শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ ভুলঃ অবকাঠামো নির্মান ধারণার বিরোধী


বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সফলতা পাবার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনপরিসরে ভাবনার জায়গায় কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যাদের হাতে আন্দোলনের সফলতা আসলো তারা দেশের জনপরিসরে একদমই নতুন ভাগীদার। এই দিক থেকে ভবিষ্যতে জনপরিসরে এদের অবস্থান কি হবে তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে আন্দোলনে জনগনের সমর্থন, শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, আন্দোলনের নতুন ভাষা ও ব্যাপ্তি সব মিলিয়ে একটা ভিন্ন আমেজ তৈরি করেছে। বিগত কয়েকদিন যাবত চায়ের আড্ডা, বাসে, পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের স্ক্রিন জুড়ে ছিল এই আন্দোলন। যদিও, এসব আলোচনার কেন্দ্রে ছিল সরকার কর্তৃক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতনের উপর আরোপিত ভ্যাটের বিরোধিতা, তবুও এই ফাঁকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরাসহ জনগণ কে কিভাবে শিক্ষাকে দেখে তারও তারও একটি মহড়া হয়ে গেল। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মূল দাবি ছিল- শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা তাদের অধিকার, এর ওপর ভ্যাট আরোপ অনৈতিক। বলা বাহুল্য, যারা আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন তাদের অবস্থানও ছিল অভিন্ন।

পণ্য না বানানো, কিংবা অধিকার হিশেবে শিক্ষাকে দেখা হচ্ছে নৈতিক (ethical) অবস্থান থেকে দেখা। নৈতিক অবস্থান মানে উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন। যুক্তিতর্ক বা বাস্তবতার উপর এই অবস্থান নির্ভর করে না। তবে নৈতিক অবস্থানের যুক্তিতর্ক যে একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। যুক্তিতর্ক এখানেও আছে তবে তা অবস্থানকে জাস্টিফাই করার জন্য। নৈতিক অবস্থান ভালো কি খারাপ সেই তর্কে যাচ্ছি না। আমরা বরং একটু অর্থনীতির জায়গা থেকে শিক্ষাকে দেখার চেষ্টা করব। নৈতিকতা দিয়ে অর্থনীতিকে বুঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে বলে নেওয়া দরকার শিক্ষা সমাজে যে ধারায় জারি আছে তা নৈতিকতার নয়, বরং অর্থনীতির। তাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা এখানে অর্থনীতির জায়গা থেকে দেখে কিছু কথা বলব। অর্থনীতি মানে বিশেষ ধরণের সামাজিক বা বৈষয়িক সম্পর্ক যা উৎপাদন, বিনিময় ও ভোগের মধ্য দিয়ে সচল থাকে। আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাজার ব্যবস্থা যে সম্পর্কের চরিত্র নির্ধারণ করে।

