আর যাবার জায়গা নাই


এক

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঝড়ের মতোই এসেছিলেন, ঝড়ের মতোই গেলেন। পাঁচ তারিখ খুব সকালে যখন তিনি দিল্লী ফিরে যাচ্ছেন তখন থেকেই ভাবছি তাঁর এই আসার আদৌ নতুন কোন তাৎপর্য আছে কিনা। দিল্লী ঢাকাকে যেটা জানাতে চেয়েছে সেটা ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও তাদের থিংক ট্যাংকগুলোর সুবাদে আমরা জানি। সেটা হোল, শেখ হাসিনার একতরফা নির্বাচনের নীতি সমর্থন করছে দিল্লী। নিজের হাতে একনায়কী ক্ষমতা রেখে অসম রাজনৈতিক পরিবিশ বহাল রেখেই নির্বাচন করতে চাইছেন হাসিনা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা ও রক্তপাত ঘটছে এর জন্যই। কিন্তু দিল্লী তাতে বিচলিত নয়। দিল্লী চায় যেভাবেই হোক শেখ হাসিনাই আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করুক।

শেখ হাসিনার প্রতি দিল্লীর দুর্বলতা স্বাভাবিক। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে একতরফা নির্বাচনের সমর্থন সেকারনে। শেখ হাসিনাকেই যেভাবেই হোক আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে দিল্লীর। এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখন। বাংলাদেশের জনগণ এটা তাদের আত্মমর্যাদা বোধের অপমান ও সার্বভৌমত্বের মারাত্মক হুমকি হিসাবেই বিবেচনা করবে। দিল্লী তাতে তাদের নীতি বদলাবে তার সম্ভাবনা কম।

সুজাতা সিং ভারতের জনগণের নির্বাচিত কোন প্রতিনিধি নন; আসলে ভারতের একজন সেক্রেটারি বা বেতনভুক সরকারী কর্মকর্তা বাংলাদেশে ছড়ি ঘুরিয়ে গেলেন। তিনি দেখা করছেন প্রধান মন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে। এটা প্রটোকলের নিয়মের মধ্যে পড়ে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনা সুজাতার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য, কারন তিনি দিল্লীর স্বার্থ দেখছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কেন দেখা করলেন? সেটা বিরাট প্রশ্ন হয়েই দেখা দিয়েছে। বিশেষত বেগম জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেন নি, সেখানে দিল্লীর সাউথ ব্লকের একজন দুই বছর মেয়াদের কর্মকর্তার সঙ্গে কী যুক্তিতে দেখা করেছেন তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষত রাজনীতির এই অতি সংবেদনশীল উত্তাল মুহূর্তে? বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে দিল্লীর নীতি বোঝার পরেও? বিএনপির রাজনীতির এই অসঙ্গতি বিকল্প হিসাবে ‘তৃতীয় শক্তি’র সম্ভাবনাকে জারি রাখে। একটি দেশের জনগণের আত্মমর্যাদাবোধ ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে সার্বভৌমত্ব চেতনার উপলব্ধি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। গ্লোবালাইজেশানের এই কালে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তুমুল একাডেমিক বিতর্কের বিষয় হলেও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা নির্ধারক ভূমিকা হয়ে উঠতে পারে। মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা কেউই এ ব্যাপারে সচেতন নন।

সুজাতা সিং নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সেখানেও একটি দল নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু শেষাবধি সেখানে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের পরোয়া না করে শেখ হাসিনাকে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’ নির্বাচন করতে হবে, এটাই উচিত কাজ। (দেখুন প্রথম আলো, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন হওয়া উচিত’, ৬ ডিসেম্বোর ২০১৩)। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দিল্লী সবার অংশ গ্রহণে নির্বাচনে হোক সেটাই চায় কিনা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। সুজাতা সিং বলেছেন, ‘অধিকাংশের অংশগ্রহণ’ কাম্য। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা গেলে দিল্লীর তাতে বিশেষ আপত্তি থাকবে না। সুজাতা পুরানা জিনিসই তিনি ফেরি করে গেলেন।

ঢাকায় নেমেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে যা জানার জেনে এসেছেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীই তাঁকে বিশেষ বিমানে পাঠিয়েছেন এ কথা বলতে যে নির্বাচন করতে হবে। এক তরফা নির্বাচনের কী পরিণতি হতে পারে তার নমুনা আমরা এখন দেখছি। অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। ঢাকার বাইরে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ কতোটুকু আছে দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা সেটা হিসাব ও মূল্যায়ন করেছেন কিনা জানি না।

নেপালের নির্বাচনের অবস্থা আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। তুলনা অর্থহীন। এরপরও শেখ হাসিনাকে দিল্লী যখন তাদের পররাষ্ট্র সচিব পাঠিয়ে এক তরফা নির্বাচনের পরামর্শ দিচ্ছে তাতে আমাদের আশংকাই ঠিক হতে চলেছে। দিল্লী বাংলাদেশে রক্তপাতই চায়। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা দিল্লী নিজের কর্তব্য গণ্য করে না। এই দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের এখনকার রক্তপাতের জন্য নির্বিচারে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থনের দায় দিল্লীর এড়ানো মুশকিল। শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও বিরোধী দলকে নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার পেছনে দিল্লীর উৎসাহ ও প্রশ্রয় কাজ করেছে।

দুই

খবর কাগজে যা পড়েছি আর বিভিন্ন সূত্রে যতোটুকু জানাজানি তাতে নিশ্চিত যে ভারতের পররাষ্ট্র সেক্রেটারির ভ্রমণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বাসি সত্য – শেখ হাসিনার এক তরফা নির্বাচন সমর্থন ছাড়া নতুন কিছুই যোগ করে নি। তবে বিয়োগের খাতায় যুক্ত হয়েছে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। এটা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের জন্য নতুন বাস্তবতা। তিনি সম্ভবত এই আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এই ঘটনা সুজাতা সিং ও দিল্লীর সাউথ ব্লকের মাথাব্যথার বড় কারন হতে পারে। সুজাতা দিল্লী ছাড়বার আগে জেনে এসেছিলেন মহাজোটের নতুন সরকারে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আছেন। দিল্লীর সঙ্গে এরশাদের সম্পর্কের কারনে এটাই স্বাভাবিক। দিল্লী শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় ফের ফিরিয়ে আনতে চায়, সঙ্গে এরশাদ থাকবেন। এরশাদের সঙ্গে দিল্লীর সম্পর্ক বিবেচনায় রাখলে দিল্লীর প্রধান মিত্র শেখ হাসিনার সঙ্গেই জাতীয় পার্টির থাকার কথা। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে দিল্লীর সম্পর্কে চিড় ধরেছে এমন কোন খবর আমার জানা নাই। ফলে এরশাদ ‘সর্বদলীয়’ সরকারে থাকবেন না, সেটা সুজাতা সিং-এর জন্য খুবই বিস্ময়কর খবর। এর জন্য তাঁর প্রস্তুতি থাকবার কথা নয়। এরশাদ গত তিন ডিসেম্বর মঙ্গলবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। পরদিন চার তারিখ বুধবার তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকা তাঁর দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। এরশাদ নির্বাচন করবেন না এই হঠাৎ ঘোষণা শুধু শেখ হাসিনার নয়, দিল্লীর পরিকল্পনাকেও বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। সুজাতা সিং-এর সফরের সঙ্গে এর কোন যোগসূত্র আছে কিনা জানা যায় নি।

তারপরও সকলে বলছেন, ডিগবাজি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ নতুন দিচ্ছেন না, এটা তাঁর পরিচিত ক্রীড়া। ফলে এরশাদ আসলে কী চাইছেন এবং কী করবেন সেটা চূড়ান্ত ভাবে জানার জন্য আমাদের ১৩ তারিখ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। সেই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। মাঝখানে রয়েছে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফর। আজ ছয় তারিখ শুক্রবার তিনি বাংলাদেশে আসবেন; তার সফর শেষ হবে ১০ তারিখে। নতুন কোন পরিস্থিতি তৈরী হয় কিনা সেটা তখন দেখা যাবে।

নতুন ভাবে গঠিত মহাজোট সরকারকেই আওয়ামী লীগ ‘সর্বদলীয়’ দাবি করছে। নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলা সরকারকে রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য করবার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নি। এই বেকায়দা অবস্থায় তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার থেকে জাতীয় পার্টীর বেরিয়ে আসা ক্ষমতাসীনদের জন্য আছাড় খাওয়ার পরিস্থিতি তৈরী করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এই বিপদ কতোটা টের পেয়েছেন আমরা জানি না। তবে তার কাণ্ডজ্ঞান সক্রিয় থাকলে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় টের পাওয়া উচিত যে দিল্লীর ছক অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে না। এরশাদের অবস্থান – সাময়িকও যদি হয় – এই দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। দিল্লীর ঘুঁটি তিনি সাময়িক হলেও কিছুটা এলোমেলো করে দিতে পেরেছেন। এর পরিণতি খারাপ দিকে গড়াতে পারে সে ব্যাপারেও এরশাদের হুঁশ আছে। তিনি বুঝেছেন এতোবড় অঘটন ঘটিয়ে তাঁর অক্ষত থাকা কঠিন। গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। তাই আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তিন

কাণ্ডজ্ঞানের কথা তুলছি বাধ্য হয়ে। এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় একজন ভারতীয় আমলা হিসাবে সুজাতা সিং যে যুক্তি দিয়েছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় দেখেছি সেখানে কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানেরই প্রকট অভাব দেখা গিয়েছে। সুজাতা সিং-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারের পরে এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাঁকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হবে। সেটা তিনি চান কিনা? তিনি উত্তর দিয়েছেন, যদি সেটা ঘটে তবে তার দায় সরকারের। বলেছেন, ‘সরকার সবাইকে শত্রু বানিয়েছে। দেশের জনমত ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে’। যদি এই সুবচন শেষ মুহূর্তে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অভিজ্ঞতা সিদ্ধ বিবেচনা বোধ (!) হয়ে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে জনরোষ থেকে তিনি কিছুটা নিস্তার পাবেন, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। যদি তিনি তাঁর চরম সুবিধাবাদ পরিত্যাগ করে এই অবস্থানে অনড় থাকেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে দর কষাকষির চালাকি পরিহার করেন, তাহলে তাঁকে নিয়ে কার্টুনের প্রতিযোগিতাও অনেক কমে আসবে।

ভারতীয় সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বলছি এ কারনে যে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতায় কাকে চায় বা না চায় সেটা তাদের ব্যাপার। মনে যাই থাকুক এ ব্যাপারে কিছু না বলাই কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। কূটনৈতিক হিসাবে সে ব্যাপারে মন্তব্য অনভিপ্রেত। আমি ‘শিষ্টাচার’ বলছি না, কারন দিল্লীর কাছ থেকে সেটা আশা করা বৃথা। তবে দিল্লী যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আদৌ প্রভাব বিস্তার করতে চায় তাহলে শেখ হাসিনার পক্ষে নির্বিচারে দাঁড়ানো কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় নয়। বিশেষত দেশের সবাইকে যে-সরকার শত্রুতে পরিণত করে ফেলেছে। এরশাদের মুখে ঝাল খাওয়া দিল্লীর পছন্দ হবে না, তবে দিল্লীর উচিত এরশাদের মতো ভুল শুধরে বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করা। আর সেই শিক্ষাটা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছ থেকে বিনীত চিত্তে গ্রহণ করে সুজাতা সিং দিল্লী ফিরে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য সেটাই ইতিবাচক হবে। দিল্লীর পররাষ্ট্র নীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটানোই বরং কাজ। হুসেন মোহাম্মদ এরশাদই, ঠাট্টা মনে হলেও, দিল্লীর উপযুক্ত শিক্ষক। আমি মশকরা করে বলছি না, বরং আন্তরিক ভাবেই বলছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীনরা দায়ী – দিল্লীর এই উপলব্ধি দরকার।

আর আমাদেরও উচিত ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রী রচনার প্রশ্নকে সবসময়ই নজরের সামনে রাখা; তাদের ন্যায়সঙ্গত উৎকন্ঠা ও উদ্বেগকে আন্তরিক ভাবে বোঝা ও প্রশমনের চেষ্টা করা। যেন দক্ষিণ এশিয়াকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা শুধু নয়, প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়ে ওঠে। ষোল কোটি মানুষের এই দেশটির নিজের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্যই সেটা জরুরী। জরুরী আমাদের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্যও। ভারতের আমলাতন্ত্র, শাসক শ্রেণী ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কারণে যা কঠিন হয়ে রয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দিল্লীর উচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে দাসমূলক সম্পর্ক নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রীর সম্পর্ক চর্চা। সেই জায়গা থেকেই দরকার অজ্ঞতা, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, মিথ্যাচার, কুপ্রচার বা ঘৃণা চর্চার মানসিকতা ও সংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্তির প্রাণপণ প্রয়াস চালানো। উভয় পক্ষের।

অন্য আরেক দিক থেকেও পররাষ্ট্র সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। ভারত যেখানে তার নিজের দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রশমন করতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠা একান্তই হিন্দুত্ববাদী উৎকন্ঠা ও ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া আর কী হতে পারে? গুজরাটের দাঙ্গায় মুসলমানদের হত্যার জন্য যাকে দায়ী করা হয় ভারতে আজ সেই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত করবার রাজনীতি প্রবল। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েও যেতে পারেন। যারা তাদের নিজের দেশের মৌলবাদ রুখতে অক্ষম তারা যখন অন্য দেশে এসে মৌলবাদ ঠেকাবার জন্য শেখ হাসিনাকে সমর্থনের কথা বলেন তাকে ধৃষ্টতা ছাড়া আর কীইবা বলা যেতে পারে।

এইসব ধৃষ্টতা আমাদের সহ্য করতে হবে। একজন ভারতীয় আমলা, যিনি রাজনীতিবিদ নন, কিম্বা ভারতের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিও নন। তিনি অনায়াসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। অথচ তার রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কথা বলার থাকলে কথা বলার কথা শুধু সচিব পর্যায়ে। পরাশক্তির নির্লজ্জ দালালী করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাই শুধু হারান না, দেশের মাথাও লুটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জনগণ নিজেরা যতোদিন তাদের মর্যাদা রক্ষাকে রাজনীতির কর্তব্য বলে গণ্য করবে না ততোদিন এই ধরণের ধৃষ্টতা কৌটিল্যপনা ও মোঘলাই অহংকার নির্বিশেষে শেয়াল কিম্বা সিংহ সকলেই আমাদের দেখিয়ে যাবে।

চার

ব্যক্তি হিসাবে সুজাতা সিং সম্পর্কে আমি আপত্তি করছি না। তিনি সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে যোগদানের পরপরই পররাষ্ট্র বিভাগকে নতুন ভাবে সাজাতে চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করছেন কিম্বা সরকারী পর্যায়ে যারা নীতিনির্ধারক তাঁদের এই পরিবর্তনটা বোঝা দরকার। সমুদ্র ভারতের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই উপলব্ধি ভারতের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে অনেক দিন আগে থেকেই আছে। চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা আছে। এগুলো নতুন খবর নয়। সমুদ্রকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সমুদ্র ও সমুদ্রের সন্নিহিত দেশ ও অঞ্চল শুধু প্রতিরক্ষা বিভাগের নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের বিষয় ও তৎপরতার এলাকা। সুজাতা সিং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সমুদ্র কেন্দ্রিক অঞ্চলের দেশগুলো যে-বিভাগের অধীনে ছিল সে বিভাগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মায়ানমার ও মালদ্বীপ ছিল এই বিভাগের অধীন (BSM division)। সুজাতা সিং দায়িত্ব নেবার পর মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে তিনি শুধু দ্বিপাক্ষিক গণ্য করছেন না, তাদের নিয়ে ভিন্ন ভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। ভারত মহাসাগর ঘিরে দিল্লীর বৃহৎ ও বিস্তৃত স্বার্থের দিক থেকে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এই দুটো দেশ ভারত মহাসাগরে দিল্লীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিশ্চিত রাখবার খুঁটি। সেই জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন; সেটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়িয়েও বহুপাক্ষিক আরও বিভিন্ন সম্পর্কের অন্তর্গত হবে। তাদের দেখভাল করবে ভিন্ন একটি কর্মবিভাগ। তার অধীনে যাবে সেশেলস, মরিশাস ও মাদাগাস্কার।

বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার আছে। সেটা দেখবে বাকি বিভাগ। বাংলাদেশ দিল্লীর দক্ষিণ এশিয়া নীতির অন্তর্গত। সুজাতা হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশ দিল্লীর অধীনই থাকবে, এবং বাংলাদেশের প্রতি দিল্লীর নীতিও হবে এই বশ্যতা নিশ্চিত করা। গত ৪২ বছর এটা সম্ভব হয়েছে, সেটা এখনও হবে।

এরশাদ শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে গিয়েছেন কিনা আমরা এখনও জানি না। সুজাতা একান্তে এরশাদকে আর কিছু বলেছেন কিনা সেটাও আমাদের জানার উপায় নাই। তবে যারা বলছেন, এরশাদ যদি শেষ অবধি শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে যায় তাহলে ক্ষমতাসীনদের হাতে জরুরী অবস্থা জারি করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না, তারা কিছুটা আগাম কথা বলছেন। অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরের ফল কী দাঁড়ায় তার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। ফার্নান্দেজ আসছেন নাভি পিল্লাইয়ের কড়া বক্তব্যের পরে। হানা হানি ও সংঘাত বন্ধ না হলে রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়ত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা হেগে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন – এই সম্ভাবনাও নতুন বাস্তবতা।

ফলে পরিস্থিতির কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। জরুরী অবস্থা জারি করে সরকার চরম হিংসাত্মক নীতি অনুসরণ করলে সেটা বাস্তব সম্মত সমাধান হবে না। ক্ষমতাসীনদের প্রস্থানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে।

আর যাবার জায়গা নাই, এই দিকটাই শুধু এখন পরিষ্কার।

৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ২২ অগ্রহায়ন ১৪২০। আরশিনগর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।