কামরাঙ্গীর চরে মাদ্রাসায় শিক্ষা বিপ্লবের সূচনা


আহমদ ছফার একটি পুরানা লেখা। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাবের কারনে কওমি মাদ্রাসা নানান দিক থেকে আলোচিত। সেই ক্ষেত্রে আহমদ ছফার এই পুরানা লেখাটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে আমরা এখানে তুলছি। বাংলাদেশের আলেম ওলামাদের প্রতি আহমদ ছফা সদয় ছিলেন, সন্দেহ নাই। তাঁদের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছেন একসময় এবং তাঁদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনবার জন্য যথেষ্ট কোশেশ করেছেন। তাঁর লেখার সেই স্বীকারোক্তি আছে। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেন নি। এর নানা কারন থাকতে পারে। যেমন, ‘রেঁনেসা’, ‘আধুনিকতা’, ‘আধুনিক শিক্ষা’ ইত্যাদির প্রতি তাঁর নির্বিচার পক্ষপাত তাঁকে আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল হয়ত। তিনি নিজেও সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, এই লেখাতে সেটা স্পষ্ট। শিক্ষাকে গণমানুষের দিক থেকে বিবেচনা ও বিচার করতে হলে শুরু করতে হবে তথাকথিত ‘আধুনিক’ শিক্ষার পর্যালোচনা থেকে, কওমি মাদ্রাসা থেকে নয়। ‘আধুনিক’ শিক্ষা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে ভূমিকা ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করে। তাকে বিচারের বাইরে রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘আধুনিক’ বা ‘যুগোপযুগী’ করার অর্থ হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাকে পুঁজিবাদী উৎপাদিন ব্যবস্থার জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিক বানাবার কারখানায় পরিণত করা এবং একইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বলয়ের অধীনে নিয়ে আসা। মাদ্রাসা শিক্ষার ‘সংস্কার’ দরকার, কিন্তু তারও আগে দরকার ‘আধুনিক’ শিক্ষার আমূল পরিবর্তন। যে-পরিবর্তন তরুণ প্রজন্মকে পুঁজির গোলামে কিম্বা সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় বরকন্দাজে পরিণবত করবে না। বরং গোলাম বানাবার বলয় থেকে কিভাবে মুক্ত করবে তার কার্যকর পথ দেখাবে। এই গোড়ার নিয়ত ঠিক না থাকলে কওমি মাদ্রাসার সংস্কার বা তাদের কারিকুলাম বদলাবার নীতি সমর্থন করার অর্থ হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নীতি বাস্তবায়ন করা।

এই তর্ককে আরও এগিয়ে নেবার জন্য এই লেখাটি আমরা পেশ করছি। -- সম্পাদনা বিভাগ ।

 ... ... ...

কামরাঙ্গীর চরে মাদ্রাসায় শিক্ষা বিপ্লবের সূচনা

আমি আলেম ওলামাদের সঙ্গে অনেকদিন থেকে সুসম্পর্ক রক্ষা করার চেষ্টা করে আসছি। সব আলেম ওলামারা আমাকে সহ্যও করেন না। সব মানুষ একরকম হয় না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি মৌলবাদী রাজনীতি যারা করে তাদের মধ্যেও স্বচ্ছ বিজ্ঞান-চিন্তার অধিকারী মানুষ আমি অনেক দেখেছি। প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক, কথা-বার্তায় অত্যন্ত বিপ্লবী এবং কেতাদুরস্ত তাদের মধ্যেও নচ্ছার মানুষ আমি কম দেখিনি। আমাদের দেশের মানুষ সাদাকে সাদা দেখে, কালোকে কালো। এই সাদা-কালোর মাঝখানে আরো যে কত রঙ থাকতে পারে সেইটা অনেক মানুষ ভাবতেও পারে না।

আমি আমার কথায় আসি। বাংলাদেশের সমাজে বিরাট একটা অংশ অনেককেই মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে আনন্দ পেয়ে থাকে। আমি তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করিনে। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ মধ্যযুগীয় এবং পশ্চাৎপদ, কিছুতেই একে মৌলবাদী বলা যাবে না। বাংলাদেশের সমাজে বিরাট একটা অংশ যদি মৌলবাদীই হয় সেখানে গত নির্বাচনে জামাতে ইসলাম মাত্র ৩টা আসন কেমন করে পায় ?

