ওয়াহিদ সুজন


Tuesday 08 May 12

print

আদোনিসের নির্বাচিত কবিতা। অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব। প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০১২। প্রকাশক: আদর্শ। প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল। ২৪০ পৃষ্ঠা। মূল্য: ৩৭৮ টাকা।

তবু প্রশ্ন করি: এ গন্তব্য কি, এই আখের কি- যা চারপাশের নাগাল ছাড়া কিছুই স্পর্শ করে না, মিলিত হয় না কোন কিছুর সাথে? তবে কি গন্তব্য মিলিত হয় যেখানে গন্তব্য নেই? (তাহার নাম, পৃষ্ঠা: ২৮)

তার প্রকৃত নাম আলী আহমদ সাঈদ ইসবার। দুনিয়ার মানুষ তাকে আদোনিস নামে চিনেন। সিরিয়ার জম্মগ্রহনকারী আরবি ভাষার কবি আদোনিস। রাজনৈতিক কারণে হিজরত করেন লেবাননে। বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসকারী এই কবি সমসাময়িক আরবি কবিতার উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাম্প্রতিক আরবিয় বসন্তে গুঞ্জরিত হয়েছে তার কবিতা। পাঁচবার নোবেল পুরষ্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা আদোনিস বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে অপরিচিত নন। তার বেশ কিছু কবিতা ইতিমধ্যে বাংলায় অনুদিত হয়েছে। তাকে নিয়ে লেখাজোখাও রয়েছে বেশ।

আমার একাকীত্ব কেবল আমার ও আমার আত্মার মধ্যে

আমার আছে সেই প্রশ্ন যার উত্তর নেই

দেহের ভেতর নড়ে ওঠে অন্য এক শরীর, অন্দোলিত হয়

আমি সারাক্ষণ বিশ্বাস করি-শুধু আমিই-আমি আছি।

…………………………………

যন্ত্রের ভেতর যারা নগরকে হারিয়ে ফেলেছে হে সেই বেদুইন, তাহলে নগরের পরিচয় কি?

(নারী, পৃষ্ঠা: ৩৪-৩৬)

আদর্শ থেকে প্রকাশিত আদোনিসের নির্বাচিত কবিতার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। অনেকগুলো কারণ থেকে এখানে দুটোর কথা তুলব। প্রথমত: শাহাদাৎ তৈয়ব মূল আরবি থেকে আদোনিসের কবিতার অনুবাদ করেছেন। দ্বিতীয়ত: বইটি নামে আদোনিসের নির্বাচিত কবিতা হলেও এই বইয়ে গ্রন্থিত হয়েছে আদোনিসের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল কবিতা। আরবিতে প্রকাশিত আদোনিসের বইয়ের সংখ্যা মোটামুটি কুড়িটি। সেইখান থেকে বাছাই করা পনেরটির বইয়ের দুইশ পনেরটি কবিতা ঠাঁই করে নিয়েছে এই বইয়ে।

তুমি কি দেখেছ কোন নারী

বহন করছে শরতের লাশ?

ফুটপাতের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে মুখ তার

বৃষ্টির সুতো দিয়ে বুনেছিল সে তার

কাপড়

এবং মানুষ

শরতের ছাইয়ের ভেতর

নিভিয়ে যাওয়া একটুকরো অঙ্গার।

(শরতের লাশের আয়না, পৃষ্ঠা: ১১৮)

আদোনিসের কবিতা বহুমাত্রিক দ্যোতনা নিয়ে হাজির। তার কবিতার নারী মানে নিছক শরীরি বিষয় নয়- তার সাথে যোগ হয় প্রবাহমান সময় ধারা। সেখানে সময় আর কাল এক নয়। চিন্তা এসে কবিতায় ভর করে। নিছক শিল্প হয়ে উঠার অন্তঃসারশূন্য বাজিকরি নয়। কবিতার স্তুতি বিমূর্ত বা শুকনা নয়। সজীব কবিতারা পড়ে থাকে দুনিয়ার পথে। আদোনিস সজ্ঞানে তাদের কুড়িয়ে নিয়ে দুনিয়ার পথেই যেন আলো ফেলেছেন।

মাঝে মাঝে

আমরা যা কিছু প্রদীপ্ত করি

তাই সবচেয়ে সুন্দর আলোর আধার

আমরা নূর দর্শন করতে তা করি না

বরং করি যেন আমরা দেখি তার ছায়া

(অভিবাদন- জীবন মৃত্যুর সাথে লীলাখেলা, পৃষ্ঠা: ২৩৬)

