আমরা মার্কস সম্পর্কে বাংলাদেশে যতোটা জানি লুদভিগ ফয়েরবাখ (১৮০৪ – ১৮৭২) সম্পর্কে তুলনায় কিছুই জানি না বলা যায়। মার্কস (এবং এঙ্গেলস) তরুণ বয়সে যার দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনিই এই ফয়েরবাখ। মার্কসের কপালে নাস্তিকতার যে খেতাব জুটেছিল, তরুণ বয়সে ফয়েরবাখের প্রভাব প্রধান একটা কারণ।

মার্কসের ওপর ফয়েরবাখের প্রভাবের প্রথম ছাপ পড়ে ১৮৪৫ সালে ‘জর্মন ভাবাদর্শ’ বইটিতে। এই বইটি মার্কস এবং এঙ্গেলস দুজনেই লিখেছিলেন, তবে বইটির প্রায় সর্বত্রই মার্কসের ছাপ খুবই স্পষ্ট। আঠারোশ পঁয়তাল্লিশ সালের শেষের দিকে দুই বন্ধু বইটি লেখা শেষ করেন। এই বইটি লেখার পাশাপাশি কার্ল মার্কস ফয়েরবাখ সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণা স্পষ্ট করবার জন্য ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস’ লিখেও শেষ করেন। এটা ছিল নিজের কাছে নিজের চিন্তা পরিচ্ছন্ন করবার খসড়া। তা সত্ত্বেও এটা মার্কসের বিখ্যাত একটি ‘নোট’। ফয়েরবাখের সঙ্গে মার্কসের চূড়ান্ত আড়ি বা বিচ্ছেদও এই নোটে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ ফয়েবাখীয় বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার পরিমণ্ডল থেকে মার্কস সুস্পষ্ট ভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

ফয়েরবাখীয় বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যাবার অর্থ বুঝতে হবে। তার মানে নাস্তিক্যবাদ থেকে মার্কস আবার পুরানা কায়দার আস্তিক হয়ে যান নি। এটা মার্কসের প্রথাগত আস্তিক্যবাদে প্রত্যাবর্তন নয়। নাস্তিক নাহলে আস্তিক, কিম্বা আস্তিক না হলে আস্তিক – চিন্তার এই প্রকার সাদাকালো গোলমাল থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ধর্ম সম্পর্কে প্রথাগত চিন্তায় যেমন তিনি ফিরে যান নি, তেমনি একই সঙ্গে ফয়েরবাখীয় বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার জগতকেও অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। আস্তিকতা/নাস্তিকতার তর্কের অসারত্ব ততোদিনে তিনি, সেই তরুণ বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন। তাঁর থিসিস অব ফয়েরবাখে সেটা প্রমাণ হিসাবে রয়ে গিয়েছে।

পদ্ধতি হিসাবে ধর্মসহ যে কোন মতাদর্শ পর্যালোচনা সমাজ ও ইতিহাস থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে করা নিরর্থক, কারন ধর্ম হোক কিম্বা হোক অন্য কোন মতাদর্শ -- মানুষের চিন্তা যেভাবে সমাজে হাজির থাকে তার রহস্য এতে উন্মোচন করা যাবে না। কিম্বা, অন্য কথায়, ধর্মকে যদি চিন্তার একটি ধরণ গণ্য করি তাহলে সমাজ ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন গণ্য করে তার বিচার করলে ধর্মের সামাজিক-ঐতিহাসিক তাৎপর্য কোনদিনই বোঝা যাবে না। এই ক্ষেত্রে মার্কসের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হোল, চিন্তা দিয়ে চিন্তার পর্যালোচনা দরকার, সেটা খুবই প্রাথমিক ও জরুরী কাজ এবং অন্য যে কোন পর্যালোচনার আগে ধর্মের পর্যালোচনা জরুরী, কিন্তু শুধু চিন্তা দিয়ে চিন্তার পর্যালোচনা চিন্তার জট খুলবে না। রহস্য থেকে যাবে। চিন্তাকে বুঝতে হলে সমাজকে বুঝতে হবে, বুঝতে হবে সমাজের বিবর্তন বা ইতিহাসকেও। ধর্মের সামাজিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝতে হলে সমাজে ও ইতিহাসে তার আবির্ভাব কেন এবং কোন বাস্তবতায় ঘটল সেই দিকগুলো আমাদের বুঝতে হবে। সেই ইতিহাস সব ধর্মের ক্ষেত্রে এক প্রকার নয়। তাহলে তাদের স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহাসিক ভিন্নতাকেও বোঝা দরকার। ‘ধর্ম’ নামক একটি সাধারণ ক্যাটাগরি দিয়ে সব ধর্মকে বিচার করলে আমরা বিশেষ বিশেষ ধর্মের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস ও তাৎপর্য বুঝব না।

চিন্তাকে স্রেফ চিন্তার পরিমণ্ডলে বিচার বাস্তবের মানুষ কিম্বা বাস্তবের সমাজ কোনটিকেই বুঝতে কোন কাজে আসে না, কিন্তু সেই পর্যালোচনা ছাড়া বাস্তবের বিচার শুরু করাও যায় না। আমরা যদি দাবি করি ধর্ম আধুনিক জীবনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক, কিম্বা ধর্ম পুরানা আর পশ্চাৎপদ ব্যাপার, ধর্মতত্ত্ব পুরানা চিন্তার আবর্জনা, অতএব এইসব নিয়ে ভাববার কোন দরকার নাই, ইত্যাদি -- তাহলে মানুষের অতীত বা বর্তমান দুইয়ের একটিরও হদিস আমরা পাবো না, বোঝা তো দূরের কথা। ধর্মের পর্যালোচনা সে কারনে মানুষের অন্য যে কোন বিষয় পর্যালোচনার পূর্বশর্ত।

