পাকা ফল বাদুড়ে খায়


 এক

সমাজে অর্থনীতিতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিম্বা রাজনীতিতে যে সকল সম্পর্ক আমাদের জাপটে ধরে রাখে, মুক্ত হতে দেয় না, আমি তা উপড়ে ফেলার পক্ষপাতি। কেবল তখনই নতুন কিছুর নির্মাণ সম্ভব। সে নতুনের রূপ কেমন হবে সেটা বর্তমানের ভেতরে থেকেই অনুমান ও চিহ্নিত করা সম্ভব। বর্তমানের মধ্যে কাজ করেই তাকে ‘বর্তমান’ করে তোলা যায়, বাস্তবায়নও সম্ভব।

এক সময় দাবি করা হোত ইতিহাস সরল রেখার মতো। পেছনের যা কিছু সবই বাতিল করে দিয়ে আমরা শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে এগিয়ে যাওয়া মানেই ‘আধুনিক’ হওয়া, তথাকথিত 'প্রগতি'র অর্থও তাই। ইতিহাসের গতি রৈখিক, অর্থাৎ সরল রেখার মতো শুধু সামনের দিকে -- এই দাবি একসময় অন্ধ বিশ্বাসে রূপ নিলো, কুসংস্কার হয়ে উঠলো। 'আধুনিক' ও তথাকথিত 'প্রগতিবাদী' হওয়াটাই সভ্য হয়ে ওঠার মানদণ্ড হওয়া শুরু করল। যা কিছু পঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মানুষ ভাল মন্দ বিচার করল তার আর কোন মূল্য রইল না। প্রগতির ঠ্যালায় আমরা মানবেতিহাসের ওইতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে গেলাম। এই একরৈখিক চিন্তা ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ‘আধুনিক’ হওয়ার মধ্যে বিশেষ কোন মহত্ত্ব নাই। ইতিহাসের গতি যদি সরলরৈখিক না হয় তাহলে ‘প্রগতি’ কথাটাও অন্তঃসারশূন্য হয়ে ওঠে। তাগিদ বোধ করলে জনগণ তাদের অতীত ঐতিহ্য থেকেও এখনকার উপযোগী নির্মাণের নানান রসদ, কারগরী ও নকশা কাজে লাগাতে পারে। উপড়ে ফেলার অর্থ নিজের গোড়া বা শেকড় উপড়ে ফেলা নয়, বরং যেসব জঞ্জালের কারণে নিজের শেকড় ও স্বরূপ ঢাকা পড়ে যায় সেই সব মৃত জঞ্জাল সরিয়ে ফেলা। মানুষের বিকাশের কোন আগাপিছ নাই, সামনে পেছনে নাই -- তার অপার সম্ভাবনাকে সে কিভাবে বর্তমানের নির্মাণে কাজে লাগাচ্ছে সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

সমাজে যখন নতুন সম্ভাবনা জেগে ওঠে, তাকে বিকশিত করতে না দিলে সে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবার ভয় থাকে। এই পরিবর্তন আপসে আপ বা প্রাকৃতিক ভাবে ঘটে না। সজ্ঞানে বা সচেতন ভাবে সেই পরিবর্তন ঘটাতে হয়। বাংলাদেশে আমরা এই ধরনের একটি মুহূর্তের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। বর্তমানের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে শনাক্ত করা এবং তাকে ‘বর্তমান’ করে তোলার একটা কর্তব্য হাজির হয়েছে আমাদের সবার জন্য। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার জন্যই যা কিছু আমাদের জাপটে ধরে রেখেছে সেই সকল শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার ওপর আমি জোর দিয়ে থাকি। ঠিক সেই কারনে ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি নানান নামে যেসকল অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার ভূতের মতো আমাদের চেপে ধরে তাদের হাত থেকে মুক্তির কথাও আমি বলি। সামনে, পিছে, ওপরে নীচে, অতীতে বর্তমানে যা কিছুই আমাদের নতুন ভাবে চিন্তা ও তৎপরতায় কাজে লাগে কিম্বা কাজে লাগবার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে মনে হয়, আমি তা বিচার করবার পক্ষপাতি।

ঐতিহাসিক পরিবর্তন একটি সচেতন কাজ। মানুষই সেই কাজটা করে। হতে পারে সেটা প্রাকৃতিক ইতিহাসের বিধিবিধানের অধীনতা মেনে। কারন মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির বাইরের কিছু নয়। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেরও প্রাকৃতিক চরিত্র আছে। তাকে খেতে হয়, তার প্রয়োজনীয় উপকরণাদি তাকে প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করতে হয়, কিম্বা প্রকৃতিকে কখনও উৎপাদনের উপায়, কিম্বা কখনও কাঁচা মালের উৎস হিসাবে ব্যবহার করতে হয়। করতে হয় ভোগের দ্রব্যাদি উৎপাদনের প্রয়োজনে। কিন্তু এ কাজকেও বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ব্যাপার বলা যায় না, তাই একে বলা হয় সমাজের মধ্যে থেকে সামাজিক উৎপাদন। ভোগ, উৎপাদন, বিতরণ ও বিনিময় সমাজের মধ্যেই ঘটে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কই এই সামাজিক রূপ পরিগ্রহণ করে। এই সম্পর্কই অর্থশাস্ত্রের বিষয়। এই শাস্ত্রের কাজ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার। এই সম্পর্ককে যিনি সবার আগে সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে শনাক্ত করেছিলেন তিনি কার্ল মার্কস। তিনি পথ দেখিয়েছিলেন কিভাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার করতে হবে যাতে এই সম্পর্কের বাধ্যবাধকতার অধীনে থেকেও মানুষ বর্তমানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের কর্তাশক্তি হতে পারে। আর, ইতিহাস অর্থ মানুষ ও প্রকৃতি উভয়েরই যুগপৎ বিকশিত হওয়া, উভয়ের বিকাশ।

মার্কসের অর্থশাস্ত্রকে সে কারণে আসলে অর্থশাস্ত্র না বলে বলা যায় সম্পর্কশাস্ত্র: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার। এ সম্পর্ককে শুধু উৎপাদনী বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক হিসাবে নয় বরং অপরাপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনী, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন সম্পর্কের সামগ্রিকতা দিয়ে বোঝাটা রেওয়াজ। এই বিদ্যা আত্মস্থ করা গেলে কী ধরণের অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি জনগোষ্ঠির শক্তি ও সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রেখেছে, কিভাবে তাকে উপড়ে ফেলতে হবে, পুরাতন সম্পর্কের জায়গায় নতুন কী ধরণের সম্পর্ক কায়েম দরকার্‌ সেই লক্ষ্যে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ কি হবে তার হদিস পাওয়া সম্ভব।

সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন ঘটেছে অনেক আগে; চিন সমাজতান্ত্রিক পথে নয়, এগিয়ে যাচ্ছে পুজিতান্ত্রিক পথে। ইউরোপীয় ‘আধুনিকতা’র বিপ্লবী প্রকল্পের সম্প্রসারণ হিসাবে যে ‘কমিউনিজম’-এর সঙ্গে আমরা পরিচিত ইউরোপকেন্দ্রিকতার কারনে তার মতাদর্শিক ক্ষয়ও ঘটেছে। সেই ক্ষয় কাটিয়ে উঠতে হলে ইউরোপের বাইরে অন্যান্য জনগোষ্ঠির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বাঁধাবুলি আউড়িয়ে কিম্বা পুরানা কাসুন্দি ঘেঁটে এখনকার সংকটের সমাধান করা যাবে না। আমাদের নতুন ভাবে ভাবতে শিখতে হবে। কিন্তু তারপরও কার্ল মার্কস আছেন দাপটের সঙ্গে। কারন তাঁকে ছাড়া ইতিহাস বোঝা এবং ইতিহাসের সজ্ঞান সত্তা  ঐতিহাসিক মানুষের কর্তারূপ এবং কর্তব্য নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের জঞ্জাল থেকে মুক্তিও কঠিন হয়।

কেউ চাক বা না চাক ধর্ম রাজনীতিতে ফিরে আসছে শক্তিশালী ভাবে। এই ফিরে আসার মোকাবিলা ধর্মের বিরুদ্ধে ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘সভ্যতা’ ইত্যাদির পুরানা মতাদর্শিক বয়ান খাড়া করে করা যাবে না। যা আসলে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক আধিপত্যকেই নিশ্চিত করে। তারপরও ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিশ্বসভ্যতার ‘কেন্দ্র’ হয়ে যে ‘আলোকিত ইউরোপ’ এতোকাল মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিল সেই কেন্দ্র থেকে ইউরোপের চ্যুতি ঘটা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এই বাস্তবতাকে হিসাবে নিতে হবে। ‘আলোকিত ইউরোপ’ এতোদিন যা কিছু দাবিয়ে রেখেছিল তারা ফিরে আসছে আবার, কারণ তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ফুরিয়ে যায় নি। ফলে ঔপ্নিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে সকল চিন্তা, স্বপ্ন, কল্পনা, সংকল্পকে দাবিয়ে রেখেছে হাজার বছর ধরে বর্তমানে কী তাদের ভুমিকা সেটা পর্যালোচনা ও শনাক্ত করাই এখনকার  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

দুই

কথাগুলো তও্ব আকারে বলা যতো সহজ, কাজের পরিকল্পনা বা কর্তব্য আকারে হাজির করা কঠিন। কিন্তু আসলে কি তাই?

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার কথাই বলা যাক। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের জন্য আওয়ামি লিগ ও বিএনপির রাজনীতি চরম ক্ষতির কারণ হয়ে রয়েছে। যা আমাদের পিষে মারছে তার বোঝা থেকে মুক্তির দরকার আছে। যদি খুবই উদার রাজনীতির লক্ষ্যের দিক থেকে বিচার করি তাহলে বাগাড়ম্বর বাদ দিতে হবে। বরং বাংলাদেশের জন্য দরকারি কাজগুলো ভাবা ও সেই কাজের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরীর চেষ্টা করা দরকার। বিশাল বিশাল দাবি ও বকোয়াজিতে ভরপুর রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির মতো না, বরং, খুবই সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা করা জরুরী, যাতে সাধারণ মানুষ এখনকার দরকারী কাজগুলো বুঝতে পারে এবং দলীয় আনুগত্য নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তা সমর্থন করে। রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে ও রাজনীতিতে যে সকল আবর্জনা জমেছে তাকে সাফ করতে হলে আমাদের এখনকার আশু কর্তব্যগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

এক. রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষা করা।

সারার্থ: বাংলাদেশ ছোট দেশ, অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে দুর্বল। যদি আন্তর্জাতিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা টিকে থাকতে চাই তাহলে আভ্যন্তরীণ হানাহানি দ্বন্দ্বসংঘাত বন্ধ করতে হবে। যদি বাংলাদেশ আমরা না চাই, তাহলে সেটা ভিন্ন বিতর্ক। তখন যতো মধুর কথা বার্তা বলিনা কেন সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়ানো যাবে না। এর জন্য এক পক্ষের উগ্র বাঙালিত্ব আর অপর পক্ষে তার প্রতিক্রিয়ায় উগ্র মুসলমান হবার পথ পরিহার করা ছাড়া অন্য কোন পথ নাই।

বাংলাদেশে শুধু বাঙালি বা মুসলমান নাই – অন্যান্য জাতি সত্তা ও অন্যান্য ধর্মের মানুষও বাস করে। এই দেশ তাদেরও মাতৃভূমি। যদি আমরা তা চাই তাহলে আমাদের বুঝতে হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিচয়টা হচ্ছে নাগরিকতার পরিচয়। এই পরিচয় অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আমরা প্রত্যেকেই নাগরিক। এখানেই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমরা এক ও অখণ্ড। বাঙালি বা মুসলমান হিসাবে নয়। বাঙালি হিসাবে আমার যা অধিকার, একজন সাঁওতাল, ম্রং কিম্বা অন্য কোন জাতিগোষ্ঠির মানুষেরও একই অধিকার। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে রাষ্ট্র তার প্রতি কোন পক্ষপাত দেখাবে না। দেখানো ভুল নীতি। এতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হয়। ঠিক তেমনি মুসলমান এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শুধু মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাত রাষ্ট্রকে দুর্বল করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসল্মান্দের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংখ্যা গরিষ্ঠের হাতে সংখ্যা লঘু নিরাপদ নয় -- এই অভিযোগ উঠবে। তারা যেমন রাষ্ট্রের নাগরিক, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। আস্তিক, নাস্তিক কিম্বা বিশ্বাস ও মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রত্যকেই নাগরিক। যারা ইসলামপন্থি রাজনীতি করেন সচেতনতা ও সতর্কতার সঙ্গে তাদের বিবেচনা করতে হবে ইসলামি রাজনীতির উদ্দেশ্য কি ‘আধুনিক’ ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা? নাকি অন্য কিছু? বলাবাহুল্য, এই তর্ক ইসলামপন্থি রাজনীতির খুবই সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। কিন্তু এই তর্কের মীমাংসা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশ নিজের অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষা করতে পারবে কিনা আমি সন্দেহ করি।

অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষার জন্য শুধু চিন্তাচেতনার দিক থেকে উগ্র বাঙালিবাদ বা উগ্র মুসলমানি পরিচয় পরিহারই যথেষ্ট নয়, নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অলংঘনীয়তা কায়েম করা দরকার। অর্থাৎ নাগরিকতার উদ্বোধন ও প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র আমাদের দরকার যে রাষ্ট্রে কোন ব্যাক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ ও লংঘন করবার কোন ক্ষমতা জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ কিম্বা নির্বাহী বিভাগের কারুরই থাকবে না। নাগরিক ও মানবিক অধিকার ঐতিহাসিক ভাবে – বিশেষত ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ হিসাবে গড়ে উঠেছে। সন্দেহ্ নাই, তার সীমাবদ্ধতা আছে। যে কারণে আমি একে ব্যাক্তির বিমূর্ত অধিকার হিসাবে বিবেচনা না করে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্ভাব্য সম্পর্ক আকারে গণ্য করি, যে সম্পর্ক ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকা কঠিন।

সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের নানান পরিচয় থাকতে পারে ও আছে। আমরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক কিম্বা অন্য যে কোন পরিচয়ের অধিকারী হতে পারি। ধর্ম এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সামাজিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আরো বহুবিধ ভূমিকা পালন করতেই পারে। নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিগঠনে ধর্ম দার্শনিক ও নীতিগত ভূমিকা রাখতেই পারে। কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ – এই শ্লোগানের মধ্যে ধর্মের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ভূমিকা অস্বীকার করবার নিয়ত নিহিত রয়েছে। এই শ্লোগান মূলত বাংলাদেশের ইসলাম বিদ্বেষীর মধ্য থেকে তোলা হয়েছে। ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি মোকাবিলা করতে হলে এর বিরোধিতা করা জরুরী। ধর্মকে তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে আমাদের ধর্মরাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের পার্থক্য অস্পষ্ট থাকলে নানান বিভ্রান্তি ও বিভ্রান্ত শ্লোগান তৈরি হয়। সমাজে ধর্ম পালনের, ধর্ম প্রচারের এবং ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধুবৃত্তিক আন্দোলনের অধিকার থাকবে প্রত্যকেরই। রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল যে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট থাকলে আমরা ঐক্য ও অখণ্ডতার রক্ষা করতে পারব সেটা হচ্ছে নাগরিকতা এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অলংঘনীয়তা। অন্য কিছু নয়।

দুই. সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কায়েম

সারার্থ: স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল তারিখে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাক্ষরিত ঘোষণায় পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে, “সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করিলাম”। মনে রাখতে হবে এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং এর জন্যই তিরিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে কোন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষতা নাই। এমনকি শেখ মুজিবর রহমান দেশে ফিরে আসার পর যে সাময়িক সংবিধান দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে নিজের স্বাক্ষরে জারি করেন তার মধ্যেও স্বাধীনতার এই ঘোষণাকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সংবিধানকে দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত করার চেষ্টা ও পালটা চেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা রক্তক্ষয়ী ৪২ বছর অতিক্রম করে এসেছি। এখন আমাদের হুঁশ হওয়া উচিত।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার মধ্যে যে ঐক্য ও সংহতির বীজ রয়েছে আমাদের সেই মুহূর্তগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার সুত্র এখানে নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দরকার নতুন একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইসসাফ। এই কাজটিই এখন জরুরী।

তিন. পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়ন মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী শ্রমনীতি, কৃষিনীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন

সারার্থ: প্রথমত বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের যে বিস্তার কাঠামোগত সংস্কার এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের জবরদস্তিতে হয়েছে তা প্রতিরোধ করা দরকার। একে অনেক সময় নব্য উদারনীতিবাদ বলা হয়। এই নীতির বিরোধিতা করার অর্থ বাজার ব্যবস্থার বিরোধিতা করা নয়, কিম্বা এখনই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করে ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েমও নয়, বরং সুনির্দিষ্ট ভাবে বাংলাদেশকে লুন্ঠন ও মুনাফা কামাবার স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবার যে কোন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকে কাজ করতে দেওয়া। লক্ষ্য হবে বিনিয়োগ ও কাজের সুযোগ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশের স্থান শক্তিশালী করা।

দ্বিতীয়ত, কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিহিত এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসা। শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার মধ্য দিয়েই সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থা এবং আভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিস্তার ও বিকাশ সম্ভব। সকল ধরণের কারখানা ও কাজের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের করবার অধিকার নিশ্চিত করা অবিলম্বে দরকার। পোশাক তৈরী কারখানায় পুড়িয়ে বা ধসে পড়া ছাদের তলে শ্রমিক হত্যা করবার ফাঁদ ও পরিস্থিতি বদলাতে হবে।

চার: প্রাণের সুরক্ষা এবং পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র ও প্রাণের ব্যবস্থাপনা মজবুত করা

সারার্থ: রাষ্ট্র রাজনীতি সমাজ ইত্যাদি সকল কিছুর আগে মানুষকে প্রাণে বেঁচে থাকতে হবে। পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র ও প্রাণের ব্যবস্থাপনা মজবুত এবং প্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বিষয়টি একালে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রাণ ব্যবস্থাপনা জটিল একটি ক্ষেত্র। কিন্তু সহজ ভাবে যে কেউই শুধু কান্ডজ্ঞাম্নেই বুঝতে পারে অর্থনৈতিক বিকাশকে টেঁকসই করতে হলে তাকে পরিবেশ সম্মত হতে হবে। বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্রে সমৃদ্ধ দেশ। প্রাণ ও পরিবেশের সুরক্ষা অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যও দরকার। সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্ন জড়িত। এই দিক গুলির প্রতি গুরুত্ব কম দেওয়া হয় বলে পরিবেশ দূষিত হয়ে চলেছে। যদি আমরা বেঁচেই থাকতে না পারি তা হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিম্বা রাষ্ট্রের রূপান্তরের কী আর মানে থাকতে পারে?

পাঁচ. জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে শক্তিশালী গণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা

সারার্থ: বাংলাদেশ অরক্ষিত। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশের নাগরিকদের নির্বিচারে নিরন্তর হত্যা করবার যে চর্চা আমরা ভারতীয় বিএসএফের মধ্যে দেখি তাকে মোকাবিলার পথ এটাই। ফেলানিকে নিয়ে আমরা বিস্তর কাব্য রচনা ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারি, কিন্তু ফেলানিরা মরবে যদি বাংলাদেশ নিজের সীমান্ত নিজে রক্ষা করতে অক্ষম হয়। মায়ানমারও বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ কারণে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা একটি জরুরী দাবি।

এই পাঁচটি দাবি, কর্মসূচি নয় – কিন্তু এই মূহূর্তের দরকারি বিষয়। এ বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে কী ধরণের আবর্জনা আমাদের সাফ করতে হবে সে সম্পর্কেও কিছু আগাম ধারণা অর্জন করা দরকার।

বাংলাদেশের রাজনীতির যে অবস্থা তাতে নিশ্চিত বলতে পারি এই দাবিগুলো পেকে গিয়েছে। অর্থাৎ এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। গ্রামদেশে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো নিয়ে মশকরা বাক্য ব্যবহারের রীতি আছে। আমি পাকা কাঁঠাল গাছ থেকে পাকাই পেতে চাই, অকালে গাছ থেকে কেটে এনে কিলিয়ে পাকাতে চাই না। সাধারণ মানুষের প্রজ্ঞা শুধু কিলিয়ে পাকানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নাই, গাছে পাকা ফেলে রাখলে কি ফল হয় সে সম্পর্কে তাদের নিরীক্ষণ চমৎকার। সেই ক্ষেত্রে প্রবাদ হচ্ছে পাকা ফল বাদুড়ে খায়। তার মানে ফল যদি পেকে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে গাছে রেখে দেওয়া নিরাপদ না। পেড়ে ফেলতে হয়। নইলে বাদুড়ে খাবে। গাছে ফল পেকেছে, কিন্তু বাদুড়ে খেয়ে নেবে সেটা হয় না।

কথাটা বলছি এ কারনে যে বাংলাদেশের এখনকার যে পাকা পরিস্থিতি তাতে তা যে কোন দিকেই গড়াতে পারে। সেই দিক থেকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টা আমাদের করা উচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি শক্তিশালী অংশ দীর্ঘদিন ধরে ‘তৃতীয় শক্তি’র উত্থান চাইছে। আওয়ামি লিগ বা বিএনপিকে মতাদর্শিক বা রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার কোন হিম্মত এদের নাই। এরা রাজনৈতিক দলও করে না। না করাটা দোষের নয়। তার পরেও তারা ইতিবাচক রাজনীতির সহায়ক নানান সামাজিক ভূমিকা পালন করতে কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রাখতে পারে যাতে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার গুণগত রূপান্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত তৈরী হয়। কিন্তু সেইসকল গঠনমূলক কাজের চেয়ে তাদের কাজ হচ্ছে রাজনীতির বিদ্যমান উদারনৈতিক বয়ানের মধ্যে ভাসা ভাসা কথাবার্তা বলা। এই অভ্যাস পরিহার করে উচিত কাজ হচ্ছে কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয় তার একটি বাস্তবোচিত মূল্যায়ন। তারা জানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে এবং তাদের কথিত ‘তৃতীয় শক্তি’র আবির্ভাবের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে পাশ্চাত্য দেশগুলোর সহায়তা ছাড়া সে্টা সম্ভবও নয়। জাতিসংঘের ভূমিকাকেও আরো গণ নজরদারির মধ্যে রাখা দরকার।

কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে, অনেক কিছুই পেকে গিয়েছে, পেড়ে ফেলা দরকার। পাকা ফল যেন বাদুড়ে নিয়ে না যায় সে ব্যাপারে যারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন সেই দিকে নজর রাখবেন আশা করি ।

সর্বোপরী দরকার নিজদের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য চেষ্টা করা। এই আকুতিই হয়ত আমাদের সঠিক পথ দেখাবে।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩। ২৯ ভাদ্র ১৪২০। শ্যামলী, ঢাকা

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।