শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি (২)


তোবা গার্মেন্টের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে শ্রমিক আন্দোলন প্রসঙ্গে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের বামপন্থিদের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে এখানে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। বিশেষত শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থ আর শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির পার্থক্য সম্পর্কে। একটি হোল শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া আদায়ের লড়াই আর অন্যটি পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সমাজ ও ইতিহাসের রূপান্তর ঘটানোর রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রকল্প ও তৎপরতা। শেষেরটি কমিউনিস্ট রাজনীতি হিসাবেও পরিচিত। দুইয়ের ক্ষেত্রে ‘শ্রমিক’ কথাটা থাকলেও, দুটো ভিন্ন বিষয়। অর্থনৈতিক শ্রেণি হিসাবে ‘শ্রমিক’ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থা বদলে দিয়ে নতুন ধরণের সম্পর্ক চর্চার বিদ্যা, দূরদৃষ্টি ও রাজনীতির যারা ধারক ইতিহাসের সেই বিপ্লবী কর্তা হিসাবে ‘শ্রমিক শ্রেণি’ বলতে যা বোঝানো হয় তা একদমই আলাদা বিষয়। অর্থনৈতিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক-দার্শনিক তৎপরতার মধ্যে ফারাকটা মৌলিক। বাংলাদেশে বামপন্থি আন্দোলন অনেক সময় নিজেদের কমিউনিস্ট দাবি করলেও এই পার্থক্য নিজেদের নীতি ও কৌশলে আজও স্পষ্ট করতে পারেন নি।

শ্রমিকের অর্থনৈতিক আন্দোলন স্রেফ অর্থনৈতিক হবার কারনে ‘অর্থনীতিবাদী’ হয় না। কমিউনিস্টরা যে আন্দোলনের সাধারণত নিন্দা করে থাকে। বরং ক্ষমতার লড়াই বা রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ক্ষেত্রকে যখন অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার লড়াইয়ে পরিণত করা হয় তখনই তা ‘অর্থনীতিবাদী’ বলে পরিগণিত হয়। পরিণতিতে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার সংকীর্ণতার মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলন খাবি খেতে থাকে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষয় শুরু হয়। যেমন, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের দাবি। এইসকল গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলেও এগুলো মূলত অর্থনৈতিক দাবি। বৈষয়িক সুবিধা থেকে বঞ্চিতদের জন্য এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা খুবই দরকার। কিন্তু ক্ষমতা, সামরিকতা, রাষ্ট্রকাঠামো, সংবিধান, আইন, প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত সরাসরি রাজনৈতিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে কমিউনিস্ট যদি এই সকল অর্থনৈতিক দাবিকেই তার পরমার্থ গণ্য করে তবে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তার ক্ষয় অনিবার্য।

দ্বিতীয় আরেকটি কারনে বামপন্থিরা শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করবার জন্য শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দরকার। এর কোন বিকল্প নাই। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং ট্রেড ইউনিয়নধর্মী কাজের সীমানা মেনে শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার আন্দোলনকে বামপন্থিরা নেতিবাচক চোখে দেখে। যারা শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন, নিজেদের কমিউনিস্ট ভাবেন, তারা অনেকে ট্রেড ইউনিয়নধর্মী কাজকে সংস্কারপন্থী ও অর্থনীতিবাদী আন্দোলন বলে বিবেচনা করেন। এই মুল্যায়ন তখনই সঠিক যদি শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করতে গিয়ে তাকে কেউ স্রেফ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে পর্যবসিত করে ফেলে। কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন তো আসলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই বটে। অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসাবে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডকে আলাদা ভাবে ‘রাজনৈতিক’ হতে হয় না, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব যেভাবে হাজির করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা এই দ্বন্দ্বের চরিত্র সম্পর্কে দ্রুত সচেতন হয়ে উঠতে পারে। তার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে বিকশিত হতে দেওয়ার ওপর কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশ নির্ভরশীল । সচেতনতার মানে এই নয় যে শ্রমিকেরা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে অবিলম্বে সম্পত্তি মালিকানা ব্যবস্থার উচ্ছেদ চায়, বরং প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক মালিকানা সম্পর্কের সঙ্গে তুলনায় আধুনিক বুর্জোয়া মালিকানা সম্পত্তির সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে তারা সচেতন হয়ে ওঠে। এই সম্পর্কের রূপান্তরের জন্য বিদ্যমান সম্পর্কের সুবিধা গ্রহণ ও তার সম্ভাবনা আত্মস্থ করা যেমন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মুখ্য কাজ, তেমনি তার সীমা ও স্ববিরোধিতা সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে শ্রমিকদের শ্রেণি হিসাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা তৈরি কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ দায় ও কর্তব্য। প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের পরীক্ষা নিরীক্ষা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে চিনের অভিজ্ঞতা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি উভয় সম্পর্কে বিস্তর প্রশ্ন তৈরি করেছে। তার পরও সাধারণ ভাবে শ্রমিকদের রাজনৈতিক শ্রেণি বা রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হিসাবে বিকশিত করে তোলার এই নীতিগত জায়গা নিয়ে বিতর্ক নাই।