মার্কসের কাছে ধর্মের পর্যালোচনা মানুষের অন্য যে কোন বিষয় পর্যালোচনার পূর্বশর্ত এই অর্থে যে মানুষের বৈষয়িক জীবনের বাস্তবতা এবং তাদের উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র -- বিশেষত উৎপাদন সম্পর্কের বিচার সেই পর্যালোচনা থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অর্থাৎ ধর্মের পর্যালোচনা সমাজ ও ইতিহাসের সামগ্রিক পর্যালোচনারই অন্তর্গত। সমাজ ও ইতিহাসের বৈষয়িক ভিত্তি বোঝা গেলে ধর্ম সহ মানুষের চিন্তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক রূপ ব্যাখ্যা করার শর্ত তৈরি হয়। বৈষয়িক জীবনের পর্যালোচনা তখন ধর্ম পর্যালোচনারও কাজে লাগে, নইলে না। অর্থাৎ সমাজ ও ইতিহাসের বৈষয়িকতা বা বাস্তবতার খবর নিলে ধর্মসহ যে কোন মতাদর্শ বা তত্ত্বের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। মার্কসের আগে দর্শন মানুষের চিন্তার পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাকে শুধু দর্শনবিদ্যা বা চিন্তার পরিমণ্ডলে সেই পর্যালোচনার গণ্ডি বেঁধে রেখেছিল। মার্কস তা ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বৈষয়িক বাস্তবতার ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছেন।

মার্কসের সারকথাটা হচ্ছে বৈষয়িক জগতকে বুঝলে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বকেও বোঝা যাবে। কিন্তু বৈষয়িক জগতকে বোঝার শর্ত তৈরি করতে হলে ধর্মের পর্যালোচনা জরুরী। তাই চিন্তার পরিমণ্ডলে আগে ধর্মের পর্যালোচনা মোটামুটি শেষ করতে হবে। মার্কস দাবি করেছিলেন, জার্মানিতে জার্মান ভাবাদর্শিক চিন্তাধারার মধ্যে যেহেতু খ্রিস্টধর্মের পর্যালোচনা মোটামুটি সম্পূর্ণ, অতএব অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্র ইত্যাদির পর্যালোচনা জার্মান দেশে শুরু হতে পারে।

মার্কসের এই দাবি থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিক অন্যত্র। একটি প্রশ্ন তুলে আমরা তা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। যদি ইসলাম কিম্বা প্রাচ্যদেশীয় অপরাপর ধর্মের পর্যালোচনা আমরা শেষ না করি তাহলে অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্র ইত্যাদির পর্যালোচনা আমরা কি আদৌ করতে পারবো? সেই পর্যালোচপ্নার সীমাবদ্ধতা কোথায়? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই পারব, সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে 'ধর্ম' বলতে আমরা শুধু খ্রিস্ট ধর্মকেই ধর্মের সার্বজনীন রূপ বলে অনুমান করে নেবার ভুল দিয়ে শুরু করছি। এর ফলে ধর্মের পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে পাশ্চাত্য চিন্তার যে দিগন্ত তৈরি করেছে, তার বৃত্তের মধ্যেই আমাদের চিন্তা ঘুরপাক খাবে। এটাই প্রধান সম্ভাবনা। এই ভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডলে থেকে ধর্ম নিয়ে ভাবাভাবি তো হচ্ছে। যদি তা তা আদৌ পর্যালোচনা হয় তবে তা খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলে বসে পর্যালোচনা। পদ্ধতি হিসাবে তা অনৈতিহাসিক এবং শুরুটাই ঘটবে খাপবদ্ধ ভাবে। খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলে বসেই আমরা ‘আধুনিকতা’’, ‘প্রগতিশীলতা’ ইত্যাদি নাম নিয়ে অন্য সকল ধর্ম বা পাশ্চাত্য চিন্তার বাইরের উপলব্ধিগুলোর প্রতি তর্জনি তুলে শাসাই। এই অভ্যাসটাই আমরা রপ্ত করেছি। তাই সহজেই বলি, ধর্ম মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল।

আধুনিকতা বা গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার অবদান মানবেতহাসে অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষের ইতিহাস পাশ্চাত্যে সর্বোচ্চ 'সভ্য' রূপ পরিগ্রহণ করেছে বা শেষ হয়েছে সেটা ঠিক নয়। এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমরা খুইয়ে বসি থাকি। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী খোপে বন্দী হয়ে যাই। মানুষের ইতিহাস বিচারের একপক্ষীয় মানদণ্ড মানবেতিহাসের অন্যান্য চিন্তা ও চিন্তাপদ্ধতির সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে, খামোশ করে দেয়। এমনকি টের পেলেও নিশ্চুপ থাকে। জ্ঞানে বা অজ্ঞানে অধিকাংশ সময় সেই সকল চিন্তা ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা অস্বীকার ও দমন করে। ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতিশীলতা’ ইত্যাদি ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী চিন্তার ধরণ চিন্তার সমূহ বিকাশের টুঁটি টিপে ধরে।

মার্কসের কাছে ধর্ম পর্যালোচনার অর্থ দাঁড়িয়েছিলো মানুষের বৈষয়িক জীবন এবং তার ইতিহাস ব্যাখ্যা করা। বিচ্ছিন্ন ভাবে ধর্ম নিয়ে আলোচনা নয়। মানুষ ইহলোকে বসেই পরলোকের চিন্তা করে, পরলোকে বা পরকালে বসে নয়। ‘পরলোক’ কিম্বা পারলৌকিক চিন্তা সে কারণে অবাস্তব কোন চিন্তা নয়। পারলৌকিক চিন্তার উৎপত্তি ইহলোকে। নবি রসুলদেরও আল্লা ইহলোকেই পাঠিয়েছিলেন। তাছাড়া আল্লার কাছে মোনাজাতের আগে ইসলামে ইহলোকে কল্যাণ চাওয়াই রীতি, তারপরই শুধু বলা হয়, ‘ওয়া ফিল আখেরাতে হাসানা’। ইসলামে আগে ইহলোক, পরে পরলোক। পারলৌকিক ক্ষেত্রে কার কি বিচার হবে সেটা শুধুমাত্র আল্লার এখতিয়ার, কোন ইহলোকিক মানুষের নয়। কিন্তু অনেক আলেম উলামা মওলানা মৌলবি ইহলোকেই স্বয়ং আল্লার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ইসলাম আপাদমস্তক ইহলৌকিক ধর্ম, এই সত্য ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা কম শক্তিশালী নয়।

