- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
ফয়েরবাখ সম্পর্কে তরুণ কার্ল মার্কসের মুল্যায়নের মূল ভারকেন্দ্র হচ্ছে ফয়েরবাখের হেগেল পর্যালোচনা। বিশেষত ফয়েরবাখ যেভাবে হেগেলের ডায়ালেক্টিস বা তথাকথিত দ্বান্দিক চিন্তার পর্যালোচনা করেছেন। তরুন মার্কস ফয়েরবাখের এই দিকটাকেই সবচেয়ে দুর্দান্ত গণ্য করেছিলেন। ফয়েরবাখের বিশেষ প্রশংসাও এই জন্যই। মার্কস বলছেন, “ ফয়েরবাখই একমাত্র মানুষ হেগেলের দ্বান্দ্বিক চিন্তা পদ্ধতির (ডায়ালেকটিকস) প্রতি যাঁর খুব সিরিয়াস আর পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল এবং যিনি এই ক্ষেত্রে মৌলিক আবিষ্কার করেছেন। তিনিই আসলে দর্শনের সামগ্রিক অগ্রগতির দিক থেকে সত্যিকারের বিজয়ী বীর। অন্যদের (হেগেল) বিরোধিতার তুলনায় দর্শনে তাঁর অর্জনের পরিধি এবং নিজের বক্তব্য কোন ভান ছাড়া পেশ করবার ক্ষমতার রীতি এতোই বিপরীত যে রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়”। (Marx, 1975, পৃষ্ঠা. ৩৮১)
মার্কসের আমলে ইয়ং হেগেলিয়ানরা হেগেলের পর্যালোচনার নামে বাগাড়ম্বর কম করে নি। কিন্তু যতোই বাগাড়ম্বর করুক হেগেলের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একমাত্র ফয়েরবাখই সত্যিকার অর্থে চিন্তার জগতে নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেছেন। ফয়েরবাখের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি যা কিছু লিখেছেন সেখানে কোন বাড়তি বা বিরক্তিকর দার্শনিক ভান ছিল না। তিনি সহজে তাঁর কথা হাজির করেছেন। ফয়েরবাখ সম্পর্কে তরুণ মার্কসের এই মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের যাঁরা মার্কসের অনুরাগী আশা করব তাঁরা অবশ্যই ফয়েরবাখ সম্পর্কে মার্কসের এই মূল্যায়নের প্রতি মনোযোগী হবেন।
ফয়েরবাখের আগে হেগেলের দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা হয়েছে। কিন্তু সেইসকল পর্যালোচনা ধর্মতত্ত্বের পরিমণ্ডল অতিক্রম করতে পারে নি। মার্কস বলছেন, ‘শুধুমাত্র ফয়েরবাখের হাতেই মানুষসংলগ্ন প্রকৃতি কেন্দ্রিক ইতিবাচক পর্যালোচনার আরম্ভ। যখনই তিনি তার চড়া কন্ঠ নামিয়ে গুছিয়ে কথা বলেছেন তখনি তাঁর লেখা আরও নিশ্চিত, গভীর, গোছানো ও প্রভাবের দিক থেকে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। হেগেলের ফেনমেনলজি ও লজিকের পর ফয়েরবাখই সত্যিকারের তাত্ত্বিক বিপ্লবটা ঘটিয়েছেন” (Marx, 1975, পৃষ্ঠা. ২৮১) ; ‘ইতিবাচক’ কথাটার ওপর গুরুত্বারোপ মার্কসের।
যারা মার্কসের অনুসারী কিম্বা অনুরাগী এবং নিজেদের মার্কসের চিন্তার ধারাবাহিকতা মেনে কমিউনিস্ট মনে করেন তাঁরা সাধারণত শিখেছেন যে মার্কস হেগেলের কাছ থেকে দ্বান্দিক চিন্তা পদ্ধতি শিখেছেন আর ‘দ্বান্দিক বস্তুবাদ’ আর ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ নামে এঙ্গেলস যা শিখিয়েছেন সেটা হেগেলের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে মার্কসের বের করে আনা দার্শনিক সারপদার্থ। মার্কসের