প্রধান বিচারপতির বক্তব্য ও বিতর্ক
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দুর্দশা নতুন কোন খবর নয়, তবে সম্প্রতি বিচারকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেভাবে প্রকাশ হয়েছে তাতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট আরও তীব্র হতে পারে। কিছুদিন আগে অবসর নেওয়া সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম সামসুদ্দিন চৌধুরী যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে ঘায়েল করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন পৃথিবীর আর কোথাও এই প্রকার আচরণের কোন নজির আছে কিনা আমার জানা নাই। সাবেক এই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক নামে পরিচিত। ব্যক্তিগত ও সংকীর্ণ পেশাগত দ্বন্দ্বকে তিনি প্রকাশ্য করে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে যেখানে নামিয়ে এনেছেন তাকে অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। বিষয়টি স্রেফ বিস্ময়ের বিষয় হলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু সাবেক এই বিচারপতির আচরণ, উচ্চারণ এবং প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তার ভূমিকা স্রেফ বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা সজ্ঞানে বিনষ্ট করার শামিল। তাঁর মন্তব্য ‘আদালত অবমাননা’র পর্যায়ে পড়ে। প্রধান বিচারপতিকে ঘায়েল করতে গিয়ে তিনি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করবার মহৎ কাজে লিপ্ত হয়েছেন। বিচার ব্যবস্থার বিপর্যয় এতে আরও ত্বরান্বিত হবার ও ভেঙে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে এই বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, 'বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে নির্বাহী বিভাগ'। বিচারবিভাগের দিক থেকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গুরুতর। মনে রাখা দরকার মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালতের সদ্ধান্ত চেম্বার জজ স্থগিত করে দিত বলে একই সারকথা বলেছিলেন। এটর্নি জেনারেল আদালতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি। দেখা গেছে হাইকোর্ট যখন কোন মামলায় রায় দেয়, এটর্নি জেনারেল তার স্থগিতাদেশ চেয়ে চেম্বার জজের কাছে আবেদন করেন। আদালতে নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি – অর্থাৎ এটর্নি জেনারেলের আবেদন অনুযায়ী চেম্বার জজ স্থগিতাদেশ মঞ্জুর করেন। নিয়মিত এই ঘটনা চলতে থাকলে সুপ্রিমকোর্টের একজন জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান দৈনিক আমার দেশকে বলেছিলেন, হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেয়াটাই যেন চেম্বার জজ আদালতের মূল কাজ। আর ঠিক এই কথাটাকেই দৈনিক আমার দেশ বলেছিল, ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’। অথচ এই কথা বলার জন্য আদালত মাহমুদুর রহমানকে ছয়মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
মাহমুদুর রহমান তাঁর বক্তব্যের জন্য আদালতের কাছে ক্ষমা চান নি। চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ছাড়াও সত্য প্রকাশের দৃঢ়তা্র জন্য মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকতার ইতিহাসে বিশাল উদাহরণ হয়ে থাকবেন। কিন্তু এখন প্রধান বিচারপতি সারমর্মের ভাষায় একই কথাই বলছেন: নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। নির্বাহী বিভাগ কেড়ে নেবার কাজটি এটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে চেম্বার জজের মাধ্যমে সম্পন্ন করছিল দৈনিক আমার দেশের এই অভিযোগ তাহলে মিথ্যা নয়। মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেবার বেঞ্চে এ এইচ এম সামসুদ্দিন চৌধুরীসহ বিচারপতি এস কে সিনহাও ছিলেন। ইতিহাস এক প্রহসন বটে!
সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সিনহা আবার বলেছেন, অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিদের রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি হিসাবে তিনি একুশতম। গত সতেরো জানুয়ারি বিচারপতি হিসাবে তাঁর একবছর পূর্ণ হোল। প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে তিনি একটি ‘বাণী’ দিয়েছেন। সেখানেই তিনি এই বোমাটি ফাটালেন।
এই কথার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সাঙ্গপাঙ্গরা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ফলে তিনি ঠিক কী বলেছেন সেটা আমাদের জানা দরকার। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলছেন, “সুপ্রিম কোর্ট এর বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের সংরক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে গণ্য হন বিধায় তাঁর গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। আদালতের নথি সরকারী দলিল । একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের নিকট সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার হারান, আশা করি বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনী কাজ থেকে বিরত থাকবেন” (দেখুন সুপ্রিম কোর্ট ওয়েবসাইট)।
সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসাবে অবসর নেবার আগে থেকেই প্রধান বিচারপতিকে পর্যুদস্ত ও অপদস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে অবসরের পর তিনি একজন সাধারন নাগরিক মাত্র। যেভাবে তিনি আদালতকেও পর্যুদস্ত ও অপদস্থ করে চলেছেন তা ঘোরতর আদালত অবমাননা। মাহমুদুর রহমান ছয় মাস অন্যায় ভাবে শাস্তি ভোগ করে আসবেন আর শামসুদ্দিন চৌধুরি মানিকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, বিচারবিভাগ এই দ্বৈত নীতি গ্রহণ করতে পারে না। টেলিভিশানেও এই সাবেক বিচারপতি বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছেন। বিতর্কিত বক্তব্য অসুবিধা নয়; টেলিভিশানে অনেকেই অনেক স্টুপিড মন্তব্য করে থাকেন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও করতে পারেন, সেটা তার মত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু যে বক্তব্য প্রধান বিচারপতিকে জনসমক্ষে অপদস্থ করে ও জনগণকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সামগ্রিক ভাবে তুমুল অবিশ্বাসী করে তোলে সেটা অবশ্যই আদালত অবমাননা। মাহমুদুর রহমান ও বাংলাদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা এক রকম আর সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরির জন্য তো সেটা ভিন্ন হতে পারে না।
দুই
জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের দিক থেকে তাকালে ক্ষমতাসীনদের বরকন্দাজ বিভিন্ন রঙ ও পোশাকের সুবিধাবাদী ব্যাক্তি বা গোষ্ঠির অন্তর্দ্বন্দ্ব বিচার ব্যবস্থার জন্য অবমাননাকর হলেও এসব কিছুতে শেষমেষ বাংলাদেশের জনগণের লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। বিচার ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে যে সকল সমালোচনা এতদিন করা হয়েছে তার ক্ষত ও দুর্গন্ধই আসলে এখন ছড়াতে শুরু করেছে। যতোই তা প্রকাশ্য হতে থাকবে ততোই জনগণ বুঝতে পারবে বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে সংস্কারের সুযোগ নাই বললেই চলে। এই দিক থেকে এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এস কে সিনহার দ্বন্দ্ব আমাদের জন্য বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিষয়টা শুধু আদালত অবমাননা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক এবং সামগ্রিক ভাবে বিচার ব্যবস্থার ক্ষয়ের বিচারের প্রশ্ন নয়। দুই একজন বিচারকের নীতিনৈতিকতার প্রশ্নও বটে।
বাংলাদেশের সাধারন মানুষকে একটি প্রশ্ন করি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। কিন্তু সেই দেশের সুপ্রিম কোর্টে কেউ যদি তার বিদেশী নাগরিকত্ব লুকিয়ে রেখে অতিশয় প্রভাবশালী বিচারক হয়ে বসে তাহলে তার কী শাস্তি হওয়া উচিত? কোন দেশ কি তা বরদাশত করবে? কোনো দেশ কি তার সুপ্রিম কোর্টে কোন বিদেশী বিচারক মেনে নেবে? অবশ্যই না।
