ফরহাদ মজহার ফরিদা আখতার সাংবাদিক সম্মেলন

আমরা সুবিচার চাই: গুম অপহরণ বন্ধ হোক

১. ফরিদা আখতারের বক্তব্য

 শ্রদ্ধাভাজনেষু

আজ আমি এবং ফরহাদ মজহার আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি দীর্ঘদিন পর আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরার জন্য। গত ৩ জুলাই সকালে ফরহাদ মজহার যে ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, সেদিন সারাদিন দেশের মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সুশীল সমাজ, সংবাদ মাধ্যম ও বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ করেছেন।

সুষ্ঠ তদন্ত ও আইনী প্রক্রিয়ার স্বার্থেই আমরা এতদিন চুপ থাকা সঠিক মনে করেছি। গুমের শিকার অধিকাংশই তাদের প্রিয়জনের কাছে ফেরেন নি, ফরহাদ মজহারের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তাদের সকলকে ফিরিয়ে আনার কন্ঠস্বর হিসাবেই আজ আমরা আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এই কন্ঠস্বর নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য ঐক্যবদ্ধ জাতীয় কন্ঠস্বর হয়ে উঠুক। গুমের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতেই হবে। বর্তমান পরিস্থিতির চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও আমাদের অবশ্যই কথা বলতে হবে।

আজ আমরা দেশে চলমান গুমের শিকার পরিবারের একজন হয়েই কথা বলছি। প্রথমেই দেশে যারা গুম হয়েছেন -- কেউ ফিরেছেন এবং কেউ ফেরেন নি -- তাদের সকলের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আশা করছি তাঁরা তাঁদের পরিবারে ফিরে আসতে পারবেন। আমরা এখনো ঘটনার ভয়াবহতা এবং তার পরে নানা ধরণের হয়রানীর শিকার হয়ে সামাজিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে আছি। তবুও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সুষ্ঠ তদন্ত এবং আইনী প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধ্বাশীল থেকেছি। তদন্তে যেন কোন ভাবেই বাধগ্রস্থ না হয় তার জন্য আমরা নিজের উদ্যোগে কোন মন্তব্য করি নি। আমরা দেশের কোন সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলি নি। আমরা পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে সঠিক তথ্যের আশা করেছি।

দুই হাজার সতেরোর জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফরহাদ মজহারকে শ্যামলী রিং রোডের বাসার কাছ থেকে তুলে নেয়ার খবরটি জানার পর আমি আদাবর থানায় জিডি করি। পুলিশ আমার বাসায় এসে তাঁকে উদ্ধারের জন্যে যে মোবাইল ফোন ট্রাকিং করেন আমি তাতে সর্বাত্মক সহায়তা করি। আমার কাছে যতো বার ফোন এসেছে আমি তত বারই পুলিশের সামনে কথা বলেছি এবং তাঁদেরই পরামর্শে উত্তর দিয়েছি যেন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। সারদিন মোবাইল ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে আমরা জেনেছি তিনি আরিচা-গোয়ালন্দ-রাজবাড়ি-মধুখালি-আরকান্দিবাজার-রাজারহাট-যশোর হয়ে যাচ্ছেন। এই তথ্য সেই সময়ে পুলিশ আমাদের জনিয়েছেন। কৃৎকৌশলগত সুবিধা এবং আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার পরও তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু রাতে তাঁকে খুলনা থেকে উদ্ধ্বার করার পর আদাবর থানা আমাকে বাদী হিসেবে গণ্য করে সেই জিডিকে পুলিশ ‘অপহরণ মামলায়’ রূপান্তর করেন।

৩ জুলাই রাতে উদ্ধ্বারের পর ৪ জুলাই সকালে ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় প্রথমে আদাবর থানায় আনা হয়। সেখানে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে জানানোর পরও তাঁকে পরিবারের কছে হস্তান্তর করা হয় নি। এক পর্যায়ে তাঁকে ইস্কাটন রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, এবং দুপুরের পর সিএমএম কোর্টে নিয়ে ১৬৪ ধারায় তাঁর জবানবন্দি নিয়ে তাঁকে পরিবারের জিম্মায় দেয়া হয়। এই সময় থেকে ফরহাদ মজহার উদ্ধার (survivor) হয়েও কার্যত বন্দি হয়ে থাকলেন।

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি মূল ঘটনা সম্পর্কে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। প্রথম রাতেই খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি জনাব দিদার আহমেদ বলেছিলেন তিনি বিনোদন ভ্রমনে বেরিয়েছেন, এরপর ৯ জুলাই আইজিপি জনাব শহীদুল হক বলেছেন অপহরণের তথ্য পাওয়া যায় নি, ১৩ জুলাই রীতিমতো প্রেস কনফারেন্স করে তিনি বলেন ‘ফরহাদ মজহার যদি আমাদের তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করেন,আমরাও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবব।’ অর্থাৎ তারা তদন্তের নামে যা বলবেন, তাই আমাদের মেনে নিতে হবে। না মানলে তারা আমাদের জেলে পুরবেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে জেল-জরিমানার কথা বলে তারা আমাদের ক্রমাগত হুমকি দিয়ে গিয়েছেন।

১৮ জুলাই ২০১৭ ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে মামলার বাদী ও ভিক্টিম হিসেবে আমাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয় আমরা যেন কোন উকিল বা সাংবাদিক নিয়ে না যাই। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। তাঁরা দাবি করেন তাদের হাতে যে তথ্য এসেছে তাতে মনে হচ্ছে তিনি অপহৃত হন নি। তাঁরা দাবী করতে থাকেন ফরহাদ মজহার নিজেই খুলনা গিয়েছিলেন এবং আমরা তাদের তদন্তে সায় না দিলে মিথ্যা তথ্য দেয়ায় মামলা হবে। কিন্তু তিনি কিভাবে খুলনা গিয়েছিলেন এবং সিসি ক্যামেরায় যে কয়েকটি মাইক্রোবাসের কথা পুলিশ নিজেই বলেছিল সে সম্পর্কে তাদের কোনই তথ্য নাই। অথচ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তারপরও আমরা পুলিশের তদন্তে বাধাগ্রস্ত যেন না হয় তার জন্য নিরব থাকি। পুলিশ আদালতে কয়েকবার সময় চেয়ে শেষ পর্যন্ত ৮ নভেম্বর, ২০১৭, ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট’ দেয়ার কথা থাকলেও সেটা দেয়া হয় ৯ নভেম্বর, যা কিনা ১২ ও ১৪ নভেম্বর কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। সেখানে তারা জানান ‘চূড়ান্ত রিপোর্টে’ অপহরণের মামলাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে বাদী ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা’ (F.R.AS. FALSE) ধারা ৩৬৫/৩৮৫ পিসি করা হয়। পুলিশ বলছে অপহরণ ও চাঁদাবাজীর মিথ্যা অভিযোগ সৃজন করার বিষয়টি “পূর্ব পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত”। তাই নির্যাতিত বা ভিক্টিম ফরহাদ মজহার এবং বাদী ফরিদা আখতারের বিরুদ্ধ্বে দণ্ডবিধি’র ২১১/১০৯ ধারায় প্রসিকিউশন দাখিলের অনুমতি চাওয়া হয়। আমরা পুলিশের প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া সঠিক মনে করি।

এর জন্যে ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ শুনানীর দিন ধার্য্য ছিল। সেই তারিখে বাদী ফরিদা আখতার তাঁর আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ’র মাধ্যমে নারাজি দাখিলের জন্য সকালে সময়ের আবেদন করেন এবং বিজ্ঞ আদালত জানুয়ারির ৯ তারিখ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত মুলতবী করেন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে সন্ধ্যায় বাদীর নারাজি দাখিলের সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয় এবং বাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য এবং হয়রানির অভিযোগে উপনেবেশিক দণ্ডবিধি আইন ১৮৬০ এর ২১১ এবং ১০৯ ধারায় ফরহাদ মজহার ও ফরিদা আখতারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলা দায়েরের অনুমতি দেওয়া হয়।

আমরা এখন উচ্চ আদালতে বিচার চাইবো, গুম-অপহরণের শিকার হয়ে এদেশের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা পাওয়া আমাদের অধিকার কিন্তু সেই অধিকার পেতে গিয়ে পুলিশের সহায়তা চাইতে গিয়ে পালটা মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমরা এখন সকলকে এই বাস্তবতা জানানোর প্রয়োজন মনে করছি। এর ফলে বাংলাদেশে ক্রমগত যে গুম, খুন, নিখোঁজ, অপহরণ হচ্ছে তাদের পরিবার কি আর পুলিশের সহায়তা চাইতে সাহস করবেন? হুমকি ও মামলা দিয়ে আমাদের কন্ঠস্বর দমন করে গুমের শিকার প্রতিটি পরিবারের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে নাগরিকদের মানবাধিকার কি লংঘন করা হচ্ছে না?