অনুমোদিত সারকথাই তারা এইসকল পরিভাষার মধ্য দিয়ে শিখছেন। আসলে এই অনুমান বা দাবি ঠিক নয়। মার্কস এ ধরনের কোন পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। এই পরিভাষাগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে জোসেফ দিয়েৎসন, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, জর্জ প্রেখানভ ও জোসেফ স্টালিনের পরম্পরায়। মার্কস যাকে ‘ইতিহাসের বৈষয়িক ব্যাখ্যা’ বলতেন সেটাই তাঁর মৃত্যুর পরে তার নামে ‘ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ নাম ধারণ করল। তাতে অসুবিধা নাই। কিন্তু এই নামের আড়ালে পরিভাষাসর্বস্ব এমন সব ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠল যার ধারে সঙ্গে মার্কসের মিল সামান্যই। বরং ফয়েরবাখের হেগেল পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে মার্কস যেটা শিখেছেন সেটা হোল ‘মানুষসংলগ্ন ইতিবাচক প্রকৃতিকেন্দ্রিক’ পর্যালোচনা। নাস্তিকতা বলতে আমরা বুঝি ধর্ম নাকচ করে দেওয়া। আল্লার অস্তিত্ব অস্বীকার করা। কিন্তু এই অর্থে ফয়েরবাখ ধর্মকে নাকচ করে দেন নি, বরং মানুষ নিয়ে প্রকৃতিকেন্দ্রিক বা বাস্তব আলোচনাকেই ধর্ম ও দর্শন পর্যালোচনার সূত্র হিসাবে হাজির করেছেন। ফয়েরবাখের গৌরব এখানেই। আর ফয়েরবাখ থেকে মার্কসে আসতে গিয়ে ধর্ম পর্যালোচনার এই মৌলিক সূত্রটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
মুশকিলটা শুধু ফয়েবাখীয় নাস্তিকতার সঙ্গে অমিলের জন্য নয়। হেগেলের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ফয়েরবাখ হেগেলের লজিক ও ইতিহাস ধারণার যে পর্যালোচনা করেছিলেন এবং সেই পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে চিন্তার পরিমণ্ডলে যে আবিষ্কার ঘটেছিল তা একদমই আড়াল হয়ে গেল। মার্কসের বৈপ্লবিক চিন্তার বিপর্যয়টা ঘটে গিয়েছিল এখানেই। কিন্তু সেটা ধরা পড়তে পড়তে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, এবং চিন পুঁজিতন্ত্রের পথ ধরেই শুধু ক্ষান্ত হোল না, গত কয়েক দশকের মধ্যে চিন এখন বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম নেতা। কথাটির ওপর জোর দিচ্ছি এ কারণে যে চিন্তার আবিষ্কার, বিচ্যুতি, বিপর্যয় এবং তার সীমা ও সম্ভাবনার সঙ্গে ইতিহাসের যোগ নিবিড়। চিন্তার অক্ষমতা কিম্বা তার আবিষ্কারের ক্ষেত্রগুলো চিনবার ব্যর্থতা উপেক্ষা করার সুযোগ নাই।
হেগেলের যে পর্যালোচনা ফয়েরবাখ করেছেন তরুণ মার্কস তার তাৎপর্য বুঝে গিয়েছিলেন। তার মানে ফয়েরবাখের পর্যালোচনার প্রতি তার সম্মতি ছিল পুরা মাত্রায়। কিন্তু মার্কস ফয়েরবাখে থেমে থাকেন নি। তিনি পালটা আবার ফয়েরবাখের সমালোচনা করেই নিজের পথ নির্ণয় করেছিলেন। তাহলে মার্কসকে বুঝতে হলে পর্যালোচনার দুটো ধাপ আমাদের পেরিয়ে আসতে হবে।
এক. ফয়েরবাখের হেগেল পর্যালোচনা আর
দুই. মার্কসের ফয়েরবাখ পর্যালোচনা।
