কাউকে না কাউকে বলে যেতেই হবে


শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেবেন না, তিনি পণ করেছেন তাঁর অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এর পক্ষে তিনি আদালতের বরাত দিচ্ছেন। আদালত রায় দিয়েছে, তিনি আদালতের কথা মতোই চলবেন। আদালত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেই সত্য আদালত কিম্বা আওয়ামি লীগ দুইয়ের কেউই প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। বলাবাহুল্য, বেগম খালেদা জিয়া জানেন এর অর্থ হচ্ছে নির্বাচনে কারচুপি করে বিরোধী দলকে হারিয়ে দেবার পন্থা হিশাবেই শেখ হাসিনা নিজের অধীনে নির্বাচন চাইছেন। অতএব খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করবেন না। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক চাই। আওয়ামি পন্থিরা বলছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে সিটি কর্পোরেশানগুলোর নির্বাচন হয়ে গেলো। সেখানে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে। যদি কারচুপিই হবে তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও স্থানীয় নির্বাচনে হারলো কেন? বিরোধী দলের যুক্তি হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধ ও ক্ষোভের মাত্রা যে পর্যায়ে রয়েছে তার কারণে ভোটের সময় জনগণের নজরদারি প্রখর ছিল, তেমনি গণমাধ্যমেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। তাই হেরেছে। কারচুপি করবার মওকা পায় নি। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের হিসাব নিকাশ এক নয়। জাতীয় নির্বাচন কিছুতেই শেখ হাসিনার অধীনে করা যাবে না। আঠারো দলীয় জোটের জন্য সেটা হবে আত্মঘাতী। অতএব জাতীয় নির্বাচন একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। সে ব্যবস্থা করা মোটেও কঠিন নয়। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এটাই পথ। নইলে?

নইলে রমজানের পরে আন্দোলন!

এটা সত্য যে বিপুল ভোটে জিতে এসেও আওয়ামি লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী কোন অবস্থান তৈরী দূরের কথা বরং কুশাসন, দুর্নীতি, সহিংসতা, চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থা কায়েম, ও আদালতকে দলীয় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে গিয়ে তার সমর্থকদেরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া তার ঘাড়ের ওপর ইতিহাসের যে ভার এসে চেপে বসেছে সেটা ভূতের মতো এই দলটিকে সামনের দিনগুলোতে তাড়িয়ে ফিরবে। তার মধ্যে শুরুতেই রয়েছে বিডিআর হত্যাকাণ্ড। অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারণ জওয়ানদের বিদ্রোহের যে কারনই থাকুক বিপুল সংখ্যক অফিসার ও তাদের অনেকের পরিবারবর্গকে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে তার জন্য অভিযোগের আঙুল এখনও আওয়মি লীগের দিকেই তোলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্রোহী জওয়ানদের বন্দী অবস্থায় নির্যাতন ও অনেকের সন্দেহজনক মৃত্যু। অভিযোগ রয়েছে ঘটনা আসলে কী ঘটেছে তার নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎসগুলো অপসারণ। বিডিআর বলে আর কিছু নাই, সেখানে গঠিত হয়েছে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)। দেশের নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে সীমান্ত পাহারা দেবার সশস্ত্র বাহিনীর পরিবর্তে সেখানে পুরো বাহিনীকে স্রেফ সীমান্তের দারোয়ানের পরিণত করা হয়েছে হচ্ছে। তারা সীমান্ত পাহারা দেবার জন্য ভারতের বিএসএফকে সহযোগিতা করবে।

দ্বিতীয় যে ভুত আওয়ামি লীগকে তাড়া করে ফিরবে সেটা হচ্ছে মানবাধিকারের বিপর্যয়। এটা বিএনপির আমলেও ছিল। কিন্তু চৌদ্দ দলীয় জোটের আমলে সেটা যে মাত্রা লাভ করেছে তার নিন্দা কুড়িয়েছে আওয়ামি লীগ। আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যু, মানুষ গুম করা এবং গুম করে খুন কিম্বা লাপাত্তা করে দেবার সঙ্গে আওয়ামি লীগের নাম জড়িয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার এই শাসনকাল শেখ মুজিবর রহমানের বাকশালের চেয়েও ভয়াবহ। বিশেষত এর সঙ্গে যদি আমরা সংবাদপত্র দলন, পীড়ন এবং সাংবাদিকদের গ্রেফতার, রিমাণ্ড, নির্যাতন ও কারাগারে নিক্ষেপের ঘটনাগুলো একত্র করি। দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এখনও কারাগারে। বেআইনীভাবে পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ। একই সঙ্গে দিগন্ত, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ। সাগর-রুনি হত্যার কোন মীমাংসা হচ্ছে না। এসব কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে প্রচণ্ড। এসবকে সাময়িক ভাববার কোন কারন নাই। আওয়ামি শাসনের ভয়াবহতা তরুণদের বিশাল একটি অংশ নতুন ভাবে দেখল। বিশেষত যারা বাকশালি আমল দেখে নি, শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া ও সামনে এগিয়ে যাবার শ্লোগানে যারা আকর্ষণ বোধ করেছিল। ডিজিটাল শাসনের রূপ কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের হাড়ে হাড়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে।

ইতিহাসের তৃতীয় যে ভার ভূতের মতো আওয়ামি লীগের ঘাড়ে চেপে বসেছে সেটা হচ্ছে আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতন, দমনপীড়ন এবং তাদের নির্বিচারে হত্যা। পাঁচই মে দিবাগত রাত্রে শাপলা চত্বরে মানুষগুলো লাল রঙ মেখে শুয়েছিলো আর পুলিশ আসায় দৌড়ে পালিয়েছে , শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এ কথা বলে নিজেকে যেভাবে নিষ্ঠুর ও নির্মম শাসক হিসাবে হাজির করলেন তার কোন তুলনা চলে না। তার পক্ষে এতদিন যুক্তি দেওয়া হচ্ছিল যে বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিবেচনায় এই ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগের বিকল্প ছিল না। যা ঘটেছে তা বাড়াবাড়ি ছিল না, ছিল গণহত্যা। কিন্তু  বাড়াবাড়ি হয়েছে ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে, নিদেন পক্ষে এই সত্য মানতে, কিম্বা আদৌ এই অভিযোগ সত্য কিনা তার নিরপেক্ষ তদন্ত করতেও রাজি নন শেখ হাসিনা। আলেম-ওলামাদের রক্তে তার শাসনামল রঞ্জিত। মতিঝিল ধুয়ে সাফ করা যাবে, কিন্তু রক্তাক্ত ইতিহাসের এই দাগ আওয়ামি লীগ নিজের কপাল থেকে মুছতে পারবে না।

আর চতুর্থ যে ভার, সেটা নতুন কোন ওজন বয়ে বেড়াবার দায় নয়, বরং পুরানা দায়কে কাঁধ থেকে এবার মাথায় তুলে নিয়েছে আওয়ামি লীগ। সেটা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ এই ধারনাই পোক্ত করেছে যে দিল্লির ভূরাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষা করার মধ্য দিয়েই একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামি লীগ বাংলাদেশে টিকে থাকতে চায়। এই স্বার্থ রক্ষা এক তরফা। এর পরিবর্তে দিল্লীর কাছ থেকে কোন সুবিধা আদায় করে নেওয়া আওয়ামি লীগের লক্ষ্য নয়। এমনকি করিডোর দিয়েও তিস্তার পানি না পাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামি লীগের পররাষ্ট্র নীতির করুণ দুর্দশা ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

বিএনপি ধরে নিয়েছে এই সকল কারণে জনগণের যে ক্ষোভ তার সুফল তারা পাবে। বলা যায়, পাওয়া শুরু করেছে। কিন্তু বিএনপির রাজনীতি এখনও নেতিবাচক। এই অর্থে যে এই রাজনীতির প্রধান উপজীব্য আওয়ামি লীগের বিরোধিতা। জনগণ আওয়ামি লীগের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত বলে নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র কিম্বা সমাজের আদৌ কোন ইতিবাচক পরিবর্তন বিএনপি চায় কিনা এবং চাইলে কী সেই চাওয়া এবং কিভাবে সেই চাওয়াকে বিএনপি সত্যকারের পাওয়ায় নিয়ে যেতে চায় তার কোন ইঙ্গিত, ইশারা বা হদিস বিএনপির কাছ থেকে এখনও পাওয়া যায় নি।

যেহেতু আওয়ামি লীগের বিরোধিতাই বিএনপির উপজীব্য, অতএব বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার চালানো আওয়ামি লীগের জন্য খুবই সহজ। সেটা বেশ কার্যকরীও বটে। সে প্রচার হচ্ছে আওয়ামি লীগ মুক্তিযুদ্ধের শক্তি, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন রাজনীতির ধারক ও বাহক। বিএনপি সাম্প্রদায়িক এবং সে কারণে ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে তার গাঁটছড়া বাঁধা। এই ক্ষেত্রে গণ মাধ্যমগুলোর অধিকাংশই আওয়ামিপন্থী ভূমিকা পালন করে। এই প্রচারের মুখে বিএনপি নিজেও খুব এলোমেলো হয়ে পড়ে। নিজেকে পালটা মুক্তিযুদ্ধের দল হিসাবে প্রমাণ করবার জন্য বিএনপি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিম্বা নিজেকে একটি ‘আধুনিক’ চিন্তাচেতনাসম্পন্ন দল হিসাবে হাজির করবার মধ্য দিয়ে বিএনপি আওয়ামি লীগের এই প্রচারের জবাব দিতে চেষ্টা করে।

এই রাজনীতি ভুল। বিএনপি এতে পিছিয়ে পড়বে। পড়ছেও। ওপরে আওয়ামি লীগ সম্পর্কে যে কথাগুলো বলা হোল তা বিচার করলে আমরা দেখব, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, কিন্তু সেই ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় রাখলেও বাংলাদেশের রাজনীতির ভারকেন্দ্র মোটেও সেখানে নয়। আওয়মি লীগের প্রচারে ভীত হওয়ার কিছুই নাই। যে দেশে নব্বইভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম, সেখানে ইসলাম রাজনীতির নির্ধারক হয়ে উঠবে। কেউ চাক বা না চাক।

ইসলাম তো একাট্টা একরকমের নয়। তার নানান বয়ান রয়েছে। এদেশের জনগণ রাজনীতিতে সেই বয়ানই গ্রহণ করবে যে বয়ান জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে। ইনসাফ কায়েমের জন্য শহিদ হতে ভয় পায় না। মানুষে মানুষে সাম্যের প্রশ্নে নিরাপোষ ও অটল থাকে। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামে পিছু হঠে আসে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির ভারকেন্দ্র হচ্ছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণমানুষের আত্মমর্যাদা ও অধিকার কায়েমের লড়াই। গণতন্ত্রের লড়াই। বাঙালিত্বের মুখোশ পরে বর্ণবাদ (racism), সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট। বাঙালিত্বের নামে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শর্ত টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আমরা দেখছি। তার বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে সকল প্রকার ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও একই সঙ্গে লড়াই করতে হবে। বর্ণবাদী 'বাঙালি' দের ফ্যাসিবাদ উৎখাত করে সাম্প্রদায়িক 'মুসলমান'দের ফ্যাসিবাদ কায়েম গণমুক্তির পথ হতে পারে না। ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তরই এখনকার রাজনীতি। একই সঙ্গে এই রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে সকল প্রকার ফ্যাসিবাদী শক্তির আবির্ভাবের সম্ভাবনাও নস্যাৎ করে দেওয়া। এই লড়াইয়ে পতনের সুবিশাল খাদটা হচ্ছে নানান ভাষায় ও নানান রূপে গণমানুষের দাবি দাওয়ার মর্ম অনুধাবনের ন্যূনতম চেষ্টা না করে তাদের পরস্পর বিরোধী গণ্য করা, কারণ বিদ্যমান রাষ্ট্রের রূপান্তরের কর্তব্য মাথায় রেখে রাজনীতি বিচার করার পদ্ধতি ও অভ্যাস আমাদের নাই। ফল দাঁড়ায় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি। যেমন, রাজনীতির মেরুকরণ ঘটে ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতার বিভেদে। অথচ গণতন্ত্র মাত্রই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাকে আলাদা করে ধর্ম নিরপেক্ষ হবার দরকার পড়ে না। তার ভিত্তি ধর্মতত্ত্ব নয়, বরং নাগরিকদের ইচ্ছা ও সংকল্প। জনগণ চায় তাদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার কায়েম হোক। এমন ভাবে নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়্ন করা হোক যাতে রাষ্ট্রের নির্বাহী, আইন প্রণয়ণী ও বিচার বিভাগ কারুরই জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার কেড়ে নেবার কোন ক্ষমতা না থাকে। যেন যখন তখন রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশান কেউ বদলাতে না পারে। রাষ্ট্রকে জনগণের কাতার থেকে এমন ভাবে গড়ে তোলা হোক যাতে সমাজের সকল স্তরে প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যক্ষ ভাবে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করবার সুযোগ থাকে। জনগণ যেন কার্যকর ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে পারে। জনগণ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন চায় না, বরং চায় শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এক রাজধানী ঢাকা আর সব জেলা ও ইউনিয়নের ওপর জোঁকের মতো শাসন শোষণ চালিয়ে যাক সেটা কেউই চায় না।

জাহেলি-মুক্ত সজ্ঞান ও সচেতন ইসলামি রাজনীতির দিক থেকে এই গণতন্ত্রের ওপর ইসলামি ছাপ পড়বে একে 'মুসলমানি' করে নয়, বরং আরও বিকশিত রূপ দিয়ে। যেমন, মানুষের রিজিক বা জীবনধারণের শর্ত ও হক এবং সৃষ্টির হেফাজত বা প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষাও নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হবে। রাষ্ট্রের অধিকার নাই 'অবাধ বাজার ব্যবস্থা' কায়েমের নামে জনগণের জীবনজীবিকা ধ্বংস করা, অল্প কিছু লোকের হাতে পুঁজি ও সম্পদের পাহাড় জমিয়ে বাকি সবাইকে নিঃস্ব আর সর্বহারায় পরিণত করা, তাদের গোলাম বানানো।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি তাঁর "হুকুমতে রব্বানিয়া'র ধারণার মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক চিন্তার কিছু দিশা আমাদের দিতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেইসব আমাদের বধির কানে কোন আওয়াজ হয়ে উঠতে পারে নি।

বাংলাদেশকে আসলে নতুন ভাবে গড়তে হবে। এর বিকল্প নাই।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুক্তি যুদ্ধের চেতনার অর্থ ভারতের আগ্রাসন ও আধিপত্য মেনে নেওয়া নয়, বরং তার উলটা। সেই আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। সীমান্তে নিরন্তর যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তার অবসান চায় জনগণ। ভারতের সঙ্গে অবশ্যই এদেশের জনগণ মৈত্রী চায়। কিন্তু সেটা হতে হবে মর্যাদার ভিত্তিতে। দাসত্বের দাসখৎ দিয়ে নয়। এর জন্য বাংলাদেশের গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই। সেটা করতে হলে একদিকে সৈনিকের মর্যাদা ও পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি যেমন জরুরী একই সঙ্গে জরুরী বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা।

বলাবাহুল্য বিএনপির যে শ্রেণি চরিত্র তার কারণে এ রাজনীতি গড়ে তোলা কঠিন। এখানেই আওয়ামি লীগের স্বস্তির জায়গা। এই কাজটি ঐতিহাসিক ভাবে যাঁরা গণমানুষের রাজনীতি করেন তাঁদেরই করবার কথা। কিন্তু আওয়ামি লীগ ও বিএনপির চেয়ে তাদের ধর্মের চুলকানি আরো বেশি। অর্থাৎ তারা অধিকাংশই মনে করেন একাট্টা ধর্মের বিরোধিতা করাই প্রগতিশীলতা। এই অবস্থান মার্কস, লেনিন বা মাও কারও নীতি বা কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একাট্টা ধর্মের বিরোধিতার কারণে জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। একটি বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে তাকে নতুন ভাবে গড়বার যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা দরকার সেটা তাদের নাই। তাদের কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক কিছু আশা করতে পারি না। ঐতিহাসিক কারণে জনগণের মধ্যে নানান ভুল চিন্তা, ভুল মতাদর্শ ও ভুলভাবে নিজেদের স্বার্থ হাজির করবার প্রবণতা থাকে। তাতে অবাক হবার কিছু নাই। যদি জনগণের সঙ্গে কাজ করাই ঐতিহাসিক কর্তব্য বলে কেউ গণ্য করে তাহলে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের যে কোন লড়াই সংগ্রামের সময় জনগণের আকাঙ্ক্ষার দিকটি বুঝতে পারা ও তাকে স্পষ্ট করে তোলা জরুরী কাজ। ওর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অভিমুখকে শনাক্ত করে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক দূরদৃষ্টি, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার দরকার । সমাজ যখন বড় কোন রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য তৈরী হয়, তখন সে কাজটা সরল রেখায় সরল ভাবে সম্পন্ন হয় এই রকম ফুল ছড়ানো সদর রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসে তার কোন নজির নাই। ইতিহাস সরল রেখায় চলে তার পক্ষে কোন প্রমাণ নাই।

ফলে আমাদের এখনকার কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তব্যগুলোকে সুস্পষ্ট ভাবে শনাক্ত করা এবং বারবার সেই কর্তব্যের কথা বলে যাওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং চৌদ্দ দলকে হঠিয়ে দিয়ে আঠারো দলকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসানোর রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠবে কিনা জানি না। কিম্বা আদৌ নির্বাচন হবে কিনা সেটাও তো নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

কিন্তু গণমানুষের দরকার রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সে কথা কাউকে না কাউকে তো বারবার বলে যেতেই হবে।

২৬ জুলাই, ২০১৩, শ্যমলী, ঢাকা

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।