ইঁচা ও পুঁটি মাছে্র সমাজ


আসলেই, ‘সমাজ বদল’ কথাটার অর্থ কী?

বাংলা ভাষায় ‘সমাজ’ নামে একটি শব্দ আছে। কিন্তু শব্দটি এখন কী বোঝায় সে সম্পর্কে আমরা আর একদমই অবহিত নই। আগেও খুব সজ্ঞান ছিলাম বলা যাবে না। যদি থাকতাম তাহলে সমাজ বদল, পরিবর্তন বা রূপান্তর ইত্যাদি ধারণার একটা মানে আমরা দাঁড় করাতে পারতাম এবং আমাদের বর্তমান অবস্থা বিচার করবার মানদণ্ড হিসাবে তা ব্যবহারও করা যেতো। সেই সুবিধাটুকু পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও প্রাচীন অভ্যাস বশত সমাজ বদলাবার কিম্বা সমাজ পরিবর্তনের কথা আমরা শুনে এসেছি। শুনতাম। আজকাল তাও শুনি না। কিম্বা শুনলেও সেটা কোন বিশেষ অর্থ জ্ঞাপন করে না। সমাজ যদি বর্ণনাত্মক অর্থে কিছু মানুষের সমষ্টিও বুঝি তাহলে এই সমষ্টিকে বর্তমান বাস্তবতা থেকে ইতিবাচক অর্থে ভিন্ন একটি বাস্তবতার দিকে নিয়ে যেতে হলে কী আমাদের করা উচিত কিম্বা কী আমাদের কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে আমরা দিশাহারা হয়ে আছি। আজ সেই বিষয়েই দুই একটি কথা বলব।

সমাজ কথাটার মানে বুঝতে আমরা কেন আর সক্ষম নই সেটা ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে ক্লিশে কায়দায় বলা যায় ‘সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত শব্দগুলোর অন্তর্গত ধারণা এবং অর্থ বদলায়’। এখানে ‘ক্লিশে’ মানে হোল জীবনানন্দের কবিতা। সেটা কেমন? কোন কিছু ব্যবহারে ব্যবহারে ব্যবহারে ‘শূকরের মাংস’ হয়ে যায়। যা আর ব্যবহার করা যায় না। কোন কিছু অতি ব্যবহারে আর কোন অর্থ ব্যক্ত করে না, তার ব্যবহার কবিতায় হারাম। তাই সেটা ‘শূকরের মাংস’। জীবনানন্দ কেন যে ‘শূকরের মাংস’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন সেটা আজ অবধি আমার কাছে বিস্ময়। অথচ কবিতার কাব্যগুণ এভাবে শব্দের মোক্ষম ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। তো, বলছিলাম, সমাজ কথাটা আসলে কোন অর্থ ব্যক্ত করে না। অথচ আমরা এখনও সমাজ বলি, সমাজ লিখি, সমাজ ব্যবহার করি, ইত্যাদি।

একে কি আবার ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়? নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু সমাজ বলতে আমরা আগে যা বুঝতাম সেভাবে তার উদ্ধার সম্ভব না। সেই বাস্তবতাও নাই।

একটু ভাবুন। একটা সময় ছিল ‘সমাজচ্যুত’ কথাটার একটা অর্থ হোত। তখন বড় বড় শহর বড় বড় নগর গড়ে ওঠে নি। গ্রাম ও জমি থেকে উৎখাত হয়ে উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এখনকার মতো ছুটে আসে নি। এমনকি ধরুন সত্তর কি আশির দশক -- ঢাকা শহরের বিস্তার সবে শুরু হয়েছে – তখনও গ্রামে সমাজ ছিল। এখনও হয়তো কিছু কিছু ভূগোলে আছে। সেই সকল গ্রামে গেলে মানুষ প্রবল কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইত নাম কি? বাড়ি কই? বাবা মা কোথায়? কার বাড়িতে যাবো? কার কাছে যাবো? ইত্যাদি। অনেকে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যেতেন। গ্রামের মানুষ প্রাইভেসি লংঘন করছে। এতো কিছু জানার দরকার কি? আমি একজন মানুষ, একজন ব্যক্তি। ব্যস।

