গুম, সালাহ উদ্দিন ও  দিল্লির দায়


গত পাঁচদিন ধরে বিএনপির মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন আহমেদকে কেন্দ্র করে  তিনটা শব্দ মিডিয়া ছেয়ে রেখেছে – মেঘালয়, সালাহউদ্দিন আর খোঁজ। যারা সালাহ উদ্দিনকে গুম বা ‘নিখোঁজ’ করে রেখেছিলেন বলা বাহুল্য তারাই এ’বিষয়টায় সবচেয়ে ভাল জানেন ও বলতে পারবেন। ফলে তারাই তো সবার উপরে সালাহ উদ্দিনের খোঁজ প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য সোর্স। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে তাঁরা সেটা চাচ্ছেন না। বলাই বাহুল্য তাদের পক্ষে সোর্স হবার মত পরিস্থিতি নাই, হওয়াটা নতুন বিপদেরও। অথচ সালাহ উদ্দিনের যে “খোঁজ পাওয়া গেছে” এটা তারা রাষ্ট্র করতে চান, করা দরকার বোধ করছেন। তাই আমরা লক্ষ্য করলাম ‘‘খোঁজ’ পাবার পর’ প্রথম দুদিন সালাহ উদ্দিন সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পাওয়া গিয়েছে এর স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের সোর্স হয়ে হাজির হয়েছিলেন শিলং টাইমসের সম্পাদক মানস চৌধুরী। সম্ভবত তিনি সফল এবং অযাচিতভাবে কোন পক্ষের দায় নিতে তিনি যান নাই।

‘খোঁজ পাবার’ খবরটা মিডিয়ার ভাষায় বললে বলতে হয়, ‘চাঞ্চল্যকর’। এটা পপুলার পাঠের দিকে তাকিয়ে বলা। মূলত “সরকারি দায়দায়িত্বের” দিক থেকে এটা খুবই বিপজ্জনক একটা খবর ও ফেনোমেনা – বিপদ নানান দিক থেকেই -- ঘটনা হিসাবে, লক্ষণ হিসাবেও। যারা এর সাথে জড়িত তাদের জন্য তো বটেই। সরকারি পদাধিকারী, যারা হুকুম বা নির্দেশদাতা এবং যারা বাস্তবায়ন কর্তা উভয়েই এবং এছাড়া যারা তথ্য জানতেন তাদের সবার জন্য এ ঘটনা খুবই বিপদের। যে যত উপরের কর্তা ও পদবির তাঁর উপর এর দায় ততোটাই মারাত্মক। আসলে কী ঘটেছিল তা প্রকাশিত হয়ে পড়া পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুতি, ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত হয়ে যাওয়া, সাজা হয়ে যাওয়া, ইমেজ কি হবে ইত্যাদির দিকগুলো চিন্তা করলেই আমরা বিপদের মাত্রা বুঝতে পারব। আমাদের মত দেশে ও দুনিয়ায় এমন অনেক উদাহরণ আছে, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা যেমন। সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়ার কথা অনেকের মনে থাকার কথা। বাংলাদেশও এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে জাতীয় জীবনের অভিজ্ঞতা এমন যে এপর্যন্ত এখানকার প্রতিটা জাতীয় গুরুত্বপুর্ণ ঘটনায় আসলে কি ঘটেছিল তা শেষেমেষে কখনই অপ্রকাশিত থাকে নি। ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।

এই ঘটনায় মজার দিকটা হল সংশ্লিষ্ট পক্ষ অনেকানেক, শুধু তাই না প্রত্যেকটা স্বার্থই অন্যটার চেয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা। এখানে এমন স্বার্থগুলোর কয়েকটার চাওয়া-পাওয়ার দিকটা নিয়ে আলাপ করব।

সরকার ও বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত ১০ মার্চ সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ হবার দিন থেকে থানায় মামলা নেয়াকে কেন্দ্র করে থানা এবং পরে আদালতে বিচারক মোকাবিলা এবং প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নিজে যেচে এসে ব্যাখ্যা বয়ান দিতে যাওয়া ইত্যাদি দিকগুলো দেখলে মনে হয় ক্ষমতাসীনরা এই ইস্যুটাকে শক্তহাতে মোকাবিলা করতে চান। এতটুকুই হাবভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সরকারি দায়দায়িত্ব নিয়ে আন্তরিকতায় জনগণকে আশ্বস্ত করা, আসলে ঘটনাটা কি ঘটেছে তা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে নিজেকে হাজির করে বলার দিক থেকে সরকারের অর্জন শূন্য। এই অবস্থায় ঠিক দুমাস পর খোঁজ পাবার দিনে দুএকটা মিডিয়ায় –“সালাহ উদ্দিন নিজেই নিখোজ হয়ে ছিলেন, নিজেই মেঘালয়ে এসেছেন” – গোয়েন্দা সুত্রে প্রাপ্ত খবর বলে বরাত দিয়ে এমন নিউজ করিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝা যাচ্ছে সরকারের পালটা বয়ান এভাবে হাজির করে রাখা হল। কিন্তু এই গল্প এতই দুর্বল এবং বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের বিশ্বাসযোগ্যত্র মাত্রাও এতো নীচু যে কোন আদালতেই এমন ষ্টেটমেন্ট কোন কাজে আসবে না, তা বলা বাহুল্য। কারণ সরকার “সালাহ উদ্দিনকে গুম বা অপহরণ করে রাখে নাই” এর পক্ষে সরকারের সাফাই শুনার চেয়ে জনগণ শুনতে চায় নিশ্চিত হতে চায় যে সালাহউদ্দিন কে কেউ অপহরণ করতে পারবে না। সালাহ উদ্দিন সেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও প্রতিশ্রুতির বেষ্টনিতে নিরাপদ আছে। তাতে সালাহউদ্দিনের নামে আবার আদালতে অমীমাংসিত কোন মামলা থাকুক অথবা কোন মামলাই না থাকুক।  

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী  দৃষ্টিকটুভাবে দুটা তথ্যের উপর জোর দিচ্ছেন দেখা গেছে। প্রথম তথ্য - “এতে প্রমাণিত হল যে আমরা সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতার করি নাই” - আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন ষ্টেটমেন্টের উপর জোর দিচ্ছেন। যদিও সালাহ উদ্দিনকে মেঘালয়ে খুঁজে পাওয়ার গেছে এই প্রাথমিক তথ্য নিজে - আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতার করে নাই অথবা করে ছিল - এমন কোন তথ্যকেই এই পর্যায়ে নাকচ করে না। দ্বিতীয় তথ্য – এখন সরকার সালাহ উদ্দিনকে কিভাবে ফেরত আসতে সাহায্য করবেন বা তিনি আসতে পারেন সেটা নয় বরং খুবই জোর দিয়ে জনগণকে সাজেশন ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে ভারতের আইনি প্রক্রিয়ার কারণে সালাহ উদ্দিন এখন দীর্ঘ এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের জেলে পচবেন – এটা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই নিশ্চিত এবং আশ্বস্ত। নিজেদেরকে এভাবে উপস্থাপনের ভিতর দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদেরকে দায়শূন্য জ্ঞান করছে। বরং সালাহ উদ্দিনকে আগে ভারত থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে সাহায্য এবং তারপর আদালতে মামলা চালানোর কঠোরতা দেখালে জনগণ তাদের হয়ত মেনে নিত, বিশ্বাস করত।

সালাহ উদ্দিনের খোজ পাওয়াতে এবং বিশেষত ভারতের “মেঘালয়ে তাঁর খোঁজ পাওয়াতে” এই ঘটনাটা আর এক মারাত্মক দিকে মোড় নিয়েছে। সাদামাটা ভাবে বললে নিখোঁজ ঘটনাটা আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। মানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনকানুন তো বটেই এখন এর বাইরে ভারত রাষ্ট্রও জড়িত হয়ে পড়ল। সালাহ উদ্দিন ভারতের মেঘালয়ে হাজির হলেন কি করে, কেন কিভাবে – এজাতীয় সকল সম্ভাব্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে মূলত ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতা এবং সংশ্লিষ্টতার স্তর এবং মাত্রাকে কেন্দ্র করে।

আগেই বলেছি সালাহ উদ্দিনের নিখোজের ব্যাপারটা “রাষ্ট্র ও সরকারি দায়দায়িত্বের” দিক থেকে খুবই বিপজ্জনক একটা খবর ও ফেনোমেনা। এছাড়া সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ একটা হাই প্রফাইল রাজনৈতিক ঘটনা। এটা নারায়ণগঞ্জ সাতখুন ঘটনার নূর হোসেনের কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার মত সহজ ঘটনা নয়। কারণ নূর হোসেন ভিসা পাসপোর্টে নিজেই কলকাতায় হাজির হয়েছিলেন। তুলনায় সালাহ উদ্দিন দাবি করছেন, তাকে “অপহরণ” করে কেউ শুধু দুমাস বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও তৎপরতা চালিয়ে অপহৃত অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় ভুখণ্ডেও সালাহ উদ্দিনের উপর একটা বড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই অপহরণ রাজনৈতিক অপহরণের অভিযোগ এবং ঘটনা। এখানে রাজনৈতিক শব্দের অর্থ ক্ষমতা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন এর তুলনায় রাজনৈতিক ঘটনাই নয়। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের সাথে জড়িত এই ঘটনা। এই অর্থে রাজনৈতিক। আন্তর্জাতিক আইন কানুনে গুম, অপহরণ খুবই নিন্দিত অপরাধ বলে চিহ্নিত, বিশেষত রাজনৈতিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রে। ফলে সেনসেটিভও।

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে ভারত কোন পক্ষ নয় এটা পরিষ্কার রাখা এবং এ ধরনের কোন ইঙ্গিত যেন কোনভাবেই ফুটে না ওঠে সেই দিকে মোদি সরকারের দৃষ্টি দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনত তো নয়ই এমনকি কূটনৈতিকভাবেও  তা হবার কোন সুযোগ রাখা বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে। বিশেষত বাংলাদেশের কোন পক্ষের ক্ষমতা পেতে বা রাখতে গিয়ে কোন খুনাখুনি, গুম বা অপহরণের সাথে ভারতের  ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা ছিল -- ভারত বাংলাদেশের  ক্ষমতাসীন সরকারকে চরম অবৈধ এবং ক্রিমিনাল আচরণ করতে সাহায্য করেছে --  এমন ধারণা ঘূণাক্ষরে তৈরি হলেও বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের দিক থেকে সেটা খুবই বাজে একটি চিহ্ন হয়ে থাকবে। আজকের জন্য যেমন,  আগামি দিনের জন্যও। এই ধরণের দাগ পড়ে গেলে সেই  কলংক মোচন দিল্লীর জন্য কঠিন হবে। এক রাষ্ট্রের ভিতর অপর রাষ্ট্রের স্বার্থ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নির্বাহী নিজ রাষ্ট্রকে কোন খুনাখুনি গুম বা অপহরণের মত ক্রিমিনাল কাজে জড়িয়ে ফেলতে পারে না। বাংলাদেশে ভারতের বহুবিধ স্বার্থ আছে। কিন্তু সেজন্য ভারত বাংলাদেশের খুনাখুনি গুম, বা অপহরণের রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িত করতে পারে বা জড়িত করেছে এই ভাবমূর্তি একবার দানা বাঁধলে কূটনৈতিক ভাবে ভারত গভীর কলংকের গর্তে পতিত হবে। মোদি এই ঝুঁকি নেবেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন।

এসব দিক বিবেচনায় নরেন্দ্র মোদির উচিত হবে যেচে তাঁর নিজের হাত পরিষ্কার করে রাখা। এটা বাংলাদেশ ও ভারতের আজ এবং আগামিদিনের সম্পর্ককে ফাংশনাল ও কার্যকর রাখার দিক থেকে দরকারি। কোন ধরণের কাল ছায়া থেকে মুক্ত রাখার দিক  বিবেচনা করে ন্যূনতম দায় ও কূটনৈতিক দিক থেকে দুরদর্শী চিন্তা ও কাজ করতে হবে মোদীকে।

সালাহউদ্দিনের মেঘালয়ে হাজির হওয়া নেহায়তই এক কাকতলীয় ঘটনা। এটা বাংলাদেশ সরকার কিম্বা সরকারের অজান্তে আইন শৃংখলা করা আইন শৃঙ্ঘখলা বাহিনীকে ক্রিমিনাল কাজ করতে সহায়তা করার ঘটনা নয় মোটেও। এই সত্য নিরপেক্ষভাবে প্রমাণ করে রাখা প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাজ। কিভাবে সালাহ উদ্দিনের ভারত ভুখন্ডে প্রবেশ করলেন অথবা কে তাকে আনল, তিনি কিভাবে আসলেন তা বিশ্বাসযোগ্য কোন কমিশনকে দিয়ে উদ্ঘাটন করে রাখা প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তাঁর সরকার এবং আগামি বহু অজানা সরকারের দিক থেকে হাত পরিস্কার করে রাখার মত একটা কাজ হবে।

সালাহ উদ্দিন কিভাবে মেঘালয়ে হাজির হলেন তা নিয়ে তিনি নিজে যা বলছেন তা এক বর্ণনা মাত্র মনে হচ্ছে। কিন্তু তিনি আসলে যা বলছেন তা কিন্তু ভারত সরকার ও প্রশাসনের কাছে এক নালিশ বা অভিযোগ। অভিযোগটা এই যে ভারত ভুখণ্ডে কোন আইনভঙ্গকারী ভারত সরকারের ক্ষমতা ও এখতিয়ার অবজ্ঞা করে সালাহ উদ্দিনকে নির্যাতন ও অপহরণের মত জঘন্য অপরাধ করেছে। এই অভিযোগ যেহেতু ভারত ভুখন্ডে ঘটেছে বলে সালাহউদ্দিন অভিযোগ করছেন ফলেএই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে স্বাভাবিক চাওয়া হবে তিনি এই অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করবেন ও সকল তথ্য নিরপেক্ষা ভাবে যাচাইয়ে ব্যবস্থা করবেন । প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে তাঁকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫ মে ২০১৫

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।