নির্বাচন, পরাশক্তির হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ


পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বকাঠামোতে গণতান্ত্রিক চর্চা মানেই সাম্রাজ্যবাদীদের কর্পোরেট আধিপত্য মেনে নিয়েই রাজনীতি করা, বাংলাদেশে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাই করে কিন্তু তারপরও এই সাম্রাজ্যিক হেজিমনির যুগেও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা, সীমিত স্বাধীনতা রয়েছে তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকার আদায়ের বন্দোবস্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রেরএই সীমিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও পুরাপুরি নস্যাৎ হয়ে যাবে যদি বাংলাদেশ সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট হয়ে উঠে। বাংলাদেশের বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর সেবাদাসসুলভ মনোভাবের কারনে আগামী নির্বাচনে পরাশক্তির সমর্থন লাভ ক্ষমতার রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নির্বাচনের এই মৌসুমে বাইরে যতোই সংঘাতের দিক দেখা যাক না কেন ভেতরে চলছে আপোষের খেলা, মূল ধারার রাজনৈতিক দুই ফ্রন্টের মাঝে চলছে পরাশক্তির আনুকূল্য লাভের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় দুর্ভাগ্যজনকভাবেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত করার জন্য সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সহযোগিতা দানের অঙ্গীকার করছেন। বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনে কোন দল ওয়ার অন টেরর এর মার্কিন প্রকল্পে এই অঞ্চলের হাবিলদার হিসেবে বেশি যোগ্যতার সাথে কাজ আঞ্জাম দিতে পারবে তার এক অশুভ এবং আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখে যেতে হচ্ছে।

গত ২০ অক্টোবর বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, “আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের সরকারের আমলে আমরাই এর সূচনা করেছি। আগামীতে এ লড়াই কেবল অব্যাহতই থাকবে না, সন্ত্রাস বিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অন্যান্য দেশ ও সংস্থার সঙ্গে মিলে এই সহযোগিতা আরো বাড়াবার উদ্যোগ আমরা নেব”। এভাবেই বেগম জিয়ার দেয়া ভাষণে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পরিপূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন জয়ের চেষ্টার পর পরই ২২ অক্টোবর সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগও বুঝিয়ে দিল এ কাজে তারাই বেশি যোগ্য। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দেয়া ভাষণে পরাশক্তিদের রাজি খুশি করার দিকেই নজর ছিল বেশি; যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর এর প্রকল্পে (খালেদা জিয়ারর ভাষায় আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) বিএনপিও যে যোগ্য দেশীয় এজেন্ট তা প্রমাণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল, আর ছিল প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার নামে ভারতীয় আধিপত্যবাদের মুখেও নমনীয় ও নতজানু হয়ে থাকার ইঙ্গিত। ফলে পরাশক্তির আধিপত্য কে কত বেশি মেনে নিয়ে দেশ চালাবে এটাই এখন নির্বাচনের বৈদেশিক ফ্যাক্টর !

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃপা লাভের আশায় মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা চুক্তি করল সরকার। বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্র সচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এতে স্বাক্ষর করেন। এতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব যে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক স্ট্রাটেজিক স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ যে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে তা আমলে নেয়ার কোন গুরুত্বই মনে করেননি নীতি নির্ধারকরা। এই চুক্তির আওতায় সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে দুই দেশ আধুনিক কলাকৌশল বিনিময় করবে। এ ছাড়া উভয় দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ফরেনসিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ এবং সাইবার অপরাধ দমনে দুই দেশ সহযোগিতা করবে। দুই পক্ষের সম্মতিক্রমে বন্দর ও সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয় এবং সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসী কোনো দেশের সীমানায় আবদ্ধ নয়। এ বিষয়টি সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদ দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিয়েছে”। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেন, বাংলাদেশের পুলিশ বিজিবি কোস্টগার্ড সবাই সন্ত্রাসবাদ দমনে কাজ করছে। এ চুক্তির ফলে দুদেশ চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং সন্ত্রাস দমনেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এই উদ্যোগের লক্ষ্য হল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার উন্নয়ন করা, যা আমাদের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব ও সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”

আমরা লোকাল অর্থে যেভাবে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করি তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস ধারণার মারাত্মক পার্থক্য রয়েছে। সন্ত্রাস বলতে যুক্তরাষ্ট্র বুঝে থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে এবং যে দল বা গোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী শক্তি আকারে লোকালি এবং আন্তর্জাতিকভাবে লড়বে তাদেরকেই সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে তাদের দমনের প্রচেষ্টা চালাবে। একেই তারা নাম দিয়েছে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’। ফলে সরকার, বিরোধী দল এবং রাষ্ট্রদ্যূত ড্যান মজিনা যেভাবে সন্ত্রাসবাদ দমনকে মহিমান্বিত করছেন তা মোটেই মেনে নেয়া যায় না। বর্তমানে মার্কিন বিরোধিতাই যেহেতু সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছে সেহেতু বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ সুরক্ষার (তেল গ্যাস লুণ্ঠনসহ বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের উপর মার্কিন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা , বাংলাদেশের সেবা খাত দখলসহ বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনীতিক আধিপত্য বজায় রাখা, কিংবা আগামীতে চীনকে ঠেকাতে অথবা দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে বঙ্গোপসাগরে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপরতা) যে কোন নীতি, প্রকল্প বা চুক্তির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয়া ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দলকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে তাকে দমণে দুই দেশের মাঝে সম্ভাব্য সব রকমের সহযোগিতা করাই হবে এই চুক্তির মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যে কোন আন্দোলন প্রতিরোধের জন্য এই চুক্তিকে কাজে লাগাবে যুক্তরাষ্ট্র।

পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে চলমান ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টের মত এদেশকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী প্রকল্পের নয়া ক্ষেত্রে পরিনত করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাথে ১৯৮৬ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, হানা (হিউম্যানেটারিয়ান এসিস্ট্যান্ট নিডস এগ্রিমেন্ট) চুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত চুক্তি, সোফা চুক্তি (Status of Forces Agreement /US Serviceman Protection Agreement) এবং মেমোরেন্ডাম অব ইনটেন্ট (এমও আই) এসব সাম্রাজ্যবাদী হেজিমনিক চুক্তির পর আকসা আর টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র! যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় বাংলাদেশের ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইন পাস এবং তা সংশোধন করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০১৩ প্রবর্তন , কয়েক মাস আগে ঢাকায় এফবিআই এর স্থায়ী প্রতিনিধিসহ স্থায়ী অফিস বসানোর চুক্তি স্বাক্ষর, অ্যাকুইজেশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) স্বাক্ষরের লক্ষ্যে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্কট এইচ সুইফট এর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিনিধি দলের দুই দফা বাংলাদেশ সফর, টিকফা ও আকসা চুক্তি সাক্ষরের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি এবং স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থানকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোতেই সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা, ঢাকায় নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের জন্য একটি একাডেমি স্থাপনের প্রস্তাব, আর এখন আবার নতুন করে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর এই সব কিছুর মূল লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নাম করে, আর বাংলাদেশের নিরাপত্তার নাম করে, এদেশকে ওয়ার অন টেরর এর পরবর্তী যুদ্ধ ক্ষেত্র বানানো! অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক খাতকে পুরাপুরি মার্কিন বলয়ে নিয়ে এসে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার উপর চলমান সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা আরও জোরদার করা। সেই প্রচেষ্টাই চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংলাপ প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এখন ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত ২ দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ঢাকা ও ওয়াশিংটনে। এই সংলাপের টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ দেখভালের জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী নিয়ে এমন একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা যেন সন্ত্রাসবাদ ( মার্কিনী আগ্রাসন বিরোধী তৎপরতা) মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল প্রজেক্টে বাংলাদেশ লোকাল ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মার্কিন সহায়তায় ঢাকায় ন্যাশনাল একাডেমি ফর সিকিউরিটি ট্রেনিং স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে গত ৯ই এপ্রিলের ঢাকা ওয়াশিংটন নিরাপত্তা সংলাপে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি । রাষ্ট্রদূত মজিনার মতে এই একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নাকি আবার বাংলাদেশের। মজিনা বলেন, “এটি একটি অসাধারণ প্রস্তাব। আমরা এটাকে সমর্থন করি। এই একাডেমির মাধ্যমে পুলিশ, বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনী সবাই প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একে অন্যের সম্পর্কে জানতে পারবে”। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে অংশীদারিত্ব সংলাপ বলে চালিয়ে দিলেও এসব সংলাপ আসলে মার্কিনীদের হেজিমনিক চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা ছাড়া আর কিছুই না! এসব সংলাপে উন্নয়ন ও সুশাসন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা এসব বিষয়ের ওপর আলোচনা হলেও মূলত এই সংলাপের টার্গেট ছিল বাংলাদেশের নিরাপত্তায় মার্কিন সহায়তার নামে এই অঞ্চলে মার্কিনী ঘাঁটি গড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশকে রাজী করানো আর বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশ বিধ্বংসী টিকফা চুক্তি সাক্ষর করা !

যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এবং ২০১৩ প্রবর্তন করার পরও এখানে নতুন করে সন্ত্রাস বিরোধী সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর কেন দরকার সেই বিষয়টি খানিক আলোচনার দরকার আছে। সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এবং ২০১৩ বাংলাদেশের লোকাল পর্যায়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী তৎপরতায় যুক্তদের প্রতিহত করার কাজে সহায়ক হলেও সরাসরি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ওয়ার অন টেরর এ যুক্ত করার জন্য আমেরিকার সাথে দ্বিপাক্ষিক সন্ত্রাস বিরোধী চুক্তি দরকার যেখানে সর্বদা মার্কিন স্বার্থের বিরোধী রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক যে কোন শক্তিকে এই চুক্তির নিরিখে সন্ত্রাসী বলে প্রতিহত করা যায়। তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বাত্মক সাপোর্ট পাবে বলে নিশ্চয়তা বিধান করতে চায় । আগামীতে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর উপর মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে হলে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাশক্তি হিসেবে দ্রুত বেড়ে ওঠা চীনকে ঠেকাতে হবে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি মোর্চা গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের নয়া কৌশল। এজন্য বঙ্গোপসাগরে এবং ভারত মহাসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তাই বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র! এই প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) আইন ২০১৩ এবং সন্ত্রাস বিরোধী সহযোগিতা চুক্তির ধারা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে সামরিক দিক থেকে মার্কিন যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্র নীতির অধীনস্থ হবে এবং তার সার্বভৌমত্ব হারাবে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী নিয়ে যে নিরাপত্তা বলয় তৈরি হবে তা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের নামে বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যে কোন রেডিক্যাল রাজনীতির উত্থান ঠেকানোর জন্যই কাজ করে যাবে। ফলে সুস্পষ্টভাবেই বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে যা দেশের সার্বিক নিরাপত্তাকে ভঙ্গুর করে তুলবে; ব্যাপকভাবে বাড়বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক অবস্থান এ অঞ্চলের গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদ এর উপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করবে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের তেল গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ, বন্দর, বিদ্যুৎসহ নানান সেবা খাতের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য আরও পাকাপোক্ত হবে।

এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট যেভাবে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে পরাশক্তির স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বারবার অঙ্গীকার করছে তাতে আবারও প্রমাণিত হোল বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতি নীতিগতভাবে একই - উভয় ধারাই সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু, উভয়েই নিওলিবারেল পলিসির মাধ্যমে দেশ চালায়। উভয়েই পরাশক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে দেশের তেল গ্যাসসহ জাতীয় সম্পদ এর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির কাছে তুলে দেয়। ফলে নির্বাচন হচ্ছে বুর্জোয়া রাজনীতির পরিমণ্ডলে থেকে কোন দল ৫ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদের সেবা দাসত্ব করবে তার নির্বাচন। বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তি এই নির্বাচনে নাই, নতুন গণমুখী রাজনীতির বিকাশ ছাড়া এই নির্বাচন তাই অর্থহীন!দুই বিবদমান রাজনৈতিক জোটের সংঘাতের সুযোগে পরাশক্তির এই অন্যায্য হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে পুরাপুরি ধসিয়ে দিয়ে দেশকে যে স্রেফ একটা পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত করবে সে হুঁশ আমরা হারিয়ে ফেলেছি!

জনগণের উপর আস্থা না রেখে এভাবে পরাশক্তির সেবায় নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে রাজনীতির নামে কূটনীতি করার যে চর্চা আমরা এদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক জোটের মধ্যে দেখছি তা দুর্ভাগ্যজনক।

জনগণের তরফ থেকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির অভিমুখ হবে দুইটি। প্রথমত দুই বিবদমান পক্ষকে অবিলম্বে নিজেরাই দেশের অভ্যন্তরেই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে বাধ্য করা যেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভবপর হয়। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদের সুযোগে বাংলাদেশের উপর পরাশক্তির নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করা। পরাশক্তির আধিপত্য বাংলাদেশকে এতো বেশি গ্রাস করার মূল কারণ হচ্ছে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা এখনো নিজেদের তৈরি করতে পারি নাই। ফলে এখনও একদিকে চলছে গণরাজনীতি বিবর্জিত কূটনৈতিক রাজনীতি যার ভিত্তিতে দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট পরাশক্তির কৃপা লাভ করে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর। অন্যদিকে এই নতজানু রাজনীতির বাইরে গণশক্তির বিকাশও সম্ভবপর হয় নাই যে রাজনৈতিক শক্তি পরাশক্তির হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ করতে পারত। ফলে পলিটিক্যাল কমিউনিটি আকারে নিজেদের পুনর্গঠন করাই এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

যোবায়ের আল মাহমুদ,শিক্ষক; ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই মেইলঃ zalmahmud@yahoo.com

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।