অধঃপতন নাকি উল্লম্ফন?

দুই হাজার পনেরো সালের জানুয়ারির ৫ তারিখ বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ কারন এই দিনে দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা সমাজের নানান স্তরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত মীমাংসার অতীত রাজনৈতিক বিরোধের রূপ নিয়ে ক্রমে ক্রমে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের অতীতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের তুলনায় এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নতুন। এর মীমাংসা সহজ নয়।
একদিক থেকে একে বাংলাদেশের গভীর গহ্বরে পতন হিসাবে বিবেচনা করা যায়, অন্যদিক থেকে, গর্ত যতো গভীরই হোক উল্লম্ফনের পথটিও ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টির প্রতিভা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারে যদি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার অভিজ্ঞতা দিয়ে এই গর্ত কিভাবে আমরা একাত্তরের পর থেকে নিজেরাই খনন করে চলেছি বুঝতে পারি । আমরা আত্মহননের পথ বেছে নেবো, নাকি ঘুরে দাঁড়াবো সেটা আমাদের সামষ্টিক না হোক সংখ্যাগরিষ্ঠের সংকল্পের ওপর নির্ভর করে। গহ্বর আমরা পেরিয়ে যেতে চাই, সেটা পারব বলেই বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের জনগণের হিম্মত ও দূরদৃষ্টি দুটোই আছে। আমি তাঁদের ওপর ভরসা করি।
দুই হাজার ৫ সালে ক্ষমতাসীন পক্ষ ৫ জানুয়ারি তারিখটিকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসাবে আর ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রতিপক্ষ একই দিন গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসাবে পালন করতে চেয়েছিল। রাজনীতির দিক থেকে এটা কোন সমস্যা নয়। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঐক্যমত্য পোষণ উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বাধ্যবাধক কিছু নয়। একটি দিনকে দুই পক্ষ দুই ভাবে পালন করতেই পারে। প্রতিপক্ষের মূল্যায়ন ক্ষমতাসীনদের মেনে নিতে হবে এমনও কোন কথা নাই। বিরোধী দলের দাবি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত হয়ে উঠবে তারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কোন আইন রীতিনীতি না মেনে বিরোধী পক্ষকে দমন, পীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। সেখানেই তারা ক্ষান্ত থাকে নি, তারা খালেদা জিয়াকে তাঁর কার্যালয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে অবরুদ্ধ করে রাখে, যাতে তিনি ৫ই জানুয়ারিতে বেরুতে এবং তাঁর ঘোষিত কর্মসূচিতে যোগদান করতে না পারেন। এরপর অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচি শুরু হয়। দেশ ক্রমশ রক্তপাত, গুমখুন ও ভয়াবহ দমন পীড়নের মধ্যে পতিত হয়। এর মধ্যেই আরাফাত রহমান কোকো অকালে মারা যান। কিন্তু তাঁকে সেনাবাহিনীর পরিবারের জন্য বরাদ্দ গোরস্থানে দাফনের অনুমতি দেওয়া হয় নি। এরপর বিশ দলীয় জোটের নেতা এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বিদ্যুৎ, টেলিফোন সংযোগ ও ইন্টারনেটের সংযোগ ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
এগারো তারিখে দেখলাম এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। গুলশান কার্যালয়ের মধ্যে কার্যত অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া এবং তাঁর নিরাপত্তা ও অন্যান্য কর্তব্যে নিয়োজিত ব্যাক্তিদের জন্য রাতের খাবার যেতে দিল না পুলিশ। একটি পোর্টালে দেখলাম খালেদা জিয়াসহ সকলেই একটি রাত অভূক্ত কাটিয়েছেন।
সংঘাত ও সংঘর্ষে অবরোধের ৩৮ দিনে নিহত হয়েছে ৮৭ জন। এদের মধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছে ১৯ জন। এই সংখ্যা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে টুকেছি। এর বাইরে আসলে কতোজন মরেছে, পঙ্গু হয়েছে, গুম হয়ে গিয়েছে ইত্যাদির সঠিক হিসাব নাই। সংঘর্ষ, হত্যা, গুমখুন ও ক্রসফায়ার চলছে। কিভাবে এই রক্তপাত ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন হবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই শহরের অভিজাত শ্রেণি আবার সংলাপের কথা বলা শুরু করেছে। রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘাতের গোড়ায় না গিয়ে কিম্বা তাকে সমাজের মুখ্য তর্ক হিসাবে আমলে না নিয়ে যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে শুধু দুই নেত্রীর পরস্পরের সঙ্গে কথা না বলার সমস্যা হিসাবে দেখেন তাদের চিন্তার দৈন্যতা নিয়ে আমি বহুবারই লিখেছি। সম্প্রতি আবারও লিখেছি (দেখুন, ‘শিষ্টাচারের নসিহত: বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও’)। তারপরও সংলাপের জন্য দুই পক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টির মধ্যে কোন দোষ নাই।