পুলিশ যে ভাবে গুলি করে মানুষ মারছে তা নজিরবিহীন সন্দেহ নাই। কিন্তু এটা যে প্রথমবারের মত ঘটছে এমনটি নয়। বাংলাদেশ ডাকনামের যে ভু-অংশটিতে আমরা এতদিন আছি তার জন্মের সমান বয়স বর্তমানের গণহত্যার। আমরা দল বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা, ক্রসফায়ার, গুম পার হয়ে গণহত্যায় পৌঁছেছি। বলাই বাহুল্য, এই সময়ের বিবেচনায় এর সাথে আরও নানা বা ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে চলতি গণহত্যা আমাদের যে বিনাশের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। আমরা যদি মনে করি হঠাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তালগোল পাকিয়ে গেছে আর দেশে গণহত্যা শুরু হয়েছে তাহলে বিপদের পালে হাওয়াই দেয়া হবে। নিষ্ঠার সাথে এই গণহত্যার পূর্বাপর খতিয়ে দেখতে হবে । কিন্তু এই দেখবার পথে একটা বড় মুশকিল হল মিডিয়ার সন্ত্রাসবাদী আচরণ। মিডিয়া বরং এই গণহত্যার রেটরিককে আরও উস্কে দিচ্ছে বললে ঠিক বলা হবে না। বলা ঠিক হবে, মদদ দিচ্ছে।

প্রথমত পরিকল্পিত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ঘৃণার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে এই গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। ফলে এই ভাষাতীত বিনাশের সামনে দাঁড়িয়েও নাগরিক হিসেবে আমরা ব্যক্তি ‘আমি’ কে নিয়ে মশগুল থাকতে পারছি। আমরা ভোঁতা হয়ে গেছি। আমরা ক্ষয়ে গেছি। নির্মূল করার সংস্কৃতি আমাদের স্বভাবের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে গেছে। আমরা কিছু শুনি না। কিছু দেখি না। মিডিয়াতে আমরা খবর পাই, জামাত শিবিরের সহিংসতায় নিহত। কিন্তু কে কার বিরুদ্ধে কি কারনে কিভাবে সহিংস হোল, কিম্বা কে কিভাবে নিহত হোল সেই আসল খবর থাকে উহ্য। ধরে নিতে হবে তারা বুঝি সহিংসতা করতেই যায়, যায় নিহত করতে কিম্বা নিহত হতে। আমরা একবারও প্রশ্ন করি না সংবাদ ভাষ্যে যা শুনছি বা শহরে বসে যে অবস্থাটা পরখ করছি তা কি আমাদের দেখবার চোখকেও নষ্ট করে দিচ্ছে না? টেলিভিশন ফুটেজে দৃশ্য দেখি, তার সাথে সংবাদ ভাষ্যের গরমিলটাও আমরা খেয়াল করি না। মানিকগঞ্জে বা বগুড়ায় যারা হাজার হাজার ইঁট এনে রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে, যারা অসংখ্য গাছের গুড়ি ফেলে মাইলের পর মাইল রাস্তা বন্ধ করে ফেলেছে তারা সবাই জামাত-শিবির। বাংলাদেশে শিবির কি এত শক্তিশালী? যে নারীরা রাস্তায় নেমে এসেছে তারা সব শিবির? ক্লাস ফাইভের যে শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেও তহলে মায়ের গর্ভ থেকেই শিবির? গ্রামের ঘরে ঘরে যে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠেছে এরা মানবতাবিরোধী? এই সব প্রশ্ন একবারও আমাদের মনে জাগে নি। ফলে বাংলাদেশে জামাত-শিবির আসলে কী? তার চরিত্রটা কেমন এই প্রশ্নটা তুলতেই আমরা ভুলে গেছি। ওথচ এই প্রশ্ন না তুললে আমরা আসলে কী ঘটছে তা কখনই বুঝবোনা। মিডিয়া আমাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জামাত জুজুর ভয় দেখিয়ে আমাদের বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে, ধর্মপ্রাণ মানুষের ক্ষোভ কে জামাতের নাশকতা আকারে হাজির করে চলেছে ক্রমাগত। জামাতের আন্দোলনের সাথে বর্তমানের গণহত্যার যদি কোন সম্পর্ক থাকে তাহলে সেটা কী? বা আদৌ আছে কীনা তা আমরা একবারও খতিয়ে দেখছি না। যথা সময়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তালাশ করব।


পরিকল্পিত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ঘৃণার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে এই গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। ফলে এই ভাষাতীত বিনাশের সামনে দাঁড়িয়েও নাগরিক হিসেবে আমরা ব্যক্তি ‘আমি’ কে নিয়ে মশগুল থাকতে পারছি। আমরা ভোঁতা হয়ে গেছি। আমরা ক্ষয়ে গেছি। নির্মূল করার সংস্কৃতি আমাদের স্বভাবের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে গেছে। আমরা কিছু শুনি না। কিছু দেখি না। মিডিয়াতে আমরা খবর পাই, জামাত শিবিরের সহিংসতায় নিহত। কিন্তু কে কার বিরুদ্ধে কি কারনে কিভাবে সহিংস হোল, কিম্বা কে কিভাবে নিহত হোল সেই আসল খবর থাকে উহ্য। ধরে নিতে হবে তারা বুঝি সহিংসতা করতেই যায়, যায় নিহত করতে কিম্বা নিহত হতে।