মোল্লা-মওলানাদের দিকে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকেন। তাদের সকলকে আমি ভালো মানুষ মনে করিনে। আবার আমি এ কথাও বলব না যে, মোল্লা-মওলানারা সবাই ভালো মানুষ। সকলে একমত হবেন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের মধ্যে মোল্লা-মওলানাদের অপ্রতিহত প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাবের অনেকখানি অংশেই আধুনিক যুগের জীবনধারার প্রতি অনুকূল এবং ইতিবাচক নয়। আমাকে আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যেকদের অনেকে অনেকদিন পর্যন্ত মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমার খারাপ লেগেছে তথাপি আমি বিস্মিত হইনি। এ ভদ্রলোকরা মনে মনে নিজেদের প্রগতিশীল ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই। আমি নানা বিষয়ে অল্প-স্বল্প পড়াশোনা করেছি। এ পড়াশোনা থেকে আমি এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি যে, এই দেশে একটি রেনেসাঁর মত ঘটনা যদি ঘটিয়ে তোলা সম্ভব না হয় তাহলে এই জাতি, এই সমাজের মুক্তি অসম্ভব।


মোল্লা-মওলানাদের দিকে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকেন। তাদের সকলকে আমি ভালো মানুষ মনে করিনে। আবার আমি এ কথাও বলব না যে, মোল্লা-মওলানারা সবাই ভালো মানুষ। সকলে একমত হবেন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের মধ্যে মোল্লা-মওলানাদের অপ্রতিহত প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাবের অনেকখানি অংশেই আধুনিক যুগের জীবনধারার প্রতি অনুকূল এবং ইতিবাচক নয়। আমাকে আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যেকদের অনেকে অনেকদিন পর্যন্ত মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমার খারাপ লেগেছে তথাপি আমি বিস্মিত হইনি। এ ভদ্রলোকরা মনে মনে নিজেদের প্রগতিশীল ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই। আমি নানা বিষয়ে অল্প-স্বল্প পড়াশোনা করেছি। এ পড়াশোনা থেকে আমি এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি যে, এই দেশে একটি রেনেসাঁর মত ঘটনা যদি ঘটিয়ে তোলা সম্ভব না হয় তাহলে এই জাতি, এই সমাজের মুক্তি অসম্ভব।


আমাদের দেশের মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন অত্যন্ত সংকীর্ণ তাদের সৃষ্টিকর্মও সেরকম নিকৃষ্ট। নিজেদের স্বার্থের বাইরে এই শ্রেণীর এক চুল অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা নেই। শব্দবন্ধ হিসেবে ‘রেনেসাঁ’ শব্দটি তাদের অত্যন্ত প্রিয় বটে, কিন্তু তাদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে রেনেসাঁর সামান্যতম উপাদানও নেই। তারা ভালবাসতে অক্ষম, যে কারণে তাদের ঘৃণা করতে হয়। ঘৃণা করে তারা এমন একক ধরণের চিত্তসুখ খুঁজে পায়। যাদের ঘৃণা করছি তাদের চাইতে আমরা অনেক উৎকৃষ্ট প্রাণী। মুখ্যত এই মানসিকতা থেকেই বাংলা নাটকে, সিনেমায় অপরাধী এবং খল চরিত্র দেখাতে হলে একজন দাঁড়িওয়ালা টুপি পরা মানুষকে হাজির করানো চাই। যে সমস্ত মানুষ নিজদের উৎকৃষ্ট প্রজাতি হিসেবে ভেবে থাকেন তারা ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকে বিজ্ঞানচিন্তা সহায়ক একটা বিষয় বলে ধরে নিয়ে থাকেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে আস্তিক মানুষ যেমন আছেন তেমনি নাস্তিকও রয়েছেন। কেউ ধর্ম মানেন, কেউ মানেন না। ধর্ম মানা হোক, কিংবা না-মানা হোক তাতে বিজ্ঞানের কিছু আসে যায় না। বিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিষয়। সুশৃঙ্খল চিন্তা এবং সুশৃঙ্খল পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানের উদ্ভব। যে ধরণের প্রণোদনা এবং চিত্তবৃত্তি বিজ্ঞানের বিকাশে প্রোৎসাহিত করে সেই জিনিসটিকে বেগবান না করে অজ্ঞ, কৃসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের সঙ্গে বিবাদ বাঁধানোকেই অনেকে বিজ্ঞানের পক্ষের কাজ বলে পুলকিত বোধ করে থাকেন। বিজ্ঞান চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। সেই জিনিসটি সূচনা না করে বেহুদা উল্টা-পাল্টা বিজ্ঞানের সপক্ষে কথা বলে বিজ্ঞানের কোন উদ্দেশ্যই সাধন করা যাবে না। এই প্রক্রিয়াটি যদি শুরু করা যায় তাহলে শত বাধার মুখেও তার গতি অবরুদ্ধ হবে না।

আমি একটু পেছনের দিকে যাব, আমি জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সারাদেশের তরুণদের মধ্যে আমাদের যথেষ্ট সমর্থক ছিল। শেখ সাহেবের সময়, জিয়ার সময় এমনটি পরবর্তীকালেও এ রাজনীতিতে বিশ্বাস করার কারণে আমাদের অনেক কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে, কারা ভোগ করতে হয়েছে এবং আরো নানা ধরণের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। যে নির্বাচনটিতে বিচারপতি সাত্তার বিএনপি’র প্রার্থী হয়েছিলেন সে নির্বাচনে দেখা গেল, খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা মোহাম্মাদ উলাহ হাফেজ্বী হুজুর জাসদ প্রার্থী মেজর জলিলের চাইতে তিনগুণ বেশি ভোট পেয়েছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল দেখে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। খেলাফত আন্দোলনের বিশেষ কোন রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না এবং তাদের সাংগঠনিক দিকটিও ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তা সত্ত্বেও যখন হাফেজ্বী হুজুর এত বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে গেলেন আমি তার কারণটা খুজে বের করতে চেষ্টা করলাম। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাওলানা সাহেবের সাথে দেখা করলাম, তার ঘনিষ্ঠ ভক্তদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলাম।

আমার দীর্ঘকালের মেলামেশার পর খেলাফত আন্দোলনের এই শক্তি এবং জনপ্রিয়তা তার প্রকৃত উৎস কোথায় সে বিষয়ে পুরোপুরি না হলেও একটা ভাসা ভাসা ধারণা আমি গঠন করতে পারলাম। ইংরেজ রাজত্বের শুরুর দিকে ওহাবিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ যুদ্ধ করে গেছে। সে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের জয় হয়েছে, কিন্তু ওহাবিরা অন্তর থেকে সে পরাজয় মেনে নেয়নি। তাঁদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জঙ্গী-চেতনা জিইয়ে রাখার জন্যে তারা ‘দেওবন্দ’ নামক জায়গায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল। সাহারানপুর, জৌনপুর এবং দিল্লীসহ ভারতের নানা প্রান্তে এ প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করেছিল। প্রায় আড়াই লাখ ওহাবি নানাসময়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। মাওলানা আজাদ সোবাহানি, যিনি স্বায়ত্তশাসনের বদলে পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি উপস্থাপন করে মহাত্মা গান্ধীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলেন - তিনিও ছিলেন একজন ওহাবি তরিকার মানুষ।


আমার দীর্ঘকালের মেলামেশার পর খেলাফত আন্দোলনের এই শক্তি এবং জনপ্রিয়তা তার প্রকৃত উৎস কোথায় সে বিষয়ে পুরোপুরি না হলেও একটা ভাসা ভাসা ধারণা আমি গঠন করতে পারলাম। ইংরেজ রাজত্বের শুরুর দিকে ওহাবিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ যুদ্ধ করে গেছে। সে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের জয় হয়েছে, কিন্তু ওহাবিরা অন্তর থেকে সে পরাজয় মেনে নেয়নি। তাঁদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জঙ্গী-চেতনা জিইয়ে রাখার জন্যে তারা ‘দেওবন্দ’ নামক জায়গায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল।


ওহাবিদের সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করার অবকাশ এই নিবন্ধে নেই। হাফেজ্বী হুজুরের রাজনীতির যারা সমর্থক ছিলেন তারা সকলেই ছিলেন ওহাবি তরিকার মানুষ। বাংলাদেশের ওহাবিদের সংখ্যা অল্প নয়। তাদের সংহতিবোধ অত্যন্ত দৃঢ়। তারা ছেলেদের দেওবন্দ তরিকা অনুসারে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মাদ্রাসা ছাত্র রয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি ওহাবিদের দ্বারা পরিচালিত। এ সকল কওমি মাদ্রাসা সমাজের ধর্মপ্রাণ এবং ধনাঢ্য মানুষের দান-অনুদান এবং তাঁদের টাকায় চলে। তাঁরা সরকার থেকে কোন প্রকার মঞ্জুরি কিংবা অনুদান গ্রহণ করেন না।

এখন আমার কথা বলি। হাফেজ্বী হুজুরের লোকজনের সঙ্গে আমার একটা বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি হল। আমি তাঁদের মাথাওয়ালা লোকদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম তারা একটি সুপ্রাচীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী ধারার অনুসারী। তাদের সঙ্গে আধুনিক ধারায় যারা বিপ্লব করতে চান তাদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রথমে আমার প্রস্তাব শুনে অনেকে বারুদে আগুন লাগার মতো জ্বলে উঠেছিলেন, ‘আপনি কমিউনিস্টদের কথা বলছেন, কমিউনিস্টরা ধর্ম মানে না, আলাহ-রাসুলের শক্রু, ওদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয় কি করে?’ আমি ধৈর্য্য না হারিয়ে চেষ্টা করে যেতে লাগলাম।

একই প্রস্তাব প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছেও রাখি। তারাও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। দাঁড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা মধ্যযুগীয় মোল্লা-মৌলভীদের সঙ্গে কিছুই করার নেই। ভূতের পা যেমন পেছনের দিকে, মোল্লা-মওলানারাও অতীতের দিকে যেতে চায়। আমাদের যা কিছু করার তা করতে হবে তাদের পরাজিত করে।

আমাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমিতে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং হাফেজ্বী হুজুরসহ খেলাফত আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একই ডায়াসে আনতে সক্ষম হই। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এ রচনায় আমি আরেকটা বিষয় স্পর্শ করতে চাই। মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে এখন অনেকেই কথাবার্তা বলছেন। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং এক ধরনের শিক্ষানীতি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবর্তন করার দাবিও উত্থাপন হচ্ছে, এটা অযৌক্তিকও নয়। কিন্তু যে সমস্ত মাদ্রাসা সরকার থেকে কোন অর্থ গ্রহণ করে না, সরকারের কাছে কোন রকম জবাবদিহি করে না, তাদের ক্ষেত্রে এ নীতি কার্যকর কিভাবে করা হবে। জোর করে তো একটা বিষয় চালু করা যায় না। সেজন্য আমি অনেক দিন থেকে বলে আসছি জোর করার বদলে বোঝানোর নীতি গ্রহণ করা হোক, কওমি মাদ্রাসার যারা জিম্মাদার রয়েছেন তাদেরকে ডেকে বোঝানো হোক, আপনারা যে শিক্ষা ব্যবস্থাটি কার্যকর রেখেছেন, এই সময়ের মধ্যে সেটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দোযখের ভয় দেখিয়ে এবং বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে এ যুগে মুসলমানদের কোন উপকার করা সম্ভব নয়। যেখানে মানব সাধারণের কল্যাণ নেই সেখানে মুসলমান সামাজেরও কোন কল্যাণ থাকতে পারে না। আপনারা নিজেরাই যুগের দাবিটা মেনে নিন, নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে শিক্ষাক্রম সংস্কার করতে এগিয়ে আসুন। এই দেশকে একটি ভাল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মক্ষম এবং বিবেকবান মানুষ সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, এই পন্থাটি অনুসরণ করা হলে অনেক বেশি সুফল পাওয়া যেত। মওলানা সাহেবদেরও আমি একইভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আপনারা দ্বীন-দুনিয়া শব্দটির সঙ্গে পরিচিত আছেন। দুনিয়া শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল পরিবর্তন। দুনিয়া এক জায়গায় বসে থাকে না। তার মধ্যে নিত্য নিত্য পরিবর্তন সংঘটিত হয়। এ পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করাই হল প্রকৃত শিক্ষার কাজ। আপনারা যদি মধ্যযুগীয় ধরন-ধারণ, সংস্কার আঁকড়ে বসে থেকে মনে করেন ধর্মের সেবা করছেন, আপনারা নিজেদেরই প্রতারিত করবেন। ইসলাম একথা বলেনি। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ছাড়া এ যুগের জীবনব্যবস্থা অচল। এগুলো আপনাদেরকে বুদ্ধি, শ্রম, মেধা এবং সময় দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। কেউ ভয়ানক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন- আপনি ইসলামের লোক, বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদেরকে ইহুদি-নাছারাদের দিকে টেনে নিতে চেষ্টা করছেন। আমি মানুষকে বিশ্বাস করি। মানুষের উপর অটল বিশ্বাস রাখা ছাড়া কোন ধর্মের মহৎকর্ম সম্ভব নয়। মাদ্রাসার প্রতি আধুনিক শিক্ষিত অহংপুষ্ট লোকদের মত আমার বিরূপ ধারণা নেই। কিন্তু আমার বেদনাবোধ আছে। বাগদাদ নিজামীয়া মাদ্রাসা এক সময় সমস্ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল। নিশাপুর, খোরাশান, হাডোবা, টলেডো, ইত্যাকার মাদ্রাসাসমূহে এক সময়ে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হয়েছিল তার উত্তাপ থেকেই সম্ভাবিত হয়েছে আধুনিক ইউরোপের রেনেসাঁ। আবার অক্সফোর্ড, ক্যাম্বব্রিজ, হাইডেলবার্গ-ইউরোপের এই সকল সম্ভ্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু ধর্মতত্ত্বই শিক্ষা দেয়া হত। সুতরাং আমাদের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে পরিবর্তন আসবে না বা পরিবর্তন আনা অসম্ভব সেটা আমি বিশ্বাস করি না।


মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং এক ধরনের শিক্ষানীতি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবর্তন করার দাবিও উত্থাপন হচ্ছে, এটা অযৌক্তিকও নয়। কিন্তু যে সমস্ত মাদ্রাসা সরকার থেকে কোন অর্থ গ্রহণ করে না, সরকারের কাছে কোন রকম জবাবদিহি করে না, তাদের ক্ষেত্রে এ নীতি কার্যকর কিভাবে করা হবে। জোর করে তো একটা বিষয় চালু করা যায় না। সেজন্য আমি অনেক দিন থেকে বলে আসছি জোর করার বদলে বোঝানোর নীতি গ্রহণ করা হোক


আমি এ রচনার প্রায় শেষাংশে এসে গেছি। গত নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখের দিকে মরহুম হাফেজ্বী হুজুর প্রতিষ্ঠিত কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসা থেকে একটি নিমন্ত্রণপত্র পাই, পত্রের বয়ান ছিল এরকম - ‘আমরা এই প্রতিষ্ঠানটিতে আধুনিক কৃৎ-কৌশল এবং ভৌতবিজ্ঞানের নানা বিষয়ক শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি প্রবর্তন করে একটি জামেয়া তথ্য আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিক করতে চাই। আগামী ১৯ তারিখের ইসলামি সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণাটি দিতে চাই। এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আপনি যদি আসেন এবং আমাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দান করেন। আমরা খুবই উপকৃত হব এবং কৃতজ্ঞ থাকব।’

এই সংবাদটি আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং আমি প্রতিরোধ করেছিলাম। অনুভব করেছিলাম একটা পরিবর্তনের হাওয়া আসতে শুরু করেছে। মানুষের উপর বিশ্বাস রেখে কাজ করতে গেলে ঠকার সম্ভাবনা নেই। সমস্ত প্রাণীর মধ্যে মানুষই হচ্ছে সবচাইতে পরিবর্তশীল। কিন্তু পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সূচনা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আমি আমার জুনিয়র বন্ধু রতন বাঙালিকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় সোজা হাজির হয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে দেখি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শরীরে আতর মেখে হাজির হয়েছেন। সভার কথা বিশেষ বলব না। মওলানা সাহেবরা সচরাচর যেসব কথা শুনতে চান, বাইরের লোকেরা গিয়ে সেসব কথা শোনায় তাদের মধ্যে জজবা ছুটে যায়। আমি কিছু সাদামাটা এবং প্রয়োজনীয় কথা বলেছিলাম। আমার আনন্দ এ কারণে যে, মওলানা সাহেবরা আমার হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে আমাকে সভাগৃহ থেকে বের করে দেননি, বরং এক ঘন্টা ধরে আমার অপ্রিয় বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। আমি নিশ্চিত ভেতর থেকে একটা পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। প্রশ্নটা সুদক্ষ নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার এবং ভালবাসার। বিশ্ববিদ্যালয় একটা গালভরা শব্দ। আমাদের দরকার শিশুদের স্কুল, কিশোরদের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আজ রয়েছে। প্রাইমারি স্কুল, মিডেল স্কুল এবং টেকনিক্যাল স্কুলের প্রয়োজন তার চাইতে অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। টাকা দিয়ে আসবাবপত্র কেনার মত করে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আত্মা থাকতে হয়। ইটা, কাঠ, লোহালক্কড় দিয়ে ইমারত বানালে সেখানে আত্মা সঞ্চার হয় না। কামরাঙ্গীর চরের নরম মাটি ভেদ করে হঠাৎ একটা বিশ্ববিদ্যালয় জেগে উঠবে এমন অসম্ভব প্রত্যাশা আমাদের নেই। অন্তত আগামী ১০ বছরের মধ্যে যদি সেখানে একটা কার্যকর টেকনিক্যাল উন্সটিটিউট গড়ে ওঠে আমি সেটাকেই রীতিমত বিপ্লব বলব। উদ্যোক্তাদের মাথায় যখন ধারণাটি এসেছে একসময় তাতে অবশ্যই রক্ত-মাংসে জোড়া লাগবে। একটা মাদ্রাসা যদি পরিবর্তনের পথে ধাবিত হয় অন্য সকল মাদ্রাসাও মধ্যযুগের মধ্যে নোঙ্গর ডুবিয়ে বসে থাকতে পারবে না।

২৯ অক্টোবর, ১৯৯৮

... ... ...

এছাড়া পড়তে পারেন:

শিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার রাজনীতি

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।