‘বেটার লেইট দেন নেভার’


বাংলাদেশের কয়েকজন সম্পাদক গত ১৮ তারিখে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, বন্ধ টিভি চ্যানেল ও আমার দেশ ছাপাখানা খুলে দেবার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হবার প্রায় ৪০ দিন পর এই বিবৃতি এলো। এই ৪০ দিনে অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে। তবুও একদমই কোন বিবৃতি না আসার চেয়েও দেরিতে আসাকে মন্দ বলা ঠিক না। সাহেবরা যেভাবে বলেন, ‘বেটার লেইট দেন নেভার’। আমরাও তাই বলি। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।

হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ লংমার্চ ও সমাবেশের পাঁচ দিন পর ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে সাদা পোশাক পরা পুলিশ। সে অনেক দিন হয়ে গেল, মাহমুদুর রহমানকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তিনি এই প্রথম গ্রেফতার হন নি, নির্যাতনও প্রথমবার নয়। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হলেন। আইনি অনুমতি নিয়ে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলাম। ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি’র পক্ষে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম আমরা। কোন নাগরিক যদি বিদ্যমান আইন লংঘন করে তাহলে সরকার তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু অভিযোগ সুনির্দিষ্ট এবং বিচার আইনানুগ হতে হবে। মাহমুদুর রহমানকে বানোয়াট অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু এই কারণেই সংবাদপত্রের সম্পাদকদের নীতিগত অবস্থান নেওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। অন্যদিকে শুধু প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য যদি সরকার কোন নাগরিককে নির্যাতন করে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই কুকাজে নিয়োজিত করবার জন্য অনায়াসে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় তখন সেটা রাষ্ট্রের আরও গভীর ও গুরুতর সংকটের লক্ষণ হিশাবেই হাজির হয়। এই ব্যবহার বর্তমান সরকারই করেছে তা নয়, এর আগের সরকারও করেছে। সকল ক্ষেত্রেই যেসব সম্পাদক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিশ্বাস করেন তাদের উচিত এই ধরণের অত্যাচার নির্যাতনে বিরুদ্ধে নিঃশর্ত ভাবে দাঁড়ানো। সেটা আমরা দেখি না। দুই একজন ব্যতিক্রম থাকতে পারেন, কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সাধারণ চরিত্রের প্রতিভূ নন। তাই সাধারণ ভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জগত দলবাজিতে বিভক্ত এবং কোন নীতিনৈতিকতার তোয়াক্কা করার সংস্কৃতি এই জগতে নাই।

... ... ...

মাহমুদুর রহমানের মতাদর্শ, রাজনীতি, কিম্বা সম্পাদকীয় চর্চার প্রশ্নে অনেকের সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের এখন মোকাবেলা করতে হচ্ছে এমন একটি সরকারের সঙ্গে যারা চিন্তা, বিবেক, মত এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা চরিত্রের দিক থেকে নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে অক্ষম শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে সেই অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগী। নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করবার প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যেকারণে বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর অনায়াসেই সরকার দমনপীড়ন করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যারা সরকারের পক্ষে যেকোন কারণেই হোক অবস্থান নিচ্ছেন তারা গণমাধ্যমের স্বার্থের বিপক্ষেই শুধু নয়, গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা এটাই প্রমাণ করছেন, চিন্তা, বিবেক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষাকে তাঁরা তাঁদের নৈতিক কর্তব্য মনে করেন না। এর জন্যই তাঁরা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে সে কর্তব্য এড়ানোর অজুহাত খাড়া করতে চাইছেন মাত্র। যারা একটি উদারনৈতিক মধ্যপন্থা অনুসরণ করেন তাঁরাও জানেন ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানকে সমালোচনা করে নিজের দায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা নিতান্তই সুবিধাবাদ ছাড়া কিছুই না। কারণ বাস্তবতা এমন যে এই ধরণের অবস্থান নিলে এক সুবিধাবাদী জায়গায় তারা থাকতে পারেন।

এই দুই ধরণের নীতি যাঁরা অনুসরণ করছেন তাঁদের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের বর্তমান অসুস্থ পরিস্থিতির হদিস জানাচ্ছে আমাদের। যাঁরা বিরুদ্ধ মত, চিন্তা ও রাজনীতি ধারণ করেন তাদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের মাত্রা ও চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রিক নীতিনৈতিকতার ভয়াবহ অবস্থা অনায়াসেই বোঝা যায়। সেই দিক থেকে মাহমুদুর রহমানের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন এই সরকার ও রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝার জন্য খুবই সহায়ক। এখন তাৎপর্যের দিকটা হলো, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার অর্থ ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানকে নয়, বরং যে নীতিনৈতিকতার বিকাশ ও সুরক্ষা ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব সেই নীতিনৈতিকতা রক্ষা। ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই গণমাধ্যমগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ভূমিকা দরকার। যদিও, বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের সমাজ বিভক্ত। যতক্ষণ না নিজের নাক কাটা যায় ততক্ষণ অন্যের রক্তক্ষরণ দেখে আমরা উল্লাস বোধ করি। সমূহ বিপদের চিহ্ন দেখার পরেও তার অর্থ উদ্ধার করতে অক্ষম হয়ে যাই। নিজেদের চিন্তাচেতনার বিকৃতি অনুভব করবার শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলি।

... ... ...

খেয়াল রাখা দরকার, ইউরোপের বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ‘মানবাধিকার’, ‘গণতন্ত্র’ ইত্যাদি ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। সেই বিশেষ ইতিহাসকে অদৃশ্যে রেখে বা আড়াল করে দিয়ে এই ধারণাগুলোকে সার্বজনীন বয়ান আকারে আজকাল হাজির করা হয়। সে কারণে নিপীড়িত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে এই ধারণাগুলোকে বিচারের দরকার আছে। সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখি বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তি হিশাবে বলা হয় যুদ্ধ ও সন্ত্রাস পরিচালিত হচ্ছে ‘মানবাধিকার’ বা ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করবার জন্য। আর মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দুষমণ হিশাবে হাজির করা হয় ইসলামকে। এর আগে দুষমণ ছিল কমিউনিজম। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ এই ধারনাগুলোকে যেভাবে ব্যাখ্যা ও ব্যবহার করে সেই ধারণা নিয়ে তর্ক আছে। তারপরও বাংলাদশের বাস্তবতা বিচার করে এই ধারণাগুলোর মর্ম সম্পর্কে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরী করা সম্ভব। বিরুদ্ধ, বিচিত্র ও পরস্পরের সঙ্গে ভিন্ন মত থাকলেও যে মর্মের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি। দুর্ভাগ্য আমাদের বাংলাদেশের গণমাধ্যম এই ধরণের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা ও সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে নি। দলবাজিতা বাংলাদেশেকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গিয়েছে।

তার পরেও হতাশ হওয়া ঠিক নয়। কারণ আমরা দেখেছি ঐক্যবদ্ধ ভাবে না হলেও মাহমুদুর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা ভিন্ন মত পোষণ করেন, কিম্বা তার সম্পাদকীয় নীতির সমালোচনা করেন তাদের অনেকেই মাহমুদুর রহমান ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ওপর সরকারের দমন-পীড়নকে নিন্দা করেছেন। অনেকে এটাও বলেছেন, মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে সরকার মামলা করেছে, তার সবগুলোই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় যে সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থেকে যদি আদালত বিচার সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি বেকসুর খালাস পাবেন। তাঁদের এই ভূমিকার প্রশংসা না করে পারা যায় না।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের সমর্থন নীতিগত মনে হয় নি। মনে হয়েছে, তাঁরা মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন, বিশেষত পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া এবং অবৈধভাবে ছাপাখানা সিলগালা করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যেন বাধ্য হয়েই সমালোচনা করছেন। না করতে পারলেই বুঝি বেঁচে যেতেন। অথচ এই নীতিগুলোর সমর্থন তো ‘যদি’, ‘কিন্তু’ ধরণের শর্তসাপেক্ষে হতে পারে না। নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান নিয়ে নিঃশর্তে দাঁড়ানোকে তাঁরা যেন মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দাঁড়ানো বলে গণ্য করছেন। যে কারণে এই অস্বস্তিকর কাজটি করতে গিয়েই নিজেদের সাফাই গাওয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন এবং বারবার, অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে, মাহমুদুর রহমানের রাজনীতি ও সম্পাদকীয় নীতির সমালোচনা করেছেন। এটাই যেন প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে অনেক দোষ থাকা সত্ত্বেও নিছকই করুণাবশত এবং নিজেদের ব্যক্তিগত মহত্ত্ব ও ঔদার্য প্রদর্শন করবার জন্য তারা মাহমুদুর রহমান ও দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের বিরোধিতা করছেন।