এখন ধরা যাক কোন একজন বিচারক সম্পর্কে এই ধরনের অভিযোগ উঠল। সুবিচারের খাতিরে আমরা ধরে নিচ্ছি এই অভিযোগ মিথ্যাও হতে পারে। তাহলে এই ক্ষেত্রে সরকার, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হতে পারে? অবশ্যই এই অভিযোগের সত্যমিথ্যা যাচাই করা। সত্যতা সাপেক্ষে তাকে দ্রুত অপসারণ করা। যদি কেউ সত্য গোপন রেখে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়ে থাকে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা।
কিন্তু বাংলাদেশ বিচিত্র দেশ। সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরি মানিক সম্পর্কে এইসকল গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরেও তার কোন তদন্ত হয় নি। দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ এ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। বিলাতে তার বাড়ি ও দুর্নীতি সম্পর্কে কিছু তথ্য তারা প্রকাশ করেছিল। রাজনৈতিক বিরোধ ও বিদ্বেষ ছাড়াও এই সকল কারনে দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে যে বেঞ্চ শাস্তি দিয়েছিল সেখানে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও ছিলেন।
বাংলাদেশে ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত কোন আইন নাই। ঔপনিবেশিক আইন চলছে। সেই দিক থেকে ঔপনিবেশিক আইনের ভিত্তিতে আদালত অবমাননার বিচার চলতে পারে না। ঔপনিবেশিক আইন চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবার জন্য প্রণীত হয় নি বরং তা দমন করবার জন্যই ব্যবহার করা হোত। একটি জনগোষ্ঠিকে পরাধীন রাখার আইন দিয়ে একটি স্বাধীন দেশে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশ সংক্রান্ত মামলার সিদ্ধান্ত কিভাবে বিচারকরা নিচ্ছেন? তাহলে তর্ক করা যায় ঔপনিবেশিক আইনের অধীনে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের যে বিচার বিচারকরা করেছেন তা রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক চেতনার বিরোধী। এই অর্থে বলা যায় ঔপনিবেশিক আইনের অধীনে যে সকল রায় হয়েছে তা অবৈধ। অভিযুক্তকে 'পরাধীন' ব্যাক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে, স্বাধীন দেশের চিন্তা ও বিবেক সম্পন্ন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় নি। লিগাল সাবব্জেক্ট হিসাবে নাগরিকদের যেভাবে কলোনিয়াল সাবজেক্টে বিচারকরা পর্যবসিত করেছেন তাঁরা তা করতে পারেন না।
এ ছাড়াও আরেকটি গুরুতর আইনী বা সাংবিধানিক তর্ক মাহমুদুর রহমান সংক্রান্ত আদালত অবমাননার রায়ে উঠেছে। অপরাধের শাস্তি কি হবে তা নির্ধারণ বিচারকের এখতিয়ার নয়। আইনের অনুপস্থিতিতে যদি শাস্তি সুনির্দিষ্ট না থাকে তাহলে বিচার প্রক্রিয়া বিচারকদের বৈচারিক স্বেচ্ছাচারে পর্যবসিত হতে পারে না। এছাড়া অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কোন অপরাধে কতোটা শাস্তি হবে সেটা নির্ণয়ের অধিকারও বাংলাদেশের সংবিধান বিচারকদের দেয় নি। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দুই হাজার দশ সালে আনা অভিযোগে যে রায় দেওয়া হয়েছিল তা বিচারকদের ব্যক্তিগত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ কিনা তা তর্ক আকারে যেমন রয়ে গিয়েছে তেমনি মাহমুদুর রহমানের রায়ে বিচারবিভাগ সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতার বাইরে কাজ করেছেন কিনা সেটাও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তর্ক আকারে রয়ে গিয়েছে। আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না। ইনসাফ নিশ্চিত করা না হলে তুষের আগুনের মতো তা থেকে যাবে। এজলাসে বসে রায় দিলেই তার জের শেষ হয় না। আইন কিম্বা বিচার সমাজ ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একজন নাগরিককে শাস্তি দিতে গিয়ে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হলে তা দ্বিগুণ শক্তি হয়ে বেইনসাফির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রায়ের জেরও বাংলাদেশে কাটে নি। আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ যেহেতু নাগরিকদের মানবিক অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত এই রায়টি বারবারই ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াবে এবং আবার ইনসাফ নিশ্চিত করবার জন্য ফরিয়াদ জানাতে থাকবে।
ঠিক। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ওপরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শাস্তি অসাংবিধানিক । আদালত অবমাননার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার অধিকার বিচারকদের আছে। অবশ্যই। কিন্তু অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি নির্ণয়ের অধিকার তাঁদের নাই। কীসের ভিত্তিতে মাহমুদুর রহমানের ছয়মাসের কারাদণ্ড হোল? অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা নির্ণয়ের অধিকার এখতিয়ার একান্তই জাতীয় সংসদ বা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী বিভাগের। এ ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ তো কোন আইনই প্রণয়ণ করে নি। কিন্তু বিচারকরা প্রায়ই নিজেদের জাতীয় সংসদের উর্ধে ভাবতে পছন্দ করেন। সংবিধানে ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার’ নামক একটি ধারণা আছে বলে অনেকে মনে করে এই ইনহেরেন্ট পাওয়ার খোদায়ী ক্ষমতার সমতুল্য। বিচারক যা খুশি তাই শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু ইনহেরেন্ট পাওয়ারের অর্থ এমন নয় যে কোন আইন না থাকলে আদালত নিজেই নিজের ক্ষমতাবলে যা খুশি আইন তৈরি করতে পারে । সওয়াল জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা উচ্চ আদালতের। কোর্ট অব রেকর্ড হিসাবে যা থেকে যায়। আইনের ব্যাখ্যা হিসাবে আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে ‘আইন’ হয়ে হাজির থাকে। যাকে কেইস ল, প্রিসিডেন্স ইত্যাদি নানান নামে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন আইনের মধ্যে সমন্বয় বা বিরোধ থাকলে এবং তা আদালতে মীমাংসার সুযোগ থাকলে বৈচারিক ক্ষমতাবলে তা মীমাংসার ক্ষমতাকেও অনেকে আদালতের ইনহেরেন্ট পাওয়ার বলে মানেন। এতোদূরই বড়জোর। ইনহেরেন্ট পাওয়ার নিয়ে অন্যত্র ভিন্ন ভাবে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করতে পারি।
কিন্তু আদালত অবমাননার অজুহাতে কোন আইন না থাকা অবস্থায় কাউকে ছয় মাসের শাস্তি দেবার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। অথচ ইনহেরেন্ট পাওয়ারের অজুহাত দিয়ে বিচারক সেই শাস্তি দিতে পারেন না। এটা তাঁর এখতিয়ারের জায়গা নয়। যেহেতু বাংলাদেশে বৈচারিক যুক্তিবিদ্যা (jurisprudence), দর্শন কিম্বা রাষ্ট্রনীতি নিয়ে শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক বিতর্ক নাই, বহু গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন রয়ে গিয়েছে। কিছু বিচারক তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে। মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কিভাবে ব্যাক্তিগত ক্রোধ বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যূত করে। কিছু বিচারক তাঁকে 'চান্স এডিটর' মন্তব্য করেছিলেন এবং আদালত অবমাননার জন্য দীর্ঘদিন কারাগারে পচতে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজ বা তথাকথিত সিভিল সোসাইটি নামক কিছু যে নাই সেটা তখন থেকেই আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কারন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ যেভাবে হবার কথা ছিল সেভাবে হয় নি। মাহমুদুর রহমান ‘ইসলামপন্থী’ এই অভিযোগে সংবিধান, আইন ও বিচার ব্যবস্থার এই সকল নানাবিধ ঘাটতি উপেক্ষা করা হয়েছে। তাকে শাস্তি দেবার জন্য ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের আনন্দ আমরা তখন প্রত্যক্ষ করেছি। যে তলোয়ার অন্যের মাথা কাটে, একদিন তার কোপ আমার ঘাড়েও পড়তে পারে এই সাধারন কাণ্ডজ্ঞানের প্রকট অভাব দেখে অবাক হয়েছি। কিন্তু এটাই বাংলাদেশ। আজ দেখছি, যে সকল বিচারক মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দিয়ে পুলকিত হয়েছিলেন আজ তারাই পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। প্রহসন বটে!
