শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি (১)


তোবা গার্মেন্ট কেন্দ্র করে শ্রমিকদের আন্দোলন ও অনশন কর্মসূচি পূর্ণ সমর্থন করে সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তরে একটি লেখা লিখেছিলাম 'দেখুন অভিযুক্ত গার্মেন্ট মালিকের জামিন বনাম শ্রমিক আন্দোলন, ১০ অগাস্ট ২০১৪)।  তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, ওভারটাইম ও বোনাসের অর্থনৈতিক দাবি আদায় করে নেবার জন্য যারা তোবা বিল্ডিং-এ অনশনের কর্মসূচি সফল করেছিলেন, তাদের কৌশল সঠিক কি বেঠিক তা নিয়ে একটি তর্ক উঠেছে। এই ক্ষেত্রে বামপন্থিদলগুলোর মধ্যে ঐক্য বেড়েছে, নাকি অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়েও কিছু কথা উঠেছে। আমি মনে করি সুনির্দিষ্ট ভাবে তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের 'অর্থনৈতিক' দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য কর্মসূচি হিসাবে অনশন ছিল সঠিক পদক্ষেপ, যার কারনে শ্রমিকদের বাইরেও তা ব্যাপক জন সমর্থন লাভ করেছে। বিশেষত, মনে রাখতে হবে, একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে হামলার ঝুঁকি নিয়ে এই আন্দোলন করতে হয়েছে। যারা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবিকে বামপন্থার 'রাজনৈতিক'  লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার করবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের সদিচ্ছাকে স্বীকার করে নিলেও কৌশল হিসাবে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বাইরে আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়া হোত ভুল পদক্ষেপ। এতে শ্রমিকদের প্রতি সমাজে যে সংবেদনা তৈরি করা গেছে, সেটা হোত কিনা সন্দেহ। যাঁরা  আসলেই শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতিতে এখনও আস্থা রাখেন তারা কংক্রিট লড়াই সংগ্রামের এই উদাহরণ সামনে রেখে পরস্পরের অধ্যে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন। কারন অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা আর শ্রমক শ্রেণির রাজনীতির মধ্যে পার্থকয় ও ওইক্যের জায়গা নির্ণয় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনোইতিক ইস্যু।  এই আলোচনার সহায়ক হবার জন্য প্রকাশিত লেখাটিকে আরও বিস্তৃত করে দুই কিস্তিতে এখানে পেশ করছি। প্রথম কিস্তিতে কিভাবে অভিযুক্ত গার্মেন্ট মালিককে কারাগার থেকে জামিনে বের করে আনবার জন্য শ্রমিকদের বকেয়া জিম্মি করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। দ্বিতীয় কিস্তিতে নীতি ও কৌশল সংক্রান্ত প্রশ্ন।

... ... ...

বিষয়টা সহজ। কাজ করেছে শ্রমিকেরা, তাদের মজুরি দিয়ে দিতে হবে। অনেক দেশে নিয়ম আছে সপ্তাহান্তেই সেটা দিয়ে দিতে হয়। দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে মাসের শেষে দেওয়াই রেওয়াজ। রেওয়াজ বলছি, কারন সেটা আইনে থাকতে পারে, কিন্তু দেবার জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা নাই। অর্থাৎ বিধান হিসাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা অনুপস্থিত। কারখানার মালিকেরা তা মানেন না। বিধান দূরে থাকুক, কাজ করালে শ্রমিকদের মজুরি দেবার রেওয়াজটুকুরও তোয়াক্কা অনেক গার্মেন্ট মালিক করে না। তোবা গার্মেন্টের ঘটনায় বোঝা গেল, গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ-ও তোয়াক্কা করে না।

তোবা গার্মেন্ট শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়েছিল। ইতোমধ্যে ঈদ আসে।এটা শ্রম আইনের লংঘন। কিন্তু তার জনু গার্মেন্ট আম্লিকদের বিরুদ্ধে সরকারের কোন পদক্ষেপ নেয় নি। অতএব বাংলাদেশে শ্রম আইন, বিধি বিধান, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভগের দায়দায়িত্ব ইত্যাদি ফালতু কথা বলে লাভ নাই।  কথা হোল, ঈদের আগে বকেয়া বেতন বুঝিয়ে দেওয়া বিধান বা রেওয়াজ না হোক ধর্মীয় নৈতিকতার মধ্যেও তো পড়ে। কিন্তু সেকুলার বলি ধর্মীয় বলি গার্মেন্ট মালিকগণ কোন প্রকার নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না। তোবা গ্রুপের ক্ষেত্রে দেখা গেল গার্মেন্ট মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজেওএমইএ-ও ঈদের আগে শ্রমিকদের মজুরি আদায়না  করে দিলে তাদের নিজেদের ঈদ করা ধর্মীয় দিক থেকে প্রশ্নাত্মক হয়ে পড়ে -- এটা মনে করে না। বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদলগুলোর  দিক থেকেও  কোন প্রতিবাদ ওঠে নি। গরিবের হক উসুল করে দেবার দায় আইনে নাই, ধর্মেও নাই। এ এক অভিজ্ঞতা বটে! ঈদের আনন্দ বিষাক্ত নিরানন্দে পরিণত হওয়ায়  বাধ্য হয়ে শ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের দাবিতে তোবা গার্মেন্ট ভবনে অনশন শুরু করে।

তোবা আর তাজরিন উভয়েরই মালিক দেলোয়ার ছিলেন কারাগারে বন্দী। দুই হাজার বারো সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে মরে, অনেকে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। নিদারুন মর্মান্তিক ছিল সেই মৃত্যু। আহত হয়েছেন কয়েক শত, অধিকাংশই এখনো সুস্থ হতে পারে নি। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার দায় মালিকের, অতএব দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে শ্রমিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের সেটা হোল বিজিএমইএ তাজরিনের মালিককে রক্ষা করবার জন্য জানপরান চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত আদালতে একটি রিটের পরই কেবল দেলোয়ার হসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অর্থাৎ রিট না হলে দেলোয়ার বহাল তবিয়তেই থাকতেন; একশ এগারোজন শ্রমিক হত্যার দায়ের কথা মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যেতো।

পরিস্থিতি হোল এই যে বিজেএমইএ খেয়ে না খেয়ে দেলোয়ারকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তার পরও দেলোয়ার কারাগারে। এরপর বিজেএমইএ-র একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হোল, তাকে বের করে আনা যায় কিভাবে? তোবা গার্মেন্টে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হোল। তিন মাস বন্ধ করে রাখার পর ঈদ এসে যায়। শ্রমিকরা বেতন ছাড়া ঈদ করতে পারবে না। বিজেএমইএ ইচ্ছে করলে সমাধান অনায়াসেই করতে পারত। কিন্তু তা না করে একটা মানবিক সংকট তৈরি করলো তারা। শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে জিম্মি করে তারা দাবি করল দেলোয়ার হোসেনকে কারাগার থেকে জামিন না দিলে বেতন দেওয়া যাবে না। শ্রমিকদের জিম্মি রেখেই বিজেএমইএ দেলোয়ারকে জামিনে কারাগার থেকে বের করে আনলো। কিন্তু তারপরও শ্রমিকেরা পুরা বেতন পেলেন না। বিজেএমইএ দুই মাসের বেতন পরিশোধের দায়িত্ব নিল। ফলে শ্রমিকদের অনশন কর্মসূচি চলল। এগারো দিন পর তাদের কয়েকজনকে দুই মাসের বেতন দিয়ে অনশনকারীদের পুলিশ পিটিয়ে বের করে দিল। অনশনরত অবস্থায় মোশরেফা মিশু ও জলি তালুকদারকে পুলিশ আটক করে। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।


