দুই হাতেই তালি বাজুক


পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিকদের প্রধান বাজার বাংলাদেশ। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের বাজার রক্ষার খাতিরে বাংলাদেশের তোষামোদ করা তাদের জন্য জরুরী। এটা কোন খারাপ অর্থে বলছি না, ভাল অর্থেই বলতে চাইছি। বাজার ব্যবস্থার চরিত্রের কারণেই তোষামোদি দরকার হয়ে পড়ে। বাজার ব্যবস্থার ‘অদৃশ্য হাত’ তার প্রণোদনা। বাংলাদেশের পাঠক বা বই ভোক্তাদের নিজের প্রতি আগ্রহী করে রাখার ওপর পশ্চিম বাংলার লেখকদের বইয়ের বেচাবিক্রি অনেকাংশেই নির্ভর করে। তোষামোদির দরকার সেই কারণেই। বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলার লেখকদের গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে নিজের বইয়ের বাজার সুরক্ষার প্রশ্ন জড়িত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকেই বাংলাদেশের প্রতি সে কারণে অনেক সদয় মন্তব্য করেছেন। বাজার ব্যবস্থায় তোষামোদি জায়েজ, অন্যায় কিছু নয়। লেখকদেরকেও বাজার সম্প্রসারণ প্রতিনিধি হতে হয়। বাজারের এতোই মাহাত্ম।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার রবীন্দ্র সদনের একটি অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাঠকদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু পাঠকরা অনেক বেশি মৌলবাদী’ (দেখুন বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। এটাও তোষামদি। তুলনা করে বলতে চাইছেন হিন্দু পাঠ্কদের চেয়ে বাংলাদেশের পাঠক ভাল। আর এটা তো জানা কথাই যে তাদের অধিকাংশই মুসলমান। তারা সমরেশ মজুমদারের বই যখন পড়েন তখন তিনি হিন্দু নাকি মুসলমান সেই বিচার করেন না। তিনি ভাল লিখলেন কিনা, বইটি উপভোগ্য কিনা বাংলাদেশের পাঠক সেইসব বিচারই করে। এটাই তো পাঠকের আদর্শ হওয়া উচিত। নাকি? কিন্তু পশ্চিম বাংলার হিন্দু পাঠকরা এটা করে না। তারা বই পড়তে গিয়ে আর পাঠক থাকে না। হিন্দু হয়ে যান। খুবই আফসোসের ব্যাপার।

সমরেশ মজুমদার কলকাতার পাঠকদের বাংলাদেশের পাঠকদের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে ‘মৌলবাদী’ বলেছেন। (বলা বাহুল্য, তিনি ব্যাতিক্রমের কথা বলেন নি, তবে নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রম আছে)। হিন্দু জাতের দিক থেকে যে বর্গেরই হোক যদি নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য বা সনাতন চিন্তার মৌল ভিত্তির দাঁড়াতে চেষ্টা করে তাতে তো দোষের বা নিন্দার কিছু নাই। সেটা সমস্যা তৈরি করে না, তা নয়। যদি তা মতের গোঁড়ামি হয়ে ওঠে তাহলে সেটাও মুশকিলের। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। সমরেশ মজুমদার আসলে ‘মৌলবাদ’ বলতে সাম্প্রদায়িকতা বুঝিয়েছেন। বাংলাভাষী ভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবনচর্চা থেকে উঠে আসা শব্দ, ধারণা, লেখালিখির প্রতি পশ্চিম বাংলার পাঠকদের অস্বস্তি, বিতৃষ্ণা বা বিদ্বেষ, ইত্যাদি। যারা অধিকাংশই হিন্দু। এটা ঠিক মৌলবাদ নয়, সাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম, আচার বা সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাভাষী ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষার প্রতি অস্বস্তি। তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের শব্দগুলো পাঠ করলে ‘অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া’ ঘটা।

সমরেশ মজুমদার বলছেন, “আমাদের বই যখন বাংলাদেশের পাঠকরা হাতে পান, তখন তারা বিচার করেন না- এটা কোন ধর্মের লেখক। তারা বিচার করেন এটা পাঠযোগ্য কিনা, কাহিনী তার ভালো লাগছে কি না, কিংবা পড়তে তার আরাম লাগছে কি না। কিন্তু বাংলাদেশের লেখকদের বই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু পাঠকরা আম্মা, ফুপা, নামাজ এইশব্দগুলো যখন দেখতে পায়- তখন তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এবং এই প্রতিক্রিয়ার কারণেই বাংলাদেশের অনেক লেখকের বই এখানকার পাঠকদের কাছে পৌঁছে না। আমি পরিষ্কার করে বলছি, বাংলাদেশের পাঠকদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু পাঠকরা অনেক বেশি মৌলবাদী। এই ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে যদি বলতে হয় তবে বলব, আমরা অনেক বেশি মৌলবাদী, আমাদের পাঠকরা অনেক বেশি মৌলবাদী। আমাদের পাঠকরা গ্রহণ করতে পারছেন না...পশ্চিমবঙ্গের যারা মুসলমান লেখক ছিলেন, যেমন মুস্তাফা আলী সিরাজ সাহেব ছাড়া এখানকার পাঠকরা কয়জনকে গ্রহণ করতে পেরেছেন। হ্যাঁ যাদের গ্রহণ করতে পেরেছেন তাদের লেখায় ওই সব মুসলিম শব্দগুলো নেই। ফলে ওদের বই এখানে (পশ্চিমবঙ্গ) এসে পাইরেসি হবে এই সম্ভাবনা খুবই কম”।

তাঁর কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাই পত্রিকায় যেভাবে এসেছে সেভাবেই টুকে দিলাম। হয়তো আরও কথা বলেছেন। ‘মুস্তাফা আলী সিরাজ’ নামটা তিনি উচ্চারণ করেছেন নাকি পত্রিকার রিপোর্টিং-এর গোলমাল জানি না। তবে নামটা নিশ্চয়ই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (১৯৩০-২০১২) হবে। পশ্চিম বাংলা ইসলামী নাম উচ্চারণ ও বর্ণীকরণের ক্ষেত্রে যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে এটা তারই আরেক নজির কিনা জানিনা। আশা করি এতো বড় ভুল নিজ দেশের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক সম্পর্কে সমরেশ মজুমদার করবেন না।

কলকাতার হিন্দু পাঠকদের সাপ্রদায়িকতা বিষয়ে শুধু সমরেশ মজুমদারের কাছে নয়, পশ্চিম বাংলার অন্যান্য লেখকদের কাছ থেকেও জানার আরও আগ্রহ রইল। তিনি বইয়ের পাইরেসি নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি চান পশ্চিম বাঙলার বই বাংলাদেশে বে-আইনী মুদ্রণ বন্ধ হোক। পাইরেসি বা বে-আইনী ছাপা হলে তাঁরা তাঁদের বইয়ের রয়ালটি পান না। সত্যি কথা। স্রেফ ব্যাক্তিস্বার্থেই তিনি কথাগুলো বলেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম বাংলার লেখক হিন্দু কিনা সেটা বিচার করে বই পড়েন না, এটা ব্যবসায়িক দিক থেকে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। নিজের স্বার্থের জায়গা থেকেই কথাগুলো বলা। বাংলাদেশীদের তোষামুদির কারন লেখক হিসাবে তাঁর ব্যাক্তি স্বার্থ। টাকাপয়সা পাওয়ার আকুওতি ও না পাবার বেদনা। আমরা তা বুঝি। ফলে তোষামুদিতে আমাদের আপত্তি করার কারন নাই।