তাহলে ইহলোকে মানুষের কাছে ধর্ম কিভাবে হাজির রয়েছে সেই বাস্তবতা বোঝা দরকার। ইহলোকে মানুষের অর্থনৈতিক দুঃখকষ্ট, বঞ্চনা, শোষণ ইত্যাদি বুঝলে ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এই অবস্থা থেকে কিভাবে মুক্তি চায় তার মর্মটাও বোঝা যাবে। সোজা কথায়, মানুষের ইহলৌকিক অবস্থার বিচারের মধ্য দিয়েই আল্লাহ ও পরকাল নিয়ে চিন্তিত মানুষকে বোঝা সম্ভব, উলটা ভাবে নয়। ইহলৌকিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষের ধর্ম বা ধর্মচিন্তা বোঝার চেষ্টা করলে সেটা হবে গাছের গোড়া কেটে দিয়ে শাখাপ্রশাখা ফুলপাতার দিকে তাকানো। যে ইহলৌকিক বাস্তবতায় মানুষ ধর্ম নিয়ে চিন্তা করে ও ধর্ম চর্চা করে সেটা বোঝা জরুরী। মানুষের চিন্তার সারবত্তা বোঝার এটাই পথ। বালখিল্য নাস্তিকতা, কিম্বা অর্বাচীন ধর্ম বিরোধিতা নয়। ধর্মচর্চা যখন তার ইহলৌকিক ভিত্তি হারায়, তখন তা সমাজ ও ইতিহাসের জন্য আপদের কারন হয়ে ওঠে।

ফয়েরবাখ কার্ল মার্কসকে আসলে দুটো ক্ষেত্রে গুণগত ভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। প্রথমত বৈষয়িক জীবন যাপনের ক্ষেত্র থেকে ধর্ম ও দর্শনকে পর্যালোচনা করবার নতুন পথ আবিষ্কারের ইশারা। ফয়েরবাখের এই ইশারা মার্কস কাজে লাগিয়েছিলেন। দর্শনের জগত ছেড়ে মার্কস কেন তাঁর পরিণত বয়সের পুরাটাই অর্থশাস্ত্র – বিশেষত ‘পুঁজি’র রহস্য নির্ণয়ে ব্যয় করেছেন সেটা মনে রাখলে মার্কসের ওপর ফয়েরবাখের এই প্রভাবের যুগান্তকারী ভূমিকা আমরা বুঝতে পারব।

দ্বিতীয়ত, ফয়েরবাখ সহ তত্ত্ববাগীশ ভালগার মেটেরিয়ালিজম বা ইতরোচিত বস্তুবাদের সীমাবদ্ধতা ফয়েরবাখের পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই মার্কস টের পেয়েছিলেন। ফয়েরবাখের চিন্তাকে মার্কস ‘ভালগার মেটেরিয়ালিজম’-এর অন্তর্গতই গণ্য করেছিলেন এখানেই মার্কসের পর্যালোচনার শক্তি আমরা ধরতে পারি। ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে’ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। ফয়েরবাখ তাঁর আদর্শ নয়, হতে পারে না, এটা তরুণ বয়সেই মার্কস বুঝে গিয়েছিলেন। ফলে ফয়েরবাখীয় নাস্তিকতাও তাঁর আরাধ্য নয়। সেই আলোচনা আমরা বিস্তারিত ভাবেই করব। তারপরও তরুন বয়সে ফয়েরবাখ সহ তরুণ দার্শনিকদের মধ্যে যারা ইয়ং বা বামপন্থি হেগেলিয়ান হিসাবে পরিচিত ছিলেন, মার্কস তাঁদের কাতারে দাঁড়িয়ে হেগেলের বিরোধিতা ও পর্যালোচনায় বিস্তর রসদ জুগিয়েছিলেন, কার্পন্য করেন নি। সেখানে মার্কসের মেধা সহজেই ধরা পড়ে। তরুণ বয়সের রচনায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি কোনটিরই অভাব ঘটে নি।

বাংলাদেশে আমরা এখনও কমিউনিজমের নামে ইতরোচিত বস্তুবাদের উপদ্রব সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি। এই বালখিল্য ইতরোচিত বস্তুবাদের সঙ্গে আর যাই হোক কার্ল মার্কসের কোন সম্পর্ক নাই। যাঁরা আসলেই মার্কসের অনুরাগী তাদের এই দিকটা ভাল ভাবে বুঝতে হবে।

তরুণ মার্কসের সেই সময়ের লেখালিখিগুলো একালের তরুণদের জন্য সোনার খনির মতো। অল্পকিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া একাডেমিক আলোচনা-পর্যালোচনার বাইরে ব্যবহারিক রাজনীতিতে তরুন মার্কসের লেখালিখির প্রত্যক্ষ প্রভাব কমিউনিস্ট আন্দোলনে নাই। তরুণ মার্কসকে পড়লে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে কিভাবে আগামির আরেক বিশাল চিন্তক অল্প বয়সে হেগেলের মতো বিপুল আর প্রচণ্ড প্রভাবশালী একজন দার্শনিককে মোকাবিলা করতে করতে নিজের চিন্তার রাস্তা অতি অল্প বয়সেই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে তুলছেন। ওর মধ্য দিয়ে নিজের যাত্রার অভিমুখও সাব্যস্ত করে নিয়েছিলেন তিনি।