যেহেতু ফয়েরবাখ খুব বেশী উপেক্ষিত সে কারণে আমরা ফয়েরবাখের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিচ্ছি। আমরা এখন মার্কসের চোখ দিয়ে ফয়েরবাখ পড়ার কিছু সূত্র চিহ্নিত করবো।
ফয়েরবাখের মহান অর্জনগুলো কি? মার্কসের ভাষ্যেই শোনা যাক। মার্কস বলছেন,
“ফয়েরবাখের মহান অর্জনগুলো হচ্ছে:
১. এটা প্রমাণ করা যে দর্শন আর কিছুই না, ধর্মকে চিন্তায় পর্যবসিত করা এবং চিন্তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা; অর্থাৎ অন্য রূপে বা অন্য আরেক ধরণে নিজের কাছ থেকে নিজে অপর হয়ে গিয়ে মানুষের (estrangement) অস্তিত্ব যাপন, অতএব এও নিন্দনীয়;
২. ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের’ সামাজিক সম্পর্ককে প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি ধরে ‘সত্যিকারের বস্তুবাদ’ এবং ‘আসল বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠা করা
৩. নেতির নেতিকরণের বিরোধিতা, যে বিরোধিতার মধ্য দিয়ে চিন্তার নির্ণয়কে পরম গণ্য করা হয়, যে পরম নিজেই নিজের নির্ণায়ক, যার ইতিবাচকতা সে নিজে”।
ফয়েরবাখ সম্পর্কে ওপরে মার্কসের প্রথম দুই মূল্যায়ন তৃতীয় পয়েন্টের তুলনায় সহজ। তৃতীয়টি হেগেলের ‘পরম’ বা তার ‘এবসলিউট স্পিরিট’-এর পর্যালোচনা। ফয়েরবাখ যে ধারণাকে নাকচ করেছেন। ফয়েরবাখের নাস্তিকতাটা এখানে যে ধর্মের ঈশ্বর আর দর্শনের পরম উভয়কেই ফয়েরবাখ বাস্তবের ‘মানুষ’ সংক্রান্ত আলোচনা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে করবার পদ্ধতি নাকচ করে দিয়েছেন। ফয়েরবাখীয় নাস্তিকতা যে কারণে বিশ্বাসীদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরণের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। যে চ্যালেঞ্জের যথাযথ উত্তর আমাদের হাজির করতে হবে। যারা মনে করেন স্রেফ ধর্মীয় বিশ্বাসের তাকত বা শুধু ঈমান বা বিশ্বাসের জোরে তারা তা মোকাবিলা করবেন, দর্শনে সেই সংকল্পের প্রতি বিনয় ও শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু দার্শনিক লড়াইয়ের জগতে তার মূল্য সামান্য।
হেগেলের লজিক ও এবসলিউট স্পিরিট নিয়ে আলোচনার আগে এই বিষয়ে ফয়েরবাখ-হেগেল-মার্কসের তর্ক বোঝা যাবে না। দৈনিক পত্রিকার পাঠকের সুবিধার জন্য আমরা যথা সম্ভব আলোচনার খুবই প্রাথমিক স্তরে থাকতে চাইছি, যাতে বিষয়ের গুরুত্ব নিদেন পক্ষে তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন। আমরা ফয়েরবাখ সম্পর্কে মার্কসের ওপরের এই মূল্যায়নকে আমাদের পরবর্তী লেখার অভিমুখ হিসাবে সামনে রাখছি। এতে গুছিয়ে চিন্তা করার ও আলোচনার সুবিধা । প্রথম পয়েন্ট আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারন আমরা একথা বলেই শুরু করেছি ধর্মের বিষয় আর দর্শনের বিষয় একই, পার্থক্য শুধু রূপে – আমরা হেগেলীয় দাবির প্রতি সায় জানিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করেছি। কিন্তু মার্কস যখন বলেন দর্শন আসলে ধর্মকে চিন্তার বিষয়ে পর্যবসিত করে মাত্র, আর তিনি ফয়েরবাখের এই পর্যালোচনাকে ফয়েরবাখের অর্জন মনে করছেন তখন কী অর্থে মার্কস কথাটা বলছেন সেটা ব্যাখ্যর দাবি রাখে। আশা করি আগামি আলোচনাগুলোতে আমরা তা পরিষ্কার করতে পারব।
