জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ


ঘটনা হচ্ছে ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের বিরোধ। এটা ঘটনার বাইরের দিক। হয়তো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা নিত্যদিনের একটি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন সংঘাত হিসেবেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেটা যখন আরও বড় সংঘর্ষের রূপ নিল, দেখা গেল তার মধ্যে শ্রেণীর প্রশ্ন আপনাতেই সামাজিক বাস্তবতার কারণেই এসে পড়েছে। বের হয়ে পড়ছে আগের বিরোধ ও সমাজের সুপ্ত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিশেষত ঘটনার কয়েকদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ধানতলা গ্রামের শাহজালাল (রহঃ) মসজিদ কমপ্লেক্স ও হযরত আবুবকর সিদ্দিকী (রাঃ) কওমী মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রশাসন মাদ্রাসার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এই অভিযোগ রয়েছে।

একদিকে ব্যবসায়ী আর তাদের সমর্থক ছাত্রলীগ কর্মী; অন্যদিকে তাদের প্রতিপক্ষ বিত্ত ও ক্ষমতার প্রান্তের গরিব মানুষগুলোর সন্তান। এরা সাধারণত মাদ্রাসায় পড়ে বলে এদের শুধু 'ছাত্র' বলা হয় না, মাদ্রাসার ছাত্র বলা হয়। ক্ষমতাসীনরা যাদের ‘তরুণ প্রজন্ম’ বলে থাকে, এরা সেই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয় না। বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িকরা যেভাবে তাদের দ্বারা চিহ্নিত কিছু জনগোষ্ঠিকে সমাজের বাইরে গণ্য করে, সেভাবেই গরিবের বাচ্চাগুলোকে তারা সমাজের অংশ মনে করে না। ধনি ও বিত্তবানরা যখন ‘সমাজ’ নিয়ে কথা বলে সেখানে মাদ্রাসার ছেলে বা মেয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকেনা। বিত্তবানেরা টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষগুলোকে সমাজের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করে না।

তাতে অসুবিধা নাই। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্র উভয়েই ভদ্রলোকদের সমাজের প্রান্তে থেকেছে, এমনকি তাদের পরিসীমার বাইরেও বটে। কিন্তু এতে মাদ্রাসা কিম্বা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি মজলুমের আগ্রহকে দমন করা যায় নি। সমস্যা অন্যত্র। কোন প্রকার প্রমাণ বা যৌক্তিক ভিত্তি ছাড়া ভদ্রলোক শ্রেণি মনে করে মাদ্রাসার বাচ্চাগুলো সম্ভাব্য ইসলামী জঙ্গি, অতএব তারা সবসময়ই নির্মূলযোগ্য। তাদের নির্মূল করাই এখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও বিশ্ব রাজনীতির কর্তব্য। বিপদটা এখানেই। ব্রাহ্মবাড়িয়ার ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ সেই কর্তব্য পালন করতে মাঝরাতে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলা চালায়। তারা মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হাফেজ মাসুদুর রহমান মাসুদকে হত্যা করে। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ছাত্ররা চিনেনি তা না। চিনেছে। মাদ্রাসার ছাত্ররা এর জন্য কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে শনাক্ত ও দায়ী করেছে। তাদের তাদের অপসারণ ও শাস্তিও দাবি করেছে তারা। ভারতের সীমান্তবর্তী এ শহরের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাটিকে একটি তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে বন্ধ করে দেয়া যায় কিনা তার একটা চেষ্টা চলেছিল। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। এর থেকে শিক্ষণীয় বহু কিছু রয়েছে। সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এবং বিশেষভাবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সেক্রেটারি অব স্টেট কন্ডিলিসা রাইসের কওমি মাদ্রাসা নির্মূল নীতির পরও কিভবে  দক্ষিণ এশিয়ার মাদ্রাসাগুলো টিকে আছে সেটা এখনও রীতিমতো বিস্ময়। আল্লাহর রহমত আছে বলেই মাদ্রাসার পোলাপান এখনও টিকে আছে বললে কেউ যদি একে ধর্মবাদী ব্যাখ্যা মনে করেন, তাই আমি সেই দাবি করছি না। কিন্তু এটা পরিষ্কার টিকে থাকার প্রধান কারণ বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রান্তিক তরুণদের প্রতিরোধ ও লড়ে যাওয়ার সাহস। মাদ্রাসা নির্মূল অভিযান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নীতির অন্তর্গত। এটা ভাববার কোন কারন নাই যে এই যুদ্ধ ঘোষণার মুখে মাদ্রাসার ছেলেরা কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবে। তারা যায় নি। তারা যাবেও না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রতিরোধের শক্তির আরেকটি নমুনা দেখলাম। বলাবাহুল্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাঝরাতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, তাণ্ডব এবং হত্যা সারা দেশের মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য খুবই খারাপ সংকেত। ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পর সমূহ সংঘাতের পরিস্থিতি থাকলেও একটা সহাবস্থানের নীতি সব পক্ষ মেনে চলছিল। বোঝা যাচ্ছে মাদ্রাসা নির্মূল যাদের রাজনীতি, তারা এ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায় না। তারা বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের অসম্পূর্ণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে চায়। এর পরিণতি কী ভয়ংকর হতে পারে সেটা তারা জানে কিনা জানি না। তবে জেনে-শুনে কেউ কেউ বাংলাদেশকে সংঘাত ও রক্তপাতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে কিনা সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখার দরকার আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তরুণ সম্প্রদায় অশনিসংকেত হিসেবেই নেবে। প্রতিরোধ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ ক্ষমতাসীনরা যেমন খোলা রাখতে চাইছে না, তেমনি ইসলাম নির্মূলের সৈনিকরাও সংঘাত এবং রক্তপাতকেই বেছে নিতে চাইছে। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য।

