গুয়ানতানামো’র সংগীত-অস্ত্র


মোহাম্মদ আরজু
Wednesday 20 January 10

আধুনিক ‍দুনিয়াদারির নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে যে, সংগীত শুধু জীবনের ভাষা-ই নয়, একই সাথে মরন-যন্ত্রণার ও স্বাদ দিতে পারে সংগীত। জনপ্রিয় ইওরোপীয় ম্যাগাজিন ডার স্পিগেলে ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত টোবিয়াস র‌্যাপ-এর নিবন্ধ অবলম্বনে।

মে, ২০০৩; সেদিন গুয়ানতানামো উপদ্বিপের ডেল্টা বন্দিশালায় আটক রুহাল আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নেয়া হয়েছিলো গান শোনানোর জন্য! একজন সামরিক পুলিশ এসে আহমেদকে তুলে নিয়ে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে, তখনো আহমেদের জানা ছিল না যে ওই কক্ষে আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে সংগীতায়োজন- নিত্যকার নির্যাতনের নির্ঘন্টে আজ নতুন মাত্রা পাবে। জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের মেঝেতে লাগানো লোহার রিং এর সাথে তার পা আটকে দেয়া হলো, হাত দুটো একসাথে পিছমোড়া করে বেধে মেঝেতে লাগানো রিং এর সাথে জুড়ে দেয়া হলো। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না, আবার বসে পড়াও অসম্ভব এবং হাটু মুড়ে থাকাও সম্ভব না। আর এভাবে কিছুক্ষণ থাকলে পরেই খিচুনি শুরু হয়ে যায়। এরকম নির্যাতনের সাথে ভালোই পরিচয় ছিলো তার, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের ‘মানসম্মত পরিচালন প্রক্রিয়ার’ অংশ এটা, বন্দি অবস্থায় প্রতিদিনের একটা বড় অংশ আহমেদদের এভাবেই কাটতো। এভাবে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে একটা প্রশ্নই বারবার করা হয়েছিল- তিনি এবং তার বন্ধু ২০০১ এর শরতে আফগানিস্তানে কি করছিলেন? সেদিনও একই প্রশ্ন অপেক্ষা করছে সেটা জানতেন তিনি। কিন্তু যা জানতেন না তা হলো- ছিয়াশি বর্গফুটের কক্ষটিতে সেদিন একটা দশাসই আকারের সাউন্ড বক্স ছিলো, ওপরে একটা সিডি প্লেয়ার। একজন সৈনিক ঢুকে প্লেয়ারে একটা সিডি ঢুকালো, প্লেয়ার চালু করে সর্বোচ্চ স্বরে উঠালো, এবং দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। সিডিটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে র‌্যাপ গায়ক এমিনেম-এর। আহমদ বলছেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কি হচ্ছে। ভাবলাম, ওরা সাউন্ড বক্সের কথা ভুলে গেছে।’ সৈনিকটি যখন আবার ফিরলো আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে তাকালো ঠিকই আমার দিকে কিন্তু কিছু বললো না।

এরপর থেকে যতদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নেয়া হতো, বারবারই নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো সংগীত। প্রতিদিন নিশ্চয় এমিনেম নয়। কোনোদিন রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিনের রক গান আবার কখনো অন্য কোনো গায়কদলের ভারী বাজনাওয়ালা (হেভি মেটাল) গান ইত্যাদি। স্বরের মাত্রা ছিলো কানফাটানো, এভাবে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনতে বাধ্য করা হতো, ওই ছিয়াশি বর্গফুটের কক্ষে- না দাঁড়ানো না বসা অবস্থায়। কখনো এক নাগাড়ে কয়েক দিন ওভাবে রাখা হতো। প্রায়ই তার মুখের ঠিক সামনে ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে রাখা হতো। বাদবাকি অন্ধকার। তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, এবং কানের ঠিক কাছে চরম উচ্চস্বরে বাজছে ভারী বাজনাওয়ালা গান। আবার কখনো কক্ষের তাপমাত্রা একেবারেই কমিয়ে দেয়া হতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে। কনকনে বরফ ঠান্ডা, অন্ধকার, চোখের সামনে উজ্জ্বল বাতি, কানের কাছে কানফাটানো রক এন রোল! অসহ্য যন্ত্রণায় খিচুনি খেতে খেতে এভাবে আর কাদের কবে সংগীত উপভোগ করতে হয়েছে? গুয়ানতানামো ছাড়া?

