পোষাক খাতে মজুরি ও মুনাফা


ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা হলে কি রফতানিমুখি পোশাক খাত বন্ধ হয়ে যাবে?

তীব্র শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে সরকার তৈরি পোশাক খাতের শ্রমের ন্যূনতম মজুরি নতুন করে নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রার মান ও দ্রব্যমূল্যের বিচারে এ তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির ফলে শ্রমিকরা দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে থেকে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হবে। এ খাতের মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী যদি ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা করা হয় তবে দেশের তৈরি পোশাক খাত বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার, সেই বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলার অবস্থা এবং ক্রেতা দেশগুলার সামনে থাকা বিকল্পগুলা মালিকদের ওই দাবি সমর্থন করে না। সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে জানাচ্ছেন নাজমুস সাকিব নির্ঝর

তৈরি-পোশাক রফতানিকারী অন্যান্য দেশগুলা যে টিশার্ট গড়ে পাঁচ ডলারে বেচে আন্তর্জাতিক বাজারে, সে একই টিশার্ট বাংলাদেশ গড়ে দেড় ডলারে বেচে। প্রতিযোগী দেশগুলার চেয়ে তুলনামূলক কম দামে পোশাক বেচার মত সক্ষমতা আছে বলেই রফতানি বাজারে বাংলাদেশের তৈরি-পোশাক খাতের অবস্থা ভালো। ফলে, মোট রফতানি আয়ের মধ্যে মালিকের মুনাফার ভাগ (প্রফিট মার্জিন) তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। আর দাম তুলনামূলক এত কম রাখতে পারার প্রধান কারণ হল সস্তা শ্রম। শ্রমিক এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও অধিকার আন্দোলনগুলার বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী এই ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকার কম হতে পারে না। কিন্তু তীব্র বিক্ষোভ সত্ত্বেও সর্বশেষ এখন বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরি ধরা হয়েছে তিন হাজার টাকা। যদিও শ্রমিকরা এই কম পরিমাণ মজুরি মেনে নেন নাই এবং বিক্ষোভ এখনো চলছে। সরকারি বাহিনী সবসময়ই চূড়ান্ত বলপ্রয়োগ করছে বিক্ষোভকারীদের ওপর এবং কখনো কখনো বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠছে। তৈরি-পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন, এমনকি বিশাল সংখ্যক কারখানা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা হলে পরে কি সত্যিই বাংলাদেশের তৈরি-পোশাক খাত ভেঙে পড়বে? কিম্বা অন্যান্য দেশগুলা যেখানে সন্তোষজনক মজুরি ও কাজের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করে নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা ও গতি বাড়াচ্ছে--সেখানে শ্রমিককে এই ন্যূনতম মজুরি না দিয়ে যারপরনাই ধরনের কম মজুরি দেয়া চালু রাখলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ তার প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কি? এই প্রতিবেদনে আমরা সেই জবাবই তালাশ করেছি।

