‘নারী নীতি’ নিয়ে বিভ্রান্তি


এক

হেফাজতে ইসলাম এপ্রিলের ৬ তারিখে ঢাকা শহরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে প্রশাসনের সঙ্গে ওয়াদা অনুযায়ী ঠিক ঠিক পাঁচটার সময় শেষ করে ফিরে গেছেন। ঢাকা শহরের মানুষ শাপলা চত্বরে এতো আলেম ওলামাদের একসাথে কখনো দেখে নি, তারা বিস্মিত। কত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন তা নিয়ে সঠিকভাবে কোন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও সংখ্যাটা তাক লাগিয়ে দেয়ার মতোই ছিল। হেফাজতের এই লং মার্চ যেন না হতে পারে তার জন্য সরকার নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল; ঢাকাগামী সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ করার পরও এতো মানুষ কি করে ঢাকায় এলো তা বিস্ময়ের ব্যাপার বটে।

হেফাজতের এই কর্মসুচী শেষ হয়েছে, তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরেও গেছেন, কিন্তু শেষ হয় নি তাঁদের নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা। তবে টেলিভিশনের টকশোগুলোর ধরণ পালটে গেছে। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে একজন হেফাজতের মুফতি আসছেন তাঁদের ১৩ দফা দাবীর ব্যাখ্যা দিতে, কিংবা একই মুফতিকে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে দৌড়াতে হচ্ছে অতিথি হয়ে।

হেফাজতের তেরো দফা বোঝা এবং বোঝানোর দরকার আছে। সেই দিক থেকে হেফাজতে ইসলামের পক্ষে গণমাধ্যমে মুফতিদের এই উপস্থিতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চ্যানেলগুলোর পক্ষ থেকে তাঁদের ডাকা হচ্ছে শুধু ১৩ দফা বোঝার বা বোঝানোর জন্য ভাবলে ভুল হবে। বরং অধিকাংশ সময় ডাকা হচ্ছে তাঁদের একটু হেনস্থা বা বেকায়দায় ফেলার জন্যে। তাঁরা যে চিন্তাচেতনায় সমাজের পশ্চাতপদ মানুষ এটা যে কোন ভাবে প্রমাণ করা অনেক গণমাধ্যমের জন্য   গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন আলেমকে ঘায়েল করার জন্য থাকছেন তিন চারজন বুদ্ধিজীবী, নারী নেত্রী এবং রাজনীতিবিদ। দর্শকরা উপভোগ করছেন এই আলোচনা।  টক শো যেন একটি খেলা। শো-এর পর দর্শকরা কে জিতলো, কে হারলো, এই তর্কে মাতে।  নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী খুশী বা অখুশী  হয় অনেকে।

তের দফা দাবী না মানলে কঠোর কর্মসুচীর ঘোষণা দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম। তের দফার দুটো দফাতেই নারীদের কথা আছে। হেফাজত নারীদের মধ্যযুগে ঠেলে দিচ্ছে বলে হায় হায় শুরু হয়ে গেছে অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে যাঁরা নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ মনে করেন, তাঁরা দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন।  

এর মধ্যে সাধারণ মানুষ একটু বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এই ঘটনা এ্মন এক সময় ঘটলো যখন একদিকে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলন চলছে, তাদের নেতা কর্মীরা জেলে; অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন গরম হয়ে আছে। একই সময় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নতুন মাত্রা যোগ করে দেশকে একেবারে তরমুজের মতো করে দুইভাগ করে ফেলেছে। কতিপয় ব্লগারের  মহানবী (সঃ)কে নিয়ে ভয়াবহ কটুক্তি করেছে। তাদের এই নাস্তিকতার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম সক্রিয় হয়ে ওঠে। যে কেউ নাস্তিক হতে পারে কিন্তু অন্যের বিশ্বাস, ধর্ম বা তাদের ধর্মের প্রিয় মানুষদের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও কদর্য ভাবে লেখালেখি করতে পারে না।