সব প্রশ্ন বাদ রেখে আপাতত যদি শুধু বলি, বিএনপি কি জঙ্গি, মৌলবাদি দল? যদি তা না হয় কেন বিএনপির মিছিলে গুলি করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা তালাশ করি তাইলে গণহত্যার চলতি রেটরিককে দ্রুতই ধরে ফেলতে পারব। এত দিন তথাকথিত গণজাগরণ নিয়ে বিএনপির যে অবস্থান ছিল হঠাৎ করে কেন সে লাইন পাল্টাল? আপনাদের নিশ্চই মনে আছে চলতি বছরেই ভারত সফর থেকে এসেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেছিলেন, ‘কোন ভারত বিরোধী অবস্থান নয়।’ তিনি সেকুলার লাইন ধরে রাজনীতি করবেন এই দাসখত তিনি দিয়ে এসেছিলেন। ভারতের নীতিনির্ধারকরা কূটনৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করে শাহবাগকে সমর্থন দিয়েছে, যার প্রেক্ষিতে শাহবাগ আন্দোলন ‘র’-এর প্রজেক্ট বলে যে গুজব রটেছিল তাকে গুজব বল্কে এড়িয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। শাহবাগ ‘র’-এর প্রজেক্টে পরিণত হওয়ার পরেও বিএনপি টুঁ শব্দটি করে নি। হঠাৎ জলে না নেমে মাছ শিকারের স্বপ্ন ধসে যাওয়াতে এজেন্সি পাল্টে হরতাল দিয়ে দিল বিএনপি। তারপরেও দলটি ধরি মাছ-না ছুঁই পানি রাজনীতি ত্যাগ করেনি।

এখন কথা হল, বিএনপি, লীগ বা জামাত যে রাজনীতি করে তাতে একে অপরকে গুলি করে মারার অবস্থা কি আদর্শিক ভাবে আছে ? না নাই। সবাই পুঁজির ফাটকা দাপটের মধ্যেই বিচরণ করে। কেউ পিতার নামে, কেউ স্বামীর নামে, কেউ ইসলামের নামে। এছাড়া তাদের যে লাইন তা কোনোভাবে গণতান্ত্রিক তো নয়ই বরং কতিপয় এজেন্সির লাইন এরা সবাই মেনন্টেইন করে। তো এই অবস্থার মধ্যে এই ধরণের নির্বিচার হত্যা শুধু তাদের ইন্টার্নাল রাজনীতির কারণেই করবেন তা যৌক্তিক ঠেকে না।

দুই.আওয়ামী লীগ নিজে এত শক্তিশালী মোটেই না যে সে এ ধরণের গণহত্যা করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে। ফলে এই গণহত্যার রাজনীতির মূল শাঁসটা খুজতে হবে। এর ধারাবাহিকতায় দেশি বা বিদেশি নানা পক্ষের যে ইন্টারেস্ট আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে উঠছে তার ব্যাপারে সজাগ না হলে আমাদের সামনে যে ভয়বাহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তা এড়াতে পারব না। এই গণহত্যার হুজুগের পিছনে ইসলাম কে অপজিশনে রাখা হয়েছে, যা শুধু মাত্র আওয়ামী এজেন্ডা নয় কোনো ভাবেই। মনে রাখতে হবে সংবিধান সংশোধনের নামে আওয়ামী লীগ দেশে যখন জুডিশিয়াল কিলিং এর ব্যবস্থা পোক্ত করছিল তখন সরিক সরকারী-বামদের লাগাতর আপত্তি সত্ত্বেও আওয়ামিরা রাষ্ট্রধর্মের বিধানের ব্যাপারে কোন পজিশন নিতে পারে নি। ফলে সে ইসলামের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে বলে জামাতি যে হুজুগ তারও কোন ভিত্তি নাই। এই হাসিনা কে তো আপনারা হজ্বের পট্টি মাথায় দেখেছেন। অন্যদিকে তার প্রতিশ্রুত সেকুলার লাইন তাকে বে-খেয়ালে নাস্তিক্য ধারার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যার ফলে ইসলামের বিরুদ্বে জেহাদি হিসেবে হাসিনা কে ঠেলে দিয়ে আরেক ধরণের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ এখন আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় হিন্দু বাড়িতে আগুন দেবার রাজনীতিও যুক্ত হয়েছে। এর সাথে ভারতের নেকনজর পারার বিষয়টা তো আছেই। ভারত ব্যাকড হাসিনা এত কিলিং করে অ্যামেরিকার পথ পরিস্কার করে যাচ্ছেন। অন্য দিকে ভারেতের আলাদা ইন্টারেস্ট আছে। দুই ইণ্টারেস্টের ঝগড়াও আছে। রাজনীতির বোঝাপড়া সরলরৈখিক নয়, তার নানান জটিলতা আছে।

তবে এই গণহত্যার রাজনীতির দুইটা দিক আমাদের সামনে এখন স্পষ্ট ধরা পড়ে যাচ্ছে। এক. হাসিনার জামাত নির্মূল অভিযান। যা ইতিমধ্যে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রিহার্সালের মাধ্যমে এখানকার শহুরে-মধ্যবিত্ত এবং গণবিরোধী বুদ্ধিজীবীর সমর্থন শেখ হাসিনা আদায় করে নিয়েছেন। ফলে এই গণহত্যা রাজাকার চেতনা নিধনের নামে চলছেই। দুই. বাংলাদেশ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরাসরি মার্কিনদের ইসলামের বিরুদ্ধে জারি থাকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করল। এই কথাটা আমি মোটেও কল্পনা প্রসূত ভাবে বলছি না। আপনারা যদি বেশি না, আনন্দ বাজার আর সিএনএন বা অন্য যে কোন পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের খবর প্রকাশের ধরণটা খেয়াল করেন খুব সহজেই ধরতে পারবেন। আনন্দ বাজার শাহবাগের আনন্দে শুরু থেকে মাতোয়ারা। অন্যদিকে পশ্চিমা মিডিয়া ছিল ক্রিটিক্যাল। যেই মুসল্লিরা মহানবী (স:) কে নিয়ে পর্ণগ্রাফী লিখিয়ে আন্দোলনকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামল পশ্চিমা মিডিয়া তাদের পয়েন্ট পেয়ে গেল। যেন এই অবস্থার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল তারা। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদওয়ালারা বললেন, বিচার বানচালের জন্য জামাত অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সন্দেহ নাই এর সাথে জামাতি রাজনীতি মিশে ছিল। কিন্তু কোন মুসল্লি বিচারের বিরোধীতা করেছে এমন খবর এসব ভাড়া খাটা মিডিয়াতেও দেখা যায় নি। অথচ এটাকেও বিচারের রাজনীতির মধ্যে চালান করে দেয়া হল। আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও চেতনার জোয়ারে ভেসে মধ্যবিত্তদের কাছে গণহত্যার যৌক্তিকতা তুলে ধরলেন। কথায় কথায়, তিরিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ ইজ্জত হারানোর রেটরিক তুলে গণহত্যার জন্য মৌন সম্মতি তৈয়ার করার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। তত দিনে ইস্যু যে ঘুরে গেছে সেই খেয়াল এই দুদে পন্ডিতদের রইলনা। 


