- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
স্বাধীন গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকায় সরকার নাখোশ
বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র এবং বিদ্যমান সংবিধান অনেকাংশেই গণতান্ত্রিক নয়। সংসদের মারফতে দলীয় প্রধানের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা খাটাবার আইনি বন্দোবস্ত আছে। জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে সামনের সারির কাজ, মৌলিক নাগরকি অধিকার হরণকারী নানান কালাকানুন ও বিধিবিধানের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা। চিন্তা ও মতামত প্রচারের বাধাগুলো অপসারিত করা। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় ও স্বার্থের জায়গায় নিরাপোষ ঐক্য গড়ে তুলতে স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে যে কোনো সমালোচনা, বিরোধিতা এবং পর্যালোচনার সুযোগ থাকা চাই। সেই সুযোগ কোনো সরকারের সময়ই অবারিত ছিলনা।
বর্তমানে আমরা দেখছি চরম অসহিষ্ণু মনোভাব। বেছে বেছে বর্তমান মহাজোট সরকারের সিদ্ধান্ত বা নীতির সাথে দ্বিমত পোষণকারী মিডিয়াগুলোকে নির্মূল অভিযানে নেমেছে আওয়ামী লীগ। যেখান থেকেই সমালোচনা আসছে সেখানেই হচ্ছে খড়গহস্ত। বাড়ছে সাংবাদিক নির্যাতন। প্রকাশ্যেই তারা প্রচার করছে নিজেদের এই উদগ্র ইচ্ছার কথা। ইন্টার নেট--সামাজিক নেটওয়ার্ক, ব্লগসাইট, ইউটিউব থেকে টিভি চ্যানেল, টক শো, দৈনিক পত্রিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে এই তালিকা। ভিন্নমত দলনে শাসক জোটের বেপরোয়া মনোভাব চরম দমবন্ধ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। এভাবে চলতে থাকলে নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত ভাষ্য প্রচারের স্বৈরতান্ত্রিক দাপট অচিরেই প্রতিষ্ঠা পাবে। সেই সমূহ বিপদের মুখে কিভাবে বাংলাদেশকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তার বাস্তব কর্মকান্ড দু' দুটা টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করার নজির থেকে আমরা বিস্তারিত তুলে ধরছি।-- সম্পাদকীয়
‘আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি’
‘এই যে মিডিয়াগুলো আছে, লক্ষ করে দেখবেন, যখনই খালেদা জিয়ার নাম আসে তখন সময়টা বেশি দেয়। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো প্রোগ্রাম আসে তখন সময় কম দেয়। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।’ এভাবেই নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা দলের কর্মীদের জানাচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, গত বারোই মে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে। সরকার সমর্থিত ছাত্রসংগঠন- ছাত্রলীগের ওই সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমরা এত উন্নয়নের কাজ করছি, সব কি মিডিয়ায় আসে? আসে না।’ অবশ্য এসব দুর্ভাগ্য আর হতাশার পাশাপাশি তিনি এ বিষয়ে সরকারের তরফে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে দলীয় সহকর্মী ও সমর্থকদের আশ্বস্ত করেন। সংবাদমাধ্যমের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী প্রসঙ্গে মন্ত্রী জানান ‘আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, যেমন চ্যানেল ওয়ান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে আরো কিছু চ্যানেল আমরা বাতিল করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।’
কোনো চালু চ্যানেল ‘বাতিল করে দেওয়ার চেষ্টা’ দ্বিতীয়বারের মতো এখনো সফল হতে দেখা যায় নাই, কিন্তু এর আটদিন পরে বিশ মে অন্য আরেকটা টিভি চ্যানেলের ‘চালু’ হওয়ার প্রক্রিয়া আপাতত বাতিল হয়ে গেছে। সরকার কর্তৃক স¤প্রচার তরঙ্গ বাতিল করার বিরুদ্ধে যমুনা টিভি’র করা রিট আবেদনটির বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ কোনো আদেশ না দিয়েই ‘নিষ্পত্তি’ করে দেয় ওই দিন। এর আগে পরীক্ষামূলক স¤প্রচারে থাকা অবস্থায় গত বছরের ঊনিশে নভেম্বর বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন এর সম্প্রচার তরঙ্গ বাতিল করে দিলে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেই আদেশটি আইনত অবৈধ ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে যমুনা টিভি কর্তৃপক্ষ রিটটি দায়ের করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ তরঙ্গ বাতিল করে দেয়, ওই সরকারি আদেশের আইনগত বৈধতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেন নাই। আদালত বরং সরকারকে নির্দেশ দেন যে, সম্প্রচারের জন্য অনাপত্তি চেয়ে গতবছরের ৮ অক্টোবর যমুনা টিভি সরকারের কাছে যে আবেদন করেছে, তা যাতে সরকার দ্রুত নিষ্পত্তি করে।
ঘাতক তলোয়ার যেভাবে আইনি বৈধতা পাচ্ছে
আদালতের রায়ের বিষয়ে সরকারের তরফে যে সাড়া সাধারণত পাওয়া যায় না, সেরকম সাড়া পাওয়া গেল এই রায়ের পরে। সম্প্রচারে অনাপত্তি চেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো করা আবেদনটি খুব দ্রুত নিষ্পত্তি করে দেয় বিটিআরসি। আদালতের রায়ের একদিন পরেই ওই আবেদনটি নাকচ করে দেয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ফলে এখন বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদ মাধ্যমটির সামনে উপায় আছে দুটি। এক. হাইকোর্টের আদেশটির বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা দুই. দ্বিতীয়বারের পুনঃআপত্তিপত্রটি বাতিল করার আদেশকে আইনত অবৈধ বলে ঘোষণা করতে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করা। দ্বিতীয় উপায়ের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমটির আগের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর না নিশ্চয়ই।
২০০২ সালে টিভি চ্যানেল হিশাবে সনদ পেলেও পরে তখনকার জোট সরকার সেই সনদ বাতিল করে দিয়েছিল। সেই আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে চ্যানেলটিকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। এবারও হাইকোর্ট বিভাগ রিটের বিষয়ে কোনো আদেশ না দিয়েই নিষ্পত্তি করে দিলেন। পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী যদি আগে থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি না থাকে, তবে ওই অভিযোগে নিজেরাই বিচার করে বিটিআরসি সম্প্রচার তরঙ্গ বাতিল করে দিতে পারে কি না--সেই বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ কোনো আদেশ দেন নাই--রিটের বিষয়ে যা ছিল। বরং সংবাদমাধ্যমটির তরফে অনাপত্তি চেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো করা যে আবেদনটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটি নিষ্পত্তি করার আদেশ দিয়ে সরকারের হাতে থাকা তলোয়ারটির খাপ খোলার আইনগত বৈধতা দিলেন আদালত; যে তলোয়ারে এর আগে মারা পড়েছে একটা চালু ও জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল--চ্যানেল ওয়ান। বিচারক জনাব হোসেন ও গোবিন্দের বেঞ্চেই ছিল চ্যানেল ওয়ানের রিট আবেদনটি।
আইন প্রয়োগের চেয়ে ‘বাতিল’ করতে বেশি আগ্রহ সরকারের
এ বছরের সাতাশে এপ্রিল, সন্ধ্যা ছয়টা তেতাল্লিশ মিনিট। চ্যানেল ওয়ানের সন্ধ্যার খবর দেখছিলেন সারা দেশের দর্শক। খবরের মাঝখানে উপস্থাপক একটা অন্যরকম ঘোষণা দিলেন--সরকারি সিদ্ধান্তে ঠিক এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চ্যানেলটির সম্প্রচার। ঘোষণা পাঠের পরপরই টিভি পর্দা থেকে হারিয়ে গেলো জনপ্রিয় ওই চ্যানেলটি। পর্দার পেছনের খবর হচ্ছে; বেআইনিভাবে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তরের ‘অভিযোগে’ টিভি চ্যানেলটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী সহ সেই সন্ধ্যায় বিটিআরসি কর্মকর্তারা ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড এর মালিকানায় থাকা চ্যানেলের অফিসে গিয়ে সুইচ টিপে সম্প্রচার বন্ধ করে দেন। অথচ সংবাদমাধ্যমের তদারককারী রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হিশাবে বিটিআরসির সামনে আরো অনেক বিকল্প পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের মত ও অমতের প্রতিফলন ঘটাতে সবচেয়ে বড়ো উপায় হলো গণমাধ্যম--এই গণতান্ত্রিক চর্চার হেফাজতকারী হিশাবে সরকার এবং তার তরফে বিটিআরসির কাজ হওয়া উচিত বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার মধ্যে যথাসম্ভব গণমাধ্যম-বান্ধব পরিস্থিতি তৈরি করা। গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আলামত না। বিদ্যমান আইনের মধ্যে যেসব বিকল্প বিধান আছে সেগুলার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবাদমাধ্যমগুলাকে যথাযথ আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার কাজটি সরকারকেই করতে হবে দরদের সাথে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ এর ৬৩ (খ-৩) ধারার কাজ হলো সংবাদমাধ্যমগুলার সাথে বিটিআরসির তদারকিমূলক সম্পর্কের বিষয়ে বিধান দেয়া। যদি বিটিআরসির ইস্যুকৃত নোটিশের কোনো জবাব বা অভিযোগকৃত বিষয় সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমগুলা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেশ না করে কিম্বা নির্দেশিত সময়ে এর নির্দেশিত সংশোধন বা প্রতিকার না করা হয়--তবে কমিশন কি কি পদক্ষেপ নিতে পারে--সেই বিধান ওখানে দেয়া হয়েছে। কমিশন লিখিতভাবে এবং কারণ উল্লেখপূর্বক একটি আদেশ দ্বারা দু’ ধরনের ব্যবস্থার যেকোনো একটা নিতে পারেন। এক. লঙ্ঘনকারীর উপর অনধিক ৩ (তিন) লাখ টাকা প্রশাসনিক জরিমানা এবং উক্ত আদেশের পর যতদিন লঙ্ঘন চলতে থাকে এর প্রতিদিনের জন্য অনধিক অতিরিক্ত ৩০ (ত্রিশ) হাজার টাকা প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ করতে পারে। দুই. যথাযথ ক্ষেত্রে লাইসেন্স বা পারমিট বা সনদ স্থগিত বা বাতিল করতে বা অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করতে পারে। আইনটিতে বলা হয়েছে, তড়িঘড়ি শাস্তিবিধানের বদলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক অসংগতি দূর করে সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে এমন বিকল্প ব্যবস্থা দরকার। কিন্তু সরকার এগুলা আমলেই নেয় নাই।
...................
উনিশ নভেম্বর যমুনা টিভি, সাতাশ এপ্রিল চ্যানেল ওয়ান, উনত্রিশ মে ফেসবুক এবং এক জুন দৈনিক আমার দেশ--গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার এমন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া গণতন্ত্র ও আইনকে পদদলিত করে আমাদের একটি কথাই মনে করিয়ে দেয়, এই সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও এর কার্যক্রম গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার বাস্তব প্রমাণ হাজির করে।
..........................
চ্যানেল ওয়ানের বিরুদ্ধে মালিকানা বদলের অভিযোগ যেভাো:বে এল
চ্যানেল ওয়ান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ, পিপলস এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে অবৈধভাবে লাইসেন্স এবং এ লাইসেন্সের অধীনে থাকা যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করেছেন। যা টেলিযোগাযোগ আইনের ৩৭(১) ধারার লঙ্ঘন। আইন মোতাবেক, এ ধরনের বিক্রি বা হস্তান্তর অবৈধ বলে ধরে নেয়া হবে।
চ্যানেল ওয়ানের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের লাইসেন্স ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট এর নামে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০০৫ সালে প্রাইম ব্যাংক থেকে তেইশ কোটি নব্বই লাখ টাকার ঋণ নেয় টেলিভিশনটি। যন্ত্রপাতি বন্ধক রাখা হয় ব্যাংকের কাছে। ২০০৬ সালের চব্বিশ জানুয়ারি সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর কয়েক দফায় তারা ব্যাংক ঋণের মাত্র দুই কোটি ষাট টাকা পরিশোধ করে। জরুরি অবস্থার সময় তাদের ঋণখেলাপি হিশাবে ঘোষণা করে ব্যাংক এবং নিলামে যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। চ্যানেল ওয়ান আদালতে যায়। বন্ধকী যন্ত্রপাতির বিপরীতে আদালত নব্বই দিনের মধ্যে বাকি ঋণের পাঁচ থেকে দশ শতাংশ পরিশোধ করে বিষয়টি রিশিডিউল করার আদেশ দেন। সেক্ষেত্রেও ব্যর্থ হওয়ার পর প্রাইম ব্যাংক চ্যানেল ওয়ানের যন্ত্রপাতি নিলামে তোলে ২০০৮ সালে। পিপলস এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান এসব যন্ত্রপাতি কিনে নেয়। বিটিআরসির যুক্তি এখানেই, আইনগতভাবে বদল হয়ে গেছে যন্ত্রপাতির মালিকানা। এটি ২০০১ সালের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন এর ৫৫(৪) ধারার পরিপন্থী। ঠিক এই অজুহাতকেই কাজে লাগিয়েছে সরকার। বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘চ্যানেল ওয়ানের অপরাধের শাস্তি হিশাবে এটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ আর চ্যানেল ওয়ানের বক্তব্য ছিল, তারা আইন ভাঙ্গে নাই। যেহেতু ব্যাংকের নিলাম প্রক্রিয়া পুরাপুরি শেষ হয় নাই, যেহেতু এখনও যন্ত্রপাতির মালিক ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। তাই মালিকানা বদলের প্রশ্ন এখানে আসে না।
সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে যিনি পুলিশ এবং তিনিই আদালত
মে মাসের দুই তারিখে বিটিআরসি কর্তৃক তরঙ্গ বরাদ্দ বাতিল কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে চ্যানেল ওয়ানের পরিচালক অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামের পক্ষে অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করেন। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিটিআরসি অবৈধভাবে চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার বন্ধ করেছে। লাইসেন্সের অনুমতিপত্রের কোনো শর্ত ভঙ্গ করে নাই চ্যানেল ওয়ান। তাই চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত অবৈধ। আরো বলা হয়, চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়ার আগে বিটিআরসি কোনো প্রকার নোটিস-শোকজ করে নাই। কিন্তু মে মাসের ষোল তারিখ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিটিআরসি’র দেয়া তরঙ্গ বরাদ্দ বাতিলের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস যথার্থ হয়েছে এমন যুক্তি তুলে ধরে রিট পিটিশনটি খারিজ করে দেন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) টেলিভিশন এবং রেডিও এর জন্য ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, সম্প্রচারের জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দেওয়ার কাজ করে। এবং ইস্যুকৃত লাইসেন্স, পারমিট ও সনদের নবায়ন, হস্তান্তর নিয়ন্ত্রণ, স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতাও বিটিআরসির। কাজেই আইন প্রয়োগ ও প্রয়োগকালে বিভিন্ন পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে ফয়সালা সহ দুইটা কাজই বিটিআরসির এখতিয়ারে। হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগ এ যাবৎ শুধু এই দেখেছেন যে, ওই আইনের মধ্যে কমিশনটি তার এখতিয়ার প্রয়োগ করছে কি না। কিন্তু আইনটি নিজেই যে সাধারণ ন্যায়বিচারের নীতি বা প্রিন্সিপাল অফ ন্যাচারাল জাস্টিসের বিরুদ্ধে যায়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের তরফে কোনো পর্যবেক্ষণ দেখা যায় নাই। তদারককারী প্রতিষ্ঠান হিশাবে বিআরটিসি এবং সংবাদমাধ্যম হিশাবে টিভি ও রেডিওগুলার মধ্যে প্রাথমিক আইনি অভিযোগ ফয়সালা করার জন্য দুই পক্ষের অংশগ্রহণে কোনো সালিশের ব্যবস্থা নাই। বিটিআরসি একই সাথে অভিযোগকারী ও সিদ্ধান্তদাতার ভূমিকা রাখে।
যে কারণে সরকার বেপরোয়া : একজন মিডিয়া-মালিকের পর্যবেক্ষণ
বর্তমান সরকার নতুন করে আরো এগারোটি চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদন পাওয়া সব চ্যানেলগুলোর মালিকানা সরকারি দলের সাথে জড়িতদের। চ্যানেলের অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই পরিচালনা ও অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রেও সরকার দলীয় আনুগত্যের বাইরে যাওয়া চলবে না। বিষয়গুলা স্পষ্ট হয় এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান এর মন্তব্যে। মে মাসের ছয় তারিখ কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, সরকারি নানান মহলে তদবিরের মাধ্যমে তিনি নতুন টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি পেয়েছেন। তার মতে, ‘জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে কি বেঁচে থাকা যায়? সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে লাভ কী?’
কেন ‘যমুনা টিভি’র পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হল তা নিয়েও মন্তব্য করেছেন এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান। কলকাতার সেই অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরীক্ষামূলক সম্প্রচারেই অত্যন্ত কড়া ভাষায় হাসিনা সরকারের সমালোচনা’ হয়েছিল। সবেমাত্র একটি সরকার ক্ষমতায় বসেছিল, তখনই তাকে আক্রমণ করা কি ঠিক? এমন খবর করা কি ঠিক হয়েছে? হয় নি। তাই সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।’
Available tags : চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভি, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ
ড. মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য 1
তিনি না বললেও সকলের কাছে এটা স্পষ্ট। আমার দেশ তার বক্তেব্যরই শিকার হয়েছিলো।
যমুনা টিভির ব্যাপারে তিনি যেটা বলেছেন (‘পরীক্ষামূলক সম্প্রচারেই অত্যন্ত কড়া ভাষায় হাসিনা সরকারের সমালোচনা’ হয়েছিল। সবেমাত্র একটি সরকার ক্ষমতায় বসেছিল, তখনই তাকে আক্রমণ করা কি ঠিক? এমন খবর করা কি ঠিক হয়েছে? হয় নি। তাই সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।’)
সেটা হাস্যকর, একটা নিউজ সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই সমালোচনা? ধরা যাক সমালোচনা, মিডিয়াতো সমালোচনা করেবই। তিনি মিডিয়া বন্ধের যেভাবে সমথর্ন দিলেন তা কখনোই একজন মিডিয়া মালিক থেকে কেউ আশা করেনি।
তিনি কিভাবে নতুন চ্যানেল পেলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
Friday 11 June 10
Manik