পুনর্মুদ্রণ:পানি ও রবুবিয়াতের রাজনীতি


ফরহাদ মজহার
Sunday 16 May 10

পানির ‘হক’ আদায়, পরিবেশ কিংবা এক জলদেবতার গল্প

বন্ধু আহমদ ছফা প্রচণ্ড খরা, উত্তরবঙ্গের মরুকরণ এবং ভয়াবহ পানি সঙ্কটের কথা উঠলেই কমপক্ষে পাক্কা আধাঘণ্টা ধরে দুটো বিষয়ে কথা বলে যায়। এক নম্বর হলো, মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল। দুই নম্বর, শেখ মুজিবুর রহমানের ভারতনীতি। আমি জানি আমার মতো আরো অনেকে এই দুই বিষয় নিয়ে কথা বহুবার শুনেছে কিংবা শুনতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, ছফা যখন কোনো বিষয়ে তার মতামত নির্ধারণ করে ফেলে তখন তার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সেই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এমন কোনো কাজ নাই যা সে করে না। এক কথা হাজার বার বলার ‘কৌশল’ টা এই নিষ্ঠার অংশ। তবুও তার কথা বার বার শুনতে কেউ বিরক্ত হয়েছে সেই খবর কখনো কানে আসে নাই। কারণ হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সংস্কৃতির অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন ছাড়া বাজে বিষয়ে সময় অপচয় করার সময় ছফার যেমন নাই, কোনো কাজের মানুষেরও নাই। অন্যদিকে মৌলিক বিষয়গুলো বার বার আলোচনারই বিষয়। বহু নতুন দিক এতে উন্মোচিত হয় এবং প্রশ্নগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তুলবার হদিসটাও খুঁজে পাওয়া যায়।

এক নম্বরটি নিয়েই আগে কথা বলবো। মওলানা ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা করেছিলেন ১৯৭৬ সালের ১৬ মে। রাজশাহীর কানসার্টে ১৭ তারিখে তার মিছিল শেষ হয়। তখন তিনি অসুস্থ, দাঁড়াতে পারছেন না। ছফার কথানুযায়ী নিজের পেশাবের বেগ তিনি ধরে রাখতে পারছিলেন না। বেদনায় সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই । ফলে জীবনের শেষ সেকেণ্ডগুলো তিনি হিশাব করে খরচ করছিলেন। ছফার মুখে কানসার্টে বৃদ্ধ, অসুখে কাতর অথচ অকুতোভয় মওলানার দুই হাত তুলে দাঁড়াবার ভঙ্গি, তাঁর বক্তৃতা এবং পানির জন্য হাহাকার করে বাংলার মানুষ পুড়ে মরার ভবিষ্যৎ দৃশ্য ভেবে বুকফাটা কান্নার ছবির বর্ণনা যারা শুনেছেন, তারা আবারো শুনতে চাইবেন বলেই আমার বিশ্বাস। বিশেষত শেষ অংশ, যেখানে মওলানা কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমি আর এই বয়সে তোমাদের জন্য কী করতে পারি? আমার ফরিয়াদ আল্লার দরবারে যেন পৌঁছায়, যেন তার রহমত হয় ... ইত্যাদি।

এরপর ছফার বর্ণনা—কোথা থেকে আকাশে হঠাৎ মেঘ এসে জড়ো হয়, গম্ভীর ডাকে, মওলানার কথাগুলোই যেন মেঘ হয়ে ‘খামোশ’ বলে হাঁকতে থাকে, চরাচরের গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, মানুষ- মহিষ সক্কলে একযোগে গ্রীবা বাড়িয়ে মওলানার দুহাত তুলে মোনাজাত অবলোকন করে। অক্ষরেখার ওপর হঠাৎ পৃথিবী মওলানার মোনাজাত শেষ না হওয়া অবধি থেমে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। কিছু পাখি আকাশপথে মওলানার সভাস্থলের ওপরকার আকাশবৃত্ত ভেদ করে উড়ে যাওয়ার সময় কান্না শুনে নিজেরাও কাঁদবার জন্য আশেপাশের গাছে এসে বসে। আর কান্নার ধারার সঙ্গে সঙ্গে তক্ষুণি নেমে আসে বৃষ্টি। অপরূপ, অসাধারণ, অনন্তবর্ষী বাংলার জল। মওলানা ফারাক্কা ফরিয়াদ জানিয়ে কাঁদছেন আর বৃষ্টি তার দুই চোখের ধারা হয়ে ঝরে পড়ছে। আমার পাগল বন্ধু আহমদ ছফা এই বর্ণনাটা যখন করে তখন দুজনে একা থাকলে একসঙ্গে একচোট কেঁদে নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ তখন ছফার ঘরের দরজার একটা পাল্লার ওপর সাঁটা কানসার্টের সভায় মওলানার ছবিটিতেও মওলানা এখনো কাঁদছেন বলেই মনে হয়।

বন্ধু প্রসঙ্গ এখানে এসে গেলো বলে আমি কিছুটা লজ্জিত। কিন্তু ভাবুক ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে একটি রেওয়াজ আছে। নতুন চিন্তা, নতুন ভাব, নতুন অন্তর্দৃষ্টি, ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ, নতুন ব্যাখ্যা, নতুনভাবে দেখবার প্রয়াস- ইত্যাদির কোনো কণামাত্র বিচ্ছুরণও যদি কেউ কারো কাছ থেকে পেয়ে থাকে তবে তার প্রকাশ ও সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি দেওয়াই নিয়ম। এখানে আমি সেই কাজটিই করছি। তবে আমাদের দেশে এই রেওয়াজ কেউ খুব একটা মানে না। বুদ্ধি নিজের গৌরব এই দেশে এখনো কায়েম করতে পারে নাই ।

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের তাৎপর্য বোঝা আমার জন্য কঠিন ছিল না। ছফার কাছে আমার ঋণ এই ক্ষেত্রে নয়। ঋণ হয়েছে প্রতীকের ইঙ্গিতময়তার ক্ষেত্রে। মওলানা সম্পর্কে ছফার প্রিয় প্রতীক হলো, তিনি বাংলার ‘জলদেবতা’। এই প্রতীক আমার ভালো লাগে। কোথাও প্রকৃতির সঙ্গে মওলানার একটা শারীরিক যোগ আছে এই উপলব্ধিটুকু নতুন। এই উপলব্ধির সঙ্গে বহুদিন আগে আমার নিজের কিছু অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গতি আছে। আসলে সেই সঙ্গতির কথাই লিখতে বসেছিলাম ‘ভোরের কাগজ’ এর জন্য। ৫ জুন ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। অকারণে সারাদিন মওলানা ভাসানীর ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। এই সঙ্গে মওলানা সম্পর্কে প্রতীকী ইঙ্গিত। পরিবেশের কথাই লিখবো বলে বসতে গিয়ে এই দিবসে বন্ধুর উক্তিগুলো আগে মনে পড়লো।

নিজের অনুধাবন সম্পর্কে বলি। বাংলাদেশে আজকাল অনেকেই পরিবেশের কথা বলছে। ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে ১৯৯২ সালে ধরিত্রী সম্মেলন হওয়ার পর থেকে দেখা যাচ্ছে রাতারাতি অনেকেই “পরিবেশবাদী’ হয়ে গিয়েছে। কারণ, এটা এখনকার ফ্যাশন।

ফ্যাশনের হুজুগ মধ্যবিত্তের মধ্যে থাকে, থাকবেই। কোকাকোলাÑ আধুনিকতার একটা বৈশিষ্ট্য । ফ্যাশনের তোড়ে ঘোর লিঙ্গসর্বস্ব পুরুষকেও ‘নারীবাদী’ হয়ে যেতে দেখা যায়। সে যাই হোক, সমাজে হঠাৎ করে কোনো ধ্যান-ধারণা, তত্ত্ব বা চিন্তা হাজির হয় না। তার পিছনে অনায়াসেই একটা রক্তপাতের দাগ নজরে পড়ে। কারণ, সংগ্রাম ছাড়া মানুষের ইতিহাস অগ্রসর হতে পারে না। পুরোনো ধ্যান- ধারণা, অধিপতি শ্রেণীর স্বার্থ চ্যালেঞ্জ করেই নতুন নিজের পথ করে নেয়। পরিবেশের সংগ্রাম কিংবা নারীর হাজার বছরের লড়াইয়ের ভয়াবহ প্রেক্ষাপট আছে। আজ ইতিহাসের এজেণ্ডা হিশাবে এগুলো উঠে এসেছে। কিন্তু সেখানেও জটিলতা আছে। ‘পরিবেশবাদ’ বা ‘নারীবাদ’ নামে বহু আবর্জনাও তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো, পরিবেশ ধ্বংসের জন্য যারা দায়ী আর ‘ইতিহাসের ঘৃণ্য নারীনিপীড়নের জন্য যারা কুখ্যাত তারা সংগ্রামের মূল ধারাকে বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত করার জন্য বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। দেখা যাচ্ছে তারাই এখন মুরুব্বি। তারাই ঠিক করে দিচ্ছে কোনটা ‘পরিবেশ’ সংক্রান্ত বিষয়, কোনটা ‘নারী’ উন্নয়ন বা নারীর ‘অধিকার’ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তারাই সকলের ওপর তাদের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের সংগ্রাম কিম্বা নারীর নিজেদের মুক্তির জন্য নিজের লড়াই এতে চাপা পড়ে যাচ্ছে, গৌণ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জনগণের প্রধান পরিবেশবাদী সংগ্রাম কী? কে সেই সংগ্রাম শুরু করেছিলেন? কাদের তিনি নেতা? কাদের নিয়ে তিনি সেই সংগ্রাম রচনা করেছিলেন? কেন সেই সংগ্রামকে তথাকথিত ‘পরিবেশবাদী’ সংগ্রাম আখ্যা দেওয়া হয় নাই? একটা উত্তর হলো, নামকরণ ও সংজ্ঞা নির্ধারণও রাজনীতির অংশ। এই ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধি প্রবলভাবে সক্রিয় থাকে। যদি ‘পরিবেশবাদী’ হওয়াটা প্রধান ফ্যাশন হয়ে ওঠে তাহলে কাকে আমরা দৃশ্যমান করে তুলছি আর কাকে ধামাচাপা দিচ্ছি সেটা নামকরণ ও সংজ্ঞা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে একরকম ঠিক হয়ে যায়। পরিভাষা নির্ণয় ও প্রয়োগের রাজনীতি সম্পর্কে আমরা খুব কমই ওয়াকিবহাল থাকি।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলার পরিবেশ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাকে ম্মরণ না করে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো পরিবেশ আন্দোলনের কথা ভাবাই যায় না। পরিভাষা নির্ণয় ও প্রয়োগের রাজনীতি সম্পর্কে খানিক সচেতনতা থাকলেই আমার কথার মর্মার্থ আরো গভীরে বোঝা যাবে। মওলানা ফারাক্কা মিছিলের তাৎপর্য—বিশেষত তাঁর পরিবেশবাদী মর্মের দরজা খুলতে হলে এই হাতলটা ধরার দরকার আছে। অন্যদিকে এটাও বোঝা দরকার, কেন ফারাক্কাবিরোধী সংগ্রাম বাংলাদেশে প্রধান পরিবেশবাদী সংগ্রাম হিশাবে জাতে উঠতে পারে নাই।

সাধারণ মানুষের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পরিবেশ আন্দোলনকে যারা বিমূর্তভাবে ওপর থেকে এজেন্ডা ঠিক করে দেওয়া ফ্যাশন আকারে দেখেন, তাদের পক্ষে ফারাক্কাবিরোধী সংগ্রামের তাৎপর্য অনুধাবন কঠিন হবে। আগামী দিনগুলোতে এই বিষয়ে আরো কথা বলবার থাকবে। আমি শুধু মওলানার ফারাক্কাবিরোধী আন্দোলনের তাৎপর্য সম্পর্কে দুই একটি কথা স্রেফ তালিকা হিশাবে এখানে পেশ করব।

এক: পানি প্রকৃতির সম্পদ। প্রকৃতির সাধারণ সম্পত্তি। মওলানার ভাষায়,“আল্লার রহমত”। সাধারণ সম্পদ কথাটার একটা ইংরেজী পরিভাষা পরিবেশবাদীরা ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, Common Property বা Commons। পানি ছাড়াও আলো, বাতাস ইত্যাদিও প্রকৃতির সাধারণ সম্পত্তি। জমির কথা বললাম না। কারণ, তাহলে আমাকে সকলে আবার কমিউনিস্ট বলে গালি দেবে। মওলানা তাঁর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, প্রকৃতির সাধারণ সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করার অধিকার কাউকে দেওয়া যায় না।

ভারত একতরফাভাবে নদীর প্রাকৃতিক ধারাকে বন্ধ করে দিয়ে সেই অপরাধ করেছে। এটা অতীব ঘৃণ্য এবং জঘন্য অপরাধ। তাঁর সংগ্রামের এই নীতিগত দিকটা যদি আমরা বুঝি তাহলে দেশের ভিতরে বা বাইরে পানি সম্পদ “ব্যক্তিগতকরণের” (Privatization) বা প্রকৃতিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। যেমন, এইদিক থেকে জলমহাল ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীকে মাছ ধরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও সমানভাবে জঘন্য এবং ঘৃণ্য অপরাধ। একই সঙ্গে ভূস্তরের পানির পাম্প দিয়ে পানি তুলে শুধুমাত্র ইরি ধানের চাষের জন্য বেচাবিক্রি করা, পাম্প মালিকদের পানি ব্যবসার পথ করে দেওয়া এবং ভূস্তরের পানির ওপর অন্যান্য মানুষ, গাছপালা, জীব-অণুজীবের অধিকার ক্ষুণ্ন করা- তাদের প্রাণধারণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা এবং সর্বোপরি খাবার পানির সঙ্কট সৃষ্টি করে কোকাকোলা-পেপসিকোলা কোম্পানি ও বোতলে পানি বেচা কোম্পানিকে মুনাফায় লাল করে দেওয়া অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং জঘন্য কাজ। ভারত গঙ্গার পানি কুক্ষিগত করেছে বলে খালি ফারাক্কার বিরোধিতা করবো আর অন্য বিষয়ে চুপ থাকবো তা হলে হবে না। যারা সেই মোনাফেকি করবেন মওলানা থাকলে তাদের জামাতে ইসলামীর সদস্য হওয়ার বা চরমোনাইয়ের পীরের মুরিদ হওয়ার উপদেশ দিতেন। তাঁর কাছে ভিড়তে দিতেন না। ভালো টাকাপয়সা পেলে আনোয়ার জাহিদ বা ফ্রিডম পার্টির ভাড়া খাটলেও তিনি খুব একটা আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না।

দুই: প্রকৃতির ওপর ইঞ্জিনিয়ারগিরি ফলানোর বিরুদ্ধে এটা একটা সংগ্রাম। প্রকৃতির লালন, প্রাকৃতিক শক্তিকে জানা, বোঝা এবং প্রাকৃতিক ক্ষমতার দরকার মতো ব্যবহার এক জিনিস, আর প্রকৃতিকে “নিয়ন্ত্রণ” করা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। প্রকৃতির ওপর ক্ষমতা কায়েম বা বিশেষ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি বা দেশের “নিয়ন্ত্রণ” ও তাদের দ্বারা নির্ধারিত উদ্দেশ্যে প্রকৃতির বিশেষ ধরনের ব্যবহারটা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারগিরি। ফারাক্কা বা যেকোনো বৃহৎ ড্যাম বা কনস্ট্রাকশনের উদ্দেশ্যের একটা দিক হচ্ছে, একটি দেশ পানি সম্পদের সুবিধা অন্য দেশকে বঞ্চিত রেখে নিজেরা ভোগ করতে চাইছে। এই অনৈতিক দিক তো আছেই। কিন্তু মওলানা যেকোনো বৃহৎ ড্যামেরই বিরোধী, ইঞ্জিনিয়ারগিরি ফলিয়ে প্রকৃতিকে বেঁধে ফেলার এই যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ভাব এবং দর্শনের পরিপন্থী। কারণ হলো, পানির ব্যবহার কি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য? ফারাক্কা সংক্রান্ত পানির শেয়ার নিয়ে ভারত বাংলাদেশে আলোচনার প্রধান বিষয় হলো, শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের কতোটুকু পানি দরকার তার হিশাব ঠিক করা? কে সেই হিশাব করবে? ইঞ্জিনিয়ার? ভারত বলেছে, গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের কতোটুকু পানি দরকার- বাংলাদেশ বলুক। একটা সমাধান নাকি ভারত চায়। বাংলাদেশও পানির হিশাব করার সময় সেচের জন্য পানির কথাটাকেই জোর দেয়? কিন্তু গঙ্গার পানি কি কেবল সেচের জন্য? মওলানা বলতেন, পানির ব্যবহার শুধু সেচের জন্য কেন হবে? এটাতো প্রকৃতির অন্তর্গত শক্তির এক রকমের ব্যবহার মাত্র। বলাবাহুল্য, মওলানা কৃষিকাজের জন্য পানির ব্যবহারের মূল্য অবশ্যই বুঝতেন। তার গুরুত্ব তো অপরিসীম। তিনি কৃষকের প্রাণের নেতা ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির ওপর ইঞ্জিনিয়ারগিরি ফলানো হচ্ছে এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা যেখানে প্রকৃতিকে একটা মাত্র নির্দিষ্ট কাজে গোলাম খাটানোর চেষ্টা চলে। প্রকৃতির বহুবিচিত্র সপ্রাণ ভূমিকা এই ধরনের কারিগরি বিদ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু একমাত্র কৃষকই বোঝে পানি শুধু ধান চাষের জন্য নয়, তার ভূমিকা ব্যাপক, বিচিত্র ও বহুমুখী।

অতএব, মওলানা জানতেন হিশাব করে পানির প্রয়োজন নির্ধারণ করার চেষ্টা একমাত্র আহাম্মক ছাড়া আর কেউ করার চেষ্টা করে না। এটা সর্ব্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ও অতীব সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা দিয়েও মীমাংসা সম্ভব নয়। কারা মীমাংসা করবে? মানুষ? কিন্তু মানুষের সভায় গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গের “হক” কে ঠিক করবে? তাহলে তো সেই সভায় সকলকেই ডাকতে হয়। জৈব আর অজৈব প্রকৃতির মধ্যে সকলকে ডেকে সকলের পানির হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে। এটা অসম্ভব। ফারাক্কাকে আন্তর্জাতিকীকরণেও কোনো লাভ হবে না। মওলানা কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে পানির হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন, কিন্তু তিনি যেকোনো ধরনের বড়ো ড্যাম, বাঁধ হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রকল্পের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি জানতেন ফারাক্কার মতো বৃহৎ প্রকল্পে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রাণবৈচিত্র্য (Biodiversity), সম্পদশালী বাংলার শ্যামল, সবুজ, বিচিত্র, অপরূপ গাঙ্গেয় বদ্বীপ। বাংলার প্রতিটি প্রাণ সকলকেই মারবার ব্যবস্থা করেছে ভারত।

অন্যদিকে প্রকৃতি সবকিছু ন্যায়সঙ্গতভাবে করে, এটা নিশ্চয়ই মওলানা বিশ্বাস করতেন না। আর যাই হোক তিনি প্রকৃতিপূজারী বা রোমান্টিক কোনো পরিবেশবাদী ছিলেন না। প্রকৃতি অন্যায় করে, প্রকৃতি কাকে কী দেবে না দেবে, কাকে করুণা করবে কাকে করবে না সেটা বোঝা মুশকিল। কিন্তু প্রকৃতির এই দায়দায়িত্ব যখন মানুষ নিজের কাঁধে নিয়ে নেয় তখনই বড়ো ধরনের সামাজিক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। মওলানা ইঞ্জিনিয়ারগিরির বিরোধিতা করতেন শুধু পরিবেশগত কারণে নয়, এই ধরনের প্রকল্প অনিবার্যভাবে সংঘাত, সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহের কারণ হয়ে ওঠে। কাপ্তাই ড্যামের কারণে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের রক্তক্ষয়ী দিক তো আমরা চোখের সামনেই দেখছি। ফারাক্কাও অনিবার্য সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারগিরির বিরুদ্ধে মওলানার অবস্থান তাহলে কী? ফারাক্কা ভেঙে-গুড়িয়ে দেওয়া ছাড়া উপমহাদেশে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মাঝখানের কোনো মীমাংসা হলেও সেটা হবে সাময়িক। এই কথা আমি এখানে ভবিষ্যতের জন্য মওলানার বরাতে লিখে রাখলাম। যদি বেঁচে না থাকি তাহলে পাঠক যেন বৃহৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে মওলানার এই শিক্ষাটা মনে রাখেন। আমি কিংবা আমার বন্ধু ছফা মওলানার গুণগ্রাহী হিশাবে এই শিক্ষা সকলের মনে সঞ্চার করার চেষ্টা করেছি, তার জন্য কোনো কৃতিত্ব আমাদের দেওয়ার দরকার নাই। কারো সময়ও হবে না। কারণ লড়াই , রক্তপাত, সংঘাত, সন্ত্রাসের জাহান্নামে এইসব কথা ভাববার ফুরসত তখন কারোরই হবে না।

এখন কথা হলো, ফারাক্কাবিরোধী সংগ্রামের সাধারণ তাৎপর্য হলো বৃহৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আরো লড়াই আছে। যেমন, বিশব্যাংকের সরদারিতে আর বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের কোটি কোটি টাকার ঋণ ও অনুদানের ভিত্তিতে তথাকথিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প (Flood Action Plan)। ’৮৮ সালে যখন বন্যা হলো তখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর বউ ছিলেন ঢাকায়। তিনি দেখলেন বন্যার পানি তার গুলশানের বাড়িতেও উঠি উঠি করছে। আর গুলশানের চতুর্দিকেই পানি। দেখে তার মনে হলো,পানি মানেই বন্যার পানি, বিশেষত যে পানি শহরে ওঠে আর শহুরে মানুষদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বিশেষত গাড়ি হাঁকিয়ে রাস্তার চলাচলের ব্যাপারে ভয়ানক মুশকিল সৃষ্টি করে। আফটার অল, শহরের রাস্তাগুলোতে তো আর পাম্প বসানো নৌকা হাঁকাবার জন্য তৈরি হয় নাই। লক্ষণীয় যে, পানিকে কেবল “বন্যা” হিশাবে দেখার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং শহরমার্কা ধারণা এর মধ্যেই ফুটে বেরুচ্ছে। অথচ পানি তো কেবল দায় নয়, পানি আমাদের সম্পদও বটে। কিন্তু মিসেস মিতেরাঁ গুলশানে বসে এতো ভাববার ফুরসত পান নাই। এখন তার দেশ ফ্রান্স থেকে তিনি অনেক ইঞ্জিনিয়ার পাঠালেন। তারা বললো, নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি “নিয়ন্ত্রণ” করা হোক। এই কথা শুনে আমাদের দেশের কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, কনসালটিং ফার্মসহ আরো বহু দেশ থেকে টাকা কামাবার লোভে সকলে লাফিয়ে পড়লো। চতুর্দিকে হৈ হৈ রব, রৈ রৈ কাণ্ড। নদীর ওপর বাঁধ তুলে পানি ঠেকাও। একটা এলাহি কাণ্ড শুরু হয়ে গেলো। বিশাল বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প ফাঁদা হলো। সেই কেচ্ছা শুনতে চাইলে কয়েক বছর ধরে বলতে হবে। কিন্তু আমাদের মূল কথা হলো, যদি ফারাক্কার বিরুদ্ধে মওলানার সংগ্রামের সাধারণ নীতিগত দিকটা বুঝি তাহলে এটাও পরিষ্কার যে, তথাকথিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংগ্রামও একইভাবে চালাতে হবে। ফারাক্কার বিরুদ্ধে বলবো, আর এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পমার্কা ইঞ্জিনিয়ারগিরির বিরুদ্ধে কিছু বলবো না, সেটা হয় না। লক্ষণীয় যে, ঠিক এই কাজটাই জামাতী ও তাদের দোসররা করে। তার মানে পানির অধিকার নিয়েই যদি কথা বলি তাহলে একই নিঃশ্বাসে ফারাক্কা, ডিপটিউবয়েল ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বলতে হবে। তালিবালি করা যাবে না।

ওপরে যে কথাগুলো বলছি তা মওলানার “রবুবিয়াতের দর্শন” সম্পর্কে খোঁজ নিলে আমরা বুঝবো মওলানার ফারাক্কাবিরোধী সংগ্রাম একটা আচমকা ব্যাপার ছিল না। আল্লাহ সকলকেই রহমত দান করেন; বিধর্মী, কাফের বা নাস্তিককেও কখনো তিনি সূর্যের আলো, পানি, বাতাস বা তার রিজিক থেকে বঞ্চিত করেন না। মওলানা আল্লাহর “পরওয়ারদিগার” “প্রভু” বা “শাসনকর্তা” রূপের চেয়েও লালনপালনকারী কর্তা হিশাবে তাঁর প্রেমিক রূপের প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন। এই প্রকৃতিজগত হচ্ছে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া আল্লাহর আমানত। এর হেফাজত করা-এর মধ্যে বিকশিত সকল প্রাণের লালনপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাজকে সহায়তা করাই মানুষের কর্তব্য। এইখানেই মানুষ আর সকল প্রাণী থেকে পৃথক। শ্রেষ্ঠ-আশরাফুল মাখলুকাত। এই কারণেই আল্লাহর সম্পত্তিকে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানানোর ব্যাপারকে তিনি অনৈসলামিক কাজ বলে গণ্য করতেন। এটা তাঁর চোখে ছিল “শেরেকি”। আল্লাহর অংশীদার হওয়ার শামিল । অতএব ঘৃণ্য।

তিন: এবার আসি মওলানার কাজের ধারা অনুধাবনের জায়গায়। অন্যান্য কর্মসূচির পাশাপাশি তিনি ফারাক্কা অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি নিয়েছিলেন। এটা ছিল সকল স্তরের জনগণকে- বিশেষত গরিব কৃষক ও সাধারণ মেহনতি জনগণকে উজ্জীবিত, সংগঠিত ও সচেতন করার অতি প্রাচীন বঙ্গীয় পদ্ধতি। গান্ধী ভারতের সাধুসন্ত-বিশেষত বুদ্ধ ও তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে এই ঐতিহ্যটি ধার নিয়েছিলেন। কৃষিপ্রধান দেশে গ্রামের মধ্য দিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে ডাক দিয়ে যাওয়া এবং তাদের খেয়ে, তাদের সহয়োগিতায়, তাদের দুঃখবিষাদ আলোচনা-সমালোচনা শুনতে শুনতে একটা বিষয়কে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা এক সময় ছিল ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অংশ। এইকালে সেটা হয়েছে জনগণের অধিকার ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই ধরনের সংগ্রামে আগে থাকতেই বাগাড়ম্বর করে শ্রেণীস্বার্থের কথা বলার দরকার পড়ে না। কারণ হলো, এই ধরনের পদযাত্রায় হাঁটতে যাবে কে? নিশ্চয়ই যে শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত সেই শ্রেণীই এই সংগ্রামে শামিল হবে। তাহলে নিম্নবর্গের মানুষ ও খেটে খাওয়া গরিব ও নিঃস্ব কৃষকের জোরেই সংগ্রামের এই পদ্ধতি সফল হতে পারে। অন্য কোনোভাবে নয়।