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর ‘লুদভিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’ পুস্তিকায় ১৮৮৮ সালে লিখেছেন, তাঁরা দুজনে লিখলেও ‘জর্মন ভাবাদর্শ’ বা ‘জার্মান দর্শনের ভাবাদর্শগত মতামতের বিরুদ্ধে’ লিখিত বইটি ‘প্রধানত মার্কসেরই রচনা’। দুজনের স্বাক্ষর বহনকারী সেই গ্রন্থ ছিল তাঁদের দুজনের ‘এতদিনকার দার্শনিক বিবেকবুদ্ধির সঙ্গে হিসাবনিকাশ মিটিয়ে’ নেওয়া। জার্মান দর্শনের সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের বিবেকবুদ্ধি মিটিয়ে দেওয়ার কাজটি ছোট খাট ছিল না, বিশাল কর্মযজ্ঞই ছিল বলতে হবে। এঙ্গেলস জানাচ্ছেন পাণ্ডুলিপিটি অক্টাভো আকারের দুটো ঢাউশ গ্রন্থের রূপ নিয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বইটি আর প্রকাশিত হয় নি। ওয়েস্টফালিয়ায় যে প্রকাশককে পাঠানো হয়েছিলো পরে জানা গেল ‘পরিবর্তিত অবস্থার দরুন’ তারা আর বইটি ছাপবে না। এঙ্গেলস ভূমিকায় প্রকাশের মুখ দেখতে ব্যর্থ হওয়া পাণ্ডুলিপিটি সম্পর্কে মার্কসের কথার অনুকরণে মশকরা করে লিখেছেন, ‘পাণ্ডুলিপিটিকে ইঁদুরদের দাঁত দিয়ে কাটবার সমালোচনার কবলেই ছেড়ে দেয়া হোল সাগ্রহেই’। কারণ, ‘প্রধান যে উদ্দেশ্য, নিজেদের ধারনাকে স্বচ্ছ করা, সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল’।

‘জর্মন ভাবাদর্শ’ এবং ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস’ সহ জার্মান দর্শনের পর্যালোচনা মার্কসের চিন্তার রূপান্তর বোঝার জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে মার্কস জার্মন দর্শনের সঙ্গে নিজের বিবেক বুদ্ধির দায় কিভাবে মেটালেন সে সম্পর্কে মার্কসের পরে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোন সম্যক ধারণাই ছিল না। বৈপ্লবিক রাজনীতির পুনর্গঠন চাইলে এই বাস্তবতাকে আমলে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসের নাম ভাঙ্গিয়ে মার্কসের মৃত্যুর পরে যে মার্কসবাদ গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে মার্কসের চিন্তার ফারাক নিয়ে পাশ্চাত্যে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। মার্কসের মৃত্যুর অনেক অনেক পরে বিপ্লবোত্তর প্রাক্তন সোভিয়েট রাশিয়ায় ডেভিড রিয়াজিনভ যখন মার্কস এঙ্গেলসের কালেক্টেড ওয়ার্কস ছাপতে শুরু করলেন কেবল তখন, মাত্র ১৯২৭ সালে, মার্কসের তরুণ বয়সের কিছু কিছু লেখা আংশিক ছাপার মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু জোসেফ স্তালিনের হাতে ১৯৩১ সালে ডেভিড রিয়াজিনভ চিরতরে গুম হয়ে যান। মার্কসের চিন্তাকে সামগ্রিক ভাবে বোঝার প্রয়াসে ছেদ পড়ে। কমিউনিস্ট আন্দোলন মার্কসের সঙ্গে নাড়ীর বন্ধন ছিন্ন করে ‘স্টালিনবাদ’ হয়ে ওঠে। এর পরিণতি ইতিহাসে কী হয়েছে তা আমাদের কমবেশী জানা।

অবাক মনে হলেও কমিউনিস্ট আন্দোলন মার্কসের চিন্তার সঙ্গে পুরাপুরি পরিচিত ছিল না, এটাও ইতিহাসের চরম একটি সত্য। ঠিক যে মার্কসের নামে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সূত্র ধরে তার নামেই বলশেভিকরা দুনিয়া কাঁপানো অক্টোবর বিপ্লব সম্পন্ন করলেন, অথচ তাঁরা মার্কসের সব লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। ‘জর্মন ভাবাদর্শ' কিম্বা ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস’ মার্কসের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় নি।

যখন মার্কসের অপ্রকাশিত লেখাগুলো ছিঁটেফোঁটা ছাপার মুখ দেখতে শুরু করল তারা তৎক্ষণাৎ অফিসিয়াল মার্কসবাদের মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল, আর যারা সেইসব ছাপাতে সহায়তা করছিলেন তারা রাতারাতি দুষমনে পরিণত হলেন। এই সকল তথ্য মনে না রাখলে পরবর্তী কালে মার্কসের নামে তথাকথিত ‘বস্তুবাদী’ ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ দর্শন কিভাবে এক পেশে ভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে সেটা আমরা বুঝবো না।

হেগেলের অধিকারশাস্ত্র বা রাষ্ট্রতত্ত্বের সমালোচনা করে মার্কস একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন, সেটা তিনি ১৮৪৪ সালের ১১ অগাস্ট ফয়েরবাখকে পাঠান। সেখানে ফয়েরবাখের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশ পায়। ফয়েরবাখের ধর্ম পর্যালোচনা তরুণ মার্কসকে কোথায় কোথায় অনুপ্রাণিত করেছে এই চিঠিতে তার ইঙ্গিত মেলে। সেই সময় মার্কস ফয়েরবাখের তিনটি লেখার কথা উল্লেখ করেছেনঃ প্রথমটি হোল, ‘ভবিষ্যতের দর্শন’ (The Philosophy of the Future, 1843), দ্বিতীয়টি, ‘বিশ্বাসের প্রকৃতি’ (Nature of Faith) এবং তৃতীয়টি, ‘খ্রিস্টধর্মের মর্মার্থ’ (Essence of Christianity, 1941)।