কমবেশি সবারই অভিযোগ হোল ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে শিক্ষাকে মুনাফা লাভের পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। শিক্ষাকে যত বেশি মুনাফায় বিক্রি করা যায় ততই লাভ। এভাবে শিক্ষাকে মুনাফা লাভের হাতিয়ার মনে করার মধ্যে ব্যাপারটা খোলাসা হয় না। পৃথিবীর এখনকার প্রত্যেকটি প্রভাবশালী সামাজিক সম্পর্কের পেছনে কাজ করে পুঁজি। এ জন্য অনেকেই একে পুঁজিভিত্তিক সামাজিক সম্পর্ক বলেন। কোনো নতুন কিছুর উৎপাদন পেতে চাইলে তাতে বিনিয়োগ করতেই হয়। কমবেশি বিনিয়োগ ছাড়া কোন কিছুই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুরু করা যায় না। শিক্ষার পেছনের দরকারগুলোর মধ্যে তাই বিনিয়োগও একটা বিষয়। শিক্ষার পরিধি যত বাড়াতে চাওয়া হবে বিনিয়োগ তত বাড়াতে হবে। সেটা রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি পর্যায়েরই হোক না কেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হলে জমি কিনতে হয়, ভবন নির্মাণ করতে হয়, আসবাবপত্র কিনতে হয়, ল্যাব তৈরি করতে, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়, আরও নানা কিছু দরকার যা একমাত্র সম্ভব বিনিয়োগের মাধ্যমে। তাই শিক্ষাকে আমরা যতই নৈতিক দিক থেকে দেখি না কেন এর পেছনে রয়েছে বিপুল পরিমান বিনিয়োগ। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অর্থের ব্যাপারটা চলে আসতে বাধ্য। শিক্ষার অর্থনীতি বাদ দিয়ে শিক্ষাকে নীতিবিদ্যার তর্কে পর্যবসিত করলে সেটা খুব ফলপ্রসূ আলোচনা হবে না। দুনিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন গ্লোবাল ক্যাপিটালের অধীনস্থ ও অন্তর্গত হয়ে কাজ করছে । তাই আমাদের গ্লোবাল ইকোনমি বা গ্লোবাল ক্যাপিটাল শিক্ষাকে কিভাবে দেখে সে খবরও নিতে হবে। শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ সেদিক থেকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হয় সেই দিকটাও বিচার করে দেখার দরকার আছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে সংশোধিত আকারে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০, যেটা এখন কার্যকর। এই আইন দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা যেমন প্রমাণ করে অন্যদিকে এর সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার দিকেও ইঙ্গিত করে। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবার অক্ষমতা রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে। তবে একটা পালটা যুক্তি আছে যে, উচ্চ মাধ্যমিক পাস সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হবেই নাকি এডুকেটেড হিউম্যান রিসোর্স তৈরির একটা পরিকল্পনা আগে তৈরি করা দরকার। এরপর বুঝা যেতে পারে কতজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট আমাদের দরকার। যদিও যে হারে অর্থনীতি বাড়ছে এবং যা ইতিবাচক অর্থেই আরও বাড়ার কথা এর তুলনায় গ্রাজুয়েটের সংখ্যা এখনও হয়ত পরিপুর্ণতায় পৌছায় নাই। তবে গুরুত্বপুর্ণ দিক হল, গুণ-মান সম্পন্ন গ্রাজুয়েট আমাদের দরকার আনাড়ি গ্রাজুয়েট নয়। যেদিক যাই হোক, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর অপারগতা অক্ষমতাই এখানে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অন্যদিক থেকে বললে অভিভাবকদেরও গ্রাজুয়েট শিক্ষা খাতে ব্যয় করার মত সামর্থ বেড়েছে এটা তার ইঙ্গিত। এসব কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতেই মূলত রাষ্ট্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছে।

বলা হয় মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এসব পূরণের পরও তার কাছে শিক্ষিত হয়ে ওঠার একটা গুরুত্ব কাজ করে। মানুষ চায় শিক্ষিত হতে। কারণ এটা করে খাওয়ার শিক্ষা, শিক্ষিত হয়ে থাকলে কাজ পাবে, চাকরি হবে ভাল। গুরুত্বপুর্ণ পেশায় অন্তর্ভুক্তির পুর্বশর্ত হিসাবে এই শিক্ষিত করে তুলে কাজ দেবার দায়িত্বটা তখন ছিল রাষ্ট্রের। অর্থাৎ আবার দেখা যায় রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে আসন সংকুলন না হওয়ায় অনেকেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছিল না। এদিকে রাষ্ট্রের পক্ষেও সে পরিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা আসন বৃদ্ধি করাও সম্ভব ছিল না। তখন মানুষ উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমাত দেশের বাইরে। আর দেশের বাইরে যখন মানুষ উচ্চ শিক্ষা নিতে যাচ্ছে তখন স্বভাবতই তারা দেশের মুদ্রা বিদেশে ঢেলে আসছেন। পাঠক আপনারা একটু তুলনামূলক অনুসন্ধান করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগের ও পরের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে বিদেশে যাওয়া ও এর মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার পরিসংখ্যান পেয়ে যাবেন। দেখা যায় যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হোল যাদের টাকা আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিস্থানে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিবেচ্য হচ্ছেন তারা এখন আর বিদেশে যাচ্ছেন না, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন। এদিকে রাষ্ট্রও দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা দিতে পারছে ও দক্ষ জনসম্পদ বৃদ্ধি করতে পারছে।

শিক্ষার পুরা বিনিয়োগটা আমরা আরেকটি দিক থেকে দেখতে পারি। দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের সরকারি খরচে পড়ানো হচ্ছে অন্যদিকে শিক্ষার্থীদেরকে ছোট থেকেই ভরন পোষণ পালাপোষা সব প্রয়োজন মেটাচ্ছে পরিবার। সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমলে নিলে তাই দেখা যায় শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগ হচ্ছে একটা অংশ আসছে পরিবারের শেয়ারিংএর মাধ্যমে। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্র যে বিনিয়োগটা করে আমাদের সেদিকটা নিয়েই মূল আলোচনা। মোটা দাগে বিনিয়োগ দুই প্রকার। অবকাঠামোগত বিনিয়োগ আর বাণিজ্যিক বিনিয়োগ। বাণিজ্যিক বিনিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা হাসিল। যেমন আপনি একটা মুদি দোকান করলেন। আপনার উদ্দেশ্য অবশ্যই সরাসরি এখান থেকে মুনাফা লাভ করা। অবকাঠামোগত বিনিয়োগ এদিক থেকে আলাদা। মুনাফা এর মোটিভ নয়। না-লাভ না-ক্ষতি বা ব্রেক ইভেন হলেই এটা চলে। আমাদের মত দেশে বিশ্বব্যাংক শিক্ষা অবকাঠামো খাতে কনসেশনাল ঋণ দেয়। ব্যতিক্রমগুলো মনে রাখলে শিক্ষার বিনিয়োগকে ক্লাসিকাল ইকোনমিতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ আকারে দেখা হবে। কেননা একটা দেশের দক্ষ জনসম্পদ বের করার ব্যাপারটা বাণিজ্যিকভাবে যদি করাও হয় তবে সে জনসম্পদ ব্যবহার (মানে চাকরিতে নিয়োগ) অসম্ভব হবে কারণ বেতন অনেক বেশী দিতে হবে। জনসম্পদ তৈরিতে খরচ বেশী মানে ঐ জনসম্পদ কিনতে নিয়োগ দিতে বেতনও বেশী দিতে হবে। এজন্যই মৌলিকভাবে শিক্ষা জিনিষটা অবকাঠামো খাতের অন্তর্গত। ‘অবকাঠামো’ কথাটার মুল অর্থ হল, এথেকে উৎপাদিত উৎপাদ (এখানে শিক্ষিত জনসম্পদ) পুনরায় উৎপাদনের দক্ষশ্রম হিসাবে ব্যবহার করা হবে। শিক্ষিত জনসম্পদ সমাজের মূল ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানার দক্ষশ্রম। তাই কাঁচামালের মতই দক্ষশ্রমের মূল্য যতদুর সম্ভব কম রাখলে কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কম রাখা সম্ভব হবে। আর যত কম রাখবে সে পণ্যের বাজার তত আকারে বড় করা সহজ হবে। দেশের অর্থনীতির আকার বড় হবে।

এই সুত্রের সার কথা কারখানার প্রি-প্রডাকশন খরচ যতদুর সম্ভব কম রাখতে হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতের উৎপাদের খরচ কমাতে হবে। তাতেই অর্থনীতির সাফল্য। অতএব নীতিগতভাবে অবকাঠামো পর্যায়ে ভ্যাট ট্যাক্স আরোপ করা যায় না, যাবে না। যে এই নীতিগত দিক অমান্য করতে চায় সে অর্থনীতির মৌলিক দিক বুঝে না। খাবলে খেতে চায়। এর মানে কি তাহলে ভ্যাট ট্যাক্স তাহলে কোথা থেকে নিবে? এককথায় বললে অবকাঠামো পর্যায়ে নয়, ফিনিশ প্রোডাক্ট পর্যায়ে। অর্থাৎ ঐ শিক্ষিত জনসম্পদের বেতন বা আয়ের উপর থেকে। কারখানার উৎপাদিত পণ্যের উপর থেকে। এই নীতিগত দিক বিশ্বব্যাংকও মেনে চলে।

সারকথায়, নীতিগত কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে নয় সরকারি-বেসরকারি যে কোন শিক্ষার উপর ভ্যাট প্রোগ অনুচিত, করা যায় না। এটা জনপরিসরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটা মৌলিক ভিত্তি হতে পারে।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।