দ্বিতীয় পয়েন্ট তুলনামূলক ভাবে সহজ আর স্পষ্ট। ফয়েরবাখ ‘সত্যিকারের বস্তুবাদ’ আর ‘আসল বিজ্ঞান’ কায়েম করেছেন। দুটো শব্দের ওপর গুরুত্বারোপ মার্কসের। এই মন্তব্যে আমরা বুঝতে পারি ‘বস্তুবাদ’ মাত্রই সত্য মার্কস তা মনে করেন না। তার মধ্যে ফারাক আছে। সত্যিকারের বস্তুবাদের বাইরে ‘মিথ্যা বস্তুবাদ’ তাহলে আছে। শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে নিজেকে বস্তুবাদী বললেই কেউ নিজেকে মার্কসবাদী বা মার্কসের অনুসারী বলতে পারে না। ফয়েরবাখ যে অর্থে বস্তুবাদ বুঝছেন সেই ‘আসল’ অর্থে স্বঘোষিত বস্তুবাদী বস্তুকে বুঝেছে কিনা সেটাই হচ্ছে মূল তর্কের বিষয়। ফয়েরবাখের বস্তুবাদী অর্জন বুঝতে হলে তাঁকে পাঠের কোন বিকল্প নাই। এই ক্ষেত্রে মার্কসের মুখে ঝাল খাবার বিশেষ সার্থকতা নাই। তবে মার্কসের মূল্যায়ন ফয়েরবাখের প্রতি আমাদের আগ্রহকে শাণিত করে। সন্দেহ নাই।
‘আসল বিজ্ঞান’ বা রিয়েল সায়েন্স কথাটা এখানে এসেছে হেগেলের ‘বিজ্ঞান’ ধারণার বিপরীতে। অর্থাৎ সায়েন্স অফ লজিকে হেগেল চিন্তার যে বিজ্ঞান পেশ করেছেন বুদ্ধির পরিমণ্ডলে সীমিত ও সংকীর্ণ পরিমণ্ডলের বাইরে সেই বিজ্ঞানকে কিভাবে বাস্তবের ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার পদ্ধতি হিসাবে হাজির করা যায় মার্কসের ইঙ্গিত সেই দিকে। বিজ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝি সেই প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে কথা হচ্ছে না। হেগেল দর্শনকে যেভাবে ‘বিজ্ঞানের বিজ্ঞান’ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন তার বিপরীতে হেগেলের পরে ফয়েরবাখের ‘আসল বিজ্ঞান’কে মার্কস দর্শনের সত্যিকারের অর্জন বলেছেন। অর্থাৎ হেগেলের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে হেগেলের চিন্তার পদ্ধতি ও চরিত্রে ফয়েরবাখ যে রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন মার্কস সেই বিজ্ঞানের দিকেই ইঙ্গিত করছেন।
দুই নম্বর পয়েন্ট নিয়ে এটা হোল মার্কসের মূল্যায়নের বাইরের দিক। এখানে নির্ধারক এবং মৌলিক ধারণা অন্যত্র। সেটা সতর্ক ভাবে লক্ষ্য করা দরকার। সেটা হচ্ছে এই যে ফয়েরবাখ ‘সত্যিকারের বস্তুবাদ’ বা ‘আসল বিজ্ঞান’ আবিষ্কার করেছেন ঠিকই কিন্তু তার ভিত্তি হচ্ছে ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক’। মার্কসের এই কথার গভীর তাৎপর্য হঠাৎ ধরা যাবে না। কিন্তু তারপরও যারা বস্তুবাদ সম্পর্কে নিজ নিজ মনগড়া ধারণার জায়গা থেকে ভাবতে অভ্যস্ত তাদের একটু চমকাবার কথা।
