জায়নবাদ ও বর্বর পুরুষতন্ত্র: টার্গেট ফিলিস্তিনী শিশু ও নারী
জায়নবাদী বর্বরতার টার্গেট নারী। হামাস সদস্যদের মা বোনদের ধর্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছে ইসরাইলের এক অধ্যাপক মোরদেচাই কেদার। তার দাবি সন্ত্রাসী হামলা নিরুৎসাহিত করার এটাই একমাত্র উপায়। ইসরায়েলি সংসদ সদস্য আয়লেট সাকেদ ঘোষণা দিয়েছে জন্ম দেবার আগেই ফিলিস্তিনীদের ভ্রূণে হত্যা করতে হবে তাদের মায়েদের মেরে, কারন ফিলিস্তিনী মায়েরা সাপের জন্ম দেয়। হামাসের রকেট নয়, ফিলিস্তিনের নারীই ইসরায়েলের বড় শত্রু। ফিলিস্তিনের ছোট শিশুটি ওদের কাছে ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসী।
কিভাবে জায়নবাদ ও পুরুষতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সেটা বোঝা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে ঈদ হয়ে গেল ২৯ জুলাই। টেলিভিশনে ঘোষণার পর পর ‘ও মন রমজানের শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটিও বেজে ওঠে। ঘোষণা হয়েছে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ঈদ আসলেই আনন্দ হবে, এটা স্বাভাবিক। শাওয়ালের চাঁদ সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য একইভাবে খুশি নিয়ে আসার কথা।
ঈদের চাঁদ। সেই চাঁদ গাজাতেও উঠেছিল। আকাশে মেঘ ছিল না, কিন্তু ইসরায়েলের শেল নিক্ষেপের কারণে আগুন লেগে আকাশ কালোকুণ্ডলি পাকানো ধোয়াঁয় ঢেকে গিয়েছিল। জানি না, ফিলিস্তিনিরা ঈদের চাঁদ দেখেছেন কিনা, তবে ঈদ সেখানেও হয়েছে।
কিন্তু এবার আসলে আমরা বাংলাদেশেও কি আনন্দ করতে পেরেছি? কিংবা যারা করেছেন তাঁরা কি দেখেন নি ঈদের দিন গাজাতে কি হয়েছে? সেদিন টেলিভিশন যতোই আনন্দ অনুষ্ঠান দেখাবার ব্যবস্থা থাকুক খবরে আন্তর্জাতিক অংশে আসলেই তো ইসরায়েলের বর্বর হামলার ছবিও খবর দেখতে হয়েছে। যারা আরও একটু জানতে চেয়েছেন তাঁরা ঘুরে ফিরে আল-জাজিরা দেখেছেন।
গাজার মুসলমানরাও রোজা রেখেছিলেন, সেহরি খেয়ে কিম্বা না খেয়ে। অথচ রোজার মাসেও তাদের জন্য ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত ছিল। গাজায় ঈদ আমাদের একদিন আগে হয়েছিল, অন্যান্য আরব দেশের মতো। ঈদের দিনেও ইসরায়েল থেমে ছিল না। শুধু ঈদের দিনেই ইসরায়েলের বোমা হামলায় মারা গেছে ১০০ জনের বেশী।
জুলাই মাসের ৮ তারিখ থেকে এই লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত (৩১ জুলাই) ১৩০০ ছাড়িয়ে গেছে বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা। শেষ সংখ্যা শুনেছি ১৩৬১ জন। সংখ্যা শুনে বোঝা যাবে না যারা মরেছে তাদের বয়স কেমন। আল-জাজিরার ওয়েব সাইট থেকে জেনেছি নিহতের মধ্যে ৩১৫ জন ছিল শিশু, মাসুম শিশু, নিহতের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হচ্ছে শিশু। নারী ১৬৬ জন। ইসরায়েল খুব ভাল করে জানে, তারা বোমা যেখানে ফেলেছে সেখানে ফেললে হামাসের যোদ্ধারা মরবে না, মরবে সাধারণ ও নিরীহ জনগণ, সেটা তাদের হিশাবের মধ্যেই আছে, তারপরও তারা বোমা ফেলেছে, মানুষ মেরেছে। যাদের মারা হচ্ছে এরাই তো হামাসের আপনজন। হামাসের যোদ্ধাদের মারতে না পেরে শিশুদের মারছে। এই এক কাপুরুষ বর্বরতা, যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারীদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা পরিষ্কার ধারণা করতে পারি।
ঈদের দিনে ইসরায়েলের বোমা হামলায় বিধ্বস্থ ঘরের মধ্যে এক গর্ভবতী মা মারা যায়, কিন্তু তার পেট থেকে অপারেশান করে জীবিত শিশু বের করা হয়। মরা মা জীবিত শিশুর জন্ম দিল! সংবাদ মাধ্যম এই শিশুকে ‘মিরাকল’ শিশু আখ্যায়িত করেছিল, কিন্তু শেষে শিশুটিও মারা গেল। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো বা বেঁচে যেতো। সেতো বাঁচবার জন্যেই দুনিয়াতে এসেছিল।
৮ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই অবধি প্রায় ৪০০ শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। বোমার আঘাতে মা মারে গেছেন অথচ আশ্চর্য যে শিশুটি মায়ের গর্ভে বেঁচে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনী ডাক্তাররা তাকে বের করে আনে, নাম দেয় 'সায়মা'। যত্ন করে ইনকিউবিটেওরে রেখেছিলো তাকে, কিন্তু বোমায় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় ইনকিউবেটর বন্ধ হয়ে যায়, সায়মা মারা যায়।
অবুঝ শিশুরা এই বোমাবাজির মধ্যেও ঈদ করতে গিয়ে ঘরে ফিরেছে লাশ হয়ে। কিংবা বাড়ী ফিরে দেখেছে মা-বাবা ভাই বা বোন মারা গেছে। খবরে বলা হয় একই পরিবারের আট-নয়জন মারা গেছে। শুনেই গা শিউরে ওঠে! যারা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য একে আপরের বাড়ীতে গেছে সেটা ছিল শোকের মাতম করার জন্যে, আনন্দের জন্য নয়। কোলাকুলি করেছে আর কেঁদেছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
প্রায় ৬৭৮০ জন আহত হয়েছে (আল জাজিরা ওয়েব সাইট), এই সংখ্যা আরো বাড়ছে। এদের মধ্যে ২৩০৭ জন শিশু, ১৫২৯ জন নারী রয়েছে। রয়টারের একটি খবরের (১৬ জুলাই প্রকাশিত) উল্লেখ করছি। চারজন ফিলিস্তিনী শিশু সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলছিল, তাদের সবাই ১৫ বছরের কম বয়সের। ইসরায়েলের নেভাল গানবোট থেকে প্রথম শেল নিক্ষেপের পর তারা সবাই দৌড় মারে, কিন্তু পরের শেলটি ছোঁড়া হলেই চারজন শিশুই মারা যায়। আবু হাসারার (২২) তাদের জড়িয়ে ধরে। তার কাপড় রক্তে ভেসে যায়। সে বললো, “মনে হচ্ছিল শেলগুলো এই নিস্পাপ শিশুদের তাড়া করে মারছিল। এটা কাপুরুষতা ছাড়া কিছু নয়, একই সাথে এটা মহা অপরাধ।”
ছবিতে দেখেছি শিশুদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই, মাথায় আঘাত, পেটে স্প্লিন্টারের আঘাত, পিঠে আঘাত, রক্তে ভরা জামা কাপড়। আহত একটি মেয়ের ছবি বাংলাদেশের পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে যার শয্যাপাশে রয়েছে একটি পুতুল। তার মা ও ভাই-বোন মারা গেছে। রয়ে গেছে তার খেলার সাথী নিস্প্রাণ একটি পুতুল।