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ডক্টর বদরুদ্দোজা চৌধুরি বলেছেন সংলাপ না হলে দেশে ‘গৃহযুদ্ধ’ হবে। তিনি সম্ভবত আমলে নেন নি যে আমরা এখন কার্যত গৃহযুদ্ধের মধ্যেই আছি। সমাজের এক অংশ যখন আরেক অংশের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-বিরোধকে কোন মতাদর্শিক, সাংবিধানিক, আইনী কিম্বা সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নীতি নৈতিকতার মানদণ্ডের মধ্যে থেকে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়, তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিই তৈরি হয়। আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে আমরা কি আদৌ একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি? নাকি দুইটি? যদি বিভাজন ও বিভক্তির সমাধান করতে আমরা ব্যর্থ হই -- অর্থাৎ বিরোধ, মতদ্বৈততা ও ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অপরকে একই সমাজের সদস্য ও একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে মেনে নেবার রাজনৈতিকতা আমাদের না থাকে তাহলে আমরা মানতে বাধ্য যে বাংলাদেশে একটি নয় দুটো রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি বাস করে – বল প্রয়োগই এই ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান। জোর যার মুল্লুক তার।
যদি তা না হয়, তাহলে আমাদের খোলা মনে তর্ক করতে হবে সমাজের রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিভাজনের গোড়ার জায়গাগুলো কোথায়? কী সেই বিরোধ? এবং কেন একই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও অপরের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা মানি না। নীতি বলি, অধিকার বলি, আইন বলি কিম্বা সংবিধান বলি কেন আমরা এমন কোন বিধান তৈরি করতে অক্ষম যা মেনে চলতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকি এবং থাকবার দায় বোধ করি। কেন সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ আছে বলে জাতীয় সংসদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনে আমরা নাগরিকদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিমেষে হরণ করি। কেন?
এইসব বিষয় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাববার মতো কাণ্ডজ্ঞানও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আধুনিক রাষ্ট্রে যখনই বিরোধী পক্ষের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রাষ্ট্র অস্বীকার করে, তখন রাজনৈতিক সংকটের চরিত্র ভিন্ন মাত্রা পরিগ্রহণ করে। রাষ্ট্র যখন প্রতিপক্ষকে গুম, গুমখুন এবং নির্বিচারে আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা করবার আনন্দে ট্রিগার হ্যাপি হয়ে ওঠে তখনই আমাদের বুঝতে হবে সমাজের বিভাজন ও বিরোধের ক্ষত সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে যাকে কোন আইন, নিয়ম বা নিয়তমতান্ত্রিকতার অধীনে আনা সহজ নয়। রাষ্ট্রের সকল বলপ্রয়োগের ক্ষমতা ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা যখন প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চায়, তখন বুঝতে হবে এটা বুমেরাং হয়ে উঠতে বাধ্য, কারণ তার নির্দিষ্ট চক্রাবর্ত অতিক্রম করে খড়গের আঘাতের মতো তা নিক্ষেপকারির প্রতিই আবার তেড়ে আসে। কারন নিজেকে রক্ষা করবার জন্য প্রতিপক্ষও নিশ্চয়ই বসে থাকে না। পাল্টা আঘাত হানার শক্তি ও ক্ষমতার ওপর তার টিকে থাকা – অর্থাৎ নির্মূল না হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নির্ভর করে। আমরা সেই জায়গায় কি অনেক আগেই পৌঁছাই নি। শহরের অভিজাত শ্রেণির সুশীল পরিমণ্ডল এড়িয়ে আমরা কি পৌঁছাই নি সেই খাদের কিনারে যার পরবর্তী পদক্ষেপে আমাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। যাই নি কি? নিশ্চয়ই গিয়েছি। একেই তো কার্যত ‘গৃহযুদ্ধ’ বলে।
দুই
‘গাণিতিক নয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে’ একটি দৈনিক পত্রিকার এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই আমার যুক্তির সারকথা বিচক্ষণ নাগরিকরা বুঝবেন আশা করি। পত্রিকাটি বলছে, ‘প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কেউ শিকার হচ্ছেন ক্রসফায়ারের, বেশির ভাগই রাজনৈতিক কর্মী'। এই বাক্যটিই একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকদের সম্পর্কের চরিত্র নির্দেশ করে। অর্থাৎ নির্মূল অপারেশান চলছে। কারা মরছে? ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখের খবর হচ্ছে সেদিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনজন। রাজশাহীতে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের তথ্যবিষয়ক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন (২৪) নিহত হয়েছেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিহত হয়েছেন উপজেলা শিবিরের সভাপতি সাহাব পাটোয়ারী (২৪)। আর যশোরে নিহত হয়েছেন শহীদুল ইসলাম। শহিদুল জামায়াতে ইসলামির কর্মী। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত এক ডজন মানুষ। এর মধ্যে সরাসরি ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৮ জন। বাকি চার জনের মধ্যে দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর দু’জন পুলিশের গাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ। যদিও তাদের পরিবারের দাবি আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের। (দেখুন, ‘ক্রসফায়ার’ মানবজমিন ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।
বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করবার জন্য তাদের 'সন্ত্রাসী' উপাধি দিতেই হবে। প্রতিপক্ষকে দানবে পরিণত করা এবং গণমাধ্যমসহ সমাজের দৃশ্যমান ডিস্কোর্স থেকে এদের নাম বাদ রাখা ও মুছে ফেলা একটি সজ্ঞান নীতি। নিষ্ঠুর ভাবে তাদের হত্যার সংবাদ আড়াল করা ও আলোচনার বাইরে রাখা ক্ষমতাসীনদের যুদ্ধ নীতি। এরা কেউই শুধু সংখ্যা নয়, রক্তমাংসের স্বাভাবিক মানুষ। অনেকে মেধাবি ছাত্র, কিম্বা সামাজিক ক্ষেত্রে সফল একজন নাগরিক। তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসই তাকে হত্যার কারন। সেই বিশ্বাস ও মতাদর্শের বিরোধিতা সমাজের মতাদর্শিক তর্কবিতর্কের মধ্যেই মীমাংসা করতে হবে -- এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান অনুমান। যদি বিদ্যমান আইনে সে অপরাধ করে থাকে তাহলে তাকে আইনের অধীনে এনে তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারে রাষ্ট্র। কিন্তু র্যাপ, পুলিশ বিজিবি লেলিয়ে হত্যা করতে পারে না। এই নীতি ও আইনী পরিমণ্ডল যে সমাজে গড়ে ওঠেনি সেখানে তথাকথিত 'সংলাপ' তামাশার অধিক কিছু না।
বিএনপি দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা এবং বিদেশি কূটনৈতিক মহলের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে ১৮ হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে আর মামলায় আসামি হয়েছেন প্রায় ৭ লাখের অধিক নেতাকর্মী।
গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে দমনপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের চরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কথিত ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ট্রাকের নিচে ফেলে যেমন হত্যা করা হচ্ছে তেমনি পুলিশি হেফাজতে নেতাকর্মীদের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার খবরও পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধে গত ৫ই জানুয়ারি থেকে (৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। এর বাইরে চলতি মাসে আরও অন্তত ১০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। (দেখুন, মানব জমিন ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। প্রথম আলোর ১২ তারিখের খবর অনুযায়ী ৩৮ দিনে ১৯ জনকে ক্রস ফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। ক্রস ফায়ার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি মাত্র ধরণ। পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্ভূক্ত।
সংখ্যার হেরফের বা হিসাব রক্তমাংসের মানুষকে বিমূর্ত গণিতে পর্যবসিত করে। অনেক নামই পত্রিকার সুবাদে এখন আমাদের জানা। যেমন, নাটেরের তেবাড়িয়ার রাকিব মুন্সি (বিবিএ সন্মান), রায়হান আলী (ছাত্রদল), রাজশাহীর মহানগরের আইনুর রহমান মুক্ত (বিএনপি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহাবুদ্দিন (ছাত্রশিবির), বানেশ্বরের মজিরউদ্দীন (বিএনপি), গোদাগাড়ীর মো. এসলাম (যুবদল), বিনোদপুরের নুরুল ইসলাম শাহিন (কলেজ শিক্ষক), চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের জমসেদ আলী (বিএনপি), নবাবগঞ্জের আসাদুল্লাহ তুহিন (ছাত্রশিবির), শিবগঞ্জের মতিউর রহমান (ছাত্রদল), নোয়াখালীর চৌমুহনীর মিজানুর রহমান (যুবদল), মহসিন উদ্দিন (ছাত্রদল), বেগমগঞ্জের মো. সোহেল (যুবদল), সোনাইমুড়ির মোরশেদ আলম পারভেজ (ছাত্রদল), চুয়াডাঙ্গার শঙ্করচন্দ্রপুরের সিরাজুল ইসলাম (বিএনপি)। নড়াইলের স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস, ঢাকার খিলগাঁওয়ের নুরুজ্জামান জনি, ঢাকা কলেজের এমদাদ উল্লাহ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা ক্যাম্পাসের ছাত্র আরিফুল ইসলাম মুকুল, মাতুয়াইলের সাখাওয়াত হোসেন রাহাত, মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ, ভাষানটেকের আল আমীন, আগারগাঁওয়ের জসিমউদ্দিন, সদর উপজেলার সোলাইমান উদ্দিন, চট্টগ্রামের লোহাগড়ার সাকিবুল ইসলাম , রাঙ্গুনিয়ার জিল্লুর রহমান ভান্ডারী, ভোলা সদরের আবুল কালাম, ঝিনাইদহের শৈলকুপার সুলতান আলী বিশ্বাস, চরফ্যাশনের হারুন অর রশীদ, সাতক্ষীরার তালা’র রফিকুল ইসলাম, রামনগরের শহীদুল ইসলাম, ময়মনসিংহের নান্দাইলের আসিফ পারভেজ টুকুন, যশোরের চৌগাছার আবদুস সামাদ মোল্লা, মনিরামপুরের মো. ইউসুফ, দুর্গাপুরের মো. লিটন, সদরের রাজু, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সাইদুল ইসলাম , কুমিল্লা সদর দক্ষিণের স্বপন, চৌদ্দগ্রামে সাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী, পিরোজপুরের বাচ্চু মিয়া, প্রমুখ। নামগুলো আমি উল্লেখ করছি কারন এরা স্রেফ সংখ্যা নয়। এরা রক্ত মাংসের মানুষ। যাদের অধিকাংশকেই টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে, কারন তারা রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ।
ঠিক একই ভাবে পেট্রল বোমায় দগ্ধ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকেও সংখ্যা নয়, তারাও রক্ত মাংসের মানুষ, নাম দিয়েই তাদের মনে রাখতে হবে। আগুনে যাদের চামড়া পোড়ে এবং মাংস দগ্ধ হয়, তারা আর যাই হোক সংখ্যা মাত্র নয়। দুই পক্ষের বিরোধের শিকার বলে তাদের প্রতি সহানুভূতি সঙ্গত কারনেই আমাদের বেশী। সরকার দাবি করছে পেট্রল বোমা মারছে বিশ দলীয় জোটের কর্মীরা। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামিও বানানো হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি খবরে দেখা গেছে ছাত্র লীগ, যুব লীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও বোমা বানাবার সময়, কিম্বা বোমা হাতে ধরা পড়েছে। পুলিশ অনেককে ধরবার পর ছেড়েও দিয়েছে। বিরোধী জোট বারবারই বলেছে এই ধরনের হীন ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। ক্ষমতাসীনরাই বিরোধী দলের আন্দোলন নস্যাৎ করবার জন্য এইসব ঘটিয়ে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। জবরদস্তি ক্ষমতায় থাকতে চাইলে মানুষ পোড়ানোর দায় বিরোধী দলের ওপরই চাপিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এ নিয়ে কোন নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ হচ্ছে না। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে তার সুযোগও অতিশয় ক্ষীণ।
আমার আশংকা, আমরা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। যারা ক্ষমতায় আছে তারা আমার কথা বুঝবেন আশা করি না। কিন্তু বিরোধী দল যদি আমার কথা বুঝে থাকেন, তাহলে এটা ভেবে নেওয়া উচিত নয় যে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ তাঁদের রাজনীতির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন । না, মোটেও তা নয়। ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে বদ্ধ পরিকর। যা অবাস্তব ও অসম্ভব। আর তা করতে গিয়ে তারা খোদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলেছে। একটা গভীর গহ্বর বা খাদের কিনারায় এসে আমরা দাঁড়িয়েছি।
অধঃপতন নাকি উল্লম্ফন – ৫ই জানুয়ারির পরবর্তী পরিস্থিতি আমাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ৩ মাঘ ১৪২১। শ্যামলী।