আদালত অবমাননা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষত যাঁরা সাংবাদিক ও লেখালিখির সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে চিন্তা ও মত প্রকাশের সীমা ও সম্ভাবনা পরিষ্কার করা সংসদ ও বিচার বিভাগ উভয়েরই কর্তব্য। আদালত অবমাননা মামলায় মাহমুদুর রহমানের শাস্তি বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রসঙ্গটি আবার সে কারনেই এখন তুলেছি। সেই মামলার বেঞ্চে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাও হাজির ছিলেন। তিনিও এই দায়ের বাইরে নন। এখন বিচারকদের সংবিধান বিরোধী কাজের কথা যদি তিনি তুলেই থাকেন তাহলে তিনিও বা দায় এড়াবেন কিভাবে? এই প্রশ্নটুকু প্রধান বিচারপতির বিবেকের কাছে পেশ রাখছি। এর বেশী কথা বাড়াতে চাই না। কারন তিনি যদি আন্তরিক উপলব্ধি থেকে এখনকার কথাগুলো উচ্চারন করে থাকেন তাহলে তাঁকে শক্ত ভাবে সমর্থন করা আমি আমার নাগরিক কর্তব্য বলে মনে করি।
তিন
অবসর গ্রহণ করবার পরপরই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ সাধারণ নাগরিক হয়ে যান এবং তাঁরা আর শপথের অধীন থাকেন না। তাই অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের নিকট সংরক্ষণ,পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার তারা হারান। সে কারনে অবসরে যাবার পর রায় লেখাকে প্রধান বিচারপতি অসাংবিধানিক বলেছেন। তাঁর এই সঠিক অবস্থানের যারা সমালোচনা করছেন তাদের যুক্তি একটাই। বিচারক যখন রায় দিয়েছিলেন তখন তিনি শপথের অধীনে ছিলেন। অতএব এরপর অবসরে গিয়ে রায় লিখলে তা অসাংবিধানিক হবে না। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তো তা নিয়ে তর্ক করছেন না। শপথের অধীনে দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়কে তিনি অসাংবিধানিক বলছেন না। তিনি বলছেন, আদালতের নথি সরকারী দলিল, অবসরে যাওয়া বিচারক নিজের বাড়িতে রাখেন কোন অধিকারে? এগুলো পাব্লিক ডকুমেন্ট। কিম্বা তার পর্যালোচনা করতে পারছেনই বা কিভাবে? এবং শপথের বাইরে থেকে রায়ও বা লিখছেন কোন সাংবিধানিক বা আইনী অধিকারে? বিশেষত এমন সময় যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণের শপথ থেকে তিনি মুক্ত। এই ব্যাপারে তার আর কোন দায় থাকে না। যারা অন্য দেশের উদাহরণ দিচ্ছেন তারা সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন দেশে কোথায় বিচারপতিরা অবসরে যাবার পরে কিভাবে রায় লিখেছে তার কোন উদাহরণ দেন নি। বাংলাদেশে এর আগের বিভিন্ন বিচারপতিরাও এই কাজ করেছেন বলা হচ্ছে। আগের বিচারপতিরা অসাংবিধানিক কাজ করেছেন বলে তা স্রেফ বিচারপতিদের স্বেচ্ছাচার হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্য এতে এক তিলও বাতিল হয় না। আগের বিচারপতিরা ভুল করলে আমাদের সেই ভুল করে যেতে হবে তার কোন যুক্তি নাই। কোন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে গণ্য হন বিধায় তাঁর গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। তো তিনি যখন রায় দিয়েছিলেন তখন তিনি শপথের অধীন ছিলেন তাই অবসরে অসম্পূর্ণ রায় লিখবেন এই যুক্তি যারা দিচ্ছেন তাদের যুক্তি কাণ্ডজ্ঞানপ্রসূত মনে হচ্ছে না।
ধরুন তর্কের খাতিরে মানা গেলো যে তারা অবসরে গেলে রায় লিখতে পারবেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিচারপতিদের স্বাক্ষর করা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। বাড়িতে বসে অবসরে লেখা রায়ে যখন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক স্বাক্ষর করেছিলেন তখন কি তিনি শপথের অধীন? নাকি অধীন নন? স্বাক্ষরের তারিখ তিনি কি দেবেন? শপথ থেকে অবমুক্ত হবার পরের তারিখ নাকি যখন তিনি শপথের অধীনে ছিলেন সেই তারিখ? যদি শেষেরটা করেন সেটা হবে শুধু অসাংবিধানিক নয়, একই ভাবে দুই নম্বরী কাজ। কিভাবে একজন সাধারণ নাগরিক রায়ে স্বাক্ষর দিচ্ছেন? আর তা রাষ্ট্রের কাছে বলবৎযোগ্য বলে গৃহীত হচ্ছে? কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় প্রধান বিচারপতি সঠিক বলেছেন।
এতে কি বৈচারিক বা আইনী জটিলতা তৈরি হবে ? অবশ্যই হবে। কিন্তু সেটা ভিন্ন তর্ক। আর সেই তর্ক ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। কী ধরনের জটিলতা তৈরি হবে কিম্বা ইতোমধ্যেই হয়েছে সেই তর্কে আমি এখন এখানে যাচ্ছি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায় এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়। এই রায়টি লিখেছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়া বিচারপতির রায় লেখা নিয়ে সেই সময় দৈনিক আমার দেশ প্রশ্ন তোলে। তখন দৈনিক আমার দেশের সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান সিনিয়র আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খানের বরাতে জানিয়েছিলেন, এটা অবৈধ কাজ। বিচারপতিরা দায়িত্ব গ্রহনের আগে শপথ নেন। এই শপথ নেয়া হয় সংবিধানের আলোকে। যতদিন দায়িত্বে থাকেন ততদিন শপথের আওতায় তাদের কাজ করতে হয়। অবসরে চলে যাওয়ার পর তারা শপথের আওতামুক্ত। তখন তিনি সাধারণ নাগরিক। সুতরাং শপথের আওতামুক্ত কোন ব্যক্তি রায় লিখতে পারেন না। কারণ তিনি আর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকেন না।
তবে সাংবিধানিক বা আইনী জটিলতা তৈরি হবে বলে ক্ষমতাসীনদের বরকন্দাজরা যে সকল কূটতর্ক করছে আসলে তার কোন ভিত্তি নাই। কারন একটি নির্বাচিত সংসদ অনায়াসেই দুই তৃতীয়ানশ সদস্যের সম্মতির ভিত্তিতে বিতর্কিত বিষয় সমাধান করতে পারে। কিন্তু তারা জানে বর্তমান সংসদ অনির্বাচিত। এর নৈতিক বা আইনী ভিত্তি নাই। যে রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় এসেছে সেটাই প্রধান বিচারপতির বিক্তব্যা প্রশ্নবোধক ও অসাংবিধানিক হয়ে পড়েছে। এদের তেলেবেগুনে গোস্বা হবার কার এটাই। তারা বিতর্কিত সন্সদে এর সমাধান দিলেও তা গ্রহনযোগ্য হবে না।
প্রধান বিচারপতি এখন যা বলছেন তা আসলে নতুন কিছু নয়। তাঁর বলাটাই নতুন। জানিনা তিনি তাঁর বিবেকের তাগিদ থেকে কথাগুলো বলছেন কিনা। যদি বলে থাকেন তাহলে তাঁর উচিত বিচার বিভাগীয় উদ্যাগে মাহমুদুর রহমানের জামিন কেন হচ্ছে না তার খোঁজ নেওয়া। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার বিচার হোক অসুবিধা নাই। কিন্তু কোন বিচারপতির ব্যাক্তিগত ক্রোধের কারনে যদি নাগরিকদের ওপর অন্যায় হয় তাহলে তা প্রশমনের দায় প্রধান বিচারপতিরও বটে।
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা বুঝব তিনি আইন বা সাংবিধানিক বৈধতা বা অবৈধতার তর্ক ছাড়াও নীতি ও ইনসাফের প্রশ্নে আন্তরিক। সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য যা জরুরী।
২২ জানুয়ারি ২০১৬। ৯ মাঘ ১৪২২। আরশিনগর।