মার্কস যে বস্তুবাদের জন্য ফয়েরবাখকে তারিফ করছেন তার ভিত্তি তথাকথিত ‘বস্তু’ না। ঠিক। অর্থাৎ ‘বস্তু’ নামক কোন পরাবিদ্যামূলক ধারণা না। বরং ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের’ সামাজিক সম্পর্ক। এটা নতুন কথা। বস্তুবাদ নামক যে প্রভাবশালী ধারণা বাংলাদেশে মার্কসের নামে চালু আছে সেখানে দাবি করা হয় জগত ‘বস্তু’ দিয়ে তৈরি। চেতনার উৎপত্তি ঘটেছে বস্তুর বিকাশের ফলে। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বস্তু জটিল হয়ে উঠলে কোন এক মিস্টেরিয়াস কারণে বস্তুর মধ্যে প্রাণের উদ্ভব ঘটে। প্রাণ বা চেতনা হোল বস্তুরই বিকশিত রূপ। ফয়েরবাখ বা মার্কসের মধ্যে বস্তু সম্পর্কে এরকম কোন মিস্টিকাল কিম্বা মিস্টিরিয়াস ধারণা পাওয়া যাবে না। এটা সহজেই বুঝব যদি মার্কসের কথাটা বুঝি। বস্তুবাদের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক। মানুষের বাইরে ‘বস্তু’ নামক কোন পরাবিদ্যামূলক ধারণা নাই। ফয়েরবাখের কাছ থেকে মার্কস বস্তুবাদের এই ধারণা পেয়েছেন।
ফয়েরবাখ সম্পর্কে মার্কস যে মূল্যায়ন করেছেন তার কিছু ব্যাখ্যা মার্কস করেছেন। আমরা তরুণ মার্কসের কাছ থেকে ফয়েরবাখের পর্যালোচনা আরও একটু গভীরে গিয়ে ভালো করে বুঝতে চাই। কিন্তু সেটা পরের কোন একটি কিস্তিতে। এখানে হেগেলের তথাকথিত ‘দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি’র প্রতি তরুণ মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা দরকার, নইলে দার্শনিক তর্কের কোন্ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মার্কস ফয়েরবাখ সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করছেন আমরা ধরতে পারব না। হেগেল জর্মন দর্শনের এক মস্তো মহীরূহের মতো। তাঁর আবির্ভাবের পর চিন্তার যে মানচিত্র তৈরি হয়েছিল তার পুনর্লিখন ছিল কঠিন ব্যাপার। দার্শনিক পর্যালোচনার যে ধারা তরুণ জার্মান দার্শনিকরা তৈরি করেছিলেন হেগেলের কাছ থেকে হেগেলের পদ্ধতি ধার নিয়েই তারা তাঁর চিন্তার পর্যালোচনা শুরু করে। এই ধারা থেকেই ইয়ং হেগেলিয়ানদের আবির্ভাব। মার্কসের নিজের উদ্ভবও হেগেলের চিন্তার পরিমণ্ডলে। কিন্তু হেগেলের চিন্তার পর্যালোচনা যেসকল জার্মান দার্শনিক করছিলেন তাদের প্রতি মার্কসের প্রধান সমালোচনা ছিল এই যে তারা জর্মন দর্শনের ধারাবাহিক অতীত নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার একটা বিশেষ চরিত্র ছিল, মার্কসের আপত্তি ছিল সেখানে। জর্মন দার্শনিকরা তাদের অতীত চিন্তার ধারাবাহিকতা নিয়ে এতোই ব্যস্ত ছিলেন যে তারা মগ্ন হয়ে থাকতেন দর্শনের বিষয়ে, দর্শনের পদ্ধতিতে নয়। ধর্ম বলি, দর্শন বলি কি চিন্তা বলি পর্যালোচনা মানে শুধু বিষয়ের পর্যালোচনা না। একই সঙ্গে পদ্ধতিরও পর্যালোচনা। আমরা যখন চিন্তা করি ও চিন্তার ভিত্তিতে কোন না কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাই তখন চিন্তার শক্তি বা দুর্বলতা বুঝতে চাইলে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি শুধু তার ওপর নিবিষ্ট থাকলে চলে না। কিভাবে বা কি পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছি তার বিচার জরুরী হয়ে পড়ে। জর্মন দার্শনিকরা ধর্ম ও দর্শনের বিষয় নিয়ে মগ্ন ছিলেন, কিন্তু পদ্ধতির বিচারে অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। ফয়েরবাখ বিষয় নিয়ে নয়, আঘাত করলেন চিন্তার পদ্ধতির জায়গায়। মার্কস ফয়েরবাখের এই দিকটার প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মার্কস বুঝে গিয়েছিলেন হেগেলের ডায়ালেকটিকসের যে পর্যালোচনা ফয়েরবাখ করেছেন তা হেগেলের চিন্তার গোড়াতেই মস্তো এক ঝাঁকুনি দিয়েছে। অন্যান্য জার্মান দার্শনিকদের তুলনায় এখানে ফয়েরবাখের অর্জন সুস্পষ্ট।