ব্যক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রাইভেসি, ব্যাক্তির অধিকার ইত্যাদি ব্যক্তিতান্ত্রিক যুগে আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু গ্রামের মানুষ সেটা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না। কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক ছাড়া বিচ্ছিন্ন ‘ব্যক্তি’ নামক ভূত দুনিয়ায় থাকতে পারে এটা আন্দাজই করতে পারতো না। যেখানে এখনও গ্রাম অবশিষ্ট আছে সেখানকার মানুষ এখনও এরকমই হয়তো ভাবে। মানুষের ঠিকানা আছে, এই বোধ হয়তো তারা এখনও হারায় নি। আমরা শহরের মানুষ ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি।

মানুষ মানেই তার পরিবার আছে, তার আত্মীয়স্বজন আছে, সমাজ আছে, ঠিকানা আছে। তাই না? – তার নামসাকিন নাই সে শুধু সংখ্যা, শুধু ব্যাক্তি, এটা কেমন কথা! যেহেতু মানুষ নিজেকে সবসময় এই পরিবার-গ্রাম-সমাজের প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যেই আবিষ্কার করেছে তাই ‘সমাজ’ ধারণাও প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো তার সামনে হাজির থেকেছে। সমাজের মধ্যে থেকেই সে সমাজকে চিনেছে। বুঝেছে। সমাজের সঙ্গে কোথায় কিভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হয় শিখেছে। সমাজের অন্তর্ভুক্ত থেকে অর্থাৎ সমাজের সদস্য হিসাবে স্বীকৃতিও তার প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ভাবেই পাওয়া।

সেই সমাজ পরিচালনার জন্যও আবার ‘সমাজ’ গঠিত হয়েছে। সমাজের বিচার-আচার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিষ্পত্তি করেছে সমাজ। সমাজের যারা মাতব্বর তারা সালিশ বিচার করেছেন। তারা শাস্তি হিসাবে ‘সমাজচ্যুত’ করতে পারতেন। সমাজচ্যুতদের সঙ্গে সমাজের অন্যদের ওঠাবসা খাওয়া দাওয়া কোন প্রকার সামাজিক সম্পর্ক করা নিষেধ করে দিতে পারতেন। সমাজ ছিল বলেই সমাজের সদস্যদের সমাজ থেকে চ্যূত করা যেতো।

কিন্তু সমাজ শুধু সালিশ বিচার করত তা নয়। পাকা ধান কেটে নেবার পর গবাদিপশুগুলো কখন ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তারা যেখানে খুশি চরতে পারবে সেই সিদ্ধান্তও দিত। সমাজের উপস্থিতি অদৃশ্য ভাবে সমাজের সদস্যদের নানান নীতিনৈতিকতার বাঁধনে বেঁধে দিতো। গরিব মানুষ চাইলে যে কারো পাট ক্ষেত থেকে পাট শাক তুলতে পারত, এটা তার অধিকার, কিন্তু যারা সচ্ছল সেই নৈতিক অধিকার তাদের ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের পাশাপাশি মাটি, পানি, বন ইত্যাদি কখন কিভাবে সবাই ভোগ করতে পারবে এবং কখন পারবে না তার নীতি ও বিধান ঠিক করে দিতো ‘সমাজ’। তাই সমাজ যখন ছিল তখন ‘সমাজ’ কথাটাও বাস্তবের সত্য হিসাবে মানুষের জীবনে হাজির ছিল। সমাজ এখনকার মতো বিমূর্ত কিছু ছিল না।

যারা পেশায় জেলে তারা নদির মাছ ধরবে ও বিক্রি করবে। তাদের অন্য প্রয়োজন আছে, মাছ বিক্রি করে সেই প্রয়োজন মেটাবে। অন্যেরা মাছ ধরতে পারবে, কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। পেশায় জেলে না হলে সেই নৈতিক অধিকার অন্যদের ছিল না। যে সকল জলমহাল, নদী বা বিল সকলের – সেই সকল জলাঞ্চল হাওর বা বিলে কে মাছ ধরবে এবং কে বিক্রি করবে তার বিধিবিধানও ঠিক করে দিতো সমাজ। নিজের ভোগ বা ব্যবহার ছাড়া পেশায় জেলে না হলে মাছ ধরে বিক্রি করা সমাজ খারাপ চোখে দেখত। করলে জেল পুলিশ হোত না, লোকে নিন্দামন্দ করত। ব্যাটা তোর তো আছে, তুই আবার জেলেদের ভাত মারতে বাজারে কেন? সেটা অপমান। জেলের শাস্তির চেয়ে মানুষ তাকেই বড় শাস্তি গণ্য করতো। মানুষের লজ্জা ছিল।

