আয়নায় মুখ দেখা


‘নির্বাচনই গণতন্ত্র’ – এই ধরণের একটি ধারণার প্রকট প্রাবল্য বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে আমরা দেখেছি। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে নির্বাচন নিয়ে যে তামাশা জনগণ দেখেছে সে কারণে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কিছু ভাবনা শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু আমার অনুমান সেটা খুবই ক্ষীণ। রাষ্ট্র নামক ব্যাপারটা আসলে কী, তা নিয়ে আমাদের সমাজে আলোচনা নাই বললেই চলে। একটি সর্বগ্রাসী প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়া এবং তা একজন ব্যাক্তির কুক্ষিগত হওয়া  বিপজ্জনক। একদিকে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান আর অপরদিকে ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ -- তাদের জীবন ও জীবিকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামাজিক সুযোগগুলোও নষ্ট ও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে, সমাজ হয়ে গিয়েছে গৌণ ও অর্থহীন -- সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে খুব কমই আমরা আলোচনা করি। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। ধরা যাক আমরা এখনো কীটপতঙ্গের জীবনে আছি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির উৎপত্তির চরিত্র,  পরবর্তীতে ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং এখনকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী না থাকার জন্য সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। এই কাজগুলো দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী করে থাকে। তারপরও জনগণ তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে বোঝার চেষ্টা করে। সেই বোঝাবুঝির ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যথাসাধ্য অংশগ্রহণ করে। এই বাস্তবতায় নির্বাচন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবার সুযোগটুকু পায়। একটি গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সাধারণ মানুষকে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করেছে এবং ক্ষমতা অল্পকিছু ব্যাক্তি ও পরিবারের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছে সেই পরিস্থিতিতে ভোট দিতে পারার অধিকার অনেক বড় হয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়। ফলে নির্বাচন গণতন্ত্র নয় ঠিক, এটা জনগণ বোঝে না যে তা নয় -- কিন্তু গণবিরোধী ও কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘাড়ের ওপর ভূতের মতো রাষ্ট্রের চেপে বসে থাকার মধ্যে ভোট দিতে পারা এক দম নিঃশ্বাস নেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন বাস্তবিক কারণেই রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে রয়েছে।

এতোটুকু যদি বুঝে থাকি তাহলে সম্প্রতিকালে আন্দোলন করে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুর্বল বা ক্ষীয়মান হয়ে গিয়েছে বা অচিরে হবে বলে আমি মনে করি না। কিছু কিছু দৈনিকে এই ধরণের বিশ্লেষণ চোখে পড়েছে যার কোন বাস্তব ভিত্তি নাই। বিএনপির দিক থেকে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করাটা সঠিক ছিল, কিন্তু আন্দোলনের পর্ব অনুযায়ী পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষার কোন সারবস্তু তাদের দাবিতে তারা যুক্ত করতে পারে নি। সেই ক্ষেত্রে বিএনপি শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এটা পরিষ্কার প্রমাণিত যে বিএনপি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো কিম্বা বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে বিকাশের অন্য কোন ইতিবাচক অভিমুখ নির্দেশ করবার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে অক্ষম।

বিএনপি নিয়মতন্ত্রে বিশ্বাসী নির্বাচনপন্থি প্রধান দুই জাতীয় দলের একটি। ফলে অনেকে দাবি করেন বিএনপির পক্ষে রাষ্ট্রের মৌলিক কোন  বদল আশা করা বোকামি ও অতি-প্রত্যাশা। তত্ত্বগত ভাবে এটা ঠিক, বিএনপি বিদ্যমান ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখতে চাইবে। কিন্তু রাজনীতি কখনই সরলরেখায় চলে না। বিএনপির কাছে রাষ্ট্রের রূপান্তরের প্রত্যাশা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মনে রাখা উচিত ঔপনিবেশিক আমলে গঠিত মুসলিম লীগ বাংলাদেশে জমিদারতন্ত্র ও মহাজনী প্রথার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনী রাজনীতি করে সফল হয়েছিল। কমিউনিস্টরা ভূমি ব্যবস্থার রূপান্তরের কথা না বলে যখন তেভাগার দাবি করছিলো, বিপরীতে মুসলিম লীগ জমিদারী ও মহাজনী প্রথা উৎখাতের লড়াই করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান কায়েম করে তা বাস্তবায়ন করেছে। শেখ মুজিবর রহমান নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টপন্থি গণতন্ত্রই চেয়েছেন। যৌবনে পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন অতএব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার সাধ তার দিক থেকে অন্যায্য ছিল না। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন বলে তাকে হীন প্রমাণের যুক্তির কোন ভিত্তি নাই। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে পর্বে পর্বে আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তনের মেজাজ বুঝে ছয় দফা ও পরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার নেতৃত্বে আওয়ামি লীগ ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামি লীগ কোন বিপ্লবী দল ছিল না। ইতিহাস যুক্তি পরম্পরা মাত্র, যুক্তির বাইরে কিছুই ঘটে না, এটা হলফ করে বলা যায় না। আফসোস বিএনপি এই সকল ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে নি।  আওয়ামি লীগ যদি একটি জনগোষ্ঠিকে সশস্ত্র যুদ্ধের স্তরে নিয়ে যেতে পারে, বিএনপি গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটাতে পারবে না -- এই অনুমানের সঙ্গে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মেলে না।

বিএনপি কমিউনিস্ট পার্টি কিম্বা কোন বিপ্লবী দল নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে আওয়ামি লীগের মতো তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল। কিন্তু এটা এখন পরিষ্কার বাংলাদেশে এই দলটি এমন কোন নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে না যা বাংলাদেশের ইতিহাসে গুণগত রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম। অথচ এর পূর্ণ সুযোগ এক এগারোর সময় থেকে ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে পুরাপুরি জারি ছিল। একটি সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবির মধ্য দিয়ে যে জনগোষ্ঠি জেগে উঠেছিল তাদের মনের ইচ্ছা বুঝতে বিএনপি চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ একটি গণ অভ্যূত্থানের মধ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের রূপান্তরের জন্য মানসিক ভাবে তৈরি ছিল। কিন্তু বিএনপি পুরানা ভাঙা রেকর্ডের মতো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া বিদ্যমান ক্ষমতা ও রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে কোন দিশা দিতে পারে নি।

এর প্রধান কারন হচ্ছে বিএনপির মধ্যে আওয়ামি লীগ পন্থিদের প্রাদুর্ভাব ও ক্রমাগত অন্তর্ঘাত মূলক তৎপরতা। বিএনপির নেতাদের অনেকেই হয়তো আওয়ামি লীগের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। চলতেই পারেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর সত্যাসত্য গোয়েন্দারাই ভাল বলতে পারবে। কিন্তু বিএনপির বর্তমান দুর্দশা বুঝতে হলে বুঝতে হবে মন মানসিকতা ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার দিক থেকে বিএনপির নেতৃত্বে এমন সব ব্যাক্তিরা রয়েছেন যারা আসলে আওয়ামি লীগার। তাদের উচিত আওয়ামি লীগ করা, মোটেও বিএনপি নয়। আওয়ামি লীগে যোগদান করলে তারা ভাল করবেন। এদের অনেকেই এখন বলছেন, বিএনপিকে দিয়ে কিছু হবে না। একথা বলে তারা বোঝাতে চান বিএনপি অচিরে ক্ষমতায় যেতে পারছে না, তারাও মন্ত্রী হতে পারছেন না। অতীতের মতো দুর্নীতি ও লুটপাটেরও সুবিধা হচ্ছে না তাদের। অতএব বিএনপি থেকে এতদিন যে সুবিধা পাওয়া যাচ্ছিল, এখন আর কিচ্ছুই হবে না।

কিন্তু নির্বাচনী দল হিসাবে বিএনপির দুর্বল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কোন কারনে নির্বাচন হলে বিএনপির নির্বাচনে জিতে আসার সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু তা নিশ্চিত করতে বিএনপিকে আওয়ামি লীগারদের খপ্পর থেকে দলকে মুক্ত করবার প্রচেষ্টা নিতে হবে। বিএনপি যদি তার দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামি লীগের এজেন্টদের বের করবার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এখন সেটা খুবই ভাল সময়। আগামি নির্বাচনে, যদি শেখ হাসিনা দয়া পরবশ হয়ে নির্বাচন দেবার মতো অসম্ভব সিদ্ধান্ত আদৌ নিয়ে ফেলেন, তাহলে এই নেতারা অন্তত বিএনপির ভেতরে বসে কোন অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হবে না। এটা তো বলা যায়, অচিরে না হোক বাংলাদেশ চিরকাল নির্বাচনহীন থাকবে না।

বিগত আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য বিএনপি বা খালেদা জিয়া যতোটা দায়ী তার চেয়ে বেশী দায়ী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি শ্রেণি, যাদের আমরা ঠাট্টা করে কিম্বা আদর করে 'সুশীল' বলে সম্বোধন করতে পছন্দ করি। এরা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষাবলম্বনের নামে বাংলাদেশে এক এগারোর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি চরম ফ্যাসিস্ট এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষে নির্লজ্জ ভাবে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনপন্থি দল হিসাবে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট সমাজের বাইরের কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী সুশীল সমাজের এই রাজনৈতিক মূর্খতা ও অদূরদর্শিতা বাংলাদেশে অনির্বাচিত ও অবৈধ ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করেছে। নির্বাচনী রাজনীতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মর্ম ও কাঠামোগত সমস্যার কোন সমাধান নয় এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্ব সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির। কিন্তু তারা দুটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে এখন একবার খালেদা জিয়া আরেকবার শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করে নিজদের বুদ্ধিজীবিতা ফলিয়ে যাচ্ছে। যা অতিশয় বিরক্তিকর। সাধারণ মানুষ বা নাগরিকদের দিক থেকে এই উপলব্ধি দরকার যে বিরোধী জোটের রাজনৈতিক ব্যার্থতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য বড় কোন প্রতিবন্ধক নয়, সবচেয়ে বড়ো বাধা হচ্ছে এই নির্লজ্জ সুশীল শ্রেণি ও কতিপয় গণমাধ্যম যারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করে চলেছে।

এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও খালেদা জিয়া আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতির সীমিত পরিসরে গণতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করেছেন। আলবৎ ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সে কারণে বিএনপি ভেঙে যাবে তার সম্ভাবনা নাই। যদি ভাঙা বলতে বিএনপি থেকে আওয়ামি পন্থিরা বহিষ্কৃত বা নিজেরা বেরিয়ে যায় সেটা ভিন্ন তর্ক। একই কারনে আন্দোলন সংগ্রাম পর্বে বিএনপির ভূমিকার মূল্যায়ন এখনও সহজ নয়। কারণ দল হিসাবে বিএনপি এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের আভ্যন্তরীণ বিরোধ ও দ্বন্দের স্পষ্ট ছবি আমাদের কাছে নাই।

বিএনপির মধ্যে আওয়ামি পন্থিরা এখন কি করছে? এটা বোঝা যাচ্ছে একটি শক্তিশালী ধারা বিএনপির মধ্যে কাজ করছে যারা মনে করে ইসলামপন্থি ধারা – বিশেষত জামায়াতে ইসলামির সঙ্গ বিএনপির ত্যাগ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের দল হিসাবে ইসলাম প্রশ্ন বিএনপি কিভাবে নীতিগত ও কৌশলগত ভাবে মোকাবিলা করবে তা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে। সেটা আসলে তর্কের বিষয়ও বটে, কারণ আদর্শগত মর্মের দিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামি রাজনীতির নির্ধারক ইসলাম। একে এড়িয়ে যাবার উপায় নাই। মর্মের দিক থেকে বাংলাদেশের আগামি রাজনীতির এটাই নির্ধারক প্রশ্ন। পাশ্চাত্য লিবারেল রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় আবেগ, সংবেদনা, স্বপ্ন ও সংকল্প বিএনপি তার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বয়ানের মধ্যে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করবে সেটাই গণতন্ত্রের দিক থেকে প্রধান নীতিগত ও কৌশলগত দিক। বলাবাহুল্য, বিএনপি সেটা করতে এখনও সক্ষম নয়, এটা তাদের বুদ্ধিজীবীদের লেখালিখি পড়ে এবং কিছুকাল আগে ইসলাম সম্পর্কে তারেক রহমানের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। সেকুলার ও ইসলামপন্থিদের জোটে একসঙ্গে ধরে রেখে শেখ হাসিনার শাসনের বিপরীতে বিএনপির এখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারা  লিবারেল রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকে কম সফলতা নয়। শেখ হাসিনা এই সাফল্যটুকুই নস্যাৎ করতে বদ্ধ পরিকর। তিনি ঠিকই ধরেছেন, এই ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সফল হলে দেশে বিদেশে  বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তার জন্য শুধু জামায়াতে ইসলামিকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা নয়, মূলত ফ্যাসিস্ট দল ও বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে ধর্ম নিরপেক্ষতা পন্থী ও ইসলামপন্থিদের সম্ভাব্য ঐক্যের যে কোন সম্ভাবনাই শেখ হাসিনা নস্যাৎ করে দিতে চান। লক্ষ্য করার বিষয় যে  বিশ দলীয় জোটের  মধ্যে এই ঐক্যের বীজ রয়েছে, তাকে অংকুরেই বিনষ্ট করা আওয়ামি লীগের বর্তমান রাজনীতির প্রধান দিক। বিএনপি ও ইসলাম্পন্থীদের মধ্যে ফাটল ধরানো শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রধান দিক।

অন্যদিকে সমস্যা হচ্ছে বিএনপি কিম্বা ইসলামপন্থী দলগুলো জোট বেঁধেছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশ দলীয় জোটের তাৎপর্য তারা আদৌ বোঝে কিনা এ ব্যাপারে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। যদি বুঝত তাহলে বিএনপির সেকুলারপন্থীরা ইসলাম নিয়ে, কিম্বা ইসলামপন্থীরা ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে খামাখা অস্বস্তিতে ভুগতো না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ধর্মরপেক্ষাতাবাদী ও ইসলামপন্থীদের ঐক্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধি। এর বিপদ বুঝবার বিচক্ষণতা শেখ হাসিনার রয়েছে। এই রাজনৈতিক সন্ধির বীজ জাতীয় রাজনীতির সম্ভাব্য দিকনির্দেশক হয়ে উঠবার আগেই শেখ হাসিনা একে সমূলে নষ্ট করতে চান। তিনি তার বিপদের ক্ষেত্রগুলো বাজপাখির চোখ হেনে ধরতে পারেন। যে কারণে আমি সবসময়ই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রশংসা করে এসেছি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার বিচার আর বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ইসলামের ভুমিকার প্রশ্ন একদমই দুটো আলাদা প্রশ্ন। জামায়তে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের মধ্যে প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী রয়েছেন যারা একাত্তরে দলটির ভূমিকার সমালোচক। এই ভূমিকার কারনে বাংলাদেশে শক্তিশালী ইসলামপন্থি রাজনীতির উদ্ভব ও বিকাশ কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যে একান্তই ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগের প্রধান কৌশল – যার উদ্দেশ্য বিএনপিকে আরও দুর্বল ও খর্ব করা -- এটা বুঝবার  জন্য খুব একটা রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। এটা জামায়াতে ইসলামিকে দুর্বল করারও কৌশল। এতে বিরোধী দলগুলোকে  দমন পীড়ন ও নির্যাতন যেমন সুবিধা তেমনি জামায়াত বিরোধিতার নামে আওয়ামি লীগের লীগের ইসলাম বিরোধী নীতি বাস্তবায়নের পথও সাফ হয়।

নির্বাচনী রাজনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল জায়গাটা কি? শেখ হাসিনা স্পষ্টই জানেন সেটা হোল তাঁর পক্ষে কোন জনসমর্থন নাই। তার পাবলিক রেটিং নিম্নমুখি, একে উর্ধ্মুখি করবার কায়দা নাই বললেই চলে। অথচ তিনিই ক্ষমতায় থাকতে চান। তাই তাঁকে যেভাবেই হোক নিজেকে ক্ষমতায় রেখেই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। দুনিয়াতে বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকা অসম্ভব কিছু নয়। আওয়ামি লীগের পক্ষে গুম খুন, আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা, জেল জুলুম সহ হেন কোন অত্যাচার নির্যাতন নাই যা করা অসম্ভব নয়। কিন্তু আফসোস, যা করা যায় না তা হোল বলপ্রয়োগ করে পাবলিক রেটিং বা জনসমর্থন বাড়ানো। এমনকি নিজের পক্ষে গণ মাধ্যমগুলোর সরকারীকরণেও ফায়দা নাই বললেই চলে। শেখ হাসিনা গণ সমর্থনের সংকটে পড়েছেন। এটা সহজে কাটবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগের প্রধান বয়ান হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতের উপস্থিতিই বুঝি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ। শেখ হাসিনা এটাকেই প্রচার প্রপাগান্ডা তৎপরতার প্রধান বয়ান বানিয়েছেন এবং নিরন্তর তা প্রচার করছেন। যদিও তিনি মুখে বলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা জামায়াত, আসলে তিনি বোঝাতে চান তার দিক থেকে প্রধান সমস্যা ইসলামি বা ইসলামপন্থি রাজনীতি। আওয়ামি লিগের দিক থেকে এটা অবশ্য সঠিক নির্ণয়। তার পক্ষে পাশ্চাত্য পরাশক্তির সমর্থনের মূল জায়গাটা এখানে। তিনিই বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাস দমনের প্রধান শক্তি ও সেনাপতি।

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতিকে দমন করা। বিএনপি কেন জামাতের সাথে জোট বেঁধেছে একেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যায় পরিণত করেছেন। কিন্তু ঠিক এই কাজটি করতে গিয়েই তিনি গণসমর্থনের ভিত্তি হারিয়েছেন। নির্বাচনী রাজনীতির পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনার ইসলামপন্থি রাজনীতির বিরোধিতা তার সমর্থনের পরিসর বাড়াচ্ছে না, বরং সংকুচিত করে এনেছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন দেবার অর্থ হচ্ছে তাঁর হেরে যাওয়া। যে কারনে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচন দেবেন না। কারণ তিনি জিতবেন না। যদি আদৌ নির্বাচন দেন সেটা তাঁর অধীনেই হতে হবে। যাতে তিনি নির্বাচিত হয়ে আসেন।

এটা যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য জামায়তই দায়ী –বিএনপির মধ্যে যারা এই ধারা বহন করেন তাঁরা আসলে আওয়ামি রাজনীতিই করছেন। খালেদা জিয়াকে নেতা না মেনে তাঁরা শেখ হাসিনাকে নেতা মানতেই পারেন। সেই ক্ষেত্রে তাদের উচিত বিএনপি ছেড়ে আওয়ামি লীগে যোগদান করা এবং জামায়াতসহ বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতির বিরোধিতা করা। সেটাই হবে সৎ রাজনীতি।

কাগজে দেখেছি খালেদা জিয়া তার দলের কিছু কিছু নেতাকে আওয়ামি লীগ করবার উপদেশ দিয়েছেন। এটা ভাল পরামর্শ। বিএনপির ঘাড়ের ওপর এই নেতাদের বসে থাকার কোন যুক্তি আসলেই নাই। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেভাবে হবার কথা সেভাবে ত্বরান্বিত হলে বিএনপির নির্বাচনী রাজনীতির জন্য খুবই ভাল হবে।

একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি সিরিজ লেখার মধ্য দিয়ে বিএনপির ‘ময়নাদদন্ত’ চলছে। দেখে খুব কৌতুক বোধ করেছি। কেউ মারা গেলে বা খুন হলে ময়নাতদন্ত হয়। ধরে নেওয়া হয়েছে বিএনপিকে কেউ হত্যা করেছে এবং হত্যার ক্লু বের করার জন্য ময়নাতদন্ত চলছে। বিএনপির রাজনীতির দিক থেকে গত একদশকের জাতীয় রাজনীতির একটা মূল্যায়ন হতেই পারে। কিন্তু বিএনপি এখনই নিহত, আর গণমাধ্যম তার ময়নাতদন্ত করছে দেখে খুবই আমোদ লাভ করেছি।

শেখ হাসিনা সত্বর কোন নির্বাচিন দেবেন, এটা মনে হয় না। তিনি দমন পীড়নের পথেই থাকবেন এবং কোন না কোন মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করবেন, তারপর একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবেন এটাই গুজব আকারে আমরা শুনছি। এটা কতোটা সম্ভব বলা মুশকিল।

বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন এখনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, নাগরিক ও মানবিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের দায় ও কর্তব্যের উপলব্ধি এবং সর্বোপরি জনগণের সাংগঠনিক ক্ষমতা – অর্থাৎ গণক্ষমতা অর্জনের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু এই পর্যায়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই-সংগ্রাম – অর্থাৎ গণতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েমের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত ও সচেতন করার ওপর আন্দোলন নির্ভর করছে। এই কাজ বাংলাদেশে ধীর গতিতে ঘটছে, এটা মানতে হবে। সেটা খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনার দোষ না।

আমাদের উচিত আয়নায় নিজেদের মুখ দেখা। সেখানে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিতার অপ্রাপ্তবয়স্ক সুরত আমাদের আরও দীর্ঘদিন আমোদিত রাখতে পারবে। ইনশাল্লাহ।

২৪ জুলাই ২০১৫। ৯ শ্রাবন ১৪২২। শ্যামলী।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।