মোট খরচের শতকরা ৫০ ভাগ মজুরি: একটা ডাহা মিথ্যা প্রচারণা

তৈরি-পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রায়ই দাবি করছে; তৈরি-পোশাক খাতে খরচের শতকরা ৫০ ভাগ যায় শ্রমিকের মজুরিতে। আর মূলধন মালিকের লাভ থাকে গড়ে শতকরা ২০ ভাগ। তার মানে, ১০০ টাকা খরচ করলে ৫০ টাকা যায় মজুরিতে, ১২০ টাকায় মাল বিক্রি হয়। কিন্তু এ খাতে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের হিসাব-নিকাশ বলছে এ দাবি সত্য না। মজুরি বাড়ালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে বলে যে প্রচারণা চালাচ্ছে মালিকপক্ষ ও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম--তা অসত্য। বাংলাদেশের গত অর্থবছরের রফতানি আয় ১৮৩৬ কোটি ডলার। এর ৮০ শতাংশ তৈরি-পোশাক খাত থেকে বলে মালিকেরা দাবি করেন। তার মানে, তৈরি-পোশাক খাতে আয় ১৪৭০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রায় ১০০০০০ কোটি টাকা। তৈরি-পোশাক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ। আয়ের ৫০% মানে ৫০০০০ কোটি টাকা যদি শ্রমিকদের বেতন দেয়া হয়, তাহলে গড়ে একেকজন শ্রমিকের বেতন হয় বছরে ২ লাখ টাকা। নতুন মজুরি কাঠামোতে সাতটা স্তরে ভাগ করা হয়েছে শ্রমিকদের দক্ষতার ভিত্তিতে, এই স্তরগুলার মাঝখানের স্তরটার মজুরি পুরনো স্কেলে ছিল প্রায় ২২৭৫ টাকা, নতুন স্কেলে প্রায় ৩৮০০ টাকা। তাহলে মানেটা দাঁড়াচ্ছে এক বছর হিসাবে শ্রমিকরা এখন পাচ্ছে ২৭৩০০ টাকা, চার মাস পর থেকে নতুন স্কেলে পাবেন ৪৫,৬০০ টাকা। অথচ পাবার কথা ২ লাখ টাকা! যারা শ্রমিকদের মজুরিকে সর্বমোট খরচের অর্ধেক বলেন, তারা কি শতকরা ৫০ ভাগ বোঝান, নাকি ৫ ভাগ? নাকি রফতানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান শতকরা ৮ ভাগ বলতে গিয়ে ৮০ ভাগ বলে ফেলেছেন? নাকি শ্রমিকদের সংখ্যা যা বলা হয় বাস্তবে সেটা তারও দশগুণ বেশি? সুতরাং, নিঃসন্দেহে মোট খরচের শতকরা ৫০ ভাগ যায় মজুরিতে--এটা একটা নির্জলা মিথ্যা কথা।

প্রতিযোগী দেশগুলাতে মোট মুনাফায় শ্রমিকের মজুরি অংশ

ইনডিয়া

ইনডিয়ায় শ্রমিক মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মজুরি যদি হয় শতকরা ৫০ ভাগ তবে ইনডিয়ার এ মজুরি শতকরা ১৫০ ভাগ। যদি এটা ধরে নেয়া হয় যে, ইনডিয়ার তৈরি-পোশাক খাতে শ্রমিকের মজুরি ছাড়া আর কোন খরচ নাই, তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাদের রফতানির প্রতি চালানে ৩০ টাকা লোকসান হওয়ার কথা। কিন্তু পয়লা কথা হল; শুধু শ্রমের মজুরি ছাড়া আর কোন খরচ নাই--এমন খাত দুনিয়ায় অসম্ভব ব্যাপার। দোসরা কথা হল; বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ বেশি মজুরি দিয়েই ইনডিয়ার রফতানিমুখি তৈরি-পোশাক খাত দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে। যার মানে হচ্ছে, বাংলাদেশের তৈরি-পোশাক খাতের শ্রমিকের মজুরি মোট মুনাফার শতকরা ৫০ ভাগ--কারখানা মালিকদের এ দাবি ডাহা মিথ্যা। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিক বছরে ২৫৩৬ টি টি-শার্ট তৈরি করে মজুরি পায় মাত্র ২৯০ ডলার। আর এর চেয়ে মাত্র ৫৬ টি বেশি টি-শার্ট তৈরি করে ইনডিয়ার একজন শ্রমিক পায় ৬৬৮ ডলার। কাজেই এটা পরিস্কার যে, বাংলাদেশের তুলনায় তিনগুণ বেশি মজুরি দেয়ার সাথে সাথে ইনডিয়ার উৎপাদন সক্ষমতাও বেশি।

কম্বোডিয়া

বাংলাদেশে যখন পোশাক খাতের শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ১৬৬২ থেকে ৫০০০ টাকা করার দাবিতে বিক্ষোভ করছে ঠিক সেই সময়ে কম্বোডিয়ার পোশাক শ্রমিকরা তাদের মজুরি ৫৪ ডলার থেকে ৬০ ডলারে নেওয়ার জন্য বিক্ষোভ করছে। অথচ সম্পদ, অবকাঠামো এবং বিনিয়োগ সক্ষমতা--কোন বিচারেই কম্বোডিয়ার অবস্থা বাংলাদেশের চাইতে সুবিধার না। যদিও বলা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন কাঠামোয় মজুরি শতকরা গড়ে ৮০ ভাগ বাড়িয়ে ৩০০০ টাকা করা হয়েছে, কিন্তু এই বাড়তি মজুরি আসলে নিচের দিকের কয়েকটি পদের জন্যই শুধু কার্যকর। ন্যূনতম মজুরি বাংলাদেশি টাকা ৩০০০ টাকা হলে পরে ডলারের হিসাবে তা দাড়িয়েছে ৪০ ডলার--অথচ কম্বোডিয়ার শ্রমিকরা এখনই পাচ্ছে ৫৪ ডলার। কম্বোডিয়া কিভাবে এই খাতে সক্ষমতা ধরে রাখছে?

