগত করেছিল সে এখনও ভিন্ন মাত্রায় অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে অন্য পৃথিবীকে (the other of Europe) উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে। ঔপনিবেশিক কালে শাসন ও শোষণের সার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট ছিল গণমানুষের চেতনার শিকড়। ফলে প্রত্যক্ষ শাসন হতে মুক্ত হলেও ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্যান-ধারণা পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখে। উপনিবেশবাদ তৈরি করে আধুনিকতায় লালায়িত প্রাশ্চাত্যবাদী এক শ্রেণী,যারা আধুনিকতা ও প্রগতির নামে অব্যাহত রাখে উপনিবেশিক সম্পর্ক ও জ্ঞানগত অধীনতা। পৌরাণিক দেবত্ব ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে আধুনিকতা ও প্রগতি মানব মনের অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। হয়ে উঠতে চায় ঐশ্বরিক সার্বভৌম। তাকে প্রশ্ন করা যায় না, বরং মেনে নিয়ে চর্চা না করলে আখ্যা পেতে হয় সেকেলে,সংস্কারগ্রস্থ,রক্ষণশীল। ফ্রানজ ফানো বলেন, ঔপনিবেশিক শক্তি যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করায়,সেখানে সব শিশুদের শেখানো হয় ইওরোপীয়দের আগমন ইতিহাস,সংস্কৃতি ও প্রগতির সূচনা বিন্দু। উপনিবেশীতের অতীতকে অসংলগ্ন বিকৃত সংকীর্ণ বিশ্ববীক্ষা দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়। উপনিবেশ পূর্ব সময়কে বর্ণনা করা হয় অ-সভ্যতা,ইতিহাস-শুণ্যতা ও বর্বরতার যুগ হিসেবে। ফলে গণমানুষের চেতনায় আত্ম ও অতীত হয়ে উঠে পরিত্যাজ্য। আর পশ্চিমের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আরাধ্য হয়ে উঠে। আপনকে পর ও পরকে আপন জ্ঞান করার পরিণতি উপনিবেশীতের,বিশেষত মধ্যবিত্তের চেতনায় বিকৃতি আনে।

অনিবার্যভাবে,একজন উত্তর-উপনিবেশী চিন্তক ইওরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস নির্মাণ ডিসকোর্সের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। উপনিবেশবাদী ইতিহাস আখ্যান হতে তাঁর ইতিহাসকে বিকৃতি ও কালিমা মুক্ত করে পুনঃনির্মাণ করা এবং পুনঃসঙ্গায়িত করার মধ্য দিয়ে আত্মঅতীত পুনরুদ্ধার করা ও আত্নপরিচয় সন্ধান করা এবং ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা উৎখাত করার তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া। ইতিহাসের প্রমিত ভাষ্যের সাথে তার বোঝাপড়া তাই অকুতোভয় বিদ্রোহী সৈনিকের। চিনুয়া আচেবে আবির্ভূত হন একজন উত্তর-উপনিবেশী কলম সৈনিকের ভূমিকায়। যোসেপ কনরাডের Heart of Darkness কিংবা যয়েস কেরির Mister Johnson-এ অফ্রিকান ইতিহাসের যে বিকৃত,খন্ডিত,বর্ণবাদী উপস্থাপনা তাকে খারিজ করে আফ্রিকান সাহিত্যে চিনুয়া আচেবের Things Fall Apart এক নতুন পথের দিশা দান করে,নতুন যুগের গোড়া পত্তন করে।

উত্তর-উপনিবেশী উপন্যাসের ধারায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পূর্ব নাইজেরিয়ায় ইওমোফিয়ার ইগবো গ্রাম। সময় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের কয়েক দশকা। আত্মপ্রত্যয়ী মুখ্যচরিত্র ওকোনকোর উত্থান পতনকে কেন্দ্র করে তিনভাগে বিভক্ত এ গল্পের আখ্যান রচিত হয়। ওকোনকোর জীবনচিত্র আঁকতে আঁকতে আচেবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ঠিক পূর্ববর্তী,সমসাময়িক এবং অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে ইগবোদের সজীব,টলটলে জীবন স্রোতে টেনে নিয়ে যান তাঁর পাঠককে।

