২. তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে


নাস্তিকতা আল্লাহ আছে এই সত্য অস্বীকার করে, যে অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মানুষই শুধু আছে সেই সত্য জাহির করা হয়। কিন্তু কমিউনিজমের জন্য এ ধরনের ঘোরাপথের দরকার পড়ে না।’ (কার্ল মার্কস)

‘যে নৈরাজ্যবাদী খেয়ে না খেয়ে আল্লাহখোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ওয়াজ করে বেড়ায় সে আসলে মোল্লা-মৌলবি-পুরোহিত আর বুর্জোয়াদের স্বার্থই রক্ষা করে।’ (ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন)


সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে কাঁচি দিয়ে কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায় না

রাজনীতি সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ধর্ম থেকেও নয়। ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্কে না গিয়ে অতি প্রাথমিক অনেক বিষয় আমরা কাণ্ডজ্ঞানেই বুঝতে পারি। যেমন, আমরা চাই বা না চাই ধর্মকে সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে যান্ত্রিকভাবে আলাদা করতে পারি না। মানুষ কী নীতি মেনে চলবে, নৈতিকতার কোন মানদণ্ড দিয়ে তার নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করবে তা নির্ধারণ বা নির্ণয় করবার ক্ষেত্রে একসময় শুধু ধর্মের নির্দেশই কাজ করেছে। এখনও বিপুলসংখ্যক ধর্মভীরু মানুষের কাছে ধর্মের নির্দেশই শিরোধার্য। ধর্ম শুধু জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা কিম্বা নৈতিক বিধিবিধান নির্ণয় করেছে তা নয়, তাকে বলবৎ করবার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ধর্মের ভূমিকাও বদলে গিয়েছে। সেটা সব দেশ বা সমাজে একই ভাবে ঘটে নি। বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় দেশে দেশে কিভাবে ঘটেছে সেটা বোঝাই সবচেয়ে প্রাথমিক অথচ জরুরী কাজ।  সেই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রেণি রাজনীতির বাস্তবোচিত নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হয়।  ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতি নিপীড়িতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী বিমূর্ত ভাবে রাজনীতি থেকে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হতে পারে না। এটা আজগবি ও বিশুদ্ধ আহাম্মকি দাবি। বিমূর্ত ভাবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার অর্থ নির্বিচারে আধুনিক কন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ানো। যারা এই দাবি করে তারা ধর্মের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে যেমন অজ্ঞ, একই ভাবে ধর্ম ও আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্পর্কেও তারা কিছু জানে না। জানার প্রয়োজন মনে করে না। প্রহসন হচ্ছে ইতিহাস সম্পর্কে বেখবর থেকে বাংলাদেশে এরাই 'ঐতিহাসিক বস্তুবাদ'-এর মুরিদী করে বেড়ায়। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

তথাকথিত 'আধুনিক রাষ্ট্র'ও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে ধর্মের বিধান বিলোপ করতে পারে নি। বাংলাদেশের সংবিধান ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার’ লাভ করবার কথা বলে। কিন্তু পারিবারিক জীবন থেকে ধর্ম বাদ দেবার কথা বলে না। বরং পারিবারিক জীবনে নাগরিকদের যার যার ধর্মের নির্দেশ পালন করতে বলে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ)। বৈবাহিক সম্পর্ক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ধর্মীয় আইন দ্বারাই সাব্যস্ত হয়। ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সমাজের অবস্থা ভেদে ধর্মই আইনদাতার ভূমিকা পালন করে এবং শাসনের হাতিয়ার হয়।

ধার্মিক না হতে পারি, কিন্তু সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ধর্মের সামাজিক অভ্যাস, চর্চা বা শিক্ষা আমাদের নীতিনৈতিকতার জগত গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। যেহেতু ধর্মের সাংস্কৃতিক ভূমিকা আছে অতএব সরাসরি না হলেও ধর্মের প্রভাব, প্রণোদনা বা প্রেরণা ব্যক্তির জীবনে কাজ করে। ঘোর নাস্তিকও সমাজের বাইরে বাস করেন না। নিজেদের সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও ধর্ম সমাজে ও সংস্কৃতিতে যে প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থেকে কেউই মুক্ত থাকে না। ইত্যাদি নানান কারণে ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে আমরা যত সরল মনে করি, মোটেও তা অত সরল নয়।