Tuba

ঈদের বকেয়া বেতন, ওভারটাইম ও প্রাপ্য বোনাসের জন্য তোবা কারখানার শ্রমিকদের অনশন  ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কৌশল হিসাবে সঠিক। শ্রমিকরা তাদের পক্ষে সমাজে সহমর্মিতা তৈরি করতে সক্ষম হয়, অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেনকে কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত করে আনবার ঘৃণ্য চালাকি স্পষ্ট হয়ে যায় এবং গার্মেন্ট মালিকদের এই অন্যায় আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে পড়ে যায় । সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের একাংশের মধ্যে আঁতাতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে এই অভিযোগও সরকার পক্ষীয়দের কাছ থেকে শোনা যায়। মালিকদের দালাল ট্রেড ইউনিয়নগুলোকেও শ্রমিকেরা সহজে শনাক্ত করতে শেখে।


এতো কিছুর পর গোড়ার প্রশ্ন গোড়াতেই থেকে যাচ্ছে। শ্রমিকেরা তাদের জুলাই মাসের বেতন পান নি। তবে এখন সরকার বলছে, ১০ আগস্টের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেতন প্রদানে তোবার মালিককে বাধ্য করা হবে। দেলোয়ার হোসেনকে ১০ আগস্টের মধ্যে শ্রমিকদের জুলাই মাসের বেতন প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘মালিক কিভাবে এই বেতন দেবেন কিংবা কোথা থেকে এই টাকা আনবেন সরকার এটা জানতে চায় না। তাকে বেতন দিতে হবে এটাই সিদ্ধান্ত’। (দেখুন যুগান্তর ৮ আগাস্ট ২০১৪)।

পুরা ঘটনায় বিজেএমইএ-র ভূমিকা ন্যক্কারজনক। শ্রম আইন না মানা কিম্বা নীতিনৈতিকতার তোয়াক্কা না করা এক কথা, কিন্তু একজন অভিযুক্ত গার্মেন্ট মালিককে কারাগার থেকে বের করে আনবার জন্য শ্রমিকদের বকেয়া বেতন না দেওয়া খুবই নিন্দনীয় কাজ। শ্রমিকদের জিম্মি করে পুরা গার্মেন্ট শিল্পকেই গার্মেন্ট মালিকরা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাজরিন ও রানা প্লাজার ঘটনায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকদের মুখে যে নোংরা কালি পড়েছে তার দায় পুরা দেশের অর্থনীতিকে বহন করতে হচ্ছে। এখন আরও ময়লা লাগল। বাংলাদেশ থেকে আর কাপড় কেনা যাবে না, এই প্রচার চলছে। সেটা সঙ্গত কারনে। ধসে পড়া ভবনের তলে চাপা পড়া জ্যন্ত শ্রমিকের আর্তনাদ সারা দুনিয়াকে কাতর করেছে। বাংলাদেশী পোশাক বর্জন করবার কথা উঠছে বারবার। এখন আবার উঠবে।

বিজেএমইএ গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন, অতএব তারা মালিকদের স্বার্থ দেখবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কারখানায় শ্রমিকদের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে যেসব মালিক শ্রমিকদের পুড়িয়ে, কিম্বা ভবন ধসে শ্রমিকদের জীবন্ত কবর দিয়েছে তাদের পক্ষে দাঁড়ানো অতি অস্বাভাবিক ও মানসিক দিক থেকে গভীর বিমারির লক্ষণ। সেই দিক থেকে শ্রমিকদের জিম্মি করে তোবা গ্রুপের মালিককে কারাগার থেকে বের করে আনার ঘটনা আন্তর্জাতিক ভাবেই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমই এ কারনে বিজেএমইএ-র সমালোচনা করছে। দৈনিক প্রথম আলো বলেছে, পত্রিকাটির কাছে ‘একাধিক শ্রমিক স্বীকার করেছেন, আন্দোলনে নামতে তাঁদের উসকানি দিয়েছেন তোবা গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা ও বিজিএমইএর নেতারা’ (দেখুন ‘নৌমন্ত্রী কী করছেন!’ ৮ অগাস্ট ২০১৪)। দৈনিক যুগান্তর স্পষ্টই বলছে, তোবা সংকটের জন্য বিজিএমইএ ও সরকারের একাংশই দায়ী (দেখুন, ‘তোবা সংকট: বিজিএমইএ ও সরকারের একাংশ দায়ী’ ৮ অগাস্ট ২০১৪)। ঈদের আগে তোবা গ্রুপের পাঁচটি কারখানা ৩৯ কোটি টাকার কাজ করেছে । বেতন না দেবার কোন কারনই নাই।

শ্রমিকেরা অনশন করছে ২৭ জুলাই থেকে, কিন্তু বিজিএমইএ বেতন সমস্যা সমাধানের জন্য কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী শ্রমিকদের আন্দোলনের জন্য নিজেরা উসকে দিয়ে দেলোয়ারের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল তারা। বিজিএমইএ সূত্রেই দৈনিক পত্রিকাগুলো জেনেছে শ্রমিকদের বেতন দিতে তারা বিভিন্ন পোশাকমালিকদের কাছ থেকে দুই কোটি ২১ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে । এর মধ্যে তোবা গ্রুপ দিয়েছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। তাহলে বিজিএমইএ নিজেই বেতনের ব্যবস্থা করতে পারত। বেতন দেবার জন্য দেলোয়ারকে জামিনে মুক্ত করে আনবার কোন দরকার ছিল না।

তোবার শ্রমিকদের জন্য দরকার ছিল মাত্র চার কোটি টাকা। তোবার ৫ কারখানার ১৬০০ শ্রমিকের ৩ মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাস বাবদ ৪ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১২৭ টাকা পাওনা রয়েছে। অনেকে বলছেন ঈদের আগে বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের চাঁদা ও ইউডির অর্থে গঠিত ফান্ড থেকে অথবা বড় মাপের সদস্যদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক অর্থ নিয়ে এ পাওনা অনায়াসেই পরিশোধ করতে পারত, কিন্তু করে নি। তারা নিজেরা না চাইলে তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনের স্থাবর-অস্থাবর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ও সচল কারখানা দেখিয়ে সরকারের সহযোগিতায় ব্যাংক থেকেও টাকা নেওয়া যেতো। মোটকথা শ্রমিকদের মাত্র ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা কোনো বিষয়ই ছিল না। কিন্তু বিজেওএমইএ দেলোয়ার হোসেনকে জামিনে বের করে আনার জন্য ঈদের আগে শ্রমিকদের সঙ্গে এই কুকাণ্ড করে এবং সরকার তাদের পক্ষের গার্মেন্ট মালিকদের পরামর্শ শুনে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা পুরা গার্মেন্ট সেক্টরের ক্ষতির কারন হতে যাচ্ছে। ওন্যদিকে সরকার পক্ষের লোকজনও বলছে, তোবার ঘটনা বিরোধী দলের ঘোষিত আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরোধী দলের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়া হোল।


Mishu_Farida

আন্দোলনের সফলতা ও বিফলতার বিচার তাৎক্ষণিক ভাবে শ্রমিকেরা হারল কি জিতল তার ওপর  আংশিক নির্ভর করে বটে, কিন্তু প্রতিটি আন্দোলন শ্রমিকদের কি শেখালো তার ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক শ্রেণি হিসাবে শ্রমিকের পরিগঠিত হয়ে ওঠার জীবন্ত প্রক্রিয়া। আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনার চর্চা শ্রমিক আন্দোলনে নাই বললেই চলে; সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যেও তা আশংকাজনকভাবে অনুপস্থিত। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলন কিভাবে একইসঙ্গে নারীর প্রশ্নকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বলয়ের বাইরে নিয়ে আসে বিশ্লেষণ ও বোঝা জরুরী। ফলে নারী আন্দোলনের ভেতর থেকেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের লড়াই সংগ্রাম বোঝা জরুরী। ( চিন্তার পাতায় দেখুন, 'নারী শ্রমিক ও নারী আন্দোলন'


গোলকায়নের এ কালে গার্মেন্ট সেক্টর কমপ্লায়েন্স নির্ভর। যে কারনে শ্রমিকের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার মেনে নেওয়ার সঙ্গে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার ধরে রাখার প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে এবং তারা তাদের মজুরি পায় না - এটা এখন আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের এই ভাবমূর্তি পোশাকশিল্পের জন্য স্বস্তিকর নয়। তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের সঙ্গে বিজেএমইএ যে আচরণ করল তাতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকদের চেহারা উজ্জ্বল হয় নি। সেখানে যে কালি পড়েছে তাকে মোছা বেশ কঠিন হবে।

মৃত্যুর মিছিল শুরু বহু আগে থেকে, ১৯৯০ সালে সারাকা গার্মেন্টসের কথা কারো ভুলে যাবার কথা নয়। সেখানে আগুনে মারা গিয়েছিলেন ৩০ জন পোশাকশ্রমিক। দুই হাজার পাঁচ সালে সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে ৬৪ শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে ১১২৭ জন শ্রমিক নিহত হওয়া (এবং আরও কয়েক শত নিখোঁজ থাকা) – মাঝখানে ছোট বড় লাশের মিছিলের শেষ নাই। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রচার চলেছে যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের রক্তমাখা কাপড় যেন কেউ না কেনে। রানা প্লাজার ঘটনার পর বিদেশি ভোক্তারা বলেছে ভবন ধসে চাপা পড়া মৃত্যুর আর্তনাদে ভারি কাপড় আমরা পরতে চাই না। শ্রমিকদের ঘামের দাম যারা মিটিয়ে দেয় না তাদের পোশাক পরা যাবে না, ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাবে এটা সকলকে আশ্বস্ত করা যে সরকার ও গার্মেন্ট মালিক উভয়েই শ্রমিকের জানের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আন্তরিক। দ্বিতীয়ত সরকার ও মালিকপক্ষ উভয়েই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত শ্রমিকের সকল অধিকার মেনে নেবে। বলা বাহুল্য, সেটা মেনে নেওয়া দূরে থাকুক, কাজ করিয়ে নিয়ে মজুরি দেবার ন্যূনতম বিধানও অনেক গার্মেন্ট মালিক মানছে না। সেটাও নাহয় ব্যতিক্রম গণ্য করা যেত, কিন্তু বিজেএমইএ যেভাবে দেলোয়ার হোসেনকে জামিনে কারাগার থেকে বের করে আনবার জন্য শ্রমিকদের ঈদের আগে প্রাপ্য বেতন ও বোনাস দিলোনা তাতে গার্মেন্ট সেক্টরের সকল মালিকদের জন্য এটা একটা কলংক হয়ে রইল। এমন কি টেলিভিশনের টক শোতে কোন কোন মালিক দেলওয়ারের আদৌ জেলে থাকা উচিত ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন! অর্থাৎ তাজরীনের শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য দেলওয়ারকে দায়ী যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে বাচাঁনোর চেষ্টা আরও স্পষ্ট করেছেন।

এই ময়লা প্রতিটি মালিককেই আন্তর্জাতিক বাজারে মাথায় বয়ে বেড়াতে হবে। ব্যাক্তির স্বার্থে পুরা একটি শিল্পখাতকে খাদে ফেলে দেওয়া অবিশ্বাস্যই বলতে হবে।

৮ আগস্ট, ২০১৪/ ২৪ শ্রাবণ, ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।