জসীম উদ্‌দীনের কাব্য বিচার পদ্ধতি

কবি আর কবিতার বিচার এক কাতারে হয় না। তথাপি কবিতার মধ্যে কবিকে কিম্বা কবির মধ্যে কবিতাকে সন্ধানের একটা রেওয়াজ কাব্য সমালোচনায় আছে। কিন্তু যিনি কবিতা লেখেন তিনি শুধু কবি নন, তাঁর ব্যক্তিত্বের আরও বহু বিচিত্র দিক থাকতে পারে। কবিতাও মানুষের অন্যান্য বৃত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অনুরাগ নয়। কবিতার নিজের ইতিহাসটিও অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও সামাজিক চিন্তাচেতনার বিকাশের হাত ধরাধরি করে চলে। সেখানে অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতির জাল মারলে অন্য সম্পদ পাবার সম্ভাবনাই প্রশস্ত হয়। গবেষকরা সেই কাজটা হরদমই করেন। বিভিন্ন দিক থেকে কবিতা বিচারের তাগিদ আর প্রয়োজনীয়তা বেশী সেই জনগোষ্ঠী ধন্য। অন্তত দুটো বিষয় এতে প্রমাণিত হয়। এক: সেই বৃত্তির স্বীকৃতি ও সামাজিক উপস্থিতি, আর দুই: তাকে বিকশিত করে তোলার সামাজিক তাগিদ। ফলে বিভিন্ন বৃত্তির বিকাশও ঘটে দ্রুত আর তার হাত ধরে কাব্য।

জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই কথা মনে হলো। ওপরের সূত্র ধরে বাংলাদেশের কবি ও কবিতা নিয়ে বিস্তর কথা বলা যায়। এখানে অবশ্য কয়েকটি মন্তব্য করাই ইচ্ছা, অধিক কিছু নয়। কিম্বা তাও ঠিক না। একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের সঙ্গে সাহিত্য বিচারের পদ্ধতির কোন সম্পর্ক আছে কি? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে। এই প্রশ্ন তোলার আগ্রহ জসীম উদ্‌দীন আমাদের জাগিয়ে তোলেন। এই দিকটি দেখানোর জন্যই কয়েকটি মন্তব্য করব কেবল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের মধ্যে তিনটি ‘প্রকাশ ধারা’ সম্পর্কে জসীম উদ্‌দীন কী বলেছিলেন সেটা তুলে ধরব।

জসীম উদ্‌দীন যখন কবি খ্যাতির তুঙ্গে তখনও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। লেখা শুরু করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ইংরেজের ভারতে। সেই সময়ের রাজনীতি তাঁর চিন্তা ও কবিতাকে প্রভাবিত করেছে। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, কবিতার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার সদ্য ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত পাকিস্তানের কবিদের ভাবতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের কবিরা সেই ভাবাভাবির বাইরে থাকেন নি, জসীমকেও ভাবতে হয়েছে। সেই সময় পুর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের বিচার করতে গিয়ে জসীম উদ্‌দীন তার মধ্যে তিনটি ‘প্রকাশ ধারা’ শনাক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তার জায়গা থেকে সেটা ছিল সাহিত্যের প্রকাশ ও প্রকরণ বিচার; পদ্ধতি হিসাবে এটা কাব্যের জন্য শুধু নয়, রাষ্ট্রচিন্তার জন্যও আকর্ষণীয়। এর মধ্য দিয়ে জসীমের রাজনৈতিক সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপাদান। পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের মধ্যে তিনটি ‘প্রকাশ ধারা’ সম্পর্কে জসীম উদ্‌দীন কী বলেছিলেন সেটা তাই আমলে নেবার জন্যই এই লেখা।

