আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা


'আপনারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন' --- আদালতকে ডা. জাফরুল্লাহ্‌  চৌধুরী

বাংলাদেশের সংবিধান ঘোষণা করে যে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল' [গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৯ (১)]। প্রশ্ন হচ্ছে, আদালত কি নাগরিকদের এই সাংবিধানিক অধিকার হরণ করতে পারে? উত্তর হচ্ছে, না। যদি তা করে তাহলে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবার কারণে আদালত নিজেই নিজের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ করে ফেলে।

আদালত পুলিশও নয়, মিলিটারিও নয়, কিম্বা নির্বাহী প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দলও নয় – তাহলে ‘আদালতের কর্তৃত্ব’ কথাটার মানে কি? বলপ্রয়োগের কর্তৃত্ব? রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন? শাস্তি দেবার ক্ষমতা? কে তাকে বিচার ও শাস্তি  দেবার ক্ষমতা দিল?

এর উত্তর সোজা: পুলিশী, নির্বাহী বা রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা আদালতের কর্তৃত্ব তৈরি হয় না। এটা বলা যতো সহজ, উপলব্ধি করা ততো সহজ নয়। অথচ এই দিকটি আমাদের সকলের উপলব্ধি করা জরুরী। কিন্তু সবার আগে আদালতকেই এটা উপলব্ধি করতে হবে। আদালতের কর্তৃত্ব সম্পর্কে আদালতের নিজের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে একটি দেশের জন্য এই অস্পষ্টতা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে।

আদালত বিচার করে এবং শাস্তি দেয়। কিন্তু কোথা থেকে আদালত সেই কর্তৃত্ব ভোগ করে। এরও উত্তর সহজ: সংবিধান। সংবিধানই আদালতকে এই কর্তৃত্ব দেয়। আদালত আদালত বলেই কর্তৃত্বের অধিকার নয়। বিচারকরা স্রেফ বিচারক বলে বিচার করবার কর্তৃত্ব পান না। দেশের সংবিধান তাদের কর্তৃত্ব দেয় বলেই তারা কর্তৃত্ববান। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে আদালতকে বিচার করবার ক্ষমতা দেয়, আদালত বিচার করে। তাহলে জনগণ কর্তৃত্ব দেয় বলেই আদালত কর্তৃত্ববান হতে পারে। জনগণের অভিপ্রায়ের বাইরে আদালতের কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা নাই।

কেন জনগণ আদালতকে এই কর্তৃত্ব দেয়? এই অভিপ্রায়ে ও প্রয়োজনে যে জনগণের সাংবিধানিক (কিম্বা নাগরিক) ও মানবিক অধিকার আদালত রক্ষা করবে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ সততই  নির্বাহী কর্মকাণ্ড -- বিশেষত আইনশৃংখলা রক্ষা করতে গিয়ে নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষূণ্ণ করে। 'সন্দেহভাজন' দাবি করে নাগরিকদের গ্রেফতার করা থেকে শুরু করে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মায় গুম খুনও রাষ্ট্র করছে। আইনের শাসনের এই ভয়াবহ বরখেলাফের প্রতি আদালতের হুঁশ নাই।

এমনকি  রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী ও নির্বাহী বিভাগ নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ বা ক্ষুণ্ণ করতে পারে। যেমন জাতীয় সংসদ এমন একটি আইন প্রণয়ন করলো যা সংবিধান অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোন নাগরিক সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে নালিশ করুক বা না করুক আদালতের কর্তব্য হচ্ছে জনগণের পক্ষে সকল আইন ও সংশোধনীর ওপর নজরদারি জারি রাখা।  জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের এমন কোন সংশোধন করে যা নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী -- যেমন, পঞ্চদশ সংশোধনী -- তাহলে স্ব-উদ্যোগে এই ধরণের সংশোধনী বাতিল করা আদালতের কর্তব্য। আদালতের বলা উচিত জাতীয় সংসদ কিভাবে তাদের কর্তৃত্বের বাইরে কাজ করেছে (ultra vires)। কারণ জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে জনগণকে এমন কোন কর্তৃত্ব দেয় না যাতে তারা নিজেরাই অধিকারহারা হয়ে যায়। এটা এবসার্ড। কিন্তু আমরা দেখেছি এই ক্ষেত্রেও আদালতের কোন ভূমিকা নাই। অথচ নাগরিকরা কে কখন আদালতকে অবমাননা করল বরং আদালত তা নিয়েই অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। যে অভিপ্রায়ে জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে আদালতকে 'কর্তৃত্ব' দেয় সেই কর্তৃত্বের মর্ম যদি আদালত বুঝতে অক্ষম হয় তখন একটি দেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের জন্য সেটা ভয়ংকর বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। আদালতের কর্তৃত্ব তখন বাগাড়ম্বরে পরিণত হয়। সেটা  ফাঁপা বা ভূয়া দাবি ওঠে। অথচ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের জন্য এবং নির্বাহী ও আইন প্রণয়ণী সংস্থার বিপরীতে রষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার দরকারে যে কোন সজ্ঞান ও সচেতন নাগরিক জানে আদালতের কর্তৃত্ব মজবুত রাখাই তাদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রধান রক্ষাকবচ। অথচ সেই সকল সজ্ঞান ও সচেতন নাগরিকদেরই আদালত ক্রমাগত অপমান করছে ও শাস্তি দিয়ে চলেছে।

