তরজমা: শাহাদাৎ তৈয়ব


Thursday 15 July 10

print

আল মাআরী

[৯৭৩ ঈসায়ী সালের ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবারে আরবের হালব এবং হিমসের মধ্যবর্তী অঞ্চল মাআরায় আল মাআরীর জন্ম। তিন বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন তিনি। এতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। ছোট বয়সে তাকে ডাকা হতো আহমদ নামে। পরবর্তীতে তিনি আল মাআরী নামে পবিচিত হয়ে ওঠেন। দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে বিশেষত্ব লাভ করলেও কাব্যই তাঁর মূল অবলম্বন হয়ে ওঠে। ১০৫৮ ইসায়ী সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। সাকতুয যানাদ এবং আল্লুজূমিয়্যাত তাঁর অসাধারণ কাব্য সৃষ্টি। নিচে এ দুই কাব্যগ্রন্থ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু পঙক্তি তরজমা আকারে তুলে ধরা হলো। ]

১.

সৌন্দর্য জানে যাদেরকে সে গোপন করে

সে এক চাঁদ, লুকোয় শাদা মেঘের আড়ালে

পাখিদের সে আচ্ছন্ন করে সুন্দরে, অতঃপর

পাখিরা ক্লান্ত হতে থাকে সুন্দরের করালে

২.

তার কাছ থেকে দূর হও! সে শুধু প্রাণ

কালের ভিতর সে কেবল মানুষের জীবন মৃত্যু

আমি দেখেছি অনেক কঠিন মুহূর্ত জ্বলে ওঠে তরুণদের ভিতর

অতঃপর সেই মুহূর্তগুলো আরো কঠিন হয়ে ওঠে

মানুষের জন্য মৃত্যুর স্বাদই আসল

মৃত্যু ছাড়া আর সমস্ত স্বাদই অতি তুচ্ছ

৩.

আমার শব্দকে সীমিত করো না

কারণ আমি আমার অপরের মতো,

অতএব কথা বলো রূপকে-প্রতীকে

৪.

আমার দায় পুরা করো, শোধ করো আমার ঋণ

তোমার তুলনা যেন আমার গন্তব্যের নাগাল খুঁজে না পায়

৫.

নিশ্চয় জ্ঞান--নিশ্চয় জ্ঞান বলে কিছুই নেই।

মূলত আমি আমার চূড়ান্ত ইজতিহাদ

আমি অনুমান করি-প্রেরণায় স্বজ্ঞা লাভ করি।

৬.

জানিও হাকিকতে নাহি আমার সবকথা

কিন্তু আছে তাহায় রূপকের রূপ যথা

৭.

এবং আমার সর্বশেষ জগত শিশুর মতো

যাকে আদিতে বলা হতো: সে বানান করে, উচ্চারণ করে

৮.

মানুষ থেকে আমার দূরত্ব তার ছোঁয়াছে রোগ থেকে মুক্তি

অথচ স্বজ্ঞা আর দ্বীনের জন্য তার নৈকট্য কতোগুলো রোগ মাত্র

আমি অন্ত্যমিলহীন কাব্যপঙক্তির মতো একা। কোনো শেষমিল নেই- যাকে উপলব্ধি করা যায়। শব্দের ভিতর-ভাষার ভিতর ঠেস দেবার কোনো বালিশ নেই, নির্ভরতার সম্পর্ক নেই।

৯.

সভাষদরা আমার কাছে কী চায়

তারা আমার যুক্তি চায়, আমি চাই আমার নিস্তব্ধতা

আমাদের মাঝে আছে বিস্তর দূরত্ব

তারা চায় তাদের পথ আর আমি চাই আমার গতিময়তা।

১০.

যখন তুমি খুব কাছে থেকে তাকাবে

দেখবে জ্ঞানী আর মূর্খ খুব কাছাকাছি

১১.