আমার মধ্যে যখন খানিক কবিতা লেখার দোষ ধরা পড়ে তখন সবসময় আমার আশপাশের ‘আধুনিক’ কবিদের কাছে শুনতে হতো জসীম উদ্‌দীন কোন কবি নন। কারন তিনি অনাধুনিক। যদিও আধুনিক কবিতার সংকললনে তিনি অন্তর্ভূক্ত হতেন। তখন আমরা জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত পড়ে কবিতা লেখা শিখছি। সুনীল ছাড়াও শক্তি ততোদিনে প্রবল খ্যাত। এঁদের তুলনায় জসমিউদ্দীন সত্যি সত্যিই কাব্যরুচির দিক থেকে পানসে। অর্থাৎ যে ধরনের কবিতা পড়ে পড়ে আমার কান আর নান্দনিক রুচি সাড়া দিতে শিখছিল জসীমউদ্দীনের কবিতা সেই স্থানগুলোতে শেকড় গাড়তে পারছিল না, ফসকে যাচ্ছিল। আমি স্বীকার করে রাখি জসীম উদ্‌দীন আমি পড়েছি মুক্তিযুদ্ধের পরে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি এই কারণে যে যদি একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যে গণযুদ্ধের স্বাদ না পেতাম এবং মানুষকে জানবার ও বুঝবার ও সঙ্গে নিয়ে চলবার তীব্র সাধ দানা না বাঁধত, আমি জসীম উদ্‌দীন মনোযোগ দিয়ে পড়তাম কিনা সন্দেহ। শুধু জসীম উদ্‌দীন কেন -- বাংলার ভাব ও ভাষার নানান প্রকাশ সম্পর্কে আগ্রহের বীজ বপন শুরু হয়েছিল যুদ্ধের মধ্যেই; এটাই বোধহয় হয়, এর অন্যথা হয় না, এখন তো তাই মনে হয়। এটা একা আমার মধ্যে ঘটেছে বলা ভুল হবে। আমার সমসাময়িক অনেকেই একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। এটা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করা না করার মামলা নয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি যেভাবে নিজের ঐতিহাসিক আবির্ভাব সম্ভব করে তুলছিল তাকে উপলব্ধির মামলা।

বলাবাহুল্য কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি ইতিহাস লেখেন না কিম্বা কাব্যে সমাজ বিচারও তার কাজ নয়। কাব্যের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা ব্যবহারের মুন্সিয়ানা গদ্যবার্তা কিম্বা ইতিহাস রচনার চেয়ে ভিন্ন। তবুও নিজের কারিগরির জায়গা থেকে কবি টের পান ভাষা, সাহিত্য ও ইন্দ্রিয়পোলব্ধির যে-জগতে তিনি এতোকাল অভ্যস্ত ছিলেন তার কলকাঠিতে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। যে জনগোষ্ঠিতে তিনি আবাসী তাকে নতুন করে উপলব্ধি করবার তাগিদ তার জেগে ওঠে। তার নিজের ভাষা ও ভাবনাকে তখন পুরানা মনে হয়। যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে-জনগোষ্ঠির আবির্ভাব ঘটেছে আর যতোই তার নব্জাতকের উত্তাপ গায়ে এসে লাগে ততোই তার কাছে কবি আগ্রহে ছুটে যান। আমিও গিয়েছি।

এখন বুঝতে পারি যাঁরা জসীম উদ্‌দীন কবি কি কবি নন বলে এখনও তর্ক করেন তাঁদের সমস্যাটা কোথায়। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসংঘাতের মধ্য দিয়ে গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার মাত্রা অনুযায়ী আমাদের চিন্তা চেতনার অনড়তা কিম্বা চলিষ্ণুতা নির্ভর করে।

জসীম উদ্‌দীন কবি কি কবি নন, তাঁর কবিতা ‘আধুনিক’ কি ‘গ্রাম্য’ এইসব অতি তুচ্ছ বালখিল্যতা, তদুপরি বেকার তর্ক। কিন্তু এই তুচ্ছ জায়গা থেকেই আমার মন্তব্য। আধুনিকতা শুধু কবিতার প্রকাশ ও প্রকরণের মধ্যে নিহিত,-- এ ধরণের মত বাংলা কবিতার কাব্যবিচারের গলায় কাঁটা হয়ে আছে, এই মতের প্রাবল্য কবিতার পায়ে বেড়ি বেঁধে রেখেছে। আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে একটি জনগোষ্ঠির গঠিত হবার ইচ্ছা ও সংকল্প কিভাবে কবিতার গঠন ও প্রকরণে ছাপ ফেলে আধুনিকতাকে সেই দিক থেকে চেনার চেষ্টা নাই বললেই চলে। এই দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের কবিতার ধারা জসীম উদ্‌দীন কিভাবে শ্রেণিকরণ করেছেন সেই দিকটা বোঝার চেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হতে পারে।

যাঁরা ঐতিহাসিক তাঁদের কাছে রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের উপাদান হিশাবে জসীম উদ্‌দীনের দুটো বই খুব কাজে লাগবে। জীবনকথা (১৯৬৪) এবং যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৪)। যে দেশে মানুষ বড় প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী। পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি ডক্টর গঙ্কোওস্কি তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে যাবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। জসীম দলেবলে যেতে চান নি, কারণ ওতে মন মত ঘুরে বেড়াতে পারবেন না। একা গিয়েছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে বেশ অনুপ্রাণিত হয়েই জসীম উদ্‌দীন ফিরে এসেছিলেন। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন কমরেড মণি সিংকে।