 

আড়ালের সংগীত

অবশ্যে এরকম চরম সংগীতায়োজন না হলেও সংগীত হামলার আরো কিছু দৃষ্টান্ত আছে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফেই। পানামার শাসন ম্যানুয়েল নরিগো যখন ১৯৮৯ সালে পানামাস্থ ভ্যাটিক্যান দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী দূতাবাসে কয়েক দিন ধরে বোমা হামলার পাশাপাশি আরেক ধরনের হামলা চালিয়েছিল। রাস্তায় সাজোয়া গাড়ি ও আকাশে কপ্টার থেকে উচ্চস্বরে রক এন রোল হামলা করেছিল দূতাবাস লক্ষ্য করে। আবার যেমন ১৯৯৩ সালে টেক্সাসে একটি খামার বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া একটা গোষ্ঠীকে বের করে আনার জন্য লাউড স্পিকারে সংগীত হামলা করেছিল। ন্যান্সি সিনাত্রা’র বাজার পাওয়া গান- দিজ বুটস ওয়ার মেইড ফর ওয়াকিং বাজিয়েছিল এফবআই এজেন্টরা। উদ্দেশ্য পরিস্কার- খামারবাড়ী থেকে বেরুবে না বলে পন করা ওই ভিন্নমতালম্বি নাগরিক গোষ্ঠীটিকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে তোলা।

পাঠক! জানাচ্ছিলাম গুয়ানতানামোর সংগীত আয়োজনের কথা। রুহাল আহমেদ- সংগীত নির্যাতনের শিকার অগুনতি বন্দিদের একজন মাত্র। আহমেদের পরিবার মূলত বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাজ্যে যায়। এখন তাদের বাস দেশটির বার্মিংহামের কাছের ছোট্ট শহরে- টিপটন। তিন বন্ধু ছিলেন গুয়ানতানামোয়। ছাড়া পাবার পর সংবাদ মাধ্যমে পরিচিত হয়েছেন টিপটন থ্রি নামে। ২০০১ এর সেপ্টেম্বরে কুড়ি বছর বয়সী আহমেদ আর দুই বন্ধু পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এক বিয়েতে। ততদিনে ওদিকে আফগানিস্তানে শুরু হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি। রোমান্ঞের তালাশে তিনি বন্ধু সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন আফগানিস্তানে। পাকিস্তানে ফেরার সময় যুক্তরাষ্ট্রের দালাল উত্তরাঞ্চলীয় জোট তাদের আটকে দেয়। তারা তিনজন ইংরেজিভাষী এবং মুসলিম, অথচ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্র কিংবা তাদের দালালদের কারো হয়ে আসেন নি ২০০১ এর আফগানিস্তান; সুতরাং আল কায়দা না হয়ে উপায় নাই! তাদের দখলদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। ২০০২ এর শুরুতে তাদের ডেল্টা বন্দিশালায় ঢোকানো হয়। ছাড়া পান ২০০৪ এর মার্চে। আহমদের বয়স এখন আটাশ।

