৫ জানুয়ারির অবরোধঃ নগদ লাভ


৫ জানুয়ারি ২০১৫। নৈতিক ও সাংবিধানিক দিক থেকে অবৈধ সরকারের একবছর শেষ হোল। বিরোধী দলের কাছে দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’, আর ক্ষমতাসীনদের কাছে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেউ কেউ ‘বিতর্কিত’ বলে কৌশলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষালম্বন করে থাকেন। অথচ ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার যেমন কোন নৈতিক ভিত্তি নাই, তেমনি ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনশ সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠন অসাংবিধানিক। ক্ষমতাসীনদের নির্লজ্জ দালাল ছাড়া কোন সংবিধান বিশেষষজ্ঞই বলবেন না, শেখ হাসিনা সাংবিধানিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। রফিকুল হক দেরিতে হলেও বলছেন, ‘সাংবিধানিক ভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়’। তিনি সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ এনেছেন, যা সকলেরই জানা। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। নির্বাচন হতে হবে প্রত্যক্ষ নির্বাচন। কিভাবে ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ সম্পন্ন করা যায় জাতীয় সংসদের সে আইন করবার এখতিয়ার আছে। কিন্তু ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচন’ ছাড়া জাতীয় সংসদ গঠন করবার কোন এখতিয়ার কারো নাই। নির্বাচন কমিশনও এমন কোন বিধি প্রণয়ন করতে পারে না যা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, কিম্বা কোন প্রতিদ্বন্দী নাই বলে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’য় কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করতে পারে। জাতীয় সংসদ অবৈধ ব্যাক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এবং এই সংসদের ভিত্তিতে গঠিত সরকারও অবৈধ। শেখ হাসিনা স্রেফ ক্ষমতার জোরে গদি দখল করে রেখেছেন।

নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার পক্ষে অবৈধ কাজ করতে উৎসাহী ছিল। সময় পেরিয়ে যাবার পরেও আওয়ামি লিগের মনোনয়ন প্রার্থীদের মনোয়ন প্রত্যাহার করতে দিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে তারা। অন্যদিকে এরশাদ ও জাতীয় পার্টির অনেক সদস্য নিজেরা মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করতে চেয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেটা করতে দেয় নি। ইত্যাদি।

সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ সরকার মাথায় নিয়েই এক বছর পার হয়ে গেল। বড়ই দ্রুত। বছর শেষে পাঁচই জানুয়ারি কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘাতপূর্ণ অবস্থানের ফলে হানাহানিতে ৫ জানুয়ারিতে দেশে চারজন নিহত হয়েছেন, আহত অনেক। আজ আট তারিখে দেখছি আরও তিনজন মারা গিয়েছেন। দায়দায়িত্ব অবৈধ সরকারকেই নিতে হবে।

সরকার খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে বন্দি করে রেখেছে; দাবি করেছে বিরোধী দলীয় নেত্রী ‘নাটক’ করছেন। খালেদা জিয়া এখনও অবরুদ্ধ (নাকি বন্দী!)। পুলিশ কোন প্রকার উস্কানি ছাড়া ৫ তারিখে ভেতরে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের মহিলা সদস্যদের ওপর পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেছে। পিপার স্প্রে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। অথচ পুলিশ সোৎসাহে আইন ভঙ্গ করছে। গুলশান কার্যালয়ে থেকে খালেদা জিয়া যখন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন তখন পিপার স্প্রে করেছে পুলিশ। আর সবমিলিয়ে ২৬টা ইট, বালির ট্রাক, পুলিশের যানবাহন দিয়ে খালেদার পথরোধ করেই শেখ হাসিনা ক্ষান্ত দেন নি। ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাইরের রেল, সড়ক লঞ্চ সব যোগাযোগ নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। গত দুই বছরে তৃতীয় বারের মতো শেখ হাসিনা এই মহান কাজটি করে দেখালেন তিনি ক্ষমতায় থেকে ঢাকা শহর অবরুদ্ধ করতে পারেন। দারুন এক গণতন্ত্র!

পাঁচ জানুয়ারিতে এক অদ্ভুত বাংলাদেশ দেখল সবাই। অবরোধ চলছে। জেলায় জেলায় হানাহানি ও রক্তপাত ও কম হচ্ছে না। খবরে আমরা সব পাচ্ছি না। কিছু কিছু পত্রিকার খবর অনুযায়ী চোরাগুপ্তা হামলাও চলছে। এর অবসান কিভাবে হবে বলা যাচ্ছে না। কিভাবে কিম্বা কবে অবরোধ কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

হাসিনা স্রেফ জবরদস্তি গত একবছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর আজ সকালেও আছেন। যদিও তার ক্ষমতার নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি শূন্য। গায়ের জোর আর মাস্তানি ছাড়া তাঁর কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। তিনি সেটাই সদম্ভে প্রদর্শন করে চলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের সরকার টিকে থাকে কিভাবে? এর উত্তর মোটেও কঠিন নয়। শেখ হাসিনার ক্ষমতার চরিত্র একনায়কতান্ত্রিক নয়। এর পক্ষে সমাজের সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের সমর্থন আছে। দ্বিতীয়ত আওয়ামি লিগ মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তা বাদ এবং পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের যে গল্প বা বয়ান জারি রেখেছে তার পক্ষেও সমাজে মতাদর্শিক সমর্থন রয়েছে। আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের দিক থেকে দিল্লী তার ক্ষমতার বহাল রাখবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। অবশ্যই। কিন্তু দেশের ভেতরে তার সমর্থনের ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে না পারলে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে একনায়ক্তন্ত্রের চরিত্রগত পার্থক্য আমরা বুঝবো না। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়া সহজ। কিন্তু ফ্যাসিবাদ না।

এই বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে খালেদা আবার নির্বাচনের কথা বলছেন, নির্বাচন চাইছেন। নির্বাচনপন্থী দল হিসাবে নির্বাচনী রাজনীতির ভেতরে থেকে তিনি তার আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান, সেটাই নতুন করে বোঝাতে চাইছেন সম্ভবত। নির্বাচনী রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে তিনি চলে গিয়েছেন বলে যে অভিযোগ ক্ষমতাসীনরাসহ অনেকে তাঁকে তাঁর অতীত রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য করছে, তিনি তাতে খামাখাই কাবু হয়েছেন। এখন সুশীল ও শান্তিপ্রিয় মধ্যবিত্তের – বিশেষত গণমাধ্যমের মন জুগিয়ে সেটা পুষিয়ে নিতে চাইছেন। গণমাধ্যমের যে অংশ তাঁকে এতোকাল ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোট করায় নিরন্তর নিন্দা করেছে, এখন সকলে না হলেও তাদের অনেককেই দেখছি তাঁর প্রতি করুণা মিশ্রিত সমবেদনা প্রকাশ করছে। এতোদিন পর যেন হঠাৎ বেগম জিয়ার নাগরিক অধিকার তাদের চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে। তাদের বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে!

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও সেটা খালেদা জিয়ার প্রতি সমর্থনে রূপ নিচ্ছে না। এর কারন, তিনি নির্বাচন চাইছেন শেখ হাসিনার কাছে, কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি জিতে আসেন তাহলে কী করবেন সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা জনগণকে আজও জানান নি। ফলে জনগণের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ছে; তারপরও আপোষহীন নেত্রী হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা তিনি করছেন। দুর্বল রাজনীতি সম্বল করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে শামিল করতে পারছেন এটা বলা মুশকিল। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ এতো তীব্র যে তার কিছু সুবিধা তিনি হয়তো পাবেন, কিন্তু সেটা আদৌ কোন গঠনমূলক রাজনীতির দিকে যাবে কিনা সন্দেহ। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের আকাংখা বুঝে বাস্তবোচিত কর্মসূচি প্রণয়ন কঠিন কিছু নয়। দুর্বল বিএনপি নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে আর ততোধিক দুর্বল সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন দিশাহীন বিএনপিকে মোকাবিলার ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজের হীন, হিংসুক, জনবিচ্ছিন্ন ও ভীতসন্ত্রস্ত চরিত্র নিজেই প্রকাশ করে ফেলছেন বারবার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দলীয় সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জোরে দুর্বল বিএনপিকে কোনঠাসা করতে গিয়ে তিনি নিজে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন।

ইন্টারেস্টিং যে খালেদা জিয়াকে বালুর বস্তা দিয়ে আটকে রাখা সেকুলার ও উদারবাদী সুশীল রাজনীতি পছন্দ করছে না, যদিও তারা আদতে সেকুলার আওয়ামি লিগেরই দ্বিতীয় সারির শক্ত সমর্থক। সৎ রাজনীতিবিদদের সন্ধানে বেরিয়ে তারা একদা ফখরুদ্দিন আহমদ ও মইনুদ্দিন আহমদকে খুঁজে পেয়েছিল। এখন তারা কাদের খুঁজছে আল্লাই মালুম! মাহফুজ আনাম অবশ্য সাফ সাফ বলেই দিয়েছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে এমন ছাতুর কিচ্ছুই নাই যে সমর্থন করা যায়। (There is nothing much in Khaleda Zia's politics that we find worthy of support. (দেখুন ডেইলি স্টার ৭ জানুয়ারি)। মাহফুজ আনামের সততা প্রশংসনীয়, তিনি প্রকাশ্যেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষাবলম্বনকারী। ইসলামপন্থিদের দমনের জন্য তিনি শেখ হাসিনার শক্ত সমর্থক। ফলে ফ্যাসিবাদ কিম্বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা তার কাছে কোন সমস্যাই না। সমস্যা হচ্ছে ইসলামপন্থীরা। এরাই তাঁর চোখে ‘কমিউনাল ফোর্সেস’। এই অর্থে তিনি ‘মর্ডানিস্ট’’। মারো ইসলামওয়ালাদের। শেখ হাসিনার আমলে উন্নয়ন হয়েছে সেই সাফাই গাইতেও তিনি ভোলেন না। কিন্তু এখন যেভাবে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়িতে তালা মেরে দিয়েছে তাতে তার খারাপ লাগছে। ফ্যসিবাদের সমর্থক এই অবস্থায় লিবারেল হয়ে গিয়েছেন। কী আনন্দ! মাহফুজও প্রতিবাদ করছেন।

কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামি লীগের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হবার সাধনা অব্যাহত রেখেছেন। যদিও দলছুট আওয়ামিপন্থীদের মধ্য থেকে নতুন কোন রাজনীতি পয়দা হবার সম্ভাবনা খুবই কম। ‘আওয়ামি লিগ, তুমি ভালো হয়ে যাও’ জাতীয় নীতিবাগীশ আওয়ামি রাজনীতিও যে বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রধান কারন সে ব্যাপারে কামাল হসেন, মাহফুজ আনান্ম কিম্বা মাহ্মুদুর রহমান মান্না বেহুঁশ সেটা বলা যাবে না। তারা তা জেনেন কিন্তু এই ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদানে তারা নিত্যই তৃপ্ত। কিন্তু তারা খালেদা জিয়ার এই দুর্দশায় তাঁর প্রতি সমব্যথী হয়েছেন। খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে চাইছেন। বোঝা যাচ্ছে, খালেদা জিয়া অনেক মিত্রদের হারালেও আওয়ামিপন্থী সুশীলদের করুণা ও সমবেদনা কিছুটা পাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামিসহ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়া তাদের কাছে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করারা ভাল একটি অজুহাত, যা তাদের স্বভাবসুলভ ইসলামোফোবিয়াকে আড়াল করে রাখতে সাহায্য করে। তাদের বাসনা খালেদা ইসলামপন্থিদের ছেড়ে সুশীল রাজনীতির কাতারে আসুক। তারা তখন হাসিনাকে থুয়ে খালেদাকে বেছে নেবার একটা যুক্তি খুঁজে পাবে। প্রতারিত হবার এই হাতছানি থেকে বিএনপির নেতৃত্ব মুক্ত নয়।

বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাগুলির খবর প্রকাশের পরিবেশনার মধ্যে এই সকল দিক স্পষ্ট। সে যাই হোক, ডিএমপি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের পরও সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সহায়তায় ৫ জানুয়ারিতে ঢাকায় সভা-সমাবেশ করেন এবং বিরোধীদের সমবেত হওয়া প্রতিহত করেন। রাজধানীর রাজপথে তাদের লাঠি হাতে মিছিল করতে দেখা যায়। ট্রাক, গাড়ি ও মোটরসাইকেলে চড়েও মহড়া দেন তাঁরা। মধ্যবিত্তের সুশীলতা আওয়ামি আচরণে খানিক আহত হয়েছে। পত্রিকাগুলো তার নিন্দাই করেছে। ভালো।

তো নিজ নিজ পক্ষের বয়ান, তৎপরতা ও প্রচারপ্রপাগান্ডার দিক থেকে বিচার করলে এখনও অবধি খালেদা জিয়ার জয় হয়েছে অবশ্যই। তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চেয়েছেন, শান্তিপূর্ণ থেকেছেন। এটাও ঠিক যে শেখ হাসিনার উলঙ্গ ক্ষমতার সামনে দাঁড়াবার কোন সাংগঠনিক ক্ষমতা কিম্বা আদর্শিক প্রস্তুতি কিছুই তাঁর নাই। ক্ষমতাসীনদের নগ্ন বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে কার্যত তিনি কিছুই করতে পারছেন না; বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা কঠিনও বটে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকেও কার্যকর রাজনীতিতে পরিণত করবার বাস্তব চিন্তা কিম্বা দূরদর্শিতা তার নাই। ইসলামপন্থী রাজনীতি থেকে তাঁর দূরত্ব বজায় রেখে চলবার সাম্প্রতিক নীতি তাঁর রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। যা আগামি দিনে আরও বাড়বে।

সুশীলদের বিভ্রান্তি থাকতে পারে, কিন্তু ইসলামপন্থীরা বিএনপিকে মোটেও ইসলামপন্থী দল গণ্য করে না। কিন্তু ইসলামের চিন্তাচেতনা এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিককে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সমাজে আত্মস্থ করা এবং তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাতন্ত্র্যবোধকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবার ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্ব মেনে নিতে তাদের কোনদিনই আপত্তি ছিল না। জিয়াউর রহমান এই সহজ সত্য বুঝলেও বর্তমান নেতৃত্ব সেটা আদৌ বোঝে কিনা সন্দেহ। এটাই বিএনপিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শেখ হাসিনার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সেকুলারদের মন রক্ষা করে চলার নীতি তাঁকে গণতন্ত্রকামী নাগরিকদের কাছ থেকেও দূরে ঠেলে দিয়েছে অনেক আগেই। কারন গণতন্ত্রীদের ইসলাম আতংক নাই। ফ্যাসিবাদই তাদের প্রধান দুষমন, ইসলাম নয়।

তবে, এটা মানা যায়, গান্ধীর রণকৌশল অনুযায়ী শান্তি ও অহিংসার কথা বলে নিজের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে বেগম খালেদা জিয়া শক্তিতে পরিণত করবার চেষ্টা করেছেন কিছুটা। ফলে সুশীল ও অহিংস মধ্যবিত্ত – যাদের পক্ষে রাষ্ট্র ও প্রশাসন হামেশাই সহিংসতা চর্চা করে, যার মধুর রূপ আমরা নিত্যদিন দেখতে দেখতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি – তারা তাঁকে সমর্থনই করবে। এটা আগামি নির্বাচনের জন্য, যখন শেখ হাসিনা সেই পুরষ্কার বিনেপিকে দিতে মনস্থ করবেন – সেই দিনগুলোর জন্য ইতিবাচক হবে বলে আশা পোষণ করা যায়। এতে কোন দোষ নাই। সরকারের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার কঠোর কিম্বা নরম হুমকি, কিম্বা শেখ হাসিনার কাছে দাবি বা অনুনয় বিনয় কিছুই কোন ফল দেয়নি। ক্ষমতাসীনরা একচুলও নড়ে নি ঠিকই, কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতিনৈতিকতার দিক থেকে শেখ হাসিনার হার হয়েছে। এটা পরিষ্কার।

এতে অবশ্য শেখ হসিনার কিছুই আসবে যাবে না। তিনি লজ্জা হারিয়েছেন বহু আগে। ক্ষমতাকে তিনি প্রতিহিংসা, হিংস্রতা , সংবিধান কিম্বা আইন বহির্ভূত কাঁচা ও বিশুদ্ধ ক্ষমতা হিসাবেই চিনেছেন। ক্ষমতা কী জিনিস সেটা তিনি সকলকে বুঝিয়ে দিতেও যারপরনাই উদ্গ্রীব। ক্ষমতার বিচারে তাঁর নিখাদ জয় হয়েছে, কিন্তু নৈতিকতা কিম্বা গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিচারে তিনি নিন্দিত হবেন। না, শুধু এখন নয়। সবসময়ই।

তবে খালেদা জিয়ার জন্য ট্রাজেডির দিকটা অন্যত্র। ক্ষমতা আর সুশীল নৈতিকতা সমার্থক নয়। যদি হোত তাহলে হারমোনিয়ামে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে গেয়েই একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যেত। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হোত না এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ শহিদ হবারও প্রয়োজন হোত না। বাংলাদেশ এখন যেখানে আছে সেই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র শক্তির বাইরে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকাশ ছাড়া বিএনপির সামনে কোন গত্যন্তর নাই। তার জন্য প্রথমেই দরকার একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক আদর্শ। কী চায় বিএনপি আসলে?

প্রশ্ন জাগে খালেদা জিয়া এতো দুর্বল হবার পরেও শেখ হাসিনার এতো ভীত-সন্ত্রস্ত হবার কারন কি? কারন, খালেদা জিয়ার ডাকে তাঁর নিজের কর্মি ও সাধারণ মানুষ সাড়া দিয়ে ফেলতে পারে আর সেই সাড়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট – এই সত্য শেখ হাসিনা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। কিন্তু ট্রাজেডি হোল খালেদা জিয়া সেটা অনুমান করতে পারেন, কিন্তু কার্যকর করতে পারছেন না। কারন কি? প্রবল মত হচ্ছে এটা তাঁর সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য। যারা তা মনে করেন আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। আমরা মনে করি এটা মোটেও সত্য নয়। আসলে জনগণ তাদের ডাকেই সাড়া দেয় যারা জনগণের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। জনগণের আশা আখাংখা, প্রত্যাশা ও চাওয়া পাওয়ার ডাকে সাড়া দিতে পারা ক্ষমতার অর্জনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা দানা বাঁধে।

খালেদা জিয়া সাত দফা দাবি দিয়েছেন, এটা তাঁর দলের দাবি। দলীয় স্বার্থের দাবি। এর সঙ্গে জনগণ কী চায় সেই দাবি এখনও যুক্ত হয় নি। যুক্ত না হলে, শেখ হাসিনার পতন জনগণ কামনা করবে ঠিকই, কিন্তু পতনের আন্দোলনে বিএনপির পতাকার তলে এসে জীবন দেবে কি? সেই আশা দুরাশা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কিছু ভাবা কষ্টকল্পনা মাত্র।

খালেদা জিয়ার অবরোধ কর্মসূচী সুচিন্তিত নয়, বরং আকস্মিক। শেখ হাসিনা নির্বাচন দেবেন সেই আশায় তাঁর সাত দফা দাবিকে সময়োচিত করতে হলে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নীতি ও কর্মসূচিও তাঁকে দিতে হবে। বিএনপি রাজনীতির সীমিত পরিমণ্ডলে যে সংস্কার করতে পারে নিদেন পক্ষে সেটা বলা ছাড়া বিএনপির পক্ষে সামনে যাওয়া কঠিন।

গুলশান কার্যালয় বাইরে থেকে ক্ষমতাসীনরা তালা বন্ধ করে দেওয়ায় খালেদা জিয়ার নৈতিক জয় ও শেখ হাসিনার পরাজয় বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত কোন পরিবর্তন ঘটাবে মনে হয় না। এতে বিএনপির দারুন উপকার হয়েছে। দুর্বলকেও শক্তিশালী মনে হচ্ছে। এখন ভেতর থেকে বিএনপি তাদের দ্বার জনগণের আশা আখাংখা শোনার জন্য খুলতে সক্ষম হয় কিনা সেই দিকেই আমাদের নজর নিবদ্ধ রাখা ইচিত।

নাগরিকদের দিক থেকে নগদ লাভ কি? আইন অথবা ও নৈতিক বিচারের দিক থেকে, ক্ষমতা জিনিষটা দেখবার, বুঝবার ও জেনে রাখার দরকার আছে। ক্ষমতা জিনিষটা স্রেফ বোঝাবুঝি নিয়ে বসে থাকার ব্যাপার না। ক্ষমতায় থাকা অথবা ক্ষমতা দখল কোনটাই চায়ের কাপ নয়। ক্ষমতা গঠন কিম্বা ক্ষমতা রক্ষা করার মুহূর্তগুলো যখন হাজির হয় তখন ক্ষমতাকে ঘিরে থাকা আইন ও নৈতিক বিবেচনার বিষয়গুলো খসে পড়ে। যেমন বিএনপির নেতাদের নেড়িকুত্তার মত রাস্তায় পিটাব, ৫ তারিখে ঢাকায় থাকবে কেবল আওয়ামি লীগ আর কাউকে নামতে দেয়া হবে না অথবা ইট বালির ট্রাকের প্রবেশপথ অবরোধ, পিপার স্প্রে ছিটানো, পুলিশের পাশাপাশি দলীয় কর্মিদের হাতে অস্ত্র হেলমেট কিংবা পুলিশের পোষাক গায়ে রাস্তায় নামানো ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা তার আসল চেহার দেখিয়ে দেয়। এটা ভাল। যতোই তা ঘটবে ক্ষমতার গূঢ়ার্থ ভঞ্জন করে নাগরিকরা ক্ষমতা কী জিনিস তা নিজেরাই বুঝতে পারবেন। যতই গূঢ়ার্থের ন্যাংটা প্রকাশ নির্লজ্জ ভাবে ঘটানো হবে ততই ক্ষমতা জিনিষটার পক্ষে আইনী ও নৈতিক ব্যাখ্যা বা বয়ান তৈরির দিকটা দুর্বল হয়ে যাবে। টক শোতে, মুখোমুখি টেবিলে বসে কিংরা আদালতের কাঠগড়ায় যুক্তিতে কি মিডিয়ায় লিখে এর পক্ষে ন্যায্যতার বয়ান দেয়া ততই কঠিন হয়ে যাবে। ফলে সেক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রসঙ্গ যে চাতুরিতেই হোক পাশ কাটিয়ে যাবার রাস্তা কঠিন হয়ে পড়বে। এইসব সহজে বুঝতে পারাই নাগরিকদের জন্য নগদ লাভের কারন হয়েছে। যারা বাস্তবিক ভাবে ফ্যাসিবাদের মোকাবেলা করতে চায় তাদের আগাম প্রস্তুতির জন্য জনগণের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। ক্ষমতাকে ক্ষমতা দিয়েই মোকাবিলা করতে হয় – এই সহজ সত্য জনগণ উপলব্ধি করতে পারবে সহজে।

তো গতদুদিনে বয়ান, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রতত্ত্ব, কিম্বা স্রেফ সহানুভুতির দিক থেকে খালেদার জয় হয়েছে অবশ্যই। তিনি কিছু করতে পারেন নাই বটে, কিন্তু হাসিনাকে ক্ষমতার গূঢ় সত্য আরেকবার নির্লজ্জ ভাবে দেখাতে বাধ্য করেছেন। এই দেখানোর ফলে হাসিনার ক্ষমতা একচুলও নড়ে নাই ঠিকই কিন্তু নৈতিক দিক থেকে তিনি আরেকবার হারলেন।

বিএনপি বুঝুক বা না বুঝুক গণক্ষমতাই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, নির্বাচনী সাত দফা না -- পাঁচই জানুয়ারিতে জনগণের শিক্ষা এখানেই। ফলে জনগণকে সংঘাতের ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। জনগণের জন্য নগদ লাভ এটাই।

 

সম্ভবত খালেদা জিয়ার জন্যও।

৮ জানুয়ারি ২০১৫। ২৫ পৌষ ১৪২১। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।