ধর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যাখ্যা এবং ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই তর্কবিতর্ক আছে। সেই তর্কবিতর্ক ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক। কোনো ধর্মেরই একাট্টা কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেটা অসম্ভবও বটে। ইসলামও একাট্টা একরকম নয়। শিয়া ও সুন্নির পার্থক্য আছে, শরিয়তপন্থী ও মারেফাতপন্থীদের ঝগড়া নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন মজহাব ও ফেরকার মধ্যেও বিরোধ প্রবল। এ ধরনের ঝগড়া অহিংস ছিল না, বিভিন্ন সময়ে বিরোধ সহিংস হানাহানিতে পর্যবসিত হয়েছে। আবার ধর্ম তার অভ্যন্তরীণ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের ঐতিহাসিক তাগিদে নিজের সংস্কারও নিজে করেছে। অর্থাৎ ধর্ম কোনো নিশ্চল অনৈতিহাসিক ব্যাপার নয়। তারও পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে।

তাহলে এটা পরিষ্কার যে বিমূর্ত ভাবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার অর্থ নির্বিচারে কোন পর্যালোচনা ছাড়া পাশ্চাত্যের ইতিহাস এবং তার পরিণতি অনুকরণ করা। এই অনুকরণের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। প্রথমত পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার গোড়ায় রয়েছে গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা। এই পরিমণ্ডলেই পাশ্চাত্যে পুঁজিতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে যাকে আমরা ‘আধুনিকতা’ বলে থাকি। তাহলে প্রথমেই এই গ্রিক-খ্রিস্টিয় ‘আধুনিকতা’র একটা পর্যালোচনা দরকার। আধুনিকতা নিজেকে সেকুলার বলে দাবি করে, কিন্তু তাতে  খ্রিস্টিয় চিন্তাচেতনার পরিমণ্ডল থেকে সে আলাদা কিছু হয়ে যায় না। তার উদ্ভব, বিবর্তন, বিকাশ ও রূপান্তর খ্রিস্টিয় পরিমণ্ডলেই ঘটে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পাশ্চাত্যে খ্রিস্টিয় ধর্মের যে রূপ ও ইতিহাস আমরা দেখি ধরে নেওয়া হয় সেটাই আর সকল ধর্মের রূপ বা চরিত্র। অন্যান্য জনগোষ্ঠির ইতিহাসও বুঝি পাশ্চাত্য ইতিহাস। আলাদা কিছু নয়। তাদের নিজস্ব কোন ইতিহাস নাই। ধরে নেওয়া হয় সেই সকল সমাজের বিচার পাশ্চাত্যের মানদণ্ড দিয়েই আমাদের নির্ণয় করতে হবে। অথচ দরকার সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনা।  কেন পাশ্চাত্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের ফারাক – অর্থাৎ ধর্ম ও আধুনিক রাষ্ট্রের পার্থক্য ঘটল সেই ইতিহাসের বিচার। বোঝা যে ‘পাবলিক’ ও ‘প্রাইভেট’-এর বিভাজন ঘটে গেল কি কারনে?  এই সকল দিক বিচার না করে তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ অর্থাৎ গ্রিক-খ্রিস্টিয় ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং তার পরিণতি হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্রকে নির্বিচারে মানা ও অনুকরণের কোন যুক্তি নাই। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতি নিপীড়িতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী কি হবে সেটা আমরা আর বুঝে উঠতে পারি না।  তখন শুধু আধুনিকতাকেই মেনে চলি, আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে দঁড়াই, গণমানুষের ধর্ম ও নানাবিধ সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলোর প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠি।

তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্রও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে ধর্মের বিধান বিলোপ করতে পারে নি। বাংলাদেশের সংবিধান ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার’ লাভ করবার কথা বললেও পারিবারিক জীবনে নাগরিকদের যার যার ধর্মের নির্দেশ পালন করতে বলেছে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ)। ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সমাজের অবস্থা ভেদে ধর্মই আইনদাতার ভূমিকা পালন করেছে এবং শাসনের হাতিয়ার হয়েছে।

ধার্মিক না হতে পারি, কিন্তু সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ধর্মের সামাজিক অভ্যাস, চর্চা বা শিক্ষা আমাদের নীতিনৈতিকতার জগত গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। যেহেতু ধর্মের সাংস্কৃতিক ভূমিকা আছে অতএব সরাসরি না হলেও ধর্মের প্রভাব, প্রণোদনা বা প্রেরণা ব্যক্তির জীবনে কাজ করে। ঘোর নাস্তিকও সমাজের বাইরে বাস করেন না। নিজেদের সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও ধর্ম সমাজে ও সংস্কৃতিতে যে প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করে থাকে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থেকে কেউই মুক্ত থাকে না। ইত্যাদি নানান কারণে ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে আমরা যত সরল মনে করি, মোটেও তা অত সরল নয়।

