বেহাত শাহবাগ ও রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের সম্পর্ক


‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ শ্লোগান নিমিষে পরিণত হল ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি’ শ্লোগানে— ট্রাইব্যুনাল দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু দণ্ডাদেশ রায় ঘোষিত হওয়ার পর। আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল শাহবাগ চত্বরে যেখানে ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ডাকে যুদ্ধাপরাধীদের ‘ফাঁসির’ দাবিতে সাধারণ মানুষ, মিডিয়া এবং তথাকথিত বামপন্থীরা ২৫ দিন ধরে অবস্থান করছিলেন। অন্যদিকে জামায়াত-শিবির-পুলিশ সংঘর্ষে মারা পড়ল ৬ পুলিশ সদস্য সহ ৫১ জন, আহত তিন শতাধিক এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। কোথাও জামায়াত-শিবির পুলিশের উপর হামলা করেছে কোথাও পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করেছে। যেহেতু মরছে জামায়াত-শিবির মিডিয়াও একটি পক্ষ নিয়ে নিউজ ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব।’ এবং ‘তাণ্ডব’ বলে এই মৃত্যুগুলোকে বৈধ করার চেষ্টা মিডিয়ার আছে। যেন জামায়াত-শিবির বলেই তাদের রাস্তায় গুলি খেয়ে মরার কথা! রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া, অথচ রাষ্ট্রই গুলি করে মারছে। এই মৃত্যুকে বৈধ করার জন্য রাষ্ট্র মিডিয়াকে তৈরি করেছে আর শাহবাগ নাটকের সৃষ্টি করেছে। যদি জামায়াত বৈধ রাজনৈতিক সংগঠনও না হত তবুও রাষ্ট্র এভাবে তাদের গুলি করে মারতে পারে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে, এখন পারলে সরকার তা করে দেখাক। তা না করে কেন সরকার তাদের গুলি করে মারবে! সেই এখতিয়ার রাষ্ট্রের কি আছে? পাখির মত মানুষ মারলে দেশে শুধু রক্তের বন্যাই বইবে। একটি সহিংসতার ধারাবাহিকতায় আরেকটি সহিংসতা সৃষ্টি হবে। এবং হচ্ছে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণ একটা গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।


মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়েই আজকে এই সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার অধীন যাদের করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় নেতা, তাই জামায়াত-শিবির তাদের রাজনীতি করতেই রাস্তায় নামছেন। আমরা যারা ‘ফাঁসি’ না চেয়ে ‘সুষ্ঠু বিচার’ চাইছি তাদের সাথে জামায়াতের পার্থক্য পরিষ্কার। জামায়াত বিচারই চায় না। তারা কি চায় স্পষ্ট না। কিছুদিন আগে তারা পুলিশের উপর আক্রমণ করতে শুরু করেছিলেন। কেন, তাও পরিষ্কার নয়। কিন্তু একে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে হবে, গুলি করে নয়। অস্পষ্ট রাজনীতি করলে তাকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে, গুলি করে নয়। ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডও বড় নির্মম একই সঙ্গে নির্মম শাহবাগ চত্বরের সিসিটিভির দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবলের মৃত্যু। এই দুই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত সবার যৌক্তিক দাবি। যদিও শাহবাগ জানিয়েছে জামায়াত-শিবিরই রাজীবকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা পুলিশ কনস্টেবল খুনের ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারে নি। রাজীবের মৃত্যুকে আদর্শিকীকরণ করা হয়েছে, তাকে শহীদ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ সে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের ব্লগার ছিল। আর নিরীহ পুলিশ কনস্টেবল দায়িত্বরত যন্ত্র ছাড়া কিছুই ছিল না। সেই জন্য তার পরিবারের ভাগ্যে সাধারণ সমবেদনাও জোটে নি।

রায় ঘোষণার পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মন্তব্য করলেন, ‘শাহবাগ দ্বারা বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয় নি’ এই কথার চেয়ে বড় কৌতুক আর কি হতে পারে! রাষ্ট্রপক্ষ নিজের খেয়ালখুশিমত বিচারও চান আবার নিজেদের নিরপেক্ষতার ফিরিস্তি দেন অযৌক্তিক ভাবে। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে যে অভিযোগে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে তাতে হত্যার ঘটনা হল ২টি আর সেই হত্যাগুলো তিনি নিজে করেন নি, তার নির্দেশে করা হয়েছে একটি; অন্যটি পাকসেনারা করেছে। অন্যদিকে কাদের মোল্লাকে, হিসাব করলে প্রায় ৪টি পরিবার, একজন যুবক এবং একইসঙ্গে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ জন মানুষ হত্যার অভিযোগের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে, এখন এগুলো কি ধরনের সাক্ষীর ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে সেই তর্কে যাব না। শুধু বলতে চাই, এত এত মানুষ হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে— শাহবাগ তৈরি করে— তার দ্বারা চাপে থেকে— ২টি খুনের দায়ে সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিয়ে ট্রাইব্যুনাল কি প্রমাণ করল না, যে তারা যোগসাজশের বিচারই করেছেন? এটর্নি জেনারেলের মন্তব্য যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন, এটি এখন নগ্ন সত্য যে শাহবাগের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে এই রায় প্রদান করা হয়েছে। অস্বীকার করলেও এই ট্রাইব্যুনাল বহু আগেই স্বচ্ছতা হারিয়েছে এবং এই ট্রাইব্যুনাল যত রায় দিয়ে যাবে ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

যে শাহবাগ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করল, আসলে কি এই শাহবাগ? ‘শাহবাগের চেতনা’ শুনছি, আসলে কি এর চেতনা? তারা কিছু চায় আসলে কি চায় তারা? শাহবাগের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পর। শাহবাগের দাবি কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ আজ এক জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই ফাঁসি শাহবাগ কার কাছে চায়? ট্রাইব্যুনালের কাছে? যে ট্রাইব্যুনাল বিচার প্রক্রিয়ায় সম্ভব থাকা সত্ত্বেও লঘু শাস্তি প্রদান করেন সেই ট্রাইব্যুনালের কতখানি নিরপেক্ষতা আছে বলে শাহবাগ মনে করে এটা একটা প্রশ্ন। আর যদি শাহবাগ ট্রাইব্যুনাল কে প্রশ্ন না করে বিচার অস্বীকার করে এবং তার কাছে শুধু ফাঁসিই দাবি করে তাহলে সেটা হয় স্রেফ আদালত অবমাননা। যার কোন বিপ্লবী দিক নাই, শাহবাগ যদি স্কাইপি কেলেঙ্কারিকে আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করে মানবতা বিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করত তাহলেও তা আদালত অবমাননাই হত। কিন্তু তার একটা বিপ্লবী ভিত্তি থাকত। এই প্রজন্মের তরুণদের চোখকান এতটুকু খোলা থাকবে এইটুক আশা তো আমরা করতেই পারি।

কিন্তু শাহবাগ কি পেরেছে এই আন্দোলনকে বিতর্কের ঊর্ধ্ব রাখতে? তারা কি পেরেছে এই আন্দোলনকে বিপ্লব আখ্যায়িত করতে? বিপ্লব তো দূরের, তারা আন্দোলন কতখানি নিরপেক্ষ সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। যে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে আন্দোলন হয় শাহবাগে সেই পুলিশের ব্যারিকেডের ভিতর তারা নিরাপদে শ্লোগান দিচ্ছেন। যে পুলিশকে আমরা শিক্ষকদের উপর পিপার স্প্রে ব্যবহার করতে দেখি, টিয়ারশেল ছুঁড়তে দেখি সেই পুলিশ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এ কেমনতরো আন্দোলন! শাহবাগে মোমবাতি জ্বালানো হল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মোমবাতি জ্বালালেন, শাহবাগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। তিনি বলেছেন তাঁরও শাহবাগ ছুটে যেতে ইচ্ছা করে। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদে দাঁড়িয়ে শাহবাগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। যেকোন আন্দোলনের প্রতি যারা খড়গহস্ত থাকেন বরাবর তারা আজ শাহবাগকে বাহবা দিচ্ছেন। শাহবাগের জমায়েত সরকারের কি কি সুবিধা আদায় করে দিচ্ছেন তা ভাবার ক্ষমতা শাহবাগের আছে তো? নাকি সরকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেই তারা বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন পূরণ হয়ে যাচ্ছে ভেবে নিজেদের চে গুয়েভারা ভাবতে থাকেন?

শাহবাগের দিকে আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গভীর মনোযোগ লক্ষ্য করতে পারি, তাঁদের কি স্বার্থ শাহবাগের সাথে জড়িত সেটা কি শাহবাগ খতিয়ে দেখেছে? একদিকে সীমান্তে তারা পাখির মত এদেশের মানুষ মারছে অন্যদিকে শাহবাগকে সমর্থন দিচ্ছে, কোন রাষ্ট্র কি আরেকটা রাষ্ট্রের সাথে স্বার্থহীন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে? আর ভারতের মত ক্ষমতাশীল প্রো-অ্যামেরিকান রাষ্ট্র স্বার্থহীন বাহবা দেবে এ কথা স্বপ্নে ভাবাও বোকামি। স্বার্থ শব্দটা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করছি না, যে যার রাষ্ট্রের স্বার্থ বুঝে ব্যবস্থা নেবে সেটাই স্বাভাবিক। শাহবাগ কি ভারতের স্বার্থ বুঝে? আর নিজেদের স্বার্থও কি তারা ন্যায়ের পথে থেকে কায়েম করার শর্তে আপোষহীন? নাকি আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র চালাবার কথা ভাবছেন আমাদের শাহবাগের তরুণরা? বিএসএফ প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশী মেরেছে সীমান্তে, তিস্তার পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, করিডোর ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে হতেই পারে সেসব ধামাচাপা দেয়ার ধারাবাহিকতায় শাহবাগের বীজ ও বিস্তার। এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ নানান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের নিমিত্ত, বাংলাদেশের সরকার হিসাবে আওয়ামীলীগকে দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শাহবাগকে সমর্থন দেবার কারণ। অস্বীকার করার উপায় নেই।

তো শাহবাগ কি অস্বীকার করতে পারবে যে তারা আগামী নির্বাচনের উপর প্রভাব ফেলছেন না? সেই প্রভাবটা কেমন তা আমরা বিরোধী দলগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। সরকার নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বলা যায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করছেন শাহবাগকে। ব্লগার ইমরান এইচ সরকারকে আমরা শাহবাগের মুখপাত্র হিসাবে দেখছি, তিনিই কি বিতর্কের ঊর্ধ্বে? তার আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন ব্লগে আর সংবাদ মাধ্যমে খবর এল তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের একজন সদস্য। তার ফেসবুকের তথ্যতে আছে তিনি ২০০২ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেছিলেন। তিনি একজন ছাত্রলীগ নেতা। অথচ তিনি নিজেকে একজন ব্লগার হিসাবে পরিচয় দেন। তিনি ছাত্রলীগ করেন এ তথ্য স্রেফ চেপে গেছেন। এ প্রসঙ্গে শাহবাগের চেতনা কি বলে? গত চার বছরে ছাত্রলীগের তাণ্ডব কি আমরা দেখি নাই? সর্বশেষ তারা নিরীহ এক পথচারী বিশ্বজিৎকে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করল। এখনও সেই রক্তের দাগ মুছে নি ছাত্রলীগের হাত থেকে। সেই ছাত্রলীগের নেতা আজ শাহবাগের মুখপাত্র! আর শাহবাগ দাবি করে এ আন্দোলন নিরপেক্ষ! এছাড়াও ইমরান ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি নামক এনজিও চালান, যার ফেসবুক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজার। ২০১১ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া এই এনজিওর নিজস্ব ব্লগই হল প্রজন্ম ব্লগ। শাহবাগও তাদের ফর্মুলাতে ‘প্রজন্ম চত্বর’ হয়েছে। যে সকল বামপন্থী দলগুলো জীবনভর ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ‘পশ্চিমা’ ‘দুঃশাসন’ ইত্যাদি শব্দগুলো মাঠে-ময়দানে উচ্চারণ করে জনগণকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তারা কি ইমরান এইচ সরকারকে শাহবাগের মুখপাত্র বানানোর আগে তার এনজিও সক্রিয়তা এবং আওয়ামী ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেছেন? যদি জেনে বুঝে বিপ্লবী রাজনীতির ধারক-বাহকরা ইমরানকে নেতা হিসাবে মেনে নিয়ে থাকেন, তবে আপনাদের প্রতি অনুরোধ ‘বিপ্লব’ শব্দটা নিয়ে আর নাটক করবেন না। আপনাদের ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসি দিয়ে আমাদের আর ফ্যান্টাসাইজড করবেন না। আপনাদের চিন্তার মিসকিনি হালত্‌ আর অদূরদর্শিতা আজ উন্মোচিত। নতুবা আপনারা ইমরানের মতই অসৎ, সত্য গোপন করছেন।

বিপ্লবীদের কাছে শাহবাগের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন যেকোন কারণেই হোক মোকাবেলা করা প্রয়োজনীয় না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এর নিরপেক্ষতার প্রশ্ন অনেক বড় আকারে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে খাবারের বিষয়টি শ্রমজীবী মানুষের কাছে বিস্ময়কর ছিল। যে জন্য ইমরানকে সংবাদ সম্মেলনে উত্তর দিতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, গণচাঁদা তুলে খাবারের ব্যবস্থা হয়। এই চাঁদার ‘গণ’ কারা? উপস্থিত সবারই যদি খেতে হয় আর সবাই যদি টাকা দিয়ে থাকেন তাহলে তো বলা যায় সবাই নিজের পকেটের টাকা দিয়ে খেয়েছেন। তাহলে আর চাঁদার কথা কেন? অনেকে এমনও ভাবছেন খাবার-পানি সরকার জোগান দিচ্ছেন। কিন্তু ইমরান সরকারের সহায়তার কথা স্বীকার করছেন না। কিছুদিন আগে সুপার ব্লগার মাহবুব রশিদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখলেন ‘যারা আমাদের সকাল-দুপুর-রাত্রিতে খাওয়া দিয়েছেন, তাদের জানাচ্ছি। আমাদের আর খাওয়া চাই না।
আপনারা আমাদের কিছু ছাতা দিয়ে যান। কিছু পলিথিন দিয়ে যান। যার নিচে থাকা যায়। সাধ্য থাকলে কিছু তাঁবুও দিতে পারেন।’

তার মানে মাহবুব একজন সুপার ব্লগার হয়েও জানতেন না যে গণচাঁদা তোলা হয়, জানলে নিশ্চয়ই তিনি মাথা বাঁচাতে ফেসবুকে ছাতা চাইতেন না। একদিন সকালে সময় টিভির প্রতিবেদককে দেখলাম। তিনি বলছেন যে, ‘এখানে সকালে কে বা কারা যেন খাবার পাঠিয়েছেন, জানা যায় নি কারা পাঠিয়েছেন, তবে সেজন্য তাদের ধন্যবাদ যে, তিনি শাহবাগের তরুণদের সাহায্য করছেন।’ গণমঞ্চ থেকে সংবাদ প্রতিবেদক খাবার প্রেরণকারীদের ধন্যবাদ জানালেন, আবার অন্যদিকে বহুল আলোচিত দৈনিক আমার দেশ প্রকাশ করেছে খাবার বিতরণকারী হিসাবে যুবলীগের কর্মীর ছবি। ইমরান এইচ সরকারের গণচাঁদা তুলে খাবারের ব্যবস্থা হয়- দাবি কতখানি যৌক্তিক সেটা অনেক বড় একটা প্রশ্ন, কারণ ইমরানের মিথ্যা বলা মানে ‘শাহবাগের চেতনা’ ব্যর্থ হয়ে যাওয়া।

মিথ্যা শুধু এই ব্যাপারে নয়। নিহত ব্লগার রাজীবের ব্লগগুলো নিয়েও তিনি মিথ্যাচার করছেন। ব্লগগুলো রাজীবের নয় বলে তিনি ঘোষণা দিলেন অথচ এইসব অপাঠ্য কুরুচিপূর্ণ লেখাগুলো এখনও ফেসবুকে এবং নানান বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্লগ গুগলের cache কপিতে দেখা যাচ্ছে। ইমরান মিথ্যাচারের চূড়ান্ত করলেন যখন বললেন তাদের সাথে নাস্তিক কেউ নাই! নিহত ব্লগার রাজীবই কি একমাত্র ধর্মবিদ্বেষী ব্লগার ছিলেন? আমরা যারা প্রতিদিন অনলাইনে বসি তারা খুব ভাল করেই জানি কারা ধর্মবিদ্বেষী উস্কানিমূলক ব্লগিং করেন। এখন প্রশ্ন হল, ডা. ইমরান এইচ সরকারের এই মিথ্যাচারগুলোর কেন দরকার পড়ল? কারণ যে দুই ভাগে শাহবাগ দেশকে বিভক্ত করেছে এই মিথ্যাচারগুলো না করলে শাহবাগ তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারত না। জেনে রাখা ভাল মিথ্যাচার দিয়ে, ষড়যন্ত্র দিয়ে কেউ কখনও বিপ্লব ঘটাতে পারে নাই, আর পারবেও না। 