তোমাদের মুখে মিথ্যা যদি মিষ্টি হয়

তবে নিশ্চয়ই আমার দুঃখি মুখে সত্য বড় মধুর

আমি পৃথিবীর জন্য তাদের তাহজীব চাই

মানুষরা বড়ই বিভক্ত হয়ে গেছে তাদের সভ্যতা নেই

বিনা যুক্তিতে তারা শুধু অনেক দাবি করে অনেক চায়

সকলেই তার ‘আমি’র পক্ষে মরিয়া হয়ে উঠছে

১২.

শাশ্বত নক্ষত্রে আমার বিশ্বাস নেই

বিশ্বাস নেই আমার পৃথিবীর প্রাচীনত্বে

১৩.

মানুষ বড় মিথ্যা বলে সকাল সন্ধায়

বিবেক ছাড়া তার আর কোনো ইমাম নেই

হে আকস্মিকতা যদি তুমি বিবেক সম্পন্ন হও

তবে আমি তার অর্জনে প্রার্থনা করি।

বস্তুত প্রতিটি বিবেকই একজন নবী।

১৪.

দুনিয়া তার নোংরামি আর ময়লায় ভরিয়ে তুলছে

সমস্ত প্রকৃতি-প্রাণ-প্রজাতি।

প্রতিটি প্রাণই এখানে জালেম।

আর মানুষের চেয়ে বড় জালেম আর কিছুই নেই।


আন নাফারী

[মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জাব্বার ইবনে আল হাসান ইবনে আহমদ আন নাফারী। এটি তাঁর পুরো নাম। পরবর্তীকালে তিনি আঞ্চলিক নামের সাথে যুক্ত হয়ে আন নাফারী হিশেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে জানা যায় নি। তবে আব্বাসী আমলে ইরাকের ফোরাত নদীর পূর্ব তীরে নাফার নামক শহরে তাঁর জন্ম। সুমিরিয় যুগের একটি অতি প্রাচীন নগর নীবুর। এটিই পরে কালক্রমে নাফার নামে পরিচিতি লাভ করে। ৯৬৫ ইসায়ী সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরবী কবিতায় সূফীবাদের চর্চা অতি বিরল হলেও নাফারী সূফী দর্শনের জন্য খুবই বিখ্যাত। কেবল কাব্য লিখেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন নি বাস্তব জীবনে সূফী সাধনা করে তত্ত্বে, ভাষায় ও কাব্যে সমানভাবে মৌলিকত্ব অর্জন করেন। নানা কারণে কবিতার ইতিহাসে তাঁর নাম খুব একটা প্রচারিত নয়। তিনি ছিলেন মানসূর হাল্লাজের সমসাময়িক। তাঁর কাব্যে ও তত্ত্বে ‘ওয়াকফ’ (বোধ, অবস্থান) এবং ‘রু’ইয়া’ (দেখা) বিশেষ তাৎপর্যে উপস্থিত হয়। বিশেষত কবিতায় ইমেজ বা রূপকল্পের ব্যবহারে তিনি গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন। অধুনা অনেক আরব সমালোচক নাফারীকে মার্টিন হেইডেগারের Being and Time এর সাথে সম্পর্কিত করে আলোচনা করেন। কারণ তাঁর কবিতায় লোকে অলোকের সন্ধান কিংবা অধরাকে ধরবার ভাষাকৌশল বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে আছে। কিতাবুল মাওয়াকিফ ও কিতাবুন নুতকি ওয়াস সামতি র জন্য নাফারীকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। নিচে এই দুই কাব্য থেকে কিছু টুকরো পঙক্তি বাংলায় ভাষান্তর করে তুলে ধরা হলো।]

১.

নিরবতা আর সরবতার মধ্যে এক যোজক আছে, এক ভেদ রেখা আছে আর তা হলো বোধের কবর। বস্তুর কবর। প্রকৃতির কবর।

২.