প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে বেড়াবার সময় মরিয়ম সালজনিক তাঁকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি’ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। জসীম উদ্‌দীন লিখেছেন, তাঁকে ‘...গুছাইয়া বলিয়াছিলাম কিনা মনে নাই’। তবে বইতে তিনি খুব গুছিয়ে লিখেছেন। তাঁর কথাগুলো নতুন কিছু নয়। কিন্তু যে তুচ্ছ কথা নিয়ে কথা শুরু করেছি তার মীমাংসা আগে জসীমউদ্দীনের বরাতেই দেবো বলে ব্যাপারটি তুলছি।

দুই

জসীম উদ্‌দীন বলছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর পূর্ব পাকিস্তানে কবিতার ক্ষেত্রে “তিনটি প্রকাশ ধারা” প্রবাহিত হয়েছে।

“একদল বলিতেছেন, আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি আমাদের তহজিব তমদ্দুনকে রূপায়িত করিবার জন্য। পাকিস্তান যেমন নতুন দেশ আমাদের সাহিত্যও হইবে তেমনি নতুন, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সাহিত্য হইতে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা সাহিত্যের উপমা, অলঙ্কার ও প্রকাশভঙ্গিতে যেখানে যেখানে পৌত্তলিকতার গন্ধ আছে সে সকল সম্পূর্ণ বর্জন করিয়া আমরা আরবি, ফারসী ও উর্দু সাহিত্য হইতে উপমা অলঙ্কার আহরণ করিয়া প্রকৃত ইসলামী সাহিত্য গঠন করিব। বহু আরবি, ফারসী ও উর্দু শব্দ আমাদের মুসলিম সমাজে কোন কোন স্থানে প্রচলিত আছে। সেই শব্দগুলিকে আমাদের সাহিত্যে নতুন করিয়া প্রয়োগ করিয়া আমরা আলাদা মুসলিম সাহিত্য গঠন করিব।”

এই হলো প্রথম ধারা।

প্রথম ধারা কী বলতে চাইছে? তাহজীব তমদ্দূনের দিক থেকে রাষ্ট্র গঠনের একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকে নিজেদের শিল্প সংস্কৃতি সভ্যতা বলে অনুমান করা হয় তার চর্চার জন্যই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র অতএব পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে শিল্প-সাহিত্য চর্চার উপায় বা হাতিয়ার। পাকিস্তান ‘মুসলমানদের জন্য গঠিত হয়েছে অতএব মুসলিম রাষ্ট্রের সাহিত্যকেও ‘মুস্লিম সাহিত্য’ হতে হবে। রাষ্ট্রের পরিগঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয় পরিগঠন সম্পন্ন হয়। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার কর্তব্য হচ্ছে যে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করা। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার কাজ রাষ্ট্রীয় বিকাশে সহায়তা করা। সেটা তখনই সম্ভব যদি রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে শিল্প সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্য একই হয় বা নিদেন পক্ষে একই রুকুতে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় ধারাও নতুন সাহিত্য রচনা করতে চায়, পুরাতন থেকে আলাদা হওয়ার সাধনা করে।

“আর একদল সাহিত্যিক আছেন। তাঁরা বলেন, আমাদের সাহিত্যের পিতা পিতামহেরা এখন মরিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইতেছেন, তাহাদের সাহিত্য হইতে আমাদের সাহিত্য হইবে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁহাদের ব্যবহৃত উপমা, অলঙ্কার, প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিয়া আমরা নতুন সাহিত্য গড়িব। এই নতুন সাহিত্য গড়িতে তাঁহারা ইউরোপ, আমেরিকার কবিদের মতাদর্শ এবং প্রকাশভঙ্গিমা অবলম্বন করিয়া এক ধরনের কবিতা রচনা করিতেছে। ইহারা কেহ কেহ পশ্চিমবঙ্গের অতি আধুনিক কবিদের ভাবশিষ্য। প্রেম, ভালবাসা, স্বদেশানুভূতি, সবকিছুর উপর তাঁহারা satire - এর বাণ নিক্ষেপ করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলে, বর্তমানে সাহিত্য তৈরি হইবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায়, জনসাধারণের মধ্যে নয়।”

এবার তৃতীয় ধারা...