আইন শৃংখলা বাহিনী উদ্ধ্বারে সাহায্য করেছে, আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু মূল ঘটনা তদন্ত করে বের করতে না পেরে বাদী এবং নির্যাতিত বাক্তি বা ভিক্টিমের বিরুদ্ধ্বে মামলা করার মধ্য দিয়ে আমাদের আরো নিরাপত্তাহীতায় ফেলে দেয়া হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে? আমরা আইনী প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করি এবং মাননীয় আদালতের কাছে সুবিচার চাই। আদালতই এখন নাগরিক মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পারেন।

২. ফরহাদ মজহারের বক্তব্য

আমি ডান চোখে আবছা ছায়া ছাড়া কিছুই দেখি না। আমার দুই চোখেই ছানির অপারেশান হয়েছে। আমার বয়সের কারণে কিছু পড়তে বা লিখতে গেলে দুই চোখ শুকিয়ে যায়। ডায়াবেটিক হবার কারনে এটা সম্প্রতি বেড়েছে। গত ৩ জুলাই ২০১৭ আমি ভোরে কম্পিউটারে লিখতে গিয়ে দেখি আমি চোখ খুলতে পারছি না, শুকনা। লেখা কিছুই পড়তে বা লিখতে পারছি না। সব আবছা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থা হলে একটি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসিতে ঔষুধ কেনার জন্য নামি। এই সময় তিন জন লোক আমাকে ঘিরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে জোর করে তুলেই আমার চোখ বন্ধ করে ফেলে। সেই সময় ফোন আমার হাতে স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ডায়াল করা অবস্থায় থাকায় প্রথম ফোন আমি ভাগ্যক্রমে আমার স্ত্রীকে করতে পারি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ অপহরণকারীরা যা কিছু করতে বলে আমি তা করি। যেখানে তারা আমাকে ছেড়ে দেয় আমি তা চিনি না। আমি বুঝতে পারি তারা আমার ওপর নজরদারি জারি রেখেছে এবং তাদের নির্দেশ মতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গড়িতে উঠলে গাড়িতে তারা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়। আমি মৃত্যুভয়ে ভীত, বিধস্ত ও শারিরীক অসুস্থতায় নির্জীব হয়ে পড়ি। সোরগোল শুনে আমি জেগে উঠি, কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে আবার নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। আমাকে আবার মারবার জন্য নামানো হচ্ছে ভেবে আমি আতংকিত হয়ে পড়ি, কিন্তু সাদা পোষাকের কিছু ব্যাক্তি র্যা বের দিকে বন্দুক তুলে শাসিয়ে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বচসা এবং তর্কাতর্কি হয়। কিন্তু র্যা ব রীতিমতো ছোটখাট যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে ওঠায় এবং আমার স্ত্রী ফরিদা আখতারের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে আমাকে আস্বস্ত করে। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো র্যা বের গাড়ি থেকে আমাকে বারবার জোর করে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।

অপহরণকারীরা তখনও এলাকায় থাকতে পারে ভেবে র্যা ব আমাকে খুলনায় নিয়ে আমার চিকিৎসা ও বিশ্রামের পাশাপাশি তদন্ত করতে চাইলেও কে বা কারা র্যােবের গাড়ির দুই দিকে যাবার রাস্তায় রাতের ট্রাক থামিয়ে দুই দিকে পথ রোধ করে এবং র্যারবের গাড়ি সহ আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে আসে। পরে বলা হয় এটা অভয় নগর থানা। আমি গুমের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তি (survivor) হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জোর করে র্যােবের গাড়ি থেকে নামানো হয়, আমার সঙ্গে তারা প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে আমি ‘বিনোদন’-এর জন্য বেরিয়েছি এবং তাদের কাছে ভিডিওসহ অন্যান্য প্রমাণ আছে। এরপর তারা মধ্যরাতে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ এবং অবিলম্বে চিকিৎসা দরকার বলা সত্ত্বেও আমাকে ক্যামেরাসহ কিছু লোকের সামনে দাঁড় করানো হয়, সাংবাদিকদের সামনে আমি বিনোদনের জন্য স্বেচ্ছায় বেরিয়েছি বলে স্বীকার করবার জন্য প্রচণ্ড চাপ দেয়,অনেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে পুলিশের একটি গাড়িতে নিয়ে আমাকে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে পুলিশ ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। সারা পথে নানান ভাবে আমি মানসিক নির্যাতন ভোগ করি।

