আইএস এসেছে (!), আইএস আসে নাই (?)


সাধারণত আমি লেখা শেষ করার পর লেখার শিরোনাম দিয়ে থাকি। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম করেছি। আগে শিরোনাম লিখলাম। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে একবার বিস্ময় চিহ্ন আর আরেকবার প্রশ্নচিহ্ন দেয়ায় পাঠকের একটু মিস্টেরিয়াস মনে হতে পারে। আসলে রহস্যের কিছু নাই। ব্যখ্যা করে বলি।

শেখ হাসিনার সরকার এতদিন আমাদের বুঝিয়েছিল,বাংলাদেশ ইসলামী সন্ত্রাসীতে ভরে গিয়েছে। তিনি দাবী করতেন, তার সরকারের আমলে কোনো বিরোধী দল নাই। যারা তার সরকারের বিরোধী, তারা ইসলামী সন্ত্রাসী। আর তাই বলতেন তিনি বিরোধী দল দমন করছেন না, ইসলামী সন্ত্রাসীদের দমন করছেন। কারণ, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাস চর্চা হয়েছে। দল বা জোট হিসেবে তারা যেমন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তেমনি তাদের নেতাকর্মীরা ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছে। সেটা প্রমাণের জন্য নেতাকর্মীদের ধরপাকড় চলেছে, জেল-জুলুম হয়েছে; তারা যে জড়িত ছিল রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে তাদের কাছ থেকে জড়িত থাকার স্বীকৃতি জবানবন্দি আকারে নেয়া হয়েছে।

এতে আমাদের মোটামুটি প্রায় কনভিন্সড করেই ফেলা হয়েছিল যে, আসলেই বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জঙ্গিদেরই একটি জোট। এদের পুরোপুরি নির্মূল করাই এখন কর্তব্য। মুজিবকন্যা শক্ত হাতে সেই কাজ করেছেন। প্রতিপক্ষ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নির্মূল করলে সারা দেশের জন্য তার পরিণতি কী হতে পারে তার আগপাছ আমরা ভাবিনি। বিএনপি কার্যত একটি অক্ষম দলে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করবার মতো কোনো শক্তি এই দলটির আর অবশিষ্ট নাই। না মতাদর্শিক ভাবে, না সাংগঠনিক ভাবে। জেল-জুলুম, দমনপীড়ন ছাড়াও আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা, গুম ও গুমখুন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা, নির্যাতন করে রাজনৈতিক কর্মীদের চিরজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়া -- ক্ষমতাসীনরা ক্রমাগত তাই করে চলেছে। এর জন্য তারা হাততালি পেয়েছে। হাততালি পাচ্ছে। কারণ আমরা কনভিন্সড যে, বিএনপি-জামায়াত-ইসলামপন্থীদের জোট একান্তই একটি সন্ত্রাসী জোট। তাদের নির্মূল করার ওপর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে জঙ্গিমুক্ত করা নির্ভর করে। শেখ হাসিনা শক্ত হাতে এই ভালো কাজটি করেছেন। তাকে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে।

এই অবিশ্বাস্য দমনপীড়নের মুখে খালেদা জিয়া অসহায় হয়ে এখন চিকিৎসার জন্য বিলাতে। এতে আমরা পুলকিত। কারণ অনুমান, তিনি আর ফিরে আসছেন না। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। হয়তো দেখা যাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্মূল করে দেয়ার কারণে যে রাজনৈতিক বাফার- অর্থাৎ সরকার ও বিরোধী এ দুইয়ের মধ্যবর্তী যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র বাংলাদেশে বহাল ছিল এবং বহাল থাকা দরকার, সেটা দিনকে দিন একেবারে নাই হচ্ছে, যা অচিরেই প্রায় আর থাকবে না। এর ফলে শেখ হাসিনা তাঁর কাঙ্খিত একটা খালি মাঠ পেয়েও যেতে পারেন বটে। তবে এই প্রকার খালি মাঠ শেখ হাসিনা যদি পান তবে তা অবশ্যই কিছু সময়ের জন্য এবং অচিরেই তাকে আসল জঙ্গিদের মোকাবেলা করতে হবে। এখনকার মত তাদের হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাঙলা টিম বানিয়ে খুব একটা কাজ হবে না।