তাহলে এটাও আমাদের বুঝতে হবে যে আদালতের কর্তৃত্বের অর্থ নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করবার নিরংকুশ কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ -- জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ -- উভয়েরই উর্ধে। এই অর্থে যে যদি সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার কিম্বা সার্বজনীন মানবাধিকার রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ ক্ষুণ্ণ করে তাহলে আদালত এই বিশেষ কর্তৃত্বের জন্যই তাদের জবাবদিহি করতে পারে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ আদালতের অধীন।

দ্বিতীয়ত সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব একমাত্র আদালতের। এটাও সুস্পষ্ট কর্তৃত্ব। অন্য কারো নয়। সংবিধান সাহিত্যের বই নয়। ভাষা মাত্রই নানান জনের কাছে নানান অর্থ উৎপাদন করতে সক্ষম। করেও বটে। সংবিধানের ভাষাও ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু আদালত বিভিন্ন রায় বা নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে যে ব্যাখ্যা হাজির করে সেটাই সংবিধানের ব্যাখ্যা।

আদালতের কর্তৃত্বের তৃতীয় দিক হচ্ছে বারবারই বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্র ও জনগণকে আদালত মনে করিয়ে দেয় যে সংবিধান আর সংবিধান মেনে জাতীয় সংসদে প্রণীত আইন এক কথা নয়। সংবিধান বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ’ আইন বটে, কিন্তু অন্যান্য আইনকে আমরা যে অর্থে আইন বলি সংবিধান সেই ধরণের ‘আইন’ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে তার উল্লেখ আছে, কিন্তু যারা মুসাবিদা করেছিলেন এই বিষয়ে তাঁদের চিন্তার অস্পষ্টতার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি লেখা হয়েছে বাঁকা ভাবে। ফলে দুইয়ের ফারাক লেজে গোবরে হয়ে গিয়েছে।

সাধারণ আইন থেকে পার্থক্য বোঝাবার জন্য সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন বলা হয়েছে। পার্থক্য স্বীকার করা হোল বটে, কিন্তু স্বীকার করা হোল আইনের মধ্যে উঁচুনীচুর হায়ারার্কি চাপিয়ে দিয়ে। একদিকে এই দোষ, অন্যদিকে যেন অনেকটা হাত মাথার পেছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এনে ভাত খাবার মতো দশা। বলা হয়েছে: ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন’। আইন? সর্বোচ্চ হোক, কিন্ত সংবিধান কি স্রেফ আইন? অথচ জনগণ কী ধরণের রাষ্ট্র চায়, তাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প কী, রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো কেমন হবে, কোন বিভাগের কী ভূমিকা থাকবে, বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে – ইত্যাদি নানান কিছু নিয়েই সংবিধানে।

এটা আমাদের বোঝা দরকার সংবিধান মোটেও ‘আইন’ নয়। বাস্তবে রাষ্ট্র গঠিত হবার আগেই সংবিধান প্রণীত হয়। দেশ আর রাষ্ট্র এক নয়। দেশ স্বাধীন করা আর রাষ্ট্র গঠন করাও সমার্থক নয়।  রাষ্ট্র কিভাবে কাজ করবে, কাজ করবার প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন হবে, তার কাঠামোর রূপ কি রকম হবে সংবিধান তার আগাম নকশা। কিন্তু এমন এক নকশা যা জনগণের সার্বভৌম নির্দেশনা ধারণ করে । কোন ব্যাক্তির, গোষ্ঠির বা দলের নয়—সামষ্টিক প্রক্রিয়া থেকেই এই নকশা জাত। জনগণের যে অভিপ্রায় সংবিধান তারই দলিল। এটা নিছকই ‘আইন’ নয়।

তবে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে দাবি করা যায় না যে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান কোন সম্মিলিত বা সামষ্টিক প্রক্রিয়া থেকে জাত দলিল। কিন্তু সেটা ভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্ক। অন্যত্র আওয়ামি লীগ কিভাবে তাদের দলীয় কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে আমি তা আলোচনা করেছি। এখানে আমরা সংবিধান এবং সংবিধানের মধ্যস্থতায় আদালত ও জনগণের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী জনগণের অভিপ্রায় ধারণ করে বলেই সংবিধান আদালতকে কর্তৃত্ব দেয় আর সেই সংবিধান প্রণয়ন করে জনগণ।

আসলে সংবিধান মোটেও ‘আইন’ নয়, বরং আইন তৈয়ারির কর্তৃত্ব দেবার ক্ষমতা। সংবিধানের বাইরে আদালতের কোন কর্তৃত্ব নাই। এই ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে বলেই জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। সংবিধান নির্বাহী বিভাগকে রাষ্ট্রের নির্বাহী ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবার ক্ষমতা দিয়েছে বলেই নির্বাহী বিভাগ দেশ শাসন করে। ঠিক তেমনি সংবিধান বিচার করবার এবং নাগরিকদের পক্ষে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করবার ক্ষমতা আদালতকে দেয় বলেই আদালত বিশেষ কর্তৃত্বের অধিকারী । এই কর্তৃত্ব নির্বাহী ও বিচার বিভাগ থেকে আলাদা। 'আদালতের কর্তৃত্ব' কথাটাটিকে সুনির্দিষ্ট ভাবেই বুঝতে হবে। জনগণ আদালতকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবার কর্তৃত্ব দিয়েছে বলেই আদালত বিচার করতে পারে। যেহেতু আদালত সমষ্টির অভিপ্রায় বিচার প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ত করে তাই আদালতের বিচার নাগরিকরা মানতে বাধ্য হয়। জনগণের উর্ধে বা জনগণ ছাড়া আদালতের ঐশ্বরিক কোন  কর্তৃত্ব নাই। যদি আদালত অন্য কোন প্রকার ক্ষমতা দাবি করে তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় আদালত সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে নিজেকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ – অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাকে নিজের কর্তৃত্ব বলে ভাবছে। নিজেদের নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের  কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার সম্প্রসারণ গণ্য করছে মাত্র। জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করবার জন্য সংবিধানে প্রদত্ত কর্তৃত্বকে নয়। এটা রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়ের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক।

প্রশ্ন উঠতে পারে সংবিধানকে খামাখা ‘আইন’ বলা হোল কেন? একে ‘আইন’ বলবার কারণ এক. ঔপনিবেশিকতা ও দুই. উকিলদের দ্বারা মুসাবিদার ফল। ইংরেজরা তাদের আইন জারি করে শাসন করত, যেখানে শাসিতের কোন ভুমিকা ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধানের মুসাবিদাকারীরাও ভেবেছিলেন তাঁরাও নব্য ইংরেজ বটে, সংবিধান হচ্ছে স্রেফ এই দেশের জনগণকে শাসন করবার একটা ব্যবস্থাপত্র মাত্র। উকিলরা এর মুসাবিদা করেছিলেন, তাই তাঁরা সংবিধান ও রাষ্ট্র বলতে ‘আইন’ ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা কিম্বা ভাবতে পারেন না। তাই ভাবেন সংবিধানও ‘আইন’। তারা ভুল ভাবে এতোটুকুই পার্থক্য করতে সক্ষম যে সেটা ‘সর্বোচ্চ আইন’।

বাংলাদেশের সংবিধান ঘুরিয়ে কিভাবে কথাটা সংবিধানে লিখেছে সেটা বিচার করলে উকিলদের সমস্যা কিছুটা বুঝব। বলা হচ্ছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন”। অথচ, ‘এই সংবিধান জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তি’ – এতোটুকুই ছিল যথেষ্ট। ঘুরিয়ে উকিলরা আমাদের প্রথমে বোঝালেন এই সংবিধান বালাদেশের সর্বোচ্চ আইন – তবে ঘুরিয়ে বললেন স্রেফ নিজ গুণে আইন নয়। সংবিধান আইন – ‘জনগণের পরম অভিব্যাক্তি রূপে’!!!

কথাগুলো ব্যাখ্যা করে বলতে হোল আদালতের কর্তৃত্বের ধারণার সঙ্গে সংবিধান ও জনগণের সরাসরি সম্পর্ক বোঝাবার দরকারে। জনগণই বিচার করবার – বিশেষত মানবিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবার কর্তৃত্ব সংবিধানের মাধ্যমে আদালতকে দেয়। আদালত জনগণের প্রদত্ত কর্তৃত্বই প্রয়োগ করে। এই কর্তৃত্বের বাইরে আদালতের কর্তৃত্ব কথাটার কোন অর্থ নাই। আদালত যখন নাগরিক ও মানবিক অধিকারের কথা ভুলে যায় এবং নিজেই সেই নাগরিক অধিকার হরণ করছে বলে গণমনে আশংকা তৈরি করে তখন তা দেশের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। আদালত নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

দুই

এই ধরনের আশংকা কি তৈরি হয়েছে? বাংলাদেশের নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ অংশই মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল 'আদালত অবমাননার' অভিযোগে ক্রমাগত নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছে এই আশংকা আদালত তৈরি করেছে। 'আদালত অবমাননা' সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে সেই আশংকা তীব্র হয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যে রায় দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ জন নাগরিক একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। এঁরা প্রায় প্রত্যকেই সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবার জন্য দেশে বিদেশে স্বনামখ্যাত। একজন শুরুতে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেও পরে নিজের নাম বিবৃতি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

বিবৃতিতে ৪৯ জন নাগরিক ‘গভীর উদ্বেগ প্রকাশ’ করে বলেছিলেন: “আমরা মনে করি ট্রাইবুনালের এই রায়ের ফলে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সাংবাদিক, গবেষক ও লেখকদের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ সংকুচিত হবে। আমরা খুবই হতাশ যে ট্রাইবুনালের দেয়া আদালত অবমাননা রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপীলের সুযোগ নেই, যদিও আপীলের অধিকার আইনের শাসন এবং সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আদালত অবমাননার এমন সংকীর্ণ আইন সংস্কার এবং সংশোধন বাতিল করার জন্য। এ ধরণের আইন কেবল ঔপনিবেশিক শাসনের একটি অবশিষ্টাংশই নয় বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার পরিপন্থী” (দেখুন, ‘বার্গম্যানের সাজায় ৫০ নাগরিকের উদ্বেগ’, দৈনিক প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪) ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বিবৃতিকারীদের কাছে বিবৃতির বিষয়বস্তুর কারণ ব্যাখ্যা করবার নির্দেশ দিলে অনেকে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চেয়ে নিষ্কৃতি পান। কিন্তু ২৩ জন তাঁদের নাগরিক অধিকার রক্ষার কর্তব্য ও নৈতিক অবস্থান পরিচ্ছন রাখবার তাগিদে তাঁদের বিবৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আদালত ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরিকে শাস্তি দেন। কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নাগরিকদের এই অতি সাধারণ উদ্বেগ প্রকাশে বিচলিত হলেন তা মোটেও পরিচ্ছন্ন নয়।

‘আদালত অবমাননা সংক্রান্ত’ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রায় বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে যার মীমাংসার ভার আদালতেরই নেওয়া উচিত। মনে হয় আদালত নিজের কর্তৃত্ব ও ভাবমূর্তির সংকট নিয়ে অতিরিক্ত উৎকন্ঠিত। এই উৎকন্ঠার কোন ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। এই পরিস্থিতিতে সতর্কতা ও দায়িত্বের সঙ্গে আদালত অবমাননার বিষয়টি আমাদের সকলকেই পর্যালোচনা করতে হবে। করতে হবে আদালতের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব অক্ষূণ্ণ রাখার স্বার্থে। বিচারের প্রক্রিয়া, অভিযোগ গঠন, সওয়াল-জবাব ও রায় – প্রতিটি ক্ষেত্রই গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তার সদুত্তর জরুরী। অভিযুক্ত নাগরিকরা সওয়াল-জবাবে বারবার বলেছেন "আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে চাই, আমরা সকলেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মহান আদর্শ দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি। আমরা এও বিশ্বাস করি যে শাস্তি থেকে দায়মুক্তির ইতি টানতে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কারণে এদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসাবে এই মহান ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অত্যাচারের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের আওতায় আনার এই উদ্যোগের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে” । আদালত অবমাননাকে কেন্দ্র করে আদালতের ভেতরে ও বাইরে যে সকল বিতর্ক তৈরি হয়েছে তার নিরসনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালকে আরও শক্তিশালী করা প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য।

বিতর্কের পর্যালোচনা বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করেই নিরসন করা উচিত। ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি আদালত নিজের ‘কর্তৃত্ব’ বলতে কী বোঝে নাগরিকদের জন্য সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত আদালতের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা। আদালতের কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার দায় আদালত একতরফা নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে তার ভাবমূর্তি ক্ষূন্ন হবে। হবেই। অন্যায় ভাবে কাউকে শাস্তি দিলে সমাজে আদালতের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়বে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আদালত সাজা দিয়ে দেশে ও বিদেশে নিজেকে বিতর্কিতই করেছে। এটা প্রমাণ করা কঠিন যে নাগরিকদের বিবৃতির কোথাও আদালতকে হেয় কিম্বা আদালতের ভাবমূর্তি বিন্দুমাত্র ক্ষূণ্ণ হবার ঘটনা ঘটেছে । উলটা তাঁদের বিবৃতি ছিল আদালতের ভাবমূর্তি সুরক্ষার চেষ্টা । সওয়াল জবাবে তাঁরা সে কথা বারবারই বলেছেন। আদালতের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করবার বিন্দুমাত্র রেশ কিম্বা কণামাত্র ইঙ্গিত নাগরিকদের বিবৃতিতে নাই।

আমার ধারণা আদালত নিজের ভাবমূর্তি উজ্ব্বল ও মর্যাদা আরও উন্নত করবার একটি মহাসুযোগ হারালো। আদালত কোন কারনে বিবৃতিতে বিচলিত বোধ করতেই পারে। সেই দিক থেকে বিবৃতিদাতাদের বিবৃতির ব্যাখ্যা চাওয়া ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। আদালতে সশরীরে নিজে স্বয়ং কিম্বা উকিলের মাধ্যমে ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আদালত চমৎকার তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারত। সেই সুযোগটি হোল এটা স্পষ্ট করা যে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার দরকারে নাগরিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আদালত পার্থক্যরেখাটি ঠিক কোথায় টানতে চায়। বিচারব্যবস্থা সবসময়ই আদালত অবমাননা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এই দুইয়ের মধ্যে টানাপড়েনে খাবি খায়। একদিকে নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার দায় – যে দায়, আমরা আগেই বলেছি কার্যত বিচার বিভাগের – অন্যদিকে ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষূণ্ণ রাখার প্রয়োজনীয়তা। এই পার্থক্যরেখা স্পষ্ট করবার মধ্য দিয়েই বিচার বিভাগ নিজের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে পারে। তাকে অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন করে নয়।

আদালতের বৈচারিক কার্যক্রমের, বিচারকদের অন্যায় ও অপরাধ্মূলক কাজের এবং আদালতের যে কোন রায়ের সমালোচনা বা পর্যালোচনার অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। কিন্তু কোথায় তার সীমা শেষ এবং কোথায় আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য এই সুযোগে আদালত সকলকে এই সুযোগে বুঝিয়ে দিত পারত। বিশেষত আদালতের নির্দেশে যখন সমাজে শীর্ষ স্থানীয় নাগরিকরা স্বয়ং আদালতে হাজির। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের যে আদালত সেই সুযোগ গ্রহণ করে নি। এখন সওয়াল-জবাব শুনে ও আনীত অভিযোগের রায় পড়ে নাগরিকদের পক্ষে বোঝা খুবই মুশকিল কীসে আদালত অবমাননা হয়! কী কথা বললে আদালত অবমাননা হবে? কিভাবে আদালতের সমালোচনা করা সঙ্গত, কীসে আদালতের মর্যাদা ক্ষূণ্ণ হয়, ইত্যাদি। আশংকা হয় যে এই রায়ের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করল যাতে আদালতের বিষয়ে কেউ কোন কথা বলতে আর সাহস পাবে না। চিন্তা ও বিবেক এবং ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করবার যে কথা নাগরিকরা তাঁদের বিবৃতিতে তুলেছেন সেটাই আদালত কার্যত প্রমাণ করলেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ নাগরিকদের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আদালতের আপত্তি বা অবস্থান আদালত ব্যাখ্যা করতে পারত। কিন্তু আদালত অবমাননা বলতে আমরা এখন কী বুঝব তাকে রায়ে আরও অস্পষ্ট করে দিয়ে আদালত নিজেকেই নিজে বিতর্কিত করে তুলেছে। আদালত অবমাননা সম্পর্কে আদালতের একটি রায়ে উদ্বেগ জানানোর ব্যাখ্যা নাগরিকরা আদালতে পেশ করবার পরে আদালতের কাছ থেকে নাগরিকদের ধন্যবাদই বরং প্রাপ্য ছিলো। ধন্যবাদ এ কারণে যে দেশের সেইসব নাগরিক যারা আদালতের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম তারাই সশরীরে আদালতে এসেছে এবং আদালত অবমাননা সম্পর্কে আদালত তার নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করে আদালত কেন তাদের মন্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া জরুরী মনে করেছে সেই ব্যাখ্যা দিতে পারত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিজের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব খাটিয়ে শাস্তি দেওয়াটাই যেন আদালতের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যা কোন ভাবেই পভিপ্রেত হতে পারে না।

নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যর পরিপ্রক্ষিতে নাগরিকরা আদালত অবমাননা প্রসঙ্গে লর্ড আলফ্রেড ডেনিং-এর একটি বিখ্যাত উক্তি পেশ করেছিলেন। বিচারক লর্ড ডেনিং সম্পর্কে বলা হয় গত শতাব্দিতে তাঁর সমান মাপের বিচারক বিলাতে জন্ম গ্রহণ করেনি। লর্ড ডেনিং শুধু ‘পিপলস জাজ’ বা গণমানুষের বিচারক ছিলেন না, বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি, মর্যাদা ও কর্তৃত্ব রক্ষা করবার ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ অতুলনীয়। সেই উক্তির সারকথা হচ্ছে বিচার বিভাগের চরিত্রের কারণে বিচারকরা তাদের কর্মকাণ্ড বা রায়ের সমালোচনার উত্তর দিতে পারেন না। সমাজে কোন তর্ক তৈরি করা থেকে তাঁদের বিরত থাকতে হবে। আর তাঁদের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়বার তো প্রশ্নই আসে না। বিচারকরা তাঁদের আচরণের মধ্য দিয়েই সকল সমালোচনার জবাব দিয়ে থাকেন। আদালতকে মনে রাখতে হবে বিচার করতে গিয়ে আদালতের ভেতরে কিম্বা বাইরে কে কি বলল না বলল সেই সবের ক্ষেত্রে চুপ থাকাই শ্রেয়। সেটাও একটা অপশন। লর্ড ডেনিং বলছেন:

“Let me say at once that we will never use this jurisdiction as a means to uphold our own dignity that must rest on surer foundations. Nor will we use it to suppress those who speak against us. We will not fear criticism, nor do we resent it. For there is something far more important at stake, it is no less than freedom of speech itself”

বিচারকদের সমালোচনা হোক, তাতে ভীত হবার কিছু নাই, প্রতিবাদ করবারও কিছু নাই। কিন্তু বিচারকরা কখনই তাঁদের ক্ষমতাকে নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করবে না। কারণ তার চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গিয়েছে যা বিচারকের মর্যাদার চেয়েও কোন অংশে কম অয়। আর সেটা হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

বিচার বিভাগ নিজের কর্তৃত্ব, মর্যাদা ও সম্মান অক্ষূণ্ণ রাখে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে। তাকে হরণ করে নয়। আশা করি আমরা এই শিক্ষা সকলে গ্রহণ করব।

২৬ জুন ২০১৫। ১২ আষাঢ় ১৪২২।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।