প্রথম পর্ব ইগবো প্রতিবেশে সমাজ সিঁড়ি বেয়ে ওকোনকোর উচ্চে আরোহনের গল্প। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় ইগবো সংস্কৃতির বীর গুকোনকোর শারীরিক সক্ষমতার উদ্বোধন। বলি খেলায় পরাক্রমশালী আমালিনজ দ্যা ক্যাটকে পরাজিত করে শারীরিক ক্ষমতার খ্যাতি অর্জন। যে শারীরিক শক্তি,সম্পদ,বীরত্ত্ব ও স্ত্রী সংখ্যা ইগবো সমাজে উপরে উঠার মানদন্ড,সবকিছুই ওকোনকো অর্জন করে অগাধ পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্প দিয়ে এবং পরিণত হয় গ্রামের ক্ষমতা বলয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে। আর তার জীবনের ঘটনা প্রবাহে ইগবো জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে এমনসব বৈশিষ্ট্য যেমন––সম্পদের ধারণা,বিয়ে,উপাসানা,বিচার ব্যাবস্থা,যুদ্ধ,ভাষা,সবকিছুই দক্ষ নৃতাত্ত্বিকের গভীর অনুসন্দিৎসায় আচেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু ওকোনকোর নির্দয়তা তার কষ্টার্জিত মর্যদাকে কিছুটা অনিশ্চতায় ফেলে। পুরোহিত এযেদুর এক ছেলেকে সে যখন দুর্ঘটনাবশত হত্যা করে,গ্রাম থেকে সাত বছরের জন্য নির্বাসিত হয় নিকটবর্তী এম্বটানার এক গ্রামে। কাহিনীর এ অংশে আচেবে উপনিবেশপূর্ব ইগবো সমাজ পুননির্মাণ করেন। ইগবো এক সুস্থিত,চলমান ও যুথবদ্ধ সম্প্রদায় যাদের আছে কর্মনীতি এবং যারা ব্যক্তিগত অর্জনকে মূল্যায়ন করে। আছে বিশদ বিচার ব্যবস্থা এবং নমনীয় সরকার পদ্ধতি। ব্যাপক বিস্তারিত ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান ইগবো সম্প্রদায়ের সত্তাজ্ঞানের (ontological) অনুভূতির অংশভাগ। তবে ইগবো অতীতকে ভাবালুতায় পর্যবশিত করা দৃঢ়ভাবে এড়িয়ে যান আচেবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে অনুমদিত নৃসংশতা,আচার হিসেবে পালিত যৌনতা,জমজ সন্তান পরিত্যাগ, নিয়মিত মানব বলিদান––এসবও বাদ পড়ে না তার অতীতের প্রতি সংবেদনশীল লেখনীতে। আচেবে আবার ওবিয়েরিকার মত সংস্কারমনা চরিত্র সৃজন করে এটাও স্পষ্ট করেন যে,ইগবো কৃষ্টিতে অন্তর্গতভাবে সঞ্চারিত ছিল গতিশীল পরিবর্তন সক্ষমতা।

chinua achebeদ্বিতীয় পর্বে, নির্বাসিত জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা জগত ও জীবন সম্পর্কে ওকোনকোর উপলব্ধি পাল্টে দেয়, পোড় খাওয়া জীবন স্বজাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা দান করে তাকে। অতিমাত্রিক আত্বসর্বস্বতার বিপদ সম্পর্কে সে সচেতন হয়ে উঠে,এবং আত্মিয়তা ও স্বজাতির প্রতি তার ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি তাকে মহৎ মানুষে পরিণত করে। আসন্ন উপনিবেশবাদের অশুভ লক্ষণ এবং সেটা প্রতিরোধে তার সংকল্পও এই পর্বে স্পষ্ট হয়ে উঠে।