মাদ্রাসা শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, এটি ছাত্রদের আবাসস্থলও বটে। মাদ্রাসায় হামলা মানবাধিকার লংঘনের দিক থেকে ভয়ংকর অপরাধ। এর মানে ক্ষমতাসীনরা আবাসস্থলের নিরাপত্তাও নাগরিকদের দিচ্ছে না। যে কোন নাগরিকের এই ক্ষেত্রে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যেও স্বভাবতই সেই মাত্রাতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে শহরের নানা জায়গায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে। এতে বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। মাদ্রাসাবিদ্বেষী গণমাধ্যমের ভাষায় একে বলা হয় মাদ্রাসা ছাত্রদের ‘তাণ্ডব’। যে দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ইসলাম নির্মূলের অভিযানে সাম্রাজ্যবাদীদের স্থানীয় বরকন্দাজ, তারা এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। তারা পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা, তাণ্ডব এবং হত্যাকাণ্ড ঢাকতে গিয়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা কত খারাপ সেটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের ব্যস্ততার আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। মাদ্রাসার ছাত্ররা এতই খারাপ যে তারা এমনকি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত সঙ্গীতাঙ্গনটিকেও বাদ রাখল না। তাদের এই প্রকার সাংস্কৃতিক হাহাকারে আকাশ বাতাস শোকাতুর হয়ে পড়ে। সংস্কৃতিকেও ভদ্রলোক শ্রেণী কিভাবে উন্নত মানের ক্যারিকেচারের পরিণত করতে পারে এই সময়ের পত্রপত্রিকা ও ভদ্রলোকদের লেখালিখি পড়লেই টের পাওয়া যায়। মাদ্রাসার ছাত্ররা কত বর্বর, কী পরিমাণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী সেটা প্রমাণ করবার জন্য বিস্তর লেখালেখি চলল। এখনও ক্ষান্তি নাই। এর ফল কি? বিচার-বিবেচনাহীন বিদ্বেষপ্রসূত প্রচারে ছাই চাপা আগুন ছাইয়ের নিচে জ্বলতে থাকবে। ঠিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আপাতত শান্ত। কিন্তু পুরোপুরি শান্ত সেটা মোটেও বলা যাবে না।

মাদ্রাসার ছাত্ররা যদি ‘তাণ্ডব’ করে থাকে তবে তা নৈতিকভাবে নিন্দা করবার অধিকার যে কোনো নাগরিকেরই আছে। কিন্তু যে ঘটনার জের ধরে মাদ্রাসায় হামলা হল এবং মাত্র কৈশোর অতিক্রম করা তরুণ মাসুদুর রহমান মাসুদকে হত্যা করা হোল, তাকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাড়ি পোড়ানোর জন্য হাহুতাশ হাস্যকর হয়ে উঠেছে। এতে আলাউদ্দিন খাঁকে সম্মানিত করা হয়নি। পাল্টা তাঁকে মাদ্রাসার বিপরীতে দাঁড় করানোর ব্যাপারটি তামাশা হয়ে উঠেছে। তথাকথিত ‘তাণ্ডব’-এর সঙ্গে মাদ্রাসার ছাত্ররা জড়িত ছিল তার কোনো প্রমাণ আছে কিনা বরং এখন সেই প্রশ্নই প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রথম আলোতেই একজন নিবন্ধকার ১৭ জানুয়ারির কাগজে একটি লেখায় জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে হামলার সময় মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে বহিরাগত জিন্স শার্ট পরা যুবকদেরও দেখা গেছে। তার মানে  আসলেই জিন্স শার্ট পরা কিছু ভুতুড়ে শক্তি রয়েছে যারা  ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে একটি বিশেষ খাতে প্রবাহিত করতে চায়। তাদের শনাক্ত করা এখন সবারই কর্তব্য হয়ে উঠেছে। অনেকেই এখন বলছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রমাণ করছে বাংলাদেশ একটি বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছে। যে কোনো সময়ই তুচ্ছ ঘটনা ধরে মহাবিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। তাঁরা খুব একটা ভুল বলেন নি।

প্রশ্ন হচ্ছে কথাকাটাকাটির জের ধরে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ মিলে গভীর রাতে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলা এবং ভাংচুর করতে গেল কেন? কেন শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান মাসুদকে হত্যা করা হল? মনে রাখা দরকার মাসুদকে রাস্তায় মারা হয়নি। মাদ্রাসা আবাসিক জায়গা, তাকে তার আবাসস্থলেই হত্যা করা হয়েছে। এটি গুরুতর মানবাধিকার লংঘন। যদি আইনের শাসন ও নাগরিক অধিকারের বিধিবিধান আমরা মানি, তাহলে এ ধরনের হামলা এবং হত্যা আমরা বরদাশত করতে পারি না। তর্কের খাতিরে মানতে পারি মাদ্রাসার ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা মামলা থাকতে পারে। কিন্তু আইন মেনে অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করে রাতে আবাসিক মাদ্রাসায় চড়াও হওয়া কেন? অথচ এই গোড়ার ও আসল সত্য কথাটাই ভদ্রলোকদের প্রতিটি গণমাধ্যমই চেপে গিয়েছে, যা নাগরিক অধিকার রক্ষার দিক নিন্দনীয় ও বিপজ্জনক। মাদ্রাসার ছাত্ররা বর্জ্যের মতো। তাদের যেখানে খুশি সেখানে হত্যা করা যায়- এ ক্ষোভ মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে আমরা এখন দেখি। এটি ভালো নয়। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে ইসলাম নির্মূলবাদীরা যা করছে তার ফল ক্ষমতাসীনদের জন্যও ভালো হবে না। বাংলাদেশের জন্য তো নয়ই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসিকে অপসারণের দাবি তুলেছে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা। এহ বাহ্য। অর্থাৎ এটা গৌণ দিক। মূল প্রশ্ন হচ্ছে যারা সমাজের বিশাল একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্রেফ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে নির্মূল করতে চায়, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পাল্টা প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে সক্ষম কি-না। এ কারণে নাগরিকতা ও মানবাধিকারের ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে। কেউ মাদ্রাসায় পড়ে বলে তাকে ইসলামী জঙ্গি ভাবা, কিংবা ইসলামকে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের ঐতিহ্য থেকে নির্মূল করবার বাসনার মধ্যে যে ভয়ংকর বিপদ নিহিত রয়েছে এ ব্যাপারে দ্রুত সবাইকে সতর্ক হতে হবে।

বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতিক্রিয়াকে ‘তাণ্ডব’ আখ্যা দিয়ে সমাজ ও রাজনীতির গভীর ক্ষতের কোনো উপশম হবে বলে আমি মনে করি না। যারা মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি সমব্যথী হতে চান, তারা দাবি করেন পাল্টা বলপ্রয়োগ ও সহিংসতা ছাড়া প্রতিবাদের এবং বিক্ষোভের অন্য কোনো তরিকা মাদ্রাসার ছাত্রদের জানা নাই। ব্যাপারটা মোটেও ঠিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা যদি খোদ রাষ্ট্রই বিলুপ্ত করে দেয় তাহলে কোনো তরিকাতেই কাজ হয় না। নাগরিক অধিকার, আইন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন যদি শাসনের ভিত্তি না হয় তাহলে মাদ্রাসার ছাত্র কেন, যে কেউই রাতে আবাসস্থলে হামলা হলে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালাবে। মুশকিল হচ্ছে যারা মুখে উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে, তারা নিত্যদিন একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। এ ব্যবস্থা বিদ্যমান রেখে নিয়মতান্ত্রিক ও উদার রাজনীতি অসম্ভব। নিদেনপক্ষে উদার রাজনীতির পরিসর গড়ে তোলার জন্য সমাজের সব পক্ষের মধ্যে যুক্তিসিদ্ধ এবং বাস্তবোচিত আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু কিছু কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকায় মনে হয় তারা তাদের প্রতিপক্ষকে নিশ্চুপ ও অদৃশ্য করে দিতেই যেন বদ্ধপরিকর।

যারা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে ভালোবাসেন, তারা সঙ্গত কারণেই তার অঙ্গনে হামলায় আহত হয়েছেন। আমারও ভালো লাগেনি। আমার কৈশোর থেকেই আলাউদ্দিন খাঁর কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়অকে এক স্বপ্নের জেলা হিসেবে ভাবি। এখনও তা মনে আঁকা হয়ে আছে। তিনি ছিলেন গানের দরবেশ। সঙ্গীত ছিল তাঁর কাছে  রূহানিয়াতের জগতে প্রবেশের দরজা। এ গানের দরবেশ দেশ ও ধর্মের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছেন। ছেলেবেলায় মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি যাত্রাদলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে বাংলার লোকসঙ্গীতের রসে ডুবে গিয়েছিলেন। তার ঘরপালাবার কাহিনী কিশোর বয়সে নানান রং চড়ানো কেচ্ছা হয়ে এখনও কানে বিঁধে রয়েছে। ভাবতাম কীভাবে একটি সংরক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের ছেলে হয়ে তিনি শুধু সঙ্গীতের প্রেমে পণ্ডিত গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের শিষ্য হতে পেরেছিলেন। এখন বুঝি সঙ্গীত ছিল তার এবাদতের ক্ষেত্র। পণ্ডিত গোপাল ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। আলাউদ্দিন খাঁ তাই তারাপ্রসন্ন সিংহ নাম নিয়ে তাঁর কাছে গেলেন,  হিন্দু নামেই তার কাছে নিজের পরিচয় দিলেন। হিন্দু নাম নিয়েই শিষ্য থাকলেন। নয় বছরের মাথায় পণ্ডিত গোপাল প্লেগে মারা গেলেন। তিনি অমৃতলাল দত্তের কাছে গান শিখলেন। এসব ঘটনার কারণে তিনি গানের জগতে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছেন। গানের প্রতি তার নিষ্ঠার সুখ্যাতি এসব কারনেও ছড়িয়েছে  ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি মুসলমান জানলে গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাকে গান শেখাতেন কিনা সন্দেহ। যারা আলাউদ্দিন খাঁকে ভালোবাসেন, তাহলে তাদের বুঝতে হবে ভাষা, সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে গিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানকে সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহু বাধার মোকাবেলা করতে হয়েছে। হিন্দু গানের গুরুর কাছে হিন্দু নাম নিয়ে গান শিখতে হয়েছে। কিন্তু যারা আজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের কথা বলেন তারা আবার সেই পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে চান, যেখানে ইসলাম কিংবা মুসলমানের কোনো স্থান নাই। তারা সমাজ ও সংস্কৃতির বাইরের উপদ্রব মাত্র। নিত্য নিগৃহীত ও অপমানিত। এ মানসিকতা স্রেফ উচ্চ বর্ণের বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। এই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে তর্ক চলছে। ঐতিহ্যের তর্কটাও একপেশে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য। ভালো কথা। একইভাবে জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসাও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য। রাতে সেই মাদ্রাসায় হামলা ও ভাংচুর তাহলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপরই আক্রমণ। কিন্তু যারা সংস্কৃতি ো ওইতিহ্য নিয়ে বাগাড়ম্বর করেন তারা  ইসলামকে সমাজ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাইরের বিষয় মনে করেন।  তারা আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিচিহ্নকে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য হিসেবে মানতে রাজি; অথচ সচল, সক্রিয় ও জীবন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসাকে মেনে নিতে রাজি না। এই স্ববিরোধিতাই ইতিহাস-ঐতিহ্যবোধের বর্ণবাদী বিকৃতি। সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র।

যারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সংবেদনশীল, আশা করি তারা বুঝবেন জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে আলাদা কিছু নয়। এখানে শিক্ষাব্যবস্থা মাদ্রাসার বলে তার বিরোধিতা করতে হবে এমন কোনো যুক্তি নাই। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ভিত্তি ও গঠন নিয়ে যেমন পর্যালোচনা হতে পারে, তেমনি কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যেরও পর্যালোচনা জরুরি। সামগ্রিক শিউক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার দরকার এই দাবি মেনে নিতে কোনোই অসুবিধা নাই। দেওবন্দি আলেম-ওলামারাও শিক্ষা সম্পর্কে তাদের অনুমান ও দর্শনের জায়গা থেকে সংস্কারের বিরোধিতা করেন না। কিন্তু ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেয়ার দাবি মেনে নেয়া যায় না। কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা বোঝে এটাই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জায়গা। মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘আধুনিক’ করে ইসলামবিদ্বেষী ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা চর্চা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলাম তৈরির কারখানা বানাবার কোনোই যুক্তি নাই। মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘যুগোপযোগী’ ও ‘আধুনিকীকরণ’-এর নামে এটাই আসলে প্রস্তাব করা হয়।

শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে সংস্কার দরকার। আর সেই দিক থেকে সংস্কারের কাজটা শিক্ষাব্যবস্থার মাথা থেকে অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই আগে শুরু করা উচিত। বিশেষত যে শিক্ষাব্যবস্থা বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট ও জর্জ বুশ এবং টনি ব্লেয়ারদের ছানাপোনা তৈরি করে সেই ব্যবস্থার বদল জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই শিক্ষাই দরকার যা আমাদের মর্যাদার সঙ্গে নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত রেখেই বিশ্ব সভায় যোগ দিতে শেখায়। সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে।

সমাজের নানান স্ববিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের অনেক গভীর থেকে উঠে আসছে। শুরুতেই তাই শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছি। রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের অপরিচ্ছন্নতা ও অস্পষ্টতার কারণে দ্বন্দ্বগুলো ধর্ম বনাম ঐতিহ্য, ইউনুছিয়া মাদ্রাসা বনাম আলাউদ্দিন খাঁ- ইত্যাদি নানাভাবে হাজির হচ্ছে। কিন্তু যিনি চিন্তায় ও দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্ন, তার চোখে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রতিরোধের লক্ষণ ও তার নানাবিধ ধরন ধরা পড়তে বাধ্য।

১৮ জানুয়ারি ২০১৬। ৫ মাঘ ১৪২২। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।