ইসলামী জঙ্গি আসলে কী জিনিস সেটা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ থেকে বুঝতে হবে। তারা জর্দার কৌটা আর ঘরে বানানো বোমা ককটেল নিয়ে আসবে না। জঙ্গি মানে যোদ্ধা। ফলে তারা যোদ্ধার বেশেই আসবে। অস্ত্রশস্ত্র কোথায় কীভাবে আসবে কিম্বা আসে সেটা বোঝার মতো বুদ্ধিজ্ঞান যদি মাথা গরম বেকুব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বুদ্ধু ইউরোপের না হয়ে থাকে তো সেখানে শেখ হাসিনা কিংবা মোদি কোন ছার! মধ্যপ্রাচ্যে কোথা থেকে কীভাবে অস্ত্রশস্ত্র হাজির হয়ে যাচ্ছে, সেসব তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ না পড়লে এটা বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন তখন যাকে তাকে ইসলামি জঙ্গী বানিয়ে দেওয়া হয় তখন বোঝা যায় আসলেই বাংলাদেশে খুবই সক্রিয় ভাবে একটি পক্ষ কাজ করছে যারা যে কোন মূল্যে বাংলাদেশকে সিরিয়া বা ইরাক বানিয়ে দেখাতে চায় ইসলামি যোদ্ধা ব্যাপারটা আসলে কী জিনিস! মনে হয় তারা তাদের প্রকল্প সফল করে ছাড়বে। এই আশংকাই দীর্ঘদিন ধরে আমি করছিলাম।

আজকাল দেখছি টেলিভিশনে বিস্তর নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাজির হচ্ছেন। এদের কথাবার্তা দারুন বিনোদন বটে! তবু সার কথাটা হচ্ছে, আমরা ঘৃণা করি আর যাই করি, বাংলাদেশে যদি ইসলামী যোদ্ধারা এসে যায় তাহলে শেখ হাসিনা কি তার র‍্যাব আর পুলিশ দিয়ে তার মোকাবেলা করতে পারবেন? সন্দেহ রাখার যথেষ্ট কারণ আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দিয়েও কি খুব বেশি কিছু করা সম্ভব? সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই জেনে থাকবে যোদ্ধা কী জিনিস। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশে বিচক্ষণ সৈনিক ও মানুষের অভাব নাই। এমন সৈনিকরাও আছেন যারা আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় রাজনীতি, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, যুদ্ধবিগ্রহের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক মানে বোঝেন।  আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতায়  ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে রূঢ় বাস্তবতা সে সম্পর্কে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নাই। অন্যদেশে জাতিসংঘের শান্তি বাহিনী হওয়া এক কথা আর জীবন বাজি রেখে যারা তাদের বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করে তাদের মোকাবিলা ভিন্ন জিনিস।

দুই

তবে সেই রাখালের গল্প তো আমাদের মনে আছে, যে বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করে গ্রামের মানুষ জড়ো করত। তাকে বাঁচানোর জন্য গ্রামের মানুষ ছুটে আসত। অথচ রাখাল গ্রামের মানুষের সঙ্গে ভালো একটি তামাশা করেছে বলে হো হো হো করে হাসত। কিন্তু একদা ঠিকই বাঘ এসে গেলেন। তামাশার বাঘ নয়, বাস্তবের ব্যাঘ্র। বাঘ ব্যাটাকে তখন আর মামা ডেকে কোনো লাভ হল না। রাখাল বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করল। হা হা হা। গ্রামের মানুষ ভাবল তারা আর রাখালের মশকরার ফাঁদে পা দেবে না। বাঘ রাখালকে খেয়ে ফেলল।

এই গল্পের নীতিশিক্ষার দিকটা হল, সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে মশকরা করিও না। না না না, কক্ষনই করিবে না। সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা আদায় হলেও না। এই নীতিটা অবশ্য আংশিক, শুধু রাখালের জন্য। কিন্তু গল্পের বাকি অংশটা বলা হয় না। সেই অংশ গ্রামের মানুষদের নীতিশিক্ষার জন্য। সেটা কী?

