মিশরের রাজনীতি ও নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা


মিসরের সেনাবাহিনী জুলাইয়ের ৩ তারিখে সংবিধান স্থগিত ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মরসিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। যুক্তি দিয়েছে বিরোধী দলের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমঝোতা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সমঝোতার একটা প্রস্তাব শেষ মুহূর্তে মরসি দিয়েছিলেন, কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনী একই সাথে অধৈর্য বাকভঙ্গীতে হুমকি দিয়ে বলেছে, গণমাধ্যম ও বিরোধী শক্তি মোকাবিলার জন্য এক বছরই যথেষ্ট। একটি নির্বাচিত সরকারকে তার পূর্ণ মেয়াদ পালন করতে না দিয়ে মোহাম্মদ মরসির বিরোধীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজসে সেনা অভ্যূত্থান ঘটানোর যে পথ গ্রহণ করেছেন তা মিশরের জনগণের জন্য আত্মঘাতী পথ। বলাবাহুল্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মরসির পক্ষে বিক্ষোভ চলছে। মানুষ প্রাণ দিচ্ছে। সেনাবাহিনী বিক্ষোভ দমন করতে নামাজ পড়া অবস্থায়ও মোহাম্মদ মরসির পক্ষাবলম্বনকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়েছে। সেনা অভিযানে কমপক্ষে এ পর্যন্ত ৭০ জনেরও অধিক মরসি সমর্থক শহিদ হয়েছেন। এর পরিণতি কী দাঁড়াবে সে সম্পর্কে গণকগিরি না করে মিশরের ঘটনাঘটন থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য শিক্ষণীয় কিছু দিক এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব। শুরুতে সারমর্মে কিছু কথা।

[এক]

মোহাম্মদ মরসির পতনে সেকুলারিস্ট এবং উদারপন্থিরা দারুন উল্লসিত। উল্লসিত ব্রাদারহুড বিরোধী ভিন্ন ধারার ইসলামপন্থিরাও। তারা তাহরির ময়দানে মরসি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছিল। মোহাম্মদ মরসির স্বল্পস্থায়ী এক বছরের শাসনামলের যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাবার যথেষ্ট কারণও আছে এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থিরা ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেই শেষমেষ হাত মেলালো। এমনকি নির্বাচনবাদী ও রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে মধ্যপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে পারল না।

অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রমাণ করলো পাশ্চাত্যের কাছে নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করবার জন্য তারা শুধু নির্বাচনী কৌশলটা গ্রহণ করতে রাজি, কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও শরিয়া আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ। এর বিপজ্জনক দিক হচ্ছে এতে প্রমাণিত হয় নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থি রাজনীতি মুখে যাই বলুক তাদের আসল নীতি হচ্ছে গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য জরুরী গণতান্ত্রিক রূপান্তর আরও পিছিয়ে দেওয়া। মিশরের নতুন সংবিধানের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধীদের আপত্তি প্রধানত এই জায়গায়। এই আপত্তি নাকচ করা কঠিন।

মিশরের অভিজ্ঞতা থেকে এই সংশয়ও আরও প্রবল হবে যে ইসলামপন্থি রাজনীতি এখনও পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক ফলাফল ও রাষ্ট্র গঠনের মর্ম ও কাঠামোর অসম্পূর্ণতা ও স্ববিরোধিতার কোন সমাধান দেবার যোগ্য হয়ে ওঠে নি। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও রূপের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করে সেটা সম্ভব নয়। বরং তাকে অতিক্রম করে যাবার সংকল্পের মধ্যেই একালের ইসলামপন্থি রাজনীতিসহ যে কোন ইতিহাস-সচেতন রাজনীতির সম্ভাব্য বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভূমিকা নিহিত রয়েছে। এখন অবধি দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ইসলামি রাজনীতি অন্য সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিয়ে শুধু মুসলমানদের জন্য বড়জোর শরিয়া আইন ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এই কালে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অসম্পূর্ণ ও স্ববিরোধী রাষ্ট্রের ধরণে ও মর্মে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এই রাজনীতি এখনও অর্জন করে নি। এই ক্ষেত্রে আদৌ কোন সমাধান দিতে পারে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ইসলামি রাজনীতির ভবিষ্যৎ। যেমন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পর্যালোচনা ও তাকে অতিক্রম করে যাবার পথ অনুসন্ধানের জন্য ইসলামের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণার বিকাশ, ব্যবহার ও প্রয়োগ । সে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদেই এই ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটবে। আর ঠিক এই ধারণার বিকাশ ঘটানোর জন্য যেমন, ঠিক তেমনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে আরও তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্যই ‘গণতন্ত্র’ দরকার। গণতন্ত্রই রাজনীতির শেষ মঞ্জিল নয়। তবে মিশরে দেখা যাচ্ছে ব্রাদারহুড মিশরের জনগণের জন্য যে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান উপহার দিয়েছে ব্রাদারহুড সমর্থক ছাড়া মিশরের জনগণ তা গ্রহণ করে নি। অথচ তাদের ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার এটাই ছিল সর্বোচ্চ রূপ।


অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রমাণ করলো পাশ্চাত্যের কাছে নিজেদের গণতন্ত্রী প্রমাণ করবার জন্য তারা শুধু নির্বাচনী কৌশলটা গ্রহণ করতে রাজি, কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও শরিয়া আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ। এর বিপজ্জনক দিক হচ্ছে এতে প্রমাণিত হয় নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থি রাজনীতি মুখে যাই বলুক তাদের আসল নীতি হচ্ছে গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য জরুরী গণতান্ত্রিক রূপান্তর আরও পিছিয়ে দেওয়া। মিশরের নতুন সংবিধানের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধীদের আপত্তি প্রধানত এই জায়গায়। এই আপত্তি নাকচ করা কঠিন।

জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল-সিসি মোহাম্মদ মরসিকে অপসারণের ঘোষণা যখন টেলিভিশানে দিচ্ছিলেন মরসি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক প্রভাবশালী নেতারা তার পাশে ছিলেন। যেমন বিরোধী দলীয় নেতা মোহামেদ আল-বারাদেই, আল আজহার মসজিদের শেখ, সালাফি ইসলামপন্থি নুর পার্টি এবং কপটিক খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের প্রধান।

সেনাবাহিনী মরসিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় তাহরির ময়দানে আনন্দ আর উল্লাস দেখা গিয়েছে। তাহরিরে একবার আমরা দেখেছিলাম হোসনী মোবারকের দীর্ঘ সেনা সমর্থিত স্বৈরশাসনের অবসানে বিজয়ের আনন্দ, আর এবার দেখছি গণভোটে নির্বাচিত একটি সরকারকে সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে বলে উল্লাস। এ ঘটনা থেকে এই সিদ্ধান্তই বেরিয়ে আসে যে সেকুলারিস্ট ও উদারবাদীরা ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজের কান কিম্বা নাক নির্লজ্জ ভাবে কেটে ফেলতে রাজি। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর দূরে থাকুক, নিদেনপক্ষে জনগণের ভোটে নিজেদের সরকার নিজেরা নির্বাচনের যে-অধিকার মিশরের জনগণ বহু বছরের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে খানিক অর্জন করেছে তাকে সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থীরা বিসর্জন দিতে রাজী। অন্যদিকে ইখওয়ানুল বা ব্রাদারহুড বিরোধী ইসলামপন্থি দল ও বিভিন্ন প্রবণতা -- বিশেষত সালাফি আল নুর পার্টি -- নিজেদের ‘ না ঘরকা না ঘাটকা’ প্রমাণ করবার জায়গায় চলে গিয়েছে । তারা সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থীদের বিরোধী, অথচ ইসলামপন্থী রাজনীতির স্বার্থে মোহাম্মদ মরসির সঙ্গে কোন সমঝোতা করে নি। হাত মিলিয়েছে তাদের শত্রু ও সেনাবাহিনীর সাথে। যে কারণে অনেক বিশ্লেষক বলছেন ভারি বিচিত্র মিশরের এই সেনা অভ্যূত্থান! এমনকি অনেকে একে সেনা অভ্যুত্থান বলতেও নারাজ। কারন তাহরীর ময়দানে ব্রাদারহুড বিরোধীদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে সাড়া দিয়েই সেনাবাহিনী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মরসিকে ক্ষমতাচ্যূত করেছে। এটা তো ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণেরই (?) বিজয়। বাংলাদেশে দৈনিক প্রথম আলোও বাংলাদেশে এই তত্ত্বটাই ফেরি করছে। তারা মিশরের আল আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামাল গাবালাকে দিয়ে বিশেষ ভাবে তাদের পত্রিকার জন্য এই তত্ত্বতাই লিখিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে প্রচার করছে। ( দেখুন, কামাল গাবালাকে দিয়ে প্রথম আলোর প্রচার ‘এটা কোন ক্যু নয়’, ৯ জুলাই ২০১৩)। হয়তো আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির সম্ভাব্য কোন পরিণতি আন্দাজ করে এই প্রচার জরুরী হয়ে পড়েছে।

মিশর ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। কিন্তু এই ধরণের প্রচারের বিপদ হচ্ছে যে-সীমিত নির্বাচনী অধিকার প্রয়োগ করে মধ্যপন্থী নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থী ধারা সমাজে নিজেদের চিন্তা ও মতামত প্রচার করে এবং সরকার ও রাষ্ট্র গঠনে লিবারেল রাজনীতির নিয়ম মেনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চায় তার বিরোধিতা করা। সেকুলারিস্ট ও উদারবাদী আধুনিকেরা সেই সীমিত সুবিধাটুকুও ইসলামপন্থীদের দিতে নারাজ। এর পরিণতি দাঁড়ায় সংঘর্ষ ও বিপুল প্রাণহানিতে। মিশরেও তাই হয়েছে। এই প্রাণহানির শেষ কোথায় দাঁড়াবে আমরা জানি না। বাংলাদেশেও এই সুবিধাটুকু ইসলামপন্থি রাজনীতিকে না দিতে পারার পক্ষে জনমত রয়েছে। শুরুতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে যদি তা আমরা মানি, তাহলে ইসলামপন্থিদেরও বুঝতে হবে সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থীদের উদ্বেগের জায়গাটা কোথায়। এ কারনে মিশরের ঘটনাবলী বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

[দুই]

মোহাম্মদ মরসি নির্লিপ্ত শাসক ছিলেন না, নিজেও সেটা স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর বিরোধী পক্ষের সমালোচনাকে তিনি দমন করেন নি, তাদের কথা বলার অধিকারও তিনি কেড়ে নেন নি। । বিরোধীপক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে সঙ্গত সমালোচনা যেমন করেছে তেমনি প্রচার প্রপাগান্ডাও কম চালায় নি। কিন্তু দেশ চালাবার ব্যবহারিক ভুলভ্রান্তি রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরের দিক। মিশরে আসলে কি ঘটেছে তা বুঝতে হলে দৃশ্যমান ঘটনাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে।

মিসরে হোসনি মোবারক সরকারের পতন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রে কোন গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটে নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও দেখা গেছে মোহাম্মদ মরসি তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ আহমদ শফিককে খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। আহমদ শফিক ছিলেন হোসনি মোবারকের অধীনে শেষ প্রধান মন্ত্রী। মরসি পেয়েছিলেন ৫১.৭ ভাগ ভোট আর আহমদ শফিক ৪৮.৩ ভাগ। অর্থাৎ পুরানা প্রতিষ্ঠানগুলো অক্ষত রেখে দেবার রাজনৈতিক শর্ত মিশরে হাজির ছিল। হাজির আছে। হোসনি মোবারক না থাকলেও তার আমলের সুবিধাভোগী ও সমর্থকরা মিশরে রয়ে গিয়েছিলেন শক্তিশালী ভাবেই।

সেনাবাহিনী ১৯৫২ সাল থেকে যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছিল মরসি তা বহাল রেখেছিলেন। এবারের নির্বাচনে পার্লামেন্ট তথা গঠনতন্ত্র অনুমোদনের সভায় ব্রাদারহুড সদস্যরাই নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন, পার্লামেন্টে তাঁদেরই প্রাধান্য ছিল। এই প্রাধান্যের জোরে সমাজের অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় নেবার বদলে উপেক্ষা করার নীতি ব্রাদারহুড নিয়েছিল। খসড়া সংবিধান বানোনোর গঠন প্রক্রিয়াও ছিল জটিল। যেমন নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা সবাই সংবিধান সভার সদস্য হবেন না। ওদের থেকে ১০০ জন নেয়া হবে আনুপাতিক হারে আর রাষ্ট্র গঠন সভার বাকি সদস্যদের ৩০ ভাগ প্রেসিডেন্টের দ্বারা বাছাই করা। ফলে প্রফেশনাল, টেকনোক্রাট ও নারীদের প্রতিনিধিত্বসহ সমাজের অন্যান্য অংশের অংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত হবে সে প্রশ্ন উঠেছিল। ব্রদারহূডের সদস্যরাই নতুন সংবিধানের খসড়া করেছিলেন এবং মরসি তাকে সমর্থনও করেছিলেন। কিন্তু সেই সংবিধানে সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্র-বহির্ভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেমন মিলিটারি ট্রাইবুনালে বেসামরিক নাগরিকদের বিচার করবার সাংবিধানিক ক্ষমতা। বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী রাষ্ট্র থেকে পাওয়া অর্থ কোথায় কিভাবে খরচ করবে তার জন্য পার্লামেন্ট বা জনগণের কাছে জবাবদিহি করার দায় থেকে সেনাবাহিনী মুক্ত ছিল। একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল এমন ভাবে গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল যেখানে সেনাবাহিনীরই প্রতিনিধিত্ব বা আধিপত্য বহাল থাকে। সেই জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলকে যে কোন খসড়া আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দেবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানের ভূমিকায় (preamble) ২০১১ সালের গণবিক্ষোভে সেনাবাহিনীর ‘অবদান’ আছে স্বীকার করা হয়েছিল।


মিশরে গণআন্দোলন ও গণবিক্ষোভ কোন বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় নি। রাষ্ট্র ক্ষমতা গণ অভ্যূত্থানের নায়কদের দ্বারা গঠিত কোন বিজয়ী আন্দোলনের সংস্থার হাতে আসে নি। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে-সংস্থা গণ অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই স্বাভাবিক গতিতে অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকারের রূপ পরিগ্রহন করে। মিশরে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে গিয়েছিল সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী শ্রেণি ও শক্তিগুলোর হাতে। ক্ষমতা চর্চার তিনটি প্রতিষ্ঠানগুলোও থেকে গিয়েছিল মোবারক আমলের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর কব্জায়। বিশেষ ভাবে তিনিটি প্রতিষ্ঠান এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যঃ পুরানা ১. সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস ২. সুপ্রিম কনস্টিটিউশিনাল ও জুডিশিয়াল কাউন্সিল আর ৩. সুপ্রিম নির্বাচন পরিচালনা কাউন্সিল।

এই পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নতুন সংবিধান সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অর্থাৎ গণ আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের পরে একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের যে ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও সংকল্প মিশরীয় জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে মোহাম্মদ মরসি তাকে রূপ দিতে পারেন নি। বরং তার বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। মরসির সরকারের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ করছিলেন তারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসী ও সহিংস কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলেন।

মিশরে গণআন্দোলন ও গণবিক্ষোভ কোন বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় নি। রাষ্ট্র ক্ষমতা গণ অভ্যূত্থানের নায়কদের দ্বারা গঠিত কোন বিজয়ী আন্দোলনের সংস্থার হাতে আসে নি। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে-সংস্থা গণ অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই স্বাভাবিক গতিতে অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকারের রূপ পরিগ্রহন করে। মিশরে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে গিয়েছিল সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী শ্রেণি ও শক্তিগুলোর হাতে। ক্ষমতা চর্চার তিনটি প্রতিষ্ঠানগুলোও থেকে গিয়েছিল মোবারক আমলের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর কব্জায়। বিশেষ ভাবে তিনিটি প্রতিষ্ঠান এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যঃ পুরানা ১. সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস ২. সুপ্রিম কনস্টিটিউশিনাল ও জুডিশিয়াল কাউন্সিল আর ৩. সুপ্রিম নির্বাচন পরিচালনা কাউন্সিল। ক্ষমতা ও ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠান কমবেশী অটুট রেখেই নির্বাচনী হাওয়া উঠে গিয়েছিল। মোবারক পতন ঘটবার পর ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ার পরিস্থিতিতে কৌশলগত কারণে নির্বাচন চাওয়া ভুল পদক্ষেপ ছিলনা, যদি গণ আন্দোলনের অসম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্দোলনের শরিক পক্ষগুলোর মধ্যে কোন নীতিগত ঐক্য গড়ে উঠত। বিদ্যমান ক্ষমতা ও ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠানের জায়গায় কী ধরণের ক্ষমতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে সেই বিষয়ে কোন ঐক্যমত হোসনি মোবারক বিরোধী তাহরীর ময়দান তৈরী করতে পারে নি। এই অবস্থায় পুরানা ক্ষমতা ও ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে না ফেলার বিপদ মাথায় নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাহরীর ময়দানে আন্দোলনসূত্রে একত্রিত হওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবণতা, দল ও গোষ্ঠির মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বিভক্তির রাজনীতির চর্চা উস্কিয়ে দেওয়া। সেনাবাহিনীও সে কাজটাই করেছে।

সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিলের হাতে রাষ্ট্রের মূল নির্বাহী ক্ষমতা থেকে গিয়েছে। পুরানা সংবিধান বাতিল হয়নি। পরে নিজের সুবিধা সুযোগ মত মিলিটারী কাউন্সিল সংবিধান বাতি্ল করেছে। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কাউকে মিলিটারি কাউন্সিলে অন্তর্ভূক্তির ঘোষণা করার আগের মুহূর্তে সংবিধান বাতিল বলে ঘোষণা দেওয়া হয় যাতে পুরান সংবিধানে প্রদত্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা মরসি চর্চা করতে না পারেন। সংবিধান বিহীন পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কনস্টিটিউশানাল ও জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নিজস্ব ক্ষমতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দিয়ে সেই শক্তির বলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কি তা নির্ধারণ করবার ও সীমা বেঁধে দেবার সুযোগ নেয় সেনাবাহিনী। আর ওদিকে সুপ্রিম নির্বাচন পরিচালনা কাউন্সিল নির্বাচনের আইন কোনটা, কী তার ব্যাখ্যা, এমনকি নির্বাচিত হয়ে যাবার পরও পার্লামেন্টকে অবৈধ বলে রায় দিয়ে তা বাতিল ঘোষণা করতে পেরেছে। নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘটে যাবার পরও তা আইনসিদ্ধ হয়নি এই যুক্তিতে তা বাতিল করে রাখা হয়েছে। এই তিনটি পুরানা ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান পরস্পরের যোগসাজশে গত আড়াই বছর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এইসব চালিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রায় কান ধরে উঠবস করার ক্ষমতা চর্চা করে গেছে তারা। আর মুল ক্ষমতা আজও নিজের হাতেই রেখে দিয়েছে।

হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে মোবারকের পতন ঘটে এবং তিনি কায়রো ত্যাগ করেন। মিশরের সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা চলে আসে। সুপ্রিম কাউন্সিল অব দ্য আর্মড ফোর্সেস-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন তানতাবি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটা ক্ষমতার কোন আইনী হস্তান্তর (de jure) নয় ঘটনার নিজস্ব পরিণতি (de facto)। সেনাবাহিনী ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয় এবং সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করে। ডিসেম্বরের ১৫ ও ২২ তারিখে দুই দফায় রাষ্ট্র গঠন সভায় (Constituent Assembly) গৃহীত নতুন খসড়া গঠনতন্ত্রের (Constitution) ওপর ‘রেফারেন্ডাম’ বা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হোসনি মোবারকের পতনের পর মিশরের রাষ্ট্রকে নতুন করে গঠন করবার দরকারে রাষ্ট্র গঠন সভা ৩০ নভেম্বর ২০১২ তারিখে যে খসড়া গঠনতন্ত্র (Constitution) অনুমোদন করেছে নাগরিকরা তাতে সম্মত কিনা।একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় মাত্র ৩২.৯ ভাগ ভোটার রেফারেন্ডামে অংশ গ্রহণ করে এবং পক্ষে ভোট দেয় ৬৩.৮ ভাগ ভোটার। যারা নতুন গঠনতন্ত্রের পক্ষে তারা দাবি করছিল মিশরের স্থিতিশীলতার জন্য নতুন গঠনতন্ত্র ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বিরোধী পক্ষের বক্তব্য ছিল গঠনতন্ত্র মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতে দুষ্ট এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত ভাবে রক্ষা করে না।সালাফিরাও নতুন গঠনতন্ত্রের খসড়া নাকচ করেছিল।তাদের বক্তব্য হচ্ছে শরিয়া আইনের ভিত্তিতেই গঠনতন্ত্রের খসড়া করা উচিত ছিল,কিন্তু সেটা হয় নি।এটা আরেক চরম অবস্থান। অন্যদিকে সেকুলার ও উদারপন্থিরা রাষ্ট্রগঠন সভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল,তাদের অভিযোগ নতুন সংবিধান শরিয়া ও ইসলামি চর্চাই মিশরের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে,যা গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই ধরণের খসড়া গঠনতন্ত্রের ওপর রেফারেন্ডাম হোক সেটা মিশরের জনগণের বিশাল একটি অংশ চায় নি।মুসলিম ব্রাদারহুডের একচেটিয়া আধিপত্যে ও মতাদর্শে প্রভাবিত গঠনতন্ত্রই রেফারেণ্ডামে গৃহীত হোল। ২৪ জুন ২০১২ মোহাম্মদ মরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।

এতে দুটি দিক স্পষ্ট বোঝা যায়: এক. হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, নেটওয়ার্ক, নাগরিক সমাজ কিম্বা ছোট খাট নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা রাজনৈতিক প্রবণতা রাস্তায় এবং তাহরীর ময়দানে একসঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করেছে ঠিকই, কিন্তু লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে পরস্পরকে জানা ও বোঝার কোন প্রক্রিয়া গড়ে উঠেছে বলে প্রমাণ মেলে না। কোন প্রক্রিয়া যদি গড়ে উঠে থাকে তবে তার কোন আশু ফল আমরা দেখি না। দুই. শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর দেখিয়ে ও গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে নতুন গঠনতন্ত্রে যান্ত্রিক ভাবে ধারণ করা যায় না। চিন্তা ও মতের পার্থক্য, বিরোধ ও বৈচিত্র বহাল রেখে কী ধরণের গঠনতন্ত্র (Constitution) মিশরের জনগণকে এক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিতে বা একই রাষ্ট্রে শামিল রাখতে পারে সে ব্যাপারে মিশরে কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ উপলব্ধি গড়ে ওঠে নি। দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সমাজকে আন্দোলিত করানো ছাড়া শুধু দলীয় রাজনীতি দ্বারা যা অর্জন অসম্ভব। মিসরের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী কী ধরণের রাষ্ট্র মিশরের জনগণের জন্য জরুরী এবং তার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত তৈরীর প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি কি হবে সেই সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে । ফলে রাষ্ট্রের ধারণা রয়ে গিয়েছে যার যার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শ অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে দমন করবার হাতিয়ার হয়ে। যেমন, সেকুলারিস্টরা এমন রাষ্ট্র চায় যাতে ইসলামপন্থিদের শায়েস্তা করা সহজ হয়, আর ইসলামপন্থিরা চায় এমন একটি ইসলামি রাষ্ট্র যাতে তারা সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থীদের দমন করতে পারে। নির্বাচন, গঠনতন্ত্র সভা গঠন, গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, রেফারেন্ডাম ইত্যাদি সকল স্তরে এই বিভেদের বীজই মাথা উঁচু করে থেকেছে। বিরোধ, পার্থক্য ও বৈচিত্র নিয়েও একটি দেশের জনগণ যদি নিজেদের একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হবার শিক্ষা ও সচেতনতা রাজনৈতিক দলের কাছে না পায় তাহলে রাষ্ট্র গঠন করা কিম্বা রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মিশরের লড়াই-সংগ্রামে নিজেদের রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ রাখবার কর্তব্য এবং সেই অনুযায়ী পরস্পরের সাথে আলাপ বা আলোচনার ছাপ কোথাও তাই দেখা যায়নি। সকল পক্ষই নিজ নিজ দল বা মতাদর্শের শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে থেকেছে।

আন্দোলন, বিক্ষোভ, বিপ্লব বাস্তবে সব সময় কেতাবের ফর্মূলা অনুযায়ী পড়া তাত্ত্বিক ধারণা মোতাবেক সামনে হাজির হয়না, এটাও ঠিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী কালীন সময়ে ক্ষমতা আন্দোলনকারীরা নিজ হাতে না পাবার বাস্তব পরিস্থিতিতে ব্রাদারহুডের প্রথম পদক্ষেপ হোত সামরিক কর্তৃত্ব বাদে আন্দোলনকারী সকল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে মিশরের জনগণের জন্য বিপ্লবোত্তর ন্যূনতম লক্ষ্য স্থির করা, নিজেদের মধ্যে ঐক্য অটুট রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। নতুন ক্ষমতা নির্মাণ ও নতুন রাষ্ট্র গঠন হোত সেই নতুন কাজের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে ইসলামপন্থা, সেকুলারিস্ট কিম্বা উদার রাজনৈতিক চিন্তার যে আদর্শগত দূরত্ব আছে তা অস্বীকার না করে বরং তার উর্ধে কিন্তু সামরিক ক্ষমতার বাইরে গণসংহতির জন্য চেষ্টা চালানো। আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

বলাবাহুল্য এই কাজ সহজ ছিল ভাববার কোন কারন নাই। আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য – অর্থাৎ বিদ্যমান ক্ষমতা ও ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরাস্ত করে জনগণের বিজয় সম্পূর্ণ করা। যার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য সামরিক শক্তির বিপরীতে গণশক্তির গঠন ত্বরান্বিত করা এবং জনগণের বিজয় অর্জিত হবার পর জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সক্ষম রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা। কিন্তু পুরানা ক্ষমতার দুর্গ ভেঙ্গে পড়ার আগেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল, গোষ্ঠি বা প্রবণতা তাদের নিজ নিজ আদর্শগত জায়গাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে, এবং বাস্তব মুহূর্তের বাস্তব কর্তব্যকে গৌণ জ্ঞান করে। আর এরই সুবিধা গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী – যারা হোসনি মোবারকের অধীনে ক্ষমতায় ছিল তারাই। মিসরের বাস্তবতা এই যে ব্রাদারহুডের আদর্শের প্রতি সমাজের বড় একটি অংশের সহানুভূতি থাকলেও বাকি রাজনৈতিক শক্তির সহানুভুতি বা সমর্থন নাই। আবার, একইভাবে সেকুলারিস্টদের আদর্শের প্রতিও বাকিদের। এই বাস্তবতা মেনে আদর্শের ঝগড়া দূরে রেখে উভয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল হোসনি মোবারকের ক্ষমতার অবশেষগুলোকে আগে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা এবং নতুন রাষ্ট্রের রূপ কেমন হবে সে সম্পর্কে একটি ন্যূনতম ঐক্যমত গঠন। একটা নতুন গঠনতন্ত্রে (Constitution) পৌছাবার পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে একমত হওয়া। বলাবাহুল্য মিশরে সেটা হয় নি। এটাই বাস্তবতা, চলমান রাজনৈতিক সংকটের গোড়া এখানেই।

হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যূত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ক্ষমতার চরিত্রে রূপান্তর ও পুরানা ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে এরপর তা ঢেলে সাজানোর জন্য সমাজের সকল স্তরে যে জনমত তৈরীর প্রক্রিয়া জারি রাখা জরুরী ছিল ব্রাদারহুড সে চেষ্টা করে নি। সম্ভবত এটা যে মুখ্য করণীয় কাজ তা তাদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাতেও নাই। এর জন্য কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষের পরস্পর কথা বলা জরুরি ছিল। সেটা উপেক্ষা করা হয়েছে। সেনা ক্ষমতার বিরুদ্ধে আগাম পালটা ক্ষমতা তৈরি ও রাষ্ট্রগঠনের কর্তব্য মনে রেখে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও রাজনৈতিক সমঝোতার পথে ব্রাদারহুড যায়নি বটে, কিন্তু, পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে মাত্র ৩০% সিটে ব্রাদারহুড প্রার্থী দিবে কিম্বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা প্রার্থী দিবে না -- এই ধরণের প্রার্থী কেন্দ্রিক একটা আপোষের ইচ্ছা ব্রাদারহুডের ছিল। কিন্তু সে ইচ্ছার কথা ঘোষণা দেবার পর তারা আবার তাতে স্থির থাকে নি। একাই সব সিটে প্রার্থী দিয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একলা চলার চেষ্টা করেছে। তার পরেও যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ফলাফল ঘোষণা নিয়ে পুরানা তিন প্রতিষ্ঠান টালবাহানা ও দরকাষাকষি করছিল তখন অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে পাঁচ ভাইস প্রেসিডেন্টের ব্যবস্থা রেখে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ঐক্যমতে ব্রাদারহুড যেতে পেরেছিল। যদিও এই মতৈক্য নতুন গঠনতন্ত্র কিম্বা নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণয় নিয়ে ঘটেনি। তবুও এর ফলে সবাই একজোট হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল।


আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ক্ষমতার চরিত্রে রূপান্তর ও পুরানা ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে এরপর তা ঢেলে সাজানোর জন্য সমাজের সকল স্তরে যে জনমত তৈরীর প্রক্রিয়া জারি রাখা জরুরী ছিল ব্রাদারহুড সে চেষ্টা করে নি। সম্ভবত এটা যে মুখ্য করণীয় কাজ তা তাদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাতেও নাই। এর জন্য কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষের পরস্পর কথা বলা জরুরি ছিল। সেটা উপেক্ষা করা হয়েছে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট হবার পর এই ধরণের সমঝোতাকে আরও শক্তিশালী করে পুরানো তিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের ক্ষমতার ভিত্তি তৈরী ও সংহত করার চেষ্টা মোহাম্মদ মরসি আর করেন নি। বরং সেনাবাহিনীর অধীন হয়ে প্রেসিডেন্টকে তারা যেটুকু ক্ষমতা দিতে রাজি হয় সেই ভিক্ষা কবুল করে প্রেসিডেন্ট থাকতে চাইলেন। সেনাবাহিনী বিরোধী সমাজের শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে মৈত্রী দৃঢ় করার চেষ্টা না করে সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট রেখে প্রেসিডেন্ট থাকাটাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। ফলে সেনাবাহিনীর বিপরীতে গণশক্তি তৈয়ারের শেষ সুযোগও মিসরীয় জনগণ হারালো।

অবশ্য মরসি যেন সেদিকে যেতে বাধ্য হন সেই প্রচেষ্টা ঐ তিন প্রতিষ্ঠানও করেছে। তথাকথিত সুপ্রিম কনস্টিটিউশিনাল কাউন্সিল পুরাটা সময় প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার কর্তৃত্বের ওপর বাধা হয়ে কাজ করেছে। মোবারকের এটর্নী জেনারেলকে পদচ্যুত করা ও নতুন নিয়োগ দেয়াকে কেন্দ্র করে মরসি ডিক্রি জারি করেছিলেন যে তার নির্দেশের উপর কোন আদালতের কর্তৃত্ব নাই। একইভাবে তিনি জোর খাটিয়ে একক কর্তৃত্বে দলবাজির জোরে যে গঠনতন্ত্র তৈরী করেছিলেন, সেটা ব্রাদারহুডের কনসস্টিটিউশান হয়েছে, মিশরের জনগণের সকল পক্ষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা তা ধারণ করতে পারে নি। ফলে মরসি বিরোধী সব রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেল। এভাবেই সবাইকে তিনি দূরে ঠেলে দিলেন।

খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদনের জন্য গণভোটের পদ্ধতিও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সেটা দুই দফায় হয়েছিল। অর্ধেক লোকের গণভোট নেওয়া ও তার ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর সেই ফলাফল জেনে বাকি অর্ধেক লোক ভোট দিয়েছিল। পদ্ধতির ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মরসি এই গঠনতন্ত্রকে সিদ্ধ বা বৈধ বলে দাবি করলেন। ফলে তিনি তার বিরোধী প্রায় সকলকেই তার বিরুদ্ধে একাট্টা হতে সহায়তা করলেন। এবার তাদের প্রতি সমর্থন দিল হোসনি মোবারকের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, এবং তা স্বাভাবিকভাবেই অপ্রকাশ্যে। সবচেয়ে আজব ব্যাপার হোল সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের উপরে ব্রাদারহুড প্রভাবান্বিত গঠনতন্ত্র নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারল না। মরসি এমন এক গঠনতন্ত্র বানালেন যেখানে সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল এর ক্ষমতা নতুন কনস্টিটিউশানের অধীন নয়, স্বাধীন। ফলে মিশরের ব্রাদারহুড তাদের দৃষ্টিতে পুরানা কনস্টিটিঊশানের তুলনায় আরও সহি এক ইসলামি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছে ঠিকই, কিন্তু সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল আগে যেমন কনস্টিটিউশানের বাইরে একক ক্ষমতা ভোগ করত এখনও সেটাই রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল কার্যত গঠনতন্ত্রের বাইরে নিজেই নিজের ক্ষমতার উৎস হয়ে রয়ে গিয়েছে।

এসবের পরিণতি ক্রমশ খারাপের দিকে গড়ালো। গঠনতন্ত্রে যেখানে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে পুরানা সংবিধানের মতো ইসলাম আছে, গঠনতন্ত্রের ইসলামি চরিত্র আছে, শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা আছে, শরিয়া সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে সুন্নি ইসলামের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিষ্ঠান আল আজহারের প্রবীন ইসলামি শাস্ত্রবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করবার বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা কার্যত রয়ে গিয়েছে কনস্টিটিউশানের বাইরে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। নতুন গঠনতন্ত্র একটি কাগুজে দলিলের অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারলো না। তবু এই গঠনতন্ত্র পেয়ে মরসি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। তাঁর সমস্ত প্রেসিডেন্সিয়াল নিয়োগের মানদণ্ড হয়ে উঠল যিনি রাষ্ট্রের কোন দায়িত্বে নিয়োগ পাচ্ছেন তিনি ব্রাদারহুডের রাজনীতি করেন কিনা। যেমন, ব্রাদারহুড যখন সশস্ত্র লাইনের রাজনীতি অনুসরণ করত সে সময়ে বিখ্যাত পর্যটন শহর লুক্সরের (Luxor) প্রায় ৬০ জন বিদেশী পর্যটক হত্যা করার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। পরে লুক্সরের পর্যটক হত্যা ঘটনার হত্যা মামলায় যার নাম মুল পরিকল্পনাকারী হিসাবে জানাজানি আছে তাকেই তিনি লুক্সরের গভর্নর করেন। এটা রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতার সুষ্ঠ প্রয়োগ হয়েছে কিম্বা সংবেদনশীলভাবে তিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন বলা যাবে না। তিনি গুপ্ত বা প্রকাশ্য যে অবস্থাতেই থাকুক ব্রাদারহুডের রাজনীতি সঠিক সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছেন। ব্যবসায়ীদের জন্য এটা ছিল একটা খারাপ সংকেত, অর্থনীতির ওপর যার খারাপ প্রভাব পড়া মোটেও বিচিত্র নয়।

পর্যটন মিসরের জিডিপিতে ১১% ভুমিকা রাখে। কিন্তু মুল্য যুক্ত করার চেয়ে পর্যটনকে কাজ সৃষ্টির দিক থেকে দেখলে সেবা খাতের ভুমিকা ৪০% এর মত। গত প্রায় তিন বছর ধরে এই খাতের ব্যবসা নেমে গেছে মারাত্মক ভাবে। পর্যটনের জন্য নিরাপত্তা একটা সংবেদনশীল ইস্যু। সেইদিক থেকে গভর্নর নিয়োগের জন্য এই বিশেষ ব্যাক্তিকে বেছে নেওয়াটা মোটেও বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। ওদিকে মরসির সংস্কৃতি মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সাফ করার নামে শিল্পকলার উপর “ইসলামি নৈতিক শাসন” কায়েম করতে গেছেন। মিসরকে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মনে করা হয়। সেটা ন্যায্যও বটে। সবচেয়ে প্রাচীন থিয়েটার, সিনেমা, আরবি ক্লাসিক গান, শিল্পকলার জন্মদাতা একমাত্র মিসর। একে সহজ নৈতিকতা দিয়ে শাসনের চেষ্টা কমিউনিস্টদের “পার্টি সাহিত্যের” জবরদস্তির মতোই সমান বিপজ্জনক। কবি, শিল্পী সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও হয়েছে মারাত্মক নেতিবাচক।

তবে হয়ত গত দুই বছরের অচলাবস্থার সব দোষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ব্রাদারহুডের বা মোহাম্মদ মরসির একার নয়। সকলেরই। কারণ, সেকুলার, কমিউনিস্ট, উদারনীতিবাদী, কিম্বা নির্দলীয় বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপ বা আন্দোলনের দিক থেকে দেখলেও দেখা যায় তারা ইসলামপন্থি রাজনীতি মোকাবিলা ও বিরোধিতা করতে যতোটা আগ্রহী ততোটা মোবারক-উত্তর মিশরে কী ধরণের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া উপযোগী এবং কিভাবে সকলকে নিয়ে সেই প্রক্রিয়া জারি রাখা সম্ভব সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে আগ্রহী নন। এ ব্যাপারে কেউ কোন স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে বিপদের জায়গা হচ্ছে ঐ তিন পুরানো প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাতে ক্ষমতা যে অটুট রাখবেই মরসি বিরোধীরা তা জেনেও না জানার ভান করেছে। এখনও করছে । এরা নতুন গঠনতন্ত্র ও রাষ্ট্রের পত্তন ঘটতে দেবেনা। কে না জানে সেনাবাহিনীর বগলে বসে মিশরকে নতুনভাবে গড়বার স্বপ্ন বৃথা। বিশেষত ইসলামপন্থিদের বাইরে রেখে যা কোনদিনই সম্ভব নয়। বড়জোর যেটা হতে পারে, পুরানা ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান অক্ষত রেখে তাদের অধীনস্থ বাদবাকি গুরুত্বহীন কিছু জায়গায় সেকুলার রাজনীতির ছিটেফোঁটা অন্তর্ভুক্তি। আগামি কোন নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ যদি ঘটেও সেখানেও সেকুলারিস্ট ও উদারপন্থিরা সেনাবাহিনীর আধিপত্য সহ তিন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা মেনে নিতেই বাধ্য হবে। আগে যেটা মরসির বেলায় ঘটেছে এবার সেই নাটকের হয়ত পুনরাবৃত্তি দেখব আমরা সেকুলারদের দিয়ে। মিসরের জনগণের আসল লড়াইয়ের দিকটা সম্পর্কে জনগণকে বেখবর রেখে কিম্বা নিজেরা বেখবর থেকে মরসিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের কাজকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। আর সেটা তারা করেছে তারা সেনাবাহিনীর হাতিয়ার হয়ে।


তবে হয়ত গত দুই বছরের অচলাবস্থার সব দোষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ব্রাদারহুডের বা মোহাম্মদ মরসির একার নয়। সকলেরই। কারণ, সেকুলার, কমিউনিস্ট, উদারনীতিবাদী, কিম্বা নির্দলীয় বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপ বা আন্দোলনের দিক থেকে দেখলেও দেখা যায় তারা ইসলামপন্থি রাজনীতি মোকাবিলা ও বিরোধিতা করতে যতোটা আগ্রহী ততোটা মোবারক-উত্তর মিশরে কী ধরণের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া উপযোগী এবং কিভাবে সকলকে নিয়ে সেই প্রক্রিয়া জারি রাখা সম্ভব সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে আগ্রহী নন। এ ব্যাপারে কেউ কোন স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে বিপদের জায়গা হচ্ছে ঐ তিন পুরানো প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাতে ক্ষমতা যে অটুট রাখবেই মরসি বিরোধীরা তা জেনেও না জানার ভান করেছে। এখনও করছে ।

সেনাবাহিনী পাশ্চাত্য শক্তির সমর্থন ছাড়া এই কাজ করেছে মনে হয় না। তবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে একটি নির্বাচিত সরকারকে সশস্ত্র শক্তির জোরে উৎখাত করার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য কাতর পাশ্চাত্য কোন দেশ বিচলিত বোধ করে নি। সবার সার কথা, যা হবার হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মরসিকে উৎখাত – এখন সকলে যেন এটা মেনে নেয়। আর সেনাবাহিনীও যেন দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে পাশ্চাত্যের মুখ রক্ষা করে। তাদের প্রধান উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা হচ্ছে এর ফলে মিশরে যেন সন্ত্রাস ও সহিংসতা যেন ব্যাপক না হয় আর অতিশয় বিস্তৃতি লাভ না করে । মিশরে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে গিয়ে পাশ্চাত্য শক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেন না যায়।

মিশরের ঘটনাকে বিশ্লেষণ বিবর্জিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা অনেকে করবেন। এটা শুধু গভীর ভাবে কিছু বুঝতে না চাইবার আলস্যই শুধু প্রমাণ করে। ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে। থাকেও। বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করে, লড়াই সংগ্রামের নানান মোড় বা বাঁক থাকে, কিন্তু রাজনীতি ষড়যন্ত্র মাত্র নয়। কোন একটি ‘ষড়যন্ত্র’ কেন সফল বা বিফল হোল তার ব্যাখ্যার জন্য সমাজ ও রাজনীতির গতিপ্রক্রিয়ার হদিস নেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। যারা বলছেন মার্কিন, ইসরায়েলি ও পাশ্চাত্য শক্তির ষড়যন্ত্রে একটি নির্বাচিত ইসলামপন্থী সরকারের পতন ঘটেছে, তাঁরা পুরাটা সঠিক বলছেন না। সেনাবাহিনী মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থ রক্ষা করবে, এটা নতুন কোন তথ্য নয়। এর জন্যই তো আনোয়ার সাদাতের আমলে ক্যাম্প ডেভিড প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছিল। যেটা গত প্রায় তিন বছরের মিশরের আন্দোলনে বা রাজনীতির মাঠে কোন ইস্যুই ছিল না। সেনাবাহিনীর প্রতি মার্কিন-ইসরায়েলি সমর্থন ছাড়া সাধারণ ভাবে পাশ্চাত্যের সমর্থন থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিশরের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিজস্ব টানাপোড়েন আছে। তাকে উহ্য রেখে কিম্বা হিসাবে না নিলে মিশরের রাজনীতির কিছুই আমরা বুঝবো না। মিশরে একটি উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল থাকুক এটা পাশ্চাত্য দেশগুলো একদমই চায় নি বা চায় না বলা যাবে না। ক্ষমতার তিন প্রতিষ্ঠানকে না ভেঙ্গে প্রতীকার্থে সেনা প্রধানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী না রেখে মিসরে উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কিভাবে কায়েম হতে পারে সে ফর্মুলা পশ্চিমের কাছে আছে মনে করারও কোন কারণ নাই। মনে রাখতে হবে, ক্যাম্প ডেভিড প্রতিরক্ষা চুক্তির (১৯৭৯) সারকথা হলো, ইসরায়েলকে দেয়া মিসরের সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি, আর ঐ চুক্তি বাস্তবায়নের উপযোগী করে মিসর রাষ্ট্রকে সাজানো; সেখান থেকেই ঐ তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিসরের পুরানো রাষ্ট্র আকার পেয়েছিল। ফলে মিসরে শুধু উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনীতির স্বপ্ন দেখলে তো হবে না। আগে ইসরায়েলের নিরাপত্তা কে দিবে এবং তা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। উহ্য রাখলে হবে না। মিশরের ঘটনাবলী সম্পর্কে জুলাইয়ের তিন তারিখে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ যে মন্তব্য দিয়েছে, তার মুল সুরটা পাশ্চাত্যের স্বার্থে মিশরে একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বজায় রাখার পক্ষে ওকালতি বলা যায়। (দেখুন, A Difficult Way Forward in Egypt) ফলে রাষ্ট্রভেদে ভিন্নতা সত্ত্বেও মিশরের ঘটনাবলীর প্রতি পাশ্চাত্যের সাধারণ মনোভাব বোঝা কঠিন নয়। সে মনোভাব হচ্ছে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক ধারাগুলো নিরাপোষ লড়ছে তাদের বাদ দিয়ে উদার ও নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলো রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে রাজি। ‘ভালো মুসলমানদের’ সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী এবং ‘খারাপ মুসলমানদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ – এই নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো সরে আসে নি। সে কারণে মিশরে সেকুলারিস্ট বা লিবারেলদের তিরস্কার করতে তাদের বাধা নাই।


মিশরে একটি উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল থাকুক এটা পাশ্চাত্য দেশগুলো একদমই চায় নি বা চায় না বলা যাবে না। ক্ষমতার তিন প্রতিষ্ঠানকে না ভেঙ্গে প্রতীকার্থে সেনা প্রধানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী না রেখে মিসরে উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কিভাবে কায়েম হতে পারে সে ফর্মুলা পশ্চিমের কাছে আছে মনে করারও কোন কারণ নাই। মনে রাখতে হবে, ক্যাম্প ডেভিড প্রতিরক্ষা চুক্তির (১৯৭৯) সারকথা হলো, ইসরায়েলকে দেয়া মিসরের সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি, আর ঐ চুক্তি বাস্তবায়নের উপযোগী করে মিসর রাষ্ট্রকে সাজানো; সেখান থেকেই ঐ তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিসরের পুরানো রাষ্ট্র আকার পেয়েছিল। ফলে মিসরে শুধু উদার নির্বাচনমুখি লিবারেল রাজনীতির স্বপ্ন দেখলে তো হবে না। আগে ইসরায়েলের নিরাপত্তা কে দিবে এবং তা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

মিশরের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য শুধু মরসির অর্থনৈতিক নীতি এককভাবে দায়ী নয়। বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অধীনে থেকে মিশরীয় জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। আবার বিপরীতে এও মানতে হবে ক্যাম্প ডেভিডের পরে গত ৩২ বছরের অভিজ্ঞতায় অর্থনীতি পরিচালনায় সেনাবাহিনী অনেক দক্ষ ছিল। যেমন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি মোতাবেক পাওয়া বছরে তিন বিলিয়ন করে আমেরিকান অনুদানের ১.৩-১.৭ বিলিয়ন চুক্তি অনুযায়ী সেনা বাহিনীর জন্য রেখে দেওয়া হোত। বেসামরিক খাতে বাকি অর্থের প্রথম খরচের খাত ছিল খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়া। এই ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সেনাবাহিনী কখনও ব্যর্থ হয়নি। কাম্প ডেভিড চুক্তি করে হলেও আনোয়ার সাদাতের “রুটির ব্যবস্থা করতে হবে আগে” তত্ত্ব তারা ঠিকই আগলে রেখেছিল।

এদিকে গত তিন বছর রাজনৈতিক ডামাডোলে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। ফরেন কারেন্সী রিজার্ভ ৬৯ বিলিয়ন ডলারের থেকে প্রায় ২৪ বিলিয়নে নেমে গেছে। কাতার মরসিকে ২০ বিলিয়ন ডলার সহজ ঋণ দিতে কবুল করেছিল। সম্ভবত ৫ বিলিয়ন ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে। কিন্তু তাতে দুঃখ ঘোচে নি। আইএমএফ মিশরকে স্থিতিশীল সরকার দেখার অপেক্ষায় বছরের বেশি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সবটাই মরসির অনুকুলে ছিল এমন নয়। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দিক থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই কষ্ট কমানোর একমাত্র সম্ভাব্য উপায়। পর্যটন শিল্পের দেশ মিসরে এই প্রথম লোড শেডিং হচ্ছে, জ্বালানীর জন্য লাইন ধরা, খাদ্যের দাম বেশি এগুলো মিসরের সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে বেশি। ফলে মোবারকের আমলের সাথে এর তুলনা তারা না করতে চাইলেও করে ফেলবে।

সম্প্রতি এক জরিপ হয়েছে মিসরে। ওখানে মিশরীয়রা রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয় অর্থনৈতিক স্বার্থ বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ মনে করে কি না এই প্রশ্নে দেখা গিয়েছে ৫২% লোক মনে করে মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ফলে অনুমান করা যেতে পারে গরীব মানুষের ধৈর্যে ফাটল ধরা শুরু হয়েছে। যেটাকে কাজে লাগিয়েছে আল বারাদিদের তাহরির ময়দানের জমায়েত।

তিন

মোহাম্মদ মরসির সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে ব্রাদারহুড নিজের পক্ষে যে যুক্তি খাড়া করছিলো তার মূল কথা ছিল, ‘বৈধতা’ । যেহেতু ব্রাদারহুড জনগণের ভোটে নির্বাচিত অতএব তাদের সকল সিদ্ধান্ত ‘বৈধ’। নির্বাচনে জিতে আসাটাই যা কিছু করবার ‘বৈধতা’ অর্জনের মানদণ্ড। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তার সঙ্গে মোহাম্মদ মরসির কার্যকলাপ ভিন্ন কিছু নয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারাটাই আসল কথা। এই নির্বাচনী বিজয়ই ক্ষমতাসীনদের যে কোন আইন বা বিধান প্রণয়ণের ক্ষমতা দেয়। ফলে নির্বাচিত হয়ে এসে একটি ইসলামি সংবিধান প্রণয়ণ ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমও তাহলে ‘বৈধ’। ব্রাদারহুডের যুক্তি হচ্ছে, মরসিতো অবৈধ কিছু করেন নি, তিনি যা করেছেন তা বৈধ ভাবেই করেছেন। অতএব তা গণতন্ত্র বিরোধী হলেও অন্যদের তা মানতে হবে। বলাবাহুল্য ব্রাদারহুড ও তাদের সমর্থকরা ছাড়া বাকি মিশরীয় জনগণ এই ‘বৈধতার’ যুক্তি মানেন নি। সুযোগ বুঝে এতদিনের সমর্থক সালাফি নূর পার্টিও সমর্থন প্রত্যাহার করে বিরোধী হয়ে যায়।

মিসরে লড়াইটা আসলে গণতন্ত্রের জন্য – নির্বাচন সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতার একটি স্তর মাত্র। কিন্তু এই ‘গণতন্ত্র’-কে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ধারণা ও চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ গণ্য করে ভাবলে চলবে না। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণাকে আরও বিকশিত করে গণতন্ত্রকে একটি ইসলামি চরিত্র দিতে সক্ষম কিনা, সেখানেই বরং ইসলামি রাজনীতির সত্যিকারের চ্যালঞ্জ নিহিত রয়েছে। এখানেই ইসলাম দেখাতে পারে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের সঙ্গে তার বিরোধ ও পার্থক্যের জায়গাগুলো আসলে কোথায়। মোহাম্মদ মরসি ও ব্রাদারহুডের নির্বাচনে জয়ী হওয়া সেই চলমান লড়াইয়েরই অংশ। নির্বাচিত হয়েছে বলেই ব্রাদারহুড এমন কোন সংবিধান দিতে পারে না যা মিশরের জনগণের আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে না নিয়ে গিয়ে তার বিপরীত স্রোত হিসাবে হাজির হয়। বিভেদ তৈরী করে। দুর্ভাগ্যক্রমে মিশরে তাই ঘটেছে।

মিসরের ঘটনাবলীকে আমি এভাবে হাজির করবার কারণ হচ্ছে এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিকগুলো চিহ্নিত করা। বাংলাদেশেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্থ একই সঙ্গে সংবিধান সভার নির্বাচনও বটে। কারণ জাতীয় সংসদকে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা দিয়ে রাখা আছে। এখানেও আমরা তাই দেখি যে নির্বাচিত হয়ে এসে গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সংশোধনী আনা ও আইন প্রণয়ণ করা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে। যেহেতু জাতীয় সংসদে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সেই সংশোধনী বা আইন পাশ হয় অতএব এইসব সংশোধনী ও আইন ‘বৈধ’। সব সরকারের আমলেই এই কুকর্ম হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার বর্তমান আমল অন্তত এই দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অসাধারণ বলেই বিবেচিত হবে। তিনি শেখ মুজিবর রহমানের পুরা ৭ মার্চের বক্তৃতাই সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

এই নজির তৈরী হওয়াতে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের আগামিতে বেশ সুবিধাই হবে বলা যায়। তারা চাইলে আখেরি নবির বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ, কিম্বা সম্ভব হলে ছহি বোখারি পুরাটাই সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পারবেন। যদি ইসলামপন্থিরা কোনদিন ক্ষমতায় এসে পুরা কোরানশরিফ সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত করতে চান তাহলে সেটাও ‘বৈধ’ হবে। এর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন থাকবে। শেখ হাসিনা যদি শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা সংবিধানে যুক্ত করতে পারেন তো কোরানশরিফ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না কেন? তিনি যদি পেরে থাকেন, তাহলে ইসলামপন্থীরা পারবেন না কেন? এখন যেভাবে আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীসহ বাংলাদেশের সংবিধানকে মানছি, তখনও তেমনি মেনে নিতে হবে। শেখ হাসিনার রাজনীতি আর ব্রাদারহুডের রাজনীতি এই দিক থেকে আলাদা কিছু নয়। বৈধতার রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমার্থক নয়। আমরা এখনও তার ফারাক করতে শিখিনি।

যে কোন নির্বাচনবাদী লিবারেল রাজনৈতিক শক্তির মতো নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদেরও সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে নির্বাচনের সুবিধা নিয়ে সরকার গঠন করবার সুযোগ অর্জন করা এবং সরকারে থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট বদলে দেওয়া। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম না করে রাষ্ট্রকে ইসলামী চরিত্র দান করার চেষ্টা করা। ইসলাম বিরোধী বিদ্বেষীরা যাকে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা বলে গণ্য করে তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের অর্জনগুলোর সঙ্গে এই ধরণের শাসনব্যবস্থার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এটাও তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে যে গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র ধ্বংস করবার কপট কৌশল গ্রহণ করে। গণতন্ত্রের জন্য যা বিপজ্জনক। নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে এই ধারা আসলে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করবার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবার ব্যবস্থায় ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার যে দাবি তোলা হয় তাকে সে কারণে শুধু ইসলাম বা ধর্মের বিরোধিতা বলে গণ্য করা ভুল হবে। সেটা এই কপটতারও বিরোধিতা বটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে কোন অগণতান্ত্রিক, বর্ণবাদী ও গণবিরোধী শক্তি - জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষতার শ্লোগান দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান বদলিয়ে যদি রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট রূপ দান করে তারাও একই যুক্তিতে কপটই বটে। এসব রাজনীতির বিরোধিতা করার অর্থও একই যুক্তিতে ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষতার বিরোধিতা নয়, বরং ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করা।


যে কোন নির্বাচনবাদী লিবারেল রাজনৈতিক শক্তির মতো নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদেরও সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে নির্বাচনের সুবিধা নিয়ে সরকার গঠন করবার সুযোগ অর্জন করা এবং সরকারে থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট বদলে দেওয়া। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম না করে রাষ্ট্রকে ইসলামী চরিত্র দান করার চেষ্টা করা। ইসলাম বিরোধী বিদ্বেষীরা যাকে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা বলে গণ্য করে তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের অর্জনগুলোর সঙ্গে এই ধরণের শাসনব্যবস্থার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এটাও তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে যে গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্র ধ্বংস করবার কপট কৌশল গ্রহণ করে।

নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আজ অবধি কোন যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারে নি। তারা নিজেদের যতোই পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের (liberalism) অনুরাগী ও সমর্থক বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে ততোই তাদের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী হয়। কিম্বা যতোই তারা একে পশ্চিমের সাথে ইসলামপন্থিদের ‘এনগেজমেন্ট’ বলে চালাতে চেষ্টা করে ততোই তাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরও করুণ ভাবে ফুটে ওঠে। তারা নিজেদের সাতিশয় উদার প্রমাণ করবার জন্য নিজেদের ধর্ম ভিত্তিক সংগঠন ও দল থাকবার পরেও ফ্রিডম ও জাষ্টিস পার্টি নামে নতুন ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল গঠন করে। কিম্বা স্বেচ্ছায় বা রাষ্ট্রের হুকুমে তাদের গঠনতন্ত্র বদলাতে বাধ্য হয়। আল্লার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। আধুনিক রাষ্ট গঠন – সেটা পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রের আদলে হোক কি ইসলামি হোক – ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম আদৌ ইসলামি রাজনীতির লক্ষ্য হতে পারে কিনা, হলে সেটা কি অর্থে, সেই গোড়ার নীতিগত প্রশ্ন তারা তোলেনা বা এড়িয়ে যায়। ফলে সবই শেষাবধি নেহায়ত কৌশল ছাড়া ভিন্ন কোন অর্থ বহন করে না। অথচ মূল লড়াই কৌশল নেয়া নয় বরং নৈতিক বা আদর্শগত জায়গায়। মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ইসলামের সম্ভাব্য ভূমিকা পরিচ্ছন্ন করবার চিন্তা ও তৎপরতা নির্ণয়ের প্রশ্নে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী রাজনীতি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্ববাসীকে কি দিতে পারে যা প্রচলিত নানান আদর্শ বা রাজনীতি দিতে অক্ষম। শুধু মুসলমানদের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার যে রাজনীতি তাকে মুসলমানদের রাজনীতি বলা যেতে পারে। সকলের নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি গড়ে ওঠা ও সাময়িক শক্তিশালী হয়ে ওঠার বাস্তবতা পূর্ণ মাত্রায় আছে এবং বেশ কিছুকাল থাকবে। অসম বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশ ও জনগণ নানা ভাবে নির্যাতীত। ফলে নিপীড়িতের সংগ্রামে ‘ইসলাম’ ভূমিকা রাখবে। রাখছেও।

কিন্তু মুসলমানদের সংকীর্ণ স্বার্থবাদী রাজনীতিই কি ইসলামী রাজনীতি? ব্যস। আর কিছু না? ইসলামী রাজনীতি কি সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে আসতে আদৌ সক্ষম নয়? এর উত্তর তখনই দেওয়া সম্ভব যখন ইসলাম নিজেকে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও চর্চা কিম্বা ইমান-আকিদার ব্যাপার হিসাবে সীমাবদ্ধ না রেখে তার অন্তর্নিহিত দর্শন, আদর্শ বা নীতি সকলের জন্য সকলের বোধগম্য প্রকাশভঙ্গী ও সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তির ভাষায় (Public Reason) হাজির করতে সক্ষম হবে। যখন নিজেদের বক্তব্যের যথার্থতার জন্য মুসলমানদের নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্ম চর্চার বরাত দিতে হবে না। এইভাবে হাজির করাকে সাধারণত ভুলভাবে ‘সার্বজনীন’ বলে গণ্য করা হয়। এভাবেই গ্রিক দর্শন আশ্রয় করে খ্রিস্ট ধর্ম নিজেকে সর্বজনগ্রাহ্য দর্শন ও সভ্যতা হিসাবে হাজির করে এবং সর্বজনগ্রাহ্য বলে অন্যদের কবুল করাতেও সক্ষম হয়। তারা একই সঙ্গে দাবি করে ইউরোপীয় সভ্যতাই সকলের মান্য, ইউরোপীয় সভ্যতাই ‘সার্বজনীন’ বিশ্ব সভ্যতা । অথচ ‘আধুনিক’ ইউরোপীয় সভ্যতা’ মানবেতিহাসের শেষ ও একমাত্র পরিণতি নয়, হতে পারে না। ইউরোপের সভ্যতা ও ইতিহাসের অবদান মেনে নিলেও ইউরোপই বিশ্ব নয়, অতএব ইউরোপের ইতিহাসই বিশ্ব ইতিহাস নয়, ইউরোপ বিশ্বসভ্যতার একমাত্র আদর্শ নয়। কখনও ছিল না। অন্য জনগোষ্ঠিরও নিজ নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনের লড়াই সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, যা বিশ্ব ইতিহাসের বাইরের কোন বিষয় নয়, মানবেতিহাসের ভেতরের জিনিস। তাকে উপেক্ষা করা গোলকায়নের এই যুগে কঠিন।

ইসলাম যখনই নিজেকে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের প্রেরণা, অনুঘটক বা মতাদর্শ হিসাবে হাজির করেছে, তখনই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তার সর্বজনগ্রাহ্যতার বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে তার উদাহরণ তৈরী হয়েছে। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, উপনিবেশবাদ, জাতপাত বিরোধী সংগ্রাম সহ সাধারণ ভাবে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে ইসলাম যখনই তার নীতি ও আদর্শ হিসাবে ঘোষণা করেছে ও লড়েছে, নিপীড়িত জনগণ জুলুমের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ে সাড়া দিতে দ্বিধা করে নি। কিন্তু যখনই ইসলাম নিজেকে অমুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই হিসাবে হাজির করেছে, তখনই সে লড়াই পর্যবসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির অন্ধ চোরাবালিতে। ইসলামের ইতিহাসে এই রক্তাক্ত টানাপড়েনের ইতিহাস অনেক তিক্ত ও দীর্ঘ। কমিউনিস্টদের নতুন সমাজ ও নতুন ধরণের মানুষ তৈয়ার করবার ঐতিহাসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা দৃশ্যত ব্যর্থ হবার পর ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী জনগণের বিশাল একটি অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহী এবং অনেকে সমর্থক হয়ে উঠছে। কিন্তু সে রাজনীতি যদি শুধু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার সংকীর্ণ বৃত্তে আটকা পড়ে থাকে তবে সেই বৃত্তেই তাকে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকতে হবে। মিসরে ইখওয়ানুলের রাজনীতির বর্তমান দৃশ্যমান পরিণতি এই দিক থেকেই বিচার করতে হবে।

জালিম বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিরাপোষ লড়াই না করে পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের জন্য ইসলাম বিপজ্জনক নয় সেটা প্রমাণের কৌশলের ওপর নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়। ফলে তার ক্ষমতায় আসতে পারা না পারা বা ক্ষমতায় টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে পাশ্চাত্য বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর। পাশ্চাত্য বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা মেনেই নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা রাজনীতি টিকতে পারে। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার, আমূল পরিবর্তন ও পরিগঠনের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণের বিশাল অংশ ইসলামপন্থী রাজনীতির পক্ষাবলম্বী হয়ে ওঠে তাদের প্রত্যাশা মেটাতে ইসলামী রাজনীতি ব্যর্থ হয়।

মিশরের রাজনীতি এখন ঠিক কোনদিকে মোড় নেবে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ছাড়া মিশরীয় জনগণের প্রায় সকলেরই সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মরসির সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়াকে ইসলাম বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসাবে না দেখে, নির্বাচনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হিসাবে দেখাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের প্রতি ইসলামপন্থী রাজনীতির নীতি ও কৌশলের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাও এই ক্ষেত্রে দায়ী। এই দিকগুলো থেকে দেখলে মিশরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক ধারার দুই পক্ষই কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, এই আশা করি।

৯ জুলাই ২০১৩। আরশিনগর। ঈশ্বরদী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।