অসামান্য বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম


তাঁর সঙ্গে দুইবার মাত্র দেখা হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, তিনি তাঁর জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষকতার সূত্রে থাকতেন চট্টগ্রামে। দ্বিতীয় কারণ আমরা এমন এক সমাজ তৈরী করেছি যেখানে জ্ঞানের কদর নাই, বিজ্ঞান তো দূরের কথা। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও বিশ্বসভায় নেতৃত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে মৌলিক বিজ্ঞান চিন্তার ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নাই। বিজ্ঞানীর যোগ্য সামাজিক সম্মান আমরা দিতে জানি না; তাঁদেরকে ঘিরে আমাদের কোন সামাজিক সংঘ নাই; চিন্তার আদান প্রদানের কোন সাধারণ পাটাতন নাই। ফলে জ্ঞানবিজ্ঞানের আউলিয়া হয়ে তাঁরা তাঁদের নির্জন সাধনায় একা একা রত থেকেছেন। এখন যখন সংবাদ পাচ্ছি যে তিনি আর নাই, তখন বেদনায় কাতর হতে পারি, কিন্তু সেটা কুমিরের অশ্রুর বেশি মূল্য পাবে কিনা জানি না।

আমার বিজ্ঞানী বন্ধুবান্ধবদের কাছে প্রায়ই শুনতাম জামাল নজরুল ইসলাম যদি দেশে ফিরে না এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বা ক্যাম্ব্রিজের মতো বিলাত-ইউরোপের কোন প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যেতেন তাহলে নির্ঘাৎ তিনি নোবেল পুরস্কার পেতেন। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়িয়েছেন, গবেষণা করেছেন। প্রিন্সটন, ক্যাম্ব্রিজসহ বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বই পাঠ্য। যারা তাঁর নোবেল পুরস্কার পাবার কথা বলেন তারা নোবেল পুরস্কারের রাজনৈতিক দিক সম্পর্কে জানেন। বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানীর এই পুরস্কার পাওয়া রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কথাটা বলা হোত গণিতে ও পদার্থ বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের মাত্রা বোঝানোর জন্য। সহজে আর কিভাবে বোঝানো সম্ভব? গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের দিক থেকে বিশ্বপ্রকৃতিকে জানা, বোঝা ও সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি বিচারের যে-শাস্ত্র সে শাস্ত্রেও তাঁর অসাধারণ অবদান রয়েছে। সাধারণ মানুষদের কিভাবে এই বিজ্ঞানীর বিশালতা বোঝানো যায়? তাই মন্দের ভালো হিশাবে বলা হয়, তিনি যদি দেশের টানে দেশে চলে না আসতেন তাহলে পাশ্চাত্য তাঁকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করতো। কথাটা হয়তো মোটেও মিথ্যা নয়। বিশ্বখ্যাত মানুষ ছিলেন। কিন্তু এই মানুষটিই আমাদের মধ্যে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই ছিলেন অতি সাধারণ, সরল ও কোলাহলহীন। তাঁকে শেষ বিদায়ের সালাম জানাই।


বিজ্ঞানীর যোগ্য সামাজিক সম্মান আমরা দিতে জানি না, তাঁদেরকে ঘিরে আমাদের কোন সামাজিক সংঘ নাই, চিন্তার আদান প্রদানের কোন সাধারণ পাটাতন নাই। ফলে জ্ঞানবিজ্ঞানের আউলিয়া হয়ে তাঁরা তাঁদের নির্জন সাধনায় একা একা রত থেকেছেন।


আমরা জ্ঞানচর্চায় অলস, বিজ্ঞানবিমুখ আর পরনিন্দায় তুমুল আমোদ উপভোগ করি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষকে তাঁর সম্পর্কে ধারণা দেবার উপায় কি? সম্ভবত ২০০১ সালের দিকের ঘটনা। গুজব রটেছিল যে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে, কারণ গ্রহ নক্ষত্রগুলো একই সরলরেখা বরাবর চলে আসছে, প্রলয় অনিবার্য। জামাল নজরুল ইসলাম সহজেই গণিতের হিশাব কষে দেখান গ্রহনক্ষত্রের এই চলন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তারা যেভাবে বিশ্বমণ্ডলে সরল রেখায় এসে খাড়া হচ্ছে সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। দুনিয়া ধ্বংস হবার মতো কোন বিপদ দেখা দেয় নি। গণিতের এই হোল শক্তি। বিশ্বপ্রকৃতির গতিপ্রক্রিয়ার নিয়মকে গণিত যতো বেশী সফল ভাবে সূত্রাবদ্ধ করতে সক্ষম হয় ততোই এই ব্রহ্মান্ড কিভাবে নিয়মের অধীনে চলে মানুষ ঘরে বসে কাগজ কলম নিয়ে সেটা বলতে সক্ষম হয়। গ্রহনক্ষত্রের স্থান পরিবর্তন কোথায় কিভাবে ঘটছে বিজ্ঞানী এভাবেই জানেন; আগেই বলে দিতে পারেন কে কোথায় কোন্‌ অবস্থানে যাচ্ছে। কী ঘটছে। একেই বলা হয় বিশ্বপ্রকৃতিকে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের বিদ্যা দিয়ে জানা। ইংরেজিতে বলা হয় Cosmology। এই জ্ঞানকে বাংলাদেশে আরও পোক্ত করবার জন্য জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন একটি বিভাগ: রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকস এন্ড ফিজিকাল সায়েন্স। তাঁকে সম্মান জানাতে হলে তাঁর কীর্তিকে রক্ষা করতে হবে। নিশ্চয়ই তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীরা সে কাজ করবেন। আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের নৈতিক সমর্থন দেওয়া এবং সরকার ও রাষ্ট্র যেন সেইদিকে নজর দেয় তার জন্য চাপ অব্যাহত রাখা।

আমার সঙ্গে তাঁর খুব কম দেখা হলেও পরস্পরকে বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হয় নি। দেখা হওয়া মাত্রই দ্রুত কাছে আসতে পেরেছি। তার দুটো কারণ ছিল। এক. মৌলিক বিজ্ঞান এবং ফলিত বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী; দুই: গণিত ও বিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি বিচারের প্রতি আমাদের দুইজনেরই বিপুল আগ্রহ। আজ সেই সম্পর্কেই এখানে দুই এক কথা বলব।

তিনি খুবই পছন্দ করেছিলেন আমার একটি লেখা ও সাক্ষাৎকার যেখানে আমি বলেছিলাম বাংলাদেশ এমন এক বিচিত্র জায়গা যেখানে তরুণরা বিজ্ঞানী বা বড় চিন্তাবিদ হবার সাধনা না করে কবিতা লিখতে, নাটকে অভিনয় করতে বা দ্রুত পরিচিতি ও খ্যাতি লাভের এমন সব ক্ষেত্রে আগ্রহী হয় যা তার নিজের প্রতিভার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কবি হওয়া বা নাটকে অভিনয় করা মোটেও খারাপ কিছু নয়। মুশকিল হচ্ছে আমাদের সমাজ মৌলিক চিন্তা ও বিজ্ঞানসাধনাকে মর্যাদা দেয় না বলে আমাদের নায়করা কেউই বিজ্ঞানী নন। কোন বিজ্ঞানী আমাদের রোল মডেল হতে পারেন নি। আমরা বিজ্ঞানী হতে চাই না, কিন্তু বাজে কবিতা বা বাজে অভিনেতা হয়ে জীবন অপচয় করতে রাজি। তরুণরা যখন চিন্তা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সামনের সারির নায়ক হতে চায় না, তখন সমাজের জন্য সেটা খুব বড় বিপদ হয়ে দেখা দেয়। যে-প্রজন্ম গড়ে ওঠে তারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বদলে পেছন দিকে টেনে ধরে।

আমাদের অবশ্যই মৌলিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব বোঝার দরকার আছে। আমরা প্রায়ই প্রগতিশীলতার দোহাই দিয়ে থাকি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। কিন্তু অনুসরণ করি সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি। সাম্রাজ্যবাদীরা চায় আমরা শুধু ফলিত বিজ্ঞান শিখি, মৌলিক বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানের মূল সূত্র ও নিত্যনতুন ক্ষেত্র পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবিষ্কার করবে, আর আমরা তাদের ভাড়া খাটা দিনমজুরের মতো সেটা প্রয়োগ করে যাবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই সত্যেন বোস বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। তাঁর নাম আইনস্টাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। 'বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব' নামে যা এখন পরিচিত। আইনস্টাইন তাঁর ধারণা গ্রহণ করে সেটা প্রয়োগ করেছেন পরমাণু বিশ্লেষণে। 'বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট' নামে যার খ্যাতি। এই অবদান রাখতে সত্যেন বোসের বিশাল কোন ল্যাবরেটরির দরকার হয় নি। পেন্সিল কাগজই ছিল যথেষ্ট। এই মাপের মানুষ যারা বিজ্ঞানের খোদ ভিত্তিটাকে গড়েন তাদের আমরা সমাজে তৈরী করতে চাই না, আমরা চাই কারিগরী বিজ্ঞান। অর্থাৎ পাশ্চাত্য যা আবিষ্কার করবে এবং তার ভিত্তিতে যেসব নতুন টেকনলজি আমাদের দেশে বেচাবিক্রি করবে, সেই ব্যবসার সহায়ক হওয়া। তাদের কলকারখানার জন্য প্রায়োগিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত মজুর সরবরাহ করা। আবার তাদেরই কারিগরী পণ্যের ভোক্তা হওয়া। আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের কলকারখানার জন্য শিক্ষিত মজুর সরবরাহ করা। আবার তাদেরই কারিগরী পণ্যের ভোক্তা হওয়া। বিশ্বব্যবস্থা কিভাবে উচ্চ শিক্ষার নামে বাংলাদেশের মতো পুঁজির পরিধিতে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের জন্য শিক্ষিত মজুর সরবরাহ করার কারখানা তৈরী করে এবং সেই মজুর আমরাই আবার রপ্তানি করি সেটা বুঝতে পারা সহজ কাজ নয়।


সাম্রাজ্যবাদীরা চায় আমরা শুধু ফলিত বিজ্ঞান শিখি, মৌলিক বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানের মূল সূত্র ও নিত্যনতুন ক্ষেত্র তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবিষ্কার করবে, আর আমরা তাদের ভাড়া খাটা দিনমজুরের মতো সেটা প্রয়োগ করে যাবো।


জামাল নজরুল ইসলাম মজুর হতে রাজি হন নি। দেশকে ভালবেসে দেশে ফিরে এসেছেন বলে নয়, মৌলিক বিজ্ঞান চর্চা আমাদের বিজ্ঞান সাধনার গোড়ায় থাকতে হবে নিজের জীবন দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি মৌলিক বিজ্ঞান চর্চা ও ফলিত বিজ্ঞানের ফারাক অবশ্যই জানতেন, আমাদের দেশের জন্য উভয়েরই প্রয়োজনীয়তা আছে। তাকে তিনি অস্বীকার করেন নি। আমিও করি না। পড়াশুনাও করেছেন ফলিত বিজ্ঞানে। কিন্তু মৌলিক বিজ্ঞানকে গৌণ জ্ঞান করে ফলিত বিজ্ঞানকে প্রধান করে তোলার যে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতি, আমরা যা বিনা বিচারে গ্রহণ করি, তাকে নিজের জীবন দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মৌলিক বিজ্ঞানকে তাঁর বিজ্ঞান সাধনার কেন্দ্রে নিয়ে আসবার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চার অভিমুখ দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি।

আমরা অতিশয় দেশ প্রেমিক বলে তাঁর দেশে ফিরে আসাটাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি, বিজ্ঞান সাধক হিশাবে তাঁর তাৎপর্য ধরতে পারি না। যেসব বাংলাদেশী বিদেশে আছেন তাঁরা দেশকে কম ভালবাসেন না। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের তাৎপর্য অন্যত্র। তিনি সত্যেন বোসের মতো মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্বকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। মৌলিক বিজ্ঞানের ওপর নিজের অসামান্য দখল ও প্রতিভা প্রমাণ করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানের চর্চার দিক থেকে যদি আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হতে হয় তাহলে চর্চার চরিত্রটা কেমন হবে। বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অভিমুখ কোনদিকে হওয়া দরকার। দেশের বাইরে শিক্ষিত শ্রমিক রপ্তানি বা দেশে বহুজাতিক কম্পানির বড় সাহেব হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের দরকার সত্যেন বোস, জামাল নজরুল ইসলাম, আইনস্টাই্ন, হেইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানী। জ্ঞানবিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম এক ঝাঁক তরুণ যারা দেশে বসেই দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াবে। জামাল নজরুল ইসলাম আমাদের সেই স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছেন।

শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়। আমরা অর্থশাস্ত্র পড়ি না, পড়ি বিজিনেস এডমিনিস্ট্রেশান। মানে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির দোকানদারি চালাবার বিদ্যা। বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা এবং ওর মধ্যে আমাদের অবস্থান শক্ত করবার সীমা ও সুযোগ বোঝার মতো মৌলিক অর্থশাস্ত্রে পণ্ডিত কোন তরুণ আমরা জন্ম দিতে পারি নি। অথচ অর্থনৈতিক গতিপ্রক্রিয়া বোঝার মৌলিক শাস্ত্র না জানলে আমরা কিভাবে বাংলাদেশকে উন্নতির পথে নেব? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পরামর্শে? বিদেশী পরামর্শদাতাদের হুকুমে? এদের বিরুদ্ধে মুখস্থ শ্লোগান দিয়ে?

আমরা ইতিহাস পড়ি না, কারণ আমাদের ধারণা বাংলাদেশের ইতিহাস মানে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এর বেশি আর আমাদের ইতিহাস জানার দরকার নাই। মোগল শাসন, সুলতানি আমল, কিম্বা পাকিস্তানী আমলে আসলে কী ঘটেছিল – কিভাবে আমরা আজ এখানে এসে হাজির হয়েছি সেটা জানার কোনই দরকার নাই। অথচ ইতিহাস চর্চা মৌলিক বিদ্যার অন্তর্গত। আমরা ইতিহাসবিদ হতে চাই না। এখন আর তার দরকারই বা কি, কারন আদালতই তো দেখা যাচ্ছে রায় দিয়ে ইতিহাস লিখে ফেলছে। আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী নই, কিভাবে আধুনিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ হয়েছে, আমাদের জন্য কী ধরণের রাষ্ট্র উপযুক্ত সেইসব তর্ক আমাদের দরকার নাই। আমরা ইংরেজের গোলাম ছিলাম, এই গোলামি সংসদীয় গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের জন্য উপযুক্ত অন্য কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিন্তা করতেও ভুলিয়ে দিয়েছে, জন্ম তো দূরের কথা। রাষ্ট্র কিভাবে গঠিত হয় এবং তাকে পরিচালনা করতে হলে তার কলকাঠির ভূমিকা জানা আমাদের দরকার নাই। আমরা পড়ি লোক প্রশাসন। মানে বিদ্যমান গণবিরোধী গণনিপীড়নের হাতিয়ার কিভাবে জনগণের ওপর প্রয়োগ করতে হবে সেটাই আমরা শিখি ও শেখাই। এর ফলে যে-তরুণ প্রজন্ম গঠিত হয়েছে তার ওপর আমরা কতোটা ভরসা করতে পারি তার বিচার আমি পাঠকের কাছেই ছেড়ে দিচ্ছি। শুধু বয়স আর আবেগ দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা এখন মহা বিপদে পড়ে খাবি খাচ্ছি।

এতো বড় গণিতজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতেন না। কমপিউটার বা মোবাইল ফোন পরিহার করতেন। তিনি এই সবের বিরোধী ছিলেন বলে নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে কৃৎকৌশলের প্রতি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টিই ধরা পড়ে। কৃৎকৌশল মাত্রই বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের চরিত্র বদলে দেয়। স্বাভাবিক ভাবে আমরা যেভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত সেই স্বাভাবিকতায় রূপান্তর ঘটে। সেটা ঘটে আমাদের অজান্তে। কোন কিছুকে সরাসরি উপলব্ধি করা আর বই পড়ে বা বইয়ের মধ্যস্থতায় উপলব্ধির মধ্যে পার্থক্য বিশাল। ঠিক তেমনি নিজের চিন্তার খোদ প্রক্রিয়া দিয়ে সংখ্যা নিয়ে কারবারের মধ্যে নিজের মগজকে যেভাবে খাটানো হয়, তার সঙ্গে মগজের বাইরে ক্যালকুলেটারকে দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। গোনাগুনি তিনি নিজের মগজ দিয়েই করতে চাইতেন, এতে নিজের গাণিতিক চিন্তাশীলতার বলবৃদ্ধির যেমন সম্ভাবনা থাকে, তেমনি গাণিতিকতার বাইরে চিন্তার সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনা প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ইন্দ্রিয় ব্যবহারের রূপান্তর ঘটিয়ে টেকনলজি মানুষকেও বদলে দেয়। এই বদলকে নির্বিচারে ইতিবাচক মেনে নেওয়ার কোন যুক্তি নাই। টেকনলজির গুরুত্ব অস্বীকার করার দরকার নাই, কিন্তু এর ক্ষতির দিকটাও বিবেচনায় থাকতে হবে। মানুষ কি তার সহজাত শক্তি বা ক্ষমতার বিকাশ ঘটাচ্ছে, নাকি সেখানে তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা। সহজাত শারিরীক চিন্তাশীলতার বৃত্তির বাইরে জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান সাধনায় ক্যালকুলেটার, কম্পিউটার বা অন্য কোন কৃৎকৌশল ব্যবহার করতেন না ব্যাপারটিকে খুব হাল্কা ভাবে নেবার সুযোগ নাই।


মৌলিক বিজ্ঞানের ওপর নিজের অসামান্য দখল ও প্রতিভা প্রমাণ করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানের চর্চার দিক থেকে যদি আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হতে হয় তাহলে চর্চার চরিত্রটা কেমন হবে। বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অভিমুখ কোনদিকে হওয়া দরকার। দেশের বাইরে শিক্ষিত শ্রমিক রপ্তানি বা দেশে বহুজাতিক কম্পানির বড় সাহেব হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের দরকার সত্যেন বোস, জামাল নজরুল ইসলাম, আইনস্টাই্ন, হেইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানী। জ্ঞানবিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম এক ঝাঁক তরুণ যারা দেশে বসেই দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াবে। জামাল নজরুল ইসলাম আমাদের সেই স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছেন।


গণিত ও বিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি জানার দরকার কি? এই বিজ্ঞানগুলোকে বলা হয় পজিটিভ সায়েন্স। তারা মৌলিক বিজ্ঞান অবশ্যই, কিন্তু মৌলিক চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে তাদের পার্থক্য আছে। এই বিজ্ঞানগুলো কিছু অনুমানকে আগেই সত্য ধরে নিয়ে গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে অনেকসময় বলা হয় ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘পূর্বসিদ্ধান্ত’ ইত্যাদি। দর্শন এই অনুমান, প্রতিজ্ঞা বা পূর্বসিদ্ধান্তকে বিচার করতে শেখায় এবং দেখায় যে গণিত এবং বিজ্ঞানের ‘সত্য’ বিশেষ ধরণের সত্য কিন্তু চিন্তা আরো নানান সত্য নিয়ে কারবার করে সেখানে গণিত ও বিজ্ঞানের অনুমান, প্রতিজ্ঞা বা পূর্বানুমান খাটে না। মানুষের ধর্মচিন্তা, শিল্প, সাহিত্য, কাব্যকলাসহ নানান দিব্য অভিজ্ঞতা জানা ও বোঝার কাজ বিজ্ঞানের পদ্ধতি দিয়ে সম্ভব না। মানুষের ইতিহাসও গণিতের নিয়ম মেনে চলে না। প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতি ইতিহাসের ওপর খাটাতে গেলে বিপদ দেখা দেয়। তখন মানুষের চিন্তার নিজস্ব শক্তিকে যেমন অস্বীকার করা হয়, তেমনি সেই চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ যে ভূমিকা রাখে সেই ভূমিকাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি খাটিয়ে গণিতের সূত্রের মতো আগেই আন্দাজ করা যায় না। তাছাড়া মানুষ যন্ত্র নয় বা প্রাকৃতিক জীব মাত্র নয় যে তার আচরণ মেশিনের মতো বা জীবজানোয়ারের মত হবে।

তবে চিন্তা অবশ্যই গণিত ও বিজ্ঞানের গোড়ার ভিত্তি কিভাবে তৈয়ার হোল সেটা দেখিয়ে দিতে পারে। একে বিজ্ঞানের দর্শন বলা হয়। কিন্তু এটাই চিন্তার কাজ নয়, চিন্তাকে বারবারই বুদ্ধির সীমা ভেদ করে প্রজ্ঞার জগতে প্রবেশ করতে হয়। সেটা গণিত বা বিজ্ঞানের জগত নয়, দিব্যজ্ঞানীর জগত।


পর্যালোচনা মানে সমালোচনা বা নাকচ করা নয়, বরং মানুষের অভিজ্ঞতার সারাৎসারটুকু ছেঁকে বের করে আনা, যাতে মানুষের ইতিহাস কদমে কদমে এগিয়ে যায়। সেই মৌলিক কাজ না হলে সমাজ বিজ্ঞানকে ধর্মের বিপরীতে আর ধর্মকে বিজ্ঞানের শত্রু হিশাবে বার বার হাজির হতে থাকে। সমাজ পিছিয়ে যায়। কিম্বা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি হানাহানি শুরু হয়ে যায়।


মানুষের সক্রিয় চিন্তা, যাকে আমরা দর্শন বলি, সেই ক্ষমতা বিজ্ঞানের অনুমান, প্রতিজ্ঞা ও পূর্বানুমানগুলো উদাম করে দিতে সক্ষম। ঠিক যেমন সক্ষম ধর্মশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও। যে কারনে সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে বিজ্ঞানের পর্যালোচনা যেমন দরকার, তেমনি দরকার ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মশাস্ত্রের পর্যালোচনা। আরও সাধারণভাবে বললে সব কিছুরই পর্যালোচনা। পর্যালোচনা মানে সমালোচনা বা নাকচ করা নয়, বরং মানুষের অভিজ্ঞতার সারাৎসারটুকু ছেঁকে বের করে আনা, যাতে মানুষ নিজের বিকাশ নিজে ঘটাতে পারে, ইতিহাস কদমে কদমে এগিয়ে যায়। সেই মৌলিক কাজ না হলে সমাজ বিজ্ঞানকে ধর্মের বিপরীতে আর ধর্মকে বিজ্ঞানের শত্রু হিশাবে বার বার হাজির করতে থাকে। সমাজ পিছিয়ে যায়। কিম্বা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি হানাহানি শুরু হয়ে যায়।

গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং মানুষের অপরাপর সৃষ্টিশীল চিন্তার এই গোড়ার ফারাক বুঝতে পারা সহজ নয়। বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধানো সফলতার কারণে দেখা যায় অনেকে ধর্মগ্রন্থকে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করার নিস্ফল প্রয়াস করতে থাকেন। দাবি করেন ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞানের সমস্ত সূত্রই আগে থেকেই নাকি আবিষ্কৃত বা নিহিত রয়েছে। এদের অনেকের যুক্তি শুনলে মনে হয় কোরানশরিফ বুঝি ফিজিক্স বা কেমেস্ট্রির মতোই একটি গ্রন্থ। বিজ্ঞান দিয়ে কোরানের সত্য প্রমাণ করবার বিকারও আমরা দেখি। যেন, কোরানুল করিমকে বিজ্ঞানশাস্ত্র আকারে না পড়লে তার সত্যতা নিশ্চিত করা যাবে না। ধর্ম সম্পর্কে ফালতু ও অজ্ঞ ধারণা এবং ধর্ম্বোধের সত্য আরে প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের সত্যের ফারাক না বুঝতে পারার জন্য এই সব আপদ তৈরি হয়। এই কাজ যারা করেন তাদের ঈমান কোরানশরিফে নয়, আসলে বিজ্ঞানে। শুধু ধর্মশাস্ত্রের ক্ষেত্রে এই কাণ্ড ঘটে তা নয়, মানুষের ইতিহাসকেও প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো পাঠ করবার রেওয়াজ রয়েছে। আজকাল তা নিন্দিত হলেও এর ভূত অনেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে বয়ে বেড়ান। বাংলাদেশে এই সকল প্রাচীন চিন্তার উৎপাত বড় কম নয়।

বলা বাহুল্য জামাল নজরুল ইসলাম সমাজ নিয়ে যে চিন্তা করতেন তা খুবই অগ্রসর। তাঁর দুই একটি সাক্ষাৎকারে সেটা খুবই পরিষ্কার। কিন্তু এই ধরণের চিন্তা করবার মানুষ আমাদের সমাজে আরও অনেকে আছেন। তাঁর বিশালত্ব এইসব চেনাজানা প্রগতিশীল কথাবার্তায় ধরা পড়বে না। বরং মৌলিক চিন্তার সামাজিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে পারলেই তাঁকে ঠিক মতো আমরা বুঝতে পারব। কেন তরুণদের তিনি আদর্শ হবেন তার কারণও বুঝব।

এটা ভাববার কোন কারণ নাই যে বাংলাদেশীদের মধ্যে বিজ্ঞানে আর কেউ মৌলিক চিন্তা করছেন না। অবশ্যই আছেন। দেশেবিদেশে ছড়িয়ে আছেন তারা। যদি আমরা জামাল নজরুল ইসলামের প্রতি আমাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে চাই তাহলে আমাদের এখন প্রধান কাজ হবে সেই সকল ‘নায়ক’-দের খুঁজে বের করা এবং বাংলাদেশের তরুণদের কাছে তাদের অবদান তুলে ধরা।

এই কাজ যখনই আমরা করব, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীকে যখন যোগ্য মর্যাদা দেব তখনই আমরা এগিয়ে যেতে পারব দ্রুত। আর, সেটাই তো এখন দরকার। তাই না?

১৮ মার্চ ২০১৩।  চৈত্র ১৪১৯। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।