মার্কস ফয়েরবাখের এই লেখার মধ্যে কী পেয়েছিলেন? ফয়েরবাখের লেখা চিঠির সূত্র ধরে আমরা কিছু কথা বলে রাখতে পারি।

 

মার্কস ফয়েরবাখকে লিখছেন,

“সজ্ঞানে করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু এইসব লেখালিখির মধ্য দিয়ে আপনি সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে দিচ্ছেন, আর কমিউনিস্টরা এভাবেই আপনাকে বুঝেছে। মানুষের বৈচিত্র ও বিভিন্নতার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের ঐক্যের ক্ষেত্র দেখিয়ে দেওয়া আর মনুষ্য প্রজাতিকে বিমূর্ততার বেহেশত থেকে বাস্তবের দুনিয়ায় নামিয়ে আনা – এটা কী আর, সমাজ –এর ধারণা ছাড়া!” (দেখুন, ফয়েরবাখকে লেখা মার্কসের চিঠি)।

সজ্ঞানে হোক কি অজ্ঞানে, ফয়েরবাখ ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে ধর্ম আল্লাহ, পরকাল, নবি-রসুলদের কথা বললেও আসলে তার বিষয়বস্তু মানুষ। দ্বিতীয়ত, এক মানুষ অন্য মানুষ থেকে আলাদা বা ভিন্ন হতে পারে, মানুষ বিভিন্ন ও বিচিত্র -- কিন্তু মনুষ্য প্রজাতির এই বৈচিত্রই মানুষকে প্রজাতি হিসাবে পরস্পরের প্রতি একান্ত করে তোলে বা ঐক্য বোধের তাগিদ তৈরি করে। কারণ শেষাবধি মানুষ সামাজিক জীব। সমাজেই তার পরমার্থ, সমাজের মধ্যেই তার সার্থকতা নিহিত। ধর্ম এই বিভিন্নতা ও বৈচিত্রসহ ঐকান্তিক সমাজের ধারণাই করে, কিন্তু করে বিমূর্ত ভাবে। অর্থাৎ দাবি করে মানুষের মধ্যে এই ‘ঐক্য’, ‘ঐকান্তিকতা’ ইহকালে বাস্তবায়িত হবার নয়। তার বাস্তবায়ন ঘটবে পরকালে – বেহেশতে। কিন্তু ফয়েরবাখ বিমূর্ততার বেহেশত থেকে মানুষের সমাজকে নামিয়ে এনেছেন বাস্তবের দুনিয়ায়। পরস্পরের প্রতি ঐকান্তিকতা বোধের তর্ক ইসলামি পরিভাষায় ‘উম্মাহ’ ও ‘তৌহিদ’ সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে যুক্ত। সকল মানুষ একদিন আল্লার একত্বে বিশ্বাস করবে এবং একমাত্র ‘এক’ই মানুষের উপাস্য সেটা উপলব্ধি করবে। এই উপলব্ধিই তাদের মধ্যে তৌহিদের বোধ জাগ্রত করবে এবং তারা বুঝতে পারবে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা সত্ত্বেও তারা একই ‘উম্মাহ’ বা বিশ্বসমাজের অন্তর্গত।

ফয়েরবাখের এই কাজটি তরুণ মার্কসের দারুন পছন্দ হয়েছে। কারণ মার্কস দুনিয়াতেই মানুষের সমাজ গড়তে চান। দুনিয়াই মানুষের বেহেশত হয়ে উঠুক। তরুণ মার্কস খুশি এ কারণে যে তিনি বুঝে গিয়েছেন সমাজতন্ত্র কিম্বা কমিউনিজম নতুন কোন আদর্শ বা মানুষের জন্য নতুন কোন ঐতিহাসিক কর্তব্য নির্ণয় করে না। বরং মানুষ নিজের জন্য যে পুরানা কর্তব্য নির্ণয় করে রেখেছে – বিশেষত ধর্মে -- তাকেই ইহলোকে বাস্তবায়িত করে মাত্র। ধর্ম মানুষের অন্তর্নিহিত ইচ্ছা, অভিপ্রায় বা তাগিদকেই কল্পনায় নির্মাণ করে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্য গড়ে তুলবার নৈতিক কর্তব্যবোধ জাগ্রত রাখে। ধর্মের আকাঙ্ক্ষা কিম্বা ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের যে গভীর আকুতি প্রকাশিত হয় তার সারার্থ হচ্ছে সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক হয়ে উঠবার আকুতি, ভেদবুদ্ধি অতিক্রম করে ঐক্যবদ্ধ সমাজ বা ইসলামের পরিভাষায় একই উম্মাহর অন্তর্গত হবার তাগিদ। একই উম্মাহ গঠনের তাগিদ একান্তই মনুষ্যজনোচিত আকাঙ্ক্ষা। মানুষের এই স্বাভাবিক আকাংখাকেই মার্কস তাঁর তরুণ বয়সের অনেক লেখায় মানুষের প্রজাতিগত স্বভাব (species being) বলে উল্লেখ করেছেন। আক্ষরিক কিম্বা পরিভাষাগত ভাবে ‘সমাজ’ আর ‘উম্মাহ’ বাহ্যিক দিক থেকে আলাদা মনে হয়। কিন্তু যতোই ভিন্ন মনে হোক, মর্মের দিক থেকে দুটো পরিভাষা খুবই কাছের। উভয়ের সাযুজ্যের ইঙ্গিতটুকু বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ধর্মের পর্যালোচনা আমাদের চৈতন্যের সংস্কার ঘটায়, মানুষের ইহলৌকিক কর্তব্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে। মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গেই মার্কস তরুণ বয়সে তাঁর বন্ধু আর্নল্ড রুজকে ১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা এক চিঠিতে বলছেন, “চৈতন্যের সংস্কার কথাটার আগাগোড়া মানেটাই হয়ে দাঁড়ায় জগতকে তার আপনকার চেতনা সম্পর্কে সজ্ঞান করে তোলা, তার নিজেকে নিয়ে নিজের স্বপ্ন দেখার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, জগতের নিজের কাছে নিজের কাজের ব্যাখ্যা তুলে ধরা”। অর্থাৎ মানুষ যে স্বপ্ন দেখে তাকে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে মানুষের কর্তব্য দেখিয়ে দেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়া বা নির্দেশ করাই ধর্ম পর্যালোচনার কাজ।