তিনি আমাকে বললেন, যখন গভীরদৃষ্টি খুলে যায়। ভাষা সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আমাকে বললেন, ভাষা এক পর্দা মাত্র। তাহলে কী করে তা ভেদ করবে? জানিও ভাষা আমার খাজানা। যে তাতে প্রবেশ করে সে যেন আমার আমানত বহন করে। জানিও হরফ আমার আগুন, হরফ আমার রহস্যের আধার।

৩.

জানিও, হরফ আবার ইবলিসের চিকনপথ।

তিনি বললেন হে! হরফ আত্মাকে ব্যক্ত করতে অক্ষম করে দেয়। তাহলে আমার রহস্য কী করে রটাবে? তিনি বললেন, সরল রেখার সবই হরফ। হরফের সবই সরল রেখা। তিনি বললেন, হরফ এক আড়াল। হরফের সমগ্রই হিজাব। হরফের বিশেষ, একক সবই হিজাব। হরফ এবং হরফের ভিতর যা কিছু আছে এর কিছুই আমাকে ধরতে পারে না। চিনতে পারে না। অধীন করতে পারে না।

৪.

তিনি আমাকে বললেন, ভাষা এক হরফ। এবং হরফের কোনো আইন নেই। শরীআ নেই।

৫.

তিনি আমাকে বললেন, দৃষ্টি বিজ্ঞান সমগ্রের অভাষা প্রত্যক্ষ করে। এবং হিজাব বিজ্ঞান (ভেদজ্ঞান) সমগ্রের ভাষা প্রত্যক্ষ করে।

৬.

যে দেখতে সক্ষম অদৃশ্য ভেদজ্ঞান তার এক দেখার জগত।

যে দেখতে সক্ষম বস্তুত তাকেই দেখা যায় না ধরা যায় না।

তিনি তার গুপ্ত জ্ঞানের নূর তৈরি করেন

যার পর্দা তিনি ভেদ করতে পারেন

৭.

যখন আমি কোনো জ্ঞানার্জন করি তখন তার কোনো প্রতিপক্ষ থাকে না। যখন আমি কোনো মূর্খতা লাভ করি তারও কোনো বিপরীতপক্ষ থাকে না। অতএব আমি পৃথিবীর কেউ নই আকাশেরও কেউ নই।

৮.

আমি কি জানি কোথায় সত্যপন্থীদের লক্ষ্যপথ? সেটি দুনিয়ার আড়ালে। বস্তুজগতের আড়ালে। দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার আড়ালে এবং পরজগতে যা কিছু আছে তারও আড়ালে।

৯.

জানিও হে! যখন তুমি আমাকে দেখবে না তখন যা কিছু দৃশ্যমান সবই তোমাকে ছিনিয়ে নেবে।

১০.

তিনি আমাকে বললেন, আমার কাছে চূড়ান্ত বলে কিছুই হয় না। তাই তুমি আমাকে দেখতে পাবে প্রতিটি বস্তুর পিছে পিছে।

১১.

তিনি আমাকে বললেন, যারা দেখতে অক্ষম তারা অধরা এবং অদৃশ্যজ্ঞানের যোগ্য নয়।১২.

ইমানের হকিকত হলো তার কোনো আকার নেই। তার তুলনার কোনো কিছুই নেই।

১৩.

আগুনকে দেখে বলবে, তাঁর সমরূপের কিছুই নেই। জান্নাত দেখে বলবে, তাঁর সমরূপের কিছুই নেই। এবং প্রতিটি বস্তুকেই দেখে বলবে, তাঁর সমকক্ষ কোনো কিছুই নেই।

১৪.

বস্তুতে সন্তুষ্ট নই। তোমাতেই সন্তুষ্ট। আমাকে বস্তুর বিষয়ে প্রশ্ন করো না। আমি তো সমস্তু বস্তু সৃষ্টি করেছি তোমার খুশির জন্য। তাহলে বস্তু দিয়ে কী করে তোমাতে আমার খুশি মিলবে। তোমার জন্য সবকিছু কিন্তু আমি তোমারই জন্য। আমি শুধু তোমারই তোমারই দ্রষ্টা। কোনো বস্তুর নই আমি।

১৫.

তিনি আমাকে বললেন, মহাকালে সবকিছুর উপর রাতদিন দুটি মহাবিস্তৃত পর্দা। তারই ভেদমূলে আমি তোমাকে খুঁজেছি। তোমাকে ধরার জন্য আমি এই পর্দা ভেদ করেছি। তুমি আমাকে দেখলে। অতএব আমার সমুখে সিধা হয়ে যাও তোমার মাকামে। সিধা হয়ে যাও আমার দৃষ্টি রেখায়। না হয় দৃশ্য জগতের তাবৎ বস্তুরা তোমাকে ছিনিয়ে নেবে।

১৬.

তিনি আমাকে বললেন, তোমার ভাব-অর্থ আকাশ ও পৃথিবীর চেয়ে মহাশক্তিশালী। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ভাব-অর্থ দেখতে পায় সীমাহীন। শুনতে পায় যা শুনা হয় নি। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ভাব বাস করে না দেয়াল ঘেরা ঘরের ভিতর। ভক্ষণ করে না কোনো ফল। তিনি আমাকে বললেন, তোমার অর্থ-ভাব যাকে রাতের অন্ধকার আচ্ছন্ন করতে পারে না। দিনের আলোয় আবিষ্ট নয়। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ভাব জ্ঞানীর জ্ঞানে বেষ্টিত নয়। তোমার অর্থের সাথে কোনো কারণ, শর্ত সম্পর্কিত নয়।

১৭.

আমি পৃথিবী দেখি-প্রতিটি পৃথিবী--কী করে তা বোধের ভিতর ধরা দেয়। আমি দেখি পানি-প্রতিটি পানি--কী করে তা বোধের ভিতর ধরা দেয়। আমি দেখি আগুন-প্রতিটি আগুন--কী করে তা বোধের ভিতর ধরা দেয়। আমি দেখি জ্ঞান--প্রতিটি জ্ঞান কী করে তা বোধের ভিতর ধরা দেয়।

১৮.

অতএব হে! আমাকে ‘সে’র মধ্যে উপলব্ধি করাও। ধরিয়ে দাও। তুমি জ্ঞানগত হও আমার ভিতর তার আগেই যে হন ‘সে’। আদিতে ‘সে’ হরফ ছিল না। অর্থ-ভাবই হরফ। তোমার ইচ্ছা এক ইশারা--সে হয় দেশ ও দেহগত। সে হয় জ্ঞানগত। সে হয় পর্দা ও রূপকীয়। সে হয় নৈকট্যজনিত। অতএব তুমি তার আগেই জ্ঞানগত যে হয় ‘সে’। আমি ‘সে’ কে দেখেছি। কিন্তু ‘সে’ একমাত্র ‘সে’ই তার সমরূপ কিছুই নেই। সে শুধু সেই তাকে ছাড়া আর কোনো ‘সে’ নেই।

১৯.

তিনি আমাকে বললেন, আমি অধিষ্ঠিত হই সুঁইয়ের ছিদ্রে। যখন আমি সুঁইয়ের ভিতর সুতো হয়ে প্রবেশ করি। সুঁই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন তা ছিদ্র ভেদ করে বের হয় সুঁই তা দীর্ঘ করতে পারে না।

২০.

তিনি আমাকে বললেন, যখন তুমি আগুন দেখবে, আগুনেই বসে যাবে। পালিয়ে যেও না। যদি তাতে বসে পড়ো তা নিভে যাবে। তবে যদি পালিয়ে যাও আগুন তোমাকে কামনা করবে। সন্ধান করবে এবং তোমাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করবে।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 4081 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD