দিন বদলের শ্লোগান সমাচার

আমি যখন আমার স্নাতকোত্তর পড়াশুনা করছিরাম, তখন বিজ্ঞাপনী ভাষা বা এ্যাডভার্টাজিং ল্যাংগুয়েজের উপর আমাকে একটি কোর্স করতে হয়েছিল। সে সময়ে বিভিন্ন কোম্পানীর শ্লোগান নিয়েও কাজ করেছিলাম। এগুলো করতে গিয়ে ব্যবসায়িক কোন প্রতিষ্ঠানের শ্লোগান নিয়ে আমার বেশ কিছুটা ধারণা হলো। যেমন আমি জানতে পারলাম যে, কোন একটি কোম্পানীর শ্লোগানটিকে হতে হবে তার উৎপাদিত পন্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। শ্লোগানটিকে হতে হবে আকর্ষণীয়, যাতে ক্রেতা শ্লোগানটি পড়েই যেন পন্য কিনতে আগ্রহী হন। শ্লোগানটিকে সে অর্থে হতে হবে সংক্ষেপ, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ন। সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো, শ্লোগানটিকে হতে হতে ব্যতিক্রমধর্মী। যাতে এর মূল ভাব বা স্পিরিটটা কোনভাবেই আরেকটি কো্‌ম্পানীর সাথে মিলে না যায়। মিলে গেলেই বিপদ। কারণ পন্যের শ্লোগান এক হলে প্রচারনার ধরনও এক হয়। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি পন্যের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার ঝুকিতে পড়ে যায়। আমি আমার এই লেখায় মূলত ৩ টি প্রতিষ্ঠানের শ্লোগানের বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করবো। ৩ টির মধ্যে দুটিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলা গেলেও আরেকটি ভিন্ন ট্যাকের। একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তি। ৩টির মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো। প্রথম আলো তার ১০ ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী থেকেই প্রচারনা শুরু করলো, নিজেকে না বদলালে বদলানো যাবে না কিছুই। তাই আমরা সব সময় বদলে যাওয়ার কথা বলি। বদলে যাও, বদলে দাও। দেশের ২য় শীর্ষস্থানীয় মোবাইল অপারেটর বাংলা লিংক, তার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দিন বদলের কথা বলছে। তারা তাদের প্রচারনায় বলছে,, সেই দিন কি আর আছে, দিন বদলাইছে না। যেখানেই আছে দিন বদলের স্বপ্ন, সেখানেই বাংলালিংক। একই শ্লোগানের কথা বলা ৩য় পক্ষটি হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০০৭ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের সময় পূর্ববর্তী সরকারের নানা ধরনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কথাই তারা তাদের প্রচারনায় বলেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনটি হয় নি। ২০০৮ এর ২৮ শে ডিসেম্বর যে নির্বাচনটি হলো, তার আগে হঠাৎ করেই তারা দিন বদল, পরিবর্তন আর ডিজিটাল বাংলাদেশ- এই বিষয়গুলিকেই বেশী করে প্রচারনা করতে শুরু করে। আমি শুরুতে শ্লোগান নিয়ে যে বিষয়গুলির অবতারনা করেছিলাম, সে ভাবে বিচার করলে এই ৩টি বৈসাদৃশ্যপূর্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শ্লোগান বা প্রচারনার দিক থেকে এই মিল থাকাটি খুব স্বাভাবিক নয়। এই ৩ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে আগে এই দিন বদল শব্দটির ব্যবহার বা প্রয়োগ করে বাংলালিংক। প্রথম আলোর মত একটা বিশাল অবকাঠামো সমৃদ্ধ প্রত্রিকাটির এই ধরনের শ্লোগান কপি বা নকল করার কোন প্রয়োজন নেই। তার দিন বদল শব্দ প্রয়োগ না করে আরো অনেক শব্দ ব্যবহার করেই তাদের উদ্দেশ্য পূরন বরতে পারতো। কিন্তু তারা এই দিন বদল শব্দটিই কেন ব্যবহার করলো, কেনই বা তারা মানুষকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখালো, বিষয়টি আমার কাছে পরিস্কার নয়। এই ৩ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বশেষ এই দিন বদল বা দিন বদলের সনদ কথাটির প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগ। যে কেউ স্বীকার করবেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্য সব বিষয়কে ছাপিয়ে এই দিন বদল বা ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটি বেশী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিষয়টিই এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, আজ নির্বাচনের ৬ মাস পরেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে এই দিন বদলের কথা বলেই খোঁচা দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। এই মিলটা যদি কাকতালীয় হয়ে থাকে, আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিজ্ঞাপনের কৌশল অনুযায়ী সাদৃশ্যতার অজুহাতে যে কোন পক্ষই তার প্রচারনা থেকে বিষয়টি বাদ দিয়ে দিতে পারতো। কিংবা পরবর্তীতে প্রচার শুরু করা কোম্পানীগুলোর বিরম্নদ্ধে প্রথম কোম্পানীটা অনুকরনের বা আইডিয়া চুরি করার অভিযোগ তুলতে পারতো। কিন্তু সেরকম কোন ঘটনা ঘটেছে বলেও আমার জানা নেই। কাকতালীয় যদি না হয়, তাহলে বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। আমরা কি ধরে নেবো, যে, এত বিপুল সার্কলেশন সম্পন্ন একটি পত্রিকা কিংবা কোটির বেশী কাস্টমার সমৃদ্ধ বাংলালিংক অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগের অনুকূল পরিবেশ তৈরীর জন্য এই ধরনের পরিকল্পিত প্রচারনা বা ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল। সেই ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সংশিস্নষ্টতা বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রশ্ন চলে আসতে পারে। নির্বাচনে আর্থিক বা জনবল দিয়ে সহযোগিতার সন্দেহও তৈরী হতে পারে। এমনকি আজ আবার নতুন করে বদলে যাওয়ার শপথ শিরোনামে যে প্রোগ্রাম চালু হয়েছে তার উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সামগ্রিকভাবে আমাদের কর্পোরেট বানিজ্যের গ্রহণযোগ্যতারও সংকট তৈরী হতে পারে। সর্বোপরি একটি সিন্ডিকেটেড বা মোটিভেটেড ক্যাম্পেইনের প্রশ্নটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি আশা করবো, যে আমার সন্দেহ নিতান্তই অমূলক। কারন এ ধরনের ঘটনা আমাদের কারো জন্যই শুভ কোন ফলাফল বয়ে নিয়ে আসবেনা। তবে ঘটনাটি পরিস্কার করার দায়িত্ব উপরে উল্লেখিত ৩ প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে।


নিজের সম্পর্কে লেখক

I am a ordinary person. A peaceful world is my dream



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।