ফিলিস্তিনীদের ঈদের রঙিন জামা আরও রঙিন হয়েছে রক্তের লাল রংয়ে। গাজায় এখন আর কোন রং নাই, একটি মাত্র রং, রক্ত লাল! আহত ও নিহতদের জড়িয়ে ধরে হাসপাতালে যারা নিয়ে এসেছেন তাদের কাপড়ও রক্তে লাল। প্রায় ২,৪০,০০০ মানুষ ঘরবাড়ী হারিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। এদের জন্যে ঈদ বলে কি কিছু আছে? বাংলাদেশে কিছু ফিলিস্তিনি ছাত্র উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। একটি টিভি চ্যানেল তাদের তিনজনের সাক্ষাতকার নিয়েছিল ঈদের দিনে। তারা বললো আমাদের কোন ঈদ নেই। আমরা শুধু দোয়া করছি আমাদের মানুষরা যেন ভাল থাকে, আমাদের পরিবার যেন নিরাপদে থাকে। একজন বললো, আমি গত কয়েকদিন মায়ের সাথে যখনই কথা বলেছি, তখনই বোমার শব্দ পেয়েছি। মা বলেছে, এটাই তোমার সাথে শেষ কথা হতে পারে। কথা বলার সময় তার চোখ ছলছল করছিল, আমার বিশ্বাস দর্শকের চোখও সিক্ত হতে বাধ্য। ঈদের রাতে আল-জাজিরায় দেখেছি ফিলিস্তিনীদের বিশাল মিছিল, সেখানে ছোট শিশুদের লাশ দুই হাতে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে আর বড়দের লাশ খাটিয়ায়। এই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়, তবুও অবাক হয়ে দেখেছি ফিলিস্তিনীদের চোখে মুখের দৃঢ়তা; ওরা লড়াই করে যাবেই। সাবাশ!
বোমার হামলা থেকে সন্তানদের রক্ষা করতে মায়ের আকুতি। গাজা একটি বন্দী শিবির, কোথাও আশ্রয় নেবার জায়গা নাই।
ইসরায়েল হামাসের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছে না। ইসরায়েলের পেছনে বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর দেশ থাকলেও তাদের নিজ দেশেই মানুষ এই বর্বর আচরণ সহ্য করতে পারছে না। তেল আবীব ও যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদী তরুণরা রাস্তায় নেমে এসেছে এই যুদ্ধ থামাবার দাবী জানিয়ে। তারা বলছে আমার নামে এই যুদ্ধ করতে পারবে না “Not in my name”. অর্থাৎ ইহুদী হলেই সে এই বর্বতার সঙ্গে একমত নয় মোটেও। ইহুদি হলেই জায়নবাদী হবে এমন কথা নয়, বরং ইহুদি নয় এমন অনেকে জায়নবাদিতায় আক্রান্ত হতে পারে। তারা ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। তাই একটি সহজ দাবী হচ্ছে ইসরায়েলে সহযোগী পণ্য, যেমন পেপসি, কোক ইত্যাদি বর্জন করার, সেটাও ফিলিস্তনীদের পক্ষে দাঁড়াবার পথ হতে পারে। বাংলাদেশে বসে আর কিছু না পারি এইটুকু তো করতে পারি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছে সে হামাসকে ধ্বংস করে ছাড়বে, তাদের টানেল ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু সে সব কিছুই করতে পারছে না তাই শিশুদের মেরে তার কাপুরুষতার নির্লজ্জ প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
জায়নবাদী বর্বরতার টার্গেট নারী। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস- এ প্রকাশিত একটি খবরে প্রকাশ হয়েছে হামাস সদস্যদের মা বোনদের ধর্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছে ইসরাইলের তথাকথিত এক অধ্যাপক। তার দাবি সন্ত্রাসী হামলা নিরুৎসাহিত করার এটাই একমাত্র উপায়। ইসরাইলি এক রেডিও চ্যানেলে এই অধ্যাপক(!) যার নাম মোরদেচাই কেদার বলেছেন, আত্মঘাতী কোন বোমা হামলাকারীকে শুধু একটা জিনিসই নিরুৎসাহিত করতে পারে, যদি সে জানে যে ধরা পরলে তার মা বোনকে ধর্ষণ করা হবে। এটা শুনতে অনেক খারাপ লাগলেও, কেদার দাবি করছে, এটাই মধ্যপ্রাচ্য। আত্মঘাতি হামলাকারি বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে বা ট্রিগার টানার আগে একটি বিষয়ই তাকে থামাতে পারে যদি সে জানে তার বোনকে ধর্ষণ করা হবে। ব্যাস।
অন্যদিকে প্যারিসের ডেপুটি মেয়র জ্যাক রেনো বলেছেন, ফিলিস্তিনি নিহত শত শত শিশুর গোশত হালাল। তিনি শিশুদের নিহত হবার ঘটনাকে উপহাস করে টুইটারে এ মন্তব্য করার পর প্যারিসে বিক্ষোভ করেছে প্রায় ২৫হাজার মুসলমান। [ মানবজমিন ডেস্ক, ২৭শে জুলাই, ২০১৪]। তিনি পরে তার বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। তার চেয়েও মারাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন ইসরায়েলের একজন কট্টরপন্থি ইহুদী নারী সংসদ সদস্য আয়লেট সাকেদ। এই মহিলা মনে করে সকল ফিলিস্তনীরা সন্ত্রাসী, তাই তাদের মায়েদের মেরে ফেলা উচিত। এই খবর ১৭ জুলাই থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়। সাকেদের বক্তব্য এই মহিলারা ছোট ছোট সাপের জন্ম দেয়। তাদের মেরে ফেলতে হবে, তাদের বাড়ীঘর ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে হবে, যেন তারা আর কোন সন্ত্রাসী জন্ম দিতে না পারে। তারা আমাদের শত্রু, আমাদের হাত তাদের রক্তে রঞ্জিত হওয়া উচিত। যাদের মারা হয়েছে তাদের বেলায় এই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ এই সংসদ সদস্য খোলামেলাভাবেই গণহত্যার ডাক দিচ্ছেন, যার মূল লক্ষ্য হবে নারী।
আয়লেট সাকেদের মতো নারীও আছে যারা গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়ে বলছে, ফিলিস্তিনী মায়েদের হত্যা করতে হবে যারা সাপের জন্ম দেয়। জন্ম হবার আগেই ফিলিস্তিনীদের ভ্রূণে হত্যার এই ডাক ইসরায়েলি নীতি।
তাহলে এটা নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয় যে আহত ও নিহতদের অধিকাংশ শিশু এবং নারী। ইসরাইল জেনে-বুঝেই, সিদ্ধান্ত নিয়েই এই কাজ করছে। শুধু মেরে ফেলা নয় নারীদের ধর্ষণ করার পরামর্শ দিচ্ছে ইসরায়েলের বুদ্ধিজীবি, যাকে একজন অধ্যাপক নামে পরিচয় দেয়া হয়েছে। মনে করার কোনই কারণ নেই যে শিশু ও নারীরা দুর্বল বলেই বেশী সংখ্যায় আহত ও নিহত হচ্ছে। আসলে ওরাই হচ্ছে টার্গেট। হামাসের রকেট নয়, ফিলিস্তিনের নারীই ইসরায়েলের বড় শত্রু। ফিলিস্তিনের ছোট শিশুটি ওদের কাছে ভবিষ্যৎ সন্ত্রাসী। ও গুলতি মারলেও সেটা রকেট হয়ে যায়। ওদের রক্ত দিয়ে হাত লাল করলে জায়নবাদির শান্তি হবে।
বিশ্বের নারী সংগঠন, বাংলাদেশের নারী সংগঠন সবার কাছে আহবান: যুদ্ধের এই পুরুষতান্ত্রিক কৌশল, যার সাথে নারী খুব ভাল ভাবেই পরিচিত, তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। বর্বর ইসরায়েলের পক্ষে বর্বর নারী ও পুরুষরা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা দাঁড়াবো মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে যারা লড়ছেন তাদের পাশে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে, ফিলিস্তনি নারী ও শিশুদের পাশে।