টিপটনের নিম্নশ্রেণীর আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে তিনি ডার স্পিগেলের প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আমি যখন লোকজনকে বলি সংগীতও জুলুম হতে পারে তখন তারা ভাবে আমার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। লোকজনকে এতো আনন্দ দেয় যে শিল্প সেটা আবার কিভাবে জুলুম হয়? কিন্তু আমার কথা সত্য। আপনি স্বাভাবিক জুলুম সামলে নিতে পারেন, কিন্তু সংগীতের জুলুম সহ্য করা সম্ভব না। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা যা শুনতে চেয়েছে তার সবই আমি তাদের বলেছি; যে আমি বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সাথে দেখা করেছি, আমি তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানি। আমি শুধু তাদের বলছিলাম গান থামাতে।’ শুধু গুয়ানতানামোয় না, আফগানিস্তান ইরাক সহ সারা দুনিয়াজুড়ে সিআইএ’র গোপন বন্দিশালাগুলোতে এমন সব শিল্প-অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। পানিতে চুবিয়ে রেখে, ঘুমাতে না দিয়ে, কাঠের ছোট্ট বাক্সে ঢুকিয়ে, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সর্বোচ্চ স্বরে রক এন রোল এবং হেভি মেটাল গান শুনতে বাধ্য করা হয়েছে বন্দিদের; যেমন বি গিজ গায়কদলের গান ‘স্যাটারডে নাইট ফিভার’।

বেপরোয়া গায়কদের মাঝে প্রতিবাদী কজন

যেসব গায়ক বা গায়কদলের গান জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের খুব কমই এযাবত আপত্তি জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে বিষয়টি জানাজানি হবার পর অবশ্য দেশটির ওইসব রক গায়কদের মোটেই বিচলিত মনে হয়নি। বরং অনেককেই মনে হয়েছে যে তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার মতো কিছু মনে করেন না। শুধু একটা গায়কদল- রক গোষ্ঠী রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন এর পক্ষে গায়ক টম মোরেলো তাদের তীব্র প্রতিবাদের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে রক গায়ক ট্রেন্ট রেজনর ও কান্ট্রি সং গায়ক রোজানে ক্যাশ আপত্তি জানিয়েছেন এবং জানতে চেয়েছেন ঠিক কিভাবে তাদের গানকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বামপন্থার প্রতি অনুরক্ত গায়কদল ‘রেইজ অ্যাগেইনস্ট দ্য মেশিন’ এর বেজ গিটারিস্ট টম মোরেলো দেশটির জনপ্রিয় সংগীত-সাময়িকী স্পিন’কে বলেছেন ‘এমন বর্বর জুলুমে আমাদের গান ব্যবহার করা হয়েছে! এটা খুবই বিরক্তিকর। আপনি যদি আমাদের আদর্শিক পক্ষপাতের ও মানবাধিকারের প্রতি আমাদের সমর্থনের কথা জানেন তবে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর।’ অনেকেই আবার তাদের গর্বের কথা জানিয়েছেন। যেমন দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্রের ভারি বাজনাওয়ালা (হেভি মেটাল) গায়কদল ‘মেটালিকা’র গায়ক জেমস হেটফিল্ড- এই গায়ক জানিয়েছেন ‘জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে তার গান ব্যবহৃত হওয়ায় তিনি গর্বিত।’

তবে আরো যাদের গান ব্যবহৃত হয়েছে তাদের অধিকাংশ গায়ক এবং গায়কদল এখনো চুপচাপ। যেমন; এসি/ডিসি, ব্রিটনি স্পিয়ার্স, নেইল ডায়মন্ড, অ্যারোস্মিথ, ব্রুস স্প্রিংস্টন, ক্রিস্টিনা অ্যাগুলেরা, ডেভিড গ্রে, ডিসাইড, ডন ম্যাকলেন, ডক্টর ড্রি, ডোপ, ড্রাউনিং পুল, জেমস টেলর, লিম্প বিজকিট, ম্যারিলিন ম্যানসন, ম্যাচবক্স টুয়েন্টি, মিট লোফ, পিংক, প্রিন্স, কুইন, রেড হট চিলি পেপারস, নাইন ইঞ্চ নেইলস, রেডম্যান, স্ট্যানলি ব্রাদারস, এবং স্যালিভা। এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নাগরিক সংগঠন- দি ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ সরকারের কাছে তথ্য সরবরাহের আবেদন করেছে। ১১ টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তারা তথ্য চেয়েছে যে সবমিলিয়ে কাদের গান কিভাবে জুলুমের কাজে ব্যবহার হয়েছে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সরবরাহের জন্য। যেমনটি আগে বলেছি কিছু শিল্পী এই দাবিতে সংগঠনটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