মার্কস তাঁর বন্ধু আর্নল্ড রুজকে ১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা সেই চিঠিতে আরও বলছেন, “ফয়েরবাখের ধর্ম পর্যালোচনার মতো আমাদের সকল কাজের লক্ষ্য হবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্বেগকে আত্ম-সচেতন মানবিক রূপ দেওয়া”। বিশেষত ধর্ম আসলে আদিতে কী আকাঙ্ক্ষা বহন করে চলেছে তার রহস্য সকলকে ব্যাখ্যা করা ও বুঝিয়ে বলা। বলাবাহুল্য, এটা পরিষ্কার মার্কসের চিন্তায় খেয়ে না খেয়ে ধর্ম বিরোধিতার ও নিরর্থক নাস্তিক্যবাদের কোন স্থান নাই। চিঠির পরের লাইনগুলো পাঠ করলে সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মার্কস আর আর্নল্ড দুই বন্ধু মিলে একটি পত্রিকা বের করতে চাইছিলেন। সেই পত্রিকার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা কর্মসূচি কি হবে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস বলছেন,

“আমাদের কর্মসূচীকে অবশ্যই হতে হবে চৈতন্যের সংস্কার, কিন্তু সেটা কোন প্রকার গোঁড়ামি বরদাশত করে নয়, বরং যে চেতনা তার নিজের কাছেই রহস্য হয়ে আছে -- ধর্মীয় হোক কিম্বা হোক রাজনৈতিক চেতনা রূপে -- তাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে পরিচ্ছন্ন করে তোলার মধ্য দিয়েই সেটা হবে। এর মধ্য দিয়েই এটা সাফ সাফ বোঝা যাবে, দুনিয়া দীর্ঘদিন ধরেই একটা কিছুর স্বপ্ন দেখছে যে স্বপ্ন সম্পর্কে জগতের শুধু সচেতন হয়ে ওঠা দরকার, যেন বাস্তবেই জগত তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্য দিয়েই আমরা সাফ সাফ বুঝে যাব, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের কোন প্রকট ভেদরেখা টানা আমাদের কাজ না, বরং আমাদের কাজ হচ্ছে অতীতের চিন্তাভাবনাকেই সম্পূর্ণ করা। পরিশেষে, এটাও সাফ সাফ বোঝা যাবে, মানুষ নতুন কোন কাজ আর শুরু করবে না, বরং সচেতন ভাবে তার পুরানা কাজেরই সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটাবে।” (হরফে গুরুত্বারোপ মার্কসের নিজের, দেখুন, আর্নল্ড রুজকে মার্কসের ১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা চিঠি। (Marx, Letters from the Franco-German Yearbooks, 1975))।

এই চিঠির উল্লেখ করছি বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের সেইসব ইসলামপন্থিদের জন্য যাঁরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পাশ্চাত্যের প্রপাগান্ডার কারনে মার্কসকে নাস্তিক দার্শনিক বলে বিরোধিতা করেন ও দূরে সরিয়ে রাখেন। অন্যদিকে সেইসব তরুণদের জন্য যারা আন্তরিক ভাবে বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তরের লড়াইয়ে শামিল হতে গিয়ে কমিউনিজমের প্রতি সঙ্গত কারনে আকৃষ্ট বোধ করেন। কিন্তু কমিউনিজম সম্পর্কে তারা যে ধারণা পোষণ করেন – বিশেষত ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী --তার সঙ্গে মার্কসের চিন্তার আদৌ কোন সাযুজ্য আছে কিনা সেটা নিজেরা ভালভাবে বিচার করে দেখেন নি। কমিউনিজম সম্পর্কে ধারণা তাঁরা প্রচলিত মার্কসবাদ থেকে পেয়েছেন।

বাংলাদেশে আমরা যদি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক সংকল্পের পুনর্গঠন চাই তাহলে ইতিহাসে মার্কসের নামের অধীনে যেসকল মার্কসবাদী পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে তার পর্যালোচনা জরুরী। আমরা যে পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করছি সেইদিক থেকে মার্কসের চিন্তার সঙ্গে মার্কসবাদ নামে বিভিন্ন ধারা-উপধারার মিল এবং পার্থক্য দুটোই নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যালোচনা করা দরকার। এ ছাড়া চিন্তার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। মার্কসের নামে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যর্থতার কারন নতুন করে বিচার করে দেখা গুরুত্বপূর্ন।সেই ব্যর্থতার পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংগঠনিক, বৈশ্বিক পরিস্থিতির বাস্তবতা প্রভৃতি বাস্তব কারণ থাকতে পারে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু দর্শনের দিক থেকে গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে মার্কসের নামে নানান ধারার মার্কসবাদ মার্কসের চিন্তার সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল কি? যেমন, তারা কিভাবে কমিউনিজম বুঝেছে এবং মার্কস কিভাবে কমিউনিজম বুঝতেন? মার্কসের তরুণ বয়সের লেখালিখি, বিশেষত এই চিঠিটি এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আমাদের নতুন ভাবে ভাবতে সাহায্য করতে পারে।

