ইউরোপের পার্লামেন্ট ও বাংলাদেশের রাজনীতি


ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে জামায়াত ও হেফাজত সংক্রান্ত প্রস্তাব ছাড়া বাকি সবগুলোই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।  প্রত্যেকেই এই নির্বাচনকে ' ভূয়া'  বা কূটনৈতিক ভাষায় 'অগ্রহণযোগ্য' বলেছে। আবার দ্রুত নির্বাচন চাইছে তারা।

এক

তথাকথিত ‘নির্বাচন’ নামক তামাশার পরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বেশ কিছু প্রস্তাব নেয়। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম সেই পার্লামেন্টে গৃহীত অনেকগুলো প্রস্তাবের মধ্যে সব বাদ দিয়ে বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামি ও হেফাজতের সঙ্গে ছেদ ঘটাতে হবে বলে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ইউরোপিয়ানদের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক ছিন্ন করাই তাদের একমাত্র কাজ। মনে হয়েছে, বিএনপি এতে ঘাবড়ে গিয়েছে, ভড়কে গিয়ে বিএনপি ইসলামপন্থিদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইছে, এই গুজবও ছড়িয়েছে বেশ। তাই ‘ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না’ শিরোনামে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলো ধরে ধরে আরেকটি দৈনিকে (দৈনিক যুগান্তর) আলোচনা করেছি। দেখাতে হয়েছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের প্রায় সবগুলোই ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে। অথচ বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম য়াওয়ামি লীগের তরফে আঠারোদলীয় জোট ভেঙ্গে দেবার মতলবে খালেদা জিয়াকে ভড়কে দিতে চাইছে।

বাংলাদেশের সোজা সরল মানুষগুলোকে ধোঁকা দেওয়া সহজ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর সরকারী পক্ষ এই দুর্বলতা জানে। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি ভূয়া নির্বাচন (?) হয়ে যাবার পর তারা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একটি প্রস্তাবকে এতো বেশী ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে যাতে মনে হয় ইউরোপিয়ানদের বুঝি আঠারোদলীয় জোট ভেঙ্গে দিতে চায়। যেন, জামায়াতে ইসলামি ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ও সংসর্গ ত্যাগ করতে বিএনপিকে বাধ্য করতে হবে। জামাত আর হেফাজতই নাকি সকল সন্ত্রাস ও সহিংসতার মূল কারণ। ১৬ জানুয়ারিতে গৃহীত অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তারা এই একটি প্রচারের কোলাহল দিয়ে বেমালুম গায়েব করে দিতে চেষ্টা করেছে।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আসলে কি এবং তাদের প্রস্তাব আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিনা এ ব্যাপারে বাংলাদেশে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। যেকারণে ক্ষমতাসীনদের সমর্থক গণমাধ্যমগুলোর কোলাহলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করা উচিত গণ আন্দোলনের তরফে আমরা তা বিচার করতে পারছি না। জনগণও বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। অতএব আগের লেখারই সম্পূরক হিসাবে এই লেখা। এই লেখাটির আগে ‘ভড়কে গিয়ে ভুল করা যাবে না’ লেখাটি পড়ে এলে খুশি হবো।

‘পার্লামেন্ট’ কথাটার একটা বিশেষ ধরণের দ্যোতনা আছে। ধরে নেওয়া হয় এখানে আইন প্রণয়ন করা হয়। যে কারনে বাংলাদেশে অনেকেরই ধারণা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট মানে যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য আইন তৈরী হয়। কিন্তু পৃথিবীতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টই এমন এক পার্লামেন্ট যা আসলে ‘পার্লামেন্ট’ নয়। যেখানে ‘কার্যকর’ আইন পাশ করা হয় না। ‘কার্যকর’ কথাটা বলছি এ কারনে যে যদি প্রস্তাব পাশ ছাড়াও তেমন কিছু হয় তার চরিত্র প্রধানত কাগুজে ব্যাপারই হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সঙ্গে মিলে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এক ধরণের ‘আইন’ পাশ করে বটে, কিন্তু তাদের আইন বলা মুশকিল। আধুনিক রাষ্ট্রে যাকে আইন প্রণয়নী সংস্থা (legislative assembly) বলা হয় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সেই অর্থে সত্যিকারের আইন বা বলবৎযোগ্য আইন প্রণয়নের অধিকারী নয়। সেই অধিকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় পার্লামেন্টের। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কোন প্রস্তাব ইউরোপীয় রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বিবেচনায় নিতে পারে, কিম্বা নাও পারে। কোন বাধ্যবাধকতা নাই। এই অর্থে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব কোন আইনের ক্ষমতা বা কার্যকারিতা ধারণ করে না। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলেরও আইন প্রণয়ণের কোন ‘আইনী ক্ষমতা’ (legislative power) নাই। লিসবন চুক্তির (Treaty of Lisbon) মধ্যে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কাজের পরিধি ও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। দুই হাজার নয় সালের ডিসেম্বর থেকে লিসবন চুক্তি কার্যকর হওয়া শুরু করেছে। বলা হয় চুক্তির কার্যকারিতার ফলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ক্ষমতা বেড়েছে, সেটা কোন ভাবেই আইন প্রণয়নী ক্ষমতা নয়।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এতো কিছুর খবর জানে না। ফলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন প্রস্তাব তোলা হলে তাকে তারা অতিরিক্ত রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলে, বুঝতে পারে না। একে তো বিদেশিরা কিছু বললে মানুষ ভড়কে যায়, তারপর আবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এই বিকার প্রবল। দুইশ বছরের বিদেশী শাসনে রপ্ত অভ্যাস তো সহজে যাবার নয়। এই শ্রেণিরই অনেকে মনে করেন বাপ রে বাপ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে যখন প্রস্তাব পাশ হয়েছে তখন সারা ইউরোপে বুঝি এই প্রস্তাবই রীতিমতো আইন হয়ে যাবে। টেলিভিশান টক শোতে দেখেছি শিক্ষিতদের কথাবার্তা এই ধারার। এতে সাধারণ মানুষ কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায়। বিদেশীদের কথাবার্তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

আসলে নৈতিক গুরুত্ব ছাড়া ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব আর কোন তাৎপর্য বহন করে না। নৈতিক গুরুত্বের অর্থ কোন ঘটনাকে নৈতিক ভাবে বিচারের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত প্রভাবিত করা। বাংলাদেশে হিংসা ও সন্ত্রাস ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। নৈতিক দিক থেকে এটা বন্ধ করা উচিত। খালেদা জিয়াকে বলা হোল জামায়াতে ইসলাম আর হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে আপনি দূরে থাকুন। এতে ইউরোপে একটা জনমত তৈরী হোল যে বিরোধী দলের উচিত ইসলামপন্থিদের কাছ থেকে দূরে থাকা। এটা ঠিক যে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের অনুমান অনুযায়ী আওয়ামি লিগ ও বিএনপি উভয়েই ‘গণতন্ত্রী’ দল। এখন বাগড়া বাধাচ্ছে ইসলামপন্থিরা। ইসলাম গণতন্ত্র বিরোধীও। শুধু তাই নয়, ইসলাম একটি বর্বর ও হিংস্র ধর্ম, এরা ধর্মের নামে জেহাদ করে। খ্রিস্টিয় ইউরোপে এই বর্ণবাদী চিন্তার আধিপত্য প্রবল। ফলে বিএনপিকে জামাত ও হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে দূরে থাকতে কথা বলার মধ্যে অবাক হবার কিছুই নাই।

দুই

তবে আমি অন্য কারণে অবাক হয়েছি। আওয়ামি লিগ পন্থী লবিওয়ালা আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দিল্লীও আঠারো দলীয় জোটের বিরুদ্ধে প্রচার করেছে। এই প্রচারের পরও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলে নি, সহিংসতা ও সন্ত্রাস শুধু ইসলামি দলগুলোই করেছে; আর, ক্ষমতাসীনরা ধোয়া তুলসি পাতা। না, বরং উভয় পক্ষকেই নিন্দা করেছে। আন্তর্জাতিক ভাবে এখন প্রতিষ্ঠিত যে আওয়ামি লিগ নিজেও একটি সন্ত্রাসী ও সহিংস দল। এবং তারা মুখে দাবি করলেও এই দলটি আসলে সাম্প্রদায়িক, এমনকি তারা ধর্ম নিরপেক্ষ নয়। এটা একটা বিরাট ঘটনা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট একটা গড়ে হরিবোল প্রস্তাব পাশ করেছে। সেটা হোল, সকল পক্ষকেই সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করতে হবে। এর মধ্যে আওয়ামি লিগও অন্তর্ভূক্ত।

বিস্মিত হবার দ্বিতীয় কারন হচ্ছে সরাসরি জামায়াতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করতে হবে এটা কোত্থাও বলা হয় নি। ইউরোপকে আমরা যতোটুকু জানি তাতে এই প্রস্তাব পাশ হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকত না।। ক্ষমতাসীনদের পক্ষের গণমাধ্যম এই প্রচারেই মুখের ফেনা বের করে দিয়েছে যে জামায়াতকে নিষীদ্ধ করবার কথা বলেছে ইউরোপ। অথচ পার্লামেন্ট বরং বলেছে, যেসব দল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে (Stresses that parties which turn to terrorist acts should be banned ) । যে কোন দলই সেটা হতে পারে। আওয়ামি লিগও। ইসলামপন্থিরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরুদ্ধে পাল্টা বল প্রয়োগ করে নি, এটা দাবি করা যাবে না। করেছে, না করলে তারা এতোদিনে চিনাবাদাম হয়ে যেতো। কিন্তু আসলে কি ঘটেছে, কার কি ভূমিকা তার একটা নির্মোহ অনুসন্ধান দরকার আছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো ‘দ্রুত, স্বাধীন ও স্বচ্ছ’ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দেবার কথা বলেছে ইউরোপিয়া ইউনিয়ন। বিশেষ ভাবে আইন শৃংখলা বাহিনীর যারা এই ধরণের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট আসলে ক্ষমতাসীনদের নিন্দাই করছে। অথচ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পক্ষাবলম্বনকারী মিথ্যুক গণমাধ্যম উল্টা প্রচার করছে।

ইউরোপে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কি ভাবছে, কেমন করে ভাবছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা কি জানে আর কি জানে না পার্লামেন্টের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে এই সকল দিক ভালভাবে আন্দাজ করা যায়। কারা কি প্রস্তাব করছে এবং কারা সমর্থন করছে তা বিচার করে কারা বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে সক্রিয় সেটাও বোঝা যায়। দ্বিতীয়ত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মতামত গঠনে কিছুটা ভূমিকা রাখে। প্রস্তাবের গুরুত্ব অতোটুকুই। তার বেশি কিছু নয়।

তো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের গুরুত্ব কেমন তা বোঝাবার জন্য একটা নজির দিচ্ছি। ২০ নভেম্বর ১৯৯৭ সাল। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট প্রস্তাব নিয়েছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। পাহাড়ি অধিবাসী বা ‘জুম্ম জাতি’র স্বায়ত্ব শাসনের দাবি বাংলাদেশ সরকারকে মানতে হবে। পাহাড়ে শুধু আদিবাসীরাই থাকবে আর কেউ নয়। বাঙালি সেটলারদের পাহাড় থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে।

জাতিগত বিশুদ্ধতার দাবি পাহাড়িরা আগে তুলেছে, তা নয়। এই বর্ণবাদী দাবি বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের। ঠিক এখন যেমন বাঙালিদের ‘সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বিশুদ্ধতা’ বজায় রাখার জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামকে ‘নির্মূল’ করবার কথা আমরা শুনি। আমি কে তুমি কে? বাঙালি বাঙালি। তো এখানে কেউ নিজের মুসলমান পরিচয় প্রধান গণ্য করে বাস করবে কেন? তাদের হয় মারো, অথবা অন্য দেশে পাঠিয়ে দাও। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ পাঠাইয়ে দিচ্ছেন প্রতিদিনই। বর্ণবাদ বয়ানক জিনিস। এটা এমন এক অসুখ যাকে ধরে সে নিজেও বুঝতে পারে না সে অসুস্থ।

তো পাহাড়িদের মধ্যে কেউ কেউ পাহাড় থেকে ‘বাঙালি’ সেটলারদের সরিয়ে দেবার যে দাবি তোলে তার শিক্ষা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকেই নেওয়া। সেটলারদের সরিয়ে নেবার জন্য ইউরোপীয় দেশ গুলো অর্থ সাহায্য করতেও রাজি ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা জুম্ম জাতির অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের পাহাড় থেকে সরিয়ে সমতলে নতুন বসতি তৈরী করবার জন্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের উন্নয়ন বরাদ্দের অভাব হোত না। এখনও তারা এ কাজে সম্ভবত রাজি। তো সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য – আমরা যেদিক থেকেই দেখি -- সেটা প্রস্তাব হয়েই থেকে গেছে। ইউরোপীয় পার্লেমেন্টের প্রস্তাবের রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝাবার জন্য উদাহরণটা দিলাম। প্রস্তাব অনেক হতেই পারে, কিন্তু সেটা বল্বৎ হওয়া অনেক দূরের কথা। (প্রস্তাবের ইংরেজি ভাষ্য: Urges the Government of Bangladesh to review its demographic policy, to relocate the Bengali settlers from CHT and rehabilitate them in the plains, in full respect of their rights and with the full use of the financial assistance of the European Union;)

আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বর্ণবাদ গণ্য করি এবং ক্ষুদ্র জাতি সত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ঘোর সমর্থক। বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের মতো পাহাড়ের জনগণের নিজেদের সম্পত্তির ওপর অধিকার কায়েমও এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে একক ও অখণ্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শক্তি গঠন করবার জন্য এটা জরুরী । এ ছাড়াও বাংলাদেসের যে কণ জায়গায় নাগরিক হিসাবে তাদের হক আছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নও সরাসরি জড়িত। ক্ষুদ্র জাতি সত্তার আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং বাংলাদেশে তাদের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের দেশ হিসাবে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। কোন বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক আদর্শ দ্বারা নয়। কিম্বা শেখ হাসিনার শান্তি চুক্তির মতো গরু মেরে জুতা দান কোন রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না। যে কারনে শান্তিও আসে নি। কারন সমস্যার মূল কারণ সম্পত্তিতে অধুকার তার সমাধান হয় নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা মাত্র নয়, বরং সরাসরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে জড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উদাহরণ দিয়েছি ইউরোপ কিভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত এবং তারা কিভাবে আমাদের নিয়ে ভাবে সেটা বোঝাতে। যদি আইনী গুরুত্ব না থাকে তো ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউরোপ যা খুশি প্রস্তাব নিতেই পারে। ওপরের উদাহরণ যেমন। তাকে গুরুত্ব দেব কি দেব না নির্ভর করবে আমরা কি ধরণের বাংলাদেশ চাই তার ওপর।

তবু বলব, আইনী কার্যকারিতা না থাকলেও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত। ইউরোপের কথা শোনার মধ্যে দোষ কিছু নাই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের নৈতিক ওজন তো আছেই। সেটা অস্বীকার করা বেয়াকুবি। ঠিক তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স কিম্বা মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে তর্ক বিতর্ক ও প্রস্তাবকেও। তুলনায় তারা ইউরোপীয় পার্লেমেন্টের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সিদ্ধান্তের আইনী পরিণতির সম্ভাবনা থাকে।

বিদেশিরা তাদের পার্লামেন্টে, সিনেটে বা আইন সভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তার মধ্যে ইউরোপীয় মন ও তাদের চিন্তার ধরণ -- স্বাভাবিক হোক কিম্বা এবসার্ড –বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনগণকে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যান্য রাষ্ট্র ও তাদের জনগণের মন মানসিকতা, চিন্তার প্যাটার্ন, ঝোঁক, অভ্যাস, ঐতিহ্য, ইতিহাস ইত্যাদির হদিস রাখতে হবে। বিশ্ব সভায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের টিকে থাকার জন্যই এই হুঁশিয়ারি দরকার। অনেকটা সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট বা নিজেদের রক্ষার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির চর্চা হিসাবে জারি রাখলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই।

বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের জায়গা মজবুত করতে হলে যে কোন ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব বা পরামর্শে সাড়া দেওয়া, আর অন্যায় প্রস্তাবের বিরোধিতা করাই সঠিক কাজ। গোলকায়নের (globalization) এই যুগে আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গণ্য করতে পারি না। সবাই সবার সঙ্গে কোন না কোন ভাবে যুক্ত। অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই আমাদের নিজেদের পথ বের করতে হবে। তবে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ এক মত হওয়া নয়, কিম্বা সব কথাতে সায় দেওয়াও নয়। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা কিম্বা এশিয়ায় সাধারণ মানুষ বিশ্বব্যবস্থায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়ছে। সে লড়াই অধিকাংশ সময় সশস্ত্র রূপ নিয়ে হাজির হয়। সহিংসতা কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সশস্ত্রতা ও সহিংসতা দিয়ে হরণ করা হয়, সেই অধিকারহীন অবস্থায় জনগণকে শান্তিপূর্ণ ও নিয়ম তান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলা বাস্তব সম্মত নয়।

তিন

ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক তাদের প্রস্তাবে নয় মোটেও, বরং তাদের প্রস্তাবকে বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক পক্ষ কে কিভাবে মুল্যায়ন করেছেন ও গ্রহণ করেছে সেখানে। আমাদের আলোচনার নজর সেদিকেই দেওয়া উচিত।

শেখ হাসিনা জানেন এই ধরণের প্রস্তাবের কোন মূল্য নাই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রায় এগারোটি প্রস্তাবের একটি প্রস্তাব ছাড়া বাকি সবই শেখ হাসিনার বিপক্ষে। তিনি তার থোড়াই কেয়ার করছেন। শেখ হাসিনা জানেন, দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিজের সংগঠন ও শক্তির ওপর। মুখে প্রপাগাণ্ডা হিসাবে যাই বলা হোক, তিনি জানেন তাঁর সরকার একটি বে-আইনী ও অবৈধ সরকার। সারা বিশ্ব তাঁকে নিন্দা করছে, কিন্তু তিনি কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না। করবেন বলে মনে হয় না। কারণ দুনিয়াতে তিনিই প্রথম নিষ্ঠুর ও নির্মম একনায়কতান্ত্রিক শাসক নন। আরও ছিল, আরও আছে এবং ভবিষ্যতে আরও আসবে। তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিম্বা ইউরোপ কি কাজ করছে না? করছে। অতএব তাঁর সঙ্গেও করতে হবে। বল প্রয়োগের শক্তিই প্রধান শক্তি।

খালেদা অবিলম্বে কাবু হয়ে গিয়েছেন। কিম্বা কাবু হবার জন্যই তিনি তৈরী ছিলেন। তিনি শান্তির পক্ষে আন্দোলনে ছেদ দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কর্মসূচিতে সাময়িক বিরতি দেওয়াকে আমি এর আগে একটি লেখায় সঠিক বলেছি। কিন্তু কতদিন? নতুন ভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি দেবার আগে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ও ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের মূল্যায়ন তাঁর জানা দরকার ছিল। ধারণা করেছিলাম ২০ তারিখের সভায় তিনি আরও কংক্রিট কর্মসূচি এবং আন্দোলনের আগামি পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট করবেন। নিদেন পক্ষে সাংগঠনিক ভাবে নিজেকে সংহত করবার জন্য ‘সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা’ রক্ষা কমিটি গঠনের ওপর জোর দেবেন। তিনি সেটা করেন নি।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে জামায়াত ও হেফাজত সংক্রান্ত প্রস্তাব ছাড়া বাকি সবগুলোই মূলত তাঁর পক্ষেরই প্রস্তাব। প্রত্যেকেই এই নির্বাচনকে ভূয়া নির্বাচন বলেছে এবং আবার দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এর পূর্ণ সুযোগ তিনি নিতে পারতেন। কিভাবে নেবেন সেটা তো পরের কথা, বরং ইউরোপকে খুশি করবার জন্য জামায়াত ও হেফাজত ছাড়ছেন তার ইঙ্গিতও দিয়ে দিয়েছেন। অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বললেও এই দাবি মার্কিন কিম্বা ব্রিটিশ দাবি নয়। বেগম জিয়া বোঝেন কিনা জানিনা, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এই দাবি আসার একমাত্র কারণ ভারতীয় প্রভাব, আর কিছুই নয়।

বলাবাহুল্য, তাঁর ২০ জানুয়ারি তারিখের সমাবেশে জামায়াত এবং হেফাজতের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রবল গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মীর্জা আলমগীর অবশ্য দাবি করেছেন, তারা জামায়াতকে ছাড়ছেন না। কিন্তু বেলুন থেকে বাতাস বেরিয়ে গেলে তাকে ফুলিয়ে তোলা কঠিন। আবার ফোলানোর যন্ত্রের দরকার হয়। সেই যন্ত্র বিএনপির আছে কি? জনগণ ভেবেছিল বিদেশি প্রচারে কান না দিয়ে খালেদা জিয়া কিভাবে তাঁর জোটকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করবেন সেই দিক নির্দেশনাই দেবেন। হয়তো কিভাবে সেটা করতে হয় সেটার দিশা তিনি আর পাচ্ছেন না। তিনি এখনও ভাঙা রেকর্ডের মতো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে যাচ্ছেন। কার কাছে? শেখ হাসিনার কাছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার ন্যায্যতা কি? একদমই নাই। বল প্রয়োগের ক্ষমতা ছাড়া। সারা দুনিয়ার চোখে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার বে-আইনী ও অবৈধ সরকার। আন্দোলনের এই বিশাল সাফল্য আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়া উলটা জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার ইঙ্গিতই যেন দিলেন। শেখ হাসিনা ‘জাতীয়তাবাদী’ শক্তি ও ইসলামি শক্তিকে বিভক্ত করতে চেয়েছেন। প্রতিপক্ষের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে অবিশ্বাস্য ভাবে সফল হয়ে যাবেন কি? এই আশংকা দেখা দিয়েছে।

আসলে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স, কিম্বা মার্কিন সিনেট কি বলল আর না বলল তাতে কী আসে যায়! গোড়ার কথা হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের লড়াই ন্যায়সঙ্গত কিনা। যদি তাই হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কে কি সিদ্ধান্ত নিলো, সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক জনগণের সমর্থন আদায় করা। দুনিয়ায় কেউই এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করে না। অতএব বাংলাদেশের গণ আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পর্কে দেশে বিদেশে সবাইকে অবহিত করাটাই প্রধান কাজ। আন্দোলনের ধরণ হিসাবে সহিংসতা ও সশস্ত্রতার ভালমন্দ নীতিবাগীশতা দিয়ে ঠিক হয় না। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো গণতন্ত্রের নামে বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে বিরোধী পক্ষকে সহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামে প্রকাশ্যেই উসকিয়ে দিচ্ছে। গাদ্দাফির পতন কিভাবে ঘটানো হোল, আমরা সে ঘটনা বিচার করে দেখতে পারি, সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য যুদ্ধ চলছে। প্রয়োজনে বিরোধী দলকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিতে পাশ্চাত্য কুন্ঠাবোধ করে না। বরং অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। আকাশ থেকে বোমা মেরে তাদের অপছন্দের শাসককে হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করে না। অতএব পাশ্চাত্য দেশগুলো বাংলাদেশে আন্দোলনের সহিংস ধরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন, এটা ডাহা মিথ্যা কথা। তাদের উৎকন্ঠা অন্যত্র। বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শক্তিমান হয়ে উঠুক এটা তারা চায় না। পাশ্চাত্যের দিক থেকে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি অবস্থান। ইউরোপের এই স্বাভাবিক অবস্থানকে প্রতিপক্ষ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে। তুলুক।

কিন্তু বিএনপি এতে কাবু হয়ে যাচ্ছে কি? কাবু হয়ে আন্দোলনে ছেদ দিলে বর্তমান পর্যায়ে সেটাই হবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ঘটনা।

 

২৭ জানুয়ারি ২০১৪। ১৪ মাঘ ১৪২০। শ্যামলী।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।