সংগীতের প্লাবনে মুছে ফেলো বোধ

সংগীতকে জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার এই উপায় উদ্ভাবন করে সিআইএ, ১৯৬৩ সালে, ভিয়েতনাম আক্রমণের সময়। সিআইএ’র ম্যানুয়ালে উপায়টি সর্ম্পকে বলা হয়েছে, সংগীতের প্লাবনে বন্দির বোধ শক্তি ডুবিয়ে দেয়া অথবা তাকে বোধ শক্তির অনুভব থেকে বঞ্চিত করার উপায় এটি। গুয়ানতানামোর তথ্য বেরোনোর আগে সবাই মনে করতো যে যুক্তরাষ্ট্র এই পদ্ধতি আর ব্যবহার করছে না। তবে নিজেদের সেনাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়- সেটা জানা ছিলো। একই পদ্ধতি যদি শত্রুপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তবে কি করে তাকে রুখবে সেনারা- সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ চালু আছে সিআইএ’র তদারকিতে- এসইআরই অর্থাত সার্ভাইভাল, ইভ্যাশন, রেজিস্ট্যান্স এবং এসকেপ- এতে সৈনিকদের শেখানো হয় যে কিভাবে তারা এমনতরো জুলুম থেকে নিজেদের বাঁচাবে।

স্পর্শহীন জুলুম

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ জিজ্ঞাসাবাদের নতুন পদ্ধতি গড়ে তুলতে ওই এসইআরই প্রকল্পের আওতায় ২০০১ সালে সিআইএ একজন মনোবিদকে চাকরি দেয়। মনোবিদের নেতৃত্বে খুব শীঘ্রই- ২০০২ সালের গ্রীষ্মে চুড়ান্ত হয় ‘জিজ্ঞাসাবাদের বিশেষ পদ্ধতিসমূহ’; যার মধ্যে প্রধান হলো ‘সংগীত পদ্ধতি’। এই পদ্ধতিকে সংক্ষেপে এভাবে বণর্না করা হয়; চরম শীতল বা উত্তপ্ত তাপমাত্রাওয়ালা ছোট্ট কক্ষে বন্দিকে যন্ত্রণাকর শারীরিক অবস্থায় রেখে দীর্ঘ সময় ধরে তার কানের খুব কাছে উচ্চস্বরে গান বাজানো- অবশ্যই হেভি মেটাল-রক এন রোল বা র‌্যাপ গান, এবং এই সংগীতায়োজনের অধিকাংশ সময় জুড়েই বন্দির চোখের একদম সামনে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি চালু থাকে। এই পদ্ধতিতে জুলুমের কোনো আলামত পরে আর দৃশ্যমান থাকেনা, কাজেই একে বলা হয়- ‘স্পর্শহীন পদ্ধতি’।

মগজের দখল নেয় সংগীত

রুহাল আহমেদ বলছেন, যখন বন্দিদের মগজে সংগীত চাপিয়ে দেয়া হয় তখন জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কেউ কক্ষে আসলেও আসতে পারে, এসে চিৎকার করে কানের মধ্যে প্রশ্নটা আবার ‍ছুড়ে দিয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই কেউ আসে না। শুধু সংগীতের যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং এমন এক অনুভূতির জন্ম হয় যে এই যন্ত্রণা বুঝি আর শেষ হবে না! বিষয়টা এমন যে আপনার মাইগ্রেন এর ব্যাথা আছে এবং একজন এসে আপনার মাথার মধ্যে প্রকটভাবে চিৎকার করছে, হাজার হাজারবার। তিনি জানান, ওই অবস্থায় ‘আপনি কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারবেন না। বন্দি হওয়ার পর প্রথম যখন আমাকে প্রহার করা হতো, আমি কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে আমি যন্ত্রনা ভোলার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু সংগীত আপনাকে একদম উন্মুল করে দেবে। আপনার মন-মগজের দখল নিয়ে নেবে। আপনার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন এবং জেগে থেকেই খাব দেখতে শুরু করবেন। মনে হবে যে আপনাকে দরজার মেঝেতে রাখা একটা পাথরের নীচ দিয়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এবং পাথরের ওপাশেই ওত পেছে উন্মাদনা, পাথরের সীমানা পেরিয়ে একবার দরজার ওপাশে পৌঁছলেই আর কোনো ফিরে আসা নেই। এমন পাথুরে চৌকাঠের নিচে আমি ছিলাম, অগুনতিবার।