তৃতীয় পর্বে, ওকোনকো ফিরে আসে ইওমোফিয়ায়,যেখানে সে আবার নিজেকে পুনরায় একীভূত করতে চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ইওমোপিয়া ভীষণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। সব কিছু ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে––উপনিবেশী প্রশাসনিক কাঠামোর নির্বিঘ্ন সক্রিয়তা আনে সনাতন জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন। বৃটিশ মিশনারীদের আগ্রাসী ধর্মপ্রচার সূচিত করে নতুন মূল্যবোধ, যেটা জাতিগত একতা বিনষ্ট করে। ওকোনকোর স্বপুত্র নওয়ি খ্রিস্ট বিশ্বাস গ্রহণ করে এবং প্রত্যাখান করে পিতাকে। পরিবর্তনের প্রতি ওকোনকোর সহিংস প্রতিরোধ তাকে অন্তরাল করে কারাগারে। উপনিবেশী প্রশাসনের ভয়ে ভীত তার স্বজাতীর স্বজনরা তাকে সামান্যই সাহায্য প্রদান করে। নতুন বাস্তবতার সাথে আপোষে অনিচ্ছুক ওকোনকো আত্বহণনে অসীমের অনন্ত যাত্রায় শামীল হয়ে যায়।

উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে বিস্ময়করভাবে বক্রাঘাতমূলক (ironical) এক অনুচ্ছেদে। যে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ওকোনকোর জটিল জগত হাজির হয়েছিল,এক মুহূর্তে আচমকা তা দিক বদলায় উদ্ধত ও সংকীর্ণ বৃটিশ সাম্রাজ্যের বংশবদ জেলা প্রশাসকের দিকে। তার সীমিত বিশ্ববীক্ষা আফ্রিকাকে মামুলি গৎবাঁধা ধারণায় পর্যবসিত করে,যে ধারণাকে উপন্যাসটি শুরুতেই সফলভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিল।

ওকোনকোর উত্থান-পতনের কারণ তালাশ করতে গেলে তার ট্রাজেডির সম্মিলিত মাত্রাসমূহ সচেতনভাবে ভাবতে হয়। যে মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ তাকে ধারণ করেছিল,উপনিবেশবাদের সম্মুখে সেগুলো যখন ভেঙ্গে পড়ছিল,তখন তার পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী। জীবনের অগাধ পরিশ্রম দিয়ে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল,উপনিবেশী শক্তির সম্মুখে সে তা বিসর্জন দিতে পারে না। আত্মসমর্পন করে খ্রিস্টান হতে পারে না। আত্মহননই তার ট্রাজেডির পরিণতি। ওকোনকোর নিজের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার যে সংকট,তার সাথে আপন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক সংকটের নিবিড় সর্ম্পক আছে। নয়া-ঔপনিবেশিকতা সম্প্রদায়ের চিহ্নায়নের বৈশিষ্ট্যগুলো অবমূল্যায়ন করে ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। এ ইস্যুগুলো Things Fall Apart-এ খুব বলিষ্টভাবে এসেছে।