তৃতীয় ধারার মধ্যে ‘আলাদা’ হবার কোন সাধনা নাই। তাঁরা বরং ‘এক’ হবার সাধনা করেন।

জসীম উদ্‌দীন ঠিকই ধরেছেন, প্রথম ধারার সঙ্গে সম্পর্ক সাহিত্য ও রাজনীতির আর দ্বিতীয় ধারার সঙ্গে সম্পর্ক সাহিত্যের সঙ্গে সাহিত্যের, নতুনের সঙ্গে পুরাতনের। বাংলাভাষী যে জনগোষ্ঠীকে প্রথম ধারার সাহিত্যিকরা রাজনৈতিকভাবে শত্রু জ্ঞান করেন তাদের সাহিত্য থেকে ‘আলাদা’ সাহিত্য রচনাই তাঁদের ইচ্ছা। এই ইচ্ছার রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলো। যে রাজনৈতিক ইচ্ছা সেই আন্দোলনে প্রকাশিত হয়েছে তারই একটা সাহিত্যিক রূপ খাড়া করাই প্রথম ধারার লক্ষ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চোখে এই ধারা মন্দ বলেই সবসময়ই দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিচার রাজনৈতিক বিবাদের মানদণ্ড দিয়ে নির্ধারিত। এর সমর্থন কিম্বা অস্বীকার রাজনৈতিক পক্ষপাতের সঙ্গে যুক্ত। তবে সেই বিবাদের সার কথা খেয়ালে রাখা জরুরি। প্রথম ধারা বলছে রাষ্ট্রের পরিগঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিগঠন সম্পন্ন হয়। অতএব সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার কর্তব্য হচ্ছে সেই পরিগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা যখন রাষ্ট্রীয় বিকাশে সহায়তা করে সেটা জাতীয় বিকাশের সমর্থক হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র আর জাতির সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথম ধারার পক্ষপাত রাষ্ট্রের দিকে।

প্রথম ধারা পাকিস্তানবাদী ধারা হিসাবেও পরিচিত। এর বিরোধী ধারা হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা। জসীম উদ্‌দীন পাকিস্তান আমলেই পাকিস্তানবাদের বিপরীতে যার উত্থান দেখেছেন। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের অনুমানের ধরণ ও বক্তব্যের সারকথার সঙ্গে পাকিস্তানবাদীদের কোন ফারাক নাই। পাকিস্তানবাদীদের মতোই তারা দাবি করে মুসলমানদের তাহজিব তমদ্দুনের মতো বাঙালিদেরও আলাদা ও সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি ও সভ্যতা আছে। বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে বাঙালিদের শিল্প-সাহিত্য ও সভ্যতা চর্চার জন্য। সাহিত্যে যা কিছু পৌত্তলিক বা অমুসলমানি ব্যাপার আছে তাকে যেমন পাকিস্তানবাদীরা সাফ করতে চেয়েছে, ঠিক তেমনি যা কিছু বাঙালি না তাকেও বাঙালি জাতীয়তবাদীরা ছেঁটে ফেলতে চায়; যেখানে যেখানে মুসলমানিত্ব আছে সেইসব বর্জন করে বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তুলতে হবে।