গণহত্যার রাজনীতির দুইটা দিক আমাদের সামনে এখন স্পষ্ট ধরা পড়ে যাচ্ছে। এক. হাসিনার জামাত নির্মূল অভিযান। যা ইতিমধ্যে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রিহার্সালের মাধ্যমে এখানকার শহুরে-মধ্যবিত্ত এবং গণবিরোধী বুদ্ধিজীবীর সমর্থন শেখ হাসিনা আদায় করে নিয়েছেন। ফলে এই গণহত্যা রাজাকার চেতনা নিধনের নামে চলছেই। দুই. বাংলাদেশ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরাসরি মার্কিনদের ইসলামের বিরুদ্ধে জারি থাকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করল।


বিবিসি সাঈদীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলছে ‘ইসলামী’ নেতা। সিএনএন বলছে ‘ইসলামি’ পন্ডিত। বাংলাদেশে নির্মূলের রাজনীতির ধারক বুদ্ধিজীবীরা এখনও রাজাকার, রাজাকার করে যাচ্ছে। মার্কিনী এজেন্সির কাছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি খুবই অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। বা বরাবরই এদের কে সে খরচের খাতায় রেখেছে। তাই এদের বাইরেও সে জামাতকে বগলে রেখেছিল। এরা তো আর বাংলাদেশকে জঙ্গি প্রমান করতে পারল না। এত আওয়ামী, বাম, সেকুলার, এত এত মাস্টার,পন্ডিত সারা দিন দেশে জঙ্গিবাদের জিকির জারি রাখার পরেও বাংলাদেশ যেহেতু যথেষ্ট জঙ্গি প্রমাণিত হচ্ছে না, তো এই সমস্যার সমাধানের জন্য এই সুযোগে জামাতের মত ভোগবাদি, ইসলামি চেতনার সম্পূর্ণ উল্টা দিকের দলটিকেই ইসলামি করে তোলা হল। তার সাথে যেহেতু সে নিজ দলের স্বার্থ এবং আগামী দিনে ক্ষমতায় আসার জন্য একটা লড়াই শুরু করেছে। তারপর দেখা যাচ্ছে এর সাথে ধর্ম চেতনার টানে প্রচুর সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে, ফলে এটাই সুযোগ। শুরু হল গণহত্যা- জঙ্গি পরিস্থিতি তৈরির নিয়তে। বিশ্ব রাজনীতির এই গ্র্যান্ড ডিজাইনের ভিতরে আমরা ঢুকে বসে আছি। অথচ আমাদের কোন হুঁশ নাই। আপনারা হয়ত ইতিমধ্যে জানেন আল-জাজিরা তার নিউজ টিম বাংলাদেশে পাঠানোর আয়োজন করছে। এতে কিছু জামাতি ভাবছে এবার নাকি তারা সত্যি খবর পাবেন! তারা মনে করছেন জামাতের সব খবর যেহেতু এখানকার মিডিয়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছে আল-জাজিরা বুঝি তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিন হিসেবে কাজ করবে। যারা বিশ্ব রাজনীতির খোঁজজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই আল-জাজিরার অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে অবগত হয়ে থাকবেন ইতিমধ্যে। যে পুলিশ রিকশার টায়ার ফাটার শব্দ শুনে কোনো সমাবেশ ছাড়াই গুলি ছুড়ে ঘরের মধ্যে থাকা বাচ্চা কে গুলি করে (ঢাকার কমলাপুর ৪-৩-২০১৩ তারিখে), এক্ই দিনে কড়া পাহাড়ার মধ্যে কমলাপুরে ট্রেনে আগুন জ্বলে, আর সাথে সাথে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ হয় জামাতের নাশকতা বলে -- তো সেই পুলিশ জামাত নির্মূল অভিযানের এসাইনমেন্টে আছে এটা কোনো কানাও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটা আমাদের প্রগতীশীল বন্ধুরা অবশ্য এখনও বিশ্বাস করে বসে আছেন। এবং এই বিশ্বাসের বিষ ছড়াচ্ছেন। তারা একবারও সাধারণ মানুষের কথা, শহরের আল্ট্রা-আধুনিকতার বাইরের জনমানুষের কথা শুনছেন না। মানুষ কিন্তু ঠিকই বুঝে গেছে। কিন্তু তার বুঝটা আবার পরিচালিত হচ্ছে আরও সর্বনাশা পথে। এক ষাট বছর বয়সি নারী বলছিলে, ‘পুলিশ যাদের গুলি করছে সেখানে আমি তো জামাত দেখি না। গ্রামের ঘরে ঘরে জামাতের এমন ঘাঁটি থাকলে তো তারা বিচার ঠেকাতে পারত। আমরা শেরেকির মধ্যে আছি..ওরা মোমবাতি ধরাইয়া শেরেক করেছে। এখন মুসলমানদের ঈমানি লড়ায়ে ফেলে দিয়েছে।’ যে নারী এসব কথা বলছিলেন সে যে খুব ইসলামি আইন-কানুন মানেন তা কিন্তু না। সে জামাতকে পছন্দ করে এমনও না। সে যে খুব রাজনীতি সচেতন তাও না। তাইলে তার এই মুসলমানি চেতনার মানে কি? কোথা থেকে আসল এই বোধ? আপনারা কি বুঝতে পারছেন আমরা একটা ধর্ম যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছি। যে যুদ্ধে পাশ্চাত্য আমাদের ঠেলে দিতে চায়। অন্যদিকে জামাত নিজেই বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছে.. আমরা যারা জনগণের তরফে রাজনীতিটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি আমাদের জোর করে জামাতি বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা হল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আরেকটি জঘন্য সন্ত্রাসবাদী দিক। এবার কেন বাংলাদেশের এই হাল বা কোন রাজনীতির পথ ধরে আমরা এই বিনাশী পথে এলাম তার অন্ধকার গলিতে টর্চ ধরব।