আওয়াজ এর বদলে সংগীত কেন?

এমনতরো জুলুমে কেন সংগীতকে ব্যবহার করা হচ্ছে? কেন শুধু উচু আওয়াজ ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই প্রশ্নের জবাবে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজানে চসিক জানিয়েছেন যে, কখনো কখনো শুধু আওয়াজও ব্যবহার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে সংগীতের ব্যবহার’ বিষয়ে গবেষণা করছেন সুজানে, তিনি বলছেন ‘সংগীত সহজলভ্য, আওয়াজ ততটা না। তার ওপর কথা হচ্ছে; ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে অনেক গোষ্ঠীর কাছে সংগীত শোনা পাপের কাজ, বিশেষ শর্ত ছাড়া। শর্তটি হচ্ছে, সংগীত অবশ্যই শুধু মানুষের কন্ঠের থেকে হবে। বাজনা সহ সংগীত কখনোই নয়। যে কন্ঠ সংগীতে খোদায়ী নৈকট্য অনুভূত হয়। তাদের এই বাজনা সহ সংগীত শোনানোর মানে হলো- সাংস্কৃতিকভাবে উপহাস করা। দেখা যাচ্ছে, (এই ভারি বাজনাওয়ালা সংগীত) নিজেই আমাদেরকে আমেরিকান সেনাদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে অনেক কথা জানান দিচ্ছে।

ব্রিটনি যখন জালেম

গুয়ানতানামোতে ব্যবহৃত গানগুলোর তালিকা আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিগত তিন দশকের জনপ্রিয় গান’ এর তালিকার মাঝে খুব বেশি ফারাক নাই। ট্রাম্পেট বাজনার গান আছে- যে গান আমেরিকার বিজয়ের গান হিসাবে গাওয়া হয়। যেমন কুইন-এর গান ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়নস’ কিংবা ব্রুস স্পিংস্টনের ‘বর্ন ইন আমেরিকা’- যেসব গান ‘আমেরিকা’র শ্রেষ্ঠত্ব আর অহংকারের কথা কয়। বন্দিদের কানে যেন ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে- আমেরিকা জয়ী আর তোমরা হেরে গেছো। যে তালিকায় আরো আছে ব্রিটেনের সফট-রক গায়ক ডেভিড গ্রে’র ‘ব্যাবিলন’, আছে মেটালিকা’র ‘এন্টার স্যান্ডম্যান’ কিংবা নাইন ইঞ্চ নেইলস এর ‘মার্চ অফ দি পিগস’; যেসব গান সচেতনভাবেই বাছাই করা হয়েছে, বন্দিদের অনুভূতিকে আহত করা জন্য। তালিকায় আছে মূলধারার রক, হিপ হপ, কান্ট্রি সং; সই যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে টপ চার্টে থাকা গান। চারপাশের যুদ্ধাবস্থাকে ছাপিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা যেসব গান শোনে, টহলে থাকার সময়।

জুলুমে চুড়ান্তভাবে লক্ষ্য থাকে বন্দিদের যৌনভাবে অবমাননা করা। এ লক্ষ্যে বাছাই করা হয়েছে- ক্রিস্টিনা অ্যাগুইলেরা এবং ব্রিটনি স্পিয়ার্সের মতো গায়কের গান।