সেটা হল বাঘ রাখালকে আনন্দের সঙ্গে আহার করল। এরপর তার গ্রামের ঢোকার পালা। ঢুকল। এবং সুযোগ মতো আস্তে আস্তে গ্রামের লোকজন তার আহার্যে পরিণত হল। গ্রামের মানুষ ভুলে গিয়েছিল যে গ্রামটি যখন বনের পাশে, তাহলে বাঘ এলে গ্রামে হামলা করতেই পারে। রাখালের তামাশার শাস্তি দিতে গিয়ে দল বেঁধে যেখানে রাখালকে উদ্ধারের দরকার ছিল, সেটা তারা করল না। রাখালকে তামাশার শাস্তি দিতে গিয়ে রাখাল সহ নিজেরাই বাঘের আহার হয়ে গেল। সেই গ্রাম আর নাই। গল্পের এই শেষটুকু বলারও কেউ আর অবশিষ্ট নাই। শেষে গল্প বলার জন্য এই সকল ক্ষেত্রে সাধারণত কবি-সাহিত্যিকদের কিছুটা কল্পনা, কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান, কিছুটা উপদেশমূলক বাণী দেয়ার ডাক পড়ে। আমি সেই দায়টা এখন পালন করছি:

আমরা যেন ভুলে না যাই আফগানিস্তান আমাদের পাশেই। ভুলে যেন না যাই মধ্যপ্রাচ্যও আমাদের অতি নিকটে। এটাও যেন ভুলে না যাই, ষোল কোটি মানুষের এ দেশে অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। জ্বি। ভুলে যেন না যাই, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও আত্মঘাতী ভুল এবং ইসলামী সন্ত্রাসীর অজুহাত তুলে নিপীড়ন নির্যাতন হত্যা গুমখুন করে নিজের দানবীয় ক্ষমতার পক্ষে ন্যায্যতা জোগাড়ের চেষ্টার কারণে ঘরে ঘরে ইসলামী যোদ্ধা তৈরি হতে পারে। বাঙালি অসম্ভব ভীরু ও কাপুরুষ জাতি। সে কারণে এই ঘটনা এখনও ঘটেনি। কিন্তু হতে থাকলে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাবে। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, শেখ হাসিনার জনকের ডাকে এই ভীরু ও কাপুরুষ বাঙালি অস্ত্র ধরতে একদিনও সময় নেয়নি। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' বলে এই দেশের ভীরু, কাপুরুষ বাঙালিরাই পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছিল। তুলনায় ধর্ম রক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতেও সেই একই জনগোষ্ঠির সময় খুব কমই লাগবে। এটা আমরা ভুলে যাই জাতির জন্য মৃত্যু বরণ যদি ন্যায্য হয়, ধর্মের জন্য শহিদ হওয়াকে অন্যায্য প্রমাণ কঠিন কাজ। জাতির জন্য যুদ্ধ করলে   'দেশপ্রেম' আর ধর্মের নামে যুদ্ধ করলে তা 'সন্ত্রাস' -- এই কেচ্ছা সাধারণ মানুষকে গেলানো বাঙলাদেশে অনেক আগেই কঠিন হয়ে গিয়েছে। এই গল্প কাজ করছে না, কিন্তু আমাদের হুঁশ নাই। এই দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যদি অকাতরে প্রাণ দিতে শিখে থাকে তাহলে ধর্মের জন্য শহিদ হতে দ্বিধা করবে কেন? এই অতি সহজ কাণ্ডজ্ঞানটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি।  সমাজে যদি ইনসাফ না থাকে আর সাধারণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে সবসময় অপমানিত ও লাঞ্ছিত করাকে যদি মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলি তাহলে  পরিণতি ভয়ানক হয়, ভয়ানক হবে -- এই কথাটাই আমি তারস্বরে দীর্ঘদিন বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কারো কানে গিয়েছে কিনা সন্দেহ। এখন আমরা  দ্রুতবেগে সেই ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধেয়ে চলেছি, যা বহুদিন আগে থেকে আমি অনুমান করেছিলাম। এখন আর বললে কী হবে!!!

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন, মানুষকে সেই প্রান্তসীমায় নেবেন না, যখন সে বোঝে তার আর কোনো উপায় নাই। শেখ হাসিনাকে আজ হোক কাল হোক সত্যিকারের ইসলামী যোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে হবে। আমরা যখন উদার রাজনীতির ক্ষেত্রকে ধ্বংস করি, কথা বলার দ্বার বন্ধ করে দেই, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা হচ্ছে বল প্রয়োগ – এক দিশাহীন জঙ্গীপনার আবির্ভাব বাংলাদেশে ঘটতেই পারে। একথা আমি বহুবার আমার লেখায় নানাভাবে বলেছি। বলেছি, বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক তৎপরতাকে এই সম্ভাবনাকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে।

তিন

তাহলে আইএস এসেছে কথাটা মিস্টেরিয়াস লাগে কেন? কারণ আমরা বিশ্বাস করতে পারি না আসলেই এটা বাংলাদেশে ঘটছে। আমরা সহজে বিশ্বাস করি হয়তো সরকারের দাবি সঠিক, বিদেশীরা ভুল বলছে। কিন্তু বাংলাদেশে আই এস আসা অসম্ভব কি? নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি লেখায় দেখলাম প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “যেভাবে সরকার ইসলামিক স্টেইটের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চাইছে সেটা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়”। মিজান চিনের ‘উইঘর’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখবার পর ইসলামিক স্টেট, বাঙলাদেশ থেকে তাঁকে ফোনে রীতমতো থ্রেট করেছে। শুধু তাই নয়, কিছুদিন আগে তিনি রিক্সা করে যাবার সময় তাঁকে বন্দুক দেখিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে, তিনি দৌড়ে একটি দোকানে আশ্রয় নেন। তিনি এইসব নিয়ে থানাপুলিশ করছেন। মিজানুর রহমান খান মার্কিন পত্রিকাটির কাছে অভিযোগ করেছেন, “আসলে বিপদটা কেমন আমাদের তা বোঝা কঠিন হয়ে গিয়েছে, আমরা বাংলাদেশ সরকার কিম্বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কারো কাছ থেকেই কিছু শুনছিনা”। কেউই সহযোগিতা করছে না। দেখুন (Bangladesh Pushes Back as Warnings of ISIS Expansion Gather Steam। ৩১ অক্টোবর ২০১৫)

এর আগে আমার ‘ইতালিয়ান নাগরিক হত্যা ও তিনটি অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত’ লেখাটিতে আমি কার্যত অস্বীকার করেছিলাম যে বাংলাদেশে আইএস এসেছে। রিটা কার্ৎজ এবং তার ওয়েবসাইট সম্পর্কে তথ্যও দিয়েছিলাম। আমি এই সাইটসহ ইন্টারনেটে ওপেন সোর্স ইনফরমেশন যা পাওয়া যায় সবই মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ করি। কারণ বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যতের সঙ্গে আমার- সর্বোপরি বাংলাদেশের তরুণদের ভাগ্য জড়িত। আমি অবাক হয়েছিলাম, এতকাল বাংলাদেশ দাবি করছিল যে, বাংলাদেশ ইসলামী সন্ত্রাসীতে ভরে গিয়েছে, অথচ এখন বলছে নাই। রিটা কার্ৎজ দাবি করছেন বাংলাদেশে আইএস এসেছে, অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোট বলছে আইএস আসে নাই। মিস্ট্রি বা রহস্যটা এখানেই।

‘ইতালিয়ান নাগরিক হত্যা ও তিনটি অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত’ লেখাটিতে আমি বলেছিলাম, যে রাজনৈতিক দল, তাদের সমর্থক ও সরকার সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদ মোকাবিলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সবসময়ই প্রাণান্ত, সেই সরকার সিজার তাভেল্লার হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে তা প্রাণপণ এখন অস্বীকার করছে কেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কী এমন পরিবর্তন ঘটল যে নিজেদের থুতু এখন ক্ষমতাসীনরা নিজেরা গিলতে বাধ্য হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, যেসব রাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশংকা রয়েছে, সেই আশংকার ভিত্তি বা যুক্তিসঙ্গত কারণ সম্পর্কে সেসব দেশ বাংলাদেশ সরকারকে কোনো তথ্য বা সূত্র দিয়ে সাহায্য করছে না। কিংবা করতে চাইছে না। এর কারণ কী? তারা কি মনে করে, রাখালের তামাশা যারা রাজনীতিতে প্রয়োগ করে, তাদের দিয়ে সত্যিকার ইসলামী যোদ্ধাদের মোকাবেলা সম্ভব নয়! যদি আসলেই আইএস বাংলাদেশে এসে গিয়ে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনাকে দিয়ে তার মোকাবেলা হবে না। এটা কি তাহলে তাদের কাছে স্পষ্ট যে শেখ হাসনার ইসলামি জঙ্গি দমন নিছকই বিদেশীদের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের ছলনা মাত্র, তিনি জঙ্গি দমনের নামে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে চান। দমন করেছেন। বিএনপি-জামাত-কে বিনাশ করাই তাঁর রাজনীতি। সেটা করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেইট আসবার রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করে দিয়েছেন।

হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! পাশ্চাত্যের উদ্বেগ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জঙ্গিদের পাশ্চাত্য মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, ইসলামপ্রধান ষোল কোটি দেশে যদি আইএস এসেই যায়, তাকে তারা এই অঞ্চলে মোকাবেলা করবে কীভাবে? শেখ হাসিনাকে দিয়ে? এটাই হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঢাকার কুটনৈতিক মহলের লুকোচুরি মিস্ট্রি বা রহস্য। সরকারের সঙ্গে বিদেশীদের তথ্য শেয়ার করা না করারা পশ্চাত কাহিনী।

বিদেশীরা রিটা কার্ৎজের তথ্যকেই মেনে নিচ্ছে, রিটা কার্ৎজের দাবির বাইরে আর নতুন কোনো তথ্য দেয়া তারা দরকারি মনে করছে না। ইসলামিক স্টেটের বিদেশী হত্যায় সম্পৃক্ততার সূত্র কোনো সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা নয়, একটি বিতর্কিত কিন্তু প্রাইভেট ইহুদি বা জায়নিস্ট গোয়েন্দা সংস্থা। বিদেশীরা এদের তথ্যকেই নির্ভরযোগ্য মনে করছে। তাই তারা বলছে, আইএস বাংলাদেশে এসেছে। একে বিস্ময় চিহ্নের মধ্যে রেখেছি। কারণ বিদেশীরা ভেবেছিল, শেখ হাসিনা ইসলামী জঙ্গিদের ঠেকাতে পারবেন। এখন তারা এ কী বলছেন! তারা বলছেন, বাংলাদেশে আইএস সক্রিয় কি-না নিশ্চিত নয়। আর সরকার বলছে, আইএস আসেনি। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বলছে- বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স কই? তাই পাশে ব্র্যাকেটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখেছি। কারণ সরকারের কাছে এটা এখনও প্রশ্ন। কেন প্রশ্ন? কারণ, যতদূর জানি বিদেশীদের নিশ্চিত করতে হলে নিদেনপক্ষে ঘটনার ব্যালিস্টিক রিপোর্ট তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। কী ধরনের গুলি, কী ধরনের পিস্তল ব্যবহার হয়েছে তার তথ্য। জানি না, দেয়া হয়েছে কি-না। মিডিয়ায় কোনো রেফারেন্স দেখিনি। সেটা গোয়েন্দারাই ভালো বলতে পারবেন। যদি দিয়ে থাকেন তাহলে বিদেশীরা আইএস নাই সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে না কেন? যদি না দিয়ে থাকেন, তাই আইএস আসেনি কথাটা প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। অন্তত এই লেখা অবধি।

আইএসের রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দেশে নানা মতামত থাকতে পারে। কিন্তু সেসব নিয়ে এই মুহূর্তে তর্ক করার চেয়েও আমাদের ভাবতে হবে সারা বাংলাদেশ নিয়ে। ভাবতে হবে ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে। বাংলাদেশকে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে দিতে চাই কিনা, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে যে যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না, কবে শেষ হবে কেউ জানে না বাংলাদেশকে তেমন যুদ্ধক্ষেত্র আমরা বানাতে পারি না, বানাতে দিতে পারি না। আর সেই যুদ্ধের শর্ত তৈরি হয়েছে বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করার কারনে, বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতি শূন্য করারা অর্থ যেখানে কথা বলবার, শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশের, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জানাবার কোন অবস্থা নাই। যেখানে রাজনৈতিক পরিসর বলে কিছু নাই, দমন পীড়ন পুলিশী নির্যাতন হামলা মামলা ছাড়া।

এক অনিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যারা দেশকে ঠেলে দিচ্ছেন, আশা করি তারা হুঁশে আসবেন। যা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব তাকে ঘটবার সুযোগ দেয়া হবে চরম আত্মঘাতী কাজ।

৩০ অক্টোবর ২০১৫, ১৫ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।

পরিশিষ্ট

এই লেখাটি ৩০ অক্টোবর তারিখে লিখেছিলাম। ৩১ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে লেখাটি ছাপা হবার দিন সন্ধ্যায় জাগৃতি প্রকাশনার দীপন সহ শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুল ও অন্য দুই লেখক সুদীপ কুমার বর্মন ও তারেক রহিমের খবর পেয়ে পাথর হয়ে রয়েছি। দীপন আমাকে দিয়ে এক হিসাবে জোর করেই ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ বইটি তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, আপনার কিছু বই আমাকে দিতেই হবে। ও ছিল আহমদ ছফা ও আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন আবুল কাশেম ফজলুল হকের ছেলে। দীপনের চেহারা আমাদের মতো বাম রাজনীতি করে আসা পুরানা আর রুক্ষ বাবা-কাকাদের মতো ছিল না। স্নেহ জাগানিয়া মুখ, লজ্জিত ভাবে হাসত। দুই একবার যতোটুকু কথা বলেছি মনে হয় নি মগজের কোন খোপ বন্ধক দিয়ে দীপন মুক্তবুদ্ধিওয়ালা হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করতে চাইত সব দিক থেকেই। ওকে প্রথম দিন থেকেই আমার ভাল লেগেছিল। বইটি ২০১১ সালের শেষের দিকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। ও পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে বের করেছিল।

জাক দেরিদার ওপর আমার লেখাগুলো জোগাড় করে বললো এটা গুছিয়ে দিন, আমি প্রচ্ছদ বানিয়ে প্রচার করে দিয়েছি। আমার মাথায় তখন ‘ভাবান্দোলন’ চেপে বসা। দেরিদার সঙ্গে হুসার্লের তর্ক পাশ্চাত্য চিন্তার জায়গা থেকে যতোটা বুদ্ধিদীপ্ত তার চেয়েও বাংলার ভাবচর্চার জায়গা থেকে আরও দুর্দান্ত। ভাবলাম, নতুন করে পুরাটা বাংলাভাষার ভাবচর্চার ক্ষেত্র থেকে লিখব। এমন ভাবে লিখব যাতে ফকির লালন শাহের ভাষা ও শরীরের সম্পর্ক বিচার কিম্বা নদিয়ার সাধকদের ‘গুরু’ ধারণা ভাষার বহু অর্থ বোধকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করে তা নিয়ে লিখি। এতে দেরিদা প্রাসঙ্গিক হবে। বিদেশী দার্শনিকদের নিয়ে আঁতেলি ভাল লাগে না। কিন্তু লেখা সহজে এগুলো না। কারণ যা লিখতে চাই তা সহজ বিষয় নয়। লিখছিলাম আস্তে আস্তে – দীপনকে আর দেওয়া হোল না। ও বইয়ের জন্য তাড়া দিতে আবার যখন গত বছর এলো, আমি বুঝিয়ে বলায় খুব খুশি। এ বছর তাকে যেভাবেই হোক শেষ করব বলে কথা দিয়েছিলাম। গুছিয়ে এনেছি।

দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’ (দেখুন, 'আমি কোন বিচার চাই না' প্রথম আলো ১ নভেম্বর ২০১৫)

অবিশ্বাস্য শোক মাথায় নিয়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক এই কথাটা খুবই স্পষ্ট ভাবে বলতে পেরেছেন। আমরা দেশকে বিভক্ত করে দিয়েছি। আমরা দুই পক্ষেই আমাদের সন্তানদের হারাতে থাকব। আমরা কাঁদতে ভুলে যাব। নিজ নিজ সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাব, আর সন্তানের রক্তে আমাদের শরীর ভিজে যাবে।

কে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সেকুলার মুক্তবুদ্ধিওয়ালা আর কে ধর্মান্ধ বা ইসলামি জঙ্গী গোরস্থান তার বিচার করে না। শুধু কবরের ওপর ঘাস গজায়, আর একদা ঐতিহাসিকরা গবেষণা করতে বসে কিভাবে একটি জাতি তাদের বেয়াকুবির জন্য ধ্বংস হয়ে গেলো।

যেহেতু আমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নই, তাই জীবনের কোন মূল্য আমরা দিতে জানি না।

আমি দেখছি, বিভক্ত ও দ্বিখণ্ডিত বাংলাদেশে দুই দিক থেকে দুটো মিছিল গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ বিভাজনের পরিণতি সম্পর্কে আমি জানপরান সবাইকে হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করে যাব।। কিন্তু তাতে কি যারা চলে গিয়েছে ফিরে আসবে?

কেউই প্রত্যাবর্তন করে না।

এই লাশের ভার অনেক ভারি, বাংলাদেশ বহন করতে পারবে কি? সেই দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার চর্চা আমরা কবে করব, যা আমাদের গোরস্থানের দিকে নয়, সপ্রতিভ জীবনের দিকে নিয়ে যায়।

জাতি বা জাতীয়তাবাদের নামে ভিন্ন চিন্তা বা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের দমন পীড়ন ও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, বিরুদ্ধে দাঁড়ান ধর্মের নামে হত্যার বিরুদ্ধে। জাতি, রাষ্ট্র কিম্বা ধর্ম -- কারো একচেটিয়া ব্যাখ্যার কাছে আমরা যেন আমাদের বাস্তবের জীবন ও বিবেক বন্ধক না দেই।  আমরা মত, বিশ্বাস বা বদ্ধমূল ধারণার দাস নই, আমরা 'আমি' নই, আমরা প্রত্যেকে সব সময়ই 'আমরা' -- কারণ আমরাই সমাজ, আমরা সমাজে বাস করি। আমার মত ও বিশ্বাস যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, অন্যের মত ও বিশ্বাসও সমান গুরুত্বপূর্ণ।  অপরেরবিশ্বাসকে হেয় করা, তার আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধকে ক্রমাগত আহত ও রক্তাক্ত করা আমাদের কাজ হতে পারে না।

আসুন আমরা একটি রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তুলি যেখানে মানুষ বর্তমান ও ইতিহাসের অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে বিবেক, বিচার ক্ষমতা ও সামষ্টিক স্বার্থ নিয়ে পর ও অপর সকলের সঙ্গে কথা বলে। নিজ নিজ মত ও বিশ্বাস নিয়ে পাথর হয়ে থাকে না। আসুন আমরা  বিশ্বাস করি  হিংসা, হানাহানি, হত্যা ও বিভক্তির রক্তে স্নাত নদি আমরা একসঙ্গে পার হয়ে যেতে সক্ষম।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।