পর্যালোচনা ‘শাহবাগ’ :

প্রথমত শাহবাগ কে নিয়ে যে সেন্টিমেন্টাল অবস্থা তৈয়ার হয়েছে তাকে আফিমের আছড়ের সাথে তুলনা করা যাবে। কিন্তু সেটাও কাজের কথা হবে না। এই আন্দোলন আর তার বিপরীতে গড়ে ওঠা সাধারণ মুসল্লিদের আন্দোলনকে সাংবাদিকতার ভাষায় একই মুদ্রার দুইটা পিঠ মাত্র বলা যাবে না। সাফ করে বলি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আওয়ামী এজেন্টের বাইরেও সাধারণ মানুষের কলিজার টান আছে। যেমনটা একাত্তর সালেও ছিল। যারা আজ শাহবাগের কথা বলে বুদ্ধিজীবী সাজছে তারা প্রত্যেকে সন্ত্রাসী। কথাটা পরিস্কার করে বলি, আমি দ্বীতিয় মুক্তি যুদ্ধ চাই, কিন্তু আপনারা এটাকে হত্যার রাজনীতির দিকে নিয়ে গেছেন। আমরা বলেছি শাহবাগ ৭১ এর শিক্ষার বিপরীতে দাড়িয়েছে। কারণ ৭১ এ আমরা মুক্তিযুদ্ধ ডিক্লেয়ার করার আগে বিদ্যমান জুলুমবাদী পাকিস্তান রাস্ট্র ও আইনকে অন্যায্য সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে এসে আমরা কী করলাম? সাংবিধানিক ভাবে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক- ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ালাম। বিচারের কথা ভুলে... ইনসাফের কথা ভুলে, চাইলাম ফাঁসি! তার পরিণতিতে দেশ আজ জ্বলছে। পন্ডিতির নামে কিছু লোক বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস করে যাচ্ছেন। আওয়ামীলীগের কোলে বসে এক এক জন নির্লজ্জের মত মার্কস- এর শিষ্য দাবি করছেন। রাজনৈতিক দিশা শূন্য শাহবাগকে মনে করেছেন বিপ্লবের কেবলা। একবারও ভাবলেন না ৭১ সাল বলে যা ঐতিহাসিক ভাবে মিন করে তার অনুকূলে আমরা একটা রাষ্ট্র পয়দা করতে পারি নি। স্বাধীনতার সরল অর্থ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নৌকায় চড়ে আমরা জিন্নাহ এভিনিউ থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ এসে পৌঁছেছি। তৈরি করতে পারি নি কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত। এমন একটা অবস্থার মধ্যে বিচারের (এখন অবশ্য ফাঁসির) রাজনীতি শুরু হয়েছে এতদিন পরে। যেহেতু বাংলাদেশ কে একটা রাষ্ট্র আকারে গড়ে তুলবার জরুরী কাজটা রাজনৈতিক ভাবে আমরা করি নি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বেহুঁশ হয়ে আছি ফলে এর মধ্যে পয়দা হয়েছে কালচারল ফ্যাসিজম। এই ফ্যাসিজমটা অতি অদ্ভুত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাঁড়ায় নাই কিন্তু তার জন্য চেষ্টা নাই। একাত্তরের মহান সংবিধানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে তার চরিত্র বিশ্লেষণের কোন খবর নাই, সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মধ্য দিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চালাবার আইনী যন্ত্রপাতি পোক্ত করা হয়েছে, কিন্তু কালচারাল ফ্যাসিস্টদের কোন খবর নাই। তার এখনও বাঙালি জাতীয়তাবাদ রক্ষা করা জন্য এই রাষ্ট্রকে খুনের লাইসেন্স দিয়ে দিতে চাইছে। এখানকার রুলিং গংরা এক ধরণের এজেন্টশিপ করে, ফলে সে সাংস্কৃতিক ভাবে এমন এক সেকুলার সংস্কৃতির দাসত্ব করে যা দিল্লির অধীনস্ত। এর নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এগুলো বেশ চালু কথা। তো যে জায়গায় ৭১ জনগণের জনগণের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জনগণেরই হতে পারত সেটা রেটরিক্সের তোড়ে হারিয়ে গেল তোড়ে হারিয়ে গেল। পয়দা হল কালচারাল ফ্যাসিজম। এই কালচারাল ফ্যাসিজম আক্রান্ত হল ইসলামোফোবিয়ায়। ফলে রাজনীতিটা দাঁড়াল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম ইসলাম। এটা এখন তুঙ্গে।


আমরা একটা ধর্ম যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছি। যে যুদ্ধে পাশ্চাত্য আমাদের ঠেলে দিতে চায়। অন্যদিকে জামাত নিজেই বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছে.. আমরা যারা জনগণের তরফে রাজনীতিটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি আমাদের জোর করে জামাতি বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা হল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আরেকটি জঘন্য সন্ত্রাসবাদী দিক।