মেটালিকা : আমি এটাকে সম্মান জ্ঞান করি

মেটালিকা- লস এঞ্জেলস-এ ১৯৮১ সালে জন্ম নেয়া গানের দল, এখন দুনিয়াজুড়ে মেটাল সংগীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। দলটির প্রধান গায়ক জেমস হ্যাটফিল্ড এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, বন্দিদের ওপর জুলুমে তার গান ব্যবহৃত হয় শুনে তার খুশি লাগছে। তিনি বলছেন ‘আরেকটা নাইন-ইলেভেন অথবা ওরকম কিছু রুখে দিতে আমাদের গান কাজে লাগতে পারে, এটাকে আমরা আমাদের প্রতি সম্মান হিসেবে জ্ঞান করি।’ দুশমনকে হারিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের একজন সাহায্যকারী মনে করেন হ্যাটফিল্ড। এর পেছনে শ্রোতাদের দেশপ্রেমের ডোজ দেয়ার লক্ষ্য আছে নিশ্চয়।

আসল ঘটনা হচ্ছে; আধুনিক সমাজের একজন তরুণ-যুবক হওয়া যে কষ্ট ও নিদারুন যন্ত্রণার, তা সংগীতের অন্য যে কোনো ধরনের চেয়ে মেটাল বা হেভি মেটাল সংগীতেই প্রকাশ করা সম্ভব। এ হচ্ছে আধুনিক যুবকের জীবন-নরকের থেকে সৃষ্ট এক শিল্প মাধ্যম। যেসব তরুণ-যুবক মেটাল সংগীতের পাঙ্খা, তাদের বেলায়- ‘আমরা সংগীতের ধকল সামাল দিতে পারি, তা যতই কর্কশ-বিশ্রী আর পীড়াদায়ক হোক, তাতে কিছু আসে যায়না!’- এটা প্রমান করার একটা রাস্তা হলো এসব কনসার্টে যাওয়া। জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্রেফ এর উল্টোটা ঘটে মাত্র, যতই কষ্ট আর নিদারুন যন্ত্রণাকর সংগীত হোক না কেন, তা শুনতে বন্দিদের তাদের বাধ্য করা হয়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ‘আধুনিক’ জীবন যাপনে যে বন্দির অনাগ্রহ আছে শুধু নয়, যে বন্দি যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিকতার সওদাগরিতে বাধা দিতে আগ্রহ করেছে- বলে যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ করছে। সেই বন্দীকে প্রবেশ করানো হয় আধুনিক যুবকের জীবন-নরকে, অবশ্য বন্দির বেলায় প্রয়োগ করা হয় এমন মাত্রা যা সহ্যের সীমানার বাইরে।

গত তিরিশ বছর ধরে পপ সংগীতের যেসব কারিগরী উন্নয়ন হয়েছে, তা জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে সংগীতকে ব্যবহার করা সহজ করে দিয়েছে। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা লাগাতার কোশেশ করে বাদ্যযন্ত্র শব্দের প্রতিটি শেষ কাঁপন বের করে আনছেন উন্নত সাউন্ড স্টুডিও ব্যবহার করে। যা গুয়ানতামোর জালেমদের কাজে লেগেছে।

ছবির ক্যাপশন: ‘মেটালিকা’র গায়ক জেমস হেটফিল্ড- এই গায়ক জানিয়েছেন ‘জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে তার গান ব্যবহৃত হওয়ায় তিনি গর্বিত।’

View: 6386 Posts: 2 Post comments

exclucive story

This article is exclusive. thank you. but main motto of this article is funy but crucial.

tools of torchar

undoubtedly this is a well written article. this article informed us a new way of torturing in custody and we also found out a manifestly hidden character of American army. unfortunately, I have some experience to watch such horror of torture in their jail........ it's brutally painful, neglected and shameful for human being...though they don't sense shame...
Home
EMAIL
PASSWORD