কিন্তু ধর্মমাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল এবং তার সঙ্গে মোকাবিলার পথ একাট্টা ধর্মের বিরোধিতা—এই বিকৃত ধারণা আমরা বাংলাদেশে যেভাবে দেখি, পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। আর কোনো দেশে কমিউনিস্ট নাম নিয়ে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কমিউনিস্টরা হরতাল করেছেন তার নজির নাই।

এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে পাশ্চাত্য বনাম প্রাচ্যের লড়াইয়ে পর্যবসিত করাও চিন্তার অক্ষমতা এবং সংকীর্ণতা। পাশ্চাত্য তার চিন্তা ও ইতিহাসকে মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ ও সার্বজনীন পরিণতি হিসাবে দাবি করে। এ কারনে আমরা ভাবি ‘আধুনিকতা’ , ‘প্রগতিশীলতা’ ইত্যাদি বুঝি সার্বজনীন ব্যাপার। মোটেও তা নয়। এইসকল অভিধাকে ইনোসেন্ট ভাববার কোন কারণ নাই। কারন এর অধ্য দিয়ে ‘বিশেষ’কে সার্বজনীন দাবি করা হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও চিন্তা পাশ্চাত্যেরই ইতিহাস। সেটা ঐতিহাসিক ভাবে সীমিত। পাশ্চাত্যের ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাস বা সর্ব মানবের ইতিহাসও নয়। অথচ এই বিশেষ ইতিহাসকেই সার্বজনীন বিশ্ব ইতিহাস কিম্বা চিন্তা ও সভ্যতার সর্বোচ্চ রূপ বা প্রকাশ বলে দাবি করা হয়। এরপর দাবি করা হয় পাশ্চাত্যে ধর্ম, ধর্ম নিরপেক্ষতা, আধুনিকতা ও প্রগতি, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদির যে রূপ তা অন্যদের নির্বিচারে অনুকরণীয়। তাদের অনুমান ও চিন্তার পদ্ধতি সমেত। এই অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হওয়া দরকার।

তাহলে একালে কমিউনিজম বা যে ডাকনামেই নতুন ভাবে পৃথিবী গড়বার আহ্বান আসুক তাকে এনলাইটমেন্ট, আধুনিকতা, প্রগতি ইত্যাদি ধারণার মোকাবিলা করেই পুনর্গঠিত হতে হবে। পাশ্চাত্যের যে পর্যায়কে আমরা মানবেতিহাসের ঐতিহাসিক উত্তরণ গণ্য করি – আলোকিত পাশ্চাত্য বা এনলাইটমেন্ট হিসাবে যা পরিচিত – সেই পর্যায় পর্যালোচনার হিম্মত অর্জনের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ জড়িত। কথাটা শুধু কমিউনিস্ট নয়, ইসলাম্পন্থিসহ সকলের জন্যই প্রযোজ্য। কিভাবে সেই পর্যালোচনা করতে হবে এখানে তার বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়, কিন্তু নিদেন পক্ষে কথাটা বলে রাখা জরুরী।

একাট্টা ইসলাম বিরোধিতা জর্জ বুশের রাজনীতি

আমরা আরও একটি কারণে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। একাট্টা সব ধরনের ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি বিশেষভাবে জর্জ বুশের নীতিকেই মনে করিয়ে দেয়। জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন এস্পিসিতোর কথাই ধরি। তাঁর কথা হচ্ছে, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে জিমি কার্টারের সময় থেকে সব মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে ৯/১১’র ঘটনার পরে জর্জ বুশ যে চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হয়েছিলেন, তার সঙ্গে তুলনা চলে না। সে সময় তিনি ও তাঁর নীতিনির্ধারকরা রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যেও যে চরমপন্থী এবং মধ্যপন্থীর ভেদ আছে—সেটা বুঝতে চাইতেন না, বোঝার ক্ষমতাও ছিল না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল ইসলামের সব কিসিমের রাজনৈতিক প্রকাশ ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে। তারা রাজনৈতিক ইসলামকে বিশ্বব্যাপী হুমকি গণ্য করেছিল, ঠিক যেমন সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির আমলে কমিউনিজমকেও গণ্য করা হয়েছিল দুনিয়ার হুমকি হিসেবে। সবকিছুকে এক থোকে এক ডাকনামে ভাববার চর্চা ও আতঙ্ক থেকে আস্তে আস্তে নীতিনির্ধারকরা সরে আসে। তবে ওয়ার অন টেররের শুরুতে প্রেসিডেন্ট বুশ রাষ্ট্র থেকে ধর্ম সরানোর কথা বলতেন।