কিন্তু যারা বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস করতেছে তারা এটাকে একাট্টা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম জামাত এর লড়াই আকারে হাজির করতেছে। এখন ঘটনা টা কি ঘটছে আসলে? শাহবাগের আন্দোলন যেমন শুরু হবার পর থেকেই আওয়ামী নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তেমনি তার বিপরতে নাস্তিক বিরোধী ও ইসলাম অবমাননার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন জামাতের নিয়ন্ত্রণে না গেলেও এর রাজনৈতিক ফায়দা পুরাটা পাচ্ছে জামাত— আপাত ভাবে। ফলে দুই তরফই একই বে-কায়দায় পড়েছে। শাহবাগের আন্দোলনের যে পলিটিক্যাল মেরিট তা যেমন আওয়ামী খাঁচার মধ্যে আটকা পড়েছে। অন্য দিকে ইসলামের যে র‍্যাডিক্যাল উত্থান হবার আলামত তা জামাতের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। ফলে দুই তরফের র‍্যাডিক্যল টেনশন একই রকম। বলাই বাহুল্য তাদের এসেন্সের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। এখন ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিরা এই দুই র‍্যাডিক্যাল পসিবিলিটির মেরিট যাচাই না করে রিঅ্যাকশনারি পজিশন নিছে। যারা ভিন্ন ভাবে ভাবতে চাইছে তাদের বলছে রাজাকার। এখন আপনি যদি ইসলাম অপছন্দ করেন তাহলে কি সে গুটিয় যাবে? না তাকে পলিটিক্যালি আপনার ডিল করেই আগাতে হবে।

অন্যদিকে এজেন্টগুলা চায় না জামাত নিষিদ্ধ হোক। বিভিন্ন দেশের মনোভাব আপনারা জানেন। উপরের আলোচনা থেকেও তার কারন স্পষ্ট। ফলে আওয়ামী লীগ- বিএনপি-জামাত একই রাজনৈতিক লাইনে আছে। কাজেই- এর যে কোন একটার পক্ষ নিয়ে বা বিপক্ষ নিয়ে মাতামাতি করা বিপ্লবী রাজনীতির জন্য কাজের কাজ না। জামাতের বিরুদ্ধে বেহুদা রিঅ্যাকশন আওয়ামী লীগের রাজনীতির পথকে যেমন পরিষ্কার করে। অন্যদিকে জামাতের দিকে দরদী হলে বিএনপির পথ পরিষ্কার হবে। আওয়ামী লীগ করা আর বিএনপি করা আলাদা কিছু না চয়েজের ব্যাপার মাত্র- এটাও আপনারা জানেন এতদিনে । ফলে বিপ্লবী রাজনীতির নিরিখে শাহবাগ বিরোধীদের যারা জামাতি বলে প্রচার করছেন তারা চলমান সন্ত্রাসেরই শরিক। গণজাগরনের নামে জামাতের প্রতি আপনি ঘৃণা ছড়িয়ে কই যাচ্ছেন - এখনও হুশ হয় না? জবাই করার অঙ্গীকার জানালেন। কিন্তু যখন মুসল্লিরা নাস্তিক জবাইয়ের পাল্টা জিকির তুলল আপনি তো সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের কাছে ধরা খেয়ে গেলেন। আপনি না মার্কস এর শিষ্য? লজ্জা লাগে না মার্কস এর নাম নিতে এত গণবিরোধী অবস্থান নেয়ার পরেও? ইসলাম বা ধর্ম প্রশ্নকে আপনি যদি পলিটিক্যালি মোকাবেলা করতেন তাহলে জামাত আজ এই অবস্থায় আসত না। ফলে জামাতের লালন-পালনকারী বলা যায় সেকুলার প্রগতীশীলদের বা মার্কস এর ভাষায় ভালগার মেটেরিয়ালিস্টদের। অন্য দিকে র‍্যাডিক্যাল ইসলাম শুধু বাংলাদেশেই যে আলোচনার এজেন্ডায় এসেছে তা না। গ্লোবালি এটা এখন প্রধান ইস্যু। ফলে তাকে মোকাবেলা করা, তার সাধে শত্রুতা বা মিত্রতার প্রশ্নকে খতিয়ে দেখা যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির সাধারণ কাজের মধ্যেই পড়বার কথা। অনেকে প্রশ্ন করবেন বাংলাদেশ তো মডারেট মুসলিম দেশ। এখন আপনি ইসলামকে এই রকম জেহাদি কায়দায় কোথায় দেখলেন? উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে তাদের অন্ধ বলা যায়। তার পরেও আরও হাল্কা ভাবে তাদের জন্য মেলা উদাহরণে না গিয়ে বলব, ইসলাম জনগনের কাছে এখনও মেটার করে। ফলে এর পলিটিক্যাল- র‍্যাডিক্যাল পসিবলিটি খতিয়ে না দেখলে হবে না। আপনি যদি কমিউনাল না হন! আপনি যদি বিপ্লব চান তা লেলিন-মাও বা ইসলাম যে নামেই হোক— আপনার আপত্তি থাকার কিছু তো নাই। ফলে ইসলামের নামে যাদের এলারজি তারা নিচুমানের মৌলবাদি আচরণ করে। প্রগতীশীল মৌলবীদের বলি, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না।

শ্রেণী সংগ্রাম এসেছে জেহাদের কাফনে সেজে ও ‘তারুণ্য‘ ‘প্রজন্ম’ কথাটার চলতি অর্থ:

একট্টা ‘প্রজন্ম’ প্রেমের যে সাম্প্রদায়িক পাটাতন তা আর লুকানো গেল না। বিস্তারিত বলছি, প্রজন্ম নামে আমরা কাদেরকে দেখেছি, এরা জয়বাংলা ম্লোগান দেয়। আওয়ামী ক্যাডার ও পুলিশ পাহারায় বসে বিচার চাই না শুধু‘ ফাঁসি চাই’ ‘ফাঁসি চাই’ বলে উৎসব/ফেস্টিভাল করে -রাজনীতির নামে আপনারাও সেই আমোদে শরিক- শিক্ষিত সমাজ। রাজনীতির পাকা বুঝের কথা থাক। ‘তারুণ্য’, ‘প্রজন্ম’ নামি শাহবাগী ধারনার মধ্যেই এ দেশের গরিব, নির্যাতিত, অসহায় খেটে খাওয়া জনগণকে অস্বীকার করার তত্ত্ব নিহিত আছে এটা বুঝার জন্য কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। আমার এ কথাকে আবারও গোয়ার্তুমির জোরে ভুল বুঝবার সম্ভাবনা আছে। একটু ফিরিস্তি দরকার। এত দিন যারা শাহবাগ আন্দোলনের একটা ইউনিক জায়গার দোহাই দিয়েছেন আমরা তাদের বলি, প্রজন্মের যে পর্যালোচনা আমরা এত দিন করতে পারি নি তার একটা নোক্তা দিচ্ছি। যখনই আপনি , ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপনার ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তার ‘রাজনীতিকরণ’ করেন তাকে পলিটিসাইজ করেন, তখনই আপনি একটি সাম্প্রদায়িক কনডিশান তৈয়ার করেন। এবং এইখান থেকে পয়দা হয় গৃহযুদ্ধের লোকাল কন্ডিশন। আমাদের দেশে বাঙালি যেমন আছে, চাকমা, হিন্দু, মারমা যেমন আছে তেমনি আছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। একবার তো আপনি জুম্মু জাতির বিরুদ্ধে অন্যায় করে মার খেয়েছেন। এখনও সেই সংঙ্কট আপনি মোকাবেলা করতে পারেন নি। আপনি পরস্পরের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়াবার কোন আয়োজন জারি রাখেন নি। অন্যদেরকে আপনার ঐতিহ্য ডিক্লেয়ার করে হজম করে চলেছেন। তাদের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেবার কোন আন্তরিক চেষ্টা আপনার মধ্যে নাই। যদি থাকত তাইলে আপনার রাষ্ট্র নির্মানের বাসনার মধ্যে এতদিনে তা ধরা পড়ত। তা না করে আপনি যখন বাঙালি জাতিকে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তি ধরে রাষ্ট্র করতে যাবেন, আপনি আসলে অন্য সবার অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। আপনি এটা করলেন কোন অজুহাতে, আপনি বলবেন যে, ‘বাঙালিত্ব’ সংখ্যা গরিষ্ঠের আত্নপরিচয়। সেটা তো অবশ্যই। কিন্তু যার কছে তার বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে তার মুসলমান বা পাহাড়ী পরিচয় প্রধান তারে কি আপনে জঙ্গি রাজাকার, ইত্যাদি বলে পার পাবেন? বলাই বাহুল্য এই তর্ক’র সাথে বিচারের আলোচনার কোন বিরোধ নাই। বরং সম্পর্ক আছে। তো এখন তর্কটা কোন জায়গায় ঠেকেছে? সেকুলার বনাম ইসলাম।


ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপনার ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তার ‘রাজনীতিকরণ’ করেন তাকে পলিটিসাইজ করেন, তখনই আপনি একটি সাম্প্রদায়িক কনডিশান তৈয়ার করেন। এবং এইখান থেকে পয়দা হয় গৃহযুদ্ধের লোকাল কন্ডিশন। আমাদের দেশে বাঙালি যেমন আছে, চাকমা, হিন্দু, মারমা যেমন আছে তেমনি আছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। একবার তো আপনি জুম্মু জাতির বিরুদ্ধে অন্যায় করে মার খেয়েছেন। এখনও সেই সংঙ্কট আপনি মোকাবেলা করতে পারেন নি।


কেউ যদি সেকুলার হয় তার সাথে কি অন্য কোন ধর্ম বা চেতনা ( নাস্তিক্যবাদও একটা চেতনা) র বিরোধ থাকতে পারে? না পারে না। তার মানে আপনি যে সেকুলার আদর্শ প্রচার করেন তা রেটরিক মাত্র। আপনার চেতনা আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক, যে কারনে মুসলমান আপনার কছে জঙ্গি। এটা আসলে করছেন আপনারা সরকারের সাথে মিলে। ফলে এই কথার কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য কি আছে প্রোপাগান্ডা ছাড়া? আপনি তো তার অনুভূতিকে নোংরা ভাবে আহত করেছেন... সে কেন প্রতিবাদ করলে সেটা জঙ্গি হয়ে যায়? আপনি তাকে জঙ্গি বলে এখানে মার্কিন অনুপ্রবেশের পথকে পরিস্কার করছেন-প্রগতীশীলতার নামে। আর এর নাম দিচ্ছেন বিপ্লব? অন্য দিকে জামাতের যে বিপুল কর্মী পুলিশ গুলি করে মারল তাকে আপনি উস্কানির পরিনাম আকারে দেখছেন। আপনি নিজের বাঙালি চেতনাকে রাজনৈতিক ভাবে হাজির করেলে সেটা বৈধ। অন্যে করলে জঙ্গিপনা? সে কি এই জন্যেই জঙ্গি যে তার চেতনার নাম ইসলাম? আপনি প্রগতীশীল কারণ আপনার চেনতার নাম ‘বাঙালি’? ফলে এখন কন্ডিশনটা হল, একদিকে জাতিয়তাবাদীরা অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ। যারা অবশ্যই বাঙালি কিন্তু ধর্মও তাদের চেতনার অংশ। এটাই তাদের আত্নপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সে জামাত হোক আর কওমি হোক বা আলিয়া বা দেওবন্দি হোক। ফলে আপনে যেমন বাঙালিত্বকে ঝান্ডা বানিয়েছেন তার বিপরীতে তাকে বাধ্য করেছেন ইসলামের ঝান্ডা নিয়ে হাজির হতে। তখন তাদের গোড়া মৌলবাদি আখ্যা দিয়ে পাশ্চাত্য বিশ্বের সহযোগিতায় তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন। আজ আমরা সেই যুদ্ধের মধ্যে পতিত হয়েছি ৭১ এর চেতনার নামে, প্রজন্মের রাজনীতি-শূন্য ফ্যান্টাসির কারনে। রাজিব যখন মারা যায় আপনি তাকে শহীদ আখ্যায়িত করেন। নি:সন্দেহে রাজিব যে নোংরা পদ্ধতিতে ইসলামকে দেখেছেন তা যে কোনো মানুষ নিন্দা করবেন। অন্য দিকে তার হত্যার জন্য তার মায়ের যে বেদনা আর একজন ছেলে ইসলামী রাজনীতি করে বলে তার মৃত্যুতে তার মায়ের যে বেদনা তা কোনো ভাবেই প্রগতীচেতনার কারণে হেরফের হওয়ার কথা না। অথচ আপনে মিডিয়া প্রোপাগান্ডায় একজনকে বলেন শহীদ অন্য জন জঙ্গি। তাকে গুলি করে মারার মত পয়দা করেন বুদ্ধিজীবীতার নামে। তো আপনি তরুণ কারণ আপনি শাহবাগ যান কিন্তু পুলিশ যাকে গুলি করে মারল সে কে? সে তরুণ না? ফলে প্রজন্ম বা তারুণ্যের দোহাই দিয়ে আর লাশের সংখ্যা বাড়াবেন না। গণমাধ্যম আজ দেশ কে আপনাদের সহযোগিতায় দুই ভাগে ভাগ করেছে। এইসব প্রত্যেকটি গণমাধ্যমই এই হত্যার উস্কানি দাতা। সাংবাদিকতার নামে পলিটিক্যাল ক্যাডারের ভুমিকা পালন করছে। তাদের নিশ্চই জবাবদিহি করতে হবে।

অন্য দিকে বিচারের দাবি নিয়ে শুরু থেকে তরুণদের বড় একটি অংশ ক্ষুব্ধ। তাদের ক্ষুব্ধতাকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। কিন্তু তারা যে ভাবে এটা করে চলেছে আওয়ামী ছত্রছায়ায় তা আজ আমাদের ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে যারা এই আন্দোলনের উপযোগবাদী বামপন্থী ব্যাখ্যা দেন, যে এর একটা বিপ্লবী চেতনা ছিল সেটাকে কাজে লাগিয়ে জগৎ উদ্ধার করা যেত তাদের কে নিন্দা করার ভাষা আমার জানা আছে। আমি ভদ্রতার খাতিরে তা করছি না। ফলে জামাত তো রাজনৈতিক ভাবে তার নেতাদের জন্য আন্দোলন করতেছে। সেটা নতুন কিছু না। এর সাথে যে সকল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এখন মনে করছে তাকে ইসলাম রক্ষার জন্য মাঠে নামতে হবে তাকে এক করে দেখা যাবে না। আমরাও মনে করি সাধারণ মানুষের অনুভুতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে। জঘন্য অপরাধ করা হয়েছে। রাস্ট্র তার ধর্ম অধিকার ধসিয়ে দিয়েছে। আপনি হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির নামে যে ক্যালক্যাশিয়ান বয়ান সাম্প্রদায়িক ভাবে জারি রেখেছেন আজ তার খুনি চেহারাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলতে প্রণব মুখ্যাপাধ্যায় (ভারতের রাষ্ট্রপতি) এর কাছে হাত পাতছেন। এখনও ভাবছেন বাঙালি ভাই সে। সে যে দিল্লির স্বার্থ ছাড়া বাংলাদেশের এক গ্লাস পানিও খাবে না বা ত্যাগ করবে না এই সোজা হিসাবটা ভুলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সেকুলার ইতিহাস প্রকল্পের একাট্টা নেরেশনের প্রতাপে আপনি ভুলে গেছেন, বাংলার মানুষের কাছে মুসলমান পরিচয়টা স্রেফ তার ধর্ম পরিচয়ই নয়। যে শূদ্র বা নিম্ন বর্গের মানুষ ইসলামের নামে বাবু আধিপত্যবাদি চেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ইসলাম তার শ্রেণী সংগ্রামের ভাষা। যে শাহবাগীরা আজ আন্দোলন করছেন আপনার ঘরের দিকে তাকালেই এটা বুঝতে পারবেন। আপনার দাদা বা বয়স্কদের সাথে আপনার যে সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈয়ার হয়েছে সেটা আধুনিকতার বিকারের মধ্যে পড়ে। তার মনের দিকে তাকালে বুঝবেন সে ইসলাম কে কিভাবে দেখে। ফলে ঐতিহাসিক ভাবে ইসলাম এখানে যে শ্রেণী সংগ্রামকে এত দিন লুপ্ত রেখেছিল আজ সে জেহাদের কাফনে বেরিয়ে এসেছে। সবটাই জামাতি চাল ভাববার সুযোগ নাই। অন্যদিকে এটা কে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভাষ্যে উপস্থাপনের যে রাজনীতি তাও গণবিরোধী। এ লড়াই কোন ভাবেই মুসলমান-অমুসলমান -এর লড়াই না। যে কোনো বিপ্লবী রাজনীতির কাজ হল, এই লড়াইকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ে পরিণত করা । খ্রিষ্ট চেতনা যদি রাষ্ট্র তৈয়ার করতে পারে। ইসলাম ও এই দেশের গণ্মানুষের সংস্কৃতিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। এই সত্য বুঝতে পারা আজ খুব জরুরী।

 


সেকুলার ইতিহাস প্রকল্পের একাট্টা নেরেশনের প্রতাপে আপনি ভুলে গেছেন, বাংলার মানুষের কাছে মুসলমান পরিচয়টা স্রেফ তার ধর্ম পরিচয়ই নয়। যে শূদ্র বা নিম্ন বর্গের মানুষ ইসলামের নামে বাবু আধিপত্যবাদি চেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ইসলাম তার শ্রেণী সংগ্রামের ভাষা। যে শাহবাগীরা আজ আন্দোলন করছেন আপনার ঘরের দিকে তাকালেই এটা বুঝতে পারবেন। আপনার দাদা বা বয়স্কদের সাথে আপনার যে সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈয়ার হয়েছে সেটা আধুনিকতার বিকারের মধ্যে পড়ে। তার মনের দিকে তাকালে বুঝবেন সে ইসলাম কে কিভাবে দেখে। ফলে ঐতিহাসিক ভাবে ইসলাম এখানে যে শ্রেণী সংগ্রামকে এত দিন লুপ্ত রেখেছিল আজ সে জেহাদের কাফনে বেরিয়ে এসেছে।

 

 


মার্কসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা হচ্ছে, “ধর্মের পর্যালোচনা শেষ করা। কোনো দেশে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত মানুষের রাজনীতির যদি বিকাশ ঘটাতে হয় তাহলে প্রথমে যে কাজটা করতে হবে সেটা হচ্ছে ধর্মের পর্যালোচনা --- ক্রিটিক অব রিলিজিয়ন। ক্রিটিক বা ‘পর্যালোচনা’ করার মানে ধর্মকে নাকচ করে দেয়া নয়। ধর্মের বিপরীতে অধর্ম কায়েম তো নয়ই। ধর্মকে দর্শনের জায়গা থেকে, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করা।”

 

এ প্রসঙ্গে দার্শনিক ফরহাদ মজহারের কথা খুব প্রাসঙ্গিক, “মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের ভূমিকার কারণে আমাদের সমাজে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা আছে। এটা অন্যায় কিছু নয়, কারণ একাত্তরে আমাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। একাত্তরের ভীতি থেকে আমরা মনে করি ইসলাম নিয়ে কোনো আলোচনা করার মানেই হচ্ছে একাত্তরে যে-ইসলাম আমরা দেখেছি, বুঝি সেই ইসলামকেই প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ এই বিষয়কে আরো জটিল করেছে।” এখন এর সম্ভাবনার শর্ত কিন্তু নানা ভাবে আমাদের ইতিহাসে আছে। আমরা কি কখনও ভাসানিকে লাল গেলাফের বাইরে এনে দেখেছি? আমরা কি বুঝতে চেয়েছি তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে কেন হুকুমতে রব্বানীর কথা বললেন? আমরা এগুলা শুধু মূর্খতার বশে করেছি এমটি মানা যায় না। আমরা জনরাজনীতির প্রতি প্রকৃত প্রস্তাবে চরম অবহেলা করেছি। তরান্বিত করেছি ধর্ম যুদ্ধের সম্ভাবনা। আমরা যদি ইসলাম কে এখনও জঙ্গিপনার ভাষ্যের আদলে দেখি এই ধর্মযুদ্ধ কোন ভাবেই ঠেকাতে পারব না। এখনই দ্রুত আমাদের একাট্টা ইতিহাসের বয়ান ধসিয়ে দিয়ে নতুন ইতিহাস নির্মানের শর্ত তৈয়ার করার কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।

আর্মি বা রক্ষা কর্তা বামুন কে প্রার্থনা:

আমরা আলোচনা আজকের মত এখানেই শেষ করব। শেষ করার আগে, বর্তমান পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে তাতে আমাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের উপর ভরসা শত ভাগ উঠে গেছে। এই ধরণের অবস্থার মধ্যে পড়ে সেনা হস্তক্ষেপের জন্য আমাদের দেশের মানুষ যে প্রর্থনা করে তা এখন ওরসের মত বছর ঘুরে ঘুরেই আসে। অলরেডি সেনা নেমেছে বা নামতে হয়েছে যদিও রাষ্ট্র পক্ষ মিথ্যাচার করেছে। কিন্তু হায় আফসোস এবার কোন বামুন আমাদের প্রর্থনা শুনবে এমনটা মনে করার কারন নাই। বা আরও সরল ভাবে বললে, সেনা নামলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না যাবে না। সেটা হওয়ার নয়। রাজনৈতিক ভাবে আমাদের গড়ে ওঠা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নাই। অন্য দিকে বর্তমান পরিস্থিতি আর আমাদের ঘরের ব্যাপার নাই। ধর্মযুদ্ধে মানুষের শত্রু-মিত্র রাজনীতি যুদ্ধের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে কোন নাগরিকের পক্ষেই পেশাগত অবস্থান নিয়ে বসে থাকা সম্ভব হবে না। এই মানুষ সেনা বা পুলিশ মাত্র নয় সে মুসলমান বা অন্য কোন ধর্ম পরিচয়ও তার আছে। তাছাড়া আমরা তো একটা শক্তিশালী জনমানুষের স্বার্থ -দরদি মিলিটারি গড়ে তুলি নি। আমাদের সেনা সংস্কৃতির অবস্থা কি? বিডিআর বিদ্রোহের পর এটা একটা শিশুও জানে। আমরা সেনা বাহিনীকে জনগনের বিপরীতে কোন শক্তি মনে করি না। আমরা মনে করি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য গণপ্রতিক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া পথ নাই। যে কোন এলিট বাহিনীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা জনগনের বুকের উপর রাইফেল তাক করবে, নাকি তারা জনরাজনীতির স্বার্থ কে প্রধান্য দিয়ে জনগনের কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ কে ইনসাফের রাষ্ট্র আকারে কায়েমের লড়াইয়ে সবারই সামিল হওয়া ছাড়া পথ নাই।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।