তরুণ মার্কসের এই চিঠি অসাধারণ এই অর্থে যে এই চিঠিতেই স্পষ্ট যে মার্কস কমিউনিস্ট আন্দোলন বলতে আসলে কি বুঝতেন। এই চিঠিরই আরেক জায়গায় তরুন মার্কস পরিষ্কার আর্নল্ড রুজকে বলছেন,

“আমি অতএব মোটেও কমিউনিজমের নামে কোন মতান্ধ ঝাণ্ডা তুলে ধরতে চাই না। বরং মতান্ধরা যেন পরিষ্কার ভাবে চিন্তা করতে পারে তাদের সেই সহায়তা দেওয়াই আমাদের কাজ। বিশেষ করে বলা দরকার, কমিউনিজম নিজেই এক বিমূর্ত মতান্ধ চিন্তা, আর আমি কমিউনিজম বলতে এই ধরনের কাল্পনিক সম্ভাব্য কমিউনিজম বুঝি না, বরং বুঝি যা আসলেই কাবে, দেজামি এবং ভাইতলিং প্রমুখের মধ্যে ছিল। এই কমিউনিজম নিজেও বিশেষ ধরণের মানবিক নীতিনৈতিকতার প্রকাশ, যা আবার তার বিপরীত বাস্তবতা হিসাবে হাজির থাকা ব্যাক্তিগত সম্পত্তির দ্বারা দূষিত। ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উৎখাত অতএব কোনভাবেই কমিউনিজমের সমার্থক হতে পারে না, কারণ কমিউনিজম অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনাও ইতিহাসে হাজির দেখেছে। যেমন, ফুরিয়ের, প্রুধোঁ – যারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, সে বিরোধিতা আকস্মিক নয়, অনিবার্যই ছিল, কারন সেটা ছিল সমাজতান্ত্রিক নীতির একপেশে বাস্তবায়ন”।

কমিউনিজম সম্পর্কে মার্কসের এই বক্তব্যও বাংলাদেশের ইসলামপন্থি ও কমিউনিস্টদের আমলে নেওয়া উচিত। মনে রাখার সুবিধার জন্য আমাদেী আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক মার্কসের কথার সারমর্ম করছি, যাতে আমরা সহজে মনে রাখতে পারি।

এক. মার্কস কমিউনিজমকে কোন কাল্পনিক বিশ্বাস বা মতান্ধ আদর্শ বলে গণ্য করেন নি।

দুই. বিমূর্ত বা অনৈতিহাসিক ভাবে মার্কস কমিউনিজমকে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উৎখাত গণ্য করেন নি, কিম্বা তার সমার্থক মনে করতেন না। বাস্তবিক লড়াই সংগ্রামের মধ্যেই মানুষ বাস্তব রূপান্তরের ভাবনা ভাবে। কমিউনিজম বিমূর্ত ধারণা নয় কথাটার মানে মার্কস ‘কমিউনিজম’ নামক কোন মনগড়া আদর্শ প্রস্তাব করতে চান নি। মানুষের বাস্তবের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ তার বিকাশের পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করবার জন্য যেভাবে বিভিন্ন সময়ে ভেবে এসেছে সেই ভাবনার পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই তিনি কমিউনিজম বুঝতে চেয়েছেন। কোন কাল্পনিক স্বপ্ন, সংকল্প বা অনুমান নির্ভর মতাদর্শ হিসাবে নয়, ইতিহাসের বাস্তব লড়াইয়ের ভেতরে গড়ে ওঠা বয়ান থেকেই কমিউনিজমকে বুঝতে হবে। তরুণ বয়সেই তিনি এ ব্যাপারে স্পষ্ট ছিলেন।

তিন. আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা বিচার করতে গিয়ে মানুষের চিন্তার ইতিহাসে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের চিন্তায় কমিউনিজম নামক যে ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে, মার্কস তাকেই বাস্তবের কমিউনিজম বলে পর্যালোচনা করেছেন। সেই সকল তত্ত্ব বা ধারণার মধ্যেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ রয়েছে; দ্বন্দ্ব-বিরোধের সেইসকল ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কেও তিনি সজ্ঞান থেকেছেন। কমিউনিজমকে মানুষের বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধিতার সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাস হিসাবে বিচার করাই এই ক্ষেত্রে সঙ্গত।

চার. ব্যাক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব, উপস্থিতি ও তার বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ভিন্ন ভাবে সমাজ গঠনের কথা চিন্তা করবেই। ঐতিহাসিক কারণেই তা অনিবার্য। কিন্তু সমাজ গঠনের এই চিন্তা নিজেকে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র যে নামেই ব্যাখ্যা করুক ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারণার বিপরীত ধারণা হিসাবেই তার উদ্ভব ও বিবর্তন ঘটে এবং তার ঐতিহাসিক উপস্থিতিও ব্যাক্তিগত সম্পত্তির জন্যই। এর ফলে কমিউনিজম কিম্বা সমাজতন্ত্র ইত্যাদি সবসময়ই ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারণার দ্বারা দূষিত থাকে।