জর্জ বুশের একাট্টা ইসলাম বিরোধিতা কিম্বা ‘ক্রুসেড’ নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে এসেছে। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ইসলামের আবির্ভাব, বিস্তার ও শক্তিবৃদ্ধি এই বিভাজন টানতে তাদের বাধ্য করেছে। ইসলাম, বিশেষত রাজনীতিতে ইসলামের ব্যবহার সম্পর্কে তাদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানতে হয়েছে। ইসলামী রাজনীতির আবির্ভাব এবং তার প্রতি জনগণের সমর্থনের কারণগুলো তাদের বুঝতে হয়েছে। তাদের নজরে আসে যে, মার্কিন অর্থসাহায্য আসলে উলটা চরমপন্থী ইসলামী রাজনীতির আবেদনকেই শক্তিশালী করেছে, আর দুর্বল করেছে মধ্যপন্থীদের। ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে যারা ব্যবহার করছেন, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বা মার্কিন কূটনীতিক ভাষায় ‘এনগেজমেন্ট’-এর প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। বিশেষত সেসব ক্ষেত্রে যেখানে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারের গোড়া শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার মধ্যে নয়, বরং আরও গভীরে -- যার রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটে অহিংস কায়দায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবার মধ্যে।

প্যালেস্টাইনের নির্বাচনে হামাসের জয়, ইরাকে শিয়াদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব এবং মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। চরমপন্থী রাজনৈতিক ইসলাম আর মধ্যপন্থী অহিংস ইসলামের প্রতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতি এখন আর এক নয় (দেখুন, It’s The Policy Stupid: Political Islam and US Foreign Policy by John L. Esposito . Georgetown University. ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ার কথা। বলা বাহুল্য, ৯/১১’র পরপরই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন বিএনপি/জামায়াতকে যে চোখে দেখা হতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই চোখে এখনও দেখে কিনা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল; কিন্তু না দেখাই স্বাভাবিক। বিশেষত শেখ হাসিনা যেমন বলেন, বাংলাদেশের সকল প্রকার ‘জঙ্গি’ ইসলামের হোতা বিএনপি/জামায়াত অতএব তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখাই শ্রেয় কিংবা শেখ হাসিনার সঙ্গে মৈত্রীই বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করার একমাত্র উপায়—এ ধরনের চিন্তা ওয়াশিংটনের এখন থাকার কথা নয়। বাস্তব পরিস্থিতির বদল ঘটলে সমাজে শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর সম্পর্ক এবং শক্তির ভারসাম্যেও রূপান্তর ঘটে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।

এ কথাগুলো তোলার কারণ হচ্ছে, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা যে মূলত জর্জ বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নীতিরই প্রতিধ্বনি, সেই কথাটা মনে করিয়ে দেয়া।

তাহলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করা বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা কমিউনিস্টদের দাবি হতে পারে না। তারা বলছেন, সকল ‘সাম্প্রদায়িক’ দল নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আর সাম্প্রদায়িকতা এক নয়, সেটা আমি নিজের জবানে না বলে অগ্রজ বদরুদ্দীন উমরের শরণাপন্ন হব।

বদরুদ্দিন উমর বলছেন, ‘ধর্মের যে কোনো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবহারকেই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া এক মহাতাত্ত্বিক ও বাস্তব ভ্রান্তি। সাম্প্রদায়িকতা হলো ধর্মের এই ব্যবহারের একটি রূপমাত্র, যেখানে এক ধর্মীয় সম্প্রদায় অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করতে নিযুক্ত থাকে, অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত লোকের ক্ষতি করা তার লক্ষ্য হয়।’ এরপর তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সেখানে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচুর মানুষ থাকা সত্ত্বেও ভারতে সাম্প্রদায়িকতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকলেও বাংলাদেশ ভারত নয়, সাম্প্রদায়িকতা এখানে কিছু থাকলেও সেটা জাতীয় কোনো সমস্যা নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল বা তাঁর ভাষায় ‘মৌলবাদ’ রয়েছে, কিন্তু উমর মৌলবাদমাত্রই সাম্প্রদায়িক মনে করেন না। কারণ তাদের টার্গেট হিন্দু বা অন্যান্য সম্প্রদায় নয়। তিনি মনে করেন, ‘এদের টার্গেট হলো কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি। সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা নয়, এই হিসেবে এর মূল্যায়ন করে এদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে ও প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়েই এদের প্রতিরোধ করতে হবে।’ (দেখুন, ‘সুবিধাবাদীদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলন’, বদরুদ্দীন উমর, যুগান্তর ২৩ ডিসেম্বর ২০১২)। লেখাটি নেটে এখানে আছে

বদরুদ্দীন উমরের এই লেখাটির গুরুত্ব—বিশেষত এখন—অনস্বীকার্য। তবে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি দিক যোগ করতে চাই। ইসলামপন্থী দলগুলোর ঘোষিত নীতি যা-ই হোক, ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় জনগণ—বিশেষত তরুণদের বিশাল একটি অংশ রয়েছে, যারা স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইসলামকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল, সে ব্যাপারে কিছুটা হলেও ওয়াকিবহাল। কারণ এখন গণতন্ত্রী(?), প্রগতিশীল(?) ও কমিউনিস্টদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সে অভিজ্ঞতা থেকেও তাদের কিছু শিক্ষা হচ্ছে।

বদ্ধমূল বেকার অনুমানগুলো নাকচ করা জরুরী

বাংলাদেশের জনগণ সাম্রাজবাদকে তত্ত্বগতভাবে বুঝতে না পারে; কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে বোঝে। যে শ্রমিক পোশাক তৈরি কারখানায় পরিশ্রম করে তিলে তিলে নিজের শরীর ক্ষয় করছে কিংবা পুড়ে মরছে। পুঁজিবাদ কী জিনিস—সেটা সে তার শরীর দিয়েই আন্দাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের নিজেরও বয়ান আছে। সমাজে শ্রেণী যদি থাকে, তাহলে সংগ্রামও থাকবে। সেই সংগ্রামের বয়ান যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে ধার নিতে হবে কিংবা তার সঙ্গে মিল থাকতে হবে, তার কোনো কথা নাই। নিপীড়িতের এই ভাষা বোঝা দরকার। একইভাবে এই অনুমানও ভুল নয় যে ইসলামপন্থী দলগুলোরও সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নিজস্ব বয়ান আছে। এই বয়ান বোঝার দরকার আছে। অর্থাৎ নিজ নিজ  গর্ত থেকে কমিউনিস্টদের বেরিয়ে এসে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কমিউনিস্ট নিজের জগতের বাইরের কিন্তু  সমাজের অন্যান্যদের সাথে কথা বলবার ক্ষমতা অর্জন না করলে কমিউনিস্ট রাজনীতি আরও অবক্ষয়ের মধ্যে নিপতিত হবে। বাংলাদেশে এটাই নিয়তি কিনা জানি না। সেই ক্ষেত্রে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই থেমে থাকবে না। আমাদের কাজ হবে তাকে বিকশিত করে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবার অভিমুখ, নীতি ও কোশল নিয়ে ভাবা। কমিউনিজম বদ্ধ, সংকীর্ণ ও ইসলামী আতংকের রুগী হয়ে বাংলাদেশে হাজির রয়েছে। এই প্রকার কমিউনিজমের কোন ভবিষ্যৎ নাই এটা কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মজলুমের লড়াই যদি থেমে না থাকে তাহলে একালে তার চিন্তা, মতাদর্শিক ও কৌশল্গত রূপ কি হবে সেটা সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। চোর বাসন চুরি করে নিয়ে গেছে বলে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষ মাটিতে ভাত খাবে না, সে সম্পর্কে কমিউনিস্ট কমরেডরা নিশ্চিত থাকতে পারেন।

পাশাপাশি আরও অগ্রসর পর্যালোচনার দরকার। অসাধারণ অবদান স্বীকার করার পরেও কার্ল মার্কসকে চিন্তা জগতের শেষ কিম্বা একমাত্র বাদশাহ ভাববার কোন দরকার নাই। মার্কস 'মানুষ'কে তার সমাজ ও ইতিহাসের সারাৎসার হিসাবে ভাবতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাকে নিছকই অর্থনৈতিক এজেন্টে পর্যবসিত করেছিলেন, কিম্বা অন্যদের সেভাবে ভাবতে প্রণোদিত করেছেন। সেই ভুলের বোঝা মাথায় নিয়ে চলবার কোন যুক্তি নাই। তিনি ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলেন দাবি করা কঠিন। ইতিহাসকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি দিয়ে তৈয়ার কিম্বা বিশ্লেষণের ওপর তার অকুন্ঠ বিশ্বাস কম আপদ তৈরি করে নি। বিজ্ঞান চর্চা ও ইতিহাস চর্চার ফারাক নিয়ে অতএব বিস্তর কাজ করবার আছে।

