উত্তম কুমার বড়ুয়াকে চাই
রামুতে যারা পরিকল্পিত ভাবে এই হামলা করেছেন তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। হাইকোর্ট রিট জারি করেছে যেকোনো ধর্মীয় উপসানালয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানে এটা প্রমাণ হল যে বাংলাদেশে মুসলিম ভিন্ন অন্য ধর্মের মানুষরা নিরাপদ নয়। প্রথম আলো সহ প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম মিছিলে সমাবেশে লীগ নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা আর ইসলামী জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছেন। একে সাম্প্রদায়িক হামলার পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আলো সব চেয়ে অগ্রগণি ভূমিকা পালন করেছে। যা একটা বিশাল প্রভাব ফেলেছে নাগরিকদের ভেতর। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ করতেও দেখা গেছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। এতে আরো সহজ হয়েছে সুশীল সমাজ কে খুশি রেখে নিরাপরাধ মানুষদের গ্রেফতার করা।
বিশ্ব জানল আমরা উগ্র ইসলামী জাতি। আর আমরা কী দেখলাম? রামু, উখিয়া, পটিয়ার বৌদ্ধবিহারে আমাদের ‘মানুষদের’ বাজে ধরনের রাজনীতির শিকার হতে দেখলাম। দেখলাম ‘মানুষের’ বিশ্বাসের ওপর কীভাবে অগ্নিসংযোগ করা হল, কীভাবে ভস্ম করা হল ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় উপাদান। এবং ‘মানুষ’ কাঁদল। বিশ্বাসে আঘাত করলে মানুষ এভাবেই কাঁদে। বুকের যেখানে, আর কিছু না থাক, ঈশ্বর তো আছে এমন বিশ্বাসের বসবাস, সেই বাসস্থান-কে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে দেখলাম। জন্মগত ও সাংস্কৃতিক কারনে‘মানুষ’ যে ধর্মীয় পরিচয় বহন করে এবং সেই পরিচয়ের কারণে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করলে ‘মানুষ’ ঠিক এই ভাবে কাঁদে। আমরা ‘তাঁদের’ কাঁদতে দেখেছি।
আর কী দেখলাম?— দেখলাম খবর কীভাবে খবর হয়, খবরে কীভাবে বিভিন্ন লেবাসে পরিবেশিত হয়। সেই লেবাস কীভাবে মানুষের সিধান্ত তৈরি করে। সেই সিদ্ধান্ত কীভাবে কার কোন স্বার্থ হাসিল করে সেটা ভাবা আর বোঝা মনে হয় এখনকার জরুরী কাজ।
তার আগে ঘটনার বীজ-বিস্তার এর দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ‘সন্দেহ’ ও ‘সিদ্ধান্ত’ বাদ দিয়ে দয়া করে একটু ফ্যাক্ট নিয়ে ভাবি। জানা যায়, রামু’র উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইলে কেউ পবিত্র কোরআন অবমাননা মূলক একটি ছবি ট্যাগ করে, (ট্যাগ বিষয়টা কী আমরা সবাই কম-বেশী জানি। মানে ছবিটি উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রদর্শন করেন নি। তার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা কেউ একজন এই কাজটি করেছে।) এই অবমাননাকর ছবি প্রচারের প্রতিবাদে রাত সাড়ে নয়টার দিকে ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃতে প্রায় ৫০-৬০ জনের একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে একটা সমাবেশও হয়, প্রায় ২৫০ জন লোক জমায়েত হয়েছিল। একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আর মৎস্যজীবী লীগের একজন নেতা বক্তৃতা দেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও সেখানে বক্তব্য রাখেন। বিএনপির স্থানীয় সাংসদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
রাত দশটার দিকে বিভিন্ন যানবাহনে করে শত শত লোক রামুর দিকে আসতে থাকে। তাদের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও ছিলেন। এভাবে রাত বারোটার ভেতরে সেখানে শত শত লোক জড়ো হয়। এবং তখন হামলা শুরু হয়, রাত প্রায় সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ। আক্রমণকারীদের আওয়ামি লীগের কেউ ছিলেন কীনা এই প্রসঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জানান অন্ধকারে তিনি দেখতে পান নি। পরদিন উখিয়া আর পটিয়ার বিহার গুলোতে হামলা হয়।
প্রথম আলো ঘটনার পরদিন সকালে যে খবর দিল তা হল,
“ হাসপাতালে নেওয়ার পথে যতীন শর্মার স্ত্রী বুচি শর্মা (৭০) মারা যান। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামসুল ইসলামও বুচি শর্মার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।”
অথচ পরদিন জানা যায় বুচি শর্মা বেঁচে ছিলেন। তাহলে শিরোনামে একজনকে মেরে ফেলে প্রথম আলো সালাদের সাথে কি কোনো আমিষ পরিবেশন করতে চেয়েছিল? এমন অতিরঞ্জিত খবর প্রথম আলোর মত প্রথম সারির সংবাদপত্রের কাছে আশা করা যায় না।
এর পরদিন প্রথম আলো শিরোনাম দিল,‘সন্দেহে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা’ । শিরোনাম আর খবরে কোনো মিল নাই। হিন্দু-রাজ্যে গরুর রচনা লিখেছেন আর অযাচিত শিরোনাম দিয়েছেন ‘বিফ কাবাব’। এতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধল কীনা এ বিষয়ে প্রথম আলোর কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না। অনেকেই এই হামলাকে ‘রোহিঙ্গা-বৌদ্ধ দাঙ্গা’ আবার অনেকে একে ‘মুসলিম-বৌদ্ধ’ দাঙ্গা বলে’ অভিহিত করতে লাগলেন শুধুমাত্র এইসব খবরে যেখানে মিছিল সমাবেশ আর গাড়ি বহরে স্থানীয় নানান লীগ-এর নেতা কর্মীদের দেখা গেছে। ফেসবুকে তো এমনও দেখেছি ‘রোহিঙ্গামুক্ত বাংলাদেশ চাই’ লিখে অনেকে শেয়ার করছেন। অথচ এরাই ক’মাস আগে রোহিঙ্গাদের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন এই ফেইসবুকেই। এই হল ‘বিফ কাবাবের’ পুষ্টি।
প্রথম আলোর ০৩/১০/১২ তারিখের প্রধান শিরোনামের যে রিপোর্টটি যায় তাতে ঘটনাকে এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পড়ে মনে হয়, ছাত্রলীগকে ধোয়া তুলসি পাতা প্রমাণের জন্য তারা কলম ধরেছেন। ঘটনাকে সাজিয়েছেন তারা এভাবেঃ
“রামুর উত্তর মিঠাছড়িতে টিলার ওপরে স্থাপন করা হয়েছে ১০০ ফুট লম্বা শোয়ানো বুদ্ধমূর্তি। করুণা শ্রী ভিক্ষু এটি স্থাপন করেছেন। সেদিনের হামলার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কংক্রিটের মূর্তিটি শাবল দিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ভাঙতে পারেনি। তবে হামলার কারণে বৃহৎ আকারের মূর্তিটিতে ফাটল ধরেছে। সেখানে অতি মূল্যবান একটি ত্রিপিটক রাখা ছিল, সেটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনা নিজের চোখে দেখেন এমন বৌদ্ধ বাসিন্দা অমল বড়ুয়া বলেন, শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা সাদ্দাম হোসেন, আমজাদ হোসেন, জিন বাবু, রুস্তম আলীসহ কয়েকজন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বৌদ্ধমন্দির ঘুরে উপজেলা সদরের চৌমুহনীতে আসার পর রামু নাগরিক কমিটির নেতা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম যোগ দেন। মিছিলটি রামু বাজারের মোড়ে আসার পর সেখানে আরও লোকজন জড়ো হয়। সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুশরাত জাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ও থানার ওসি উপস্থিত হন। বক্তব্য শেষ করতে না-করতেই লাল চিং মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে।” দেখুন
খেয়াল করেছেন পাঠক? ‘এই ঘটনার’ প্রতিবাদে? মানে কী? কোন ঘটনার প্রতিবাদে? মিঠাছড়ির মন্দিরের হামলার প্রতিবাদে? যেন মন্দিরের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েই সেই মিছিল হয়েছিল। এরা মন্দিরের হামলার প্রতিবাদ করতেই যেন সমাবেশ করেছিলেন! আর এর পর পরই লালচিং মন্দিরে জ্বলে ওঠে আগুন! মিথ্যারও একটি সীমা আছে। প্রথম আলো দিনকেই শুধু রাত করে নি, রাতের আঁধারে ডাকাতও পাঠিয়ে দিয়েছে গেরস্থের ঘরে।
হামলাটি যে পূর্ব পরিকল্পিত তা খুব সহজেই বোঝা যায়। উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তিকে ফেসবুকে কোরআন অবমাননামূলক এক ছবিতে ট্যাগ করা, সেই ছবির প্রতিবাদে মিছিল করা— যে মিছিলে নানান লীগদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে, সমাবেশ, ২ ঘণ্টার ভেতরে শত শত মানুষের গাড়ি বহরের আগমন, কংক্রিটের ব্লক, ট্রাক বাসের ব্যবহার, সব চেয়ে বড় কথা ২ ঘণ্টার ভেতরে সেই কোরআন অবমাননামূলক ছবির ফেস্টুন এই সবগুলো ঘটনা একটা দিকেই ভাবতে সাহায্য করে যে এগুলো উত্তেজিত জনতার কাজ নয়। প্রশাসন পুলিশ রাজনৈতিক নেতা কর্মী সবার উপস্থিতে এত বড় নাশকতামূলক কাজ কীভাবে হয় সেটা বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। এমনকি দমকল বাহিনী পর্যন্ত দেরী করে পৌঁছেছে। একে মুসলিম জঙ্গি বা রোহিঙ্গা জঙ্গিদের হামলা বলে চালানোর চেষ্টা কেউ কম করেন নি। পুলিশ প্রথম দিন জানিয়েছে হামলার সময় নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনি শোনা গেছে। অথচ যাদের ওপর হামলা হয়েছে তারা এমন কিছু বলেন নি। তারা বার বার বলছেন মিছিলে সমাবেশে আওয়ামি লীগের নেতারা ছিল। তারাই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত্য করে তুলেছিল।
উখিয়া আর পটিয়ার হামলাগুলো রামুর ঘটনার পরদিন ঘটেছে। এতে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র এবং শিক্ষকদের জড়িত থাকার খবর পাওয়া যায়। এও অসম্ভব কিছু না। কিন্তু রামুর ঘটনা আর উখিয়া পটিয়ার হামলাকারী এবং হামলার ঘটনা এক নয়, রামুর হামলার ঘটনার ভেতর দিয়েই এই ধরনের ধর্মীয় ম্যাসাকারের দিকে ধাবিত করা হয়েছে মানুষকে।
ওদিকে আবার থানার ওসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ০৭/১০/১২ এর প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে,
“রামু মোড়ে এসে দেখতে পান, সেখানে সমাবেশ হচ্ছে। এতে রামু নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নূরুল ইসলাম ওরফে সেলিম ও মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হকসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন। ওসিও বক্তব্য দেন। এক ঘণ্টা পর সমাবেশটি শেষ হয়। এলাকায় তখন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কিন্তু ওসি একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ওসি শ্রীকুলের লালচিং মন্দিরে পাহারার জন্য যেতে বললে তিনি তিন সহকর্মী নিয়ে সেখানে যান। ওই মন্দিরে হামলার চেষ্টা করা হলে তিনি ওসির কাছে অতিরিক্ত লোক চান। বারবার ফোন করলেও ওসি সাড়া দেননি। একপর্যায়ে তিনি ওসির ফোন বন্ধ পান। ফলে তিনজনকে নিয়ে মন্দিরের সামনে তিনি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের সামনেই মন্দিরটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।” দেখুন
এখানে বারবার ‘তিনি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কার না এই ‘তিনি’ কোন ‘তিনি’। এখানে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম ওরফে সেলিম ও মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হক এদের নাম স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে এবং খবরের ধারাবাহিকতায় লেখা হয়েছে ওসি সেই সময়ে ঠিক কী কী আচরণ করেছিলেন। যেমন তাকে পাহারা দিতে যেতে বলা হয়, প্রশ্ন আসে, কে পাহারা দিতে যেতে বলেন? বারবার ফোন করেও ওসিকে পাওয়া যায় নি। ফোন কে করেন? ছাত্রলীগের নেতা নুরুল হক নাকি মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হক? আর প্রথম আলোকে এই বয়ান-ই বা কে দিল? কোনো লীগ? ওসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা খুব সহজ বলেই আমরা প্রশ্ন করছি, কিন্তু ওসি খবর পেয়ে যে সমাবেশে যান, সেই সমাবেশটি কেন হয়েছিল? ছাত্রলীগ মৎস্যলীগের নেতারা কেন সেই মিছিল সমাবেশ করলেন সেইসব প্রশ্ন কি হাজির হয় না? যদি কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই সেই জমায়েত হয়, তাহলে সেটা মিছিল কেন হবে? আর সেই মিছিলে “বড়ুয়াদের গালে জুতা মারো তালে তালে’’ ধরনের স্লোগান কেন হবে? দেখুন
রামুর ঘটনার ক্ষেত্রে এমন কোনো খবর পাওয়া যায় নি যে লীগ মিছিলে বাধা দিয়েছে বা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। বরং তারাই মিছিল সমাবেশ করে পরিস্থিতিকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। ‘রামুতে হামলাকারীদের উসকানি দেয় পুলিশ’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন ০৭/১০/১২ এর প্রথম আলোর রিপোর্টে এসেছে তার ভেতরে লেখা,
“বৌদ্ধপল্লি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় রামু থানার পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। হামলার সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিষ্ক্রিয় ছিলেন।”
উসকানি আর নিষ্ক্রিয়তা কি এক বস্তু? পুরো প্রতিবেদনের মাত্র এক জায়গায় ছাত্রলীগের এক নেতার বয়ানে জানা খবরের ভিত্তিতে উসকানি দেয় পুলিশের দুই কনস্টেবল এমন বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রথম আলো কোন উদ্দেশ্য হাসিলে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে উসকানি বলতে চায় সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। পুলিশ যদি নিষ্ক্রিয় থেকে থাকে, পুলিশ যদি উসকানি দিয়ে থাকে তাহলেও সরকারের দিকেই চোখ যায়। পুলিশ তো আর সরকারের বাইরের কিছু না। আর লীগ-ও বিরোধী দল না।
সব চেয়ে বড় রহস্য উত্তম কুমার বড়ুয়া। প্রথম আলোর প্রথম দিনের (০১/১০/১২) খবরঃ
“রামু থানার পুলিশ জানায়, এক পর্যায়ে উত্তম কুমার বড়ুয়া ও তাঁর মা মাদু বড়ুয়াকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় তারা। উত্তম কুমার পুলিশের কাছে দাবি করেন, কেউ একজন তাঁর ফেসবুকে কোরআন শরিফের অবমাননার ওই ছবিটি যুক্ত (ট্যাগ) করেছে। বিক্ষোভ শুরুর পর উত্তম নিজেই তাঁর ফেসবুক আইডি বন্ধ করে দেন।” দেখুন
দ্বিতীয় দিনের (০২/১০/১২) খবরঃ
“যে তরুণের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি দেখা গেছে, সেই তরুণের খোঁজ মেলেনি। রামুর হাইটুপি গ্রামের উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এই তরুণ ঘটনার পর থেকে পলাতক। পুলিশ তার মা ও বোনকে হেফাজতে নিয়ে রেখেছে।” দেখুন
তৃতীয় দিনের(০৩/১০/১২) খবরঃ
“ যে তরুণের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়, তাঁর নাম উত্তম কুমার বড়ুয়া। উত্তমের নামেও মামলা করেছে রামু থানার পুলিশ। উত্তমকে পুলিশ খুঁজে পায়নি। তাঁর মা ও বোন পুলিশ হেফাজতে আছে।” দেখুন
আর ০৭/১০/২০১২ প্রথম আলোতে এসেছে
“তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, থানার উপপরিদর্শক (এসআই) উজ্জ্বল কান্তি দাস কমিটিকে বলেন, ঘটনার রাতে (২৯ সেপ্টেম্বর) ওসি তাঁকে ফোন করে দ্রুত আসতে বললে তিনি আসেন। তিনি এসে দেখেন, রামু বাজারের মোড়ে ফারুকের দোকানে অনেকে জড়ো হয়ে ফেসবুকের ছবি দেখছেন। তিনি দোকানে ঢুকে দেখতে পান, উত্তর কুমার বড়ুয়া নামের এক তরুণের ফেসবুক থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি তাঁর ২৬ জন বন্ধুর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি কম্পিউটারটি জব্দ করে থানায় আনেন। এরপর উত্তমকে গ্রেপ্তার করতে তাঁর বাসায় যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, উত্তমের মা ও তাঁর বোন ছাড়া বাসায় কেউ নেই। তিনি তাঁদের আটক করে থানায় আনেন।’’দেখুন
কোথায় উত্তম কুমার বড়ুয়া। পুলিশের হেফাজতে নেওয়ার পর সে পুলিশের সাথে কথাও বলেছে। নিজের ফেসবুক আইডি বন্ধ করে দেওয়ার খবরও সে পুলিশকে দিয়েছে। অথচ পরের দিন সে নিখোঁজ। তার পরদিন পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা করল! পুলিশ কি তবে প্রথম দিন মিথ্যা বলেছিল যে উত্তম কে তারা তাদের হেফাজতে নিয়েছিল, নাকি পুলিশ পুলিশ মিথ্যা বলল?— যে উত্তম কুমারকে পাওয়া যায় নি? এই হামলার ঘটনায় সব চেয়ে নির্মম শিকার উত্তম। তাঁর প্রতি যে অবচার করা হয়েছে এই নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না। এখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে গেছে নিরবে। কৌশলে তাকে আসামী বানিয়ে দেয়া হল! সে কোথায়? সে কি বেঁচে আছে? নাকি মরে গেছে? বেঁচে যদি থাকেও, সে কি খাবার পাচ্ছে? পানি পাচ্ছে? নাকি লাশ হয়ে ভেসে গেছে ‘গুম’ নদীর জলে?
শুধু মানবাধিকার রক্ষার দায়েই নয়, তাঁকে আমাদের প্রয়োজন আরো নানা কারণে। যেহেতু ঘটনার বীজ তার ফেসবুকে ট্যাগ করা ছবি। তার ফেসবুক আইডি ডি-এক্টিভেট কি তিনি নিজে করেছিলেন নাকি পুলিশ ‘হেফাজতে’ যাওয়ার পর বাধ্য হয়ে করেছিলেন ? এসব প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিতে পারবেন। তার আইডি থেকে কে ছবি ট্যাগ করেছিল তার পরিচয়ও বের করা সম্ভব। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এইসব বিষয়কে তদন্তের আওতাধীন না করে পুলিশ যেন কারো নির্দেশে অনাধুনিক রূপে কাজ করছে। এমনকি খবরে এসেছিল বিভিন্ন মোবাইল ফোন থেকে হামলার ঘটনা ভিডিও করা হয়েছিল। কোথায় সেই ভিডিও? কোথায় সেই ছবি? কেন বারবার রোহিঙ্গা বা ইসলামী জঙ্গি প্রসঙ্গ আসল? ছবি বা ভিডিও ফুটেজে কি তদন্তকারী এমন কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন? যা চোখ দিয়ে দেখার সুযোগ আছে আমরা তা ইসলামোফোবিক মন দিয়ে কল্পনা কেন করছি? আমরা দেখতে চাই সেইসব ছবি সেইসব ভিডিও কে আমলে নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। আমরা উত্তম কুমার বড়ুয়াকে কে চাই। পুলিশের হেফাজতে থাকা সে কীভাবে নিখোঁজ হল? উত্তম কুমার বড়ুয়াকে কে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এখনকার দাবী এই হওয়া উচিত।
০৭/১০/১২
রওশন আরা মুক্তা
লেখক, কবি, অনলাইন সাহিত্যকর্মী
raramukta@gmail.com