দুই

কিন্তু এর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক আছে। তার প্রভাব ও পরিণতি সুদূরপ্রসারী। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও দিল্লীর আধিপত্য থেকে সীমান্তের দুই পাশের বাংলাভাষী শুধু নয়, সারা দুনিয়ার বাংলাভাষীদের মুক্ত করার প্রশ্ন জড়িত। হিন্দু বাঙালির প্রকট সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশীদের খুবই পরিচিত। এখানে নতুন কিছু নাই। বাঙালি মুসলমান ধর্মে মুসলমান বটে, ধর্ম প্রাণও হতে পারে, নিজেকে সে ধর্ম নিরপেক্ষ বা বাঙালি বলে গলা ফাটিয়ে দাবিও করে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে হিন্দুর বই পড়ব না, এই কাজটা সে করে না। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা নাই, তা নয়। কিন্তু তার ক্ষেত্র অন্যত্র ও প্রকাশ ভিন্ন। কিন্তু হিন্দু লেখক যখন তার নিজ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ধর্মাচরণ, আচার ঐতিহ্যের বর্ণনা করেন তখন তা পড়তে অস্বস্তি বোধ করে না। এটা তো ভাল, যে পাঠক হিসাবে সে বাঙালির আরেকটি জগত সম্পর্কে জানতে পারছে। কিন্তু বাঙালি হিন্দু পাঠক নিজেকে বাঙালি বলে হয়তো গলা ফাটিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রমাণ করছে নিরন্তর, কিন্তু যখন লেখায় ‘আম্মা, ফুপা, নামাজ এই শব্দগুলো যখন দেখতে পায় - তখন তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়’। পশ্চিম বাঙলার এই হিন্দু মনকে বাংলাদেশের মানুষকে আরও সতর্কতার সঙ্গে ও গভীর ভাবে বোঝা উচিত। ধর্ম ও আচারের পার্থক্য থাকার পরেও ‘বাঙালি’ নামে যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের মানুষ গড়ে তুলতে চায় সেখানে হিন্দু অন্তর্ভুক্ত। ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে আলাদা হতে পারে, কিন্তু বাঙালি হিসাবে তাকে সে বাঙালি সমাজের বাইরের বলে গণ্য করে না। সেটা বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে সে হিন্দুর ধর্ম, আচার, সংস্কৃতির সরব উপস্থিতিওকে স্বাভাবিক বলেই মনে করে। কোন অস্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু পশ্চিম বাঙলার হিন্দু সম্পর্কে একথা বলা কঠিন। সমাজ বা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি দূরের কথা – সাহিত্যের মতো উদার ক্ষেত্রেও এই হিন্দু শক্ত দেয়াল তুলে রেখেছে। আশ্চর্য!

সাম্প্রদায়িকতার এই ধরনের মোকাবিলা তুলনামূলক ভাবে কঠিন এ কারণে যে এই সাম্প্রদায়িকতা বাইরে দিকে বাঙালিত্ব এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। অতএব প্রতিটি বাংলাভাষীকেই তার বিরুদ্ধে লড়াই দরকার। সমরেশ মজুমদারের কথা থেকেই পরিষ্কার কলকাতার বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের সাম্প্রদায়িকতা কিভাবে তাদের সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এটা শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ তাতো নয়। তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনোইতিক প্রকাশ আছে। কিন্তু তারপরও অভিনন্দন জানাই যে এদিকে আস্তে আস্তে নজর পড়ছে। এই উপলব্ধিগুলো কলকাতার জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ প্রীতি আমরা জানি। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কোন পর্যবেক্ষণ ছিল কিনা জানি না। আমার চোখে পড়ে নি। আমি এই পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিকে হালকা ব্যাপার বলে মনে করি না। বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিম বাংলার গায়ক-কবি কবির সুমনের শুভেচ্ছাও অনেক বড় ব্যাপার। এ ব্যাপারে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও বক্তব্য আমি দেখেছি। এদের আমরা জানি, সমরেশ মজুমদার সম্ভবত নতুন যোগ হলেন।

রাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিম বাংলার বাঙালী আর বাংলাদেশের বাঙালী এক নয়। উনিশশ পাঁচ সালে কার্জনের বাঙলা ভাগ থেকে সেই পার্থক্যের সূচনা। সাতচল্লিশের দাঙ্গা ও দুই দেশে দুই পৃথক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির আবির্ভাব সেই বিভক্তিকে দৃশ্যমান করে তুলেছিল। এরপর এলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দিল্লীর জন্য রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত করবার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। ‘বাঙালি’ নামক রাজনৈতিক বর্গটি সীমান্তের দুই পাশেই সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ছিল তার কারণ। সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় পশ্চিম বাংলায় রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ে রূপান্তরিত হতে পারে এই সম্ভাবনা দিল্লীর জন্য বিপজ্জনক মনে হয়েছিল। যদি বাংলাদেশের বাঙালি আর পশ্চিম বাংলার বাঙালি নিজেদের একই ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী মনে করে, ধর্ম তাদের তখন আর আলাদা রাখতে পারে না –দিল্লীর এই উৎকন্ঠা অযৌক্তিক ছিল না। সেই অবস্থায় ধর্ম জাতীয়তার নির্ধারকও থাকতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যা চোখের সামনেই প্রমাণ করছিল। একাত্তরে সীমানের ওপাশেও সেই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশের বাঙালিরা এই ক্ষেত্রে নিজেদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রমাণ করতে হয়েছে ইসলাম তাদের ধর্ম বটে কিন্তু তারা বাংলাভাষী ও বাঙালী।

কিন্তু পশ্চিম বাঙলার হিন্দুর কাছে তার ধর্ম পরিচয় বড় নাকি ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বড় তুলনায় সেটা আজ অবধি প্রশ্নবোধক হয়েই রইল। কেন সেটা বুঝতে হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পশ্চিম বাংলার হিন্দু কিভাবে একান্তই হিন্দুর সাহিত্য হিসাবে আগলে রাখে সেটা আমাদের বোঝা দরকার। সেখানে মুসলমানদের আম্মা, ফুপা, খালা ইত্যাদির প্রবেশাধিকার নাই। এর সঙ্গে যুক্ত বাংলা ভাষা থেকে আরবি ফারসি শব্দ তাড়িয়ে দেওয়া। বাংলাভাষা থেকে আরবি, ফারসি শব্দ বিতাড়ন বাংলা সাহিত্যের জমি হিন্দুর অধীনস্থ রাখবার প্রাণান্তকর চেষ্টায় পর্যবসিত। একাত্তরের পর সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখা স্রেফ হীনমন্যতা। পশ্চিম বাংলার খুবই করুণ অবস্থা। বলা বাহুল্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কি থাকবে আর থাকবে না সেটা সাহিত্যের প্রসাদ্গুণ দিয়েই নির্ধারত হবে। হচ্ছেও তাই। সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সেই ক্ষেত্র করে তুলতেই হবে যেখানে সকলে একসঙ্গে বসবাস বসবাস শিক্ষা করে ও বসবাস করে। কো দেয়াল তোলে না। এই রাজনৈতিক সংকল্প থেকেই ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে হিন্দুয়ানি শব্দ বলে কোন শব্দ বাদ দেওয়ার কথা আমরা ভাবি না। যারা করে তাদের নিন্দা করি। তবে পশ্চিম বাংলার সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বপনা আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যেও আছে – যারা আরব ও ফারসি শব্দের প্রতি বিরাগ ও বিদ্বেষ পোষণ করেন। তাদের অবশ্য আমরা চিনি। সব সমাজের এই রকম বিরক্তিকর উপাদান থাকে।

তবে একাত্তরে পশ্চিম বাংলার মানুষের ভালবাসা ও আন্তরিকতা ছাপিয়ে বাংলাদেশীদের এই উপলব্ধি ঘটেছিল যে কলকাতার ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙালিত্ব বা বাঙালিপনা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদের বঙ্গীয় সংস্করণের অধিক কিছু হয়ে ওঠে নি। পশ্চিম বাংলা দিল্লীর পরাধীন। সেই পরাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য দাবি করুক, এটা বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে না। কারন ইতিহাস ও বাস্তবতা অনেক জটিল বিষয়। আমরা কুতর্ক করতেই পারি যে ভাষা ও সংস্কৃতি যদি জাতিবোধের ভিত্তি হয় তাহলে ‘বাঙালি’ সীমানের দুই পাশে বিভক্ত হয়ে থাকবে কেন? তাদের তো একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত হওয়াই সমীচিন। কিন্তু এই তর্ক আমাদের কোথাও নেবে না। পশ্চিম বাংলার মন ও মনন বোঝাটাই বরং বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পার্থক্য চিহ্নিত করবার সঙ্গে মৈত্রীর জায়গা গুলোও আমরা শনাক্ত করতে পারি। সমরেশ মজুমদারের স্তরের একজন লেখক যখন পার্থক্যের কথাটি তোলেন তখন বাংলাদেশের পক্ষে ভাবতে সুবিধা হয়।

ইতিহাসে নজর দিলে দেখি একাত্তরে দিল্লীর ভয় কেটে যেতে অসুবিধা হয় নি। পশ্চিম বাংলার বাঙালির কাছে হিন্দু ভারতই আদর্শ এটা বুঝতে দিল্লীর দেরি হয় নি। পশ্চিম বাংলার মনে ও মননে নিজেদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তি ভাষা কিম্বা সংস্কৃতিতে নয়। তার ভিত্তি ধর্মে। ধর্মীয় জাতীয়তায় – হিন্দু জাতীয়তাবাদে। বং ভঙ্গে তার উনেষ ঘটেছিল, সাতচল্লিশে সেটা স্পষ্ট রূপ নিল। তারপর বাঙলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তোড়ে সেটা একদমই অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। বেশ তো সময় পার হোল। এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই দিকগুলো স্পষ্ট এবং যারপরনাই খোলাসা । সমরেশ মজুমদারকে অভিনন্দন তার মন্তব্য এই দিকটা বুঝতে আমাদের খুব সহায়ক হবে।

বাংলাদেশে এটা আমরা বুঝি যে একাত্তর যদি তথাকথিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ নামক জাতীবাদী ধারণার ইন্তেকালের বছর হয়ে থাকে তাহলে তা একই সঙ্গে অখণ্ড ভারততত্ত্বের মহাপ্রয়ানের বছরও বটে। উপমহাদেশে বাঙালি যদি আলাদা জনগোষ্ঠি হিসাবে একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে তাহলে মণিপুরী, অহমিয়া, নাগা, কাশ্মিরী, পশ্চিম বাংলা, কামতাপুরিসহ প্রতিটি জাতিগোষ্ঠিরই আলাদা রাষ্ট্র কায়েম করবার দাবি ন্যায্য। স্বাধীন সার্ভভৌম বাংলাদেশ দিল্লীর জন্য এই বিপদ তৈরি করেছে। শুধু নিরাপত্তার দিক থেকে বিচার করলে আমরা বুঝব দিল্লীর পক্ষে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকাটাই বিপজ্জনক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতি তৎপরতা দিল্লী চালিয়ে যাবে, যাবেই। তাকে বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাস আবিষ্কার করতেই হবে। কিম্বা প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ ভারতের তথাকথিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের অভয়ারণ্য। দিল্লিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করতেই হবে। কারণ ভারতকে অখণ্ড রাখবার জন্যই এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার বিনিয়োগ। সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ অখণ্ড ভারতের জন্য সবসময়ই মারাত্মক হুমকি হয়ে বিরাজ করবে। বাংলাদেশের জনগণ এই ব্যাপারগুলো এখ জানে এবং বোঝে। ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির গভীর ও গহিন সম্পর্কগুলো এখন আর অতোটা অস্পষ্ট নাই।

বাংলাদেশ দেখেছে অখণ্ড ভারতের ভিত্তি হিসাবে ধীরে ধীরে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ভারতকে অখণ্ড রাখতে হলে এটাই তো হবার কথা। পশ্চিম বাংলায় আমরা তা এখনও প্রকট দেখছি না। কিন্তু যদি ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে পশ্চিম বাঙলায় হিন্দুত্ববাদেরই চর্চা হয় তাহলে পশ্চিম বাংলা সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের দিকেই ঝুঁকবে সেই ভয় বাংলাদেশের রয়েছে। ভারতের প্রগতিশীলরা যখন ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে তখন তারা একে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক অর্থেই ব্যবহার করেন। বহু ধর্ম, বহু জাতি, বহু বর্ণ, বহু ভাষা বহু সংস্কৃতির দেশ হিসাবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছাড়া ভারতের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বা ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের বিচার করলে ভারতীয় ধর্ম নিরপেক্ষতা হিন্দুত্ববাদের নামান্তর ছাড়া কিছু নয়। সাংস্কৃতিক দিক থেকে তার পক্ষে অন্য কোন ধর্ম গোষ্ঠির জীবনচর্চা, ভাষা বা সংস্কৃতিকে ভারতের জাতীয় সংস্কৃতির মূল ধারা ও গাঠনিক উপাদানে অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে অসম্ভবই বটে। ভারতীয় জাতীয়তাদের এই হিন্দুত্ববাদী পরিগঠন এই অঞ্চলের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনচেতা অন্যান্য জনগোষ্ঠির জন্য বিপদের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন বুঝেছে যে ভারতে সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী ধারা এবং ভারতীয় বাংলাভাষীরা বাহ্যিক ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ ধরে রাখতে গিয়ে এর বিরোধিতা করলেও মনে ও মননে হিন্দুত্ববাদ থেকে আলাদা কিছু নয়। হিন্দুত্ববাদী ধারার মধ্যেই তাদের বিলীন হবার সম্ভাবনা। পচিম বাংলাকে অবশ্যই সাহিত্য পাঠের এই সাম্প্রদায়িক অভ্যাস পরিহার ও পরিত্যাগ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশকে তোষামুদির দরকার নাই। পশ্চিম বাংলা বদলাক। পশ্চিম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে কিনা, নাকি আরও ‘হিন্দুভূত’ ও ‘হিন্দিভূত’ হবে কিনা সেটাই প্রবল আশংকার বিষয় হয়ে উঠেছে।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের বিকাশ কোন পথ ধরে এগুবে আমরা এখনও স্পষ্ট নই। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিজের মধ্যে এই দেশের জনগোষ্ঠির ধর্মভাব, জীবনযাপনচর্চা ও সংস্কৃতিকে আত্মস্থ না করে যেভাবে নিজেকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে তাতে দিল্লীর আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোন ভুমিকা পালন করতে পারে নি। এই মূর্খ বাঙালিপনার কোন ভবিষ্যত আছে কিনা সন্দেহ। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়ায় অতিমাত্রায় ইসলামপন্থি হতে গিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে ‘আরব’ বা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি রপ্ত করবার আগ্রহ বেড়েছে। সেটা বাড়ছে মধ্য প্রাচ্যে শ্রমিক সরবরাহ বা সম্পর্কের কারণে তা আরও সবল হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে কোথায় কোন দিকে নিয়ে যাবে আমরা হলফ করে তা বলতে পারি না। বাংলাদেশ বিচ্ছিন দ্বীপ নয়। তবে পশ্চিম বাংলাকে বুঝতে হবে, তাদের নিজেদের অভিমুখ নির্ধারণ ও নিজেদের পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের রূপান্তরও নির্ভর করে। দিল্লীর দিকে তাকিয়ে থাকবার কিম্বা হিন্দী বলয়ের বেদিতে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে বলি দেবার কোন যুক্তি পশ্চিম বাংলার নাই। এটা চর্চার মধ্য দিয়েই মীমাংসা করতে হবে। সেই পথ হচ্ছে বাংলাভাষীদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি জোরদার করা। করতেই হবে। কারণ বাংলাভাষি হিসাবে আমাদের কিছু সাধারণ স্বার্থ আছে তা বাদ দিলে পশ্চিম বাংলা খোলস হয়ে যাব। তাই কলকাতার লেখকদের তোষামুদি বাংলাদেশ সহ্য করে। এটা বুঝতে হবে।

শুরুতে বলেছি পশ্চিম বাংলার বাংলাদেশ তোষামোদির পেছনে বাজার ব্যবস্থার ‘অদৃশ্য হাত’ থাকতে পারে। একটু ব্যাখ্যা করি। ‘অদৃশ্য হাত’ কথাটা আমার আবিষ্কার নয়। আধুনিক অর্থশাস্ত্রের দেবতা খোদ আদম স্মিথ মহাশয়ের। আমরা সমাজে যদি কোন কাজ সরাসরি সমাজের ভাল করার বিবেচনা থেকে করি তার চেয়ে বরং স্রেফ নিজেদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা ইতিবাচক ফল দেয়। অর্থাৎ ব্যাক্তি স্বার্থ রক্ষার পরিণতি সমাজের জন্য ‘ভাল’ হয়। ‘ভাল’ কথাটা কিভাবে বুঝব সেটা পুঁজিতন্ত্রের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। আদম স্মিথের এই অনুমান থেকে স্বার্থবাদী সমাজের ধারণা দানা বাঁধে, যাকে অনেকসময় ‘বুর্জোয়া’ বা ব্যাক্তিতান্ত্রিক সমাজও বলা হয়। স্বার্থপরতা সম্পর্কে এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিবেচনা খুব কমই আজকাল আলোচিত হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় তো একদমই না। বাঙালি বড়ই নৈতিক!!! এই অঞ্চলের ধর্মচর্চার ইতিহাসে অতি দীর্ঘকাল ব্যাক্তি পর্যায়ে কৃচ্ছসাধনা, ত্যাগ, তিতীক্ষা, গুরুবাদ, সন্যাসতন্ত্র ইত্যাদির প্রকট প্রভাবের ফলে মোটা ময়লা তলানির আস্তর হিসাবে আমাদের মনে ও মননে নিজের স্বার্থের কথা প্রকাশ্যে বলার ক্ষেত্রে দ্বিধা রয়ে গেছে। আমরা মনেপ্রাণে স্বার্থপর অথচ প্রকাশ্যে সকলেই পরোপকারী হতে চাই। সমরেশ মজুমদার নিজের স্বার্থের কথা প্রকাশ্যে বলছেন । সেটা মন্দ না।

পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক বাংলাদেশের বইয়ের বাজারটা চান, কিন্তু তাদের পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের পাঠকদের পৌঁছাবার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসাবে তাঁদের পাঠকদের দোষারোপ করেন। এটা কতোটা মানি সেটাই ঊপরে ব্যাখ্যা করলাম। কিন্তু এর বেশী মানি না। কলকাতার লেখকরাও বাধা তৈরি করে রেখেছেন। তাঁরা বাজার চান, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সাহিত্যের আদান প্রদান চান না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের লেখক ও লেখালিখিকে পরিচিত করে দেওয়া এবং তাদের জন্য পাঠক তৈরি তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের লেখকদের বাজার বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সম্রেশ মজুমদারদের সহায়ক ভূমিকা পালন করা উচিত। এটা তাঁদের কর্তব্য। শুধু পাঠকদের দায়ী করবেন, সেটা ঠিক না।

এক হাতে তালি বাজানো যায় না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যদি বিকাশ আমরা চাই তাহলে দুইহাতে তালি বাজাতে হবে। সমরেশ মজুমদারসহ পশ্চিম বাঙলার লেখকরা সেটাই করবেন, এই আশা করি।

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/ ৩ আশ্বিন, ১৪২২ শ্যামলী

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।