তাহলে কর্তব্য কী? প্রথম কাজ সমাজে কথাবার্তা বলবার ইচ্ছা ও সামর্থ্য অর্জন করা। তবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের প্রধান আপত্তির জায়গাগুলো হচ্ছে— ১. নাস্তিকতা ২. জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শের কথা মুখে বললেও মূলত আওয়ামী-বাকশালি আদর্শে বিশ্বাস, এবং ৩. ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের প্রতি চরম অনীহা ও অজ্ঞতা। ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসে অজ্ঞতার কারণে কমিউনিস্টরা ইসলামের ভেতর থেকে ইসলামী আন্দোলন কীভাবে জীবন ও জগতের বিচার করে এবং জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রাম চালায় তা বুঝতে পারে না। যার ফলে কমিউনিস্টদের সঙ্গে ইসলামপন্থিদের নীতিগত না হোক, কৌশলগত আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি হলেও সেটা ঘটে না। সেই আলোচনা বা ডায়ালগ অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই অভিযোগকে উড়িয়ে দেয়া কঠিন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বদ্ধমূল ধারণাকে নাকচ করতে হবে। যেমন, ধর্মকে চিন্তার পশ্চাত্পদতা,অর্ধচেতন বা অসম্পূর্ণ অবস্থা মনে করা। ধর্মচিন্তা যুক্তিবর্জিত, কুসংস্কার বা সোজা কথায় চিন্তাহীন কিম্বা দেশকালপাত্র নির্বিশেষে প্রতিক্রিয়াশীল  এই সকল মুখস্তবিদ্যা বাদ দিতে হবে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ধর্মসহ নীতিনৈতিকতার ওপর গড়ে ওঠা প্রতিটি সম্পর্ককে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে খারিজ না করে দিয়ে এবং তাকে ‘প্রাইভেট’ ব্যাপারে পরিণত না করে টিকে থাকতে পারে না। কারণ বাজার ব্যবস্থা ও পুঁজির প্রধান চরিত্রই হচ্ছে টাকার কাছে পুরান সকল নীতিনৈতিকতার অবসান ঘটানো। এ কারণে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একাট্টা ধর্মবিরোধীদের— বিশেষত বয়ান নির্বিশেষে ‘ইসলাম’ নামের যে কোনো রাজনৈতিক ধারার যারা বিরোধী তারা মূলত পুঁজির অতি নিম্ন শ্রেণির দাস। তার  অধিক কিছু নয়। এরা ধর্ম যেমন বোঝে না, পুঁজির স্বভাব সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা নাই। পুঁজির গোলামগণ কমিউনিজমের পতাকা উত্তোলন করে রাখলেও না বদলালে কোনো অবস্থাতেই তারা বাংলাদেশের জনগণের মিত্র হতে পারে না।

বাংলাদেশে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় থেকে হাল পর্যন্ত মোটা দাগে বাম, সেকুলার এবং ধর্মীয় ধারার ভেতর ধর্মকে বিচার করবার মূল জায়গাটা ছিল আস্তিকতা/ নাস্তিকতা এবং প্রগতিশীলতা/ প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্ব। আজ এটা স্পষ্ট বোঝার সময় হয়েছে যে, এই দ্বন্দ্ব বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কগুলো মীমাংসায় কোনো কাজেই আসবে না; বরং এ যাবতকালের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় প্রচণ্ডভাবে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাচেতনা ও গণবিরোধী রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে, দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।

কিন্তু তার পরও এই প্রশ্নে মজলুম জনগণকে দৃঢ় থাকতে হবে যে বাংলাদেশে ধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতি বিচার করবার প্রশ্নটিকে পদ্ধতিগতভাবে শ্রেণী রাজনীতির দিক থেকে কিংবা সাম্রাজ্যবাদ/ পুঁজিবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকেই তুলতে হবে। এর বাইরেও যদি কোনো মুক্তিকামী রাজনৈতিক চিন্তা, ভাব বা বিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে তাকেও আমলে আনা দরকার। যেহেতু বাম বা তথাকথিত প্রগতিশীলদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা আর ফলে তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামপন্থী দলগুলোর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরনো স্নায়ুযুদ্ধের নীতি অনুযায়ী কমিউনিজম ও কমিউনিস্টদের বিরোধিতা করা। একদিকে প্রগতিশীলতার নামে একাট্টা ইসলাম বিরোধিতা আর অন্যদিকে ইসলামের নামে গণমানুষের ইহ্লৌকিক স্বার্থের বিরোধিতা দুই দিকেই  আত্মঘাতী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। এই আত্মহননই বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতির বড় স্রোত হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কমিউনিস্টদের ভুল রাজনীতি ছাড়াও আরও নানা কারণে গত কয়েক দশকে কমিউনিজম বা কমিউনিস্টদের প্রতি এদেশের জনগণের সংশয় ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তার একটি কারণ কমিউনিজমের যে বয়ান আমরা হাজির করি, তার উৎপত্তি পাশ্চাত্যে। এটা এখন স্পষ্ট হওয়া দরকার, পাশ্চাত্য জ্ঞান-শৃঙ্খলার নির্বিচার অধীনতা মেনে এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্যসাধন সম্ভব না। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সেক্ষেত্রে স্লোগানসর্বস্ব কেরিকেচার ছাড়া আর কিছুই হবে না, গণমানুষের রাজনীতি হওয়া তো দূরের কথা। আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শিখতে হবে এবং পরিবর্তনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে গণশক্তি নতুনভাবে গঠনের কাজ করবার জন্য চিন্তা ও তৎপরতায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে ইসলাম প্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধে নির্বিচার যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ দেখার পরেও ইসলামপন্থী অধিকাংশ দল মার্কিনিদের পুরনো বুলি আউড়িয়ে চলেছে। জনগণকে বোঝাতে হবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে যারাই ধর্ম বা আস্তিকতা/নাস্তিকতার ধুয়া তুলে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে, জনগণকে বিভক্ত করে—তারা যে পক্ষেরই হোক—জনগণের দুশমন। স্নায়ুযুদ্ধকালে বামদের রাজনীতি ছিল নাস্তিকতার চর্চা। বিপরীতে ইসলামী রাজনীতির বা বাম বিরোধিতার মূল জায়গা ছিল নাস্তিকতা বিরোধিতা; মূলত তারা এ জায়গায় দাঁড়িয়েই কমিউনিস্ট ও কমিউনিজমের বিরোধিতা করেছে। এই দুই ধারা একই সমস্যার দুই দিক মাত্র।

বাংলাদেশের এই বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রমাণ করে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে একটি নির্বিচার অবস্থান আমাদের দেশে জারি রয়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ কায়েমই আমাদের আদর্শ -- এই বিচারশূন্যতাকে প্রশ্ন করা দরকার এবং এ বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান আরও গভীর করা আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্যকে রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

সোজা কথায় ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার ছাড়া এখন কোনো সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদবিরোধী রাজনীতি সম্ভব নয়। সেটা বামপন্থী বা ইসলামী রাজনীতি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যদি তারা প্রত্যেকেই আদৌ জনগণের পক্ষে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চায়। বামপন্থার নামে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার দিন যেমন শেষ হয়ে গেছে, একইভাবে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই বাদ দিয়ে ইসলামের নামে রাজতন্ত্র কায়েম কিংবা ধনীকে আরও ধনী ও গরিবকে আরও গরিব বানাবার রাজনীতির দিনও শেষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে গণশক্তি গঠনের প্রশ্ন তাই ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্র্রের মৌলিক বিচার সম্পন্ন না করে অগ্রসর হতে পারবে না। এককথায় বললে, আধুনিকতার ভিত্তিকে প্রশ্নের সম্মুখীন ও চ্যালেঞ্জ না করতে পারলে আমাদের এগিয়ে যাবার বিকল্প কোন পথ নাই।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ও ধর্ম বিভাজনের অনুমানগুলো বা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করবার যে ক্লাসিক্যাল সেকুলার প্রস্তাবনা, তার প্রেক্ষিত ইউরোপ। ইউরোপের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে অনৈতিহাসিকভাবে এই বিভাজনকে শাশ্বত ও অনিবার্য ধরে নেয়া ঐতিহাসিক অজ্ঞতা অবশ্যই। তাছাড়া এই অনুমানের বিস্তর রাজনৈতিক ও দার্শনিক সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের অবশ্যই সেসব সমস্যা নতুন করে বিচার করে দেখতে হবে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ইউরোপীয় সে্কুলারিজমের সঙ্গে বাংলাদেশের বামপন্থীদের ধর্মহীন রাজনীতি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রধারণার কোনো সম্পর্ক নাই। বিশেষত যখন ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রমাত্রই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেহেতু তার গাঠনিক ভিত্তি ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব নয়, বরং জনগণের ইচ্ছা বা সংকল্প। গণতন্ত্র কায়েমের কথা বলার পর বাড়তি ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তোলাকে অবশ্যই আমাদের সন্দেহ করতে হবে। সন্দেহ করতে হবে এই বলে যে সেকুলারিজমের নামের আড়ালে এটা মূলত ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ চর্চা। ইসলাম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি ছাড়া এই রাজনীতির অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

বলা বাহুল্য, গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরন, রাষ্ট্রের এই ধরনের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক অনুধাবনের অক্ষমতা একই সঙ্গে গণতন্ত্র সম্পর্কে অপরিচ্ছন্ন ধারণারও প্রমাণ। অর্থাৎ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মবিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বামপন্থীরা প্রায় কখনোই শ্রেণী,পুঁজি,সাম্রাজ্যবাদের জায়গা থেকে ধর্মীয় রাজনীতি বা আন্দোলনের বিচার করে না। একইভাবে ইসলামী আন্দোলনের দিক থেকে দেখা যায়, ইসলাম কায়েমের অর্থ পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তন নয়, এই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেই শরিয়া আইন কায়েম, ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবার কথা তাঁরা বলেন। ইসলামী আন্দোলনের এই সঙ্কীর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক লক্ষ্য মানুষের ইহলৌকিক সমস্যা ও সঙ্কটের কোনো সমাধান দিতে পারে না। ধর্ম, রাষ্ট্র ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে সেকুলার প্রস্তাবনা রাজনৈতিক এবং দার্শনিকভাবে যেমন সমস্যাজনক, তেমনি বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির প্রস্তাবনাও সমান মুশকিলের। বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে সব দিক থেকেই আমাদের মারাত্মক ঘাটতি আছে। ইউরোপীয় আধুনিকতা ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যে কোনো রাজনীতির জন্য ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের মৌলিক দার্শনিক বিচার সে কারণে জরুরি। ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে এখন পর্যন্ত সেকুলারিজমের সমালোচনা বা বিরোধিতা জালিম বিশ্বব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার আলোকে আমলে নিতে বিশেষ দেখা যায় না।  কথাবার্তায় অনেকে বলেন। কিন্তু এই জালিম ব্যবস্থাকে বুঝেসুঝে নীতি ও কৌশল নির্ণয়ে ব্যর্থতাই লক্ষণীয়। কৃষক শ্রমিকের লড়াইয়ে বা মজলুমের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ইসলামপন্থিরা উপস্থিত নাই বললেই চলে। অথচ রক্ত, বর্ণ, দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে দুনিয়ার সব মানুষকে এক করে জালিম বিশ্বব্যবস্থা উৎখাতের রাজনৈতিক আদর্শ বা বয়ান নির্মাণের  অপার সম্ভাবনা ইসলামে আছে। এটাই বরং ইসলামের মৌলিক প্রস্তাবনা। ইসলামের অন্তর্গত বিষয় হলেও নিজেদের আন্দোলনকে বিশ্বমানুষের মুক্তি বা বিশ্ব মানবসমাজ কায়েমের আন্দোলন হিসেবে না দেখে ইসলামপন্থীরা তাদের লড়াইকে শুধু অন্য সব ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতির বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই হিসেবে হাজির করে। ফলে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের ন্যায়সঙ্গত লড়াইও বহুলাংশে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হয়ে যায় । কার্যকর হয় না। তার বৈশ্বিক আবেদন হারিয়ে যায়। একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ের সীমার মধ্যে ইসলামি আন্দোলন আটকা পড়ে যায়। সেই সীমা অতিক্রম রাজনৈতিক লড়াই  লড়াই বৈশ্বিক ও সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহণ করে না। বাংলাদেশে এই দিকগুলো আরও সম্যকভাবে উপলব্ধি করা খুবই জরুরি।

এ কথাগুলোর সঙ্গে যদি আমরা একমত হতে পারি, তাহলে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তাই বলছিলাম, কমিউনিস্টদের দুর্দশা ও করুণ অবস্থা দেখে আমরা যেন ভুলপথে না হাঁটি।

... ... ...

১. মার্কসের যে উদ্ধৃতি দিয়েছি তা রুজের কাছে লেখা মার্কসের চিঠি : Early Writings by Karl Marx, Vintage 1975 বইটিতে পাবেন।

এই লেখাটি ‘বিশেষ নিবন্ধ হিসাবে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। চিন্তা ওয়েবে তুলে দেবার আগে কিছু পরিমার্জনা করে দুই কিস্তিতেই চিন্তা ওয়েবে পেশ করা হোল। এটা দ্বিতীয় কিস্তি। প্রথম কিস্তি এখানে দেখুন

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।