এই দিকটা আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ বয়সে হেগেলের দ্বান্দিক পদ্ধতির সমালোচনা্র ক্ষেত্রে ফয়েরবাখ যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, মার্কস তার প্রতি দারুণ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর সেসময়ের লেখালিখি, দার্শনিক পর্যালোচনা এমনকি অর্থশাস্ত্র বিষয়ক রচনাগুলোতে ফয়েরবাখীয় পদ্ধতির ছাপ স্পষ্ট। ফলে এটা বোঝা দরকার এখানে একটা পদ্ধতির বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। এটা বিশেষ ভাবে বলা দরকার এ কারণে যে থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিস মার্কা যে চিন্তার ফর্মুলা দ্বান্দিক বস্তুবাদী পদ্ধতি বলে প্রচার রয়েছে তার সঙ্গে মার্কসের সম্পর্ক অতিশয় ক্ষীণ। মার্কসের পদ্ধতি বুঝতে হলে হেগেলের চিন্তার পদ্ধতি যেমন বোঝা দরকার, একই সঙ্গে ফয়েরবাখ কিভাবে সেই পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন সেই দিকটাও সতর্ক ও সনিষ্ঠ ভাবে বোঝা দরকার।
ফয়েরবাখের চিন্তার পর্যালোচনা করতে গিয়ে মার্কসের প্রস্তাবনা হচ্ছে দর্শনকে শুধু চিন্তার বিষয়ের প্রতি মনোযোগী কিম্বা পর্যালোচনামূলক হলে চলবে না। একই সঙ্গে পদ্ধতির প্রতিও কট্টর পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে হবে। তার সমসাময়িক জর্মন দার্শনিকদের সীমাবদ্ধতা এখানেই ধরা পড়ত। মার্কস বলছেন, পদ্ধতিকে আপাত দৃষ্টিতে ফর্মাল বা নিছকই প্রাকরণিক মনে হলেও, পদ্ধতির তর্ক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। দর্শনের প্রাণকেন্দ্র এখানে। তাহলে তাঁর সময়কালে দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছেঃ ‘হেগেলের দ্বান্দিক পদ্ধতির সঙ্গে আমরা এখন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?’ আধুনিক পর্যালোচনার ধারার সঙ্গে হেগেলের দর্শনের সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে ‘সম্পূর্ণ অসচেতনতা’ সম্পর্কে মার্কস ছিলেন সোচ্চার। এই অসচেতনতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সেই সময়ের দুই দার্শনিক ডেভিড স্ট্রাউস ও ব্রুনো বাউয়েরের দার্শনিক সীমাবদ্ধতার আলোচনা করেছিলেন। ফয়েরবাখ ছিলেন ব্যাতিক্রম। আর সেই ব্যাতিক্রমটা দ্বান্দিক চিন্তার পদ্ধতির সমালোচনায়, দর্শনের বিষয়ে শুধু নয়, দর্শনের পদ্ধতি বিচারের প্রতিভায়।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ২৯ ভাদ্র ১৪২২। শ্যামলী।
www.facebook.com/farhadmazhar2009
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)