পাঁচঃ মার্কস ‘অতীতের সঙ্গে প্রকট ভেদরেখা টানার বিরোধী। দুনিয়া দীর্ঘদিন ধরেই যার স্বপ্ন দেখছে সেই স্বপ্ন সম্পর্কে জগতকে শুধু সচেতন করাই মার্কস নিজের কর্তব্য হিসাবে চিহ্নিত করছেন। যেন স্বপ্নের জগতে নয়, বাস্তবেই মানুষ যা ভাবছে তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সামাজিক মানুষ স্বপ্ন দেখে এমন এক সমাজের যেখানে সে সমাজ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়। এটা মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছন্নতা নয়। যেমন, পুঁজি যখন সমাজকে একদিকে স্বল্পসংখ্যক পুঁজিপতি আর অন্যদিকে পুরা সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে সেই বিচ্ছিন্নতা বাস্তবিক বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা দূর করে মানুষের সমাজ গঠন মানে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের রূপান্তর। এই অর্থে ধর্ম যেভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বাস্তবিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব নিরসন করে সকলকে একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত ভাবতে চেয়েছে সেই সমাজ ভাবনার বিপরীতে কমিউনিজম নতুন কিছু ভাবে না। সামাজিক মানুষের সমাজ গঠনের লক্ষ্য ছাড়া নতুন কোন লক্ষ্য বাস্তবায়নের কথা মার্কসও ভাবেন নি। এমনকি পরিণত বয়সে কোথাও ভিন্ন কিছু বলেন নি। এই অর্থেই এখানে পরিষ্কার বলছেন অতীতের সঙ্গে প্রকট কোন ভেদরেখা টানার তিনি বিরোধী। কেন? কারণ মানুষ নিজের জন্য নতুন কোন প্রকল্প আর তৈরি করবে না। ধর্মকে অতীতের ব্যাপার বলে মার্কস কোথাও তার কোন লেখায় নাকচ করেছেন নজির নাই। এখানে বরং মার্কস উলটা দাবি করছেন ধর্মের প্রকল্প – সামাজিক মানুষের সামাজিকতার স্বপ্ন বাস্তবায়নই মানুষের ঐতিহাসিক কর্তব্য। ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের যে ইচ্ছা, সংকল্প বা অভিপ্রায় বাহিত হয়ে চলেছে বিপ্লবীর কাজ হচ্ছে তাকে পারলৌকিক আকাঙ্ক্ষা হিসাবে গণ্য না করে ইহলোকে বাস্তবায়িত করা। বেহেশতে বিমূর্ত মনুষ্য সমাজের কল্পনা না করে, ইহ জগতেই সেই সমাজ কায়েম করা – যেখানে বিচিত্র ও বিভিন্ন হয়েও মানুষ একই বিশ্বসমাজের অন্তর্গত।

ফয়েরবাখের ধর্ম পর্যালোচনার এই শিক্ষাটুকু মার্কসের খুশির কারণ হয়ে উঠেছিল। ধর্মের মধ্য দিয়ে দানা বেঁধে ওঠা সামাজিক মানুষের সমাজ ভাবনা বাস্তবায়নই কমিউনিজমের ঐতিহাসিক কর্তব্য, ধর্মের একাট্টা বিরোধিতা নয়। যদি তা হয় তবে ধর্ম বিরোধীদের কবল থেকে বিপ্লবী মার্কসকে উদ্ধার একালে আমাদের জন্য বিশাল কিন্তু অনিবার্য দায় হয়ে উঠেছে। আশাকরি ইসলামপন্থী ও সত্যিকারের কমিউনিস্ট উভয়েই এই কথার মর্ম উপলব্ধির চেষ্টা করবেন।

তবে এটা নিশ্চয়ই মনে রাখতে হবে মার্কসের ধর্ম পর্যালোচনার এই ধারা খ্রিস্টিয় চিন্তার অভ্যন্তরে ঘটেছে। ইসলাম, হিন্দু,বৌদ্ধ, জৈন কিম্বা অন্য কোন ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এ যাবতকাল যে সকল স্বপ্ন দেখে আসছে তার হদিস আমাদের নিতে হবে। ইসলামের দিক থেকে সুবিধা হচ্ছে সেই হদিস নেওয়া ইসলামের নিজেরই ধর্মীয় কর্তব্য। যে ধর্ম নিজেকে একমাত্র সত্য ধর্ম বলে দাবি করে নি, বরং আখেরি নবির আগে আসা হজরত ইসা, হজরত মুসা সহ সকল নবিরসুল তো বটেই এমন কি অন্য সকল জনগোষ্ঠির ধর্মগুরুদের আল্লার প্রেরিত পথ প্রদর্শক রূপে স্বীকার করে। ইসলামের যে রূপ আমরা এখন দেখি তা অনেক সময় বিস্ময় সৃষ্টি না করে পারে না। ইতিহাস নিষ্ঠ ঔদার্যের নজির কেন বিকশিত তার সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণ অবশ্যই আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তবে ধর্মের পর্যালোচনা ইসলামের শক্তি ও গৌরবের জায়গা আমাদের উপলব্ধি ও বুদ্ধির আয়ত্বে আনতে সহায়তা করবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত।  এমনকি কার্ল মার্কস ও কমিউনিজম বোঝার ক্ষেত্রেও।  আল্লাহ সকল জনগোষ্ঠির জন্য পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন। ফলে তাঁরা তাঁদের সমাজের জন্য কী চেয়েছেন সেটা জানা ইসলামের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। ইসলামের গৌরবের জায়গাগুলো এই প্রকার ঔদার্যে ও ইতিহাসবোধে নিহিত রয়েছে, যার ওপর আমাদের এখন বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া দরকার।

মানুষ অতীতে নিজের জন্য যে সকল কর্তব্য নির্ধারণ করে রেখেছে – ধর্ম যার সাক্ষী – তার মর্ম আমাদের বুঝতে হবে। সেটা বুঝতে হবে কোন রহস্য হিসাবে নয়, বরং মানবেতিহাসের অর্জিত প্রজ্ঞার মর্মার্থ উন্মোচনের জন্য। যেন কোন প্রকার ধাঁধা বা রহস্যের কেচ্ছা ফেঁদে মানুষকে তার ধর্ম বা স্বভাব থেকে বিচ্যুত করা আর সম্ভব না হয়।

৩০ অগাস্ট ২০১৫। ১৫ ভাদ্র ১৪২২। শ্যামলী।

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 8935 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD