চিন্তা প্রতিবেদক


Tuesday 13 July 10

print

ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আইন

আদালত অবমাননা বিষয়ে সরকার দুই হাজার চার সালে একটা আইন তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। আইনটি কেমন হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ আইন কমিশনের কাছ থেকে সুপারিশ চায় সরকার। দীর্ঘ গবেষণার পর ২০০৫ সালের নয় জুন আইন কমিশন কিছু সুপারিশ দেয় সরকারকে। ২০০৬ সালের ১৭ এপ্রিল মন্ত্রীপরিষদ আইনের খসড়া চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে। বিলটিতে আদালত অবমাননার সংজ্ঞাসহ মানদণ্ড, আওতা, বিচারকদের জবাবদিহিতা, আদালতের রায় বা আদেশ-এর উপর আলোচনার আওতা, অবমাননার শাস্তি এবং প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে বিধান ছিল।

কিন্তু তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মেয়াদের মধ্যে সেটাকে আইনে পরিণত করে নাই। পরে ২০০৮ সালের দোসরা মার্চ আদালত অবমাননা অধ্যাদেশ, ২০০৮ অনুমোদন করে তৎকালীন উপদেষ্টা পরিষদ। এবং পঁচিশে মে সেটি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে জারি করে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. শামছুল হক ও তাজুল ইসলাম অধ্যাদেশের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করেন। শুনানি শেষে চব্বিশে জুলাই ২০০৮ তারিখে রায় ঘোষণা করে বিচারক এবিএম খায়রুল হক ও মো. আবু তারেক এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আদালতের স্ববিরোধী রায়

রায়ে আদালত অবমাননা অধ্যাদেশ ২০০৮ কে অবৈধ এবং সংবিধান বহির্ভূত বলে বাতিল ঘোষণা করে আদালত। রায়টির মধ্যে প্রচুর স্ববিরোধিতা আছে। রায়ে আদালত বলেন, অধ্যাদেশটা সংবিধান বহির্ভূত ও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা। সংবিধান স্বীকৃত তিনটি মৌলিক অধিকারের বিষয় ‘আদালত অবমাননা’র সাথে--ব্যক্তির জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা; যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ এবং ৩৯ অনুচ্ছেদে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

অনুচ্ছেদ ১০৮ বলছে, ‘‘সুপ্রীম কোর্ট একটি কোর্ট অব্ রেকর্ড হবেন এবং এর অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশ দান বা দণ্ডাদেশ দানের ক্ষমতাসহ আইন সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।” এখানেই অর্থাৎ ‘আইন সাপেক্ষে’ বিধান তো এ কারণেই দেয়া হয়েছে যাতে করে প্রয়োজনে এক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইন তৈরি করা যায়। ৩২ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা কাজগুলাকে আদালত অবমাননার আওতার বাইরে না নিয়ে আসলে নাগরিকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না। অবমাননার তদন্ত বা শাস্তির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে নিয়ে আসার সুযোগ আছে, ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী।

আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, নির্বাচন সংক্রান্ত আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন প্রণয়নের বৈধতা নাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। আবার আদালত এও বলছেন, অধ্যাদেশটা বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ দুইটাও ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই জারি করেছিল। এবং ওই অধ্যাদেশ দুইটা যে নির্বাচন সংক্রান্ত ছিলো না তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

আদালত বলেন, কোন অপরাধ করলে পরে আদালত অবমাননা হবে তা ঠিক করার এখতিয়ার আদালতের, সরকারের না। আবার একই সাথে আদালতের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অধ্যাদেশটার খসড়া আইন-প্রণেতাদের কাছে উপস্থাপন করার আগে আমলাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। ক্ষমতা যদি সরকারের না-ই থাকবে, তো আইন প্রণেতা ও আমলার তফাৎ করার তো কোনো মানে দাঁড়ায় না।

আদালত বলেন, বিচারকদের ব্যক্তিগত কাজের বা রায়ের সমালোচনা করে কোনো খবর প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি তার রায়ের গঠনমূলক সমালোচনাও (কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজম) করা যাবে না। বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করা যাবে না; যদি কোনো বিচারকের সমালোচনা করা হয়, তবে তিনি কোনো আদেশ দিতে ভীত হতে পারেন, যারফলে মামলার পক্ষভুক্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আদালত যখন রায়ের গঠনমূলক সমালোচনাকেও অবমাননার অন্তর্ভুক্ত করেন, তখন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনের আবশ্যকতার কথাই শুধু স্পষ্ট হয়।

অবশ্য তখন সরকারের তরফ থেকেও এমন অযৌক্তিক উদ্যোগ ছিলো। অধ্যাদেশটিতে বিধান রাখা হয়েছিল যে, চাকরিকাল শেষে অবসরে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের আর অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না। সবমিলিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালত ঘোষণা করেন যে, অধ্যাদেশটি সংবিধান বহির্ভূত, কাজেই অকার্যকর। মামলাটি আপিল বিভাগে থাকায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এই অধ্যাদেশটি সংসদে অনুমোদন করে নাই। ফলে এখনো আদালত অবমাননা বিষয়ে কোনো আইন ছাড়াই চলছে বাংলাদেশ।

আইনের অনুপস্থিতিতে সর্বশেষ অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের নজির

এ বছরের একুশ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/21/28433। প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে হাইকোর্ট বিভাগের মোট ছয়টি আদেশের আলোচনা করা হয়। যেগুলোর ওপরে চেম্বার জজ আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনকে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া বিদেশ যেতে বাধা না দিতে হাইকোর্ট বিভাগ আদেশ দেন। এটর্নি জেনারেলের দপ্তর থেকে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে চেম্বার জজ আদালতে এই আদেশের ব্যাপারে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়। এবং বিশ এপ্রিল চেম্বার জজ বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন সেটা মঞ্জুর করেছেন।

প্রতিবেদনটিতে অনুসন্ধানে জানা গেছে বলে উল্লেখ করা হয়, এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য দুই ছাত্রকে গত নয় ফেব্র“য়ারি জামিন দিয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ। জামিনের আদেশে বলা হয়েছিল, পরীক্ষা শেষ হলে তারা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবার আত্মসমর্পণ করবেন। জামিন আদেশের সার্টিফাইড কপি পৌঁছার পরও এটর্নি জেনারেলের দফতর থেকে ফোন করা হয়েছে মর্মে জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মুক্তি দেয় নাই। ৬ দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি চেম্বার জজ দুই পরীক্ষার্থীর জামিন স্থগিত করে দেয়। এতে চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার্থী মাসুম ও আলজাবের ইনস্টিটিউটের ছাত্র লুতফুল কবির মুক্ত অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারে নাই।

দৈনিক আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ

একুশ এপ্রিল ২০১০: দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনাম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আদালত অবমাননা হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রিয়াজুদ্দিন খান ও কাজী মাইনুল হাসান।

দুই জুন ২০১০: প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, প্রকাশক হাসমত আলী, উপসম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বার্তা সম্পাদক মুজতাহিদ ফারুকী এবং প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। এবং পাঁচ জুন শশরীরে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেন।

পাঁচ জুন ২০১০: মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার থাকায় তিনি ছাড়া অন্য চারজন আদালতে হাজির হন। আদালত নয় জুলাই সবাইকে হাজির হতে নির্দেশ দেন।

নয় জুলাই ২০১০: মাহমুদুর রহমান ছাড়া অন্য চারজন আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাহমুদুর রহমান রুলের জবাব দিবেন বলে জানান। আদালত বারো আগস্ট পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।

প্রতিবেদনের শেষের দিকে বলা হয়, ‘এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় জামিন পাওয়া আসামিদের না ছাড়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়ে এটর্নি জেনারেল চেম্বার জজ আদালতে স্থগিতাদেশ চায়। এতে ৩ শতাধিক মামলার আসামির জামিন চেম্বার জজ আদালত স্থগিত করে দেয়।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে, আদালত প্রসঙ্গে প্রতিবেদক সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খানের কাছে জানতে চান। তিনি আমার দেশকে বলেন, হাইকোর্টোর আদেশ স্থগিত করে দেয়াটাই যেন চেম্বার জজ আদালতের মূল কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেই হল। অনেকটা মুখ দেখেই চেম্বার জজ আদালতে ইদানিং স্থগিতাদেশ দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

পুরা প্রতিবেদনটিতে ছয়টি কেস স্টাডি আলোচনা করা হয়। এছাড়া দুই লাইনের একটি মন্তব্য ছাড়া প্রতিবেদনে আদালত সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য করা হয় নাই। শেষের প্যারার ঠিক আগে বলা হয়, ‘জরুরি অবস্থার সরকারের সময়ও হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ স্থগিত করে দিত আপিল বিভাগ। এ নিয়ে আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আদালতের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।’

আরো পড়ুন

১. আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : আদালত অবমাননা, আমার দেশ

View: 8943 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD