রাজন আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না


আর ক’দিন পরেই ঈদ। পুরো এক মাস সিয়াম সাধনার পর সব মানুষের জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঈদ খুশি বয়ে আনে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ঢাকা শহরে ঈদের বাজারের জন্য রাস্তায় বের হওয়া যায় না, ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, টেলিভিশনে ইফতারের আয়োজনে নানা সু-স্বাদু খাবারের ছড়াছড়ি দেখানো হয়, ঈদের বাজারের দামি দামি কাপড় কেনাবেচার প্রতিবেদন দেখানো হয়। তখন বোঝা যায়, রমজান মাস চলছে। সামনে ঈদ। এদেশে আনন্দের সীমা নেই। তার ওপর বিশ্বব্যাংক বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে, শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবে। সবাই সুখে আছে! সুখে থাকবে। ক্রিকেট খেলার জয়ে উল্লসিত বাংলাদেশের তরুণরা, মিরপুর স্টেডিয়ামে তাদের ভিড় লক্ষণীয়। আমরা তো তাই চাই। দেশ এগিয়ে যাক, দেশের মানুষ ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। কিন্তু আসলে কি আমরা আনন্দে আছি? আসলে কি বিশ্বের কাছে আমাদের মুখ দেখাবার কোনো পথ আছে? আমরা কি বলতে পারি আমরা একটি সভ্য দেশ?

মাত্র ক’দিন আগে এ রোজার মাসেই ঘটে গেল ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে এসে ঠেলাঠেলি ও ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা। মরেছে ২৭ জন (বেশিরভাগই নারী) আর আহত হয়েছে ৫০ জনেরও বেশি। নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিকের দান-খয়রাতে মানুষ মরে, নূরানী জর্দাও মানুষের ক্ষতি করে, কোনো উপকারে লাগে না। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক আইন থাকলেও উৎপাদনকারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যান এবং তাদের এতই লাভ হয় যে, জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য শত শত মানুষ লাইন ধরে। তারা এই লাইন দেখে পুলকিত হয়। জাকাত দেয়া দয়া নয়, কর্তব্য, যারা এ জাকাত নেয় তারাই বরং দয়া করে আমাদের কর্তব্য পূরণে। কিন্তু এই জাকাত নিতে এলে তাদের প্রতি যে আচরণ করা হয় তা অমানবিক। তারা একটু ঠেলাঠেলি করলে তাদের লাঠিপেটাও করা হয়। যেন তারা জাকাত নিতে এসে অপরাধ করে ফেলছে। ময়মনসিংহে এ ঘটনাই ঘটেছে। লাঠিপেটার কারণেই এ পদদলিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং এতগুলো প্রাণহানি হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে সবাই স্তম্ভিত। নির্মম এ মৃত্যু প্রশ্ন তুলেছে, দেশের অগ্রগতি হলেও গরিবের এখনও মরতে হয় জাকাতের কাপড় নিতে এসে। যত কাপড় দেয়া হবে তার চেয়েও বেশি মানুষ জড়ো হয় সেখানে। অর্থাৎ এ মানুষগুলো জাকাতের কাপড়ের আশায় থাকে। বছরে একবার তারা নতুন কাপড় পায়। গরিব মানুষ যা আয় করে তা দিয়ে নতুন কাপড় কেনার সাধ্য নেই। তাই তারা জাকাতের কাপড় পেলে খুশি হয়। কিন্তু কাপড় নিতে এসে যদি মরতে হয় তাহলে সে খুশি আহাজারিতে পরিণত হয়, তাই হয়েছে। এখন কান্নার রোল উঠেছে সেই পরিবারগুলোতে, যা মিডিয়া আর দেখাবে কিনা সন্দেহ। ঈদ ছিল তাদের জাকাত পাওয়ার সঙ্গে জড়িত, এখন ঈদ বলে কিছু আর থাকবে না তাদের জন্য। জাকাত দেয়ার ঘটনায় এত মৃত্যুতে আমরা লজ্জিত হলাম, আমরা কলঙ্কিত হলাম।

এ নির্মম ঘটনার রেশ না কাটতেই সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় করা ভিডিও বের হলো, ১৩ বছরের শিশু রাজনকে চোর অপবাদ দিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য। হ্যাঁ, রাজন যতক্ষণ বেঁচে ছিল তার কণ্ঠের আর্তচিৎকার শোনা গেছে। তার বেঁচে থাকা অবস্থায় তাকে যেভাবে লোহার রড দিয়ে মারা হচ্ছে, সেইসঙ্গে ওই ছোট্ট শরীর একটি পিলারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় যতটুকু নড়তে পারছে সে চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। পাঠক, ক্ষমা করবেন, পুরো ভিডিওটা দেখার মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল কিংবা টিভিটাই বন্ধ করে দিয়েছি। তাই বর্ণনা দিতে ভুল হতে পারে এবং সম্পূর্ণ বর্ণনা দিতে পারছি না। তবুও রাজনের চেহারা এবং তার নিষ্পাপ চোখের অসহায় চাহনি এখন যখন স্থির ছবি আকারে দেখছি তখন আর চোখ ফেরাতে পারছি না। বাংলাদেশ কলঙ্কিত হলো। এদেশে শিশুরা নিরাপদ নয়। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে একটি সুস্থ শিশুকে পিটিয়ে মারা চাট্টিখানি কথা নয়। কেন দিনদুপুরে এমন ঘটনা ঘটলেও একজন মানুষও এগিয়ে এলো না। আজরাইলেরও কষ্ট হয়েছে তার প্রাণ নিয়ে যেতে। এটা ভিডিও হয়েছে ঠা-া মাথায় খুনিদের দ্বারাই। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিও তারাই করেছে। অনেকেই বলছেন, ভিডিওটি দেখানো উচিত এবং দেখে আমরা জানতে পারছি। কিন্তু একটা খুনির ভিডিও দেখে আমরা কি এভাবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে ভিডিও করার পক্ষে সাফাই গাচ্ছি না!

৮ জুলাই একটি ভ্যানগাড়ি চুরির অভিযোগে সিলেট-সুনামগঞ্জ-কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের কাছে বাদেআলী গ্রামের ছেলে রাজনকে হত্যা করা হয়েছে। সে গরিব পরিবারের ছেলে। বাবাকে কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত সে। তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে বড়গাঁওয়ের সুন্দর আলী মার্কেটের একটি ওয়ার্কশপের সামনে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে নির্মমভাবে এবং আনন্দ-উল্লাস করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, খুনিরাই রাজনকে পেটানোর দৃশ্য ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। অপরাধ সম্পর্কে জানে বলেই তারা লাশ গুমেরও চেষ্টা করে। পত্রিকা থেকে জানা যায়, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে চার যুবক মাইক্রোবাসে করে লাশ নিয়ে কুমারগাঁও গ্রামের ভেতরের খালি মাঠে ফেলার চেষ্টা করলে স্থানীয় লোকজন ধাওয়া করে অন্যতম খুনি মুহিতকে আটক করে এবং তাকে জালালাবাদ থানায় সোপর্দ করে। পুলিশ ওই মাইক্রোবাস থেকে রাজনের লাশ উদ্ধার করে।

এর আগে আরও অনেক নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও হয়েছে, মিডিয়ায় সেগুলো দেখিয়ে এখন টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। আমরা কি আসলেই ভিডিও করে এবং দেখিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করছি? তার চেয়ে আর দশজন এগিয়ে এসে রাজনকে ওই পিশাচদের কবল থেকে রক্ষা করছে এমন ভিডিও ধারণ করলে কি ভালো ছিল না? যুক্তি হতে পারে যে, এর মাধ্যমে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তাই দেখানো হচ্ছে এবং মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। আমি সেটা মনে করি না। রাজন আমার পরিবারের কেউ হলে আমি নিশ্চয়ই সেটা হতে দিতাম না। আমাদের সচেতন হতে এমন নিষ্ঠুরতা দেখতেই হবে? আমাদের মনে আছে, এর আগে শিশু জিহাদ যখন কুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল তখন তাকে উদ্ধারের চেয়ে দর্শকদের বিস্তারিত দেখানো যেন খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল। ফায়ার সার্ভিসের ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছিল, অথচ তারা সময়মতো উদ্ধারকারীদের কাজ করতে দিলে জিহাদ হয়তো বেঁচে যেত। এখন ক’জন জিহাদের মা-বাবার খোঁজ রাখেন? আমরা জিহাদের উদ্ধারের লোমহর্ষক লাইভ শো দেখে কি শিখলাম? না, কিছুই শিখিনি। কিছুই আমাদের মনে থাকবে না। আবার একটি নতুন ঘটনা ঘটলে এ কথাই আবার আওড়ানো হবে। আর আমরা জাতি হিসেবে তো সব কিছু ভুলে যেতে খুবই ভালো পারি।

রাজনের মৃত্যু কোনোভাবেই আমাদের কাউকেই রেহাই দেবে না। কোনোভাবেই ক্ষমা করবে না। রাজনের শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জানা গেছে, মস্তিষ্কে অধিক রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে মানসিক চোট থেকে তার মৃত্যু হয়েছে। আঘাতজনিত কারণে রাজনের শরীর নীলচে হয়ে যায়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই লিটার রক্ত জমাটবাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। মাথার খুলির হাড়ও ভেঙে গেছে। (কালের কণ্ঠ, ১৪ জুলাই, ২০১৫)। কত নিষ্ঠুরভাবে মারলে একটি তরতাজা প্রাণবন্ত শিশু এমন করে মরতে পারে!

পুলিশ হত্যাকারীদের প্রথমে সহায়তা করেছে বলে কিছু প্রচারমাধ্যমে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ ছাড় পাবে না; ঘটনাটি হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী।’ এটা বলা কি যথেষ্ট? তার বলার কথা, ‘আমরা লজ্জিত, আমরা ব্যর্থ! পুলিশের ভূমিকা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠেছে। এলাকার মানুষ প্রতিবাদ না করলে জালালাবাদ থানার পুলিশের এসআই রাজনের লাশকে বেওয়ারিশ বানিয়ে চালিয়ে দিতেন। এলাকার মানুষ মাইক্রোবাসসহ অন্যতম খুনি মুহিতকে ধরিয়ে দেয়ায় রাজনের লাশ পাওয়া যায়। রাজনের বাবা হন্যে হয়ে রাজনকে খুঁজছিলেন, অথচ পুলিশ তার ছেলেকে বেওয়ারিশ বানিয়ে দিচ্ছিল। গ্রামের একজনের কাছে একটি শিশুর লাশ উদ্ধারের কথা শুনে তিনি থানায় যান, রাজনকে শনাক্ত করেন। এ অবস্থায়ও সেখানে তার সঙ্গে পুলিশ ভালো আচরণ করেনি। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিল। পত্র-পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব কথা কি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানেন না? পুলিশের সহযোগিতার আশ্বাস ছিল বলেই খুনিরা এমন কাজ করে উল্লাস করতে পেরেছে। তাদের একজন বিদেশেও পাড়ি জমাতে পেরেছে! খুনিদের অন্যতম প্রধান কামরুলকে জেদ্দা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ দেখেছি। এখানেও লক্ষ্য করলাম সরকারের এক ধরনের ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা আছে, লজ্জা বা বিব্রত ভাব নেই। খুনিদের ধরা পর্যন্তই কি সব?

এমনকি টেলিভিশনে এক আওয়ামী সাংবাদিক খুনিদের ধরা পর্যন্তই সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, একজন অভিযুক্তকে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত অপরাধী বলা যাবে না। এখানে কি তাই? খুনিরা নিজেরাই তো তাদের অপরাধ ফলাও করে প্রকাশ করছে। সেখানে প্রমাণের আর কী বাকি রেখেছে? তাদের খুঁটির জোর অনেক বড়, তাদের অপরাধ কখনোই প্রমাণ হবে না। রাজনের হত্যায় কোনো রহস্য নেই, আছে ক্ষমতা, বিকৃত মানসিক উল্লাস ও পাশবিকতার জোর। সরকারি দলের নেতারা বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপরও একটু দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধীরা জানে তাদের কিছু হবে না। কাজেই এখানে লোক দেখানো তদন্ত ও রিমান্ডের কথা বলে সাধারণ মানুষকে ঈদের খুশিতে মশগুল করে দেয়া যাবে না। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এখনও মানবিকতা একেবারে লোপ পায়নি। খুনিরা নিজেরাই নিজেদের বিচারের পথ তৈরি করে দিয়েছে।

ঈদ সবাই করবে ঠিকই; কিন্তু রাজনের শরীরের দুই লিটার জমাটবাঁধা রক্ত ও ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন সারা দেশের ৬৪ জেলার মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। রাজন কেন এবার ঈদ করতে পারবে না তার জবাব আমাদের দিতে হবে। রাজন আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না। একটি ছোট্ট শিশু রাজন এদেশে বাঁচতে পারে না। কীসের বড়াই করি আমরা! ধিক এদেশের সভ্যতার মুখোশের।

পদদলিত মানুষের আর্তচিৎকার ও রাজনের জমাটবাঁধা রক্তে মাখা এবারের ঈদ।

তবুও জানাই ঈদ মোবারক। পদদলিত হয়ে মরে যাওয়া নারী ও পুরুষ এবং রাজনের আত্মা শান্তি পাক।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।