Things Fall Apart-এর ভাষা ইংরেজি,প্রকরণের দিক থেকে উপন্যাস। প্রখ্যাত কেনিয়ান লেখক নগুজি ওয়া থিওঙ্গো (Ngugi wa Thiong’o) ভাষাকে মানুষের বিশ্ববীক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। ইংরেজিতে লেখালেখি করে আফ্রিকার প্রধানতম লেখকদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া সত্ত্বেও তিনি ইংরেজিতে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে তার অখ্যাত মাতৃভাষা গিকুয়ুতে (Gikuyu) লেখালেখি শুরু করেন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তবে ঔপনিবেশিকের ভাষার ইওরোপীয় আদর্শ আগ্রাহ্য করে দেশজ শব্দ,বাগবিধী ও অভিব্যাক্তির পুনঃপুনঃ প্রয়োগে ঔপনিবেশিকের ভাষাকে বিনির্মাণ করা ও ভাষার উপর সাম্রাজ্যবাদী কতৃত্ব খর্ব করে দেওয়ার ভিন্ন এক উত্তর-উপনিবেশী প্রকল্পও কেউ কেউ গ্রহণ করেন। আচেবের অন্যসব উপন্যাসের মত Things Fall Apart আফ্রিকান ভাষারীতিকে ঔপনিবেশকের ভাষায় সমন্বয় করার কষ্টসাধ্য এক প্রচেষ্টা। আচেবে তার নিজ কৃষ্টিকে উপস্থাপন করেন ইগবো ভাষার লোকজ অলংকারে,বিশেষ করে প্রবাদ ও প্রবচনের কথ্য-রূপে ঔপনিবেশকের ভাষার অটুট শৃংখলার মূলে কুঠারাগাত করে। প্রকরণের দিক থেকেও আচেবে গ্রহণ করেন নি ইওরোপীয় উপন্যাসের আদর্শ।প্লট বুননের যে দুর্বলতা (আধুনিক ইওরোপীয় উপন্যাস সাপেক্ষে)কতিপয় সমালোচক আবিষ্কার করেন সেটা মূলত আচেবের ইচ্ছাকৃত বিচ্যুতি। গল্প বলার যে কথ্যরীতি ইগবো ঐতিহ্যে বজায় ছিল সেটাকে অবলম্বন করতেই আচেবে সরে আসেন ইওরোপীয় আদর্শ থেকে।

Things Fall Apart রচনার মধ্য দিয়ে আচেবে আফ্রিকান সাহিত্যে বি-উপনিবেশায়ণের (decolonialism) যে ধারাপত্তন করেন তা আফ্রিকান মানস হতে পাশ্চাত্যায়ণের বিকৃতি সারাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আত্নপরিচয়ের হিনমন্যতা সংকট তাদের জর্জরিত করে না। অলিম্পিক গেমসের উদ্ভোধনী পর্বে স্যুট পরে ভদ্দরলোক সাজতে হয় না তাদের। “আমি খুবই আনন্দিত হব যদি আমার উপন্যাসগুলো (বিশেষ করে যেগুলো আমি অতীত প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছি) আমার পাঠকদের এতটুকু পাঠ দিতে পারে যে তাদের অতীত সব অপূর্ণতা সত্ত্বেও বর্বরতার একটা দীর্ঘ আন্ধকার রজনি ছিল না,বরং ‘খোদার প্রতিনিধি’ প্রথম ইওরোপীয়রাই অমানিশার আঁধারি নিবেদন করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের।” আচেবের এ আশাবাদ আফ্রিকানরা ব্যর্থ হতে দেয় নি। কারণ ইগবো প্রবাদেই আছে: “Where one thing falls, another stands in its place” এবং “When the moon is shining, the cripple becomes hungry for a walk”।

 

View: 11722 Posts: 1 Post comments

চিনুয়া আচেবের থিংস ফল এপার্ট : উত্তর-ঔপনিবেশিক বিবেচনা

চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। আমি তার No Longer at Ease পড়েছিলাম। এখানে ওকোনকোর নাতি'র গল্প বলা হয়েছে। যেখানে উপনৈবেশিক শাসন পরবর্তী বিচ্যুতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পড়তে পড়তে বার বার মনে হচ্ছিল এ যেন আমার সমাজের কাহিনী। শুধুমাত্র স্থান আর নামের পার্থক্য। যা অনুভূতির মর্মে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। আপনার কাছে আরো লেখা আশা করছি।।
Home
EMAIL
PASSWORD