পিলখানা হত্যাকাণ্ড, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, রেল বাণিজ্য, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, সীমান্তে হত্যা, গার্মেন্টস ফায়ার— এমন কত ইস্যু যে শাহবাগের গণজোয়ারে ভেসে গেল তা কি শাহবাগ ভেবে দেখেছে? শাহবাগ এই সকল বিষয়ে চুপ কেন? পিলখানা হত্যার মত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আর এদেশে ঘটেনি, সেই হত্যাকাণ্ডের চার বছর পূর্তির দিন শাহবাগ কেন পারল না পিলখানায় শহীদ সেনা অফিসারদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে? কেন জানানো হল না তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা? যে মেয়েটির মেহেদির রঙ রক্তে ধুয়ে গেছে তার কাছে কি শাহবাগ আর কি বিচার! সে এখনও জানে না তাঁর স্বামীকে কেন মরতে হল। মা জানে না কেন সে ছেলে হারা হল। সন্তান জানে না কেন সে এতিম হল। এই প্রশ্নগুলো কি একবারও শাহবাগের মনে আসে নি? কেন তারা চুপ ছিল? এই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? শাহবাগ পারল না ইনসাফের জন্য লড়াই করতে, কারণ ইনসাফের লড়াই জালিমের কাছে বিচার বা ফাঁসি চেয়ে প্রতিষ্ঠা হয় না। হয় জালিমকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে। সেই আত্মসচেনতা আর সাহস কি শাহবাগের আছে?

আমি বলি না যে শাহবাগে যারা যাচ্ছেন তারা সবাই চিন্তা করতে সক্ষম। স্কুল ড্রেস পড়া বাচ্চা থেকে ইউনিভার্সিটি শিক্ষক, দুধপিতা বাচ্চা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ সব ধরনের মানুষই শাহবাগ গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এমনই গর্বের ইতিহাস যে এর নাম নিয়ে যাই করা হোক সবই সহি হয়ে যায়। দেশপ্রেমকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, আর করা উচিতও না। যার দেশপ্রেম নাই সে কিসের মানুষ! যে সাধারণ মানুষগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেখানে গেছেন তাদের প্রতি আমার কোন প্রশ্ন নেই কিন্তু যারা এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাজারজাত করছেন আমার প্রশ্ন তাদের কাছে। এই বাজারজাতের ফলাফল জেনেই তারা বাজারে নেমেছেন। বিপ্লবী রাজনীতির নামধারী কেউ যদি না জেনে নেমে থাকেন তাহলে সে আবর্জনা বৈ কিছু না। চিন্তা করতে অক্ষম এইসব নীতি নির্ধারকগণ সমাজে সংঘাত সৃষ্টির জন্য দায়ী থাকবেন। গত নির্বাচনের পরিস্থিতির কথা আমরা ভুলে যাই নি। ওয়ান ইলিভেন এখনও আমাদের আলোচনার বিষয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে আর চলবে এইটুকু সাধারণ বুদ্ধিতেই বলা যায়। কারণ আমরা ওয়ান ইলিভেনকে যদি মুছেও দেই তবু সেখানে শূন্যস্থান নামক একটা বস্তু থাকবে, যা আমলে নিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। কেননা শূন্যস্থান মানেই এখানে কিছু ছিল, অথবা এখানে কিছু থাকবে।

একটা দিনের ভেতরে এত এত মৃত্যু শাহবাগের আনন্দ ছেদ করতে পারে নি। এমনকি তারা সাধারণ দুঃখ প্রকাশটুকু করেন নি। কেন? যারা মরেছে ধরেই নিলাম সবাই জামায়াত-শিবিরই ছিল, তাই বলে কি সে আমাদের অংশ না? এই যে একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হল, এবং এখনও হচ্ছে সে তো আমাদের বাংলাদেশেই হচ্ছে, তাহলে শাহবাগ এ কোন ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাসী যে তারা এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না? মিডিয়া পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে খবর প্রচার করছে। ভুলে যাচ্ছে যত ঘৃণিত অপরাধীই হোক না কেন, তারা বাংলাদেশী। তারা বাংলাদেশেই রাজনীতি করেন। তাদেরও বিচার পাবার অধিকার আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা শাহবাগে এক হয়েছেন তারা রাষ্ট্রের এই বিচার বহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কিছুই বলবেন না এ বড় লজ্জার! যে ঘৃণার রাজনীতিতে তারা বিশ্বাসী তার ফলাফল সাধারণ মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। সেই ভয়াবহতার দায় অবশ্যই মিডিয়া, শাহবাগ আর বামপন্থীদের নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না সরকারকে তো দায় নিতে হবেই।

২৮/০২/২০১৩

রওশন আরা মুক্তা
লেখক, কবি, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।