গোরস্থানে মৃতদের দেশে আছি !
এই লেখাটি যেদিন ছাপা হবে সেইদিন ২৬ তারিখ। আমার মনে হয় না এই দিনটির কোন গুরুত্ব আমাদের কাছে আছে। মনে হয় কবরস্থানে আছি। নিজের নিঃশ্বাসকেও নিঃসাড় মনে হয়। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই দিনটির গুরুত্ব অসামান্য। ব্যবহারিক রাজনীতি ও নৈতিক অবস্থান দুই দিক থেকেই।
২৬ জুন নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস। বিভিন্ন দেশে যাঁরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁদের প্রতি সংহতি জানাবার জন্য প্রতিবছর সারা বিশ্বে এটা পালন করা হয়। শুধু মানবাধিকার সগঠন এই দিনটি পালন করে তা নয়, আদর্শ ও কর্মসূচির কারনে যে সকল রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার হয় তারাও সেটা পালন করে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলগুলোও তাদের ভাবমূর্তি অক্ষূণ্ণ রাখবার জন্য দিবসটি পালন করতে আগ্রহী হয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এই দিনটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাঁরা অত্যাচার নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নিষ্ঠুর ও অমানবিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাঁদের প্রতি প্রতিবছরই সংহতি জানায়। আজ ২৫ তারিখ তারা একটি সভারও আয়োজন করেছে। এই দিন উপলক্ষ্যে অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীরা ২৫ ও ২৬ জুন সারাদেশে নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণ, ভিকটিম ও ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। খুব ভাল হোত যদি সব মানবাধিকার সংগঠন এক সাথে দিনটি পালন করতে পারত।
কোন রাজনৈতিক দল দিনটি পালন করছে কিনা তার কোন খবর পত্রিকায় দেখি নি। আমার ধারণা ছিল বিরোধী দল অন্তত এই ধরনের আন্তর্জাতিক দিবসের সুযোগ নেবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাই প্রধানত সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নর্যাতনের শিকার। কিন্তু তাদের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে এক ধরণের কবরের শান্তি বিরাজ করছে। কোন আওয়াজ নাই, টুঁ শব্দও নাই। দেখা যাক কাল কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা।
দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। বড়সড় ভাবে এই দিনটি উদযাপন করবার কর্মসূচি বিরোধীদল অনায়াসেই নিতে পারত। ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অন্যান্য মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করে। এই ধরণের অবস্থানকে কনভেনশন বলা হয়। তবে আন্তর্জাতিক আইনে এই ধরণের কনভেনশান বিধিবদ্ধ চুক্তি (Treaty) হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। এই ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের নৈতিক শক্তি যেমন প্রবল তেমনি ক্ষেত্র বিশেষে তা আন্তর্জাতিক ভাবে বলবৎযোগ্যও বটে। এই আন্তর্জাতিক বিধান কার্যকর হয় ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন। পাশাপাশি সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবছর ২৬ জুন তারিখটিকে নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। শুরুতে স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশ ৫ অক্টোবর ১৯৯৮ এই চুক্তি স্বীকার করে নিয়েছে। ভারত ১৪ অক্টোবর ১৯৯৭ সালে এই কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেছে, কিন্তু মেনে নেওয়া (Accession) কিম্বা নিজেদের আইন সভায় আইন হিসাবে পাশ করা (ratification) তার কিছুই করে নি। (দেখুন, United Nations Treaty Collection) স্বাক্ষর করার অর্থ হচ্ছে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এই কনভেনশান পাশ করার পক্ষে থাকা, কিন্তু সেটা নিজে মানা এবং তা প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া বিধিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত আলাদা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ‘অধিকার’ ও ‘আইন ও সালিশ নিয়মিতই করে। ‘অধিকার’-এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত অন্তত:পক্ষে ৯১ জন মানুষ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে তাদের নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশী অভিযোগ করেছেন কিম্বা অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণে এই ধরণের অপরাধের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন করে নাগরিকদের মেরে ফেলা ভয়াবহ অপরাধ। নির্যাতন করা এবং নিজেদের হেফাজতে নিয়ে হত্যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপত্তি করার কেউ নাই, কোন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ নাই। আইন শৃংখলা বাহিনীর একটি অংশ হত্যার মেশিন হয়ে উঠছে। ফলে এসবের যারা হোতা বা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
অপরাধ করারা পরেও অনুসন্ধান নাই, অভিযোগ নাই, শাস্তি নাই – এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। বাংলাদেশে যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু রয়েছে। এটা নতুন নয়, স্বল্প সময়ের জন্যও নয়। চালু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের ঘটনা শুধু অব্যাহতই রয়েছে তা নয়, তার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এমনকি হত্যার ধরণেও বদল ঘটেছে। এখন কাউকে ধরে নিয়ে গেলেও আইন শৃংখলা বাহিনী স্বীকার করে না। এই ব্যাপারে কিছু কিছু আইন থাকলেও তার কোন প্রয়োগ নাই। তার ওপর রয়েছে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা। পরিস্থিতি ফলে ভয়ানক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মী হিসাবে এই বিষয়ে কাজ করাও বিপজ্জনক। কারন এ বিষয়ে বাংলাদেশে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। হয়তো অনেকেই মনে করেন আমাকে তো ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নি, কিম্বা আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে না। তাহলে অসুবিধা কি? কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীর কাছে এই ধরণের ঘটনা ঘটনা ঘটানো যখন সাধারন অপারেশান হয়ে দাঁড়ায় – যার জন্য তাদের কাউকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তখন তখন কার ভাগ্যে কখন কী ঘটে বলা মুশকিল।
এই ক্ষেত্রে অনুসন্থানী তদন্ত করাও মুশকিল। কতজন মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। নির্যাতনের ধরণ বা টেকনলজিতেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু নির্যাতন কিভাবে এবং তার ব্যবহার কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে হচ্ছে তারও সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন। যারা একবার নির্যাতীত হয়েছেন, তাঁরা ভয়ে মুখ খুলতে চান না। সমাজের নীরবতা ও শিতলতা তাদের আরও ভীত করে তোলে। অনেকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দুয়ার থেকে জীবিত ফিরে এসেছেন। তাদের ট্রমা কাটিয়ে ওঠাই এক বিশাল সমস্যা, নির্যাতনের বররনা দেওয়া তো দূরের কথা।
মানুষকে নির্যাতন করবার পক্ষে যে যুক্তিগুলো দেওয়া হয় তার এক নম্বর হোল তথ্য বের করা। বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলেন, নির্যাতন করে তথ্য আদায় বা বের করার দাবি ভূয়া। কারণ যারা অপরাধ করে তারা নিজেদের বাঁচাবার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালায়। নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু এই যুক্তি দেওয়া এবং মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করার যারা বিশেষজ্ঞ সমালোচক তারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে আরেকটি যুক্তি দিয়ে থাকেন। সেই যুক্তি আইন শৃওংখলা বাহিনীর পারফরমেন্স বা দক্ষতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আইন শৃংখলা বাহিনী তখনই নির্যাতনের আশ্রয় নেয় যখন তাদের গোয়েন্দামূলক কাজ বা তদন্তে দক্ষতার অভাব থাকে। এই অভাব তারা নির্যাতন করে তথ্য আদায়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে চায়। তাহলে নির্যাতনের ঘটনার বৃদ্ধি মানে আইন শৃংখলা বাহিনীর দক্ষতার অভাব। এই ধরণের আইন শৃংখলা বাহিনী দিয়ে আর যাই হোক অপরাধ প্রতিরোধ বা দমন সম্ভব নয় সেটা অনায়াসেই বলা যায়।
বাংলাদেশে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং তথ্য বা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় এমন একটি চর্চা যা আইন বিরোধী। নিজের বিরুদ্ধে নিজের সাক্ষ্য দেওয়া যে কোন আধুনিক আইনে নিষিদ্ধ। আদালতের কাছেও তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং তার কোন মূল্য নাই। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নির্যাতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রবল। কাউকে ক্রিমিনাইলাজ করতে চাইলে তারা পুলিশের নির্যাতনের ফলে কোন অভিযুক্ত কোন কিছু স্বীকার করলেই সেই স্বীকারোক্তি এমন ভাবে প্রচার করে যাতে অভিযুক্তের বিপক্ষে জনমত তৈরি হয়ে যায়। ন্যায় বিচারের জন্য তা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আদালত বিচার করারা আগেই গ্ণমাধ্যম তাদের বিচার ও রায় দিয়ে দেয়। গণ্মাধ্যমের এই আইন ও ন্যায়বিচার বিরীধী ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্ছার না হলে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার সংখায় বেড়েই চলতে থাকবে। আশা করি গণমাধ্যমের কর্মীরা এই ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।
আন্তর্জাতিক আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং তা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবেনা কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না”। নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষূণ্ণ করেই নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের শিকার না হওয়া অলঙ্ঘনীয় অধিকার। কোন রাষ্ট্র-ই নাগরিকদের সেই অধিকার খর্ব করতে পারে না, হোক তা যুদ্ধাবস্থা, জরুরী অবস্থা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কিংবা অন্য যেকোন বিশেষ পরিস্থিতি।
নির্যাতনের আরও দুটি কারণ হচ্ছে এক. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের শায়েস্তা করা এবং দুই. অবৈধ ভাবে অভিযুক্তদের কাছ থেকে অর্থ উসুল করা। সবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতিসংঘ প্রণীত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। কনভেনশন অনুমোদনকারী প্রতিটি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জাতীয় আইনে নির্যাতনকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করবার কথা। সে অনুযায়ী ২০১৩ এর ২৪ অক্টোবর সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর উত্থাপিত “নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩” জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাশ হয়। কিন্তু তারপর কোন খবর নাই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন এবং নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর ঘটনা অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে।
এই দিনটি নিয়ে আজ লিখবার কারন হচ্ছে দিনটিকে স্মরণ করা। তবে সেটা গৌণ। মূলত বিরোধী দলের নীরবতার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশের তাগিদ বোধ করছি। । এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে তারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে জনমত তৈরি করতে পারত তার কোন উদ্যাগ বা চিন্তা তাদের মধ্যে আদৌ আছে কিনা বোঝা মুশকিল। তারা কি নির্যাতীত হতে ভালবাসে? পুলিশি হেফাজতে নির্যাতীত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে ঠাণ্ডা ও নিষ্ঠুর মৃত্যু আর কী হতে পারে। হাজার হাজার কর্মী কারাগারে তাদের শরীর ও আয়ু ক্ষয় করছে। নির্যাতনে, কেউ মরে গিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে কিম্বা অনুমান করতে পারি উন্মাদও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন খবর নাই।
মনে হয় গোরস্থানে আছি। এই এক মৃতদের দেশ, যেখানে নিঃশ্বাস ফেলছি কিনা নিজের কাছে নিজেরই সন্দেহ হয়।
২৫ জুন ২০১৫.১১ আষাঢ় ১৪২২। শ্যামলী।