আমি যতদুর জানি, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইছে, কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকেও তারা গ্রহণ করতে পারছেন না। হেফাজতে ইসলাম ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের, বিশেষ করে যারা ধর্মের ও রাসুলেরও অবমাননা করেছে, তাদের শাস্তির দাবী নিয়ে এসেছে। শাহবাগ শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। কিন্তু এই একটি দাবীর পর এখন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা,এরপর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা,শেষে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা সহ শাহবাগের ছয় দফা নানাদিকে বিস্তারিত হয়েছে। হেফাজতে ইসলামও ব্লগারদের শাস্তির দাবী থেকে এখন নিয়ে এসেছে ১৩ দফা। তের দফার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবী।

দুই

শাহবাগের ৬ দফা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না, কারণ ধরে নেয়া হয়েছে এই সব দাবী নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। সরকারের মেনে নেয়ার ব্যাপার মাত্র। যা সরকার একের পর এক তাদের জন্য করে যাচ্ছে। যদিও ছয় দফা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। আমি হেফাজতের ১৩ দফা নিয়েই লিখছি, কিন্তু সব দফা নিয়ে নয়। শুধু নারী অধিকারের প্রশ্নের সাথে জড়িত দুটি দাবীর (দাবী নং ৪ ও ৫) বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।

হেফাজতে ইসলামের দাবীগুলোর ঢালাও বিরোধিতা করার কারণ আমি দেখি না। ব্যাপারটা বিরোধিতা বা পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবার বিষয় নয়। গ্রামীণ গণ মানুষের বিশাল একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের জায়গাগুলো নারী সমাজের বোঝা দরকার। তারা তাদের ক্ষোভ বিক্ষোভের কথাগুলো জানিয়েছে। এখন দরকার সেগুলো নিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশের সাথে একটা ব্যাপক আলোচনার আয়োজন করা। সেদিক থেকে নারী আন্দোলনের কর্মী হিশাবে যে সকল দাবি নারীর জন্য প্রাসঙ্গিক আমি শুধু সেই দাবিগুলো নিয়ে কিছু কথা তুলব। কিন্তু আমার ভয় হয় এই ডায়লগ, ব্যাপক কথাবার্তা বা আলোচনার জন্য যে সময় প্রয়োজন তা আমরা দিতে চাই কি না। একটি পক্ষ মনে করে দাবী আদায়ের সময় নির্ধারণ করে দিয়ে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই বলপ্রয়োগে সমাধান করতে হবে। অন্যদিকে এই দাবিগুলো ধর্মের মোড়কে ইসলামপন্থিদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে বলেই নারীদের প্রথম প্রতিক্রিয়াই নেতিবাচক হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে এর বিরোধী হতে হবে, এটাও কোন যুক্তি হতে পারে না। যে মোড়কেই আসুক মোড়ক খুলে মুল বিষয় নিয়ে আমাদের পরস্পর কথা বলতেই হবে। এখন সে সময় এসেছে। ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন নতুন কোন গল্প নয় যে নারীদের তা বোঝাতে হবে। সেটা করতে গিয়ে নারীকে কে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর বিপদও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বেগম রোকেয়া তা অনেক আগেই এইসব বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় যখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী মুক্তির নামে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা পুরুষতান্ত্রিক  অবাধ বাজারব্যবস্থা ও নারীকে পণ্যে রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই। আবার ধর্মীয় জায়গা থেকে তোলা  দাবিদাওয়া বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রাবারের মতো ক্রমাগত টানতে গিয়ে জেনে বা না জেনে  বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে থাকি।


ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন নতুন কোন গল্প নয় যে নারীদের তা বোঝাতে হবে। সেটা করতে গিয়ে নারীকে কে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর বিপদও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বেগম রোকেয়া তা অনেক আগেই এইসব বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় যখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী মুক্তির নামে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা পুরুষতান্ত্রিক  অবাধ বাজারব্যবস্থা ও নারীকে পণ্যে রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই। আবার ধর্মীয় জায়গা থেকে তোলা  দাবিদাওয়া বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রাবারের মতো ক্রমাগত টানতে গিয়ে জেনে বা না জেনে  বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে থাকি।


ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল, নারী সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের কাছ থেকে অনেক প্রতিক্রিয়া এসেছে। তাদের একটি সাধারণ বক্তব্য হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানলে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাবো। কেমন করে? সেটা কিন্তু কেউ পরিস্কার বলছেন না। প্রথমত মধ্যযুগ বর্তমান যুগের চেয়ে মন্দ ছিল কিনা সেটা একটা তর্কের বিষয়। দ্বিতীয়ত কেউ মধ্যযুগে যেতে চাইলেই কি যেতে পারবেন? আমার মনে হয় না। তৃতীয়ত আমরা একটি বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি, হেফাজতে ইসলাম বা আমরা কেউই এর বাইরে নই। ফলে হেফাজতে ইসলাম বিশ্বব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত আমাদের কোন এক ‘মধ্যযুগে’ ফিরিয়ে নিতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনা দেখছি না। বরং সমাজের গণমানুষের বিশাল একটি অংশ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কিভাবে দেখছে, কিভাবে সমালোচনা করছে এবং কিভাবে তার প্রতিকার খুঁজছে সেটা বুঝতে পারাই আমাদের প্রধান কাজ হতে পারে। আমাদের দরকার ধর্মীয় ভাষায় তোলা তাদের মুল বক্তব্য গুলো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, এবং কতটুকু অসম্ভব বা কেন সম্ভব নয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সুস্থ আলোচনার দিকে নেয়া্র চেষ্টা করা। তাদের দাবিগুলো আদৌ সমর্থন করা যাবে কিনা, কিম্বা কতোটুকু করা যাবে তার তর্কবিতর্ক কিভাবে হতে পারে সেইসব আলোচনা করা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারাই গ্রামের গরীব নারী-পুরুষদের কাছে একটি প্লাটফর্ম হিসেবে হাজির হতে পেরেছে। কাজেই একে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি ধন্যবাদ জানাই হেফাজতে ইসলামকে। কারণ প্রথম ১৩ দফা হাজির করার পর সমাজের প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা সাড়া দিচ্ছেন। তারা পত্রিকায় তের দফার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যখ্যা থেকেও আমি দফা ৪ ও ৫ নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ করতে চাই।

দফা নং ৪.ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

এই দাবীকে ভাগ করলে অন্তত তিনটি ভিন্ন দাবী তৈরী করা যেতো। যেমন ১. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা, ২. বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ এবং ৩. মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ।

অর্থাৎ এই ৪ নং দাবীটি পুরোটাই নারীদের বিরুদ্ধে নয়। মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের অংশটি বাদ দিলে থাকে  “বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ” অংশটি। এবং এই অংশটি নিয়েই চলছে বিতর্ক। আমার মনে হয় এই অংশটি হেফাজত বা কোন ইসলামী দলের কাছ থেকে না এসে যদি কোন রাজনৈতিক দল, কিংবা নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আসতো,আমরা একে স্বাগতই জানাতাম হয়ত। পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক নারী এই ধরণের সমস্যার শিকার হচ্ছেন, যা নারীকে পণ্য আকারে হাজির করছে। কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় এমন পথ বেছে নিয়েছেন, কিন্তু তাদের কারণে অধিকাংশ নারীদের ওপর অপবাদ আসছে। ফলে এই অবস্থা পরিবর্তন করা প্রগতিশীল নারীদেরও দাবী হতে পারে,এবং হয়েছেও। এর সাথে নারীদের ঘর থেকে বের হবার বা না হবার কোন সম্পর্ক নেই। হেফাজতে ইসলামের এই দাবী থেকে অনেকে ভেবে নিয়েছেন তাঁরা নারীদের ঘর থেকেই বের হতে দিতে চান না। নারীদের কাজ করা বা শিক্ষার সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। দেখা যাক, আল্লামা আহমদ শফি এই নিয়ে কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেনঃ      

দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারীজাতির সার্বিক উন্নতির বিকল্প নেই লক্ষ্যে তাদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থল, সম্মানজনক জীবিকা এবং কর্মজীবী নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে নারীদের ইজ্জত-আব্রু, যৌন হয়রানি থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক হিসেবে পোশাক বেশভূষায় শালীনতা প্রকাশ এবং হিজাব পালনে উদ্বুব্ধকরণসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; এবং একই লক্ষ্যে নারী-পুরুষের সব ধরনের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ অশালীন মেলামেশা, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহিংসতা, যৌতুক প্রথাসহ যাবতীয় নারী নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমন করতে হবে 

এই ব্যাখ্যায় আমি মৌলিকভাবে কোন সমস্যা দেখি না। তবে শুধু এটা যেন না হয় যে শালীনতার একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকবে, তার বাইরে অন্য পোষাক থাকবে না। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কিছু বিষয় হেফাজতে ইসলাম তুলে এনেছে, যা আমি এখানে উল্লেখ করলাম না। এ অভিযোগ সত্যি কিনা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কিছুটাও যদি সত্যি হয় তাহলে এমন প্রতিক্রিয়া আমরা ঠেকাতে পারবো না। আমরা কেউই কোন নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ  চাই না, এমনকি উন্নত বিশ্বেও চায় না। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন নয়, কারণ যে কোন সমাজে রুচির প্রশ্নেও একটা সামাজিক মানদণ্ড গড়ে ওঠে। সামাজিক মানদণ্ড  নিপীড়নমূলক হলে মেয়েরা অবশ্যই আপত্তি করবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করেই সামাজিকতা গড়ে ওঠে। শাহবাগ নিয়ে অন্য প্রশ্ন তোলা হলেও যে সব নারী সামনের কাতারে আছে তাঁদের পোষাক নিয়ে আপত্তি তোলার কোন জায়গা আমি দেখি না। আল্লামা আহমদ শফি বলছেনঃ “আমাদের কথা পরিষ্কার যে, হিজাব বা শালীনতার সঙ্গে নারীদের নিরাপদ পথ চলাচল, শিক্ষার্জন কর্মক্ষেত্রে যেতে কোনো বাধা নেই

তাঁদের আর একটি বক্তব্য নারীদের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য আলাদা বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ থাকতে পারলে আলাদা কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আপত্তি তোলার যুক্তি থাকতে পারে না’’ । এই দাবী কতখানি বাস্তব সম্মত হবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা নিজেরাও মনে করি প্রতিটি কর্মস্থলে নারীদের প্রয়োজনে কিছু আলাদা ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। বেশির ভাগ কর্মস্থল নারীকর্মীদের উপযোগী করা নয়। এবং সেটা হলে নারীরা কাজ করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন। কিন্তু আলাদা কর্মস্থল সম্ভব হবে কিনা সেটা আমরা তাদের বিবেচনা করতে বলতে পারি।  


আমরা কেউই কোন নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ  চাই না, এমনকি উন্নত বিশ্বেও চায় না। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন নয়, কারণ যে কোন সমাজে রুচির প্রশ্নেও একটা সামাজিক মানদণ্ড গড়ে ওঠে। সামাজিক মানদণ্ড  নিপীড়নমূলক হলে মেয়েরা অবশ্যই আপত্তি করবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করেই সামাজিকতা গড়ে ওঠে। শাহবাগ নিয়ে অন্য প্রশ্ন তোলা হলেও যে সব নারী সামনের কাতারে আছে তাঁদের পোষাক নিয়ে আপত্তি তোলার কোন জায়গা আমি দেখি না।


তাহলে দেখা যাচ্ছে, চার নম্বর দাবীতে নারীদের ঘরে ঢোকানো হচ্ছে না, বরং নারীদের সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে ইসলামের বয়ানে। এই প্রস্তাবে ভীত না হয়ে আমাদের দেখতে হবে নারীদের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখে নারীকে ভোগ্য পণ্য ভেবে যারা নির্যাতন করে, তাদের হাত থেকে আমরা কিভাবে মুক্ত হতে পারি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে কেউ ধর্মের নামে নীতির কথা বললে ঘাবড়ে যাই যে তাহলে বুঝি ধর্মীয় গোঁড়ামীর মধ্যে পড়ে গেলাম। ‘বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার’, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়, তবে প্রতিটি সংস্কৃতি ও সামষ্টিক মূল্যবোধ সামাজিক ভাবেই এই সকল বিষয় নির্ধারণ করে। আমি আল্লামা আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের অনুরোধ করবো এই বিষয়টি নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হোক, কোন আরোপিত নীতি হিশেবে নয়। শাসনের সুরে নয়। সমাজকে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আরও বিকশিত করে নেবার দায়িত্ব আছে সকলেরই। সেই দিক থেকে আলোচনা করলে তা ইতিবাচক হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীরা কাজ করছেন। মুসলিম নারীরা হিজাব পরে  কিংবা না পরেও শালীনভাবে কাজে যাচ্ছেন এবং নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন। তবে মনে রাখতে হবে, এ কথা কেউ হলফ করে এখনও বলতে পারবে না যে নারীর পোষাক পরিবর্তন হলে আপনা থেকেই ধর্ষণ বা যৌন হয়রানী বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়টির সাথে পুরুষদের মন মানসিকতা ও নারীর প্রতি ব্যক্তি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী জড়িত। এটা যতোদিন সামাজিক আন্দোলন করে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পরিবর্তন না করা যাবে ততদিন এই দুরাবস্থা চলতে থাকবে। তাছাড়া শালীনতা শুধু মেয়েদের বিষয় হতে পারে না। একই সঙ্গে পুরুষদের শালীন ও সংস্কৃতিবান হতে হবে। কিন্তু সেই দাবি হেফাজতে ইসলাম করে নি।

হেফাজতের সমাবেশে আসা নারী সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ দিয়ে অন্তত এটা মনে হয় যে নারীরা আশে পাশে থাকলেই পুরুষরা তাদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন। এবং সেটা ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষণে গিয়ে পর্যবসিত হয়। নাদিয়ার শারমিনের ক্ষেত্রে সৌভাগ্যক্রমে সেটা হয় নি, তবে তিনি অনেক বেশী আঘাত পেয়েছেন। এটাও শারীরিক আক্রমণ তবে ধর্ষণের মতো গ্লানিকর নয়। তার পোষাকে কোন অশালীনতা আমি দেখিনি। কিন্তু যারা আক্রমণ করেছেন তাদের কথা হচ্ছে শুধু-পুরুষদের একটি সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এসেছেন? নারীদের শালীনতার প্রশ্নই যদি প্রধান হয় তাহলে কোন্‌ ধরণের সভায় নারী যাবে আর কোনটাতে যাবে না সেটাও কি ঠিক করে দেয়া হবে? আমি মনে করি বিষয়টি এতো চরম নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না। সাধারণভাবে বললে নারীদের পোশাক সম্পর্কে আমাদের সামাজিক যে প্রধান বোধবুদ্ধি ও সচেতনতা তা নিজে থেকেই যথেষ্ট শালীন ও ভারসাম্যপুর্ণ।এই দিকটাকে আমলে নিয়ে হেফাজতের নেতা কর্মীদের সতর্ক থাকার দরকার আছে। যেকোন জবরদস্তি উলটা ফল বয়ে আনতে পারে।

মিডিয়া কর্মীদের উপর আক্রমণ নিন্দনীয়। আবার এমন ঘটনা শুধু হেফাজতের সমাবেশেই নয়, অতি আধুনিকদের গানের কনসার্টেও হতে দেখেছি আমরা। যেখানে শুধুই পুরুষ। একা নারীর ওপর আক্রমন কোন ধর্মীয় কারণে নয়, পুরুষতান্ত্রিক কারণেই হয়।


মিডিয়া কর্মীদের উপর আক্রমণ নিন্দনীয়। আবার এমন ঘটনা শুধু হেফাজতের সমাবেশেই নয়, অতি আধুনিকদের গানের কনসার্টেও হতে দেখেছি আমরা। যেখানে শুধুই পুরুষ। একা নারীর ওপর আক্রমন কোন ধর্মীয় কারণে নয়, পুরুষতান্ত্রিক কারণেই হয়।


হেফাজতে ইসলামের পঞ্চম দাবী “ইসলাম বিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক  স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা”। এখানেও একাধিক বিষয় টেনে আনা হয়েছে। আমি শুধু নারী নীতি প্রশ্নেই থাকতে চাই।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বাংলাদেশ সরকার কোন নারী নীতি ঘোষণা করেন নি, যেটা আছে সেটা হচ্ছে ‘নারী উন্নয়ন নীতি’। দাতারা যেভাবে বুঝেছে সেই দিক থেকে “উন্নয়নের” জন্যে নারীদের কোন্‌ কোন্‌ দিকগুলো প্রাধান্য দেয়া হবে তারই নীতি। কাজেই আমরা কোন্‌ নীতি নিয়ে বিতর্ক করছি তা আগে পরিস্কার থাকতে হবে।

তিন

womenpolicy

নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে ভাল করে বুঝতে হলে আমাদের এর পেছনের কথা জানতে হবে। এই নীতি প্রণয়নের সাথে নারী আধিকার প্রতিষ্ঠার সম্পর্কের চেয়ে নারী উন্নয়নের সম্পর্ক অনেক বেশী। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় দেশের নারী সংগঠনগুলো একসাথে কাজ করেছিল। আমরা নিজেরাও সেই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। এর একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতও রয়েছে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনের ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার অংশ হিশেবে এই নীতি প্রণীত হয়। তার আগে ১৯৭৯ সালে জাতি সংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) গৃহিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে চারটি ধারায় ২, ১৩(ক), ১৬(ক) ও (চ)সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুসমর্থন করে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ধারা ১৩(ক) এবং ১৬.১ (চ)সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হয়। ধারা ২ হচ্ছে রাষ্ট্র সমুহের সংবিধান ও আইন সমূহে নারী-পুরুষের সমতার নীতি অনুসরণ। ধারা ১৩(ক) পারিবারিক কল্যাণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ধারা ১৬ হচ্ছে বিবাহ ও সকল পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার; ১৬.১ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের ব্যাপারে পিতা-মাতার অধিকার, সন্তান গর্ভধারণে নারীর অধিকার ইত্যাদী মৌলিক বিষয়গুলো রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ১৩(ক) এবং ১৬.১(চ) প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৬.১(চ) -এ অভিভাবকত্ব, দত্তক গ্রহণ, ট্রাস্টশিপ ইত্যাদী ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারের কথা রয়েছে।

সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন  হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ সরকার, বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছিলেন বিএনপি সরকার; বেগম খালেদা জিয়া প্রধান  মন্ত্রী হিশেবে বেইজিং গিয়েছিলেন। তারই আলোকে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছেন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে। ২০০৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন ঘটায় এবং নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪ প্রণয়ন করে। আবার ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংশোধিত আকারে নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ প্রণয়ন করে। যদিও তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। কাজেই নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে সব সরকারই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। কারণ দাতাগোষ্ঠির কাছে নারী উন্নয়ন নীতি তাদের উন্নয়ন সহযোগিতার একটি অপরিহার্য অংশ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় অঙ্গীকার করলেও নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছে অনেক দেরীতে, ২০১১ সালে। প্রায় ৪১টি লক্ষ্য সামনে রেখে প্রণীত এই নীতিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করার কথা ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে আপত্তি তোলার মতো কিছুই নাই।

হেফাজতে ইসলাম নারী নীতি পুরোটার বিরোধিতার করছেন না, তাঁরা নারী নীতির ইসলাম বিরোধী ধারা বিলুপ্ত করতে বলছেন। আল্লামা আহমদ শফীর দেয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ “ত্যাজ্য সম্পত্তিতে সম-অধিকারের আইনসহ নারীনীতির পবিত্র কোরআন-সুন্নাহবিরোধী ধারাগুলোই আমরা সংশোধনের দাবি করছি”। হেফাজতে ইসলাম যদি সর্বশেষ নারী নীতি (২০১১) পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন নারী উন্নয়ন নীতির ২৫.২ ধারায় বলা হয়েছে “উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা”। এখানে অর্জিত সম্পদের ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে পরিচ্ছন্ন বা স্পষ্ট ভাবে কিছু বলা হয় নি। বলাবাহুল্য, এই দিকটি একটি বিষফোঁড়ার মতো সমস্যা হয়ে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রচুর আলোচনা তর্কবিতর্কের প্রয়োজন আছে।

আমরা দেখেছি, জোট সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি থেকে উত্তরাধিকার সম্পদ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল, পরে ২০০৮ সালের তত্ত্ববাধায়ক সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার শব্দটি না রেখে “স্থাবর ও অস্থাবর” শব্দ যোগ করা হয়। ২০০৮ সালে ওলামা মাশেয়খদের প্রতিবাদের কারণে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মুহাম্মদ নুরুদ্দিনকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। এ কমিটি ২০০৮ সালের নীতিমালার ১৫টি ধারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে তারা সিডও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেন (কালের কন্ঠ, ৭ মার্চ, ২০১০)।       


আমরা দেখেছি, জোট সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি থেকে উত্তরাধিকার সম্পদ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল, পরে ২০০৮ সালের তত্ত্ববাধায়ক সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার শব্দটি না রেখে “স্থাবর ও অস্থাবর” শব্দ যোগ করা হয়। ২০০৮ সালে ওলামা মাশেয়খদের প্রতিবাদের কারণে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মুহাম্মদ নুরুদ্দিনকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। এ কমিটি ২০০৮ সালের নীতিমালার ১৫টি ধারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে সিডও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত ধারাটি বাতিলের সুপারিশও করা হয়।


নারী উন্নয়ন নীতির ব্যাপারে ২০০৮ সাল এবং ২০১১ সালে ওলামা মাশায়খরা প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তাঁদের কথা দিয়েছেন যে কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন সরকার অতীতেও করে নি, ভবিষ্যতেও করবে না। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও বিভিন্ন সভায় বলেছেন কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করা হবে না। কিন্তু মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীণ শারমিন চৌধুরী ১৯৯৭ সালে নীতিমালা অনুযায়ী উত্তরাধিকার বিষয়টি নতুন নীতিমালায় পুনর্বহাল করেন। বলা বাহুল্য তিনি নারী সংগঠনের সাথে পরামর্শ করেই করেছেন।ফলে দেখা যাচ্ছে, নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকারের বিষয়টি সরকার আসলে কতখানি রাখছেন তা তাঁরা নিজেরাই নিশ্চিত নন। সরকার একদিকে নারী সংগঠন, অন্যদিকে ইসলাম পন্থীদের এ বিষয়ে অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন। নারী আন্দোলন মাঝখানে বিভ্রান্ত হয়েছে। যেটাই হোক, নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ পূর্ণাঙ্গ রূপে ঘোষিত হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয় নি।  

দেখা যাক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও ওলামা মাশায়েখরা নারী উন্নয়ন নীতির মধ্যে কোন ধারাগুলোকে কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী মনে করছেন। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মুহাম্মদ ইনাম উল হক এই ধারা গুলো চিহ্নিত করে লিখেছেন। তাঁর মতে ক. ১৬.১ বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে প্রণীত ও গণজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা আনা সম্ভব নয়। ক. ১৬.৮ নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করার বিষয়টিই পরিস্কার নয়। গ. ১৭.৪ বিদ্যমান সব বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করা এবং আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন বা কমিটিতে নারী আইনজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব কোরআন ও সুন্নাহ’র সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।           

হেফাজতে ইসলাম তাঁদের ১৩ দফায় এতো কথা বলেন নি, তাঁরা শুধু বলেছেন নারী নীতি ইসলাম বিরোধী। আমরা পত্র-পত্রিকায় আলেম সমাজের পক্ষ থেকে যে সমালোচনা দেখছি, হেফাজতে ইসলামও কি একই মতের কিনা তা আমরা জানি না। যদি হয়ে থাকেন তাহলে বলবো তাঁদের আপত্তি যেখানে সেটা নারী উন্নয়ন নীতিতে  খুব জোরালো ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। কিন্তু নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা যেভাবে করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নারীদের সকল প্রকার উন্নয়নের বিরুদ্ধে, যা তাঁরা নন বলেই ইতিমধ্যে বিভিন্ন আলোচনায় তারা পরিস্কার করেছেন। তাহলে তাঁদের উচিত হবে এই ব্যাপারে হেফাজতের নারী সংগঠন ও অন্যান্য নারী সংগঠনের সঙ্গে মত বিনিময় করা। নারী আন্দোলন যখন দাবী করে নারী নীতি সব নারীদের জন্যে, সেখানে হেফাজতের পুরুষদের মতামত ছাড়াও হেফাজতের নারীদের মতামত শোনাও আমাদের প্রয়োজন। অন্যদিকে নারী্রা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেই বাস্তবতাকে মনে রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা চিন্তার প্রভাবের কারণে নারী উন্নয়ন নীতির যেসব দিক আমাদের স্বার্থের প্রতিকুল বলে মনে হচ্ছে অবশ্যই সেগুলোর বিষয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ঢালাও ভাবে কোন কিছু বাতিল বা সমর্থন করা যাবে না।  

হেফাজতের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের বিতর্কিত সিডও সনদ বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক যে কোন সনদে পশ্চিমা দেশের চিন্তা চেতনার প্রাধান্য থাকবে এবং এর বিরুদ্ধে খোদ পশ্চিমা দেশের ধর্মীয় নেতারা শুধু নয়, আরও অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন, বিশেষ করে পোপ ও ভ্যাটিকানরা খুশি নন। তার অর্থ হচ্ছে শুধু ইসলামী ওলামারাই নন অন্যান্য ধর্মের পক্ষ থেকেও সিডও সনদ গৃহীত হচ্ছে না। সিডও সনদ সংক্রান্ত তর্ক যথেষ্ট জটিল বিষয়। তবে জাতি সংঘের সনদ হিশেবে ধরে নিয়ে নিজ দেশের প্রেক্ষাপটে কিভাবে গ্রহণ করা যায় সে আলোচনা অবশ্যই আমাদের করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ জরুরী।

আশা করি নারী নীতি নিয়ে এই সকল বিভ্রান্তি আমরা নারীদের মধ্যে আরও আলোচনার মধ্যে সমাধান করতে পারবো। তার আগে নারীদের দুই পক্ষ হয়ে পরস্পরের বিরোধী অবস্থান নেওয়া কৌশলগত ভাবে ভুল হবে বলে আমি মনে করি।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।