কি করে দুনিয়ার পথে কবিতা জেগে উঠে! মানুষের পদচিহ্ন ধরে কবিতা কি করে ফুঁড়ে দেয় সেই মানুষেরই দেশ-কাল! এই প্রশ্ন ধরে আমরা আদোনিসের সাথে কবিতার পথে হাটতে পারি। আদোনিস সেই কবি যিনি ভাবকে মুহাজির বলে আখ্যা দেন। তার কাছে ইতিহাস ফুঁড়ে ভাবের চাঁদ উদিত হয়। সেই কাব্যকলা দ্রাঘিমা-অক্ষাংশের মাপ দিয়ে বিচার করা যায় না।

কবিতার স্থির কোন দেশ নাই। নিয়ত পরিবর্তনশীল ভাবের চাঁদ আলোকিত করে পূব-পশ্চিমকে। আদোনিস তার ভাব দিয়ে অখন্ড পথে হাঁটছেন। হাটঁছেন যেমন- চাদেঁর আলোয়, নারীর শরীরে- তেমনি হেটেছেন আরব দুনিয়া কি দুনিয়ার গ্লানি, অস্থিরতা, ভেদের ইতিহাসের ভেতর। তার ভাবের চাঁদ কি সবকিছুকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিতে পেরেছে! সেই প্রশ্নের উত্তর পাঠক মিলিয়ে নিতে পারেন তার কবিতার ভূবন থেকে।

সড়ক কি নারী?

দুঃখ পেলেও সে আলহামদুলিল্লাহ বলে

কিংবা ইশারায় ফুটিয়ে তোলে ক্রুশের ছবি

তার উঁচু স্তনের নিচে

অচিন অসহায় কুজোঁ হয়ে আছে অন্ধকার

(বৈরুতের দর্পন, পৃষ্ঠা: ১১৬)

আদোনিসের কবিতার গতি নির্ভার ও সহজিয়া। সেই গতি দেশ-কাল-জাত-পাতের ভেদ উড়িয়ে নিয়ে যায় মানুষের আত্মার সামনে। ইতিহাস আর ভাবের বাঁকে বাঁকে তিনি নিজেকে এবং নিজের চিহ্নকে আবিষ্কার করছেন। সেই আবিষ্কার নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে! কিন্তু তার সেই আবিষ্কারে বাদ পড়ে নাই প্রাচীন মিথ, আরব সমাজ, ইসলামি সংস্কৃতি, কাব্য-ঐতিহ্য থেকে শুরু করে সমসাময়িক বিশ্ব। তার কবিতার বিষয় দেখে মনে হতে পারে তিনি সারা দুনিয়ায় চিন্তার বীজ বুনেছেন। তার কবিতা আকার ও উপাদানে গীতল ও মাধুর্যময়। সেই মাধুর্যের ভূবনে পাঠক আপনাকে স্বাগতম।

আমি হয়ে গেছি আয়না:

প্রতিটি বস্তুই প্রতিফলিত করেছি, ভাসিয়ে তুলেছি

তোমার আগুনের ভেতর আমি বদলে দিয়েছি পানি এবং উদ্ভিদের প্রথা

বদলে দিয়েছি কন্ঠ আর ধ্বনি রূপ

(প্রাচ্যের বৃক্ষ, পৃষ্ঠা: ৯০)

বইটিতে তাৎপর্য ভূমিকা লিখেছেন কবি আনন্দ মজুমদার। সবশেষে সেই ভূমিকা থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করা যাক-

পারমার্থিক সম্ভাবনা ছাড়া জীবন অসম্ভব। জীবনের অর্থবোধকতা সংস্কৃতির মধ্যে। ভাষা সেই সংস্কৃতির অন্তর্জগত। আরবি ভাষার কাব্যময়তা ও সৃজনকাতরতা শৈশবের তিলাওয়াতের মধ্যে, পাক কালাম ও কাব্যের গীতল স্পন্দনে এই মশহুর কবির শায়েরির সাথে যেভাবে, সেভাবে পাঠকের সঙ্গেও মোলাকাত ঘটিয়ে যায়। জীবন সদাই সৃজনকাতর। এই সৃজনকাতরতার গর্ভধারিনী আরবি কবিতার রূহের ধুকপুকানি ...।

সেই রূহের আওয়াজ মূল আরবি থেকে অনুবাদ করে কবি শাহাদাত তৈয়ব আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাকে অসংখ্য মোবারকবাদ।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 6663 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD