কে হবেন রাষ্ট্রপতি?


প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মানুষের প্রচুর ভালবাসা পেয়েছেন। ব্যক্তি হিশাবে এটা বিরল সৌভাগ্য। তবে তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মূল্যায়ন রাজনৈতিক ভাবেই হওয়া উচিত। সেটা তাঁর মৃত্যুর পরপরই করতে হবে এমন কথা নাই। আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সেটা খাপ খাবে না। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতা নেত্রীদের যে সাংস্কৃতিক মান দেখি তুলনায় তাঁকে ফেরেশতা মনে হয়। হয়তো এই জন্য মানুষ তাঁকে প্রাণভরে দোয়া করেছে। জানাজায় বিপুল সংখ্যায় শরিক হয়েছে। তাঁর নিরীহ জীবন, অহিংস বাচনভঙ্গী ও শারিরীক অঙ্গভঙ্গীর শালীনতা বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে কাছে টেনেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এই ব্যক্তিগত গুণগুলোই সশব্দে জানান দিয়ে গিয়েছে।

তবে চিন্তায় মনে মননে তিনি আওয়ামী রাজনীতির অন্দরমহলেরই মানুষ। শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালে যখন বাকশাল গঠন করেন তিনি তার এক নম্বর সেক্রেটারি ছিলেন। তবে এক এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের সময় তিনি আওয়ামী লীগকে সামাল দিতে পেরেছিলেন। এই সময় বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তার বিচক্ষণতা সকলের চোখে পড়েছিল।

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এই ভাল দিকগুলো নিয়ে মানুষ কথা বলছে। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও আছে প্রবল। এখন কে হবেন রাষ্ট্রপতি? বিশেষত এই অস্থির ও সংঘাতে জর্জরিত সময়ে? এই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অর্থ আসলে কী, সেটাও ভাবছে মানুষ। রাষ্ট্রপতি ‘সুপ্রিম কমাণ্ড’, তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সর্বাধিনায়ক। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী “বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর” ন্যস্ত (অনুচ্ছেদ ৬১)। তবে এই ক্ষমতা তিনি কিভাবে প্রয়োগ করবেন সেটা জাতীয় সংসদ আইনের মাধ্যমে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন বহাল ছিল তখন সেই সরকারের মেয়াদের সময় রাষ্ট্রপতি ক্ষমতার প্রয়োগ সংক্রান্ত ‘আইন’ নিজেই পরিচালনা করতে পারতেন। সেই ব্যবস্থা এখন বহাল নাই।

এই দিকটি বাদ দিলে বলা হয়ে থাকে নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বিশেষ কোন ক্ষমতা নাই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান মন্ত্রীই সর্বে সর্বা। তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রধান মন্ত্রী (অনুচ্ছেদ ৫৬) ও প্রধান বিচারপতিকে (অনুচ্ছেদ ৯৬) ‘নিয়োগ’ দেন। প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়াকে ঠিক ক্ষমতা বলা চলে না। সংবিধানের নির্দেশ পালনের অধিক কিছু নয়। আসলে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত। সংবিধান পরিষ্কারই বলছে, অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) অনুসারে এই দুইজনকে “নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন”। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের অধীন। যদি এসবের সঙ্গে আমরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পড়ি তাহলে দেখব জাতীয় সংসদে আমরা কাকে নির্বাচন করলাম তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ সংসদ সদস্যরা তাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে কিছুই করতে পারে না। তারা দলের বাইরে কোন ভোট দিতে পারে না। আর দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন দলনেত্রী। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা। বিএনপির ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে যিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অধিষ্ঠিত হন তিনি আসলে ‘একনায়কতান্ত্রিক’ শাসক। কিন্তু এই ‘একনায়কতন্ত্র’ কায়েম হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, সংবিধান মেনে। অথচ আমরা মনে করি আমরা গণতন্ত্রে হাবুডুবু খাচ্ছি।

 


বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান মন্ত্রীই সর্বে সর্বা। তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রধান মন্ত্রী (অনুচ্ছেদ ৫৬) ও প্রধান বিচারপতিকে (অনুচ্ছেদ ৯৬) ‘নিয়োগ’ দেন। প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়াকে ঠিক ক্ষমতা বলা চলে না। সংবিধানের নির্দেশ পালনের অধিক কিছু নয়। আসলে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত।

 

 


বাংলাদেশের এই একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বলা হয় সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র। কারন খোদ সংবিধানই এই একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার ভিত্তি। ভোট দিয়ে একনায়কী শাসক নির্বাচনের ব্যবস্থা সংবিধানই করে রেখেছে। আমরা এই গোড়ার সমস্যাটা বুঝলেও স্বীকার করি না। উলটা একনায়কী দুঃশাসনের জন্য একবার খালেদা জিয়া, আরেকবার শেখ হাসিনাকে পালা ক্রমে দোষারোপ করে যাচ্ছি। দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য নতুন ভাবে রাষ্ট্র গড়বার কথা ভাবি না, তার চেয়েও সহজ পথে সমাধান আশা করি। যেমন, ‘মাইনাস টু’ বা দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে গায়েব করে দেওয়া। এখনও কে কোন অর্থে ‘মাইনাস টু’-র কথা বলে সে বিচারে না গেলেও মাইনাস টু একটি গুপ্ত জনপ্রিয় বাসনা আকারে জারি রয়েছে।

 

রাজনৈতিক দলগুলোর দুঃশাসন, দুর্বৃত্তপনা ও লুটপাটে অতীষ্ঠ জনগণ রাজনৈতিক সংকটে দিশাহারা হয়ে পড়লে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কামনা করতে থাকে। এটা আমরা প্রায়ই দেখি। কিন্তু তখন সমাজের আরেক অংশ থেকে আবার তার বিরোধিতা করা হয়। বাংলাদেশে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিরোধিতা যারা করেন তাদের অধিকাংশেরই আসল মতলব হচ্ছে সৈন্যতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার বিপরীতে রাজনৈতিক দলের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা রক্ষা করা। দলীয় একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা যেহেতু সংবিধানের দোহাই দিয়ে রক্ষা করা হয়, সে কারণে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল রুদ্ধ করবার জন্য সংবিধানকে মোক্ষম অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করা হয়। যদি গণতন্ত্রই আদর্শ হয় তাহলে দরকার সকল প্রকার একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই। সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিকতন্ত্র কায়েম যেমন গণতন্ত্রের লক্ষ্য হতে পারে না, ঠিক তেমনি রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বা সৈনিকদের ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসন টিকিয়ে রাখার কোন অর্থ হতে পারে না। সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রীরা বলেন রাজনীতির স্বার্থে তৃতীয় শক্তিকে সামনে আনা যাবে না, সেনাবাহিনী প্রশ্নে তাদের আতংকের স্বরূপটাকে এভাবেই আমাদের বুঝতে হবে।

এই বিরোধ সাধারণত সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণি থেকেই আসে। যাদের কাছে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হচ্ছে মূলত তাদের সয়সম্পত্তির পাহারা দেওয়া বা তাদের দারোয়ানগিরি করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণপ্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে তুলতে হবে সেই তর্ক সামরিকতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের খোপের বাইরের তর্ক। গণতন্ত্রে নাগরিকতা ও সৈনিকতার সম্পর্ক বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে বিষয়ে আমরা আজও প্রবেশই করতে পারি নি।

 


যদি গণতন্ত্রই আদর্শ হয় তাহলে দরকার সকল প্রকার একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই। সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিকতন্ত্র কায়েম যেমন গণতন্ত্রের লক্ষ্য হতে পারে না, ঠিক তেমনি রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বা সৈনিকদের ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসন টিকিয়ে রাখার কোন অর্থ হতে পারে না।

 

 


রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা বলার কিছু একটা অর্থ থাকে। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রই নাই সেখানে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা বলার মানে রাজনৈতিক দলের নেতা বা নেত্রীর একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়ানো। এমনকি রাজনৈতিক দলের দুঃশাসনে জনগণ যখন নাগরিক ও মানবিক অধিকার হারিয়ে কাতর তখনও রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর নতুন ভাবে কিভাবে গঠন করা সম্ভব সেই তর্ক না করে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রকেই বাংলাদেশের একমাত্র নিয়তি হিশাবে হাজির করা হয়। এই চক্রের মধ্যে আমরা দীর্ঘকাল ধরে পড়ে আছি।

 

ক্ষমতাবান না হলেও রাষ্ট্রপতির সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকার করে। রাষ্ট্রপতি সে ক্ষমতা কিভাবে চর্চা করছেন তার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রপতিকে আমরা চিনি। তার নিজের রাজনৈতিক চরিত্র সেই চর্চার মধ্য দিয়েই ধরা পড়ে।সেই বিশেষ ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্রপতির কোন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সাজা মওকুফ করে দেবার ক্ষমতা। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যে কোন দণ্ড স্থগিত, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ২১ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত (১৯৭২-২০১১) মোট ২৫ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছেন এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে ১ জন, ২০০৫ সালে ২জন, ২০০৮ সালে ১ জন, ২০০৯ সালে ১জন, ২০১০ সালে ১৮ জন এবং ২০১১ সালে ২জন । তার মানে ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানই মাফ করে দিয়েছেন। একে মহানুভবতা হিশাবে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। তাঁর গায়ে এই কালিটা লেগে আছে।

মানবাধিকারের দিক থেকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিশাবে মৃত্যুদণ্ড আদৌ থাকা উচিত কিনা সেটা একটি তর্ক হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিশাবে দলীয় বিবেচনায় জিল্লুর রহমান যেভাবে শাস্তি মওকুফ করেছেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিন্দিত হয়েই থাকবে। লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লবের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা কামালউদ্দিনকে ২০০১ সালের অক্টোবরে নিজ বাড়িতে তাঁর বাবা-মার সামনে পিটিয়ে হত্যা করে। ১০ বছরের বেশি সময় পলাতক থেকে বিপ্লব ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পন করে। এরপর তার বাবা সরকার দলীয় নেতা আবু তাহের ছেলের দণ্ড মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে। আবু তাহেরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান এর আগে এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করেছিলেন, যা ২০১২ এর ১৪ জুলাই কার্যকর করা হয়েছিল। যাবজ্জীবন শাস্তিও কমিয়ে এনে দশ বছর করা হয়। উল্লেখ করা দরকার যে ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আবু তাহেরের তিন ছেলে বিপ্লব, লাবু ও টিপু’র নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে অপহরণ করে। হত্যা করার পর তার লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নাটোরের আলোচিত সাব্বির আহাম্মেদ গামা হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ২০ জনের সাজাও মওকুফ করে দিয়েছিলেন। বিচার ব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা যেভাবে প্রয়োগ করেছেন তার জন্য তিনি নিন্দিত হয়েছেন। অপরাধী অপরাধ করেও যদি সাজা না পায়, কিম্বা সাজা পেলে সেটা যদি রাষ্ট্রপতি মাফ করে দেন, তাহলে বিচার তো আর বিচার থাকে না। যারা ন্যায়বিচার চেয়েছেন তাদের প্রতিও রাষ্ট্রপতি অবিচার করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিশাবে ক্ষমতার এই অপপ্রয়োগ দেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেবার ক্ষমতা আদৌ থাকা উচিত কিনা এমনকি সেই তর্কও উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের এই দৃষ্টান্ত রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থায় কালো অধ্যায় হিশাবেই বিবেচিত হবে।

রাষ্ট্রপতির মৃত্যু এই কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছে কিনা বলা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদেরই এখন নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। সংবিধানের ১২৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা বিধেয়। সে হিসাবে আগামী ১৯ জুনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে।

 


অপরাধী অপরাধ করেও যদি সাজা না পায়, কিম্বা সাজা পেলে সেটা যদি রাষ্ট্রপতি মাফ করে দেন, তাহলে বিচার তো আর বিচার থাকে না। যারা ন্যায়বিচার চেয়েছেন তাদের প্রতিও রাষ্ট্রপতি অবিচার করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিশাবে ক্ষমতার এই অপপ্রয়োগ দেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেবার ক্ষমতা আদৌ থাকা উচিত কিনা এমনকি সেই তর্কও উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগের এই দৃষ্টান্ত রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থায় কালো অধ্যায় হিশাবেই বিবেচিত হবে।

 

 


বলাবাহুল্য রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর কারনে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দায় একটা নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরী করেছে। এই সহিংস ও অস্থির সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কে হবেন সেটা সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে বলছেন এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য একটি সুযোগও বটে। অনেকের আশা এই যুযোগে তিনি এমন একজনকে নির্বাচিত করে আনতে পারেন যিনি সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। তবে তার কোন সম্ভাবনা দেখি না।

 

বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা সংসদীয়। রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তবে তফসিল ঘোষণাসহ এই নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। তাই রাষ্ট্রপতি কে হবেন জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতায় বহাল আওয়ামী লীগই তা ঠিক করবে। ওপরে যে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার কথা বলেছি যদি সেটা আমরা বুঝে থাকি তাহলে কে হবেন রাষ্ট্রপতি তার সিদ্ধান্ত নেবেন আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নাগরিক হিশাবে আমাদের আসলে রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র নিয়েই প্রথমে প্রশ্ন তুলতে হবে। সাংবিধানিক বিধিবিধান ও তর্ক বর্তমান বাস্তবতায় অর্থহীন। তারো আগে আমরা প্রশ্ন করতে পারি নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের আদৌ কোন নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা আছে কিনা। বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ, দেশকে দুই যুদ্ধমান পক্ষে বিভক্ত করেছে, আইনশৃংখলা বাহিনীকে তাদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত করেছে। বিরোধী পক্ষ এবং বিক্ষুব্ধ জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। বহু জেলার ওপর সরকারের সেই সময় কোন কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এখনও আছে কিনা সন্দেহ। এই ব্যর্থ সরকারের পক্ষে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আদৌ কোন নৈতিক বৈধতা আছে কিনা সেটাই বরং এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

স্বৈরতান্ত্রিক এরশাদ সরকারকে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করবার পর নব্বই দশকে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সেই সরকার ছাড়া পরবর্তী প্রতিটি সরকারের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারা দুই-আড়াই বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। দুই-আড়াই বছর পরে নির্বাচন হলে তারা পরাজিত হোত। বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যে সরকার গণ সমর্থন হারিয়েছে তাকে শুধু সাংবিধানিক নিয়মের কারনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এখতিয়ার দেওয়া রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন। এতে দেশ রাজনৈতিক ভাবে আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।

রাজনৈতিক দিক থেকে আরও একটি বড় সমস্যা আছে। জাতীয় সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। এই সংসদের মেয়াদ ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। পরবর্তী নির্বাচন শুরু হতে হবে এই বছর অক্টোবরের মধ্যে। এই সীমিত মেয়াদ নিয়ে জাতীয় সংসদ যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে তিনি নির্বাচিত হবেন ৫ বছরের জন্য। অথচ এই জাতীয় সংসদের সদস্যরা আগামি নির্বাচনে আদৌ নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন কিনা সেটাই সন্দেহের। অর্থাৎ জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে যারা রাজনৈতিক ভাবে জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি কিনা আমরা আগাম জানতে পারছি না। সেই দিক থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা বর্তমান জাতীয় সংসদের নাই। রাজনীতির সংকট সংবিধানের নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে কাটানো অসম্ভব। সংবিধানে নিয়ম আছে বলে এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে এই বিধান মেনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। তাছাড়া দলীয় সংকীর্ণ বিবেচনার বাইরে বর্তমান জাতীয় সংসদের পক্ষে কোন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা অসম্ভব। সে কারনে অনেকেই বলছেন সকলের কাছে গ্রহ্ণযোগ্য একজন রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনা নির্বাচিত করুক। সেটা এক অসম্ভব প্রত্যাশা মাত্র।

 


রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা বর্তমান জাতীয় সংসদের নাই। রাজনীতির সংকট সংবিধানের নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে কাটানো অসম্ভব। সংবিধানে নিয়ম আছে বলে এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে এই বিধান মেনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

 

 


বিরোধী দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঠিক কি ভূমিকা রাখবে স্পষ্ট নয়। তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করবার আন্দোলন করছে। দাবি করছে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করুক। ক্ষমতাসীনদের এই মুহূর্তে তারা প্রবল গণআন্দোলনের চাপের মধ্যে রেখেছে। এই চাপের মুখে ক্ষমতাসীন দল নানান গ্রুপে ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে শেখ হাসিনার পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের পথে নিয়ে যাওয়ার মানে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু সংবিধানের বিধিবিধান মেনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য করানো যাবে বলে মনে হয় না। বর্তমান জাতীয় সংসদ গায়ের জোরে একজন দলীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতেই পারে, কিন্তু তাতে রাজনীতি আরও জটিল হয়ে পড়বে।

 

ইতোমধ্যেই নানান গুজব ও অনুমানে রাজনীতির বাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছে। বলা হচ্ছে শেখ হাসিনাই নতুন রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে তাঁর পক্ষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া অন্য কোন ঝুঁকি নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাঁর আস্থাভাজন সাজেদা চৌধুরীকে রাষ্টপতি হিশাবে পেশ করা কঠিনই বটে। স্পিকার আব্দুল হামিদ তাঁর স্বপদেই থাকবেন। প্রধান মন্ত্রী হতে পারেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

জুন খুব দূরের সময় নয়। দেখা যাক কি হয়। কিন্তু আমরা বারবার যেকথা বলে আসছি সেই কথা আবারও বলব। যতক্ষণ না আমরা নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গড়বার সংকল্প না করছি ততক্ষণ জোড়াতালি দিয়ে চলাই সার হবে।

জোড়াতালি বা তাপ্পি মেরে কাজ চালিয়ে দেওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে, এটাই আশার কথা।

 

২৫ মার্চ ২০১৩। ১৪ চৈত্র ১৪১৯। শ্যামলী।

farhadmazhar@hotmail.com

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।