Tuba worker

শ্রমের সঙ্গে পুঁজির দ্বন্দ্বের কারনে নিজের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায় করে নেবার জন্য স্বাভাবিক কারণেই শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। তাকে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হতে দেওয়ার অর্থ স্বতঃস্ফূর্ত অর্থনৈতিক স্বার্থবোধের ওপর নির্ভর করা নয়। শ্রমিককে বোঝানো দরকার তার নিজস্ব লড়াই-সংগ্রাম পুরা সমাজের জন্য কেন, কোথায় ও কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কেন তার নিজের উন্নতির সঙ্গে সমাজের উন্নতি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। তাহলে  শ্রমিক আন্দোলনকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করা শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির কাজ নয়, তা্র নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ কিভাবে সমাজের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত সেটা বোঝানোর মধ্য দিয়েই তাকে রাজনৈতিক করে তোলা সঠিক পথ। এটাই রাজনৈতিক ভাবে শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার পথ। কোথায় অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিমণ্ডল আর কখন কিভাবে তা রাজনৈতিক তাৎপর্য পরিগ্রহণ করতে শুরু করে সেই মুহূর্তগুলো চিহ্নিত করবার ক্ষমতা যেন শ্রমিকেরা নিজেরাই অর্জন করে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না।

শ্রমিকদের 'রাজনৈতিক' শিক্ষার দরকার আছে, সন্দেহ নাই। নইলে অর্থনৈতিক সংগ্রামের বলয় শ্রমিক তার অর্থনৈতিক স্বার্থের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে অতিক্রম করতে পারে না। তাদের সংগ্রাম অর্থনীতিবাদী থেকে যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যারা সেই শিক্ষাটা দেবে যদি তারাই অর্থনীতিবাদের ভূত মাথায় বয়ে বেড়ায়? তখন?  আসলে শিক্ষা দুই পক্ষেই দরকার। আর শিখতে হবে শ্রমিকদের  কাছ থেকেই। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা শ্রমিক তার জীবন দিয়ে ঠিকই উপলব্ধি করে ও বোঝে। সেই বোঝাবুঝিই শ্রিক শ্রেণির রাজনীতি গড়ে তোলার ভিত্তি।


মুশকিল হচ্ছে বাংলাদেশের এখনকার কমিউনিস্ট আন্দোলন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে সজ্ঞান নয়। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির অর্থনৈতিক মর্ম নিয়েও খুব একটা তর্ক চোখে পড়ে না। বিশেষত কমিউনিস্টদের দিক থেকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের পথ নির্ণয়ের বিতর্ক নাই বললেই চলে। যেমন, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করাই কি এখন বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের কাজ? নাকি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অর্থনীতির পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ জাতীয় উৎপাদন শক্তি ও আভ্যন্তরীন সম্পদ ব্যবস্থার বন্টনে সাম্য যা জাতীয় বিনিয়োগ ও শ্রম নীতির জন্য লড়াই? সেখানে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক তো থাকতেই পারে, যা সামাজিক নীতির অধীন, অবাধ বাজার ব্যবস্থা নয়। এই ধরনের নীতি মূলত বহুজাতিক কম্পানির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, কিন্তু পাশাপাশি জাতীয় ক্ষেত্রে কৃৎকৌশল অর্জন, উৎপাদন ব্যবস্থা্নায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও রপ্তানি বাজারে সক্ষম প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠার জন্য জাতীয় নীতির জন্য লড়াই বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সারকথা হচ্ছে, বিশ্ব অর্থ নৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালি অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ণয় করবার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের সুনির্দিষ্ট ধরন কী হতে পারে সেই তর্কের মীমাংসা করাই প্রধান কাজ।

ব্যাতিক্রম থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে স্রেফ এই বদ্ধমূল বিশ্বাস থেকে অংশগ্রহণ করে যে সমাজ থেকে এখনই বুর্জোয়া মালিকানা বা পুঁজিতান্ত্রিক “মালিকানা’ সম্পর্কের উৎখাত করাই তাদের প্রধান, একমাত্র ও আশু কাজ। অর্থনৈতিক বিকাশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা তারা আমলে নেয় না। এই অনৈতিহাসিক অন্ধ বিশ্বাস তাদের একদিকে যেমন কারখানার মালিকদের চোখে স্রেফ নুইসেন্স বা আপদ হিসাবে হাজির করে, তেমনি শ্রমিকদের চোখেও তারা তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে হাজির হয়। ট্রেড ইউনিয়ন কিম্বা শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি দুটির একটিরও এতে উপকার হয় না। ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের চিন্তার প্রাবল্যের কারনে রাজনীতিতে পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে পেটিবুর্জোয়া ক্রোধের অতিরিক্ত কিছু তারা পয়দা করতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন কাজের সহায়ক না হয়ে সেটা অনেক সময় আত্মঘাতী ভূমিকায় পর্যবসিত হয়।

কমিউনিস্টরা নৈরাজ্যবাদী নয়, নৈরাষ্ট্রবাদীও নয়, কিন্তু সব রাষ্ট্র একদিন শুকিয়ে মরবে এটা তারা অবশ্যই তত্ত্ব হিসাবে মানে। কিন্তু যতক্ষণ অবধি শুকিয়ে মরবার পরিস্থিতি তৈরি না হচ্ছে ততক্ষণ উপস্থিত রাষ্ট্র ভেঙে কিভাবে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় সেকথা তো ভাবতেই হবে। সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি হাজির করা দরকার, কাল্পনিক উপাখ্যান নয়। গড়ার কাজ ও চিন্তা যেমন বন্ধ রাখা যায় না, ঠিক তেমনি একদিন সব মালিকানা উচ্ছেদ ঘটবে তত্ত্বগত ভাবে সঠিক হলেও এখনকার কাজ নয়। কোন্‌ ধরণের মালিকানার তারা এখনই বিরোধিতা করে না, আর কোন্‌ ধরনের মালিকানার তারা এখনই ঘোর উচ্ছেদের পক্ষে –সেটা স্পষ্ট করাই তাদের এখনকার আসল কাজ। সাধারণভাবে সব ধরণের ব্যক্তিগত মালিকানার বিরুদ্ধে সব সময় থাকতে হবে এই ধরণের বিমূর্ত অবস্থানের সঙ্গে কমিউনিস্ট চিন্তার – বিশেষত কার্ল মার্কসের চিন্তাভাবনার কোন মিল নাই।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি সর্বক্ষণ সর্বহারা শ্রেণিতে পরিণত হবার দুশ্চিন্তায় ভোগে। বিমূর্ত ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করা বা ‘সমাজতন্ত্রী’ হওয়া এই দুশ্চিন্তার ফল মাত্র। বিমূর্ত কায়দায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির কোন সম্পর্ক নাই। পুঁজিবাদ বিরোধী হলেই কেউ কমিউনিস্ট হয় না। সমাজতন্ত্রীও মানেও কমিউনিস্ট নয় হিটলার বা মুসোলিনি তার আদর্শ হতে পারে। সামন্ত শ্রেণি, নানান স্তরের মধ্যবিত্ত বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণিও ঘোরতর ভাবে পুঁজিবাদ বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করে। তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট ইশতেহারে মার্কস ও এঙ্গেলস এই ধরণের সমাজতন্ত্রীদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কেউ ধনি হতে না পারায় খেয়ে না খেয়ে ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করার মনস্তত্ত্ব বোঝা কঠিন কিছু নয়।

বাংলাদেশের বাম আন্দোলন নানা কারনে দুর্বল। এটা শুধু সাংগঠনিক দুর্বলতা নয়। এই ধরণের গোড়ার কিছু প্রশ্ন সপর্কে অস্পষ্টতা ও মীমাংসাহীনতাই বড় কারন। আরও কারন রয়েছে বা থাকতে পারে। তবে আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য সেইসব জরুরী নয়। সেই কারনগুলো মনে রেখে এটা অনায়াসেই স্বীকার করা যায় শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি বামপন্থার আগ্রহ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে বামপন্থিরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যা প্রশংসা করার মতো। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সংগ্রাম ছাড়া তোবা শ্রমিকদের পাওনা আদায় হোতনা, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর জন্য শ্রমিকদের পাশাপাশি যারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন তারা নিঃশর্ত অভিনন্দন পাবার যোগ্য।


police

শ্রমিক আন্দোলন দমন করার জন্য শুধু পুরুষ নয়, রাষ্ট্রের নারী পুলিশেরও প্রয়োজন। প্রায় একই শ্রেণি থেকে আসা গার্মেন্ট শ্রমিক আর পুলিশ নারী পস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের তরফে নারীনির্যাতন করাকে নারী পুলিশ অস্বাভাবিক কিছু মনে করিনা। একই শরীর ও একই অর্থনৈতিক শ্রেণি জালিম ও মজলুম এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। শ্রেণি রাজনীতিকে এই ধরনের বাস্তবতাকেও আমলে নিতে হবে।


শ্রমিক শ্রেণির জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা, ইতিহাস ও রাজনীতির পর্যালোচনা অনেক বড় একটি বিষয় – সামগ্রিক ভাবে সমাজের চিন্তার বিকাশের সঙ্গে বামপন্থার বিকাশ জড়িত। এই দিক থেকে বামপন্থিদের পশ্চাতপদতা সমাজের পশ্চাতপদতার লক্ষণ। কিন্তু তারপরও বলা যায় খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হোক – সম্ভবত সেটা বামপন্থী দলগুলো যতোটা আন্তরিক ভাবে চায়, অন্য রাজনৈতিক দল ততোটা চাইবে না। অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধী। তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আমরা তা স্পষ্ট ভাবেই আবার দেখলাম।

দলগত ভাবে শ্রমশক্তি দরদামের ‘বুর্জোয়া’ অধিকার

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে শ্রমিক আন্দোলনের সম্ভাবনা ও সীমা নিয়ে বাম মহলে খুব কম আলোচনাই আমার চোখে পড়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিক বা শ্রমিকতাকে এখনও জাতীয় পরিমণ্ডলের সীমার মধ্যে ভাবা হয়, এর বাইরে যদি ভাবা হয় তাহলে সেটা ‘প্রবাসী’ শ্রমিক শিরোনামে, সে আলোচনা আলাদা ভাবেই হয়। বামপন্থীরাও এভাবে ভাবতেই অভ্যস্ত। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এ কালে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিশাল একটি অংশ দেশের বাইরে, শ্রম শক্তি এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্য– এই বাস্তবতায় শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি কথাটা নতুন কোন তাৎপর্য গ্রহণ করেছে কিনা সে বিষয়ে খুব কমই বাংলাদেশে ভাবাভাবি হয়েছে। সেই দিক থেকে ‘শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি’ দূরে থাকুক, সাধারণ ভাবে ‘শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ’ রক্ষা করার কাজও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে সুসঙ্গত নীতি ও কৌশল নির্ণয় না করলে বামপন্থী রাজনীতি দূরের কথা, শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের রূপান্তরের প্রশ্ন অতীতের তুলনায় যতোটা না জাতীয়, তারচেয়ে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। তুলনায় শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের লড়াই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয়ের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। তীব্র পুঁজিতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাগে নিজের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে কিনা সেটা অনেকাংশই এখন নির্ভর করছে সজ্ঞান ও সচেতন শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ওপর। এই দিকগুলো বুঝতে না পারলে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক রূপান্তর দূরের কথা, বাংলাদেশের বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বামপন্থিরা কোন ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ।

কথাগুলো বলছি এ কারনে যে শ্রমিকদের ‘অর্থনৈতিক’ স্বার্থ হাসিল করার কাজ আর শ্রমিক শ্রেণির ‘রাজনীতি’ সমার্থক নয় এই দিকটা ভালভাবে বোঝা যথেষ্ট নয়। বামপন্থি রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার বাস্তব ও ব্যবহারিক অর্থ কী দাঁড়ায় সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা বামপন্থিদের জন্য এখন খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। উভয় ক্ষেত্রে 'শ্রমিক' কথাটি আছে বলে তাদের সমার্থক গণ্য করার কোন যুক্তি নাই। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দলীয় মতাদর্শিক রাজনীতির পার্থক্য তত্ত্বগত ভাবে অনেকে বলেন, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখি না। এই পার্থক্যের প্রকৃত অভাব আছে বলে বাংলাদেশে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যেমন গড়ে ওঠে নি, ঠিক তেমনি শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির এমন কোন শক্তিশালী ধারাও গড়ে ওঠে নি যা জাতীয় রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী হওয়া অবশ্য ভিন্ন কথা।

শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনের দিক থেকে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে জরুরী কাজ কি? এক কথায় সেটা নিজের পণ্যের দরদাম করবার অধিকার। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের নিজের পণ্য কি? সেটা তার শ্রমশক্তি। তাহলে শ্রমিক সংঘবদ্ধ ভাবে তার শ্রমশক্তি কারখানার মালিকদের কাছে কি দামে বিক্রি করবে কি করবে না – সেটা একান্তই শ্রমিকের এখতিয়ার। আইনের ভাষায় যদি বলি তাহলে এটা শ্রমিকেরই অধিকার। একে আইনী বাধ্যবাধকতার অধীনে আনা দরকার। এটাই ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নামে পরিচিত। কারখানার মালিক কি দামে তার পণ্য বিক্রি করবে তার জন্য বাজারে দরদাম করা যেমন একান্তই তার অধিকারের অন্তর্গত, শ্রমিকের অধিকারও তাই। উভয়েই একই অধিকারের অধীনে নিজ নিজ পণ্য বাজারে দরদামের জন্য আনে ও বেচাকিনি চলে। পুঁজিপতির যেমন তার পণ্যের ওপর অধিকার, শ্রমিকেরও তেমনি তার শ্রমশক্তির ওপর অধিকার রয়েছে। বলাবাহুল্য শ্রমশক্তি বাজার থেকে কিনতে না পারলে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বুর্জোয়া শ্রেণি এই ‘অধিকার’ নীতিগত ভাবে মানে। মানতে বাধ্য। কারখানা মালিকদের ক্ষেত্রে নিজের পণ্য দরদাম করে বেচাবিক্রির অধিকার থাকবে, কিন্তু শ্রমিকের থাকবে না – এটা হতে পারে না। এই অসাম্য চলে না। খেয়াল করতে হবে, আমরা শ্রমিকের মজুরি কি হবে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি না। আমরা বরং আরও গোড়ার প্রশ্ন তুলছি। শ্রমিক তার মজুরি নির্ধারণের জন্য দরদাম করবার অধিকার রাখে কিনা। আন্তর্জাতিক আইন বলে, এই অধিকার অবশ্যই শ্রমিকের আছে। যেহেতু কারখানা মালিকের আছে, অতএব শ্রমিকেরও আছে। এক দেশে দুই আইন থাকতে পারে না। এটাও বোঝা দরকার, এই অধিকারের দাবি কোন বিপ্লবী কর্মসূচি নয়। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার একান্তই বুর্জোয়া অধিকার । কিন্তু বাংলাদেশের কারখানা মালিক ও শাসক শ্রেণি শ্রমিকদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এই দিকটা সকলের কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার।

এই অধিকার বামপন্থী ভাষায় ‘বুর্জোয়া অধিকার’ অবশ্যই, এই অর্থে যে বুর্জোয়া শ্রেণি এই অধিকার নীতিগত ভাবে মানে। কিন্তু সেটা আদায় করার কাজ রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামেরই অংশ। এই হক আদায়ের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এই অধিকার একই সঙ্গে সরাসরি শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ অর্জন করার সঙ্গেও জড়িত। এখানে শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ একটা সন্ধিতে এসে দাঁড়ায়। তার মানে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন বা বোনাসের দাবি অর্থনীতিবাদী সংগ্রাম, কিন্তু শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার একান্তই রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রামের অন্তর্গত। একই সঙ্গে তা অর্থনৈতিকও বটে কারন এই অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধানে বা আইনে গৃহীত না হলে এবং এই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য দরকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললে শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক ও আইনী পরিবেশ হাজির থাকে না।

এই ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির অর্থ কি তাহলে বুর্জোয়া অধিকারের জন্য লড়াই করা? অবশ্যই না। বামপন্থি রাজনীতি এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্য সাধারণত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তোলে। যা রণনৈতিক প্রশ্ন বলে পরিচিত। সেটা হচ্ছে এই রকম: বাংলাদেশ কি বুর্জোয়া চেতনা অতিক্রম করে গিয়েছে? অর্থাৎ রাজনৈতিক চেতনার স্তর কি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যাতে আমরা ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে অতো আর ভাবি না, সামাজিক স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে স্থান দেই। এটা কি আমরা বুঝতে পারি যে সমাজের স্বার্থ রক্ষা করলেই আমাদের যার যার ব্যক্তি স্বার্থ পূরণ হয়। সামাজিক চৈতন্যের এই দুই স্তরের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারার ক্ষমতার ওপর বামপন্থী রাজনীতির সফলতা ও বিফলতা নির্ভর করে। যারা মনে করেন আমরা এখনও ব্যক্তিতান্ত্রিক চিন্তা, চেতনার পরিমণ্ডল অতিক্রম করি নি তারা তখন বলেন এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্য হচ্ছে ব্যাক্তিতান্ত্রিক অধিকার বা ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণি যে অধিকার নিজের গরজে মানে সেটা তাদের কাছ থকে আদায় করে নেওয়া। তার পর সেই অধিকারের ওপর দাঁড়িয়ে আর্থ-সামাজিক অধিকারের ও আর্থ-সামাজিক স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া। যৌথ, সমবায়িক বা বহুর স্বার্থ রক্ষা করবার বিধিবিধান, সংস্কৃতি বা আইন ধারণ করবার জন্য সমাজকে সচেতন করে তোলা। নিজের গরজে মানে বলেই বুর্জোয়া শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আন্তর্জাতিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। আই এল ওর বিধিবিধানের মধ্যে যা অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি যদি এই অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে তাহলে আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া শ্রেণি এই ক্ষেত্রে তার পক্ষে দাঁড়াবে। নিদেন পক্ষে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোন নীতিগত যুক্তি তারা প্রদর্শন করতে পারবে না। বাংলাদেশের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের দাঁড়ানো অতএব কোন ষড়যন্ত্রের অংশ না, এটাই হবার কথা।

বুর্জোয়া বা ব্যক্তিতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই সাধারণত গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রাম হিসাবে পরিচিত। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবার আইনী শর্ত তৈয়ার করে। এটা রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক দাবি পূরণ নয়। এই অধিকার পাওয়ার অর্থ হচ্ছে দলবেঁধে নিজের মজুরির দাম নির্ণয়ের অধিকার লাভ করা। এ কারণে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াই অবশ্যই। েই অধিকারের দাবির মধ্যে শ্রকের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বার্থ একটা সন্ধিতে এসে মিলিত হয়।


poster


বামপন্থি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে শ্রমিকদের আন্দোলনকে নিজ নিজ দলীয় রাজনৈতিক মতলবের অধীনে রাখা। একে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হতে না দেওয়া। এর ফলে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য দলীয় রাজনীতি বা দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ শ্রমিকদের জন্য একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকেরা তা পছন্দ করে না, এবং বামপন্থি দল থেকে নিজেদের দূরে রাখা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকুল মনে করে। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার আদায়ের লড়াই ঠিক এই কারনে এখনও পিছিয়ে রয়েছে। যেহেতু এ লড়াই বুর্জোয়া অধিকার আদায়ের লড়াই অতএব এ লড়াইয়ের জন্য শ্রমিকদেরই আন্দোলন করতে হবে এমন কোন কথা নাই। বুর্জোয়া সমাজে যারাই ব্যাক্তি অধিকারে বিশ্বাস করে তারাই নীতিগত কারনে মানতে বাধ্য যে শ্রমিকের শ্রমশক্তি তার নিজের, অতএব সে কোন দামে কোথায় কার কাছে বিক্রি করবে তা দরদাম করবার পূর্ণ অধিকার তার আছে।

বাংলাদেশ সম্প্রতি রানা প্লাজার হত্যাকান্ডের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি উদ্ধারের জন্য শিল্প-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান রেখে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল-২০১৩ পাস করেছে। এতো বড়ো ঘটনার পরেও এ আইনে পোশাক খাতের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত শিথিল করা হয়নি। সংশোধিত আইনে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) ট্রেড ইউনিয়ন করা এখনও নিষিদ্ধ রয়েছে। এতে পরিষ্কার শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম ‘বুর্জোয়া’ অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও বামপন্থী আন্দোলন বহু পেছনে পড়ে রয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি ? সে অনেক দূরের পথ।

তাহলে এখন কাজ হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্যে আন্তরিকতার সঙ্গে মনোযোগ দেওয়া। শক্তিশালী শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি বিকাশের শর্ত তৈরি করার এটাই পথ। শ্রমিক আন্দোলনের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে এই শিক্ষাগুলো নিতে পারলে বাংলাদেশের বাম আন্দোলন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করি।

তোবা গার্মেন্ট নিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৌশল নিয়ে বামপন্থিদের মধ্যে তর্ক তৈরি হয়েছে। এই তর্কগুলো খোলামেলা করা ভাল। যারা সুনির্দিষ্ট ভাবে তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, ওভারটাইম ও বোনাস আদায়ের জন্য্তোবা গার্মেন্ট ভবনেই অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা

চিন্তা ও কাজের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য

workers

ওপরের আলোচনা যাদের কাছে গ্রহণযোগ্য তাঁরা নিজেদের মধ্যে কিছু বিষয় আরও স্পষ্ট করে তুলতে পারেন।

১. ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জরুরী।

২. শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে যান বা না যান পুঁজির সঙ্গে শ্রমের বাস্তব দ্বন্দ্বের কারনে সমাজে শ্রমিক আন্দোলন হবে, হবেই। শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থের আন্দোলনকে জোর করে রাজনৈতিক করে তোলার জবরদস্তি ত্যাগ করে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার জায়গায় দাঁড়িয়ে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকারী কাজ। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না।

৩. শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য ও ঐক্যের জায়গা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা তৈরি করা না গেলে দুটির একটিরও বিকাশ ঘটবে না। উভয়ের ভুমিকার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। অর্থাৎ উভয়কে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে তার স্বাধীন জায়গা থেকে গড়ে উঠতে সহায়তা দান করতে হবে।

৪. ট্রেড ইউনিয়নের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, অর্থাৎ শ্রম আইন ও রাষ্ট্রীয় বিধি বিধানের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের আইনী ন্যায্যতা কায়েম দরকার। যেন নিদেন পক্ষে (ক) রাষ্ট্রকে নুন্যতম বেতন ঘোষণা ও বাস্তবায়নে (খ) জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাইড লাইন তৈরি ও বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও কারখানাকে বাধ্য করা যায়।

৫. নিজে দায়িত্ববান ট্রেড ইউনিয়নের ভুমিকা পালন করা, নিজ নিজ ট্রেডের স্বার্থ প্রসঙ্গে বায়ার বা বিদেশী স্বার্থের সাথে মোকাবিলার  সময়ে মালিক এবং সময়ে সময়ে সরকার যেন  শ্রমিক বিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তার জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার প্রচার জোরদার করা।

৬. অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের বাইরে বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে পাল্টা গণক্ষমতা তৈয়ারির নীতি ও কৌশল রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হতে হবে। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কাঁধে জবরদস্তি রাজনৈতিক কর্তব্যের দায় চাপিয়ে দিলে কোনটাই হবে না।

দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের বাইরে বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে পাল্টা গণক্ষমতা তৈয়ারির নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে সামান্যই অবদান রেখেছে। শ্রেণি রাজনীতির পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শিক বলয়ের বাইরে তার কোন পর্যালোচনামূলক অবস্থান নাই বললেই চলে। দল হিসাবে মাঝে মধ্যে  আওয়ামি লিগের সমালোচনা মুলত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপকারের স্বার্থে, শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি বিকাশের কর্তব্য সেখানে যারপরনাই অনুপস্থিত। শ্রমিক, কৃষক ও নিররাযাতীতশ্রেণি ও গোষ্ঠির জায়গা থেকে জাতীয় রাজনীওতিতে কোন পর্যালোচনামূলক অবস্থান না থাকার কারনে ব্যাপক জনগোষ্ঠির কাছে কমিউনিস্ট ও বামপন্থার গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে কমছে, কার বাড়বার কোন কারন ঘটেনি। তেমনি এখনও অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা স্বাস্থ্য, বাসস্থান বা এই ধরণের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়কেই কমিউনিস্ট রাজনীতির পরমার্থ বলে পরিগণিত করার কারণে শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি কি  চিন্তায় কি কৌশলে কোন অগ্রগামী ভূমিকা নিতে পারছে না।

এই দুর্বলতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে তোলা দরকার।

৮ আগস্ট, ২০১৪/ ২৪ শ্রাবণ, ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।