এই দুই ধারারা পার্থক্য রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের অঙ্গাঙ্গী বা অনিবার্য সম্পর্ক নিয়ে নয়। সেখানে তারা একমত। সাহিত্যের – বিশেষত কবিতার নিজের কোন উদ্দেশ্য বা কর্তব্য আদৌ থাকতে পারে কিনা বদ্ধচিন্তার মধ্যে সেই প্রশ্নের উদয় ঘটা অসম্ভবই বটে। যে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করাই শিল্প-সাহিত্যের কাজ। তর্ক হচ্ছে তাহজীব তমদ্দুন বনাম বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতার চর্চা নিয়ে। পাকিস্তানবাদীরা দাবি করছে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে মুসলমানদের জন্য, অতএব যা কিছু মুসলমানি না, তাকে বর্জন করতে হবে। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও যা কিছু বাঙালি না তা বর্জন করতে চায়। কে কি বর্জন করবে তাই নিয়ে বাহাস। কিন্তু এই তর্ক ওঠেনি যে কেন কবিতাকে রাষ্ট্রের বা জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়নের কর্তব্য পালন করতে হবে। পাকিস্তানবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীর মধ্যে এই ক্ষেত্রে গভীর ও আন্তরিক মিল বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পাকিস্তানবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আমরা সাধারণত দুটো পৃথক ধারা বলে বিচার করতে অভ্যস্ত। এই পার্থক্য রাজনৈতিক সন্দেহ নাই। কিন্তু রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের লড়াইয়ের কবিতা বা শিল্পসাহিত্যের ভূমিকা কি হবে সেই দিক থেকে বিচার করলে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায় না। কবিতার উদ্দেশ্য কবিতার অন্তর্গত কোন তাগিদ থেকে তৈরি হয় না, সেটা কবিতার বাইরে রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। সাহিত্য বিচারের দিক থেকে তাদের একই ধা্রার অন্তর্গত গণ্য করাই সমীচিন। রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাধান্য মানা এবং তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রথম ধারার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছাটা আসলে কী? সেটা কি পাকিস্তানী রাষ্ট্রের বয়ান? নাকি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর? এইসব বিতর্কে সবসময়ই জাতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচারের জটিল ও অমীমাংসিত দিকগুলো উহ্য থেকে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র থেকে জাতীয় চৈতন্য তৈরি হয়, নাকি জাতীয় চৈতন্য আগে? জাতীয় চৈতন্যের আবেগ ও তীব্রতাই কি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যথেষ্ট? পাকিস্তানবাদীরা বলেছেন পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অতএব তাকে অখণ্ড ও শক্তিশালী করার জন্য সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির চর্চা সেই রাষ্ট্রের মর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বলেছেন, ‘আবহমান বাঙালি জাতি’ বলে আগে থাকতেই স্থির-নির্দিষ্ট একটা জাতি আছে এই উপমহাদেশে, পশ্চিম বাংলার জনগণও সেই ‘জাতি’-র অন্তর্গত। এই জাতি পরিচয়ই নতুন রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্যতা প্রদান করে। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির কাজ হচ্ছে আবহমান বাঙালি জাতির শ্রীবৃদ্ধি ও সেই জাতিবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দুটো ধারাই মনে করে শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির ভূমিকা রাজনীতির উপায় বা মাধ্যম হয়ে ওঠা -- জাতির বা রাষ্ট্রের বিকাশ সাধন করা, জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় পরিচয় দৃঢ় করা, ইত্যাদি। সাহিত্য, শিল্প বা সংস্কৃতির স্বাধীন কোন ভূমিকা তাঁরা স্বীকার করেন তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। দুই ধারার তর্কে বিতর্কে সাহিত্য, শিল্প বা সংস্কৃতির নিজস্ব কোন স্বাধীন ভূমিকা থাকতে পারে কিনা সেই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক গৌণ হয়ে থেকেছে। প্রধান হয়ে আছে শিল্পসাহিত্যের বাইরের বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তি বা বাইরের দায়। কবিতাকে তার নিজের দায় মেটাবার আগে পাকিস্তানী রাষ্ট্রের কিম্বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের দায় মেটাতে হবে। পাকিস্তানবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আমরা সাধারণত দুটো পৃথক ধারা বলে বিচার করতে অভ্যন্ত। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি – বিশেষত কবিতাকে এই দুই ধারা যেভাবে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের লড়াইয়ের অধীন কর্মকাণ্ড হিসাবে দেখে সেখানে কোন পার্থক্য নাই। তারা একই ধারারই অন্তর্গত। অর্থাৎ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িক দায় মেটাবার কাজে ব্যবহারকেই তারা শিল্পকলার পরয়ার্থ বিবেচনা করে। সাম্প্রদায়িক – কারণ একপক্ষের কাছে সম্প্রদায় হিসাবে ‘মুসলমান’ আর অপর পক্ষে সম্প্রদায় হিসাবে ‘বাঙালি’ পরিচয়ই চিরায়ত ও অপরিবর্তনীয় পরিচয় হিসাবে মান্য। সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের মধ্যেই তারা নিজ নিজ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের মর্মার্থ উপলব্ধি করে।


podmapar


রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাধান্য মানা এবং তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রথম ধারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আমরা কমবেশী ওয়াকিবহাল। কিন্তু জসীমউদ্দীনের মুখে সেই কথা শোনার আলাদা মজা আছে:

“সিন্দুর, ধানদূর্বা, শাখা, শঙ্খ, তমাল, কদম্ব, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে হিন্দু পৌত্তলিকতার সংস্পর্শ আছে বলিয়া এইসব শব্দ-সমন্বিত কোন লেখাকে তাঁহারা শুধু অবজ্ঞাই করেন না, তাঁহাদের কোন পত্র-পত্রিকায় সেই সব লেখা কখনো ছাপা হইতে পারে না। এই দলের লেখকদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান লেখক ফররুখ আহমদ। তিনি তাঁর লেখনীর ভিতর দিয়া মুসলমানদের সেই অতীত গৌরব ফিরাইয়া আনিতে চাহেন। তাঁর মতে আমাদের যাহা কিছু অবনতি তাহার একমাত্র কারণ আমরা পবিত্র কোরানের শিক্ষা হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছি। আবার আমাদিগকে সেই শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের কবি ইকবাল বোধহয় তাঁর স্বগোত্রীয়। পূর্ব পাকিস্তানের আরও একজন কবি তাঁহার লেখায় বহুল পরিমাণে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন -- তাঁরা নাম মোফাখখারুল ইসলাম। এককালে তিনি আমাদের গ্রাম জীবন অবলম্বন করিয়া অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখিতেন। সৈয়দ আলী আহসান, আলী আশরাফ প্রমুখ কবিরা যদিও তাহাদের কাব্যসাহিত্যে প্রচুর আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন না, তাঁহারা ফররুখ আহমদের সমমতাবলম্বী। তালিম হোসেনও তাঁহার লেখায় বহুল পরিমাণে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন।”

যেখানে ধর্ম আর কোরানের কথা বলা হয়েছে সেখানে ‘বাঙালি’ ও ‘বাঙালিত্ব’ বসালে আমরা একই ধারার সাহিত্য পাবো, বিষয় শুধু বদলাবে। ধর্মের মানদণ্ড দিয়ে নিজের পরিচয় নির্ণয় করলে অন্য ধর্ম যেমন বাদ যায়, ‘জাতি’ বা ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয় প্রধান মানদণ্ড হলে বাংলাদেশের অন্য সকল জাতি ও অন্যান্য ভাষা ও তাদের সাহিত্যও বাদ যায়। দুটোর মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ আছে, এবং সেটা বিষে পরিণত হয় এমনকি সশস্ত্র যুদ্ধের রূপও পরিগ্রহণ করতে পারে। পাহাড়িদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যুদ্ধের কথা এখানে আর তুললাম না।

দ্বিতীয় ধারা অরাজনৈতিক। কিন্তু এঁরা “পশ্চিমবঙ্গের অতি আধুনিক কবিদের ভাবশিষ্য”। সমালোচনার যে দিকটার প্রতি জসীম উদ্‌দীন জোর দিচ্ছেন সেটা কলকাতার অনুকরণের জন্য যতোটা নয় তার চেয়ে বেশী জনগণের সঙ্গে এই ধারার সম্পর্কহীনতার জন্য। “তাহাদের কেহ কেহ বলেন, বর্তমানের সাহিত্য তৈরি হইবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায়, জনসাধারণের মধ্যে নয়”। কিন্তু আরো যে দিকটি তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হোল, “প্রেম-ভালবাসা, স্বদেশানুভূতি, সবকিছুরই উপর তাঁহারা satire-এর বাণ নিক্ষেপ করেন।”

এই ধারা শুধু অরাজনৈতিক নয়, গণবিরোধীও বটে। এখানেই জসীমউদ্দীনের আপত্তি এবং আমি তাঁর সঙ্গে একশ ভাগ একমত। যাঁরা এই ধারা চর্চা করেন শ্রেণীর দিক থেকে তাঁরা জনসাধারণের কাছাকাছির মানুষ নন। এই শ্রেণীচরিত্রের দিকটি ছাড়াও জসীমউদ্দীনের আরো আপত্তির কারণ হলো,

“প্রচলিত বাংলা ছন্দ যাহা ভারতচন্দ্র হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বহু মনীষীর দানে শত বাহু বিস্তার করিয়াছে ইহা বর্জন করিয়া তাঁহারা দুর্বোধ্য প্রকাশে নিজেদের কাব্যসম্ভার সৃষ্টি করেন। যদিও ইহাদের বইপুস্তক কতকটা এই শ্রেণীর লেখকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু ইহারা দলে ভারী। সে যুগের ধর্মপ্রচারকদের মতো ইহারা মনে করেন, তাঁহারা একটি বিরাট সাহিত্য-সম্ভাবনার বাণী লইয়া সাহিত্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছেন। সেই জন্য পাঠকের সংখ্যা সীমিত হইলেও ইহাদের সাহিত্য সাধনার উৎসাহ দিন দিন বাড়িয়াই চলিতেছে এবং বহু বিচিত্র ছন্দে লেখার অভ্যাস করিতে হয় না বলিয়া দিনে দিনে এই গোষ্ঠীর লেখকের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিয়াছে। ইহাদের লেখা খুব কম লোক পড়ে বলিয়া ইহারা একে অপরের লেখা অনুকরণ করিলেও পাঠক তাহা ধরিতে পারে না। এই দলের মধ্যমণি শামসুর রাহমান। বর্তমানে তিনি কিছু ছন্দোবদ্ধ কবিতাও লিখিতেছেন। তাঁহার কোন কোন কবিতা আমার বেশ ভাল লাগে।”

লেখকরাই লেখকদের লেখা পড়ছেন কিন্তু এঁরা “দলে ভারী। আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ প্রভৃতি কবিরা এই দলভুক্ত।” জসীম উদ্‌দীন যে তালিকা দিয়েছেন সেই তালিকায় আমার আপত্তি আছে। তবে তথাকথিত আধুনিক কবিতার শ্রেণী ও গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই সাহিত্য ফেলনা বা এর কোন মূল্য নেই। জসীম উদ্‌দীন বলছেন,

“পশ্চিমবঙ্গের অতি আধুনিক কবিরা গদ্যছন্দে কবিতা লিখিতে লিখিতে তাঁহাদের গদ্য লেখায় এক অপূর্ণ ধ্বনিবৈচিত্র্য আনিয়াছেন। তাঁহারা যখন গদ্যে প্রবন্ধ বা গল্প লেখেন তাঁহাদের ভাষার গতি ও সুন্দর ধ্বনিবিন্যাস দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। আমার বিশ্বাস, আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের অতি আধুনিক কবিদের হাতেও একদিন তেমনি অপূর্ব গদ্যে প্রবন্ধ ও গল্প উপন্যাস রূপায়িত হইবে। এই দলের কবিরা বেশ পড়াশোনা করেন। ইউরোপের অতি আধুনিক কবিদের উপর নানা প্রবন্ধ লিখিয়া তাঁহাদের লেখার অনুবাদ করিয়া এই দলের কবিরা আমাদের পাঠকগোষ্ঠির মনে পাকিস্তানের বাহিরের সাহিত্যের প্রতি একটা ঔৎসুক্য জাগাইতে সমর্থ হইয়াছেন। এ দান কোন অংশে কম নয়।”

কাব্যশৈলীর দিক থেকে এই ধারার অবদান জসীম মানছেন। ঠিক তেমনি প্রথম ধারার সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নও নেতিবাচক নয়। কিন্তু সেটা শর্তসাপেক্ষে।

“যদি ইহাদের সাহিত্য দেশকে অন্ধগোঁড়ামি, কূপমণ্ডূকতা আর কুসংস্কারের পথে লইয়া যাইতে সাহায্য না করে, তবে আমার মনে হয় ইহাদের রচনাশৈলী আমাদের সাহিত্যের আসরে একটি গৌরবের আসন গ্রহণ করিবে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের কবিরা তাহাদের স্ব স্ব ধর্মমত প্রচার করিতে লেখনি ধারণ করিয়াছিলেন। চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতি প্রভৃতি কবিরা শুধুমাত্র বৈষ্ণবদের জন্য যে সুললিত পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন, তাহা এখন বৈষ্ণবদের পানপত্র গড়াইয়া বিশ্বজগতের রসপিপাসুদের আস্বাদনের সামগ্রী হইয়া পড়িয়াছে। মাওলানা রুমী, হাফিজ, শেখ সাদি প্রভৃতি কবিরা ইসলাম প্রচারের জন্য সাহিত্য সাধনা আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সাহিত্য এখন বিশ্ববাসীর সাহিত্য”।

ধর্ম আশ্রয় করে সাহিত্য রচনা মানেই মন্দ রচনার নয়। বরং অধিকাংশ বিশ্বসাহিত্য কোন না কোন ভাবে ধর্মাশ্রিত। জসীম উদ্‌দীন ধর্মকে কূপণ্ডূকতা, গোঁড়ামি বা কুসংস্কারের সঙ্গে এক করে ফেলেননি। এটা যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয়।

তৃতীয় ধারায় জসীম নিজেকে ফেলেছেন। লিখছেন,

“আমাদের দেশে আর একদল কবি আছেন, তাঁহারা বলেন, আমাদের দেশের শতকরা নিরানব্বই জন লোকেই যখন গ্রামে বাস করে তখন আমাদের সাহিত্য ভরা থাকিবে তাহাদের সুখ-দুঃখ। তাহাদের আশা-আকাঙ্খা, তাহাদের জীবন-জিজ্ঞাসার সবকিছু লইয়া আমরা সাহিত্য করিব। এইজন্য তাঁহারা শুধু গ্রামবাসীদের কথাটি তাঁহাদের সাহিত্যে লেখেন না, তাঁহারা গ্রামে যাইয়া গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশিয়াই শুধু তাহাদের অন্তর জানিতে চাহেন না; যুগ যুগান্তর হইতে আমাদের গ্রামদেশে যে অপূর্ব লোকসাহিত্য রচিত হইয়া আসিতেছে তাহার ভিতরে গ্রামবাসীদের মনের কথা খুঁজিয়া বেড়ান। নিজেদের লেখায় সেই লোকসাহিত্যের কোন কোন কথা ভরিয়া দিয়া দেশের পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাঁহাদের সাহিত্যের যোগসংযোগ করেন। আমি নিজে এবং আশরাফ সিদ্দিকী, রওশন ইজদানী, আবদুল হাই মাসরেকি প্রভৃতি কবিরা এই দলভুক্ত। আমার নিজের সাহিত্যকর্মের বিষয়ে সেদিন কিছুটা বলিয়াছি। আমার এক ধরনের লেখায় গ্রামবাসীদের আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ লইয়া সাহিত্য করিয়াছি। আমার দেশের অধিকাংশ লোক লেখাপড়া জানে না। আমার লেখক জীবনের এই দুর্ভাগ্য যে, আমি যাহাদের লইয়া সারাজীবন সাহিত্য করিলাম তাঁহারা একজনও আমার লেখা পড়িল না। দেশের অর্ধশিক্ষিত আর শিক্ষিত সমাজ আমার পাঠক-পাঠিকা। তাহাদের কাছে আমি গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখ তুলিয়া তাহাদের মনে গ্রামবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাইতে চেষ্টা করি। তাহাদের দুঃখ ও শোষণ-পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তাহাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকে শোষণ করে, তাহাদের মুখের আহার কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্র্যের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।”

এখানে জসীম যাঁদের সঙ্গে নিজেকে এককাতারে ফেলেছেন তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন হবে। কিন্তু তৃতীয় একটি ধারা হিশাবে তিনি নিজেকে যেখানে স্থাপন করেছেন সেখানে তাঁর পরিচ্ছন্ন চিন্তাই কাজ করেছে। এটাও পরিষ্কার যে তিনি সন্ধিক্ষণের মানুষ। শ্রুতি ও লিখন যে সময় আলাদা হয়ে যাচ্ছে সেই সময়ের কবি তিনি। কলম বা ছাপাখানা কবিতাকে যেভাবে বদলিয়ে দিচ্ছে সেই দিকটা তিনি ধরতে পারছেন না। কবিতার তিনটি ‘প্রকাশ ধারা’ ভাগ করছেন কবিদের বক্তব্য, কিম্বা কবিতায় প্রকাশিত ভাব দিয়ে। টেকনোলজি কিভাবে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বদলে দেয়, তার আঙ্গিকে আর মর্মে যে রূপান্তরগুলো আনে তার ইশারাগুলো তখনো বাংলা ভাষার কোন কবির চোখেই ধরা পড়ে নি। জসীম উদ্‌দীন যে কবিতা লিখছেন, সেটা তিনি লিখতে শিখেছেন বলে লিখেছেন। কিন্তু যাদের লেখার সঙ্গে নিজের যোগ আবিষ্কার করছেন সেগুলো শ্রুতি ও কানের জন্যই লেখা, ছাপাখানার জন্য নয়। সেগুলো চোখে দেখে পাঠ -- চোখে দেখে শোনার জন্য নয়। আর রয়ে গিয়েছে কেচ্ছার বয়ান -- গল্পের কাঠামো।

জসীম উদ্‌দীন এই দিক থেকে খুবই মজার কবি। তাঁর মধ্যে কান আর কলমের দ্বন্দ অনুমান করে আমোদ বোধ করেছি আমি। তাঁকে পড়তে হবে ঠিক যেমন বয়াতিদের গান শুনি আমরা। কিন্তু তাঁর সততাটুকু ওখানে যে তিনি ঠিক যে কাজটি করেছেন সেটা তিনি সজ্ঞানেই করেছেন। তিনি খোলামেলাই বলেছেন আমি গ্রামের অনেক গান ‘নকল’ করেছি। নকল শব্দটি ব্যবহার করেননি। আমি কৌতুক করে বসালাম। বলেছেন, ‘... লেখায় লোকসাহিত্যের কোন কোন কথা ভরিয়া দিয়া দেশের পূর্বসূরিদের সঙ্গে ... সাহিত্যের যোগসংযোগ’ ঘটিয়েছেন তিনি ও তাঁর ধারার কবিকুল। গ্রাম্য গান বা কবিতার এক লাইন তিনি নিয়েছেন আর নিজের কিছু লেখা ঢুকিয়ে দিয়েছেন এই সরল সত্য স্বীকার করতে তাঁর কোনই লজ্জা হয়নি। তবে অন্যের রচনা নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছেন অভিযোগ থাকলেও এই সৎ ও সরল স্বীকারোক্তি ভাল। সততা সবসময়ই সুন্দর।

যেহেতু মন তাঁর পড়ে রয়েছিল শ্রুতির কাছে; কানের কাছে কবির হৃদয় বাঁধা ছিল সবসময়ই। ফলে তাঁর কবিতা নিরক্ষর পড়তে পারছে না, সেই বেদনাটুকু জসীম উদ্‌দীনের চেয়ে এতো সকাতরে আমি কাউকে উপলব্ধি করতে দেখিনি। লিখে বলা তো বহু দূরের কথা।

আমি জসীমউদ্দীনের ভক্ত। খুব মজা পাই তাঁর কবিতা।  তিনি  দুর্দান্ত সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক উপাদানও বটে। তাঁকে আরও নানান দিক থেকে পাঠ খুবই জরুরী।

 

 

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 6074 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD