আসুন গোড়ার কথা বলি
এক
দৈনিক যুগান্তরে গত সপ্তাহে ‘আয়নায় মুখ দেখা’ লেখাটি ছাপা হবার পর একজন পাঠক আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন (এই লিঙ্কেও লেখাটি পড়তে পারেন)। তাঁকে ধন্যবাদ। চিঠিতে তিনি নাম উল্লেখ না করে ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর প্রকাশিত একটি লেখার অংশ উদ্ধৃত করে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আমি এই লেখককে চিনি কিনা। হঠাৎ পড়ে আমি আসলে লেখককে চিনতে পারি নি। উদ্ধৃতিটি ছিল র্যাপিড একশান ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) সম্পর্কে। সেটা এরকম:
“...নতুন যে জাতীয়তাবাদী রক্ষীবাহিনী বিএনপি গড়ে তুলেছে সেটাই, আমার ধারণা, তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য সেটা বিষধর সাপের মতো কাজ করেছিল। সে বিষের নীল আজও আওয়ামি লীগ নিজের গা থেকে খসাতে পারে নি।‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’-এর পর বিএনপির প্রাইভেট আর্মি গড়ে তোলার প্রথম পরিকল্পনা ধরা পড়ে বাংলা ভাই বাহিনীর প্রতি তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু হ্যারি কে টমাস সাহেব সেখানে বাদ সাধলেন। তিনি বাংলা ভাই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলাবলি শুরু করায় সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হোল। সে কারণেই 'র্যাব' নামে যে প্রাইভেট বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে তার আবির্ভাব ঘটাতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে”।
“শেখ মুজিবুর রহমান যখন রক্ষীবাহিনী করেছিলেন সেটাও তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীই ছিল; কিন্তু সেটা ছিল শেখ মুজিবের নিজেরই বাহিনী। আওয়ামী লীগের বাহিনী। তার হাতে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করবার জন্যই তখন তিনি এ ধরনের প্রতিভাবান পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন। দেশের বিনাশ যেমন তিনি ত্বরান্বিত করেছিলেন, নিজের মৃত্যুকেও কাছে ডেকে এনেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাই ভোগ করছেন”।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি নিজেই নিজেদের মৃত্যুকূপ খুঁড়েছিল ক্ষমতাসীন থাকার সময় র্যাব গঠনের মধ্য দিয়ে। যে দানব বিএনপি-জামাত জোট তৈরি করেছে সেই দানবই বিএনপি ও জামায়াত কর্মীদের এখন ক্রস ফায়ার, গুম, হেফাজতে মৃত্যুর মতো অপরাধ করে যাচ্ছে। যে অত্যাচারের সীমা পরিসীমা নাই। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে জনপ্রিয় প্রচার হচ্ছে, বিএনপি মৃত্যু দশায়। জামায়াতের ভবিষ্যৎ এখনও অস্পষ্ট, ইত্যাদি। জোট আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনার সময় হার্ট অ্যাটাকের নামে ৫৮ জন এবং ক্রসফায়ারের নামে র্যাব ও পুলিশ ২০ মে ২০০৬ পর্যন্ত ৬২০ জন মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে। এখন যখন র্যাবের হাতে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীদের নির্যাতন, হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, গুমখুন ইত্যাদি দেখি তখন ভূক্তভুগীদের করুণ হাহাকারের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত আমলে র্যাবের হাতে নির্যাতীত ও খুন হওয়া মানুষ ও তাদের পরিবারের হাহাকারও শুনি।
অনেকে দাবি করতে পারেন জামায়াতে ইসলামি র্যাব গঠন করবার সিদ্ধান্তের ভাগীদার নন। এটা ঠিক নয়। কাণ্ডজ্ঞানও তা বলে না। বিনাবিচারে মানুষ হত্যা করা ইসলামের চোখে ঘোরতর অপরাধ -- এই নৈতিক প্রশ্নে সেই সময় জামায়াত জোট থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। কিন্তু আসে নি। দ্বিতীয়ত র্যাব গঠনের পেছনে আন্তর্জাতিক প্রণোদনা ছিল এই যে এই ধরণের সংগঠন দিয়ে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামি সন্ত্রাস মোকাবিলা করছে। র্যাব করায় তাদের আন্তর্জাতিক রেটিং বেড়ে যাবে। বিএনপি-জামায়াত ওয়ার অন টেররের জোকার কার্ড খেলতে চেয়েছে। যা ছিল চরম অদূরদর্শিতা ও আত্মঘাতি। যার মূল্য তারা এখন কড়ায় গণ্ডায় দিচ্ছে। নেতাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা এখন আত্মাহুতি দিয়ে চলেছে।
যে পাঠক এই উদ্ধৃতিটি আমাকে পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে লেখক ২০০৪ সালে বিএনপি সম্পর্কে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাকে আমি চিনি কিনা। বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য শেখ হাসিনার চেষ্টার অন্ত নাই। এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা আংশিক সফল তো বটেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি এই লেখকের যুক্তি মানি কিনা, আর যদি মানি তাহলে এখন কীসের যুক্তিতে বলছি নির্বাচনী দল হিসাবে বিএনপির দুর্বল হবার সম্ভাবনা নাই?
আসলে প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে টের পেলাম লেখাটি আমিই লিখেছিলাম। ‘র্যাব ও আমাদের অসুখ’ শিরোনামে সেটা দুইহাজার চার সালের ১ নভেম্বর তারিখে দৈনিক প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। এরপর র্যাব নিয়ে সেই সময় সমাজে যেসকল বিতর্ক চলছিল তা নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে আবার দুই হাজার চার সালের ১৩ নিভেম্বর ‘র্যাব বিতর্ক’ শিরোনামে আরেকটি লেখা লিখি। সেই লেখায় সেই সময় যারা র্যাবের বিরোধিতা করছিলেন তাদের সঙ্গে আমার চিন্তা ও বিশ্লেষণের পার্থক্য ব্যাখ্য করেছি।
সেই সময় র্যাব বিরোধিতার ধারার মধ্যে মানবাধিকার রক্ষার জন্য সক্রিয় এনজিওগুলোর বিরোধিতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘নীতিগত’ মনে হলেও তাদের অবস্থান ছিল বিমূর্ত ও অস্পষ্ট ব্যাক্তি-অধিকারের জায়গা থেকে। তারা ব্যাক্তির অধিকার চায়, কিন্তু যে রাষ্ট্র ব্যাক্তির অধিকার হরণ করে তার রূপান্তর চায় না। তাদের অবস্থান তাই ভালোমানুষি প্রতিক্রিয়ার অধিক কিছু ছিল না। অবশ্য যদি আমরা সেই সময়ের মানবাধিকার রক্ষাকারী এনজিওগুলোর কঠোর সমালোচনা করতে না চাই তাহলে তাদের প্রশংসা করাই যায়। কিন্তু রাজনৈতিক ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে তাদের চিন্তার পশ্চাতপদতা ছিল বিস্ময়কর। ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্ন সরাসরি বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন -- সেই সময়ের সামনের সারির এনজিওগুলোর মধ্যেও এই উপলব্ধির মারাত্মক ঘাটতি ছিলো। এখনও উপলব্ধির অভাব মিটেছে বলা মুশকিল। এই দিক থেকে এনজিওগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল অরাজনৈতিক এবং পরাশক্তির অর্থপুষ্ট। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিরোধিতার সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্ন কিভাবে জড়িত তারা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়াতারা জরুরী মনে করে নি। আইনবহির্ভূত ভাবে কোন নাগরিককে হত্যা করলে রাষ্ট্র কিভাবে নিজের অস্তিত্বমান থাকবার নৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করে সে ব্যাপারেও তাদের কোন ধারণা ছিল না। তারা ব্যাক্তির অধিকারের দিক থেকে বিষয়টিকে খুবই সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখছিল। মুখে বলেছেন চরম সন্ত্রাসীরও আইনী প্রক্রিয়ায় সুবিচার পাবার অধিকার আছে। কিন্তু এই এই ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান অনেকেরই ছিল না যে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যে অবিচারের সকল শর্ত নিহিত রয়েছে। একে না বদলালে মানবিক অধিকারের দাবি সোনার পিতলা কলস ছাড়া কিছু না। যারা আগ্রহী তারা আমার লেখাগুলো আবার পড়ে দেখতে পারেন।
এই উপলব্ধির অভাব বা অজ্ঞতার ফল ছিল জোট সরকারের জন্য মারাত্মক। বাংলাদেশের নীতিহীন নৈতিকতাবর্জিত দলীয় বিভাজনের রাজনীতি এনজিওদের মধ্যেও প্রকট। তারা একে ব্যবহার করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বিরোধিতার অস্ত্র হিসাবে। তাদের র্যাব বিরোধিতা হয়ে গিয়েছিল আওয়ামি লীগকে ক্ষমতায় আনবার প্রকল্প। সংবিধান ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর নয়। তারা গণ বিরোধী ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কাঠামো বহাল রেখে সেখানে শেখ হাসিনার আওয়ামি শাসনেরই অভিষেক ঘটিয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে তারা সফল এবং আমাদের অতি চড়া মূল্যে তার দাম দিতে হচ্ছে।
বিএনপি যদি অপারেশান ক্লিন হার্ট, তারপর ‘র্যাট’ এবং শেষমেষ 'র্যাব' বানাবার কারণে সমালোচিত হয় তো সে সমালোচনা সঠিক। আলবৎ। কিন্তু সেই সময় সুশীল সমাজের র্যাব বিরোধিতা ছিল আরও এক কাঠি সরেস। জোট সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা তার একটি দিক মাত্র। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে কাজ করা এনজিওগুলোর প্রধান রাজনৈতিক ভুমিকা ছিল প্রথম আলো-ডেইলি স্টার-সিপিডির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসাবে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অভ্যূত্থান সফল করবার পথ সাফ করা। অর্থাৎ শুধু বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যূত করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, তারা বাংলাদেশে পরাশক্তির হস্তক্ষেপও নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এদেরই ফর্মুলার নাম, ‘মাইনাস টু’। টার্গেট শুধু খালেদা জিয়া নয়, শেখ হাসিনাকেও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করা। কেউ কেউ সেই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও বনেছিলেন। তারা মানবাধিকার কর্মী হয়েও সন্ত্রাসদমনের জন্য ইসলামপন্থিদের দমন নিপীড়নের পক্ষপাতি ছিলেন। এখনও আছেন। ওয়ার অন টেররের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে ইসলামি সন্ত্রাস দমন করবার জন্য র্যাবের ব্যবহারে তাদের অনেকের আপত্তি ছিল না। মানবাধিকার কর্মী হয়ে ইসলামী সন্ত্রাস দমনের নামে তারা ইসলামপন্থিদের মানবাধিকার হরণ করবার ক্ষেত্রে নীরবই থেকেছেন। আজকের বাংলাদেশ তারই পরিণতি।
এবার বিএনপি ও জামায়াত নিজেদের কবর নিজেরা কিভাবে খুঁড়েছে তার আরেকটি দিক ব্যাখ্যা করা যাক। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ( পড়ুন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ) অধীনে র্যাব ধরণের এলিট বাহিনী বানাতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে নৈতিকতা ও সাহস নিয়ে একজন সৈনিক সৈনিকতার মর্যাদা সমুন্নত রাখে সেটা হচ্ছে শত্রুপক্ষের সৈনিকের বিরুদ্ধে লড়াই করা, কোন নিরস্ত্র ব্যাক্তিকে হত্যা করা নয়। কিন্তু র্যাবে সৈনিকরা শিক্ষা পেয়েছে নিজ দেশের নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা। তাও আবার সাজানো নাটকে নিরস্ত্র ব্যাক্তিকে খুন করা শিখছে তারা। নারায়নগঞ্জের সাতখুনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এখন অনেকে চুক্তিতে হত্যার কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর নৈতিকতার ওপর এসবের কুফল পড়বে মারাত্মক ভাবে। সেনাবাহিনীর নৈতিক মনোবলকে তা কতোটা নীচে নামিয়ে এনেছে তা বাইরে থেকে আমাদের বোঝা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও এই ধরনের ঘটনা ম্লান করেছে, সন্দেহ নাই। যারা অফিসার হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত কিম্বা র্যাবের সদস্য তারা আবার মেয়াদ শেষে ফিরে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীতে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাবাহিনীর মধ্যে এর কুফল রয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমরা তা জানতে পারছি না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাবি উঠেছে বাংলাদেশ শান্তি বাহিনীতে এমন কোন ব্যক্তি থাকতে পারবে না যিনি র্যাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করেছিলেন। কারণ তিনি মানবাধিকার লংঘনের অপরাধী হতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত অবিলম্বে র্যাব বিলুপ্ত করা।
হিউমেন রাইটস ওয়াচ র্যাবকে ‘ঘাতক বাহিনী’ বলে প্রতিষ্ঠানটির বিলুপ্তির দাবি আগেই তুলেছে। যে কোন মানবাধিকার কর্মী তা সমর্থন করবে। কিন্তু পাঠক আশা করি আমার যুক্তির ভিন্নতা খেয়াল করবেন। অর্থাৎ আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যাবের বিচার একটা দিক মাত্র। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকেও বিষয়টিকে বুঝতে হবে। আইন শৃংখলা বাহিনীর ওপর এর প্রভাব হতে পারে সর্বগ্রাসী। র্যাবের সদস্য হিসাবে সৈনিকরা সৈনিকতার নীতি থেকে বিচ্যূত হয়ে ফিরে যাচ্ছে সেনাবাহিনীতে। নৈতিক অবক্ষয়ের এই সর্বগ্রাসী কুফল প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুরা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক ভিত্তিকে ক্ষয়ে দিতে পারে। সেনাবাহিনীর নৈতিক ভিত্তির সর্বনাশ ঘটানোর প্রক্রিয়া এবং সর্বোপরী রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থে এই ধরণের বাহিনী গঠন ও ব্যবহার বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকি। বিএনপি-জামায়াত জোটের র্যাব গঠনের সিদ্ধান্ত যে বিপদে দেশকে ঠেলে দিয়েছে তার লগি ও বৈঠা এখন ঠেলছেন শেখ হাসিনা এবং তাঁর আওয়ামি লীগ। বিএনপি-জামায়ত ভেবেছিল র্যাব গঠন করে ওয়ার অন টেরর বাস্তবায়ন করবার দায়িত্ব নিয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের আনুকুল্য লাভ করবে। কিন্তু সেটা ছিল একটি অসম্ভব ও অবাস্তব কল্পনা। যার মূল্য আজ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি উভয়কেই করুণ ভাবে দিতে হচ্ছে। জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পাশ্চাত্য শক্তির তোষণই বিএনপি ও জামায়াত উভয়েরই বর্তমান দুর্বলতার প্রধান কারন।
তাহলে বিএনপি ও জামায়াতকে হুঁশে আসতে হবে। বুঝতে হবে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর যে দমন নির্যাতন চলেছে তার পথ ও পদ্ধতি তারা আগেই তৈয়ার করে রেখেছে। আইন শৃংখলা বাহিনী বিশেষত র্যাবকে এখন বিরোধী দল দমন পীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের শর্ত গত বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের কারণেই ঘটেছে। নিজেদের কর্মদোষের ফলইীখন বিএনপি-জামাতকে ভোগ করতে হচ্ছে। এখানে ভাল দিক হচ্ছে খালেয়া জিয়ার উপলব্ধির পরিবর্তন। র্যাব গঠন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর জোটের দমন নীতির দৃঢ়তা ও সফলতার গীত গাইতে গিয়ে আগে যেভাবে র্যাবের ভুমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন, এখন সেই অবস্থানে তিনি নাই। তিনি নিজেই এখন র্যাবের বিলুপ্তি চাইছেন। দেরি – খুবই দেরি হলেও সেটা খারাপ কি? বলটা তিনি এখন শেখ হাসিনার কোর্টে ঠেলে দিলেন, দেখা যাক শেখ হাসিনা কি করেন।
আমি আগেও বলেছি, (এখানে দেখুন) আবারও বলেছি বাংলাদেশের রাষ্ট্র কিম্বা রাজনীতির কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটাবার সাধ্য বিএনপির নাই। তবে বর্তমান বিএনপি থেকে আওয়ামি সমর্থক বা আওয়ামি লিগের রাজনীতি যারা করে তারা নিজেরা বের হয়ে গিয়ে নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শনের আগে খালেদা জিয়া তাদের বের করে দিলে দলটি শক্তিশালী হবে, এটা আমি মনে করি। এরা আন্দোলনের সময় ভেতর থেকে অন্তর্ঘাতমূলক ভূমিকা রেখেছে, নির্বাচনের সময়ও এরা নতুন আপদ হিসাবে দেখা দেবে। বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতি করতে চায়, করুক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী ঘটে সেটা ভবিষ্যতই বলবে।
বিএনপিতে আছে, অথচ রাজনীতি করে আওয়ামি লীগের, এদের চেনা সোজা। এরা র্যাব নিয়ে কোন কথা বলবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পরিস্থিতিতে বিএনপিকে একটা অসম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে সেটা বলবে না; বিএনপির বিরুদ্ধে প্রথম-আলো-ডেইলিস্টার-সিপিডি ও মানবাধিকার এনজিও ও সুশীল সমাজের ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ তত্ত্ব ও তৎপরতার কথা কিছু বলবে না এরা অতীতে বিএনপির দুর্নীতি সম্পর্কেও কিছু বলবে না। আওয়ামি লীগের কাছে থেকে তারা একটা কথাই শিখেছে সে্টা হোল জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি ভুল করেছে। যারা এই কথা বলে তারাই আওয়মি লিগার। এদের দল করে বের করে দেওয়া খালেদা জিয়ার জন্য জরুরী, নইলে ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি খাদ তিনি খুঁড়ে রাখবেন। বাকি তাঁর ইচ্ছা। আবারও আগের লেখার মতো দশ বছর পরে কোন পাঠক আমাকে মনে করিয়ে দেবার জন্য দলিল হিসাবে লিখে রাখলাম।
দুই
শেষ করবার আগে রাজনৈতিক দল গুলোর বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের প্রপাগান্ডার আরেকটি দিক সম্পর্কে দুই এক কথা বলে শেষ করব।
প্রায়ই সুশীলদের অভিযোগ শুনি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন গণতন্ত্র নাই। একটু খেয়াল করবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তরের প্রশ্নে দুই একজন ছাড়া এদের বক্তব্য নাই বললেই চলে। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে আলাদা কিছু নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র ক্ষমতা ও ব্যবস্থার কোন রূপান্তর হোলনা, কিন্তু রাজনৈতিক দলের মধ্যে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ চর্চা করতে হবে এর চেয়ে থার্ড ক্লাস, বাজে ও চক্রান্তমূলক প্রপাগাণ্ডা আর কিছুই হতে পারে না। জনগণ যতক্ষণ অবধি রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র কাঠামোর রূপান্তর নিয়মতান্ত্রিক কিম্বা গণতান্ত্রিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারবে না ততোদিন তারা ব্যাক্তির ক্যারিসমা, ব্যাক্তির ভাবমূর্তি – অর্থাৎ ব্যক্তির ভূমিকার ওপরই নির্ভর করবে। আমরা পছন্দ করি বা না করি বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় বিএনপি মানে খালেদা জিয়া, আওয়ামি লিগ মানে শেখ হাসিনা। অবাস্তব কথা বলে লাভ নাই। সকল সিদ্ধান্ত তারা একাই নেন। আলবৎ। যেখানে সাংবিধানিক ভাবে একনায়কতন্ত্রকেই আমরা বহাল রেখেছি, প্রধান মন্ত্রীর হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রেখেছি -- তখন দুই বৃহৎ জাতীয় দলের নেতা হিসাবে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনাই তো সিদ্ধান্ত নেবেন। তাই না? তো নেবেটা কে? জনগণ ভুল করছে না। তারা এই বাস্তবতায় ব্যাক্তির পেছনেই দাঁড়ায়। আরও দীর্ঘদিন দাঁড়াবে। যে কারণে ‘মাইনাস টু’ সফল হয় নি। সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার গুণগত পরিবর্তন না হলে ‘দলের মধ্যে গণতন্ত্র নাই’ কথাটা অর্থহীন ও বিমূর্ত।
সুশীলদের বলি, এহ বাহ্য। আসল কথা বলুন। আপনি সুশীল, তো বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (constitution) ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আপনি চান কি? গণতন্ত্র কায়েম হবার পর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। গণতন্ত্র কায়েমের ক্ষেত্রে --- নিদেন পক্ষে ধারণাটিকে বুঝবার ও জনগণকে বুঝিয়ে বলার ক্ষেত্রে আপনার অবদানটা কোথায়? গণতন্ত্র নাই, সেটা চাইবেন না, অথচ রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন নাই গণতন্ত্র নাই বলে অভিযোগ করছেন। চান কেন? তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কি ফায়দা হবে? নির্বাচন কি গণতন্ত্র কায়েম করে? যদি গোড়ার কথা না বোঝেন কিম্বা বুঝেও না বলেন, অথচ দলের মধ্যে গণতন্ত্র নাই বলে চিৎকার করতে থাকেন তখন তার একটা আলাদা রাজনৈতিক মানে দাঁড়ায়। সেটা একটু বুঝিয়ে বলি।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠার প্রধান কারণ বুদ্ধিজীবিতার দুর্দশা – অর্থাৎ রাজনীতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি বোঝে এবং জনগণকে সহজ ভাষায় বোঝাতে পারে এই ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভাব। যে কারণে দৈনিক যুগান্তরে গত সপ্তাহের লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আয়নায় মুখ দেখা’। বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ(!)-কেই বলেছিলাম দয়া করে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখুন। আপনারা খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনার চেয়ে ভাল কোন নেতা পাবার যোগ্য নন। জনগণ এদেরই চেনে। এদের কথাতে ভোট দেয়। এবার একজনকে পছন্দ না হলে আগামি বছর রাগ করে আরেকজনকে ক্ষমতায় বসায়। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ধৈর্য ধরে রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণতন্ত্র সম্বন্ধে শিক্ষার বিস্তার। সহজ কোন শর্টকাট পথ নাই। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা হয় না বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নাই বলার চেয়ে চরম মূর্খতা আর কিছু হতে পারে না। যেখানে বুদ্ধিজীবিরাই মনে করে গণতন্ত্র মানে নির্বাচন, সেখানে জনগণ গণতন্ত্র যে আসলে রাষ্ট্রের একটি ধরণ, ক্ষমতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং জনগণের ক্ষমতা চর্চার আবশ্যিক কাঠামো এই সকল প্রাথমিক ধারণাগুলো পাবে কোথায়?
আর, মাইণ্ড ইট, পাশ্চাত্যে গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে বৈপ্লবিক পথে – হিংসা ও রক্তপাতের স্রোত বেয়ে। কিন্তু আপনারা এতোই অহিংস যে মনে হয় আমরা এখনও ঘাস খাই। কিন্তু আমরা কি জনগণকে গণতন্ত্র কায়েমের ইতিহাস বলি? বলি না। তাই তারাও মনে করে পাঁচ বছর পরে ভোট দিতে পারছি – এটাই গণতন্ত্র।
কিন্তু দলের মধ্যে গণতন্ত্র নাই বলার অর্থ দলের মধ্যে বিশৃংখলা ও পরদেশী হস্তক্ষেপের শর্ত তৈরি করা। এই দাবিটা করা হয় দলের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের অন্তর্কলহ, কোন্দল ও ক্ষমতার দ্বন্দের বাহ্যিক অভিপ্রকাশ হিসাবে। নেত্রী যাদেরকে যে কারণেই হোক দলে এক ঘরে করে রেখেছেন তারা তাদের পক্ষে ক্ষমতার পরিসর বাড়াবার জন্য এইসব কথা বলে। এসব প্রচার প্রপাগাণ্ডা চালায়, সুশীল বা বুদ্ধিজীবীদের ভাড়া করে। বিদেশি শক্তি বা পরাশক্তি বিভিন্ন গ্রুপ বা চক্রের মধ্য দিয়ে সবসময়ই বড় দলগুলো থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য নানান তৎপরতা চালায়। ‘দলের মধ্যে গণতন্ত্র নাই’ বলার অর্থ নেতা বা নেত্রী যাদের কথা এখন নীতি নির্ধারণের জন্য শুনছে তাদের প্রভাব খর্ব করার জন্য তাদের বাদ দিয়ে যারা ক্ষমতা থকে বঞ্চিত ওদের কথা শোনার আবদার। সাধারণ মানুষের এইসব চাতুরিতে ভোলার কোন কারণ ঘটে নি। তাদের কাছে এটা কোন ইস্যু নয়। খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনা জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের কোন প্রতিধ্বনি ঘটাতে পারছেন না সেটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বস্তবতায় গুরুত্ব। ব্যাক্তির ক্যারিসমা বা ভাবমূর্তি টপকিয়ে আমরা নতুন পর্যায়ে পৌঁছে যাব এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে এখনও ঘটে নি।
এ কারণে বিএনপি র্যাব গঠনের মতো নিজের কবর নিজে যদি বর্তমানে ও ভবিষ্যতে না খোঁড়ে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দলটির হারিয়ে যাবার বা ম্রিয়মান হবার সম্ভাবনা নাই। কারন বিএনপি বলতে জনগণ বেগম খালেদা জিয়াকেই বোঝে। এই দল থেকে কেউ বেরিয়ে গেলেও বিএনপি বিএনপিই থাকে। আওয়ামি লীগের ক্ষেত্রেও একই কথা। যারা বেরিয়ে যাবার কথা ভাবছে, তারা যতো তাড়াতাড়ি বহর্গত হয় ততোই সেটা বিএনপির জন্য মঙ্গল। এর ভূ্রি ভূরি প্রমাণ অতীতে আমরা দেখেছি। আগামিতে দেখার জন্য আমি সানন্দে বসে আছি।
এইসব বাদ দিয়ে আসুন সকলে গোড়ার কথা বলি। কিভাবে নতুন ভাবে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা যায়। এর মীমাংসার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে কোন দল থাকবে কোন দল ইতিহাস বইয়ের অক্ষর হয়ে যাবে তা নির্ধারিত হবে। আর কোন শর্টকাট রাস্তা নাই।
৩১ জুলাই ২০১৪। ১৬ শ্রাবণ ১৪২২ শ্যামলী।