চীন

দুই হাজার ছয় সালের পরে এই প্রথম বাংলাদেশে শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হল। যদিও মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি দুইটাই বাড়ছে প্রতি বছর। দ্রব্যমূল্য থেমে থাকছে না। কিন্তু মজুরি একই জায়গায় থেমে আছে। দীর্ঘ দিনের শ্রমিক আন্দোলনে মালিকপক্ষ আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার কথা বলেছেন অনেকবার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এসব সমস্যা প্রায়ই মোকাবিলা করতে হয় প্রতিযোগী চীনকেও। চীনে মজুরির কি অবস্থা? ইকনমিস্টের এই পরিসংখ্যানের শিরোনাম হচ্ছে “গেটিং ডিয়ারার”। এই পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে ২০০৪ থেকে ২০০৯ এর মধ্যে চীনে মজুরি বেড়েছে ৬ বার। যদিও এটা একটা প্রদেশের মজুরির খতিয়ান এবং শুধু পোশাক খাত না বরং সব খাতের গড় মজুরি। কিন্তু দেশটাতে সব খাতেই মজুরি গড়-পরতা একই হারে বাড়ে। আর চনে গার্মেন্টস শ্রমিকের এখনকার ন্যূনতম মজুরি হল মাসে ৩০০ ডলার, অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ১.৪৪ ডলার। এছাড়াও তৈরি-পোশাক খাত আছে এমন কয়েকটা দেশের ন্যূনতম মজুরি হচ্ছেঃ ভিয়েতনাম ৯২ ডলার (ঘণ্টায় ০.৪৪ ডলার), শ্রীলঙ্কা ৯২ ডলার (ঘণ্টায় ০.৪৪ ডলার), তুরস্কে ৫১০ ডলার (ঘণ্টায় ২.৪৪ ডলার), মেক্সিকো ৪৫৩ ডলার (ঘণ্টায় ২.১৭ ডলার), পাকিস্তান ১১৬ ডলার (ঘণ্টায় ০.৫৬ ডলার)। আর বাংলাদেশে এ মজুরি হচ্ছে ৪২ ডলার (ঘণ্টায় ০.২০ ডলার)।

জাতীয় রফতানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান কি সত্যিই শতকরা ৮০ ভাগ?

তৈরি-পোশাক খাতে মোট খরচের বিরাট একটা অংশ কাঁচামালের পেছনে যায়, তবে সেই কাঁচামালের দাম বাদ রেখেই কি মজুরির পেছনের খরচ ৫০% বলা হচ্ছে? নাকি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে, এখানে শ্রমের মাধ্যমে তৈরি পোশাকে পরিণত হয়ে আবার বিদেশে চলে যায় বলে হিসাবে ধরা হচ্ছে না? কারণ এই হিসাবে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে, বিদেশ থেকে পাঁচ ডলার দামের কাপড় আসে দেশে, সেটা সেলাই করে ৬ ডলারে বেচা হয়। ফলে রফতানি আয় কি ৬ ডলার নাকি ১ ডলার? এখানে তো এমনকি বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ছে ১ ডলারই, কারণ পাঁচ ডলার দিয়ে কাপড় কিনতে হচ্ছে, সেলাই শেষে ৬ ডলার দেশে ফিরে আসছে। তাহলে বাংলাদেশের রফতানিমুখি তৈরি-পোশাক খাত যে দেশের মোট রফতানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ এনে দিচ্ছে--এই হিসাব তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।

মুনাফায় শ্রমিকের অংশ

ধরা যাক বাংলাদেশের কোন পোশাক কারখানায় এমন একটা পোশাক উৎপাদন হল যার দাম ১০০ টাকা, ওই পোশাকটাকে অতটা দামি করে তুলতে মালিকের স্থায়ী ও চলতি মূলধন, কাঁচামাল ও শ্রমের অবদান আছে, মিলিতভাবে। অর্থাৎ এই উপাদানগুলা আলাদা আলাদা ভাবে যতটুকু দামি করে তোলে ওই পোশাকটাকে, সেগুলা মিলেই ওই পোশাকটার দাম হয় ১০০ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ টাকার পোশাকে শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে কতটুকু দাম যোগ করে? জবাব হচ্ছে ৩১ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার পোশাক উৎপাদনে কমপক্ষে ৩১ টাকা দাম শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে যোগ করে। এই হিসাবটা বাংলাদেশের উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠান-এর (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ- বিআইডিএস) গবেষণা থেকে পাওয়া। আর এভাবে করে হিসাব করার পদ্ধতির নাম হচ্ছে- ভ্যালু অ্যাডিশান থিয়োরি বা দাম যোগ করার তত্ত্ব। আর বিআইডিএস এর একই গবেষণা থেকে জানা গেছে, মোট উৎপাদিত পোশাকে নিজের খাটানো মূলধন ও কেনা কাঁচামাল ইত্যাদি বাবদ মুনাফার প্রাপ্য অংশ তো মালিক স্বাভাবিকভাবেই নেয়, কিন্তু শ্রমিকের অবদান এই ৩১ টাকার থেকেও মালিক নিয়ে নেয় ২৪ টাকা, আর শ্রমিক পায় মাত্র ৭ টাকা। বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিক সারা বছরে ২৫০০ ডলারের সমান পরিমাণ দাম যোগ করে এই খাতে। অর্থাৎ সে তার শ্রম দ্বারা মালিককে প্রতি বছর এনে দেয় ২৫০০ ডলার। অথচ সে মালিকের কাছ থেকে পায় এর মধ্য থেকে মাত্র ৭০০ ডলার, যা সারা দুনিয়ায় সবচাইতে কম। শ্রমের মাধ্যমে সংযোজিত অবশিষ্ট ১৮০০ ডলার চলে যায় মালিকের হাতে। ফলে, বাংলাদেশে শ্রমিকের ওপর মালিকের শোষণের মাত্রা হল শতকরা ২৫৭ ভাগ।

কারাবন্দিদের চেয়ে অর্ধেক কম খেয়ে বাঁচে পোশাক শ্রমিক

নিজের কারখানার দক্ষ শ্রমিক হুট করে অন্য মালিক যাতে আরো বেশি মজুরি দিয়ে নিয়ে যেতে না পারে, সে লক্ষ্যে দুনিয়াজুড়ে শিল্পোন্নত দেশগুলাতে দক্ষ শ্রমিককে ধরে রাখার জন্য বেশি বেতন দেওয়ার চেষ্টা করে মালিকরা। এটাকে বলে এফিসিয়েন্সি ওয়েজ বা দক্ষতা নিশ্চিত করে এমন মজুরি। বাংলাদেশের কৃষি খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার কারণে শ্রমিকরা অনেকটা নিরূপায় হয়েই পোশাক খাতে কাজ করতে আসছে। এবং যেহেতু প্রায় সব পোশাক কারখানাই ন্যূনতম আন্তর্জাতিক মানদ-ও মেনে চলে না মজুরি ও কাজের পরিবেশের বিষয়ে, ফলে এই নিয়ে কোন কারখানাকেই প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয় না। কাজেই মালিকেরও চিন্তা নাই শ্রমিক ধরে রাখতে মজুরি বেশি দেয়ার। বর্তমান ন্যূনতম মজুরি ৩০০০ টাকায় জাতীয় গড় অনুযায়ী ৪.৮ সদস্যের একটা শ্রমিক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের পাতে খাবার বাবদ মাসে ৬০০ টাকার বেশি খাবার পড়ে না। অথচ ট্রেডিং করপোরেশান অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী; বাংলাদেশে একজন কারাবন্দিকে প্রতিদিন ৫২ টাকা ৩৯ পয়সার খাবার সরবরাহ করে সরকার। এতে মাসে প্রতি কারাবন্দির পেছনে ব্যয় হয় এক হাজার ৫৭১ টাকা ৭০ পয়সা। অন্যদিকে কারখানার মজুরির পুরা টাকাও যদি শ্রমিকরা খাবরের পেছনে ব্যয় করে, তারপরও শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কারাবন্দিদের তুলনায় অর্ধেক খাবার খেয়ে বাঁচতে হবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে হলে একজন মানুষের দৈনিক ২ ডলার আয় প্রয়োজন। ৪ জনের একটা পরিবার ধরলে পরিবারের আয় প্রতি মাসে হওয়া উচিত ২৪০ ডলার। ১ ডলার সমান ৭০ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ১৬,৮০০ টাকা। অর্থাৎ আমাদের পোশাক শ্রমিক পরিবারগুলা বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে।

মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বাকোয়াজি

তাত্ত্বিক অর্থনীতির জায়গায় দাঁড়িয়ে যোগান ও চাহিদার সাম্যাবস্থা থেকে দেখানো হয় যে, ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হলে বেকারত্বও বাড়বে, অনেকেই মুখস্থ হিসাব করে বলে দেন মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি-পোশাক খাতে যে মজুরি এখন ঠিক হল তা কি আসলে সাম্যাবস্থার মজুরি? অর্থনীতিরই আরেক তত্ত্ব-- ‘সাবসিস্টেন্স ওয়েজ’ বলছে যেই মজুরিতে শ্রমিক খেয়ে পরে বাঁচতে পারে, তা না পেলে শ্রমিক তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা উৎপাদনে ব্যয় করতে পারে না। মানে দাঁড়াচ্ছে, এই মজুরি স্বল্প সময়ের জন্য মুনাফা কামানোর বড় হাতিয়ার মনে হলেও আদতে এই খাতের উৎপাদন কমাতে এর একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকবে। অন্য দিকে এই সাম্যাবস্থার তত্ত্বের ক্ষেত্রে এখানে একটা জিনিশ স্বতসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে--সেটা হচ্ছে, শ্রমিকের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা সবসময় একই থাকে। বাংলাদেশে সত্তর এর দশকে তৈরি-পোশাক খাতের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মালিকরা বলে আসছে মজুরি বাড়ালে মুনাফা কমবে, সেই পরিমাণ মুনাফা যদি শ্রমিক ছাঁটাই করে কেউ আবার তুলে আনতে যায়, তাহলে ব্যবসায়ের আয়তনও কমাতে হবে। তাহলে মুনাফা আবার কমবে। এমন যদি হত, ৩০০ শ্রমিক ৫০০ শ্রমিকের কাজ করতে পারত, তাহলে ২০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করার সম্ভাবনা ছিল। মালিক কি তবে ৫০০ শ্রমিকের কাজ ৩০০ শ্রমিক দিয়ে করাবেন? কিন্তু আসলে কর্মঘণ্টার বিচারে সেটা করা সম্ভব না। তাহলে কি একজন মালিক শুধু মজুরি বেশি বলে তার ব্যবসায়ের আয়তন শতকরা ৩০ ভাগ কমিয়ে আনবেন? সেরকম নজির এই পুঁজির দুনিয়ায় নাই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে; ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দিলে আসলেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে কিনা। তথ্য-উপাত্ত বলছে অর্থনীতির অনেক বড় অংশ যদি অনানুষ্ঠানিক খাতে থাকে তবে ন্যূনতম মজুরির প্রায় কোন প্রভাবই অর্থনীতিতে নাও পড়তে পারে। মেক্সিকোতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ফলাফল নিয়ে ১৯৯৫ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এক গবেষণায় দেখিয়েছে, মেক্সিকোর অর্থনীতিতে এর কোন প্রভাবই ছিল না। মেক্সিকোর উদাহরণ এজন্যই প্রাসঙ্গিক যে, সে সময়ের পোশাক খাত এবং অনানুষ্ঠানিক খাত সর্বস্ব মেক্সিকোর অর্থনীতি আর আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি একই ধরনের।

মজুরি পাঁচ হাজার টাকা হলে কি বন্ধ হবে?

পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হলে বড়জোর বাংলাদেশের পোশাক খাতের অঘোষিত কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর বিলোপ ঘটতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সেই সমস্ত মালিক এবং বায়িং হাউস যারা সাব কন্ট্রাক্টে ছোট কারখানার কাছ থেকে কম দামে মাল তৈরি করিয়ে কিনে নেয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার দরে বায়ারদের কাছে বিক্রি করে থাকে। এ ধরনের ব্যবসা আর টিকবে না। বরং এ কারখানাগুলা বড় কারখানার সাথে একীভূত হয়ে ব্যবসা করতে বাধ্য হবে। সুতরাং এই মধ্যস্বত্বভোগীদের ব্যবসা বা অল্প পুঁজির কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা--শিল্পের স্বাভাবিক নিয়মের দিক থেকে এটা কোন আশঙ্কাই না। একটা খাতের মধ্যকার বিন্যাসের এমন অদল বদল খুব স্বাভাবিক। তার সাথে পুরা খাতের সামগ্রিক লাভ ক্ষতির আশঙ্কার কোন ভিত্তি নাই।

তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারের নানা দিক নিয়মিত পরিবর্তন হয়। চাহিদা, যোগান, প্রতিযোগিতা--সবকিছু। বাংলাদেশ যখন এই বাজারে ঢুকল সেই সত্তরের দশকে, তখন এই বাজারে যারা প্রতিযোগী ছিল তাদের অনেকেই এখন এ খাতে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। তারা এখন আর এ ব্যবসাতে নাই--যেমন তুরস্ক। চীন একতরফাভাবে রফতানিমুখি পোশাক উৎপাদন করায় তার স্থানীয় পোশাকের বাজার এখন চাহিদা মেটাচ্ছে আমদানি করে। আর সেই স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশ ঢোকার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে চীন যে দামে পোশাক বেচে তার চেয়ে কম দামে চীনের স্থানীয় বাজার পোশাক আমদানি করে। এবং বাংলাদেশের রফতানি পোশাকের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের পোশাকের দামের চেয়ে কম, অর্থাৎ চীনের স্থানীয় বাজার যে দামে পোশাক আমদানি করে সেই দামের কাছাকাছি। ফলে বাংলাদেশের জন্য চীনের স্থানীয় বাজার দখল নেয়া কোন কঠিন কাজ না। তাছাড়া তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমশ আয়তনে (বিজনেস ভলিউম) বাড়ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান হচ্ছে; ২০০৫ সালেই দেশটার চাহিদা তার আগের ৩ বছরের চাইতে শতকরা ২০০ ভাগ বেড়েছে। একই সাথে তাদের নিজেদের স্থানীয় বাজার থেকে পোশাক সরবরাহের সক্ষমতা শতকরা ৩২ ভাগ কমে গেছে। এর বাইরেও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় নতুন বাজার হচ্ছে; অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া। কাজেই সামনের দিকে বাংলাদেশের তৈরি-পোশাক খাতের ব্যবসায়ের আয়তন ক্রমশ বাড়বে, কমবে না। এছাড়া গত দশকজুড়ে বাংলাদেশেই পোশাক খাতের অনেকগুলা পেছনে থাকা সংযোগ খাত (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) তৈরি হওয়ায় ঝুঁকি অনেক কমে গেছে। কাঁচামালসহ অন্যান্য সমর্থনের জন্য আমদানি নির্ভরতা কমছে। আমদানি নির্ভরতা কমায় এবং আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজ ও বন্দর প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায় ‘অপরচুনিটি কস্ট’ কমে। ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের রফতানিমুখি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ছে। এ অবস্থায়ও যদি শ্রমিকদের যা না হলেই নয় মার্কা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি--ন্যূনতম মজুরি ৫০০০ টাকা করা হয় তাহলে পোশাক খাতে এর কি প্রভাব পড়তে পারে? এর ফলে কি তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ?

এমন আশঙ্কার সমর্থনে কোন পরিস্থিতি এখন বিদ্যমান নাই। কিম্বা সুদূর ভবিষ্যতে অমনতরো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মত কোন শর্তও বিদ্যমান নাই। কারণ, প্রথমত; এ প্রতিবেদনে অনেকগুলা প্রতিযোগী দেশের উদাহরণ থেকে দেখতে পাচ্ছি এর চাইতে অনেক বেশি মজুরি দিয়ে দিব্যি তাদের ব্যবসা চলছে। দ্বিতীয়ত; বাংলাদেশ যদি তৈরি পোশাকের দাম অনেকটা বাড়িয়েও দেয়, তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের হাতে খুব কমই বিকল্প আছে। কারণ অনেক দেশই গত দুই দশকে রফতানি পোশাক খাত গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ আরো উন্নত ও টেকসই খাতে যাওয়ার জন্য, আবার অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে। অন্যদিকে অনেক প্রতিযোগী দেশ আবার ইতিমধ্যে তার উৎপাদন সক্ষমতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে। যেমন কম্বোডিয়া, ওই দেশটার যে পরিমাণ শ্রমশক্তি ও সম্পদ-মূলধন ইত্যাদি আছে, তাতে করে এই খাতে দেশটা তার ব্যবসায়ের বর্তমান আয়তন আর বাড়াতে পারবে না। অন্যান্য খাতের চেয়ে তৈরি-পোশাক খাতের উপযোগিতার দিক থেকেও তা সম্ভব না কম্বোডিয়ার পক্ষে। কোন দেশ চাইলেই তার পুরা ভূখ- জুড়ে নিশ্চয়ই পোশাক কারখানা বানিয়ে ফেলতে পারে না, সেই অবকাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই ক্রেতাদের অবশ্যই বাংলাদেশের কাছে আসতে হবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাগ কমছে না সুদূর ভবিষ্যতে। তাছাড়া প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারানোর যে আশঙ্কার কথা বলা হয়--তার প্রধান কারণ হল বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের মুসাবিদার যোগ্যতার অভাব। ভিয়েতনামের মত দেশগুলার সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা শুধু পণ্যমূল্যেই না। ইওরোপ আমেরিকার ক্রেতারা যেহেতু তৈরি পোশাক খাতকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছে তাই বিভিন্ন দেশের পণ্য বিভিন্ন হারে শুল্ক দিয়ে দামটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে স্থিতিশীল (নরমালাইজ) করা হয়। মুসাবিদা হওয়া দরকার ওই শুল্ক হার কমিয়ে শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করা নিয়ে। তাছাড়া এ ধরনের প্রতিযোগিতা দেশের ভেতরের বাজারেও থাকে, আছে। বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে কি দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা নাই? আছে। এক কারখানা মালিক কি আরেক মালিকের চাইতে কম দামে পণ্য বিক্রির প্রস্তাব করেন না ক্রেতাদের কাছে? করেন। রফতানির বাজারে কি কোন সিন্ডিকেট নাই? আছে। তারপরও বাজার অর্থনীতি চালু আছে? বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি এভাবেই চালু থাকে। যেসব দেশের উদাহরণ আগে দেয়া হয়েছে তারা নিজেদের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে না, বরং ক্রেতাদের সাথে দামের মুসাবিদায় জয়ী হয়ে সক্ষমতা ধরে রাখছে।

বাংলাদেশের যেটা বাড়াতে হবে তা হচ্ছে তদবির মানে লবিং এবং মুসাবিদার দক্ষতা মানে নেগোশিয়েশন স্কিল। এমন কি যদি দরকষাকষি করে দাম বাড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে শুধু মালিকের মুনাফার অংশটাই কিছু কমবে। ব্যবসায়ের আয়তন বাড়িয়ে মানে নতুন বাজার নিশ্চিত করে মুনাফার এ কমতিও ঠেকানো খুব সম্ভব। অর্থাৎ মজুরি বাড়ালে ব্যবসার আয়তন কমবে না, বন্ধ হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। এই প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি যে, বাংলাদেশে তৈরি-পোশাক খাতে মুনাফার নিজের অংশ তো মালিক নেনই বরং শ্রমিকের অংশ--প্রতি একশ টাকায় ৩১ টাকা থেকে ২৪ টাকাই নিয়ে নেন মালিকপক্ষ। মজুরি বাড়ালে হয়ত শুধু শ্রমিকের অংশ থেকে আরো কিছু কম মুনাফা নিতে হবে মালিককে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের দরকষাকষির ক্ষমতা কম হওয়ার খেসারত দিতে সরকার কেন শ্রমিকদের যৌক্তিক মজুরি থেকে বঞ্চিত করবে কিম্বা ভুখা শ্রমিকদের ওপর তার পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দেবে! সরকার বরং এই খাতের মালিকদের ব্যবসা-বুদ্ধি বাড়ানোতে আরো মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিতে পারে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।