চিন্তা, বিবেক, মত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবার আগে তাঁদের নিজেদের সাফাই হিশাবে মাহমুদুর রহমানকে একই নিঃশ্বাসে সমালোচনা করতে হয় কেন? আমি সমালোচনার বিপক্ষে নই মোটেও। সমাজে যখন বিভিন্ন শ্রেণি ও মতাদর্শ আছে তখন প্রত্যেকেই যার যার শ্রেণি ও মতাদর্শের জায়গা থেকে সমালোচনা করবেই। মাহমুদুর রহমানের লেখা আমি যেভাবে পাঠ করেছি, তাতে বুঝি তাঁর কাছে ইসলাম শুধু ধর্ম বা বিশ্বাসই নয়, তিনি মনে করেন এর একটা সাংস্কৃতিক দিক আছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না। কিম্বা কলকাতায় গড়ে ওঠা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল হিশাবে জমিদারি ব্যবস্থার ঔরসেজাত শহরের ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির একমাত্র নির্ণায়ক নয়। এই উপমহাদেশে, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম গভীর ও সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ভূমিকা রেখেছে ও নানাভাবে নিজেকে ব্যক্ত করেছে। তাকে আমলে না নিলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না, পিছিয়ে পড়বে। একে আমলে নিয়েই নতুন গণশক্তি গঠন করতে হবে। এক দিকে ভাষা ও সংস্কৃতি আর তার বিপরীত দিকে ইসলামকে শত্রু হিশাবে খাড়া করে জনগণকে বিভক্ত তারাই রাখতে চায় যারা একটি অবিভাজ্য ও অখণ্ড শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশ বিকশিত হোক চায় না, যারা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। গোলকায়নের এই যুগে গণশক্তিকে রাষ্ট্রশক্তিতে রূপ দেওয়া জরুরী --এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক প্রশ্ন এদের কাছে কোন অর্থ বহন করে না। বরং তারা বাংলাদেশের জনগণকে সাম্রাজ্যবাদের গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। এর বিরুদ্ধেই মাহমুদুর রহমান একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব চান, যেখানে ইসলাম একটি নির্ধারক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর লেখাগুলোর মধ্যে এই কথাগুলো বারবারই এসেছে, তিনি তাঁর মত করেই কথাগুলো বলে যাচ্ছেন।

... ... ...

মাহমুদুর রহমানের অবস্থানের একটা সমালোচনা কিম্বা পর্যালোচনা অবশ্যই হতে পারে। তাকে সংকীর্ণ অর্থে ইসলামপন্থী বলে নাকচ করাই যায়। কিন্তু কোন অবস্থান থেকে নাকচ করা হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবস্থান থেকে নাকচ করার অর্থ হচ্ছে বর্ণবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষেই অবস্থান নেওয়া। এটাই অধিকাংশ সময় হয়েছে। যদি পাশ্চাত্য চিন্তা ও সংস্কৃতির কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁকে সমালোচনা করা হয়, তখন এই অনুমানই সক্রিয় থাকে যে পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা ‘আধুনিক’ সমাজ ও ইউরোপীয় ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রই দুনিয়ায় একমাত্র আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র। এই ক্ষেত্রে ইসলাম বা ইসলামের ইতিহাসের কাছ থেকে কিছুই শিক্ষা নেবার নাই, সেকারণে বাংলাদেশের জনগণ যে সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে চায় সেখানে ইসলামের কোন ছাপই থাকতে পারবে না। এমনকি তা সেকুলার হলেও না। যেমন, ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফের এমন ব্যাখ্যা তৈরী্র প্রক্রিয়াকে ইসলাম অবশ্যই অনুপ্রাণিত করতে পারে যা ইউরোপীয় চিন্তাচেতনার চেয়েও আরও অনেক অগ্রসর হতে পারে। ইউরোপকে অস্বীকার করেই সেটা হতে হবে, তাও নয়। বরং ইউরোপকে আত্মস্থ করেও সেটা হতে পারে। মওলানা ভাসানি তাঁর ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া’র যে ধারণা হাজির করেছিলেন তার গোড়ায় ছিল আল্লার একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেটা হচ্ছে মানুষসহ সকল প্রাণী ও সৃষ্টি জগতের প্রতিপালন। তাঁর দাবি ছিল, সকল প্রাণের প্রতিপালনই রাষ্ট্রের প্রধান ভুমিকা হওয়া উচিত। আমরা যখন বদ্ধমূল চিন্তায় বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী হয়ে ভাবি গ্রিকো-খ্রিস্টীয় সভ্যতাই মানবজাতির একমাত্র নিয়তি তখন তাকে ঔপনিবেশিক গোলামির চিন্তা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সেক্ষেত্রে তখন এটাও আগাম অনুমানে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে যেনবা পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার মধ্যে ধর্মের কোনই অবদান নাই, খ্রীষ্টধর্মের ইতিবাচক কোন ভুমিকা নাই। যেনবা এখনও পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোতে খ্রিস্ট ধর্ম কোন ভূমিকাই রাখছে না।

একটা উদাহরণ নেয়া যাক। এতে অনেকে অবাক বা লজ্জিত হতে পারেন। তবুও সদ্য সর্বোচ্চ আমেরিকান খেতাবপ্রাপ্ত প্রফেসর ইউনুসের পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার পুরা ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন। ওখানে দেখা যাবে, আমেরিকান রাষ্ট্রও ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় একটা (খ্রিস্টিয়) স্পিরিচুয়াল দিক বজায় রাখছে। ওখানে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভ এর নিয়োজিত চ্যাপলিন রেভারেন্ড প্যাট্রিক কনরয়ের পরিচালিত খ্রীষ্ট্রীয় গডের স্মরণে উপস্থিত সকলের ধর্মীয় সেবা দিয়ে। রাজকার্জে নিয়োজিত পাদ্রীদের চ্যাপলিন বলা হয়। আর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় আমেরিকান সিনেটের নিয়োজিত চ্যাপলিন ড. বেরি ব্লাকের পরিচালিত উপস্থিত সকলের মিলিত খ্রিস্টিয় গডের প্রতি দোয়া ও শুকরিয়া জানিয়ে। (এই লিঙ্কে ভিডিওটি দেখুন)

পশ্চিমের রিপাবলিক রাষ্ট্রতত্ত্বে নাগরিক ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বিকশিত নিরীক্ষা ধরা হয় আমেরিকার ফেডারল রাষ্ট্রকে। এখন এই প্রজাতন্ত্রকে কি বলব? খ্রীষ্ট্রীয় ধর্ম ইন্ট্রিগেড করে নেয়া আধুনিক রাষ্ট্র? সে যে যা খুশি ডাকনাম দিক। কিন্তু মুল বিষয়টা নজরে রাখতে আমরা যেন ভুল না করি ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক যতো সরল আমতা ভাবি ততো সরল নয়। মার্কিন ডলারে ‘“ইন গড উই ট্রাস্ট”’ লিখে রাখা স্রেফ পুরানা একটি ঐতিহ্য। ধর্ম যেভাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে ছাপ ফেলে তাকে অতো সরল ও সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো, শুধু রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় একটা ধর্মতাত্ত্বিক দিক বজায় রাখা হয় ব্যাপারটা এতো সিম্পলও নয়। আধুনিক রাষ্ট্র আসলে ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প থেকে আলাদা কিছু নয়। এই শেষের কথাটা বলেছিলেন কার্ল মার্কস। দার্শিনিক দিক থেকে ভাবলে এটাও ভোলা ঠিক না যে মানুষ স্রেফ জীব বা জন্তুজানোয়ার নয়, তার জৈবিকতার বাড়তি যে ব্যাপার তাকে আমরা স্পিরিচুয়াল বলে থাকি বটে তবে তা রহস্যজনক কিছু নয়। সেই বাড়তি দিকগুলো সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ রাষ্ট গঠনেরও ধর্মীয় বা স্পিরিচুয়াল দিক আছে।

... ... ...

এখন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের সেকুলারিজম বা সেকুলার রাষ্ট্রের ধারণা কোথা থেকে আসল তাহলে? এটা কি তাহলে এমন যে সেটা খ্রীষ্ট্রীয় হলে অসুবিধা নাই কিন্তু ইসলাম হতে পারবে না। আসলে পশ্চিমের ইসলামভীতির কারণে আমরাও ইসলাম আতংকে ভুগছি। পশ্চিমা সমাজ কি এপর্যন্ত এসেছে খ্রীষ্ট ধর্মের কোন অবদান ছাড়া? এখনও কি সমাজ ও রাষ্ট্রকে তারা খ্রিস্টিয় স্পিরিচুয়ালিটির আলখাল্লা দিয়ে আগলে রাখছে না?

অন্যের জিনিস কপি করা বা অ্ন্য সভ্যতার অভিজ্ঞতায় মনোনিবেশ বা ভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা দোষের তো নয়ই বরং গুরুত্বপুর্ণ অর্জন। কিন্তু গোলামি অথবা হীনমন্যতা কেন? । আমরা আসলে এখনও শিক্ষার যোগ্য ছাত্র হতে পারিনি, বড়জোর নকলবাজ গোলাম বলা যেতে পারে। একথাগুলো কোন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবার পক্ষে গল্প বা পুর্ব নির্ধারিত প্লট নয়। গোলামদের এমন মিথ্যা প্রোপাগান্ডা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক ভাবে ভাববার শর্ত তৈরীর জন্যই কথাগুলো বলা। আমি সবসময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলে এসেছি। বলে এসেছি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা। এই আলোচনা গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও সীমার ভিতরের আলোচনা। ইসলাম এর বাইরের কোন আসমানি বা আজগুবি ধারণা নয়।

বাংলাদেশের অবস্থা দাড়িয়েছে এই যে, পাশ্চাত্যের বাইরে ভিন্ন ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাও বুঝি অন্যায়, অপরাধ। আবার পাশ্চাত্যের ধারণাগুলোকে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভাবে বুঝবার হিম্মতও আমাদের হয় নি। বাংলাদেশে সেকুলারিজমের জন্য জানকবজ করা অদ্ভূত ধারণাটা আসলে ঘোরতর ইসলামবিদ্বেষ (নাকি আত্মবিদ্বেষ) আর গোলামের জাতবিদ্বেষ ছাড়া যে কিছুই নয় সেটাই ক্রমশ সাধারণ্যে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। ইউরোপের ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্যায়কে মানুষের সার্বজনীন ইতিহাস গণ্য করবার পেছনে দীর্ঘ বছরের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে তৈয়ার হওয়া মনমানসিকতাই শুধু কাজ করে না, এর পেছনে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও গভীর ভাবে কাজ করে। যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ নয়। বিশেষত পাশ্চাত্য শিক্ষা, পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামো এবং সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে পর্যালোচনা করবার হিম্মতের প্রয়োজন হয়। সেটা নিজের সঙ্গে নিজের দীর্ঘ লড়াইয়ের ব্যাপার।

... ... ...

এতোটুকু যদি আমরা বুঝি তাহলে বলাই বাহুল্য, সমাজে মাহমুদুর রহমানের চিন্তার সঙ্গে বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামোর সংঘাত আছে। তা স্পষ্টতই টের পাওয়া যায়। সেটা থাকা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু তাকে মোকাবিলার পথ হচ্ছে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে তর্কবিতর্কের পরিমণ্ডলকে সজীব ও সক্রিয় রাখা। উভয় পক্ষকেই এ ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এত পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও বল প্রয়োগ করে মাহমুদুর রহমানের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। এতে মাহমুদুর রহমান জিতেছেন, হারেন নি। তার দমন-পীড়নে যারা উল্লসিত হয়েছেন, বরং হার হয়েছে তাদের। ক্ষতির দিকটা হোল এই সকল বিষয়ে সমাজে আন্তরিক পর্যালোচনার পরিবেশ আমরা হারিয়েছে। যে লড়াই জারি থাকার কথা চিন্তা ও মতপ্রকাশের পরিমণ্ডলে, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পুলিশের পুলিশি তৎপরতার মধ্যে, আদালতে, কারাগারে এবং শারীরিক নির্যাতনে। এটা কোনভাবেই সমাধানের পথ নয়। চিন্তার ওপর আস্থা হারিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর বল প্রয়োগ করে যারা সমাধান খুঁজছেন তারা ভুল পথে গিয়েছেন। তারাই বাংলাদেশকে সহিংসতার দিকে নিয়ে গিয়েছেন।

যাঁদের হাতে পত্রিকা আছে তাঁরা যেকোন সময়ই মাহমুদুর রহমানের সমালোচনা করতে পারেন। করেনও। মতাদর্শিক বিরোধ ও তর্কবিতর্ক সামাজিক চিন্তার বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যদিও মিথ্যা প্রচার করতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। সারকথাটা হচ্ছে, বল প্রয়োগ করে অন্যায় ও বে-আইনি ভাবে একটি পত্রিকা বন্ধ করা এবং সম্পাদককে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন করার বিরুদ্ধে নিঃশর্ত ভাবে দাঁড়াবার নৈতিক হিম্মত তারা দেখাতে পারেন না কেন? কেন একই সঙ্গে শর্ত হিশাবে তাঁদের ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানকে সমালোচনা করে তার সঙ্গে তাদের নিজেদের পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়? জনগণকে তারা এতো বোকা ও অজ্ঞান ভাবেন কেন? অন্যের মতাদর্শ বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা এবং নিঃশর্ত ভাবে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পক্ষে দাঁড়াবার মধ্যে গুরুতর পার্থক্য আছে। মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পক্ষে দাঁড়ানো এবং কোন বিশেষ ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ানো এক কথা নয়। কিন্তু রীতিনীতির পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে এরা মনে করেন এই পক্ষপাত বুঝি ব্যক্তির পক্ষাবলম্বন, কিম্বা কোন ব্যক্তির নাগরিক অধিকারের প্রতি পক্ষপাত বুঝি তার মতাদর্শের প্রতিও পক্ষপাত। এই পক্ষপাত বিশেষ কোন ব্যক্তির পক্ষে চলে গেল কি না সেই ভয়েই সেই ব্যক্তিটিকে একই সময়ে এবং একই কণ্ঠে নিন্দা ও সমালোচনা যারা করেন সেটা আসলে তাদের নৈতিক হীনম্যতার লক্ষণ। কেন এই হীনমন্যতা?

আসলে বাংলাদেশের উচ্চকোটি সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বার্থ যারা রক্ষা করে তারা আজও ন্যূনতম সুশীল নৈতিক আচরণ রপ্ত করতে পারে নি। যাকে আমরা আরো সহজ ভাবে বুঝতে চাইলে বুর্জোয়া সংস্কৃতিও বলতে পারি। বাংলাদেশ (বুর্জোয়া) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে কেন গড়ে উঠতে পারছে না, এটা তার একটি কারণ অবশ্যই। এই ব্যর্থতার জন্য বেগম খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনাই প্রধান বা একমাত্র বাধা নয়। হীনমন্যতা ও নীতিনৈতিকতার ঘাটতি থেকে তৈয়ার হওয়া সুবিধাবাদ এবং সদা দোদুল্যমান পেটিবুর্জোয়া আচরণ ও সংস্কৃতিও সমান ভাবে দায়ী। সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অগ্রসর অংশ হচ্ছে সাংবাদিকেরা। বিশেষত পত্রিকার সম্পাদকেরা। অথচ এদের মধ্যেই গোলমাল দেখি। দুই-একজন ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশের মধ্যে ‘বুর্জোয়া’ চিন্তাভাবনার ঘাটতি বিস্মিতই করে আমাদের। অর্থাৎ পাশ্চাত্য অর্থে আধুনিকতাও এদের স্পর্শ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

... ... ...

মনে রাখা দরকার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিশাবে যে শ্রেণি দাবি করে ও কার্যকর দেখতে চায় তাদেরকেই শ্রেণি হিশাবে ইউরোপীয় ইতিহাসের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘বুর্জোয়া’ বলা হয়। এটা গালি নয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষা। সমাজ ও রাজনীতি বুঝতে পরিভাষাগুলো কাজে লাগে। বাংলাদেশে এই দাবির পক্ষে শক্তিশালী জনমত না থাকা এবং চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে না উঠাকে সমাজতাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশে বুর্জোয়া চিন্তার দুর্বল উপস্থিতির লক্ষণ বলে অনায়াসেই গণ্য করতে পারেন। বাংলাদেশে চুরি-ডাকাতি লুটপাটের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ধনী মানেই রাজনৈতিক অর্থে ‘বুর্জোয়া’ নয়। তাকে সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে লড়াই করে ও জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হয় নি। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করে সেই রাজনৈতিক বিজয়কে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হয় নি । সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে এদের মনোগঠন সামন্তীয় বা আধা সামন্তীয় বলা যায়। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা গণমাধ্যমের মালিকানা এই শ্রেণিরই হাতে। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া ধনপতিরাই বিভিন্ন গণমাধ্যমের মালিক। ধনসম্পত্তি নয়, আমি রাজনৈতিক চিন্তায় এদের গরীব দশার দিকে নজর দিতে বলছি। ব্যতিক্রম খুব কম। এই ধনপতিরা আবার তাদের নিজ সংকীর্ণ স্বার্থের গোলামি করবার জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদকর্মী নিয়োগ দেয়। পুঁজিতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির শ্রমবাজার থেকেই বেতনভোগী কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও এর পক্ষে প্রচার এই শ্রেণির কাছ থেকে আশা করা যায় না। বরং রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে এদের কাজ হয়ে ওঠে যে ব্যবস্থা নব্য ধনীদের দ্রুত ধনী করেছে সেই ব্যবস্থাকে আর্থ-সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে টিকিয়ে রাখা। এই সম্পর্কের অধীন হয়ে যে সকল সংবাদকর্মী কাজ করেন তাদের পক্ষে ন্যূনতম বুর্জোয়া নৈতিকতা ও সংস্কৃতি রপ্ত করা কঠিন। যদি সেটা সম্ভবও হয় তবে তা চর্চা করা আরো অসম্ভব। বরং সাংবাদিকতা জিনসটা কি, এর সাথে রাজনৈতিকতার সম্পর্কই বা কেমন, কি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সেগুলো শিখে ওঠা সম্ভব, এই প্রশ্নগুলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জগতের প্রশ্ন নয়। বরং সাংবাদিকতা বুঝে উঠবার আগেই সে বুঝে যায় চোরা মন্ত্রী উপদেষ্টাদের পিছনে স্কুপ খোঁজার নামে প্রপাগান্ডায় জড়ালে তাঁর মনিব খুশি হয়। উন্নতি হয়, কিন্তু সাংবাদিকতা আর শিখা হয় না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদকদের পক্ষে বুর্জোয়া নৈতিকতা ও সংস্কৃতি রপ্ত করা আরো কঠিন। এদেরই স্বার্থ ও চিন্তাচেতনার যারা প্রতিভূ তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও শাস্তি দেওয়ার পক্ষে নানান যুক্তি খাড়া করবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

অর্থাৎ যে নৈতিক হীনমন্যতার কথা বলছি তা শ্রেণিগত। এর আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই যে এই শ্রেণির কাজ সেটা অবশ্য অনায়াসেই বোঝা যায়। কিভাবে? এই শ্রেণি মনে করে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে কথা না বলা। এদের পত্রিকা পড়লে মনে হয় এই দুইজনকে কোন ভাবে সংলাপে বসিয়ে দিতে পারলেই বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কিম্বা সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকার গণমাধ্যম এবং নানান টকশোর মর্মবাণী এটাই।

অথচ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিশাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ও পরিগঠিত রূপ নিয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার নিজের নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈধতা অর্জনের জন্য শাহবাগের সমাবেশকে সফল ভাবে ব্যবহার করেছে। আবার তারই প্রতিক্রিয়া হিশাবে বাংলাদেশে সামাজিক শক্তি হিশাবে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের তত্ত্বগত ও সাংস্কৃতিক বয়ান হিশাবে যে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খাড়া করা হয়েছিল তার বিপরীতে শক্তিশালী ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। গণহত্যা, দমন-পীড়ন ও জেলজুলুম দিয়ে একে মোকাবিলা করা অসম্ভব। ফ্যাসিবাদ তার চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে একে চেনা এখন আর কঠিন নয়। ইসলামি রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পক্ষে যারা দাঁড়াচ্ছে তাদের জনগণ সহজেই চিনতে পারছে এখন। বাংলাদেশ ইসলাম প্রশ্ন এখন একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এক দিকে ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিপরীতে ধর্মকে প্রতিস্থাপন করে গত ৪২ বছর যে রাজনীতি গড়ে উঠেছে তাকে নতুন ভাবে ও খোলা মনে প্রশ্ন না করলে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নাই।

‘বাঙালি’ হিটলারের জর্মন জাতির মতো বিশুদ্ধ ‘আর্য’ জাতি নয়, এই অভাবের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরা পড়ে জাতীয়তাবাদের ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক বয়ানের মধ্যে, যার সঙ্গে যুক্ত করা হয় মুক্তিযুদ্ধকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরে ফ্যাসিবাদের জন্য সংগ্রাম করে নি, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ লড়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য। যে ফ্যাসিবাদী চার নীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আকারে হাজির করা হয় তার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা ও বৈধতা নাই। সেটা আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি হতে পারে, কিন্তু তার জন্য একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে নি। যে নীতির জন্য লড়াই হয়েছে তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই আছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় ফ্যাসিস্টদের কোন নীতিই অন্তর্ভুক্ত নয়। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে ইসলামের শক্তিশালী আবির্ভাবকে ফ্যাসিবাদের পর্যালোচনার আলোকেই বুঝতে হবে।

যারা বলছেন, মাহমুদুর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন, কোন সংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সংবাদ ছেপেছেন, কিম্বা বিদ্বেষপূর্ণ রিপোর্ট ছেপেছেন তাদের সঙ্গে এই সময় তর্ক অর্থহীন। সাংবাদিকতার দিক থেকে এই সকল কর্মকাণ্ড শনাক্ত করবার মানদণ্ড নির্ধারণ খুবই পুরানা একটি তর্ক। সমাজ যখন রাজনৈতিক ভাবে দ্বিধাবিভক্ত তখন কোন নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা সম্ভব কি না সেটাও তর্কের বিষয়। শাহবাগের সমাবেশ নিয়ে যারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছেন, একে বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে ক্রমাগত গৃহযুদ্ধের উসকানি দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ একটু হাস্যকরই শোনায়। তারা যদি দাবি করে উসকানির জন্য মাহমুদুর রহমানের শাস্তি হতে পারে, ঠিক একই ভাবে আমারদেশ বন্ধের উসকানি দাতাদের যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদেরও শাস্তি হতে পারে। তাদেরকে বলতে হবে, তারা কোন আইনগত ভিত্তিতে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য প্রকাশ্য জনসভায় উসকানি তৈরী করেছিলেন? যে মিডিয়া রাজনৈতিকভাবে পছন্দ নয় তাকে মোকাবিলার এটাই কি পথ? কালকে একই নিয়ম কি কেউ ষ্টার-প্রথম আলো গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না – এই নিশ্চয়তা তারা কোথা থেকে পান? এই কুতর্ক ও কূটতর্কগুলো বালখিল্যতা ছাড়া কিছু নয়। নিজেদের ভূমিকা তাদের নিজেদের কাছে অবশ্য ‘উসকানি’ মনে না হতে পারে, তবে এই উসকানির ফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী হতে পারে সেটা আর এখন অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এই কুতর্ক ও কূটতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের উচিত সমাজে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ককে ইতিবাচক অভিমুখে নেবার চেষ্টা করা। সমাজে নানান মতামত ধারণ করার করবার সংস্কৃতি অর্জনের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ার কাজে এগিয়ে যাওয়া যাবে। অন্য কোন ভাবে নয়।

যেসব পত্রিকার সম্পাদকেরা বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের দ্বিতীয়বার ধন্যবাদ জানাতে আমাদের আপত্তি থাকবার কথা নয়। তবে সকলে নৈতিক অবস্থান থেকে এই বিবৃতি দিয়েছেন সেটা ভাববার কোন কারন নাই। এপ্রিলের ২০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো ‘দৈনিক আমার দেশ ও প্যান্ডোরার বাক্স’ পড়ে সেটা আরো বেশি মনে হয়। সেখানে বলা হয়েছে, “আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ক্ষমতাসীন দলের এই সংবাদপত্র দলন কেবল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এক প্রচারপ্রিয় ব্যক্তির সম্পাদিত প্রচারধর্মী দৈনিকের টুঁটি চেপে ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভবিষ্যতের সরকারগুলো আর দশটা অপকর্ম অনুসরণের মতো সংবাদপত্র দলনের এই হাতিয়ারটিও ব্যবহার করতে চাইবে।” মাহমুদুর রহমানের প্রতি লেখকের বিষ তাঁর নামের আগে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিষাক্ত বিশেষণেই স্পষ্ট। ‘প্রচারপ্রিয় ব্যক্তির প্রচারধর্মী দৈনিক’ বেশ বিশেষণ। এভাবেই আমরা ব্যক্তিকে সমাজে হেয় করবার সংস্কৃতি চর্চা করি, এখান থেকেই অন্যেরা শেখে এবং যিনি এই ধরণের বিশেষণ ব্যবহার করছেন অন্য কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পুলকিত বোধ করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাংবাদিকতার রুচি নিয়ে তর্ক করব না। কিন্তু লেখাটির গুরুত্ব হচ্ছে এই সংবাদপত্রটি মনে করে যেভাবে দৈনিক আমার দেশ বন্ধ হয়েছে, ঠিক একই ভাবে ভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এলে একই কায়দায় দৈনিক প্রথম আলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পারে, যদি তাদের মতের সঙ্গে সরকারের না মেলে, কিম্বা পত্রিকাটির উসকানি সরকারের পছন্দ না হয় তাহলে একই হাতিয়ার সেই সরকারও ব্যবহার করতে চাইবে।

এই আশঙ্কা তো আসলেই আছে। এই সরকার তো চিরকাল থাকবে না। নাকি? এই ভয়েও যদি কোন সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে থাকেন তাঁকেও ধন্যবাদ জানাতে আমরা আপত্তি করব না। থ্যাঙ্ক ইউ।

২৬ মে ২০১৩, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২০ শ্যামলী

------

লেখাটি ছাপা হয়েছিল  দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ২৭ মে ২০১৩ তারিখে। এখানে কিছুটা পরিমার্জন করা হয়েছে, কিছুটা সম্প্রসারণও।

http://www.dailynayadiganta.com/?p=192630

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।