এই শিক্ষা থেকে যদি সাধারণ নীতিটুকু বের করে আনি তাহলে ভাসানীর সংগ্রাম পদ্ধতির মধ্যে একটা দিক খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো সংগ্রামকে অবশ্যই একটা গণভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। ভাসানীর কাছ থেকে এই শিক্ষাটা সবচেয়ে সফলভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মুজিব তাঁর থেকেও অনেক বেশি সফল। সেই কারণে ভাসানীকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ভাবাই যায় না। দুইজনের পার্থক্য আছে, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ভাসানীকে শেখ মুজিব থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদাভাবে বিচার না করে দুইজনের সংযোগ, ধারাবাহিকতা, ঐক্য ও বিরোধিতার বিভিন্ন দিক একটা সামগ্রিকতার মধ্যে ধরবার চেষ্টা করলে আমরা উপকৃত হবো বেশি। সামগ্রিক বিচারের মধ্য দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক ধারাকে আমাদের একটা সুতোয় অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে এর স্ববিরোধিতাসহ। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মওলানার হাত দিয়েই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম এবং আওয়ামী লীগেরও। যারা ভক্তিবশত শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা বলে থাকেন তাদের মধ্যে সৎ ও সজ্জনরা একই উচ্চারণে এই কথা বলতেও দ্বিধা করবেন না যে, যদি পিতামাতা নির্ধারণ নিয়ে ইতিহাস ঠিক করতে হয় তাহলে শেখ মুজিবের জনক কে তার বিচারও করা দরকার। সেই জনক কিন্তু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পিতা ও পুত্রের মিল ও অমিল যদি আমাদের সামগ্রিক ইতিহাসের দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের মধ্যে আমরা অনুধাবন করতে পারি তাহলে আমাদের একটা বড়ো ধরনের উল্লম্ফন হবে। কারণ, এই সুতোটা ঠিকমতো বাঁধতে না পারলে একদিকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধ রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণকে একটা কাতারে নিয়ে আসতে পারবো না, অন্যদিকে জনগণের সাধারণ স্বার্থকে কিভাবে রাজনৈতিক রূপ দিতে হয় সেই শিক্ষাটারও ক্ষয় ঘটবে। শেখ মুজিবুর রহমানের কথায় যখন এসে পড়লাম তখন তাঁর ভারতনীতি সম্পর্কে আহমদ ছফার মন্তব্যটা বলে ফেলি। সেটা হলো এই, যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতেন তাহলে এতদিনে ফারাক্কাকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে একটা লড়াই তিনি বাঁধিয়ে দিতেন। এই মন্তব্য আক্ষরিকভাবে অর্থ করার দরকার নাই। মওলানার ভাবশিষ্য হিশাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে পানির অভাবে হাহাকার করে আর পুড়ে পুড়ে মরতে দিতেন না- এই হলো কথা। আমি ছফার এই কথা বিশ্বাস করি। কেন করি, তার পক্ষে কোনো যুক্তি আমি দিতে পারবো না। কিন্তু এই লেখাটি লিখতে গিয়ে শেখ মুজিব সম্পর্কে আরো কিছু কথা আমি না বলে পারবো না। সে কথা আলাদা করে পরের কিস্তিতে বলছি।

তার আগে মওলানা সম্পর্কে ছফার একটি উদ্ধৃতি তার “মওলানা ভাসানী” নিবন্ধ থেকে দিয়ে এই কিস্তি শেষ করবে। ছফা লিখেছে,“মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক মতবাদ কী ছিল? তাঁর সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ছিল, এ কথা নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই।... সামনে খোলাপথ ছিল দুটি। এক, ইসলাম অন্যটি মার্কসবাদ। সম্ভব হলে মওলানা ইসলামী বিপ্লবই করতে চেষ্টা করতেন। তাঁর আবাল্যের শিক্ষা, সংস্কার, রুচি, জীবনদৃষ্টি তাঁর অনুকূলে ছিল। কিন্তু মওলানাকে মর্মান্তিক বেদনায় অনুভব করতে হয়েছে, সে পথে অধিকদূর অগ্রসর হওয়ার অবকাশ নাই। ইসলামের ধ্বজাধারীরা তাঁকে কাফের মনে করে। সুতরাং মওলানা সাহেবকে নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও মার্কসবাদের অনুসারীদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। বাস্তব রাজনৈতিক প্রয়োজনে কমিউনিস্ট পার্টিসহ নানান বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে বটে, কখনো প্রাণের থেকে ঐ বিপ্লবী মতবাদ তিনি গ্রহণ করতে পারেন নাই। রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে মওলানার সারা জীবন কেটেছে।”

এই “রাজনৈতিক দোলাচলবৃত্তি” আমাদের ক্ষতি কম করে নাই। সেটা ভিন্ন বিষয়। ছফার “জলদেবতা”র মনুষ্য স্বভাব যেন আমরা বিস্মৃত না হই, সে জন্য ছফার রচনা থেকেই সতর্ক করে দিলাম। মওলানা বেঁচে থাকলে তাঁর কাছ থেকে আগেই মাফ চেয়ে নিয়ে সমালোচনা গুলো করতাম। আগামী দিনের সংগ্রামে তাঁকে আমাদের দারুণ ভাবে দরকার বলে তাঁর মহৎ দিকগুলোই পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বেশি চোখে পড়লো।

 ২৫ জ্যৈষ্ঠ,১৪০২, শ্যামলী।

*প্রথম প্রকাশ: ভোরের কাগজ ৩-৭-৯৫

 

View: 14366 Posts: 1 Post comments

রবুবিয়াতের রাজনীতি

লেখাটি আমার ভালো লেগেছে।
Home
EMAIL
PASSWORD