শারিরীক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে ঢাকায় আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং বারবার বলা সত্ত্বেও আমাকে আমার পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। বহুক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি অফিসে হতভম্ব, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীর দেবার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রের কাছে পাঠানো হয়। আমি মাননীয় আদালতকে প্রচণ্ড বিভ্রান্ত অবস্থায় এইটুকুই শুধু বলতে পারি যে আমার শারিরীক ও মানসিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, আমার ভীতি ও ট্রমা এখনো কাটেনি, ডিবি অফিস আমাকে দিয়ে যা লিখিয়ে নিয়েছে আমি তাই আপনাকে দিচ্ছি। এরপর তাঁর সদয় অনুমতি নিয়ে তার কক্ষের একটি সোফায় এলিয়ে পড়ি।

পরে জানতে পারি এবং এখন বুঝতে পারি অপহরণকারীরা খুলনা যশোর সীমান্তের দিক দিয়ে আমাকে সীমান্তের ওপাশে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও গণমাধ্যমে বলেছেন, “এখন পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের কোন দোষ পাওয়া যায় নি, সীমান্ত পার করে দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হোত”। তাঁর এই উৎকন্ঠা ন্যায্য এবং তার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানতে চাই (প্রথম আলো ৫ জুলাই ২০১৭)।

ইতোমধ্যে জোরপূর্বক অপহরনের মতো মারাত্মক ও জঘন্য ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত না করে অভয় নগর থানার বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাকে অন্যদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তদন্ত শেষ হবার আগেই পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেস কনফারেন্স করে তদন্ত শেষ হবার আগেই আমাকে সামাজিক ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করেন এবং পুলিশের প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করলে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেন। এতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অপহৃত অবস্থায় আমাকে যেসব কাজ করতে বাধ্য করা হয় তার সঙ্গে পুলিশের বয়ানে সঙ্গতি ফুটে ওঠে। কিন্তু তারপরও সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে আমরা চুপ থাকি। জুলাইয়ের ১৮ তারিখে ডিবি পুলিশ আবার আমাদের তাদের অফিসে ডেকে নেয়। কিন্তু সেখানেও সুষ্ঠ তদন্তের পরিবর্তে পুলিশের প্রতিবেদনে সায় না দিলে আমাদের আরও সামাজিক ভাবে লাঞ্ছিত এবং আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে বলে পুলিশ হুমকি দিতে থাকেন। এতে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকি। আইনী প্রক্রিয়ার স্বার্থে গোয়েন্দা পুলিশ যে প্রতিবেদনই দিক তাকে আইনী ভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সত্য মিথ্যার মীমাংস আদালতে হবে আশা করে আমরা চুপ থাকি।

গুমের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইন শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা তাদের সাফল্য ও গৌরবকে মারাত্মক ভাবে ম্লান করে দেওয়া হোল। গুম ও মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করার এবং কৃতিত্বের গৌরব দাবির পরিবর্তে এটাই প্রমাণ করবার চেষ্টা হচ্ছে যে যারা গুম হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন তারা তাদের নিজের কারণেই নিখোঁজ হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক দায় এড়ানোর এই চেষ্টা ভয়ংকর। আমি জীবিত ফিরে আসায় আমাকে সামাজিক ভাবে হেনস্থা করে আমার মুখ বন্ধ করে দেবার এই চেষ্টা ঘৃণ্য ও জঘন্য। আমি সারাজীবন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছি, বাংলাদেশের গুমের এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে সকল মান অপমান সহ্য করে হলেও বাংলাদেশে এ যাবত গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারেন সেই চেষ্টা আমাদের সকলকেই করতে হবে। এই দায় সরকারকেও নিতে হবে। সেই দাবী জানাতেই আমি আজ কথা বলছি।

আমি এখানে অন্যান্য বিস্তারিত তথ্যে যাবো না, কারণ আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইনীভাবেই নারাজী দেয়ার বিষয়টি মোকাবেলা করতে চাই। আমরা আশা করছি সুবিচার পাবো।

৯ ডিসেম্বর, ২০১৭। শ্যামলী। ঢাকা।

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।