ইঁচা, পুঁটি, ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও রবিনহুড

ছেলেবেলায় নিজের বাপের পুকুরে গ্রামের গরিব বাচ্চারা ইঁচা আর পুঁটিমাছ ধরেছে বলে বাপের অহংকারে হাত দিয়ে চড় থাপ্পড় মেরেছিলাম। পুকুর আমাদের তোরা মাছ ধরবি কেন? কিন্তু বাপ শুনে আমাকে কষে আরও কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন। কারণ চিংড়ি বা পুঁটির কোন পোনা আমরা পুকুরে ছাড়িনি, ছেড়েছি রুই কাতলার পোনা। অতএব রুই কাৎলা ছাড়া অন্য সব মাছের ওপরই গরিব গ্রামের বাচ্চাদের ‘হক’ আছে। (আমরা নোয়াখ্যাইল্যারা ছোট চিংড়ি মাছকে ‘ইঁচা’ বলি)।

‘হক’? সেটা আবার কী! চিংড়ি পুঁটি প্রাকৃতিক ভাবে পুকুরে এসেছে, পুকুরে জন্মেছে – এটা কারো নয়। এর ওপর কারো ব্যক্তিগত মালিকানা নাই। এর ওপর গরিব বাচ্চাদের হক আছে। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার খাটবে না। বোঝা যাচ্ছে ব্যাক্তিগত সম্পত্তিও একটি বিমূর্ত ধারণা, বাস্তবে সেটা কিভাবে কাজ করে সেটা না বুঝলে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণা হয় না। বাস্তব বোঝা যায় না। আইন দিয়ে বা শুধু মালিকানার ধারণা দিয়ে সেটা বোঝা যাবে না।

একটু ভাবুন, পুরা মার্কসবাদী রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এবং তার বিলয় বাসনার ওপর। কিন্তু সম্পত্তিকে শুধু আইনী মালিকানার ধারণা দিয়ে বোঝা যায় না। যে কারণে মার্কসকে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ নামক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ধারণা আবিষ্কার করতে হয়েছে। উৎপাদন মানে শুধু কারখানার উৎপাদন নয়; উৎপাদন মানে একই সঙ্গে ভোগ, উৎপাদন এবং বিনিময় ও বিতরণ সম্পন্ন করবার ব্যবস্থা। তাহলে সম্পত্তির চরিত্র বা মার্কসের অর্থশাস্ত্রীয় ভাষায় উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র দিয়ে সমাজের বৈশিষ্ট্য বিচার মার্কসবাদীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবার কথা ছিল। সেটা হয় নি। উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র বা ব্যবস্থা মানে সমাজ কিভাবে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ভোগের সামগ্রী উৎপাদন, বিনিময়, বিতরণ ও ভোগ করে। অথচ বাংলাদেশে এই ধারণা মূলত আইনী বা মালিকানা ধারণার অধিক কিছু হতে পারলো না।

অধিক কিছু হতে না পারার পরিণতি হয়েছে অদ্ভূত! বাংলাদেশে মার্কসবাদ হয়ে রয়েছে রবিনহুড মার্কা নৈতিক মহানুভবতার আদর্শ চর্চা। সেটা কেমন? বড়লোকের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে গরিবদের মালিক বানানো। রবিনহুড ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী ধনিদের সম্পত্তি লুট করে গরিবদের বিতরণ করতেন। ধনির সম্পত্তি দখল করে যদি গরিবকে সম্পত্তির মালিক বানানো মানে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ব্যবাস্থা অক্ষূণ্ণ রাখা। এই ধরনের নৈতিক মহানুভবতা ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ব্যবস্থা বহাল রাখার চর্চার অধিক কিছু না। তাই না? তবে আরামটুকু এই যে নিজেকে রবিনহুড ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করা যায়। রবিনহুড সমাজতন্ত্র দিয়ে সমাজ বা রাজনীতির কোন উপকার হয় না। ডাকাতি করে গরিবদের মধ্যে সম্পদ বিতরণ রোমান্টিক হতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে কোন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না।

বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরা তাই সমাজতন্ত্র বলতে বুঝেছেন ডিক্রি জারি করে বড়লোকের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে আনা? সেটা করা হয় জনগণ বা গরিবদের নামে। কিন্তু এর ফল হোল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির ভোগদখলে নিয়ে আসা। বাংলাদেশে ‘সমাজতন্ত্র’ নামক ধারণার মর্মকথা এখনও এটাই। যে কারণে পেটিবুর্জোয়া বামপন্থা সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ কিম্বা রাষ্ট্রকে সম্পত্তিবান করাকেই সমাজতন্ত্র মনে করে। এখনও। পুঁজির গোলকায়নের যুগেও। বিশ্বাস না হলে আশপাশের কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন। ব্যাক্তিগত সম্পত্তির কোন বিশেষ ধরণের তারা বিলয় চায়? সাধারণ বা নির্বিশেষ ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু নাই। এ সকল ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট কোন ধারণা নাই।

সমাজ সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট থাকবার কারনে বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলনে অপরিচ্ছন্ন চিন্তার তার ছাপ পড়ছে। বাংলাদেশে বামপন্থিরা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও তাকে গণমানুষের আন্দোলনে অর্থাৎ নতুন ধরণের সমাজ তৈরির লড়াইয়ে উন্নীত করতে পারছেন না। স্বপ্ন হিসাবেও নতুন ধরণের সমাজের আগ্রহ মানুষের মধ্যে জাগছে না। প্রমাণ হিসাবে দেখুন তারা কিভাবে ‘জাতীয় সম্পদ’ কথাটা ব্যাখ্যা করে। সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ নিন্দিত হবার পর রাষ্ট্রায়ত্বকরণের কথা পেটিবুর্জোয়ারা আজকাল আর বলে না। কিন্তু একই কথা জাতীয়তাবাদী মার্কা ‘জাতীয় সম্পদ’ ধারণার মধ্য দিয়ে বলে। যেমন, তেল, গ্যাস, কয়লা ‘জাতীয় সম্পদ’, এর মালিকানা রাষ্ট্রের এবং তার ব্যবস্থাপনা থাকবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে। গোলকায়নের যুগে জাতি, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে রাষ্ট্রকে মালিক বানালে জ্বালানির উৎপাদন, বিনিময়, বিতরণ ও ভোগের সম্পর্কে আদৌ কোন ইতিবাচক ফল হবে কিনা তার হদিস বা বিশ্লেষণ নিয়ে মার্কসবাদীদের উৎকন্ঠিত হবার কথা। কিন্তু সেই উৎকন্ঠা কই? বরং দাহ্য পদার্থকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বলার মধ্যে যে বিমূর্ত জাতীয়তাবাদ তৈরি করা যায়, সেই দিকেই আন্দোলনের ঝোঁক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই আন্দোলন তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার মধ্যে খাবি খাচ্ছে। বাইরে আসতে পারছে না। নগদ লাভ এই টুকুই যে আমরা আওয়ামী লীগের চেয়েও অধিক জাতিবাদী, অধিক দেশ প্রেমিক – এই আনন্দটুকু লাভ করা। জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়ছি এই আনন্দ যে বিমূর্ত নৈতিক ন্যায্যতা তৈরি করে, তার চরিত্র পেটি বুর্জোয়ার। খেটে খাওয়া জনগণের নয়। ফলে জ্বালানি সম্পদের ওপর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সকল অংশের অংশগ্রহণ বাড়ে নি। দীর্ঘ বছর ধরে চালানো এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সত্যিকারের জাতীয় রূপ লাভ করে নি। এখানে বিস্মিত হবার কিছু নাই। তারাই এর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে ও যুক্ত রয়েছে যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক। মার্কসীয় অর্থে উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভাবে কি ধরনের রূপান্তর কাম্য সেটাই মার্কসবাদীদের মুখ্য আলোচনার বিষয় হলে এই প্রশ্নে সত্যিকারের জাতীয় মৈত্রী ও ঐক্য নির্মাণ মোটেও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই কর্তব্য ‘জাতীয় সম্পদ’ ধারণার আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে।

আমি জ্বালানি সম্পদ আন্দোলনের নিঃশর্ত সমর্থক। তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা জরুরী, কিন্তু এই আন্দোলনের গুরুত্ব তাতে ছোট হয়ে যায় না। অতএব আমার পর্যালোচনা এর সম্ভাবনা নিয়ে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এই আন্দোলনের একটি মার্কসীয় বিচার একে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জরুরী। কিন্তু সেটা কঠিন। তার জন্য সমাজ, আইনী মালিকানা, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি গোড়ার ধারণা পরিচ্ছন্ন করে তোলা দরকার। সেই তাগিদ যতো তাড়াতাড়ি আমরা সমাজে গড়ে তুলতে পারব ততোই রবিনহুড নৈতিকতা থেকে নিষ্কৃতি পাবো। আন্দোলনের সঠিক অভিমুখ, নীতি ও কৌশলও গণমানুষকে বিপুল ভাবে সম্পৃক্ত করবার শর্ত তৈরি করবে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এই সকল অনুমান বদ্ধমূল থাকবার কারণে সম্পদের রাষ্ট্রীয়করণই সমাজতন্ত্র তার তেজ ও জের এখনও কাটে নি। ‘জাতীয় সম্পদ’ মার্কা ধারণা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। – এটাই বামপন্থিদের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে মার্কসের বা মার্কস অনুসারী বিপ্লবী রাজনীতির সম্পর্ক সামান্যই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি একটি সাধারণ ধারণা, তার বিশেষ রূপ আছে। সমাজ বদলের ধারণা যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকা না থাকার ধারণার সঙ্গে যুক্ত থাকে তাহলে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ভেদে মার্কসবাদীদের সুনির্দিষ্ট ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোন বিশেষ রূপের বিলয় চাইছে। কিন্তু সেই মার্কসবাদ বাংলাদেশে আমরা দেখি নি।

সমাজ ও সম্পত্তির ধারণা, অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বিপ্লবী রাজনীতির তত্ত্বগত ভিত্তি শূন্য হলে এর অন্য পরিণতিও আমাদের ভোগ করতে হয়। রাজনীতির তত্ত্বগত ভিত্তি শূন্য থাকলে সেটা নৈতিক শূন্যতাও তৈরি করে। জাতীয়তাবাদ বা জাতি প্রেম সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। রাজনীতির বৈধতা জারি রাখা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। নৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য তখন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট, বাম বা প্রগতিশীলরা খেয়ে না খেয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এটাই তাদের প্রগতিশীল হবার একমাত্র মানদণ্ড হয়ে ওঠে। ধর্ম বিদ্বেষী হয়ে তারা নিজেদের প্রগতিশীল প্রমাণ করতে থাকে। সমাজ বদলাবার প্রশ্ন যে আদতে সম্পত্তি বা উৎপাদন সম্পর্ক রূপান্তরের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত তার মর্ম তারা কক্ষনোই বোঝার চেষ্টা করে নি। তারা তাই নির্বিচারে ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। রবিনহুড সমাজতন্ত্রী থেকে তারা ধর্ম বিদ্বেষীতে পরিণত হয়। হয়ে ওঠে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী। কৌশলগত হলেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষকে তাদের রাজনীতির পক্ষে রাখার ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানও তারা হারিয়ে ফেলে। ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়াবার কারনে ধর্ম প্রাণ গরিব ও প্রান্তিক মানুষ তাদের আর বিশ্বাস করে না। তাদের পেছনে মানুষ দাঁড়ায় না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘সমাজ’ কথাটা মুখে তোতাপাখির মতো মুখস্ত বলে গেলেও সমাজ ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা বোঝা সহজ কাজ নয়। আরও কঠিন যদি সম্পত্তির ধারণা বা উৎপাদন সম্পর্কের ধারণা দিয়ে আমরা সমাজকে বোঝার চেষ্টা করি। তখনও সম্পত্তিকে স্রেফ আইনী ধারণা দিয়ে বোঝা যায় না। যেমন, ‘হক’ -- এই এক ‘অধিকার’ (?) যা আসলে আইনী মালিকানার অধিকার নয়। ‘হক’ তখনই বলবৎ হতে পারে যখন সমাজের নীতি-নৈতিকতা বোধ জারি থাকে। এটা কোন আইন নয়। কিন্তু দেখেছি, গ্রামের মানুষ এই নৈতিকতা মেনে চলতো। যারা চলতোনা তাদের মন্দ লোক বলে জানত। আমার বাবা আমি যেন কখনও গরিবের ‘হক’ কেড়ে না নেই সেই শিক্ষা দেবার জন্য আচ্ছাসে ভাঙা চেয়ারের হাতল দিয়ে মেরেছিলেন। গরিব বাচ্চারা চিংড়ি আর পুঁটি মাছ ধরেছে। তাদের মেরে তাদের হক কেড়ে নিয়েছি এটা বিশাল অপরাধ। কিশোর মাংসের ওপর পুত্র স্নেহ কাতর বাবার কঠোর মার লালচে আভা হয়ে স্মৃতিতে দগ দগ করে। গরিবের হক কেড়ে নেওয়া যাবে না। যদি সমাজ শিশু বয়স থেকেই শিক্ষা না দেয় ‘হক’ আইন করে বলবৎ করা যায় না।

বড় হয়ে যখন আইন আদালত নিয়ে পড়তে শুরু করেছি তখন কিছুতেই আইনী অধিকার হিসাবে এই ‘হক’ ব্যাপারটাকে মেলাতে পারলাম না। ‘হক’ সব সময়ই আইনের (positive law) বাইরে অধরা হয়ে থেকে যায়, নীতিনৈতিকতার বাঁধনের বাইরে তাকে বোঝাও যায় না, বলবৎ করাও কঠিন। ভাগ্য ভালো মার খেয়েছিলাম, নইলে সমাজে রটে যেতো বাবা মা আমাকে কোন শিক্ষা দিলেন না। পুকুর থেকে কয়েকটা ইঁচা আর পুঁটি মাছ ধরেছে, তাই তাদের ঘরের মেজো ছেলে গরিবের বাচ্চাগুলোকে কী মারটা মারল! কী খারাপ লোক! কী খারাপ ছেলে! পরিবারের যেন সেটা ছিল ভয়াবহ শাস্তি।

ক্লিশে পরিভাষা ত্যাগ জরুরী

বোঝাবার চেষ্টা করছি সমাজ যখন হাজির থাকে তখন সমাজ আমরা টের পাই। সমাজ যখন নাই তখন ‘সমাজ’ কথাটা নিছকই কথার কথা হয়ে ওঠে। সেখানে প্রবল হয়ে ওঠে আইন, আদালত, র্যা ব, পুলিশ রাষ্ট্র, ক্ষমতার হিংসা ও হিংস্রতা। পুরানা সমাজের জায়গায় স্থান নয় নতুন ধরণের সম্পর্ক। একে আমরা পুঁজি বা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বলে থাকি। কিন্তু বুঝি কিনা বলা কঠিন। কার্ল মার্কস ‘পুঁজি’কে আমরা যেন টাকা, কারখানা বা পণ্য না বুঝি সে সম্পর্কে সাবধান করে গিয়েছিলেন। পুঁজি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ করে বটে, কিন্তু এগুলো পুঁজির বিচলনের রূপ, এই একটি রূপের মধ্যে পুঁজিকে চেনা যায় না। বোঝাও যায় না। পুঁজি একটি সামাজিক সম্পর্ক। ‘সমাজ’ কথাটা মার্কস সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক বোঝাতে ব্যবহার করেছেন।

পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পুরানা সমাজ একদমই হারিয়ে যায় বলা যাবে না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমরা একটা ‘সমাজ’ গড়ে তুলি বটে, কিন্তু সমাজ বলতে আসলে যা বোঝায় আধুনিক রাষ্ট্রে ও শহরে সেই সম্পর্ককে সমাজ বলা যাবে না। অর্থাৎ সমাজে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোথায় কবে আমূল বদল ঘটে গিয়েছে, আমরা তা টেরও পাই নি। এই পরিবর্তন বোঝার জন্য আমাদের নতুন পরিভাষা ও ধারণা তৈরি করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। গৎবাঁধা কথা বললে তা আর কোন অর্থ বহন করে না। করবে না। মোটা দাগে ভাবলে একদিকে রাষ্ট্র আর অন্যদিকে সমাজ এই দুই ভাগে আমরা আমাদের জগতকে নিত্যদিন বিভক্ত হয়ে থাকতে দেখি। নতুন বাস্তবতায় গড় বাগধারা হিসাবে বর্ণনাত্মক অর্থে তারপরও আমরা ‘সমাজ’ কথাটা ব্যবহার করি। রাষ্ট্রের বিপরীতে সংখ্যার সমষ্টি বোঝানোর জন্য এর চেয়ে ভাল শব্দ আমাদের নাই। কিন্তু সম্পর্ক কথাটার মর্ম বুঝি না।

কথাগুলো বলছি কিছু ক্লিশে পরিভাষা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য। নব্বই দশক থেকে দেখছি বাংলাদেশে তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার দিকে অধিক মনোযোগী। অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন, গতি ও প্রতিযোগিতা তাতে এটা স্বাভাবিক। বিদেশি কোম্পানিতে ভাল বেতনে কাজের জন্য এমবিএ বিবিএ করবার দিকে ঝোঁক বেড়েছে। বিজ্ঞানেও আগ্রহ দেখছি। যা ভাল। কিন্তু সমাজ, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্র বিজ্ঞানে তরুণদের আগ্রহ ক্ষীণ। অনেক মেধাবিদের সঙ্গে কথা বলে হতাশ হয়ে যাই। তবে সম্প্রতি বদল হচ্ছে টের পাই। সেটা ঠিক কবে শুরু হয়েছে জানি না। আগে মুখস্থ কথার মতো শুনতাম, আমরা সমাজ বদলে বিশ্বাসী। আমরা বিপ্লব চাই, বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই, ইত্যাদি। কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগতো, কিন্তু আসলে কে কি চাইছে বোঝা যেত না। বোঝা মুশকিল ছিল ‘সমাজ বদল’ নামক এই ‘গাল ভরা শব্দের মানেটা আসলে কী! কমিউনিস্ট আদর্শে যারা বিশ্বাসী তারা ‘বিপ্লব’ করতে চায়, কিন্তু ‘বিপ্লব’ বলতে তারা ঠিক কি বোঝে আর কেনই বা বিপ্লব চায় সেটা তাদের লেখালিখি কথাবার্তা পড়ে বোঝা মুশকিল। এখন মাঝে মধ্যে দুই একজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, বাগাড়ম্বর কমছে। সারবস্তুর দিকে আগ্রহ বাড়ছে। এটা ভাল।

ভুল হবে যদি বলি তরুণরা কিছুই বুঝতো না বা বোঝে না। এটা বোঝা কঠিন নয় যে যারা ক্ষমতায় তাদের তারা চায় না। তো তারা কী চায়? তারা নিজেরা ক্ষমতা চায়? তাও চায় না। কারন কিভাবে ক্ষমতা তৈরি হয় এবং কিভাবে তার ওপর অধিকার জন্মে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সেই সকল ন্যূনতম বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নাই। কিন্তু তারপরও দেখি যারা নিজেদের প্রগতিশীল, বামপন্থি বা কমিউনিস্ট বলে মনে করে তারা আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত। তারা বিএনপি-জামাত চায় না। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতার যে রূপান্তর ঘটেছে তাকে বাস্তবোচিত ভাবে বিশ্লেষণ এবং সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় করণীয় সম্পর্কে তাদের কোন বক্তব্য দেখি না।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে বাংলাদেশে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক আগে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলো, সেই সম্পর্ক মার্কস আর এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইশতেহারের ভাষায় ‘মোমের মতো গলে গিয়েছে’। সেখানে স্থাপিত হয়েছে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক। পুরানা সমাজ আর নাই। যে সমাজ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আগে আমরা দেবার চেষ্টা করেছি। সেই সমাজের প্রতি রোমান্টিক কাতরতার কোন কারণ নাই। আমরা সেখানে প্রত্যাবর্তন করতে পারব না। সেটা আমাদের ইচ্ছাও নয়। শুধু আইন আদালত ও রাষ্ট্র মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয়ের একমাত্র পন্থা নয়, আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠবার আগে মানুষ ভিন্ন ধরণের সম্পর্কে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেটা বোঝাবার জন্যই পুরানা সম্পর্কের নজির দিয়ে কথা শুরু করেছি। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে আমরা নিত্য বাস করি বলে সেই সম্পর্কের চরিত্র আমরা সহজে বুঝতে পারি না।

প্রতিশ্রুতি ও বিপ্লব

আসলে প্রশ্ন সেখানেও নয়। প্রশ্ন হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ছিন্ন করে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক নির্মানের কোন সম্ভাবনা আদৌ ধারণ করে কিনা। এর উত্তর হচ্ছে অবশ্যই ধারণ করে। মানুষ নতুন সম্পর্ক নির্মান করতে পারে। মানুষই তা পারে। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সকল স্বাভাবিক সম্পর্ক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মোমের মতো গলে গিয়েছে তার ছাইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন সম্পর্ক নির্মাণের কথা মানুষ ভাবতে পারি কিনা। উত্তর: হ্যাঁ। মানুষ অবশ্যই পারে, আমরা অবশ্যই পারি। মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। সেই সম্পর্ক ভবাততে পারা যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়ন সম্ভব কি? আলবৎ সম্ভব। এই প্রতিশ্রুতি বা বিশ্বাসের কোন বিকল্প নাই। এই প্রতিশ্রুতি বা বিশ্বাস জারি না রাখলে মানুষের পরাজয় অনিবার্য। পরাজিত মানুষ পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের দাসত্ব মেনে নেয়। তার আর কোন ভবিষ্যৎ নাই। আর কোন ইতিহাস নাই। বিপ্লবীদের ভাষায় সে ভেজিটেবলে বা সব্জিতে পরিণত হয়।

বিপ্লবী চিন্তা, বৈপ্লবিকতা, বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাবার সংকল্পের গোড়ায় রয়েছে প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস। মানুষ একদিন সকল প্রকার শৃংখল থেকে মুক্ত হবে। তার আত্মদর্শন ঘটবে। সে নিজেকে সকল কর্মকাণ্ডের কর্তা হিসাবে নতুন করে আবিষ্কার করবে। এর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশেষ কোন পার্থক্য আছে কিনা তা নিয়ে আমরা খামাখা কুতর্ক করতেই পারি। কিন্তু প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস ছাড়া মানুষ নিজের মধ্যে কোন বিপ্লবী কর্তাসত্তার উদ্বোধন ঘটাতে পারে না। মূলে বিশ্বাস হারালে তার ভেজিটেবল হয়ে যাবার বিপদ ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

বলাবাহুল্য, বিশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। প্রাচীন, পুরানা ও বস্তাপচা মতাদর্শ বা ইডিওলজি এই ক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে না। সবকিছুই নতুন করে ভাববার ও পর্যালোচনা করবার দরকার আছে। এটা বোঝাবার জন্যি অতি ব্যবহৃত ‘সমাজ’ শব্দটি নিয়ে আজ কথা বলার চেষ্টা করেছি। আগামি দিনের সমাজ আসলে কেমন হবে বা কেমন হতে পারে তার সম্ভাবনা কাল্পনিক বা আজগবি ধারণা ফেরি করে মানুষকে বোঝানো যাবে না। বাস্তবের বিচার বা পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই নতুন করে তৈরি করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে ডান চিন্তা বাম চিন্তার বিভাজন মানেই পচা আলুর বস্তা মাথায় তুলে নেওয়া। সমাজ, সম্পর্ক, ক্ষমতা, রাষ্ট্র, কর্তাসত্তা ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই নতুন ভাবে ভাববার আহ্বান জানানোই এখন আমাদের কাজ। সব কিছুকেই তীক্ষ্ণ পর্যালোচনার অধীন করতে পারার ওপর বাংলাদেশে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আসুন, আমরা সমাজ নিয়ে ভাবতে শিখি, সমাজ পর্যালোচনার বিজ্ঞান আয়ত্ত করি। সম্ভাব্য ভবিষ্যত আগাম চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন করি।

১৩ নভেম্বর ২০১৫। ২৯ কার্তিক ১৪২২। শ্যামলী।

(দৈনিক যুগান্তরে ১৪ নভেম্বরে ছাপা হয়েছে। আরও প্রাসঙ্গিক করবার জন্য কিছুটা পরিবর্ধন করেছি)

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।