গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য


বাম ঘেঁষা সমাজবিজ্ঞানীরা কমবেশী সকলেই মানেন যে একটি জনগোষ্ঠির মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের উদ্ভব ও বিস্তার একটি মাত্রা অতিক্রম করলে পুরানা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে, সমাজের রূপান্তর ঘটা শুরু হয়। এই অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা ঘটে। এই ফর্মুলা মাথায় রেখেই তথাকথিত প্রগতিশীল ঘরানার রাজনীতির নিজেদের রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয় করবার কথা। এই প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উৎখাত করে একটি জনগোষ্ঠি ঐতিহাসিক উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে তাদের যাত্রা শুরু করে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এটাই সারকথা।

তবে ইউরোপের ইতিহাসকে সকল জনগোষ্ঠির ইতিহাস অনুমান করে এই সাক্ষ্য দেওয়া হয়। মোটাদাগে এই বিপ্লবের লক্ষ্য থাকে তিনটি। এক. নাগরিক হিসাবে ব্যক্তির আবির্ভাব ও বিকাশ নিশ্চিত করা; দুই. প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে নতুন ও গতিশীল উৎপাদন সম্পর্ক প্রবর্তন। তিন. অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক মোকাবিলার পথ সাফ করা। প্রথম দুই লক্ষ্য কমবেশী বামপন্থী চিন্তার সুবাদে কিছুটা আমাদের জানা থাকলেও শেষের লক্ষ্য সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ভাবাভাবি করি না। এখানে একটু চেষ্টা করব। যদি ভাবি তো দেখব কোথায় ইউরোপীয় ইতিহাসের ছক থেকে আমাদের ইতিহাস ভিন্ন বাঁক নিয়েছে এবং কোন্ দিকগুলো আমাদের বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট সমস্যা অতএব ইউরোপবাদিতা পরিহার করে সেইসব নিয়ে আমাদের নিজেদের ভাবনা নিজেদেরই করা উচিৎ।

প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক নানান ধরণের হতে পারে। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র যেমন। কিম্বা হতে পারে ‘এশীয় সামন্ততন্ত্র’। তার মধ্যে বর্ণাশ্রম প্রথা, জাতপাতের ভেদাভেদ ইত্যাদি। এশিয়ায় কী ধরণের সম্পর্ক বর্তমান ছিল এবং তাদেরকে ঠিক কিভাবে শনাক্ত, শ্রেণীকরণ ও নামকরণ করা যায় তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একসময় আগ্রহ ছিল। তর্কবিতর্কও হয়েছে। আজকাল তেমন দেখি না। এরপর দক্ষিণ এশিয়ায় – কিম্বা আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বৃহৎ বঙ্গে (দীনেশ চন্দ্র সেনের অর্থে) এবং আধুনিক বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থা কেমন ছিল তা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়। বর্ণাশ্রম প্রথা, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বিধবা নারীদের চিতায় পুড়িয়ে মারার আর্থ-সামাজিক ভিত্তি বিচার বাদ দিয়ে সেই আলোচনা সম্ভব না। এই জায়গাগুলোতে এসে আমরা টের পাই ইউরোপের ইতিহাস দিয়ে কিছুটা নকলবাজি কাজ চললেও গোড়ার জায়গায় এসে আমরা আর আমাদের ইতিহাস বুঝতে পারছি না। পশ্চিম বাংলায় দীর্ঘকাল কমিউনিস্টদের শাসন এবং সীমান্তের এই দিকে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাবের পরও খুব একটা কাজ হয় নি। এই ফাঁক ভরাবার জন্য একটি সমাজ ব্যবস্থার ভাঙনের কারণ হিশাবে বাইরে থেকে মুসলমানদের আক্রমণ এবং  কার্ল মার্কসের ভাষায় 'হিন্দুভূত' হওয়া এবং পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনকে খাড়া করা হয়। দিল্লি থেকে ভৌগলিক ভাবে বহু দূরে অবস্থিত হওয়ার পরেও কিভাবে বঙ্গে এতো মুসলমান এলো সেটাও কৌতুহল জাগানিয়া তর্কের বিষয় হয়েছে। চরম সাম্প্রদায়িক না হলে বৌদ্ধ ধর্ম এবং ইসলামের বর্ণাশ্রম বা জাত পাত বিরোধী লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করবার কোন কারন নাই। কিন্তু একটি বিশাল জিজ্ঞাসা অনুচ্চারিত থেকে গেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম, মুঘল ইতিহাস, সুলাতানি বঙ্গ, ইংরেজ শাসন ইত্যাদি সব কিছুর পরও 'সনাতন' ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থাকে স্রেফ 'হিন্দু' সমাজ ভাববার কোন কারন নাই, কারন 'হিন্দু' একটি আধুনিক নির্মান। তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে সাঁওতাল, মুণ্ডা, গারো, রাজবংশী, শবর ও ব্যাধসহ অন্যান্য আরও বহু লুপ্ত বা প্রায়-বিলুপ্ত জনগোষ্ঠির জীবনেতিহাস। ইতিহাসের তলানি হিশাবে তারা  আদিবাসীদের লড়াই ও ভক্তি আন্দোলনসহ নিম্নবর্গের জনগণের নানান প্রতিরোধের ইতিহাস হিশাবে জীবন্ত রয়েছে। এই প্রতিরোধ হাওয়ায় ভেসে নাই। চাষা, জোলা, মুচি, কামার, তাঁতী ইত্যাদি নানান জীবন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই তারা বর্তমান রয়েছে। এই দিকটা কিভাবে বুঝব? গণতান্ত্রিক বিপ্লব সকলের ইতিহাস কিভাবে ধারণ করবে? বিপ্লব অতীতকে রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে পারে না, কিন্তু কিভাবে রাজনৈতিক রূপান্তর অতীত মোকাবিলা ও আত্মস্থ করে তার ওপর সেই রূপান্তত্রের শক্তি ও দীর্ঘস্থায়ীত্ব নির্ভর করে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যতও অতীতের সঙ্গে ফয়সালার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশে ইউরোপের ইতিহাসকে বোঝার জন্য ‘সামন্ততন্ত্র’ কথাটা যেভাবে ব্যবহার করা হয় ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই ইউরোপীয় ক্যাটাগরির ব্যবহার কতোটা যৌক্তিক কিম্বা কাজের তা নিয়ে তর্ক আছে। এটা তো ঠিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসকে তার নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই বুঝতে হবে। অনেকে মনে করতে পারেন এই ধরণের তত্ত্বকথা বা ইতিহাস বিচার আমাদের এখনকার রাজনৈতিক সমস্যা বোঝা বা নিরসনের ক্ষেত্রে কোন কাজে লাগে না। কথাটা ঠিক না। সে দিকটাই কিছুটা আজ বলার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশের ইতিহাসের দিক থেকে আরেকটি গুরত্বপূর্ণ দিকও রয়েছে, যা মনে না রাখলে প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক কথাটা অস্পষ্ট থেকে যায়। সেটা হোল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে বাংলার জমিদারদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী জমিদাররা রাতারাতি জমির মালিক বনে যায়। ঔপনিবেশিক শাসন ও আইনী অর্থে জমির সকল প্রকার স্বত্বের অধিকারী হয়ে যায় তারা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের শুধু জমির মালিক বানায় নি, জমির মালিক হওয়ার সুবাদে ইংরেজকে তারা যে খাজনা দিত সেই খাজনার হারও তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ইংরেজ সরকার জমিদারদের খাজনার হার বাড়াবেনা বলে চুক্তি করেছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সারকথা হচ্ছে জমিদারদের মাধ্যমে বাংলার ভূমিব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পুঁজির বিচলন ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্গত করে নেওয়া। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করেছে -- আন্তর্জাতিক পুঁজির ইতিহাসের দিক থেকে এ এক অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশে জমিদারতন্ত্র কায়েম হয়েছে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও দখলের দরকারে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল হিসাবেই ঔপনিবেশিক জমিদারতন্ত্রের শহর হিসাবে কলকাতা গড়ে ওঠে। কৃষকদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভূমি থেকে বাড়তি মুল্য তুলে আনার ব্যবস্থা হয়েছিল। আর তারই পরিণতি জমিদার, মোসাহেব, মুৎসুদ্দি ও স্থানীয় নব্য ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরী এবং ঔপ্নিবেশিক কলকাতা শহর।ঔপনিবেশিকতার ঔরসে বাংলার নবজাগরণের অর্থনৈতিক ভিত্তিও এখানে নিহিত। উচ্চবর্ণ ও ধনি শ্রেণির অধিপতি ভূমিকার ভিত্তিও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত । ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ও পরবর্তীতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শ্রেণির শাসনের ভিত্তিও এই খুঁটির ওপর গাঁড়া। কলকাতায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে গড়ে ওঠা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আধুনিকীকরণ কিম্বা গরিমার্থে ‘বাংলার নবজাগরণ’ উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই নবজাগরণ। ‘বাঙালি’ নামে যে আত্ম-পরিচয় তার বোধ, চেতনা ও আত্ম-পরিচিতি এই হিন্দু জাগরণের ফলেই নির্মিত হয়েছে। পরিচয়টা হিন্দু বাঙালির – এর বিপরীতে রয়েছে বর্ণাশ্রম, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জমিদারতন্ত্রের অধীনে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত ও শোষিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি এবং উচ্চবর্ণ পরিমণ্ডলের বাইরে অহিন্দু মুসলমান জনগোষ্ঠি।

কিন্তু তাই বলে ঔপনিবেশিকতার আশ্রয়ে উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালির নবজাগরণের অর্জনকে খাটো করে দেখার কিম্বা তার নির্বিচার বিরোধিতার কোন সুযোগ নাই। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ বা যার কথাই বলিনা কেন আধুনিক উচ্চ বর্ণের ‘বাঙালি’ বা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকদের সংস্কৃতির মধ্যে বাংলাভাষীদের যে অর্জন সেটা ঐতিহাসিক। একে অস্বীকার করার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করার শামিল। সমাজ ও ইতিহাসের বাইরে কেউ বাস করে না। হিন্দু কি মুসলমান কেউই ইতিহাসের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ পরিচয় নির্মান করেনি এবং কারো পক্ষেই ইতিহাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার মধ্যে লড়াই-সংগ্রামের চরিত্র বিচার করতে পারাই এখনকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই বিচারের দরকারেই আমাদের সবসময়ই মনে রাখতে হবে ‘মুসলমান’ পরিচয়ের বিপরীতে নিজেকে ‘বাঙালি’ বলার মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং নিজের সাম্প্রদায়িক ইতিহাস ও পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতাই প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের বিপরীতে কেউ ‘বাঙালি’ পরিচয় বহন করেন বলে তিনি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত নন। ইতিহাস বলে, সেই দাবি করার কোন সুযোগ নাই। বরং এই ঐতিহাসিক অজ্ঞতা আরও অনেকগুলো বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়। সেই বিপদ্গুলো বুঝে নেওয়া যাক।

এটা বোঝা সহজ যে প্রথমেই জাতিগত অহমিকার কারনে বাঙালি ‘জাতি’ হিসাবে নিজের পরিচয় জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। দ্বিতীয়ত জাতিগত সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও ঐতিহাসিক কারণেই এই পরিচয় ঔপনিবেশিকতার ঔরসে উচ্চবর্ণের হিন্দুর ‘জাগরণ’ থেকে তৈয়ারি বর্ণাশ্রমী সাম্প্রদায়িক পরিচয়ই বহন করে। অথচ দরকার এই পরিচয়ের পর্যালোচনা এবং এর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানের –অর্থাৎ এই অঞ্চলের কৃষক ও তাদের উত্তরাধিকারীদের যুক্তিসঙ্গত আপত্তিগুলো ঐতিহাসিক ভাবে বোঝা, যাতে ‘বাঙালি মুসলমান’ এর প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার গুহার অভ্যন্তরে ঢুকে না যায়। মনে রাখা দরকার বাঙালি মুসলমান ভুলে গিয়েছে সে মূলত নিম্ন বর্ণের শূদ্র, প্রাচীন সমাজ ও ধর্মিয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব এবং পরবর্তীতে ও ইসলাম আসার পরে ধর্মান্তরিত কৃষক। এই ইতিহাস নির্মোহ হাবে জনগণকে বোঝানোর কাজটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আরব, ইরান বা তুরানের ইতিহাস, সংস্কৃতি বা সভ্যতা নয়। তাহলে তার হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক বাঁকগুলো বোঝা এবং বর্তমান লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যখ্যা বিশ্লেষণ জরুরী। বাংলার সনাতন ও লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ নানান সূত্রে জড়িত। বাংলার জলহাওয়াতেই তাদের গড়ে ওঠা। সে সুত্রগুলো তার এখনকার লড়াই সংগ্রামে সে অবশ্যই ব্যবহার করবে এবং ব্যবহার করতে প্রস্তুত।

আর সবচেয়ে বড় কথা মানুষ তার মাতৃভাষাতেই বাস করে। বাঙালির ভাষা বাংলা। কিন্তু সামগ্রিক ইতিহাসকে উপেক্ষা করে শুধু ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে চিরায়ত ‘জাতি’ পরিচয় নির্মাণের যে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী চেষ্টা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দেখি সেই বিপদ থেকেও বাংলাদেশের জনগণকে দূরে থাকতে হবে। এই চেষ্টা ঘুরেফিরে সেই বর্ণাশ্রমী খাদের মধ্যেই নিজেকে নিক্ষেপ করা। বাংলা আমার মাতৃভাষা বলার অর্থ এই নয় যে ঔপনিবেশিকতার ঔরসে গড়ে ওঠা সাহিত্যের বাংলা বা তথাকথিত ‘প্রমিত ভাষা’ আমার মাতৃভাষা। কিছুটা নতুন সাইবার টেকনলজির কারণে এবং কিছুটা নিজেদের স্বাভাবিক উপলব্ধির দরুন বাংলাদেশের তরুণ কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় তাৎপর্যপূর্ণ বদল ঘটেছে। তাদের দৈনন্দিন জীবনে কথ্য ভাষার ব্যবহার এ কারণে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু সাহিত্যিক দিক থেকে এই চেষ্টাকে বিচার করলে চলবে না। তারা শুধু শব্দ ব্যবহারে সন্তুষ্ট নয়, ক্রিয়াপদ ও বাক্যগঠনের ক্ষেত্রেও প্রমিত ভাষার শাসন ভাঙছেন। ফেইসবুক জমানারও বহু বছর আগে, শুরু থেকেই, আমি এই লক্ষণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। তখন নিশ্চিত ছিলাম না, শেষ তক কী দাঁড়াবে। এখন যে চেহারা দাঁড়াচ্ছে তাতে নিশ্চিত বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা পুরানা ঔপনিবেশিক বাংলা ভাষার রাস্তায় আগের মতো হাঁটবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্যের আরম্ভ-চিহ্ন বাংলার নবজাগরণ নয়, বরং একাত্তর। এই অর্থে যে এই দিকচিহ্ন বাংলাদেশের জনগণের নিজেদের ইতিহাস নিজেদের মতো করে রচনা, পুনর্বিবেচনা ও পর্যালোচনারও আরম্ভ-বিন্দু। বিগত বেয়াল্লিশ বছর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি উভয়েই তাদের নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে এই কাজে বাধা দিয়েছে।

তৃতীয়ত আমরা সম্প্রতি দেখেছি বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষাবলম্বনের মধ্য দিয়ে কিভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষাবলম্বন করা হয়। নিজেকে ‘বাঙালি’ বলার মধ্যে এই ফ্যাসিবাদ ধারণ করবার চেতনা নিহিত। নিজেকে ‘বাঙালি’ বলাকে আমরা যতোটা নিরাপরাধ মনে করি, ব্যাপারটা অতো সোজা সিধা নয়।

সোজা কথা হচ্ছে ঔপনিবেশিকতার ঔরসে গড়ে ওঠা ‘বাঙালি’ একটি অসাম্প্রদায়িক ধারণা নয়। ঘোরতর ভাবে সাম্প্রদায়িক ধারণা এবং জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই পরিচয় ধারণ করেই জনগণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর কারণ হচ্ছে যে কোন জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে একটি রণনীতিগত পরিচয়ের অধীনে জনগণকে সংগঠিত এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করবার প্রয়োজন দেখা দেয়। যাঁরা সাম্প্রতিকালে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ‘উত্তরাধুনিক’ নামে পরিচিত তারা এই বিশেষ আত্ম-পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তার নাম দিয়েছেন রণনৈতিক পরিচয় (strategic essentialism)। অর্থাৎ এমন একটি সত্তায় নিপীড়িত জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি কিম্বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের চিহ্নিত করে যাতে নিজেদের মধ্যে শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম, আত্মপরিচয় বা আদর্শের বিরোধ থাকলেও একাট্টা হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে তারা কথা বলতে পারে, প্রয়োজনে নিপীড়কের বিরুদ্ধে সংগ্রামও করতে পারে। উচিত ছিল এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে সকল ঐতিহাসিক বিসংবাদ আবর্জনার মতো জমে ছিল, সেইসব সাফ করা। ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকলে অনায়াসেই বোঝা যেত একাত্তর ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল না, কিম্বা অতীতের সঙ্গে বাঙালির চূড়ান্ত বিচ্ছেদও নয়। বাঙালি মুসলমানের এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করবার অর্থ এই নয় যে তারা অতীতের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ভুলে যাবে। সে যে ভোলে নি সেটা বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রমাণ করে। একাত্তরে জনগণ 'বাঙালি' নামের অধীনে একাট্টা হওয়ার অর্থ সকলে অভিন্ন হয়ে যাওয়া নয়। রণনৈতিক পরিচয়ের ধারণা 'বাঙালি'র পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে আমাদের সহায়তা করে। এর মোচন ইতিহাসের পুনর্পাঠ ও পর্যালোচনা ছাড়া সম্ভব নয়।

দুই বাংলার বাঙালিকে একই অর্থে ‘বাঙালি’ ভাবেন অনেকে। এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে বাংলাভাষীদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক মজবুত করা দুই পক্ষের জন্যই ভাল। নৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক এই উভয় দিক থেকেই বাংলাভাষীদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করা খুবই দরকারী কাজ। কিতু এটা এক তরফা হবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অধিকাংশেরই ধারণা, ‘বাঙালি’ পরিচয়ই অসাম্প্রদায়িকতার মানদণ্ড। এটাই ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার হবার পথ। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদীদেরও মত এটাই। এখানেই মস্তো ফাঁকির জায়গা। বাংলাদেশের জনগণের মতো পশ্চিম বাংলার হিন্দুর ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার কোন রাজনৈতিক কিম্বা রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস নাই। বাঙালি বনাম মুসলমানের লড়াই হিসাবে যে পুলসিরাত বাংলাদেশী জনগণকে পেরুতে হচ্ছে, সেই বিপদের হাত থেকে তারা মুক্ত। এর ফলে তাঁরা হিন্দুই থেকে গিয়েছেন এবং শেষতক হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতকেই তার আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নিয়েছেন। তারা ইসলামকে বাঙালির ইতিহাসের অংশ বলে মনে করেন না। অন্তত তাঁদের এই উপলব্ধিটুকু আছে সেটা পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক তৎপরতা থেকে বোঝার কোন উপায় নাই। অর্থাৎ তাঁরা বৃহত্তর বাঙালি সমাজের অন্তর্ভুক্ত,  বাংলার ইতিহাসের বাইরের নন এমন কোন উপলব্ধির প্রমাণ আমার হাতে নাই। পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ অখণ্ড ভারতকে যেমন মেনে নেয় নি, তেমনি পাকিস্তানকেও নয়। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বাঙালি নিজেকে আগে হিন্দু গণ্য করে বলে নিজেকে ভারতীয় ভাবে। ভারতীয় বাঙালির সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালির এখানে বিরাট পার্থক্য। এই পার্থক্য রাজনৈতিক। শুধু ভালবাসা, প্রেম, মহব্বত বা সুসম্পর্ক দিয়ে এর মোচন হবে না। বাঙালি হিন্দুর একটি জাতীয় জাগরণ দরকার।

‘বাঙালি’ শব্দের আগে আমরা সাধারণত ‘হিন্দু’ ব্যবহার করি না, কিন্তু মুসলমানিত্বকে বাঙালিত্বের ব্যতিক্রম গণ্য করি। এই দিক থেকে ‘বাঙালি’ দ্বিগুণ সাম্প্রদায়িক। প্রথমত তার পরিচয়ের হিন্দুত্বকে সে লুকায়, দ্বিতীয়ত ‘বাঙালি’র ঝান্ডা দেখিয়ে সেও উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাসকে নাকচ করে। অথচ নির্বিচার ‘বাঙালি’ পরিচয়ের আলখাল্লা পরে ঐতিহাসিক ভাবে উচ্চবর্ণের ঔপনিবেশিক হিন্দুত্বকে পশ্চিম বাংলা বহন করে। নিজেকে সাফ না করে বাঙালি হিন্দু দাবি করে, মুসলমানকেও বাঙালি হতে হলে এই হিন্দুত্বের ঐতিহাসিক আবর্জনাই বহন করতে হবে। ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ – এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এই ঘোষণাই দেওয়া হয় যে বাংলাদেশের জনগণকে ইসলামের আগমন থেকে শুরু করে বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াইসহ তার শূদ্র ও নিম্নবর্গের জীবনের ইতিহাস ভুলে যেতে হবে। ভুলে যেতে হবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমি হারানোর স্মৃতি। ভুলতে হবে জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই। মুছে ফেলতে হবে সিপাহি বিদ্রোহ ও তার পরিণতিতে আলেম-ওলেমাদের নির্বিচার হত্যা, ভুলে যেতে হবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কৃষক হিসাবে তার সংগ্রামের ইতিহাস। মেনে নিতে হবে নয় মাসের ইতিহাসই এই দেশের জনগোষ্ঠির একমাত্র ও শেষ ইতিহাস।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন এই সাক্ষ্যই দিচ্ছে যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে এই দেশের মানুষ ইতিহাসকে তাদের জায়গা থেকেই বিচার করবার জন্য তৈরী হচ্ছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালি এই প্রক্রিয়াকে কতোটা বুঝতে সক্ষম তার ওপর 'বাঙালি' হিশাবে তাদের ভবিষ্যতও নির্ভর করছে। কিন্তু এখনও পথ অনেক পিচ্ছিল। কারন স্রেফ সাম্প্রদায়িক অর্থে ‘মুসলমান’ পরিচয়ের পেছনে যে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা সেটা বাঙালি মুসলমানের পথ হতে পারে না। কারন তারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যেমন, তেমনি জালিম পাকিস্তান শাহীর বিরুদ্ধেও লড়েছে। 'মুসল্মান' বলে জালিমকে বরদাশত করে নি।

বাংলাদেশের মানুষ আত্ম-পরিচয়ের সংকটে ভুগছে কি? এই দাবি আংশিক সত্য। পুরাটা নয়। ভোগার প্রধান কারণ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে এই দেশের জনগোষ্ঠির একমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাস গণ্য করবার যে-অজ্ঞতা নিরন্তর চর্চা হয়েছে তার বিরুদ্ধে জনগণকে – বিশেষত তরুণদের সচেতন করবার রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা যায় নি। সতর্ক ইতিহাস নিষ্ঠা এই মুশকিল কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘বাঙালি’ বা ‘মুসলমান’ নামক ধারণার কোন অর্থ নাই। উভয়ের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিরোধকে বুঝতে হলে প্রথমেই বোঝা দরকার আত্ম-পরিচয় কোন প্রাকৃতিক ব্যাপার নয় বরং ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ক্যাটাগরিকে আমরা যখন মনে করি গাছ পালা পাহাড় পর্বতের মতো প্রাকৃতিক বা চিরায়ত সত্তা তখনই সেটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেকেই মনে করেন ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’, বাঙালি’ ইত্যাদি সত্তা কিম্বা পরিচয়গুলোগুলো প্রকৃতির মতোই একটা স্বাভাবিক ও চিরায়ত ব্যাপার। জন্মসূত্রে আমরা সিলছাপ্পড় গায়ে নিয়ে মায়ের পেট থেকে এই সব দাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। সিল ছাপ্পড় মারা খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি যেমন বাঙালির নিজস্ব জিনিস, তেমনি ইসলাম এই দেশে নির্মূল হবার জন্য আসে নি, বরঙ উপমহাদেশের ইতিহাস হবার জন্যই এসেছে। এই কাণ্ডজ্ঞান যেন আমরা না ভুলি। সেই জন্য নতুন ভাবে ইতিহাস পাঠ করা জরুরী।

ইতিহাসের মধ্যে থেকে ইতিহাস কিভাবে আমাদের গঠন করেছে এবং আগামি দিনে কিভাবে আমরা নিজেদের ঐতিহাসিক ভাবে গঠন করতে চাই সেই মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে পারার মধ্য দিয়েই আমরা এখনকার বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারব। বিমুর্ত কায়দায় ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘বাঙালি’ কিম্বা ‘মুসলমান’ হয়ে নয়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শর্ত তৈরী হয়ে রয়েছে বহু আগে থেকে। সংস্কৃতি, মনোগঠন বা আত্মপরিচয় নির্মাণের ইতিহাসের দিক থেকে এই বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে জমে থাকা সকল ঐতিহাসিক আবর্জনা সাফ করা – যেন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বসভায় তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে। এই বিপ্লবে পশ্চিম বাংলার বাঙালি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সূত্রে বাংলাদেশের জনগনের  বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কোথায় কিভাবে যুক্ত থাকবে, কিম্বা আদৌ থাকবে কিনা সেটা দুই পক্ষেরই গভীর ভাবে ভাববার দরকার আছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু ও অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক মোকাবিলার পথ সাফ করা। বিপ্লবের এই তৃতীয় লক্ষ্যের ওপর আমাদের নজর তীক্ষ্ণ করা এবং বদ্ধ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসাই এখনকার কাজ।

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩। ৫ আশ্বিন ১৪২০। শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।